অথচ নিজে সঙ্গে যাইতে পারেন নাই, পথের দিকে চাহিয়া সারাদিন চুপ করিয়া বসিয়া ছিলেন। ইংরেজীতে যাহাকে বলে scene create করা, এই ছিল তাঁহার সবচেয়ে বড় ভয়। সর্বলোকের চক্ষু তাঁহাতে আকৃষ্ট হওয়ার কল্পনামাত্রেই তিনি সঙ্কুচিত হইয়া উঠেন। আজ এইটিই হইতেছে ভারতের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। গৃহে গৃহে যত দিন না এমনই সাধ্বী, এমনই লক্ষ্মী জন্মগ্রহণ করিবে, ততদিন দেশের মুক্তির আশা সুদূরপরাহত।
আজ চিত্তরঞ্জনের দীপ্তিতে বাঙ্গালার আকাশ ভাস্কর হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু দীপের যে অংশটা শিখা হইয়া লোকের চোখে পড়ে, তাহার জ্বলার ব্যাপারে কেবল সেইটুকুই তাহার সমস্ত ইতিহাস নহে। তাই মনে হয়, সন্ন্যাসী চিত্তরঞ্জনকে রিক্ত করিয়া লইতেও ভগবান যেমন দ্বিধা করেন নাই, যখন দিয়াছিলেন, তখন কৃপণতাও তেমনই করেন নাই।
অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির মিটিং উপলক্ষে কোথাও দূর-পাল্লায় যাইবার প্রয়োজন হইলেই আমার কেমন দুর্ভাগ্য, ঠিক পূর্বক্ষণেই আমার কিছু-না-কিছু একটা মস্ত অসুখ করিত। সেবার দিল্লী যাইবার আগের দিন দেশবন্ধু আমাকে ডাকিয়া কহিলেন, কাল আপনার সঙ্গে ঊর্মিলা যাবেন।
আমি বলিলাম, যে আজ্ঞা, তাই হবে।
দেশবন্ধু কহিলেন, হবে ত বটে, কিন্তু সন্ধ্যার পরে গাড়ি, কাল বিকাল নাগাদ আপনার অসুখ করবে বলে মনে হচ্ছে না ত?
আমি বলিলাম, স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে শত্রুপক্ষীয়রা আপনার কাছে আমার দুর্নাম রটনা করেছে।
তিনি কহিলেন, তা করেছে বটে, কিন্তু আপনি বিছানায় শোন, এরূপ সাক্ষ্যপ্রমাণও ত কৈ নেই!
আমার সেই ছেলেটির কথা মনে পড়িল। সে বেচারা বি. এ. পর্যন্ত পড়িয়াও চাকুরি পায় নাই। বড়বাবুর কাছে আবেদন করায় তিনি রাগিয়া বলিয়াছিলেন, যাকে চাকরি দিয়েছি, তার ক্যোয়ালিফিকেশন বেশি, সে বি. এ. ফেল।
প্রত্যুত্তরে ছেলেটি সবিনয়ে নিবেদন করিয়াছিল, আজ্ঞে, একজামিন দিলে কি আমি তার মত ফেল করতেও পারতাম না!
আমিও দেশবন্ধুকে বলিলাম, আমার যোগ্যতা অল্প, তারা আমাকে নিন্দা করে জানি, কিন্তু আমার শুয়ে থাকবার যোগ্যতাও নেই, এ অপবাদ আমি কিছুতেই নিঃশব্দে মেনে নিতে পারব না।
দেশবন্ধু সহাস্যে কহিলেন, না, আপনি রাগ করবেন না, আপনার সে যোগ্যতা তারা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করে।
গয়া কংগ্রেস হইতে ফিরিয়া আভ্যন্তরিক মতভেদ ও মনোমালিন্যে যখন চারিদিক আমাদের মেঘাচ্ছন্ন হইয়া উঠিল, এই বাঙ্গালাদেশে ইংরাজী বাঙ্গালা যতগুলি সংবাদপত্র আছে, প্রায় সকলেই কণ্ঠ মিলাইয়া সমস্বরে তাঁহার স্তবগান শুরু করিয়া দিল, তখন একাকী তাঁহাকে ভারতের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত যেমন করিয়া যুদ্ধ করিয়া বেড়াইতে দেখিয়াছি, জগতের ইতিহাসে বোধ করি, তাহার আর তুলনা নাই। একদিন জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, সংসারে কোন বিরুদ্ধ অবস্থাই কি আপনাকে দমাইতে পারে না? দেশবন্ধু একটুখানি হাসিয়া বলিয়াছিলেন, তা হলে কি আর রক্ষা ছিল? পরাধীনতার যে আগুন এই বুকের মাঝে অহর্নিশি জ্বলছে, সে ত এক মুহূর্তে আমাকে ভস্মসাৎ করে দিত।
প্রবন্ধ : স্বদেশ ও সাহিত্য Chapter : 1 Page: 23
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: কবিতার বিষয়
- Read Time: 1 min
- Hits: 256