আষাঢ় মাস। জলবায়ুর নিয়মকানুন পাল্টে গেছে। এক ফোঁটা বৃষ্টি নেই। সারাদিন ঝাঁঝা রোদ থাকে। রাতে ভ্যাপসা গরম। জীবন অতিষ্ঠ।

আজ এই প্রথম বৃষ্টি-বৃষ্টি ভাব দেখা দিয়েছে। আকাশ মেঘূলা। রাজ্যের ব্যাঙ গলা ফুলিয়ে ডাকাডাকি করছে।–তাদের উৎসাহ দেখে মনে হয় বৃষ্টি নামতে দেরি নেই।

মিসির আলি কমলাপুরে তাঁর ভাগীর বাড়িতে যাবেন বলে তৈরি হয়ে বসে আছেন। ব্যাঙের ডাক শুনে বেরুতে ভরসা পাচ্ছেন না। সঙ্গে ছাতা নেই।–বৃষ্টি নামলে যন্ত্রণার মধ্যে পড়তে হবে। r

অবশ্যি বৃষ্টি যে হবেই, এ-রকম মনে করারও কোনো কারণ নেই। নিম্নশ্রেণীর কীট-পতঙ্গ আবহাওয়ার খোঁজখবর ভালো রাখলেও আজকাল তারাও ভুল করছে।

তবে আজ বোধহয় ভুল করে নি। আকাশ ক্রমেই কালিবৰ্ণ হচ্ছে। বাতাস ছাড়তে শুরু করেছে। একমাত্র ভয়, বাতাস বোধহয় মেঘ উড়িয়ে নিয়ে যাবে।

স্যার, আসব?

মিসির আলি চমকে তাকালেন। মুনির এসেছে। নিঃশব্দে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। তার চেহারার কোনো পরিবর্তন হয় নি। তবে খানিকটা রোগ হয়েছে। চুল ছোট-ছোট করে ছাঁটা। চোখের নিচে কালি পড়েছে। ঘুমের অসুবিধা হলে এ-রকম হয়। ছেলেটি আবার বলল, স্যার, আসব?

এসেই তো পড়েছি, আবার জিজ্ঞেস করছি কেন?

আমাকে চিনতে পারছেন?

না পারার তো কোনো কারণ দেখছি না। তোমার নাম মুনির। ডাকনাম টুনু। তোমার ছোট বোনের নাম লুটু, ভালো নাম ফুলেশ্বরী।

মুনির হেসে ফেলল। মিসির আলি বললেন, আমি ধরে নিয়েছিলাম তুমি আর আসবে না। প্রথম এসেছিলে চৈত্র মাসের কুড়ি তারিখে, আজ আষাঢ়ের তৃতীয় দিন। মাঝখানে কটা মাস চলে গেছে।

মুনির জবাব দিল না। টেবিলের উপর সিগারেটের প্যাকেটটা রাখল। আজও সে বিদেশি এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে এসেছে। মিসির আলি প্যাকেট খুলে সিগারেট ধরালেন। সিগারেট কেন আনা হল? কী প্রয়োজন ছিল এ-জাতীয় কথাবার্তায় গেলেন না। তাঁর ভঙ্গি দেখে মনে হল এতক্ষণ তিনি মুনিরের জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন।

আজও অন্ধকারে কথা বলবে, না বাতি জ্বালানো থাকবে?

বাতি থাকুক।

এতদিন আস নি কেন?

ইচ্ছে হয় নি।

আজ আবার ইচ্ছে হল?

জ্বি স্যার।

খুব ভালো। চা খাবে?

জ্বি-না।

শুরু করে তাহলে।

ছেলেটিকে আজ বেশ সুন্দর লাগছে। কেন লাগছে, তা মিসির আলি ধরতে চেষ্টা করছেন। পারছেন না। ফ্লানেলের শার্টের বদলে আজ তার গায়ে হালকা নীল রঙের একটা হাওয়াই শার্ট। শার্টটায় ছেলেটিকে খুব মানিয়েছে। এবং যে-কোনো কারণেই হোক, আজ তার মধ্যে দ্বিধার ভাব একেবারেই নেই। আচার-আচরণ অত্যন্ত সহজ।

মুনির।

জ্বি!

