আজ ভোরের বেলায় ঘুম ভেঙে গেল গৌরবের। মুখ ঘুরিয়ে জানলার দিকে তাকাতেই মনে হলো চমৎকার একটা দিন শুরু হতে যাচ্ছে। সে চটপট বিছানা ছেড়ে জানলার পাশে এসে দাঁড়াতেই নির্মেঘ আকাশ দেখতে পেল। সূর্যদেব সবে উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করেছেন। ঠিক এই সময় সে কাশির শব্দ পেল। চাপা কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী। সে সঙ্গে সঙ্গে বাথরুমের দিকে তাকাল। খুব সন্তর্পণে বাথরুমে ঢুকে দেওয়ালের গা-ঘেঁষে দাঁড়াতেই ওপাশে কাশির শব্দ তীব্রতর হলো। মা। এরকম কাশি কোনো সুস্থ মানুষ কাশতে পারেন না।

কিছুক্ষণ বাদে কল খোলার শব্দ এল। জল পড়ছে। দীর্ঘক্ষণ। তারপর সব চুপচাপ। গৌরব কী করবে বুঝতে পারছিল না। মাকে প্রশ্ন করলে সে কোনো জবাব পায় না। যেন কিছুই হয় নি এমন ভঙ্গি করে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান তিনি। আজ গৌরবের মনে হলো একটা হেস্তনেস্ত করা দরকার। বনিকে জিজ্ঞাসা করা হয়নি। সে ঠাকুমার কাছে শোয়। ওকে দিয়েই শুরু করতে হবে।

দাঁত মেজে পরিষ্কার হয়ে বাইরে বেরিয়ে সে দেখল ব্যালকনিতে সরলা বসে আছেন চুপচাপ। এই ভোরেও তার বসার ভঙ্গিতে একটা ক্লান্তির ছাপ। বসে আছেন মাথাটা হেলিয়ে, তাকিয়ে আছেন গাছপালার মাথা ছাড়িয়ে। এমন কি তিনি গৌরবের পায়ের শব্দও পেলেন না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখল গৌরব। তার মনে হলো এই মুহূর্তে মাকে বিরক্ত করা অত্যন্ত অন্যায় হবে। সে পা টিপে মায়ের ঘরে ঢুকে পড়ল। বনি এখনও শুয়ে আছে কিন্তু তার চোখ খোলা। গৌরবের দেখা পেয়ে সে অবাক হয়ে উঠে বসতে যাচ্ছিল কিন্তু গৌরব তাকে ঠোঁটে আঙুল চেপে কথা বলতে নিষেধ করল। কাছে গিয়ে চাপা গলায় বলল, ব্রাশ করে আমার ঘরে চলে আয় চুপচাপ, কথা আছে। বনি রহস্যের গন্ধ পেয়ে উৎসাহিত হলো। গৌরব যেভাবে এসেছিল সেইভাবেই বারান্দায় পৌঁছে দেখল মায়ের বসার ভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হয়নি।

কিছুক্ষণ বাদে বনি ঘরে ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে কাকু?

 তুই এখানে বস। মা তোকে দ্যাখেনি তো?

না ঠাকুমা মনে হলো চেয়ারে বসে ঘুমাচ্ছে। কাল সারারাত ঘুমোয়নি তো!

কেন? কী হয়েছিল?

কি জানি!

মা খুব কাশছে আজকাল?

হ্যাঁ কাকু, খুব। কাশতে কাশতে বেঁকে যায়। যখন সামলাতে পারে না তখন বাথরুমে ছুটে যায়। কি যন্ত্রণা যে হয় তখন কি বলব!

কাউকে একথা বলিসনি কেন?

ঠাকুমা কাউকে বলতে মানা করেছিল।

 কবে থেকে হচ্ছে? অনেকদিন।

গৌরব এবার সত্যি চিন্তায় পড়ল, ঠিক আছে, তুই যা।

কী বলবে বলে ডাকলে, বললে না তো! বনি বেশ অবাক হলো।

 এখন নয়। পরে বলব।

ব্রেকফাস্টে বসার আগে গৌরব সৌরভের ঘরে গিয়ে দেখল সে শুয়ে শুয়ে কাগজ পড়ছে। দেখামাত্র সৌরভ বলল, আয়। কী খবর?

অফিসে যাবে না?

নাঃ। সকাল থেকে খুব আলসেমি লাগছে। কাজও নেই তেমন।

তোমার সঙ্গে কথা ছিল। গৌরব চেয়ারে বসল।

 সৌরভ উঠে বসল বাবু হয়ে, বল।

মায়ের শরীরে কোনো অসুখ হয়েছে।

 মানে?

বেশ কিছুদিন ধরে বাথরুমে কাশির আওয়াজ পাচ্ছিলাম। আজ বনির কাছে শুনলাম কাশিটা পুরনো। মা বনিকে নিষেধ করেছেন কাউকে না বলতে। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা সাধারণ নয়।

মাকে জিজ্ঞাসা করেছিস?

না। করলেও স্বীকার করবে না। গৌরব জিজ্ঞাসা করল, ভালো ডাক্তার জানা আছে?

 তা আছে। পাড়াতেই দুজন আছেন। কিন্তু তাতে কী হবে? পেশেন্ট যদি মনে করে তার কিছু হয়নি তাহলে ডাক্তারের কাছে যাবে কেন?

আমি যাওয়ার কথা কখনই বলছি না। তোমার কোনো বন্ধুবান্ধব যদি ডাক্তার হন তাহলে তাকে বাড়িতে ডাকো। তিনি যদি মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে চেক করতে পারেন।

ঠিক আছে। সৌরভ উঠে টেলিফোনের কাছে গেল। মিনিট দুয়েক কথা বলার পর বলল, শ্যামল দত্ত। নটা নাগাদ আসবে। মাকে কিছু বলার দরকার নেই।

নটার সময় ওরা সবাই বাগানে বসেছিল। মা যথারীতি গাছের গোড়া পরিষ্কার করছিলেন। গৌরব লক্ষ্য করছিল ওর ভঙ্গিতে ক্লান্তি ফুটে উঠছে। যেন শরীরের বিরুদ্ধে জোর করে কাজটা করছেন নিজেকে সুস্থ প্রমাণ করতে। এই সময় গাড়িটা এসে দাঁড়াতে সৌরভ এগিয়ে গেল। শ্যামল সৌরভের বয়সী, বেশ ভালো চেহারা। হাতে চ্যাপ্টা ব্রিফকেস। সৌরভ নিজের বন্ধু বলে সবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল।

মায়ের সঙ্গে আলাপ হতেই শ্যামল বলল, আপনার কথা খুব শুনেছি। কেমন আছেন আপনি?

মা বললেন, আমি খুব ভালো আছি।

কিন্তু আপনি এত ঘামছেন কেন?

ও কিছু না। কাজ করছিলাম বলে ঘাম হচ্ছে।

আপনি বসুন তো মা। শ্যামল একটা চেয়ার দেখিয়ে দিলো।

 কেন? সরলা অবাক।

বসুন। বলছি।

সরলা বাধ্য মেয়ের মতো বসলেন। শ্যা

মল জিজ্ঞাসা করল, আরাম লাগছে?

বসলে আরাম তো লাগবেই।

হুম এবার আমার দিকে তাকান। বলতে বলতে আঙুল দিয়ে সরলার নিচের পাতা টেনে দেখল শ্যামল। ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটল যে অবাক হওয়ার পর সরলা প্রতিবাদের ভঙ্গিতে জানতে চাইলেন, কী ব্যাপার? তুমি ডাক্তার নাকি?

আপনার ছেলের বন্ধু এখন ছেলে ভাবতে পারছেন না কেন? কথা বলতে বলতে ব্রিফকেস থেকে স্টেথো বের করে পরীক্ষা শুরু করে দিলো সে।

সরলা প্রচণ্ড অস্বস্তিতে প্রতিবাদ করতে চাইছেন কিন্তু সেই সময় শ্যামল বলল, এবার একটু বড় করে হাঁ করুন তো মা। হ্যাঁ, আর একটু। শব্দ করুন, অ্যা এইরকম শব্দ, গুড, ঠিক আছে। এবার আপনার হাতটা দিন। প্রেসারটা দেখে নিন আপনি।

আমি প্রেসার দেখব?

হুঁ। শ্যামলের কাজ থেমে ছিল না। সরলার হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে বলল আপনি এখানে তাকান। এটা ডিজিটাল। আপনার যেমন প্রেসার তেমন ফুটে উঠবে নাম্বার। পাম্প করার পর সত্যি নম্বর ঘুরতে দেখলেন সরলা। এরকম প্রেসার যন্ত্র তিনি এর আগে দ্যাখেননি। ঘুরতে ঘুরতে যখন থামল তখন ফুটে উঠছে একশ তিরিশ আর নব্বই। শ্যামল চিৎকার করল, দারুণ। এত ভালো রক্তের চাপ আমারও নেই। চমৎকার।

এবার হাসি ফুটল সরলার মুখে, তবে দ্যাখো। তোমরা আমাকে নিয়ে খামোকা এইসব করলে। শরীর যে ভালো তা আমার মুখ থেকে শুনে বিশ্বাস হচ্ছিল না?

যন্ত্র গুটিয়ে ব্রিফকেসে ঢুকিয়ে রেখে শ্যামল থেমে গেল না। আঙুলের ডগায় বাইরে থেকে মায়ের গলার গ্যান্ডগুলো পরীক্ষা করতে লাগল। তারপর বলল, ঠিক আছে, এবার আপনি যা করছেন তা করতে দিতে আমার আপত্তি নেই।

সরলা ততক্ষণে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন সৌরভের দিকে, কী ব্যাপার বলতো? ডাক্তার বন্ধুকে বাড়িতে এনে আমায় পরীক্ষা করাচ্ছিস কেন?

জিজ্ঞাসা করে দ্যাখো, আমেরিকায় সব বয়স্ক মানুষই করায়। সৌরভ এই যুক্তিটা ভেবে রেখেছিল, এবার বলে ফেলল।

শ্যামল বলল, বাড়িটা তো বেশ সুন্দর। চলো বাগানে বসিয়ে রাখবে না ভেতরে নিয়ে গিয়ে চা খাওয়াবে?

