বিজয়া। আপনার বুঝি আর মেয়ে নেই?

দয়াল। মেয়েও নেই, ছেলেও নেই, শুধু বুড়ো-বুড়ী বেঁচে আছি। একটি ভাগনীকে মানুষ করেছিলুম, তার নাম নলিনী। কলেজের ছুটি হয়েছে বলে সেও আমার সঙ্গে এসেছে। একটু অসুস্থ নইলে—

[সহসা বিলাস প্রবেশ করিল]

বিলাস। (বিজয়ার প্রতি কঠিনভাবে) তাঁরা চলে গেলেন, তুমি একটা খোঁজ পর্যন্ত নিলে না? একে বলে কর্তব্যে অবহেলা। এ আমি অত্যন্ত অপছন্দ করি। (দয়ালের প্রতি ততোধিক কঠোরভাবে) আপনাকে বলেছিলুম ওঁদের সঙ্গে যেতে। না গিয়ে এখানে বসে গল্প করচেন কেন?

দয়াল। (অপ্রতিভভাবে) মা’র সঙ্গে দুটো কথা কইবার জন্যে—আচ্ছা, আমি তা হলে যাই এখন।

বিজয়া। না, আপনি বসুন। বেলা হয়ে গেছে, এখানে খেয়ে তবে যেতে পাবেন। (বিলাসের প্রতি) উনি সঙ্গে গেলে তাঁদের কি বেশী সুবিধে হতো?

বিলাস। তাঁদের দেখাশুনা করতে পারতেন।

বিজয়া। সে ওঁর কাজ নয়। তাঁদের মত দয়ালবাবুও আমার অতিথি।

বিলাস। না, ওঁকে অতিথি বলা চলে না। এখন উনি এস্টেটের অন্তর্ভুক্ত। ওঁকে মাইনে দিতে হবে।

বিজয়া। (ক্রোধে মুখ আরক্ত হইয়া উঠিল কিন্তু শান্ত-কঠিনকণ্ঠে কহিল) দয়ালবাবু আমাদের মন্দিরের আচার্য। ওঁর সে সম্মান ভুলে যাওয়া অত্যন্ত ক্ষোভের ব্যাপার বিলাসবাবু।

বিলাস। (কটুকণ্ঠে) সে সম্মানবোধ আমার আছে, তোমাকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না। কিন্তু দয়ালবাবু শুধু আচার্যই নন, ওঁর অন্য কাজও আছে। সে স্বীকার করেই উনি এসেছেন।

দয়াল। (ব্যস্তভাবে উঠিয়া দাঁড়াইয়া) মা, আমার অপরাধ হয়ে গেছে, আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।

বিজয়া। না, আপনি বসুন, আপনাকে খেয়ে যেতে হবে। আর মাইনে ত উনি দেন না, দিই আমি। আমার সঙ্গে দু’দণ্ড গল্প করাটাকে আমি যদি অকাজ না মনে করি, তবে বুঝতে হবে আপনার কর্তব্যে ত্রুটি হয়নি। বিলাসবাবুর কর্তব্যের ধারণা যাই কেন না হোক।

বিলাস। না, কর্তব্যের ধারণা আমাদের এক নয়। এবং তোমাকে বলতে আমি বাধ্য যে তোমার ধারণা ভুল।

বিজয়া। তা হলে সেই ভুল ধারণাটাই আমার এখানে চলবে বিলাসবাবু।

বিলাস। তোমার ভুলটাকেই আমায় স্বীকার করে নিতে হবে নাকি?

বিজয়া। স্বীকার করে নিতে ত আমি বলিনি, আমি বলেচি সেইটেই এখানে চলবে।

বিলাস। তুমি জানো এতে আমার অসম্মান হয়।

বিজয়া। (অল্প হাসিয়া) সম্মানটা কি কেবল একলা আপনার দিকেই থাকবে নাকি?

দয়াল। (ব্যস্তভাবে উঠিয়া দাঁড়াইয়া) মা, এখন আমি যাই, দেখি গে তাঁদের কোন অসুবিধা হচ্ছে নাকি।

বিজয়া। না, সে হবে না। আমাদের গল্প এখনও শেষ হয়নি। আপনি বসুন।(একটু উচ্চকণ্ঠে) কালীপদ!

কালীপদ। (দ্বারের কাছে মুখ বাড়াইয়া সাড়া দিল) কি মা?

বিজয়া। পরেশের মাকে বলো গে দয়ালবাবু এখানে খাবেন। আমার শোবার ঘরের বারান্দায় তাঁর ঠাঁই করে দিতে বলে দাও। চলুন দয়ালবাবু, আমরা ওপরে গিয়ে বসি গে।

[বিজয়া ও তাহার পিছনে দয়ালবাবু সভয়-মন্থরপদে প্রস্থান করিলেন। বিলাস সেইদিকে
ক্ষণকাল আরক্তনেত্রে চাহিয়া বাহির হইয়া গেল]

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়