বসে আছ কেন? আরম্ভ কর।

সঙ্গে-সঙ্গে শুরু করল না। প্রথম দিনের মতো মাথা নিচু করে বসে রইল। মিসির আলি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ছেলেটির মধ্যে দ্বিধার কোনো ভাব নেই, তবু সে দেরি করছে। তার বক্তব্য হয়তো গুছিয়ে নিচ্ছে। এর অর্থ একটাই। ছেলেটির বক্তব্য খুব জোরাল নয়। গুছিয়ে নেবার প্রয়োজন আছে।

মুনির নিচু গলায় কথা বলা শুরু করল।

প্রথম রাতে আপনাকে আমার বাবার মৃত্যুর কথা বলেছি। সেটা বার বছর আগেকার কথা। এইবার বছরে অনেক কিছুই হল। বাবার সংসার পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেল। বাবার মৃত্যুর পর দেখা গেল, তাঁর প্রচুর দেন। যে—জমির উপর বাড়ি বানিয়েছিলেন, সেই জমির দামও তিনি পুরো দেন নি।

আমাদের আত্মীয়স্বজনরা প্ৰথম দিকে আমাদের দেখাশোনার জন্যে অতিরিক্ত রকমের ব্যস্ততা দেখালেন। ফুলেশ্বরীর বিয়ে দিয়ে দিলেন মাত্র তের বছর বয়সে। যুক্তি বীর সংসারের দায়-দায়িত্ব কাঁধে নেবে। ঝড়ঝাণ্টা সামাল দেবে।

ফুলেশ্বরী খুব কাঁদল। কেউ তার কোনো কথা শুনল না। এক ধনী ব্যবসায়ীর অপদাৰ্থ জড়বুদ্ধি ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে হল।

মুনির দম নেবার জন্যে থামতেই মিসির আলি বললেন, তোমার মার প্রসঙ্গে তো তুমি কিছু বলছ না। উনি কি দ্বিতীয়বার বিবাহ করেছিলেন?

জ্বি-না। বাবার মৃত্যুর দু বছরের মাথায় মা মারা যান।

ও, আচ্ছা।

আপনি মারি দ্বিতীয় বার বিয়ের কথা কোন জিজ্ঞেস করলেন??

এম্নি জিজ্ঞেস করছি। কোনো কারণ নেই।

বলেই মিসির আলি একটু লজ্জা পেলেন। কারণ ছাড়া এই পৃথিবীতে কিছুই ঘটে না। অথচ তিনি কারণের ব্যাপারটি অস্বীকার করলেন।

তারপর কি হল বল।

এই সময় আমার বাড়ি-পালোনর রোগ হল। টাকা পয়সা কিছু জোগাড় করতে পারলেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতাম। টাকা পয়সা শেষ হলে আবার ফিরে আসতাম।…

বাড়ি-পালোনর কারণে নানান ধরনের মানুষের সঙ্গে মেশবার আমার সুযোগ হয়েছে। কিছু-কিছু অভিজ্ঞতা খুবই সুন্দর, আবার কিছু অভিজ্ঞতা ভয়ংকর কুৎসিত। কিছুদিন একটা যাত্ৰাদলের সঙ্গে ছিলাম। আমার চেহারা তখন খুব সুন্দর ছিল। এই চেহারা সঙ্কল করে একটি নারী-চরিত্রে অভিনয় করতাম, যদিও সেই যাত্ৰাদলে অনেকগুলি মেয়ে ছিল অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার-মেয়েদের সাজপোশাক পরা আমার অভ্যাস হয়ে গেল। যখন অভিনয় থাকত না, তখনও শাড়ি-ব্লাউজ পরে থাকতাম। ঠোঁটে লিপস্টিক দিতাম। রাতে ঘুমুতাম ঐ মেয়েগুলির সঙ্গে এক ঘরে। তাতে ঐ মেয়ের বেশ মজা পেত। …

যাত্ৰাদলের পুরুষদের অনেকেই এইসব মেয়েদের সঙ্গে রাত্রিযাপন করত। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ওরা আমাকেও কামনা করত।

তুমি ক দিন ছিলে ওদের সঙ্গে?