মলি লজ্জা পেল। সে শ্যামলকে ভেতরে আসার জন্যে অনুরোধ করে চায়ের ব্যবস্থা দেখতে দৌড়োল। মাকে বাগানে রেখে দিয়ে ওরা গাছপালা নিয়ে কথা বলতে বলতে বাইরের ঘরে উঠে এল। শ্যামলের ভঙ্গি দেখে গৌরবের ক্রমশ ধারণা হচ্ছিল মায়ের শরীর মোটামুটি ভালোই আছে। সোফায় বসে সৌরভ জিজ্ঞাসা করল, কেমন দেখলে?

সঙ্গে সঙ্গে শ্যামল গম্ভীর হয়ে গেল, দ্যাখো বাইরে থেকে দেখে যে সব অসুখ বোঝা যায় তা তোমার মায়ের হয়নি। কিন্তু শরীরের ভেতরের কিছু কিছু অসুখ এভাবে চট করে বলে দেওয়া যায় না। ওঁর বুকের গলার একটা এক্সরে আমার এখনই পাওয়া দরকার। সেই সঙ্গে রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে।

এসব করাতে বলছ কেন?

কিছু লক্ষণ আছে যা আমার কাছে ভালো বলে মনে হচ্ছে না। আর এই লক্ষণগুলো আছে বলেই যে অসুখটা হয়েছে তা বলার কোনো হক আমার নেই যতক্ষণ না ওই রিপোর্টগুলো আমি দেখতে পাব।

কি লক্ষণ? তুমি একটু খুলেই বলো না।

লক্ষণ খুলে বললে তুমি বুঝতে পারবে। দুটো সম্পূর্ণ আলাদা রোগের লক্ষণ এক হতে পারে। ঠান্ডা লেগে কারো গলা ধরে যেতে পারে। আর গলা ধরে যাওয়া ক্যানসারের একটা লক্ষণ। তার মানে ঠান্ডা লেগে গলা ধরেছে না তার কি ক্যানসার হয়েছে? অতএব পরীক্ষা না করে বলা বোকামি হবে। আমি লিখে দিচ্ছি কী কী এখনই করতে হবে। শ্যামল প্যাড বের করল। গৌরব উঠে পড়ল। মাকে রাজি করাতে হবে এক্সরে করাতে।

কথাটা শোনামাত্র বেঁকে বসলেন সরলা, আমি বেশ ভালো আছি তোরা আমাকে ঝামেলায় ফেলছিস। এতদিন কত অসুখ গেল কেউ একবারও বলল না ডাক্তার দেখাতে আর এখন বিনা অসুখেই এসব হচ্ছে!

গৌরব বলল, দ্যাখো মা, আমাকে আমেরিকায় যেতেই হবে। যদি কলকাতাতেই ভবিষ্যতে চাকরি করি তবু ওখানকার পাট চুকিয়ে ফেলা যাবে না। তাই আমি যাওয়ার আগে নিশ্চিন্ত হয়ে যেতে চাই আমার মায়ের শরীর সেন্ট পার্সেন্ট ভালো আছে।

আছেই তো।

সেটা ডাক্তারের রিপোর্ট না পেলে বিশ্বাস করব না।

 আমার কথার চেয়ে ডাক্তারের রিপোর্ট তোর কাছে বড় হলো?

তোমার শরীরের ক্ষেত্রে তাই।

হঠাৎ খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন সরলা, তোর ছুটি তো শেষ হয়ে এল গোরা।

ও নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না।

আমি বলি কি বিয়ে করে জয়তীকে নিয়ে তুই চলে যা।

আর তুমি?

 আমি এতকাল যেমন ছিলাম তেমনই থাকব।

না। এবার যদি জয়তীকে নিয়ে যেতে হয় তাহলে তোমাকেও সঙ্গে যেতে হবে।

যাব বললেই কি যাওয়া যায়? আমার তো পাসপোর্ট নেই।

 জয়তীরও নেই। তাহলে দুজনের জন্যে একসঙ্গে অ্যাপ্লাই করি।

মাথা খারাপ দেশের মাটি ছাড়া আমি কোথাও মরলে শান্তি পাব না।

ওখানে গিয়ে তোমাকে মরতে হবে কেন? মরার আগে দেশে ফিরে এলেই হবে। এই কথাই ফাইন্যাল হয়ে গেল কিন্তু।

আমাকে লোভ দেখাস না গোরা!

কীসের লোভ? যা আকাশকুসুম তার প্রতি আকাঙ্ক্ষাই লোভ বলা যেতে পারে। আমেরিকায় যাওয়া এখন গুজরাট যাওয়ার চেয়ে সোজা। ধর যদি আমি নাগাল্যান্ডে চাকরি করতাম আর কলকাতায় আসতে তিনদিন লাগত তাহলে কি আমেরিকা থেকে দূরে থাকতাম না? লোভ দেখাব কেন, তুমি যাচ্ছ এটা আমার গর্ব। জানো মা, ওখানে কোনো ভালো জিনিস দেখলেই ভেবেছি তোমাকে দেখাতে পারলে কি আনন্দ হতো। এবার সেসব সখ মিটিয়ে নেব। আমি দাদাকে বলছি।

দাঁড়া। তোর অবস্থা, ওঠ ছুঁড়ি, তোর বিয়ের মতো।

এসব সিদ্ধান্ত নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে কাজ না করলে হয় না। তোমার কিছু ছবি তুলতে হবে। পাসপোর্টের জন্যে।

আমাকে তুই সত্যি নিয়ে যাবি?

আবার এক কথা!

শ্যামল কী বলল?

 কোন শ্যামল?

 ওঃ, তোর মন কি ভুলো। একটু আগে তোর দাদার বন্ধু এল–।

ওহো। সত্যি, একদম ভুলে গিয়েছিলাম। গৌরব বলল, কিছু না, শরীর ঠিক আছে। তবে কয়েকটা এক্সরে আর ব্লাড পরীক্ষা করাতে হবে।

সরলা আকাশের দিকে তাকালেন, বেশ, ওসব করে নে আগে।

গৌরব চেঁচিয়ে উঠল, গুড। মা তুমি খুব ভালো।

এই সময় সৌরভ শ্যামল বেরিয়ে আসছিল বাড়ি থেকে। শ্যামল জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার? হঠাৎ একটা আবিষ্কার করলেন মনে হচ্ছে?

হ্যাঁ হঠাই। মায়ের যা জেদ তা আমরা জানি। দাদা, মা রাজী হয়েছেন এক্সরে ব্লাড করাতে।

 ওকে! সৌরভ হাসল, কাল সকালেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

মলি নিয়ে গিয়েছিল সরলাকে এক্সরে করাতে। বাড়িতে এসে রক্ত নিয়ে গিয়েছিল পরীক্ষাগার থেকে। সেই সমস্ত রিপোর্ট পাওয়া গেল সন্ধেবেলায়। গৌরব রিপোর্ট নিয়ে শ্যামলের চেম্বারে হাজির হলো রাত আটটা নাগাদ। শ্যামলের পশার বেশ ভালো। অন্তত জন বারো মানুষ তখনও অপেক্ষা করে আছেন। এদের টপকে শ্যামলের কাছে পৌঁছবার চেষ্টা করল না সে। ডাক্তারের কাছে যখন কেউ আসে তখন সে প্রয়োজনটাকে জরুরি বলেই মনে করে। বারোজনের পরে এসে কেউ যদি দাদার বন্ধু হিসেবে সুবিধে নিয়ে আগে কাজ শেষ করতে চায় তবে অন্যান্যরা মেনে নিতে বাধ্য হবে কিন্তু একই সঙ্গে ডাক্তার এবং আগন্তুকের ওপর মনে মনে অপ্রসন্ন হবে।

দশটা নাগাদ শ্যমলের মুখোমুখি হতে পারল সে। রিপোর্ট দেখে শ্যামলের মুখ যে গম্ভীর তা বুঝতে অসুবিধে হলো না। বেশ কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে দেখার পর শ্যামল বলল, আমার মনে হচ্ছে ডক্টর এস কে সরকারকে কালই দেখানো উচিত।

ডক্টর সরকার?

ই এন টি স্পেশালিস্ট।

গলায় কিছু হয়েছে?

মনে হচ্ছে। তবে কতদূর কী হয়েছে তা স্পেশালিস্ট বলতে পারবেন।

শ্যামলবাবু, আপনার কী মনে হয়?

আমার? দেখুন, কিছু কিছু অসুখ থাকে যা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের এক্তিয়ারে না। আপনার মায়ের অসুখটা আমার নয়, একজন ই এন টি বলতে পারবেন। তবে শুনলাম উনি। অনেকদিন ধরে কাশছেন। তাই না?

অনেকদিন কি না জানি না, আমি হঠাৎ শুনতে পেলাম দিন কয়েক আগে।

মুশকিল কি জানেন, আমাদের বাঙালি মহিলারা সব সময় ভাবেন শরীর খারাপের কথা অন্যকে বললে বিরক্ত করা হবে। যাই ঘটুক তারা চেপে যেতে চেষ্টা করেন। চেপে থাকল তো থাকল। কিন্তু যা লুকিয়ে রাখা যায় না তা প্রকাশ পেলে অন্যরা জেনেই যায় আর তখন অনেকটা সময় চলে গিয়েছে। আচ্ছা, আমি ডক্টর সরকারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে রাখব। আপনি সৌরভকে বলবেন টেলিফোন করতে।

আপনার কী সন্দেহ হচ্ছে?

দেখুন, ইটস টু আর্লি টু–। আর তাছাড়া আগ বাড়িয়ে কিছু বলাও ঠিক নয়।

আপনি অনুমান করছেন এবং সেটা সত্যি নাও হতে পারে, এইভাবে বলুন।

শ্যামল গৌরবের মুখের দিকে তাকাল, আপনি বুঝতেই পারছেন?

