জীবানন্দ। আচ্ছা, আমি চললাম অলকা।

[প্রস্থান

দ্বিতীয় দৃশ্য

চণ্ডীগড় গ্রাম—গাজনের সঙ

গীত (১)

বড় প্যাঁচে পড়েছে এবার ভোলা দিগম্বর।
অভিমানী উমারানী বলেনি তায় প্রাণেশ্বর॥
অনেকদিনের পরে এবার এল শ্বশুরবাড়ি।
ভেবেছিল আসবে গৌরী পরে পাটের শাড়ী॥
চাঁদ-বদনে কইবে কথা
ঘুচবে ভোলার প্রাণের ব্যথা
কোন কথা না বলে সে পালিয়ে এল ছেড়ে ঘর।
ভাবের ঘোরে ছিল অচেতন
ভেবে চিন্তে পেল নাকো হলো এ কেমন—
এবার শান্ত-শিষ্ট গৃহবাসী
করবে তোমায় হে সন্ন্যাসী
জটা বাকল ছাড়িয়ে নিয়ে সাজিয়ে দেবে প্রেমের বর॥

গীত (২)

বৌ নিতে এসেছে এবার আপনি মহেশ্বর।
তুই নাকি সই বলেছিলি
করবি না আর স্বামীর ঘর॥
পাঁচ বছরে করে পঞ্চতপা
তোর হাতে তোর মা-জননী সঁপেছেন ক্ষ্যাপা,
বাঁধতে যদি পারিস নি তায়,
তাই বলে কি হবে সে পর?
(তাই বলে পর হয়ে কি যায়)
একবার নাকি গিয়েছিল কুচুনী পাড়ায়
সত্যি কথা তোর কাছে সই যদিই সে ভাঁড়ায়।
ফেলার জিনিস নয় ত সে তোর বোন
ধুয়ে পুঁছে তুল গে যা তারে ঘর॥

তৃতীয় দৃশ্য

ষোড়শীর কুটীর

[নির্মলের প্রবেশ]

ষোড়শী। এ কি, এই রাত্রে শেষে অকস্মাৎ আপনি যে নিমর্লবাবু?

[নির্মল নিরুত্তর]

(হাসিয়া) ওঃ—বুঝেচি। যাবার পূর্বে লুকিয়ে বুঝি একবার দেখে যেতে এলেন?

নির্মল। আপনি কি অন্তর্যামী?

ষোড়শী। তা নইলে কি ভৈরবীগিরি করা যায় নির্মলবাবু? কিন্তু এখানটায় তেমন আলো নেই, আসুন, আমার ঘরের মধ্যে গিয়ে বসবেন চলুন।

নির্মল। রাত্রে একাকী আমাকে ঘরের মধ্যে নিয়ে যেতে চান, আপনার সাহস ত কম নয়?

ষোড়শী। আর সে-রাত্রে অন্ধকারে যখন হাত ধরে নদী পার করে এনেছিলাম তখনি কি ভয়ের লক্ষণ দেখতে পেয়েছিলেন নাকি? সেদিনও ত এমনি একাকী।

নির্মল। সত্যই আপনার সাহসের অবধি নেই।

ষোড়শী। অবধি থাকবে কি করে নির্মলবাবু, ভৈরবী যে! আসুন ঘরে।

নির্মল। না, ঘরে আর যাব না, আমাকে এখনি ফিরতে হবে।

ষোড়শী। তবে এইখানেই বসুন।

[উভয়ের উপবেশন]

ষোড়শী। আজ তা হলে চলে যাওয়াই স্থির?

নির্মল। না, আজ যাওয়া স্থগিত রইল। রাত্রে ফিরে গিয়ে শুনতে পেলাম আজ সন্ধ্যাবেলায় মন্দিরের মধ্যে আপনার বিচার হবে। সে সভায় আমি উপস্থিত থাকতে চাই।

ষোড়শী। কিসের জন্যে? নিছক কৌতূহল, না আমাকে রক্ষে করতে চান?

নির্মল। প্রাণপণে চেষ্টা করব বটে।

ষোড়শী। যদি ক্ষতি হয়, কষ্ট হয়, শ্বশুরের সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়, তবুও?

নির্মল। হাঁ, তবুও।

[ষোড়শী হাসিয়া ফেলিল]

(হাসিমুখে) আপনি হাসলেন যে বড়? বিশ্বাস হয় না?

ষোড়শী। হয়। কিন্তু হাসচি আর একটা কথা ভেবে। শুনি, আগেকার দিনে ভৈরবীরা নাকি বিদেশী মানুষদের ভেড়া বানিয়ে রাখত, আচ্ছা, ভেড়া নিয়ে তারা কি করত নির্মলবাবু? চরিয়ে বেড়াত, না লড়াই বাধিয়ে দিয়ে তামাশা দেখত? (বলিতে বলিতে ছেলেমানুষের মত উচ্ছ্বসিত হইয়া হাসিতে লাগিল)

নির্মল। (পরিহাসে যোগ দিয়া, নিজেও হাসিয়া) হয়ত বা মাঝে মাঝে মায়ের স্থানে বলি দিয়ে খেতো।

ষোড়শী। সে ত ভয়ের কথা নির্মলবাবু।

নির্মল। (সহাস্যে মাথা নাড়িয়া) ভয় একটু আছে বৈ কি!

ষোড়শী। একটু থাকা ভালো। হৈমকে সাবধান করে দেওয়া উচিত।

নির্মল। তার মানে?

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়