ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

রাত্রি বোধ হয় একটা বাজিয়া গিয়াছে। তখনও ম্লান জ্যোৎস্না আকাশের গায়ে লাগিয়া আছে। পার্বতী বিছানার চাদরে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়া ধীরপদবিক্ষেপে সিঁড়ি বাহিয়া নীচে নামিয়া আসিল। চারিদিকে চাহিয়া দেখিল,—কেহ জাগিয়া নাই। তাহার পর দ্বার খুলিয়া নিঃশব্দে পথে আসিয়া উপস্থিত হইল। পাড়াগ্রামের পথ, একেবারে স্তব্ধ, একেবারে নির্জন—কাহারও সাক্ষাতের আশঙ্কা ছিল না। সে বিনা বাধায় জমিদারবাড়ির সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। দেউড়ির উপর বৃদ্ধ দরোয়ান কিষণ সিংহ খাটিয়া বিছাইয়া তখনও তুলসীদাসী রামায়ণ পড়িতেছিল; পার্বতীকে প্রবেশ করিতে দেখিয়া চোখ না তুলিয়াই কহিল, কে?

পার্বতী বলিল, আমি।

দ্বারবানজী কণ্ঠস্বরে বুঝিল স্ত্রীলোক। দাসী মনে করিয়া, সে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া, সুর করিয়া রামায়ণ পড়িতে লাগিল। পার্বতী চলিয়া গেল। গ্রীষ্মকাল; বাহিরে উঠানের উপর কয়েকজন ভৃত্য শয়ন করিয়াছিল; তাহাদের মধ্যে কেহ-বা নিদ্রিত, কেহ-বা অর্ধ-জাগরিত। তন্দ্রার ঘোরে কেহ-বা পার্বতীকে দেখিতে পাইল, কিন্তু দাসী ভাবিয়া কথা কহিল না। পার্বতী নির্বিঘ্নে ভিতরে প্রবেশ করিয়া সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিয়া গেল। এ বাটীর প্রতি কক্ষ, প্রতি গবাক্ষ তাহার পরিচিত। দেবদাসের ঘর চিনিয়া লইতে তাহার বিলম্ব হইল না। কপাট খোলা ছিল এবং ভিতরে প্রদীপ জ্বলিতেছিল। পার্বতী ভিতরে আসিয়া দেখিল, দেবদাস শয্যায় নিদ্রিত। শিয়রের কাছে কি একখানা বই তখনও খোলা পড়িয়াছিল—ভাবে বোধ হইল, সে এইমাত্র যেন ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। দীপ উজ্জ্বল করিয়া দিয়া সে দেবদাসের পায়ের কাছে আসিয়া নিঃশব্দে উপবেশন করিল। দেয়ালের গায়ে বড় ঘড়িটা শুধু টক্‌টক্‌ শব্দ করিতেছে, ইহা ভিন্ন সমস্ত নিস্তব্ধ, সমস্ত সুপ্ত।

পায়ের উপর হাত রাখিয়া পার্বতী ধীরে ধীরে ডাকিল, দেবদা!—

দেবদাস ঘুমের ঘোরে শুনিতে পাইল, কে যেন ডাকিতেছে। চোখ না চাহিয়া সাড়া দিল, উঁ—

ও দেবদা—

এবার দেবদাস চোখ রগড়াইয়া উঠিয়া বসিল। পার্বতীর মুখে আবরণ নাই, ঘরে দীপও উজ্জ্বলভাবে জ্বলিতেছে; সহজেই দেবদাস চিনিতে পারিল। কিন্তু প্রথমে যেন বিশ্বাস হইল না। তাহার পর কহিল, এ কি! পারু নাকি?

হাঁ, আমি।

দেবদাস ঘড়ির পানে চাহিয়া দেখিল। বিস্ময়ের উপর আরও বিস্ময় বাড়িল—কহিল, এত রাত্রে?

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়