 চট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল গৌরব। তার মুখ ভেঙেচুরে যাচ্ছিল।

শ্যামল বলল, ডোন্ট গেট আপসেট। আপনার মাকে এসব জানানোর কোনো দরকার নেই। ওঁকে আনন্দে রাখুন। এও বলছি, আমার ভাবনা মিথ্যে হলে আমি খুশি হব।

সমস্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর সন্দেহ বলে কিছু রইল না। সন্দেহ শব্দটির মধ্যে কোথাও কিছু আশা অবশিষ্ট থাকে। না-ও হতে পারে। এমন ভাবনা কাজ করে। কিন্তু এখন সেই স্তর থেকেও উঠে এল গৌরব। শ্যামল, ডক্টর সরকার সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলেন রিপোর্ট দেখে। সরলার পেটে দীর্ঘদিন একটা ঘা ছিল। যখন সেটা বড় আকার নিয়েছে তিনি ওষুধ খেয়ে চাপা দিয়েছেন। চাপা পড়ে গিয়ে তলায় সেটা চেহারা পাল্টেছে। এখন খাদ্যনালীতে তার বিস্তার।

গৌরব এবং সৌরভ পাশাপাশি বসেছিল। সৌরভ দুহাতে মুখ ঢেকে রয়েছে। তার শরীর শক্ত। হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠল সে! কান্নাটি চাপতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। শ্যামল বলল, শক্ত হ সৌরভ। নিজেকে তৈরি কর। মাসীমাকে এসব কথা জানানোর কোনো দরকার নেই। ওঁকে ওর মতো বেঁচে থাকতে দে।

সৌরভ জবাব দিল না। গৌরব জিজ্ঞাসা করল, কোনো চান্স নেই?

চান্স বলতে? ডক্টর সরকার জিজ্ঞাসা করলেন।

চিকিৎসাশাস্ত্রে যদি কোনো উপায় থেকে থাকে, যদি তার জন্য মাকে বিদেশে কোথাও নিয়ে যেতে হয় তাহলে সেটা করতে আমি রাজি আছি। গৌরব বলল।

ডক্টর সরকার বললেন, গাছের একটা ডাল পচে গেলে সেটা কেটে বাদ দিয়ে দিলে গাছটা বেঁচে যাবে। কিন্তু ধরুন পচন যদি শেকড়ে ধরে আর ওপরের গাছটা নিস্তেজ হয়ে আসে তাহলে বাদ দেবেন? য়ুরোপ আমেরিকায় গিয়ে হয়তো বাদ দেওয়ার কাজটা হতে পারে কিন্তু বাঁচানো অসম্ভব।

হঠাৎ সৌরভ হাত সরাল মুখ থেকে, আমি একটা কথা কিছুতেই বুঝতে পারছি না, গোরা যদি সন্দেহ না করত তাহলে মায়ের এই অসুখটা এখনও ধরা পড়ত না। মা দিব্যি থাকতেন।

সেইটেই স্বাভাবিক। কিন্তু যখন পড়তেন তখনই মৃত্যুযন্ত্রণা শুরু হয়ে যেত।

এখন আবিষ্কার করে আপনারা কি উপকারটা করলেন?

উপকার করার উপায় থাকলে নিশ্চয়ই করতাম। যদি দেখা যেত এটা প্রাথমিক অবস্থা তাহলে আমরা লড়াই করার সুযোগ পেতাম। এরকম অনেক কেস আমি পেয়েছি সেই সব রোগী ধরা পড়ার পরেও দশ বছর দিব্যি বেঁচে আছেন। রোগটাকে বেঁধে রাখতে পেরেছি। এক্ষেত্রে একান্তই দুর্ভাগ্য যে ধরা পড়ল প্রায় শেষ অবস্থায় এসে।

সৌরভ বড় করে নিশ্বাস নিল। বোঝাই যাচ্ছিল তার খুব কষ্ট হচ্ছে। ডক্টর সরকার জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা দুজন ছাড়া আর কেউ ঘটনাটা জানেন?

না। গৌরব মাথা নাড়ল। বউদিকেও এখনও বলা হয়নি।

না বলাই ভালো। মেয়েরা মেয়েদের ব্যবহারের পরিবর্তন চট করে বুঝতে পারে। আপনার মাকে আমি কয়েকটা ওষুধ লিখে দিচ্ছি। এগুলো মূলত ভিটামিন জাতীয় এবং ঘুমের ওষুধ। যেটুকু রিলিফ এই অবস্থায় দেওয়ার যায় তা ওঁকে দেব।

সৌরভ বলল, আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে না তো?

মানে? ডক্টর সরকার অবাক হলেন।

আজ সকালেও মা বাগানে কাজ করেছেন, আমাদের জন্যে একটা তরকারি জোর করে রান্না করেছেন, নাতিনাতনিদের সঙ্গে গল্প–! মাথা নাড়ল সৌরভ, কোথাও ওঁর আচরণের অসুস্থতার চিহ্ন দেখা যায়নি। অথচ আপনারা বলছেন–।

ঠিকই। ওঁর প্রাণশক্তি যতক্ষণ জোরালো থাকবে ততক্ষণ উনি এসবই করবেন। কিন্তু যে মুহূর্তে ব্যথা শুরু হবে তখনই সব পাল্টে যাবে।

গৌরব জিজ্ঞাসা করল, মায়ের অসুখ যে স্টেজে আছে তাতে আমরা কতদিন সময় পেতে পারি বলে আপনার অনুমান?

ঠিক অঙ্ক কষে সময় বলে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে ওটা যে স্টেজে আছে তাতে আমরা মাস তিনেকের বেশি আশা করতে পারি না।

.

সৌরভ খুব ভেঙে পড়েছিল। গৌরবের প্রচন্ড কষ্ট হলেও সে নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করছিল। শ্যামলের গাড়িতে চেপে ওরা বেশ কিছুটা পথ আসার পর সৌরভ বলল, বাড়ি গিয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা হলে কী বলব? তার গলায় কান্না বাজছিল।

শ্যামল গড়ের মাঠের পাশে গাড়ি থামাল। বলার কোনো দরকার আছে?

মা তো জিজ্ঞাসা করবেন।

জিজ্ঞাসা করলে একটা কিছু বললেই হবে। আমি যাচ্ছি, আমি বলব।

সিটের ওপরে মাথা হেলিয়ে দিয়ে সৌরভ বলল, গোরা, তুই ভাবতে পারছিস, তিনমাস পরে মা থাকবে না। এত বছর ধরে কত অত্যাচার করেছি আমি মায়ের ওপরে। তুই আমেরিকা থেকে ঠিক মতো চিঠি দিতিস না বলে মা যখন কান্নাকাটি করত তখন আমি মাকে বকতাম। আমি যখন ক্লাস টেনে পড়ি তখন মায়ের সঙ্গে খুব দুর্ব্যবহার করেছিলাম, কত মিথ্যে কথা বলেছিলাম।

গৌরব পেছনের সিটে একা বসে জানলার দিকে মুখ ঘুরিয়ে কথাগুলো শুনছিল। সৌরভ থামতেই বলল, দাদা তুমি এসব যত ভাববে তত ভেঙে পড়বে।

তুই তো বারো বছর দেশে ছিলি না, তুই কী করে বুঝবি আমার অবস্থা। মলি আর মায়ের মধ্যে যে ক্র্যাশ তা আমিই সামলেছি। আমি কখনও বউ বলে মলিকে সাপোর্ট করিনি আবার মা বলে তার হয়ে মলির ওপর অবিচার করতে যাইনি। আমার কষ্টটা তোরা বুঝবি না।

গৌরব মুখ ফিরিয়ে সৌরভকে দেখল। কিন্তু কিছু বলল না। তার মানে হলো পাল্টা কথা সে অনেক বলতে পারত। কিন্তু বলে কী লাভ।

গাড়ি থেকে নামার আগে শ্যামল আবার সৌরভকে সতর্ক করে দিল। ওরা বাগানের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে বারান্দায় উঠতেই মলি বেরিয়ে এল, রিপোর্ট পাওয়া গেল?

শ্যামল হাসল, হ্যাঁ, আপনার স্বামী এবং দেওর যা ঘাবড়ে গিয়েছিল। কিস্যু হয়নি। পেটে একটা আলসার মতো হয়েছে সময়মতো না খেয়ে। কোথায় উনি?

ছটফট করছেন! এত দেরি হচ্ছে কেন ফিরতে জানতে চাইছেন। জোর করে ডক্টর সরকারের ওখানে ফোন করালেন। শুনলাম বেরিয়ে গেছেন।

সৌরভ গৌরবের দিকে তাকাল, তোরা বোস। আমি একটু শোব। সে দাঁড়াল না।

মলি জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে ওর?

 মাথা ধরেছে। বললাম একটা ওষুধ খেতে। রাজি হলো না। শ্যামল বলল।

 আশ্চর্য। বড্ড জেদী জানেন! রাত্রে বেশ ড্রিঙ্ক করে সকালে যখন হ্যাঙ ওভার হয় তখন কিন্তু আমাকে না জানিয়ে মুঠো মুঠো ট্যাবলেট খাবে আর আমি যদি কোনো অসুস্থতা দেখে ওষুধের কথা বলি সঙ্গে সঙ্গে না বলবে। রোগ বাড়লে তবে হ্যাঁ। মলি খুব বিরক্ত হয়ে যখন এই কথাগুলো বলছিল তখন দরজায় এসে দাঁড়ালেন সরলা।

তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে বউমা?

আপনার ছেলের মাথা ধরেছে।

ও। এক কাজ করো, ও যদি ট্যাবলেট না খেতে চায় তাহলে আমার কাছে মলম আছে, ওর কপালে মাখিয়ে দাও, আরাম পাবে। সরলা বললেন।

আপনার ছেলে কি কচি খোকা যে আপনি যা বললেন তাই শুনবে। এর আগে যতবার মাথা ধরার সময় কাছে গিয়েছি বিরক্ত হয়েছে সাত বার তো বলেই দিয়েছে এই সময় তুমি আমাকে একদম বিরক্ত করবে না। আমি খাব না। মলি বলল।

শ্যামল হাসল, আপনারা কিন্তু মিছিমিছি চিন্তা করছেন। জ্যামের মধ্যে গাড়িতে বসে একটু ওরকম হয়েছে, রেস্ট নিলে ছেড়ে যাবে। বসুন মাসিমা। মা ঘরে ঢোকা থেকেই গৌরব তাকে লক্ষ্য করছিল। কাল পর্যন্ত যাঁকে মনে হয়েছিল সম্পূর্ণ সুস্থ আজ যেন মনে হচ্ছে একটা কালোছায়া তার শরীরে মাখানো। দেখামাত্র বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল তার। সে মুখ নামিয়ে নিল।

এই সময় জিজ্ঞাসা করলেন, তোর আবার কী হলো? অমন মুখ কেন?