প্রায় দু বছর।

চলে এলে কেন?

একটা ভুল তো মানুষ দীর্ঘদিন করতে পারে না। এক সময়-না-এক সময় তার জ্ঞান হয়। সে বুঝতে পারে।

তা ঠিক। তারপর বল।

ভূমিকা আমি প্রায় শেষ করে এনেছি। এখন আমি বর্তমান অবস্থাটা একটু বলেই কি জন্যে আপনার কাছে এসেছি তা বলব।…

আমি আগেই আপনাকে বলেছিলাম যে ইস্টার্ন মার্কেন্টিাইলে টাইপিষ্টের চাকরি করি। থাকি একটা বাসায়। বিনিময়ে এদের কিছু কাজকর্ম করে দিই। ওদের ছোট বাচ্চাদের রাতের বেলা পড়াই। থাকা এবং খাওয়া আমার এইভাবেই চলে। ঘুমাই তিনতলার একটি খুপরি ঘরে। তিনতলা পুরোপুরি তৈরি হয় নি। দুটো ঘর ওঠার পর বাড়িওয়ালা কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। ঘর দুটোতে ছাদ নেই। কারণ পুরোটা তৈরি হলে ছাদ ঢালাই হবে। উপরে টিন দিয়ে ছাদের কাজ চলছে। একটি ঘরে আমি থাকি, অন্য ঘরটিতে বাড়ি তৈরির সরঞ্জাম, সিমেন্টের কস্তা, রড এইসব। এই ঘরটি থাকে তালাবন্ধ। …

ছাদের ঘর দুটোতে বাথরুমের কোনো ব্যবস্থা নেই। কাজেই বাথরুমের প্রয়োজন হলে আমাকে যেতে হয় একতলার সার্ভেন্টস বাথরুমে। ঐ বাড়িতে এই সামান্য সমস্যা ছাড়া অন্য কোনো সমস্যা আমার ছিল না। বলা যেতে পারে আমি খুব সুখেই ছিলাম। …

বেতনের টাকার কিছুটা জমাই, কিছু পাঠাই আমার বোন ফুলেশ্বরীকে বিএ ক্লাসের বইপত্র জোগাড় করেছি। এখন একটা কলেজে নাম লিখিয়েছি, যেখানে ক্লাস না করলে অসুবিধা হবে না। যথাসময়ে বিএ পরীক্ষাথী হিসেবে নিয়মিত পরীক্ষায় বসা যাবে।

তুমি তা হলে আইএ পর্যন্ত পড়াশোনা করেছ?

জ্বি স্যার। যাত্ৰাদল থেকে বের হয়ে এসে আমার বড়চাচার বাড়িতে চলে যাই। ম্যাট্রিক এবং আইএ তাঁর কাছে থেকেই পাস করি। উনি খুবই দরিদ্র মানুষ। আমাকে আর পড়ানর সামর্থ্য তাঁর ছিল না।

তোমার রেজান্ট কেমন হয়েছিল?

খুবই ভালো। চারটা লেটার নিয়ে ম্যাট্রিক পাস করি। আইএতে মেরিট স্কলারশিপ পাই। ইষ্টার্ন মার্কেস্টাইলে আমার চাকরি হয় আমার রেজান্টের জন্যে। তখন আমি মুহাম্মানতাম না। অথচ আমাকে টাইপিঠের গোটে দেয়া হয়। অন্য গোট খালি ছিল না।

তারপর বল।

মুনির চুপ করে রইল। মিসির আলি বললেন, একটা ইন্টারভ্যাল হলে কেমন হয়। এস, এক কাপ চ খেয়ে তারপর শুরু করি।

জ্বি আচ্ছা।

চায়ের সঙ্গে আর কিছু খাবে? ভালো কেক আছে।

আমি শুধু চা-ই খাব। মিসির আলি চা নিয়ে এসে দেখলেন ঘরের বাতি নেভান। মুনির অন্ধকারে বসে আছে। মিসির আলি কিছু বললেন না। চায়ের কাপ এগিয়ে দিলেন।

