রাস। না, কোন কিন্তু নয় বাবা, সে আমি শুনব না। ভাল কথা, কলকাতাতেই কি এখন থাকা হবে? একটু সুবিধে-টুবিধে—

নরেন। আজ্ঞে হাঁ। একটা বিলিতী ওষুধের দোকানে সামান্য একটা কাজ পেয়েছি।

রাস। বেশ, বেশ, ওষুধের দোকানে কাঁচা পয়সা! টিকে থাকতে পারলে আখেরে গুছিয়ে নিতে পারবে নরেন।

নরেন। আজ্ঞে।

রাস। তা হলে মাইনেটা কি রকম?

নরেন। পরে কিছু বেশী দিতে পারে। এখন চারশো টাকা মাত্র দেয়।

রাস। (বিবর্ণমুখে চোখ কপালে তুলিয়া) চারশো! আহা বেশ—বেশ! শুনে বড় সুখী হলুম।

নরেন। সেই পরেশ ছেলেটি কেমন আছে বলতে পারেন?

রাস। তাকে একটু আগেই তাদের গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

নরেন। গ্রামটা কি দূরে?

রাস। তা জানিনে বাবা।

নরেন। (ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া) তা হলে আর উপায় কি। সে কথা যাক, কিন্তু আমার হয়ে বিলাসবাবুকে আপনি একটা কথা জানাবেন। বলবেন—প্রবল জ্বরে মানুষের আবেগ নিতান্ত সামান্য কারণে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে পারে। বিজয়ার সম্বন্ধে ডাক্তারের মুখের এই কথাটা তিনি যেন অবিশ্বাস না করেন।

রাস। অবিশ্বাস করবে কি নরেন, এ কি আমরা জানিনে? বাপ হয়ে এ কথা বলতে আমার মুখে বাধে, কিন্তু তুমি আপনার জন বলেই বলি, দুজনের কি গভীর ভালবাসার চিহ্নই যে মাঝে মাঝে আমার চোখে পড়ে সে প্রকাশ করিবার আমার ভাষা নেই। মনে হয় ভগবান যেন সঙ্কল্প করেই পরস্পরের জন্যে এদের সৃজন করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। তাঁকে প্রণাম করি, আর ভাবি সার্থক এদের মিলন, সার্থক এদের জীবন।

নরেন। এই বৈশাখেই বুঝি এঁদের বিবাহ হবে?

রাস। হাঁ নরেন। সেদিন কিন্তু তোমাকে আসতে হবে, উপস্থিত থেকে নব-দম্পতিকে আশীর্বাদ করতে হবে। তাড়াতাড়ি করার আমার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু সকলেই পুনঃ পুনঃ বলচেন অন্তরের আত্মা যাঁদের এমন করে এক হয়েছে বাইরে তাদের পৃথক করে রাখা অপরাধ। আমি বললুম, তাই হোক। তোমাদের সকলের ইচ্ছেই আমার ভগবানের ইচ্ছে। এই বৈশাখেই এক হয়ে এরা সংসার-সমুদ্রে জীবন-তরণী ভাসাক। জগদীশ্বর! আমার দিন শেষ হয়েছে, কিন্তু তুমি এদের দেখো—তোমার চরণেই এদের সমর্পণ করলুম। (যুক্তকর ললাটে স্পর্শ করিয়া হেঁট হইয়া তিনি প্রণাম করিলেন) কিন্তু তোমার যে রাত হয়ে যাচ্ছে বাবা, আজই কি কলকাতায় ফিরে না গেলেই নয়?

নরেন। না আমাকে যেতেই হবে। সাড়ে-আটটার ট্রেনেই যাব।

রাস। জিদ করতে পারিনে নরেন, নতুন চাকরি, কামাই হওয়া ভাল নয়—মনিব রাগ করতে পারে। আজকের দিনটাও ত তোমার বৃথায় নষ্ট হ’লো। কিন্তু কি জন্যে আজ এসেছিলে বাবা, জিজ্ঞাসা করতে পারি কি?

নরেন। দিনটা নষ্ট হলো সত্যি, কিন্তু সকালে এসেছিলুম এই আশা করে যদি টাকাটা দিয়ে সেই মাইক্রস্‌কোপটা ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারি।

রাস। টাকাটা দিয়ে? বেশ ত, বেশ ত—নিয়ে গেলে না কেন?

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়