চমকে তাকাল গৌরব। তারপরেই কাঁধ নাচিয়ে বলল, দাদার ব্যাপারে কী বলব।

তা আমার ব্যাপারে বলবি তো।

সরলার এই কথায় মুখ তুলতে পারল না গৌরব। মায়ের সামনে চট করে মিথ্যে কথা বলার অভ্যেস আজও তৈরি হয়নি। এই বিপদ থেকে তাকে রক্ষা করল শ্যামল। সরলা প্রশ্ন করামাত্র সে বলল, ও কী বলবে? বলব তো আমি। কী করেছেন বলুন তো পেটের অবস্থা। আর আপনি কী রকম বউমা?

কেন? আমি কী করলাম?

উনি কি খাচ্ছেন, কখন খাচ্ছেন দেখার প্রয়োজন মনে করেন নি?

সরলা মাথা নাড়লেন, আঃ। রোগটা কী তা বলবে তো?

শ্যামল বলল, কী বলব মাসীমা! সময়মতো না খেয়ে আপনার পেটের ভেতর একটা ঘা হয়ে গেছে। আলসার। এখনই ধরা পড়ল তাই রক্ষে!

মলি বলল, ও বাব্বা। আলসার তো খুব ভোগায়!

যে ভুগতে চায় তাকে ভোগায়।

অপারেশন করাতে হবে? মলি বলে যাচ্ছিল, আমার এক পিসিমার আলসার হয়েছিল, অপারেশন করার পর ভালো হয়ে গিয়েছে।

না, না। ওঁর একদম প্রাথমিক অবস্থা। অপারেশনের কোনো প্রয়োজন নেই। যেটা দরকার সেটা আপনার ওপরে। মলির দিকে তাকাল শ্যামল।

আমার ওপরে? মলি অবাক।

হ্যাঁ। নিয়ম করে ওঁকে খাওয়াতে হবে। কোনোরকমে ঝাল-মশলা চলবে না। সেদ্ধ, সূপ, একটু আধটু মিষ্টি চলবে। ঝাল কিংবা মশলা ওঁর কাছে বিষ বলে মনে করবেন। শ্যামল সিরিয়াসলি বলছিল আর তার দিকে তাকিয়ে বোধহয় গৌরব অবাক হয়ে যাচ্ছিল। কি সহজে শ্যামল সব ঢেকে ফেলছে।

মলি বলল, মা। আর আপনার কথা শুনব না। আমি যা বলব তাই এখন থেকে আপনাকে করতে হবে।

সরলা এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলেন। এবার জিজ্ঞাসা করলেন, খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো না করলে পেটে যে ঘা হয় তার জন্যে কি কাশি হয়?

হতে পারে। শ্যামল মাথা নাড়ল, পেটের সঙ্গে শরীরের সব অংশের সংযোগ আছে। কাশিটা ওই কারণে হতেই পারে। আপনাকে কয়েকটা ওষুধ নিয়ম করে খেতে হবে। রোজ সকাল বিকেল নিয়ম করে বাগানের কাজ যেমন করছিলেন করে যাবেন। অসুখের কথা মাথা থেকে সরিয়ে ফেলুন।

হঠাৎ বাগানের কথা উঠছে কেন?

না, মানে আপনার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা যাতে ব্যাহত না হয় তাই বলছি।

 শ্যামলের যুক্তি শুনে মা উঠে গেলেন। মলি বলল, চা খাবেন তো?

শ্যামল মাথা নাড়ল, না। আমি এখন চলি।

 গৌরব ওকে দরজা অবধি এগিয়ে দিয়ে ফিরে এল। তার ওপরে উঠতে মোটেই ইচ্ছে করছিল না। কেবলই মনে হচ্ছিল শ্যামলের সব কথা মন দিয়ে শুনেও সরলা যেন কোথায় একটা অবিশ্বাস রেখে দিয়েছেন। মুখোমুখি হলেই তিনি সেই মতো প্রশ্ন শুরু করবেন। এই মুহূর্তে হয়তো সত্যি কথাটা বেরিয়ে আসতে পারে। সে মোক্ষদাকে দেখতে পেল, মোক্ষদা। আমি আর ওপরে উঠব না। তুমি মা-বউদিকে বলে দিও আমি একটু বের হচ্ছি।

এইতো ফিরলে। পায়ে সরষে লাগিয়ে রাখো নাকি? কিছু খেয়ে যাও।

মোক্ষদা গৌরব একা থাকলে মন খুলে কথা বলে।

নাগো। খিদে নেই। আর আজ রাত্রে আমার বাইরে নেমন্তন্ন আছে। ওদের সবাইকে খেয়ে নিতে বল। গৌরব বেরিয়ে এল বাইরে। ইচ্ছে করেই সে ঘাড় ঘুরিয়ে বাড়ির দিকে তাকাচ্ছিল না। মন বলছিল সরলা নিশ্চয়ই বারান্দায় দাঁড়িয়ে তার যাওয়া দেখছেন। চোখাচুখি হলেই ধরা পড়ে যাবে সে।

এলোমেলো হাঁটছিল গৌরব। সন্ধে হয়ে আসছে। হঠাৎ মনে হলো সে কি জীবন থেকে পালিয়ে যেতে চাইছে? বাস্তবের মুখোমুখি হবার সাহস হারিয়ে ফেলেছে। এটা কি তার চারিত্রিক দুর্বলতা? নইলে সে মায়ের মুখোমুখি হতে সাহস পাচ্ছে না কেন? শুধুই মিথ্যে কথা বলার দায় থেকে মুক্তি পেতে? পৃথিবীতে কেউ তো চিরস্থায়ী নয়। প্রতিটি মানুষকে একটু আগে অথবা পরে পৃথিবী থেকে চলে যেতে হবে। সেই একই নিয়মের শিকার হয়েছেন মা। অতএব যা সত্যি তাকে স্বীকার করাই স্বাভাবিক হবে। এরকম একটা ভাবনা ভেবেও কিন্তু সহজ হতে পারছে না গৌরব। সে একটা ট্যাক্সি ডাকল।

জয়তীদের বাড়িতে পৌঁছে মন স্থির হলো গৌরবের। দরজা খুলল জয়তী। খুলেই গৌরবের মুখ দেখে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে তোমার?

কেন? গৌরব মুখ ফেরাল।

 ভেতরে এস।

গৌরব বাইরের ঘরের চেয়ারে বসে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কেমন আছ?

আমার কথা ছেড়ে দাও। তোমার চেহারার এই অবস্থা হলো কেন?

গৌরব মাথা পেছন দিকে হেলিয়ে রেখে চোখ বন্ধ করল। চটপট তার পাশে চলে এল জয়তী। একটা হাত আলতো করে গৌরবের কপালে রাখল। খুব নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, কোনো খারাপ খবর পেয়েছ?

সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে পড়ল গৌরব। ডক্টর সরকারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসার পর যে শক্তি দিয়ে নিজেকে সংযত রেখেছিল তা এক কথায় ভেঙে গেল। জয়তীর হাত আঁকড়ে মুখের ওপরে ধরে সে শব্দ করে কেঁদে উঠল। জয়তী হতচকিত। দ্রুত সে গৌরবের পাশে বসে দুহাতে জড়িয়ে ধরল তাকে, কী হয়েছে গৌরব? তুমি কাঁদছ কেন?

প্রথম কান্নাটা বুক থেকে উঠে আসতেই আবার শক্তি ফিরে পাচ্ছিল গৌরব। জয়তীর বুকের ওপর চেপে থাকা তার মুখ একটু একটু করে সহজ হতেই সে মাথা তুলল। জয়তী তার চোখের জল মুছিয়ে দিচ্ছিল। সে আর কোনো প্রশ্ন করছিল না। মানুষটাকে শান্ত হবার জন্য সময় দিচ্ছিল। ওই একই ভাবে ওরা বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর যেন সম্বিত ফিরতেই গৌরব সরে যাওয়ার চেষ্টা করল। জয়তী বলল, না। তুমি এভাবেই থাকো।

মাসীমা আসতে পারেন।

 মা বাড়িতে নেই।

গৌরব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, জয়তী!

 বলো।

মা–৷ গৌরবের গলার স্বর রুদ্ধ হলো। জয়তী চুপ করে রইল। যেন গৌরবকে বলতে দিল। গৌরব ধীরে ধীরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। তারপর বলল, কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না। এমন অসহায় এ জীবনে কখনও হইনি। মায়ের সবরকম ডাক্তারি পরীক্ষা হয়েছে। আজ রিপোর্ট পেয়েছি।

কী আছে রিপোর্টে?

মায়ের ক্যানসার হয়েছে। অ্যাডভান্সড স্টেজ। আর মাস তিনেক।

কথাগুলো কানে যাওয়া মাত্র শক্ত হয়ে গেল জয়তী। হঠাৎ তারও চার পাশ কেমন কাঁপতে লাগল। সরলার মুখখানা মনে করতেই সে বলে উঠল, না!

এটাই সত্যি জয়তী। মাকে কিছুই জানানো হয়নি। বলা হয়েছে ওঁর পেটে আলসার হয়েছে। কিন্তু আমি জানি আমাকে একা পেলেই মা জিজ্ঞাসা করবেন তার কী হয়েছে। আমি তখন কী জবাব দেব?

জয়তী উত্তর দিল না। দীর্ঘ সময় ওরা চুপচাপ বসে রইল। শেষ পর্যন্ত গৌরব উঠল। জয়তী মুখ ফেরাল, কোথায় যাচ্ছ?

দেখি।

না, এভাবে পাগলের মতো তুমি ঘুরে বেড়াবে না।

 জয়তী, তুমি বুঝতে পারছ না, আমার সমস্ত মন জ্বলে যাচ্ছে।

 ডাক্তার কি কোনো আশা দেননি?

না। শুধু ঈশ্বর যেন মাকে ক্যানসারের শেষ যন্ত্রণাটা থেকে মুক্তি দেন সেই প্রার্থনা করতে হবে। বাট হোয়াই? আমার মায়ের মতো সর্বংসহা মহিলা, যাঁকে সারাজীবন প্রচুর কষ্ট করতে হয়েছে তার শেষ জীবনে ঈশ্বর এমন শাস্তি কেন দিলেন? কর্মফল বলে কি তাহলে কিছু নেই? প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে পড়ল গৌরব। জয়তী উঠে দাঁড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল, তুমি একটু শান্ত হও। এখন এত উত্তেজিত হলে মাসীমার কোনো উপকারই তুমি করতে পারবে না।

কী উপকার করব জয়তী? ঈশ্বর আমাকে ঠুটো জগন্নাথ করে রেখেছেন। আমরা মায়ের কোনো উপকারই করতে পারি না।

কিন্তু তাকে একটু স্বস্তি, একটু আরাম দিতে পারি। আমি জানি তোমার কিরকম কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু ভেবে দ্যাখো, এছাড়া আমরা আর কী করতে পারি।

গৌরব জয়তীর দুটো কাঁধ ধরল, মা যদি জিজ্ঞাসা করেন কী বলব?