মুনির নিঃশব্দে চায়ের কাপ শেষ করে কথা বলতে শুরু করল—

ঘটনাটা ঘটল এক বছর আগে ভাদ্র মাসে। আমার অনিদ্রা রোগ আছে, বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুমুতে পারি না। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে হয়। যে-রাতের কথা বলছি, সে-রাতে অসহ্য গরম পড়েছিল। আমি অনেকক্ষণ ছাদে হাঁটাহাঁটি করলাম। ছাদও তেতে আছে। এক ফোঁটা বাতাস নেই। একটা ভেজা গামছা গায়ে জড়িয়ে রাত একটা পর্যন্ত ছাদের রেলিং-এ বসে রইলাম। তখন একটু ঝিমুনির মতো ধরল। বিছানায় এসে শুয়েছি। হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করছি, হঠাৎ পাশের ঘরে শব্দ হতে লাগল। আমি বেশ অবাকাই হলাম, কারণ পাশের ঘর তালাবন্ধ। আমার ঘর থেকে পাশের ঘরে যাওয়ার একটি দরজা আছে, কিন্তু সেই দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। প্রথম ভাবলাম ইঁদুর কিংবা বেড়াল। কিন্তু শব্দ শুনে মনে হচ্ছে না–ইঁদুর-বেড়ালের শব্দ। যেন অনেক মানুষ ঘরের মধ্যে আটক। তাদের ফিসফাস কথা কিছু-কিছু শোনা যাচ্ছে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। মৃদু হাসিও শুনলাম। যেন অনেকে দরজায় আড়ি পেতেছে। দরজার ফাঁক দিয়ে আমাকে দেখছে। আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। আমি বললাম— কে? সঙ্গে-সঙ্গে সব শব্দ থেমে গেল। চারদিক আগের মতো নীরব। আমি উঠে বসলাম। ঘর অন্ধকার। আমি কৌতূহল মেটাবার জন্যেই পাশের ঘরের দরজায় হাত রাখলাম। দরজা খুলে গেল। ঘরের ভেতরে আবছা আলো! সেই আলোয় ঝাপসাভাবে সবকিছু চোখে পড়ে, আবার অনেক কিছু চোখেও পড়ে না। আমি ঘরের ভেতর ঢুকলাম, তখনি নিচে নোমর একটা সিঁড়ি চোখে পড়ল। খুবই অস্বাভাবিক ব্যাপার, ঘরের ভেতর সিঁড়ি আসবে কেন। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আমি পরিষ্কার কিছু চিন্তা করতে পারছি না। সব কেমন জট পাকিয়ে গেছে। যেমন আমি একটা ঘোরের মধ্যে আছি। গা কাঁপিয়ে প্রচণ্ড জ্বর আসার আগে যেমন ঘোর লেগে থাকে, ঠিক সে-রকম। নিজেই বুঝতে পারছি না যে, আমি সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করে দিয়েছি। সব-শেষ সিঁড়িটা পার হবার পর আমার ঘোর কেটে গেল। আমি পুরোপুরি এক জন সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষ। তবে এই সময়ের মধ্যে কিছু একটা ঘটে গেছে, কারণ আমি আর সেই আমি নই। আমি ঢাকা শহরেও নেই! আমি আছি আমাদের নেত্রকোণার ঐ বাড়িটিতে। সবে স্কুল থেকে ফিরছি। ফুলেশ্বরী আমাকে বলছে, টুনু, বাবার শরীর খুব খারাপ। কোর্ট থেকে সকাল-সকল চলে এসেছেন। বাবার পেটে ব্যথা।…

আমার গা ঝিনঝন করতে লাগল। চোখের সামনে যে-দৃশ্য দেখছি–সে দৃশ্য আমার অতীত জীবনের। আবার তা ফিরে এসেছে কী করে? তাহলে কি আমার বয়সী। বাড়ে নি? এতদিন যা ঘটেছে সবই কল্পনা কিংবা দীর্ঘ কোনো স্বপ্ন।…