যা বলা হয়েছে। আমার মনে হয় তিনি তোমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না। মাসীমা সাধারণ মহিলাদের থেকে অনেক বেশি বুদ্ধিমতী।

সোফায় ফিরে এল গৌরব। সব উল্টোপাল্টা হয়ে গেল।

 কিছুই হয় নি। ভুলে যেও না মা এখনও আছেন।

হ্যাঁ, আছেন। একমাত্র মিরাকল ছাড়া কেউ তাকে বাঁচাতে পারবে না।

তুমি বাড়ি থেকে আসছ?

 হ্যাঁ।

কী বলে এসেছ?

মোক্ষদাকে বলেছি নেমন্তন্ন আছে।

মোক্ষদাকে কেন?

তখন নিচে কেউ ছিল না।

জয়তী নিশ্বাস ফেলল, এখানে খেয়ে যাবে?

না।

তাহলে তো তুমি কোথাও খাবে না।

 দেখি।

না। এভাবে চললে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে। নিজেকে কষ্ট দিয়ে যদি তুমি মাকে সুস্থ করতে পারতে তাহলে আমিই তোমাকে সেটা করতে বলতাম।

আমার কিছুই ভালো লাগছে না জয়তী।

গৌরব, তুমি স্বাভাবিক হও। তোমার অস্বাভাবিকতা দেখে মাসীমা আরও তাড়াতাড়ি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। ওঁর জন্যে তোমাকে ঠিকঠাক আচরণ করতেই হবে। জয়তী বলল, শোনো তুমি এখানে খেয়ে যাবে।

তোমাকে আবার–।

না। এটুকু যদি না পারি তাহলে বাঙালি মেয়ে হয়ে জন্মানো উচিত হয়নি আমার। তবে খুব ভালো কিছু খাওয়াতে পারব না আজ। আমি যা খাব তাই তোমাকে খেতে হবে।

আঃ। আজ আমি খাওয়া নিয়ে মোটেই ভাবছি না।

.

রাত এগারোটা নাগাদ বাড়িতে ফিরল গৌরব। সমস্ত বাড়ি নিঝুম। মোক্ষদা দরজা খুলতেই গৌরব জিজ্ঞাসা করল, মা কেমন আছে?

ভালো। মোক্ষদা বলল, একটু আগেও তোমার খোঁজ করছিল।

আলো না জ্বেলেই সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে এল গৌরব। মায়ের ঘরের দরজা বন্ধ। সে নিঃশব্দে নিজের ঘরে ঢুকল। আলো জ্বালল। এক মুহূর্ত দাঁড়াল।

খেয়ে এসেছিস?

গৌরব চমকে পেছন ফিরতেই দরজায় মাকে দেখতে পেল।

হ্যাঁ। গৌরব মাথা নেড়ে জামা খুলতে লাগল। এক ধরনের নার্ভাসনেস তার ভেতরে সক্রিয় হয়ে উঠল।

নেমন্তন্ন ছিল?

হ্যাঁ।

 কোথায়?

জয়তীদের বাড়িতে।

ও। বলিসনি তো।

 ভুলে গিয়েছিলাম।

কেমন আছে ওরা?

আছে।

শোন। আমি চাইছি দিন দশেকের মধ্যে বিয়েটা সেরে ফেলতে৷ তার আগে যদি লগ্ন থাকে তাহলে আরও ভালো হয়।

কেন?

আমি চাইছি তাই।

কিন্তু এত তাড়াতাড়ি, সব ব্যবস্থা করতে সময় লাগবে।

কলকাতা শহরে সব কিছুই করা সম্ভব।

 দেখি।

দেখি না। এটা আমার ইচ্ছে। জয়তীকে এ বাড়ির বউ হিসেবে আমি তাড়াতাড়ি দেখতে চাই। সেই মতো ব্যবস্থা কর।

ওদেরও তো সুবিধে-অসুবিধে আছে।

আমি গিয়ে ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলব?

না, তার দরকার নেই। ঠিক আছে তাই হবে।

শুয়ে পড়। সরলা চলে গেলেন। বেশ কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল গৌরব। তার মন পরিষ্কার বুঝে নিল মা জানেন তাঁর হাতে আর বেশি সময় খরচ করার মতো নেই।

.

বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সৌরভ। চিঠি ছাপানো, বিলি করা, ক্যাটারারকে বলা থেকে আরম্ভ করে যাবতীয় কাজ সে একাই করতে লাগল। এসব শুনে জয়তীর মা সহযোগিতা করলেন। কিন্তু কারো ইচ্ছেপূরণের জন্যে এই তাড়াহুড়ো তা প্রত্যক্ষ হওয়ামাত্র এক ধরনের অস্বস্তি থেকেই যাচ্ছিল।

ভোরবেলায় ঘুম ভাঙল গৌরবের। ভাঙামাত্র তার কান সজাগ হলো। প্রতিদিনের মতো আজও সে মায়ের কাশি শুনবে বলে ভেবেছিল। দীর্ঘসময় ধরে এক যন্ত্রণাদায়ক কাশি। কিন্তু আজ সব কিছু আশ্চর্যরকম শান্ত। কোনো আওয়াজ কানে এল না তার। কাল রাত্রে সরলা মলির সঙ্গে বেশ বিয়ের কাজকর্ম তদারকি করেছেন। বিয়ের জন্য যে বাড়ি ভাড়া নিয়েছে সৌরভ সেটা কীভাবে সাজাতে হবে তাও বলে দিয়েছেন। আত্মীয়স্বজনদের কাকে কী দেওয়া দরকার তার এটা লিস্ট করেছিলেন সেটারও অদলবদল করেছেন। আর দূরে বসে তার দিকে তাকিয়ে গৌরব চুপচাপ ভেবে যাচ্ছিল। এই মানুষটির জীবন একেবারে কানায় এসে ঠেকেছে। যে কোনো ব্যাপারে আগ্রহের অভাব আছে বলে মনে হচ্ছে না। মুখের রঙ পাল্টে গিয়েছে, শরীর শীর্ণ হয়েছে আরও কিন্তু মনের চেহারার বদল হয়নি।

গৌরব আরও কিছুক্ষণ শুয়ে রইল। ক্রমশ তার একটি অস্বস্তি বাড়ল। ওষুধে কি কাজ হচ্ছে? কাশি বন্ধের কোনো ওষুধ শ্যামলদা দিয়েছেন কি না তার জানা নেই। সে উঠল। বাসি মুখেই দরজা খুলে মায়ের ঘরে এল। অদ্ভুত নার্ভাস হয়ে পড়েছিল সে। মনে হচ্ছিল বন্ধ দরজা খুলেই ভয়ানক কিছু দেখতে পাবে। তবু দরজায় শব্দ করতে সাহস হচ্ছিল না তার। বনির ঘুম যদি না ভাঙে তাহলে সে বুঝতেও পারবে না তার ঠাকুমার কি হয়েছে। সে চাপা গলায় ডাকল, মা।

কোনো সাড়া এল না। সে আবার ডাকল, মা ওঠো, ভোর হয়ে গেছে।

এবারও কোনো সাড়া নেই। গৌরব দরজায় শব্দ করতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল কাশির শব্দ হচ্ছে। বেশ জোরে। সে চট করে মুখ ফেরাল। শব্দটা আসছে বাইরে থেকে। দ্রুত ব্যালকনিতে চলে আসতেই তার নজরে পড়ল, বাগানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বুকে হাত চেপে কাশি সামলাবার চেষ্টা করছেন সরলা। যন্ত্রণায় তার মুখ বেঁকে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত উবু হয়ে বসলেন। এবং কাশির সঙ্গে এবার রক্ত ছিটকে বেরিয়ে এল। দৃশ্যটা দেখে চিৎকার করে উঠল গৌরব, মা!

সেই অবস্থায় মুখ ফেরালেন সরলা। তার ঠোঁট রক্তে লাল। কিন্তু তা বিস্মৃত হয়েই তিনি হাসতে চেষ্টা করলেন। বাঁ হাত নেড়ে বোঝাতে চাইলেন কিছু হয়নি। গৌরব দৌড়াতে লাগল। তার মা চিৎকার এত জোরে হয়েছিল যে মলির ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। সে বারান্দায় এসে দেখল গৌরব ছুটে গিয়ে সরলাকে জড়িয়ে ধরেছে।

রক্তে ঘাস ভিজে যাচ্ছিল। সরলা দুহাতে আকঁড়ে ধরেছিলেন গৌরবকে। গৌরব মুখ ফিরিয়ে মলিকে দেখেই চিৎকার করল, শ্যামলদাকে ডাকো। তাড়াতাড়ি।

সরলা হাত নেড়ে নিষেধ করল কিন্তু মলি ছুটে গেল টেলিফোনের দিকে। ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছে সৌরভ। ধরাধরি করে তাকে নিয়ে ওরা ওপরে সরলার ঘরে চলে এল। তখনও বনি ঘুমিয়েছিল। তাকে তোলা হলো। সরলা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছেন। সেই অবস্থায় চিৎকার করে উঠলেন, ছেড়ে ফেল, জামা ছেড়ে ফ্যাল। ও মাগো। গৌরব নিজের জামার দিকে তাকাল। ছোপ ছোপ রক্ত লেগে রয়েছে তাতে। ছটফট করছে অথচ কিছু করার নেই। শ্যামল এল বেশ তাড়াতাড়ি। দেখে শুনে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিল। দিয়ে বলল, আপাতত ঘুম আসবে কিন্তু বেশিক্ষণ নয়। একবার যখন পেইন শুরু হয়েছে তখন সামলানো অসম্ভব। আমি বলি কি, ওঁকে নার্সিংহোমে নিয়ে যাও।

কেন? গৌরব জিজ্ঞাসা করল।

 বেটার কেয়ার নেওয়া হবে।

কী বেটার হবে সেখানে? গৌরব মাথা নাড়ল, আপনারাই তো বলেছেন এর কোনো ট্রিটমেন্ট নেই! চিকিৎসা ছাড়া–!

আমি বলেছি বেটার কেয়ার নেওয়া হবে। ইঞ্জেকশনে ওষুধে ওঁকে কিছুটা আরাম দেওয়া যাবে যাতে এই যন্ত্রণাটা কম টের পান। এছাড়া, শুনতে খারাপ লাগবে, নিজের মা অমন যন্ত্রণা পাচ্ছেন তা সন্তানের পক্ষে সহ্য করা খুব কষ্টকর। ব্যাপারটা চোখের আড়ালে হওয়া উচিত।

শ্যামলদা, যা হবার এখানেই হবে। আপনি নার্স আয়ার ব্যবস্থা করে দিন চব্বিশ ঘণ্টার জন্যে। অনেক যন্ত্রণা তো মাকে দিয়েছি আমরা, শেষ সময়ে এটুকু যদি সহ্য করতে না পারি–! গৌরব স্পষ্ট বলল।

শ্যামল কিছু ভাবছিল। এবার বলল। সৌরভ, আমি একজন স্পেশালিস্টকে এনে মাসীমাকে দেখাতে চাই। আপত্তি আছে?

যা ইচ্ছে কর। কিন্তু একটা কথা বলো তো। এই অবস্থায় মা কতদিন থাকতে পারেন? গৌরবের বিয়ে আর মাত্র দিন তিনেক বাদে। তিনচার দিন মা সেন্সে থাকবেন তো? সৌরভ জানতে চাইল।

আমরা আশা করতে পারি। শ্যামল ঘড়ি দেখল।

এই সময় মলি বলল, আচ্ছা, শুনেছি সিঁথিতে একজন সন্ন্যাসী আছেন যিনি শেকড় দিয়ে অসুখ সারিয়েছেন। তার কাছে গেলে হয় না?

সৌরভ চেঁচিয়ে উঠল, ও মলি, প্লিজ।

আশ্চর্য! তোমার বিশ্বাস না থাকলে আমার বিশ্বাস থাকতে পারে না?

 পারে। যা ইচ্ছে করো, নিজে করো, আমাকে বলতে এসো না।

এবার শ্যামল বলল, ঝগড়া করে কোনো লাভ নেই। শুনুন, যদি শেকড়ের রসে রোগ দূর হয়ে যেত তাহলে এত হাসপাতাল ডাক্তারখানার দরকার হতো না। তবে আপনার মন যদি খুব চায় করতে পারেন। এতে আর কী ক্ষতি হবে! শ্যামলকে এগিয়ে দিতে সৌরভ নিচে নেমে গেল। মলি গম্ভীর মুখে বলল, দেখলে! কীভাবে বাইরের লোকের সামনে মুখ করল?

গৌরব বলল, এখন মাথা ঠিক নেই বুঝতেই পারছ।

 আচ্ছা খুব ভালো হোমিওপ্যাথের কাছে গেলে হয় না?

 হোমিওপ্যাথ!

হ্যাঁ। শুনেছি এসব বড় অসুখ হোমিওপ্যাথিতে সারে।

বেশ। খোঁজ নিচ্ছি। গৌরব আবার মায়ের ঘরের দিকে হাঁটতে শুরু করল। সরলা এখন ঘুমিয়ে পড়েছেন। মুখ হা, চোখ যেন কোটরে বসছে। ভঙ্গিতে ক্লান্তির ছাপ। গৌরবের বুক নিংড়ে একটা কান্না উঠে আসছিল। এখন ডাক্তার আর দিনও বলতে পারছে না। বারো বছর এই মানুষটাকে না দেখে ছিল সে। সেই সময় একবারও মনে হয়নি যে মা তার পাশে নেই। আর আজ এই মুহূর্তে এত কাছে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে মা অনেক দূরে চলে গিয়েছেন। এই সময় কাঁধে স্পর্শ পেল সে। চমকে মুখ ফেরাতেই সৌরভকে দেখতে পেল। ইশারা করল সৌরভ।

বাইরের ব্যালকনিতে বেরিয়ে এসে সৌরভ বলল, তুই সকালেই চলে যা জয়তীদের বাড়িতে। ওকে ডেকে আন।

কেন?

মায়ের এই অবস্থায় ওর থাকা উচিত।

 না না। ভিড় বাড়িয়ে কোনো লাভ নেই।

ভিড়? কী যা তা বলছিস? জয়তী আমদের বাড়ির বউ হবে।

যখন হবে তখন হবে।

আমি তোকে বুঝতে পারছি না গোরা।

এ অবস্থায় অন্য কিছু চিন্তা করতে পারছি না দাদা।

 তাহলে আমাকেই যেতে হয়। জয়তীকে আনা খুব জরুরি। মা যদি তোর বিয়ে অবধি না থাকেন তাই একটা অলটারনেটিভ ব্যবস্থা করতেই হবে। অন্তত মায়ের মনের শান্তির জন্যে এটা করতে হবে।

কী ব্যবস্থা?

আজই মায়ের সামনে তুই জয়তীকে গ্রহণ করবি।

এটা কি নাটক হয়ে যাচ্ছে না।

জীবনের অনেকটাই তো নাটক। মায়ের শেষ ইচ্ছে তুই পূর্ণ করতে চাস না?

 ঠিক আছে। আমিই যাচ্ছি।

.

ঘন্টাখানেক বাদে গৌরব যখন জয়তীদের বাড়িতে পৌঁছল তখন সে স্কুলে যাওয়ার জন্যে তৈরি হয়ে বেরুচ্ছে, তাকে দেখা মাত্র জয়তী জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে তোমার? মাসীমা কেমন আছেন?

ভালো না আজ সকালে কাশতে কাশতে ব্লাড ভোমিট করেছেন। প্রচন্ড যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।

সর্বনাশ। কী করে হলো?

 নিয়ম মেনে। রোগ এভাবেই প্রকাশ পায়। তোমার মা কোথায়?

 আছে। কেন?

ওঁর সঙ্গে দরকার আছে।

কী ব্যাপার বলো তো?

ডাকো ওঁকে।

জয়তীর মা এলেন। সব শুনলেন। শুনে বললেন, এমন মানুষকে তোমরা বাড়িতে রেখে দিলে? বাড়িতে ঠিকঠাক যত্ন হবে?

নার্স এসে গেছে আমি দেখে এলাম।

মন খারাপ হয়ে গেল বাবা। এখনই তো কিছু ঘটবে না?

বলা যাচ্ছে না। দাদার ইচ্ছে আপনারা আমাদের বাড়িতে চলুন।

হ্যাঁ নিশ্চয়ই যাব।

 দাদার ইচ্ছে মায়ের জ্ঞান ফিরলে ওঁর সামনে যেন আমি জয়তীকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ঘোষণা করি। মা দেখে গেলে খুশি হবেন।

জয়তী বলল, না। হয়তো ঝুঁকি নেওয়া হয়ে যেতে পারে।

 জয়তীর মা বললেন, এতে তো আপত্তি করার কিছু দেখি না। ওঁর আশীর্বাদ জয়তীরও দরকার। তুই কি এই শাড়ি পরেই যাবি?

জয়তী কোনো কথা বলল না।

ট্যাক্সি থেকে নেমে আসতেই মলিকে দেখতে পেল গৌরব। সে জিজ্ঞাসা করল, ঘুম ভেঙেছে?

না। তোমার দাদা এতক্ষণ বসেছিল, বনিকে বসতে বলেছি। আর নার্স তো আছেই। আয়া এখনও পৌঁছায়নি। মলি মুখ ফেরাল, আসুন মাসীমা। এসো জয়তী। সে জয়তীর হাত ধরল।

সরলা একই ভঙ্গিতে ঘুমাচ্ছেন। ওদের দেখে বনি টনি উঠে এল। ছেলেমেয়ে দুটোর মুখ শুকিয়ে আমসি। নার্স ইশারা করলেন কথা না বলতে। ওরা চুপচাপ সরলাকে দেখল। তারপর বাইরে বেরিয়ে এল।

জয়তী বলল, আমি ওঁর কাছে গিয়ে বসব?

গৌরব বলল, বেশি হাঁটাচলা করলে ঘুম ভেঙে যেতে পারে।

মলি জয়তীর দিকে তাকাল, ওঁর ঘুম ভেঙে যাওয়ার সময় হয়েছে। আমি নার্সকে বলছি আবার ইঞ্জেকশন দেবার আগে আমাদের যেন খবর দেন। যন্ত্রণা যদি হয়ও একটু জ্ঞান নিশ্চয়ই থাকবে।

জয়তীর মা মেয়েকে বললেন, তাহলে না যাওয়াই ভালো।

মলি বলল, কী থেকে কী হয়ে গেল বলো তো? কাল রাত্রেও আমার সঙ্গে বসে বিয়ের ব্যাপারে কত কথা বললেন। আমি ঠাট্টা করলাম, ছেলের বউকে নিয়ে আমেরিকায় ছেলের বাড়ি দেখে আসুন।

জয়তীর মা বললেন, এই তো জীবন। আগে থেকে যদি বোঝা যেত।

এই সময় নার্স বারান্দায় এসে চাপা গলায় বলল, ওঁর সেন্স ফিরছে।

সৌরভ বেরিয়ে এসেছিল, শোনামাত্র সে আগে ছুটল।

সরলা মাথা এপাশ ওপাশ করছেন। যন্ত্রণার চিহ্ন স্পষ্ট ওঁর মুখে। সৌরভ ওঁর পাশে গিয়ে বলল, মা মা, জয়তী এসেছে।

সরলা চোখ খুললেন। সঙ্গে সঙ্গে একটা ককানি ছিটকে এল ওর গলা থেকে, মাগো! ওঃ বাবাগো!

নার্স বলল, আপনারা যা করার তাড়াতাড়ি করে নিন। আমি এখনই ইঞ্জেকশন দেব। পেইন বাড়ছে।

যন্ত্রণা কাতর সরলা বললেন, এখানে কেন? আমাকে বাগানে নিয়ে চল। গাছপালার কাছে নিয়ে চল।

এখানে তোমার অসুবিধে হচ্ছে মা?