আমি শোবার ঘরে উঁকি দিলাম। বাবা রেলিং- দেয়া খাটে শুয়ে আছেন, মশারি ফেলা। মা বসে আছেন। বাবার মাথার পাশে।•…

ইদরিস চাচা পানের বাটা হাতে বসে আছেন। আমি অবাক হয়ে দৃশ্যটি দেখছি। কারণ এরপর কি হবে। আমি জানি। ইদারিস চাচা বলবেন, পেটের নিচে বালিশ দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে থাক। এটা হচ্ছে অম্বলের ব্যথা। নিবারণকে খবর দিয়েছি, এসেই ব্যথা নামিয়ে ফেলবে। …

সত্যি-সত্যি ইদারিস চাচা এই কথাগুলিই বললেন। আমি চমকে উঠলাম। পরবর্তী প্রতিটি ঘটনা কি হবে। আমি জানি। আমি যেহেতু জানি, সেহেতু এই ঘটনাগুলি ঘটতে দেয়া যাবে না। নিবারণ কাকু আসবার আগেই নিয়ে আসতে হবে সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার সাহেবকে, যেন তিনি আজ কিছুতেই রাত দশটার টেনে ময়মনসিং যেতে না পারেন।…

আমি কাউকে কিছু না বলে সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার সাহেবের বাসার দিকে ছুটিলাম। ডাক্তার সাহেবকে বাবার অসুখের কথা বলাতেই তিনি সঙ্গে-সঙ্গে এলেন। বাসায় এসে দেখি নিবারণ কাকু এসেছেন। হামানদিস্তায় কিছু যেন গুড়ো করা হচ্ছে। …

ডাক্তার সাহেবকে দেখে বাবা অবাক হয়ে বললেন, আপনাকে আবার কে খবর দিল?…

আপনার ছেলে। বাবার অসুখের কথা বলতে-বলতে ছেলের চোখে দেখি পানি। আপনার ছেলে বোধহয় আপনাকে খুব ভালোবাসে। দেখি, আপনার পেটটা দেখি।…

কিছু দেখতে হবে না। বদহজম থেকে হয়েছে। নিবারণদা এসেছেন, অষুধ তৈরি হচ্ছে। খাওয়ামাত্র আরাম না হলে নিবারণদা নাকি তার কবিরাজী ছেড়ে দেবেন।ডাক্তার সাহেব বাবার কথায় কোনোই কান দিলেন না। টিপেটুপে বাবার পেট দেখলেন। অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বললেন, আপনার অ্যাপেণ্ডিসাইটিস তো পেকে। টসটস করছে। এক্ষণি কেটে ফেলতে হবে।…

বাবা অবাক হয়ে বললেন, কি বলছেন এ-সব।

যেটা সত্যি সেটাই বলছি। আশা করি আপনি বেঁচে থাকতে চান? বেঁচে থাকতে না চাইলে ভিন্ন কথা।…

সত্যি বলছেন অ্যাপেণ্ডিসাইটিস?…

হ্যাঁ, সত্যি। রাত দশটার ট্রেনে ময়মনসিং যাবার কথা ছিল, সেটা আর হতে দিলেন না। …

ডাক্তার সাহেব খসখস করে একটা কাগজে কী সব লিখলেন। আমার দিকে কাগজটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, খোকা তুমি এই চিঠিটা ডাক্তার মিহিরবাবুকে দিয়ে এস। তাঁরও হেল্প লাগবে। মিহিরবাবুর বাসা চেন তো? মেয়েদের স্কুলের সামনে একতলা বাড়ি। যাও ছুটে যাও! এই তো গুড বয়!…

আমি কাগজ হাতে নিয়ে উল্কার মতো ছুটুলাম। ঘর থেকে বেরুতেই কিসের সঙ্গে যেন ধাক্কা খেলাম। মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। মুহূর্তের জন্যে চারদিক অন্ধকার। অন্ধকার কিছুটা কাটতেই দেখি আমি আবার আগের জায়গায় ঢাকা শহরের তিনতলার আমার ছোট্ট খুপরিতে। ভাদ্র মাসের অসহ্য গরমে আমার গা ঘামছে। ঘর অন্ধকার হলেও রাস্তার কিছু আলো এসেছে। সেই আলোয় দেখলাম পাশের ঘরের দরজা আগের মতোই বন্ধ।

মুনির চুপ করল। মিসির আলি সিগারেট ধরাতে-ধরাতে বললেন, এটাই তোমার সেই বিশেষ কথা?