হ্যাঁ। নিশ্বাস নিতে পারছি না। ওঃ, আমাকে বাইরে নিয়ে চল। বাগানে নিয়ে চল। মাগো। ছটফটানি প্রবল হলো।

গৌরব বলল, দাদা, মাকে বাগানে নিয়ে চলো। বাগান মায়ের খুব প্রিয় জায়গা। ওখানে কিছুক্ষণ থাকলে হয়তো মন ভালো হবে।

নার্স আপত্তি করল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরলাকে সযত্নে বাইরে বের করে আনা হলো। বাগানে একটা সোফা পেতে তাতে শুইয়ে দেওয়া হলে কিছুক্ষণের জন্যে কাতরানি বন্ধ হলো। সরলা কাঙালের মতো চোখ ঘুরিয়ে চারপাশের গাছপালা দেখতে লাগলেন।

মলি ছুটে গেল ভেতরে, টেলিফোন করতে। সৌরভ সরলার পাশে হাঁটু গেড়ে বসেছিল। এবার ডাকল, মা কেমন লাগছে?

সরলা যেন প্রশ্নটা শুনতেই পেলেন না। তার চোখ গাছপালার ওপর কেবলই ঘুরতে লাগল। সৌরভ আবার ডাকল, মা। জয়তী এসেছে। জয়তী।

এবার সরলা যেন বুঝতে পারলেন। মুখ ঘোরালেন পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা জয়তীকে ডেকে সামনে নিয়ে এল সৌরভ। জয়তীর মুখের দিকে তাকিয়ে যেন হাসার চেষ্টা করলেন সরলা। সৌরভ বলল, ওদের বিয়ের আগে তুমি কি আশীর্বাদ করবে?

মাথা ঝুঁকিয়ে হ্যাঁ বললেন সরলা। তারপর বিপরীত দিকে মুখ ফেরালেন। উঠে দাঁড়াল সৌরভ, গোরা এদিকে আয়। মলি কোথায়? মাসীমা আপনি আগে বলুন তো এই আশীর্বাদে ধান, দুর্বো লাগে নাকি? নিয়মটিয়ম কী?

কিছু লাগবে না বাবা। জয়তীর মা আঁচল মুখে তুলেছিলেন, আশীর্বাদ করলেই হয়ে যাবে। কিন্তু এবার ওঁর মুখে রোদ লাগছে যে।

এতক্ষণ আকাশে কুচি কুচি মেঘেরা ভেসে ছাতা হয়ে ঝুলছিল। ফলে পৃথিবীটা ছিল ছায়ায় ঢাকা। এখন সেই ছাতা সামান্য সরেছে। নার্স মহিলাটি অসহায় হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। এবার বললেন, কী করবার করে নিন, আমি আর এখানে ফেলে রাখতে চাই না। ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘরে নিয়ে যাব।

আর তখনই যন্ত্রণাটা বাড়ল। সমস্ত শরীর উথাল পাথাল। নার্স একটুও বিলম্ব না করে ইঞ্জেকশন দিয়ে দিলো সরলার শরীরে। তখনও নার্ভগুলো শিথিল হয়নি। সৌরভ আবার বসে পড়ল সামনে, মা, আশীর্বাদ করবে না?

সরলার ডান হাত সামান্য উঠল। কিন্তু সেটা আশীর্বাদ করার ইচ্ছায় না যন্ত্রণার কারণে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। নার্স তাগাদা দিচ্ছিলেন ওঁকে ঘরে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। হঠাৎ জয়তী কেঁদে উঠল। কেন কান্না জানতে অথবা ওকে সান্ত্বনা দেবার মতো মানসিকতা তখন কারো ছিল না। সরলাকে আবার ঘরে ফিরিয়ে নেওয়া হলো। ঘুমিয়ে পড়েছেন তিনি। শ্যামল এল ঘণ্টাখানেক বাদে। সব শুনে বলল, তোমরা ভেবে দ্যাখো, ওঁকে নার্সিংহোমে শিফ্ট করবে কিনা?

গৌরব বলল, যদি সেখানে একটু আরাম পায় তবে তাই করা উচিত।

আরাম পাচ্ছেন কি না তা আমরা বুঝব কি করে? ঠিক আছে। এখানেই থাকুন। তবে এখন থেকে উনি যা চাইবেন তাই করতে যেও না। আমি একটু দেখে আসি। শ্যামল চলে গেল সরলার ঘরে।

মলি বলল, নার্সিংহোমে নিয়ে গেলে যদি অক্সিজেন দরকার হয় তা পাওয়া যাবে। মানে সমস্ত মেডিক্যাল হেল্প পেতে অসুবিধা হবে না। এখানে–।

সৌরভ মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কী বলো জয়তী?

জয়তী মলির দিকে তাকাল, মলিদি বোধহয় ভুল বলেননি। আর সব পেলেও এখানে তো চব্বিশঘন্টা ডাক্তার পাওয়া যাবে না।

সৌরভ গৌরবকে বলল, শ্যামলকে বল ব্যবস্থা করতে! গৌরব চুপচাপ দেওয়ালের দিকে তাকিয়েছিল। কথাটা শুনেও ওঠার কোনো চেষ্টা করল না। কেমন একটা অবসাদ সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। মায়ের এই অবস্থায় আর যাই হোক বিয়ে করা যায় না। মায়ের জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত তো নয়। কথাটা বলার জন্যে সোজা হয়ে বসতেই শ্যামলকে দেখা গেল। মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। মুখ গম্ভীর। মলি জিজ্ঞাসা করল, ঘুমিয়ে পড়েছেন?

হ্যাঁ। এ জন্মের মতো। ভাঙা গলায় বলল শ্যামল।

হো-য়াট? চিৎকার করে উঠল সৌরভ।

ঘুমের মধ্যেই উনি চলে গেছেন। শি ইজ এক্সপায়ার্ড!

শ্যামলের কথা শেষ হওয়া মাত্র দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বনি ডুকরে কেঁদে উঠল। এতক্ষণ এই দুটি বালক বালিকার অস্তিত্ব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। বনির কান্না কানে যাওয়া মাত্র সৌরভ ছুটে গেল মায়ের ঘরে। মলি দুহাতে মুখ ঢেঁকে ফুঁপিয়ে উঠল। কান্না আসছিল না কিন্তু অদ্ভুত এক শূন্যতা চারপাশ থেকে ধেয়ে এসে তাকে তুলে নিয়ে যেন লোফালুফি করতে লাগল।

শ্যামল যে তার কাঁধে হাত রেখেছে এটাও টের পেল না সে। শ্যামল সেটা বুঝতে পেরে ওকে আবার সোফায় বসিয়ে দিল। গৌরব তখনই যেন মাটিতে ফিরল। মুখ দুমড়ে মুচড়ে কান্না আসছিল তার। এই সময় শ্যামলের কথা কানে এল, উনি ভাগ্যবতী। আর কিছু না হোক এই যন্ত্রণা বেশিক্ষণ ওঁকে সহ্য করতে হয় নি। ওঁর হার্ট বিকল হয়েছে। গৌরব, এটা যে কী ভালো হলো এই মুহূর্তে তোমরা বুঝবে না। চোখের সামনে দিনের পর দিন ওঁকে যে নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হতো তা তোমাদের কাছে সহ্য করা অসম্ভব। তার চেয়ে এই ভালো হলো।

মায়ের ঘর থেকে সৌরভের চিৎকার ভেসে আসছিল। মানুষের কান্না যখন বাঁধ মানে না তখনই অমন আওয়াজ হয়। গৌরব আর শ্যামল ছাড়া সবাই ততক্ষণ মায়ের ঘরে।

শ্যামল বলল, এবার তোমাদের উচিত আত্মীয়স্বজনদের খবর দেওয়া।

গৌরব কিছু বলল না। ধীরে ধীরে মায়ের ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। সবাই এমন ভিড় করে আছে যে দরজায় দাঁড়িয়ে দুটো পা ছাড়া সে কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না।

.

মায়ের কাজের ব্যাপারে একমত হয়েছিল গৌরব আর সৌরভ। কয়েক সপ্তাহ আগে এক রাত্রে সরলা গল্প করতে করতে বলেছিলেন, আমি মরে গেলে তোদের কয়েকটা কাজ করতে হবে।

বাজে কথা নিয়ে আলোচনা করব না। গৌরব বলেছিল।

সরলা হেসেছিলেন, এখন বাজে কথা বলে মনে হলেও এটা তো সত্যি হবেই। আচ্ছা, কী কী করতে হবে না তাই বলি। শ্রাদ্ধের পর বাড়িতে আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের ডেকে নেমন্তন্ন খাওয়াবি না। যাদের সঙ্গে কালেভদ্রে দেখা হয়, খোঁজ নেবার দরকার মনে করে না যারা, তাদের ডেকে খাওয়ানোর কোনো দরকার নেই। ওতে আমি কষ্ট পাব।

সৌরভ জানতে চাইল, আর?

সরলা বললেন, আর পুরুত ডেকে আমার শ্রাদ্ধ করাবি না।

সৌরভ হেসেছিল, তুমি তো হিন্দু।

মরে যাওয়ার পরে হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টানদের কী হয় তা তো কেউ জানে না। কিন্তু কয়েকটা শেখা মন্ত্র আউড়ে পুরুত আমার আত্মাকে উদ্ধার করবে এ আমি বিশ্বাস করি না। সারা জীবনে তো মন্ত্র শুনলাম না।

সরলার মৃত্যুর তিনদিন পরে এসব কথা উঠলে মলি প্রথম আপত্তি করেছিল, তখন ওঁর যা মনে হয়েছিল তাই বলেছিলেন। সেসব ধরতে হয় নাকি? আমি যদি বলি মরে যাওয়ার পরে আমার ছাই মানস সরোবরের জলে গিয়ে বিসর্জন দেবে তবে সেটা সম্ভব হবে? বাস্তব বলে একটা কথা আছে। আত্মীয়স্বজন কী বলবে? আমার বাড়ির লোকজন? সবাই বলবে পয়সা বাঁচাবার জন্যে এসব করছ তোমরা?