জ্বি স্যার।

আর কিছু বলতে চাও না?

আর কিছু বলার নেই।

তুমি যা দেখেছ, তার ব্যাখ্যা কি খুবই সহজ নয়?

জ্বি, সহজ। আমি স্বপ্ন দেখছিলাম।

হ্যাঁ—স্বপ্ন।

স্বপ্নের স্থায়িত্বকাল খুব অল্প হয়। কিন্তু অল্প সময়েই অনেক কিছু বলে। আইনষ্টাইনের টাইম ডাইলেশনের ব্যাপার। থিওরি অব রিলেটিভিটির অন্য এক ধরনের প্রয়োগ। তাই না?

হতে পারে, থিওরি অব রিলেটিভিটি আমার জানা নেই।

আমিও জানি না। ভাসা-ভাসা যা শুনি তাই বললাম।

তুমি যে-স্বপ্ন দেখেছ এটা হচ্ছে এক ধরনের ইচ্ছাপূরণ স্বপ্ন। তোমার অবচেতন মনে আছে তোমার বাবাকে বাঁচিয়ে তোলবার আকাষ্ঠীক্ষা। অবচেতন মনের ইচ্ছগুলিও স্বপ্নে ধরা দিয়েছে। সব সময় তা হয়। এ-জীবনে যে-সব জিনিস আমরা পাই না, অথচ যে-সব জিনিসের জন্যে গভীর কামনা বোধ করি।–স্বপ্নে তাদের পাই। তাই না?

জ্বি স্যার, তাই।

বলেই মুনির উঠে দাঁড়াল।

রাত হয়ে গেছে, আজ উঠি স্যার!

মিসির আলি লক্ষ করলেন, মুনিরের মুখ থমথম করছে। চোখের দৃষ্টি অন্য রকম। যেন এই মুহূর্তে সে কোনো-একটা ঘোরের মধ্যে আছে।

মুনির।

জ্বি।

তোমার বোধহয় আরো কিছু বলার ছিল। শুধু স্বপ্নের কথা বলার জন্যে আমার কাছে আস নি।

মুনির শীতল গলায় বলল, আপনি ঠিকই ধরেছেন। এতটা নির্বোধ আমি না। সামান্য একটা স্বপ্ন নিয়ে আপনাকে বিরক্ত করব কেন?

বল সেটা কি?

আপনাকে তো বলেছি। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার সাহেব আমার হাতে একটা চিঠি লিখেদিলেন মিহির বাবুর কাছে পৌঁছে দেবার জন্যে। ঐ চিঠি নিয়ে বেরুবার সময় আমি ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাই।

হ্যাঁ, তখন তোমার স্বপ্ন ভেঙে যায়।

জ্বি স্যার। এবং আমি দেখি চিঠিটা আমার হাতে তখনো আছে।

কী বলছি তুমি!

আমি চিঠিটা আপনার জন্যে নিয়ে এসেছি।

মিসির আলি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। মুনির চিঠিটা টেবিলের উপর রাখল। মৃদু স্বরে বলল, রাত হয়ে যাচ্ছে, আমি যাই।

তুমি যে কত বড় একটা অসম্ভব কথা বলছ, তা কি তুমি জান?

জানি স্যার।

মুনির বেরিয়ে গেল। মিসির আলি চিঠি হাতে নিলেন। তাঁর কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম।

ছেলেটি যা বলছে, সবই কি বিশ্বাসযোগ্য? নিশ্চয়ই না! সে চমৎকার গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পারে। ইস্টার্ন মার্কেস্টাইলে চাকরির ব্যাপারটা মিথ্যা। তিনি খোঁজ নিয়েছেন। এই মিথ্যাটা সে হয়তো নিজেকে আড়াল করবার জন্যে বলছে। মূল ঘটনা হয়তো সত্যি। কিন্তু তা কী করে হয়!

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