সৌরভের মনে একটু অস্বস্তি ছিল কিন্তু সে গৌরবকে বলতে শুনল, কে কী বলছে তাতে কান দেওয়া দরকার নেই। মায়ের কথাই শেষ কথা। যদি তিনি মানস সরোবরের কথা বলতেন আমি যেতাম। তাছাড়া, আমার মনে হয় শ’তিন চার আত্মীয় বন্ধু এবং কিছু ব্রাহ্মণ এসে গাণ্ডেপিণ্ডে হৈ-চৈ করে চব্যচষ্য খেলে মায়ের আত্মা মোটেই শান্তি পাবে না। খেতে বসে মানুষ যেমন আচরণ করে তাতে বিয়ে বাড়ি আর শ্রাদ্ধবাড়ির মধ্যে পার্থক্য থাকে না। আমার মায়ের মৃত্যুতে কেউ আনন্দ করে খাচ্ছে এ আমি সহ্য করতে পারব না।

সৌরভ মাথা নাড়ল, ও ঠিক কথা বলছে। আমিও একমত। আমরা কাউকে নেমন্তন্ন করব না। মাদার টেরেসা আর ভারত সেবাশ্রমে গিয়ে টাকাটা দিয়ে আসব। কিছু মানুষের উপকার যদি ওঁরা ওই টাকায় করতে পারেন, তাহলে মা অনেক বেশি শান্তি পাবেন।

তোমাদের মা, তোমরা যা ভালো বোঝো তাই হবে।

তুমি মা বলতে ওঁকে। সৌরভ মনে করিয়ে দিলো।

 তাহলে অন্তত কাঙালি ভোজন করাও।

গৌরব বলল, সেটা করা যায়। কিছুনা খেতে পাওয়া মানুষকে একটা দিন পেট ভরিয়ে খাওয়ানো যায়। কথাটা খারাপ বলেনি।

সৌরভ বলল, আর পুরুতটুরুত যজ্ঞ এসবের কোনো দরকার নেই। মা গান ভালবাসতেন। সেদিন ভালো শিল্পীকে বাড়িতে এনে গান বাজনা করা হবে।

 মলি অবাক হলো, গান বাজনা? কি গান? কীর্তন?

গৌরব বলল, খুব ভালো আইডিয়া। না কীর্তন নয়, রবীন্দ্রনাথের গান। রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরকে নিয়ে ভালো গান আছে। আমার মনে হয় ওই পরিবেশে মায়ের খুবই ভালো লাগবে। এটাই করা যাক।

মলি আপত্তি করল না। কাঙালি ভোজনের প্রস্তাবটা মেনে নেওয়ায় সে খুশি হয়েছিল। যদিও এই ব্যবস্থাটায় তার মনে অস্বস্তি রয়েই গেল।

মায়ের কাজের দিন প্রায় না বলতেই জনা তিরিশেক মানুষ এসে গেলেন। তাদের মধ্যে এমন অনেকে ছিলেন যাঁরা এই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছিলেন না। কিছু মানুষ কাজের অছিলায় ফিরে গেলেন। একজন, গৌরবের মাসীমা সরাসরি সমালোচনা করলেন। এতে তার দিদির আত্মার কোনোদিন মুক্তি পাবে না। শ্রাদ্ধ এবং পিণ্ডি না দিলে আত্মা ঘুরে ঘুরে পাক খাবে আর নরক যন্ত্রণা ভোগ করবে। তিনি নিজে পুরুত আনানোর উদ্যোগ নিলেন। দেখা গেল কেউ কেউ তাঁকে সমর্থন করছেন। গৌরব এগিয়ে এল, মাসীমা আপনি কবে ফিরে এলেন?

মানে? আমি আবার কোথায় গেলাম যে ফেরার কথা বলছিস?

বাঃ এই যে বললেন মায়ের আত্মা ঘুরে ঘুরে পাক খাচ্ছে আর নরক যন্ত্রণা ভোগ করছে। সেখানে গিয়ে দেখে না এসে নিশ্চয়ই আপনি এত বিস্তারিত রিপোর্ট দিতে পারতেন না। গৌরব হাসল।

ও। তুই আমার সঙ্গে রসিকতা করছিস? বেঁচে থাকতে মেরে ফেলছিস? খুব অহংকার হয়ে গিয়েছে তোর আমেরিকায় গিয়ে না?

সৌরভ শুনছিল এতক্ষণ, এবার বলল, মাসীমা আমি কিন্তু আমেরিকায় যাইনি কিন্তু আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে মৃত্যুর পরের জগতটা সম্পর্কে আপনি খুব অভিজ্ঞ। দেখুন, আমরা তো কিছুই জানি না। আন্দাজে একটা কিছু বানিয়ে বলে কী লাভ। মা যা জীবিতকালে ভালবাসতেন। আমরা তাই করছি। যার এসব পছন্দ হবে না তিনি নাও থাকতে পারেন।

তুই আমাকে চলে যেতে বলছিস?

আপনার স্বাধীনতা আছে।

অপমান করলি তবু আমি যাব না। তোর মা আমার দিদি। আমি দেখতে চাই তোরা দিদির কী কাজ করলি। মাসীমা হলঘরের কার্পেটে বসে পড়লেন। আজ এই ঘর থেকে সমস্ত টেবিল চেয়ার সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘরের এক প্রান্তে টেবিলের ওপর সাদা চাদর পেতে ফুলের মালায় সরলার ছবি সাজিয়ে রেখেছে ওরা। ছবিতে তিনি হাসছেন। স্নেহ-প্রশ্রয়ের হাসি। গান শুরু হলো। কলকাতার এক পরিচিত রবীন্দ্রসঙ্গীতের গায়ক একটার পর একটা গান পূজা পর্ব থেকে গেয়ে গেলেন। শেষ গান, নয়ন ছেড়ে গেলে চলে শুরু হওয়া মাত্র গৌরব উঠে বাইরে এসে দাঁড়াল। কেমন একটা চাপ আসছে বুকের ওপরে। নিশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে। তবু তার মনে হচ্ছিল মা শান্তি পাচ্ছেন। তার আত্মা এতে তৃপ্তি পাচ্ছে। সে বাগানের দিকে তাকাল। মায়ের হাতের স্পর্শে বড় হয়ে ওঠা গাছগুলো এখন বাতাসে দোল খাচ্ছে আদুরে ভঙ্গীতে।

গেট খুলে একটি লোক ঢুকছিলেন। সম্ভবত মায়ের জন্যেই আসছেন বলে ভাবল গৌরব। কাছাকাছি হতেই বুঝতে পারল ইনি পোস্ট অফিস থেকে আসছেন। ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, গৌরব বসু এখানে থাকেন?

হ্যাঁ। আমিই গৌরব।

আচ্ছা। আপনার একটা রেজিস্টার্ড লেটার আছে। ব্যাগ খাতা বেছে নিয়ে খাতা বের করে এগিয়ে ধরলেন ভদ্রলোক। সই করে চিঠি দিলেন পিওন। তারপর কান খাড়া করে গান শুনলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, গানটান হচ্ছে।

গান হচ্ছে। আমার মা খুব ভালবাসতেন।

আপনার মা? মানে, এ বাড়ির সরলাদেবী?

হ্যাঁ।

বাসতেন মানে? উনি—

 নেই।

সেকি। উনি মারা গিয়েছেন? কী করে? এই তো কয়েক মাস আগে আমার সঙ্গে ওখানে দাঁড়িয়ে কথা বললেন। ভদ্রলোক হতভম্ব। সেটা কোনোমতে সামলে উঠে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি একটু ভেতরে যেতে পারি?

অবশ্যই যান। সরে দাঁড়ালেন গৌরব। মাথা নিচু করে পিওন জুতো খুলে বসার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। এই ভঙ্গিটা ভালো লাগল ওর। ভেতর থেকে না এলে এমনভাবে হাঁটতে বড় অভিনেতা হতে হয়।

খামের ওপর ছাপা ঠিকানা দেখে হাসি ফুটল গৌরবের মুখে। মুখটা ছিঁড়ে চিঠি বের করতেই অনুমান মিথ্যে হলো না। তার ইন্টারভিউতে সন্তুষ্ট হয়ে কোম্পানি তাকে চাকরি দিচ্ছে! এক বছর পরে কনফার্ম করবে। মাইনেপত্র ইত্যাদির বিস্তৃত আলোচনার জন্যে তাকে অবিলম্বে দেখা করতে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে কোম্পানি তার কাছে লিখিত একটা প্রতিশ্রুতি চাইছে যে যোগ দেবার দুবছরের মধ্যে সে কোম্পানি ছেড়ে যাবে না।

গতকাল বিশেষ প্রয়োজনে ওই অফিসের সামনে দিয়ে যেতে হয়েছিল তাকে। গৌরব দেখেছিল বেলা বারোটার সময় অফিসের বারান্দায় সতরঞ্চি পেতে জন বারো মানুষ বসে আছে। তাদের মধ্যে চারজন তাস খেলছিল। পেছনে ফেস্টুন টাঙানো ছিল, কোম্পানি এবং তাঁদের ইউনিয়ন নিপাত যাক। তার মনে হয়েছিল এরা ওই অফিসের কর্মী। বেলা বারোটায় বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন শান্তিপূর্ণ ভাবে। ঠিক কথা। অত্যাচারিত হলে এটা করার অধিকার সবার আছে। কিন্তু কর্মীরা কি তাদের কাজ থেকে আইনসম্মত ছুটি নিয়ে ওখানে বসে আছেন? যদি তা না হয়, যদি অফিসে এসে খাতায় সই করে ওঁরা ওখানে বসে প্রতিবাদ জানান তাহলে আগামীকাল আর একদল কর্মী একই কাজ করতে পারেন। কর্তৃপক্ষের যদি ব্যবস্থা নেবার ক্ষমতা না থাকে তাহলে কোম্পানির ভিত ধ্বসে পড়তে বাধ্য। আজকের চিঠিটার মর্ম হলো তাকে ওই কোম্পানিতে চাকরি করতে যেতে হবে। ইন্টারভিউ-এর সময় যে সমস্ত ইউনিয়ন নেতা বাধা দিতে এসেছিলেন তাদের মন যুগিয়ে অথবা বিরোধিতা করে চলতে হবে। দ্বিতীয়টি করলে দুবছর কেন, দুমাস কাজ করা অসম্ভব সেটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না।

তুমি এখানে?

চমকে মুখ ফেরাল গৌরব। জয়তী এসে দাঁড়িয়েছে। এখনও চোখের কোণ ভেজা। গলার স্বর থমথমে।

হুঁ। জয়তী, তোমার সঙ্গে আমার কথা ছিল।

 কী কথা?

এখানে এভাবে বলা যাবে না। চলো হাঁটি।

কি আশ্চর্য। ভেতরে অনুষ্ঠান শেষ হয়নি, সবাই বসে আছেন, এখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে কী ভাববে বলো তো?

আচ্ছা। বেশ বাগানে চলো। বাড়ির মধ্যেই থাকা যাবে।

এই অনুরোধ উপেক্ষা করল না জয়তী। ওরা ধীরে ধীরে বাগানে এসে দাঁড়াল। হাওয়ায় গাছের পাতা ডাল নড়ার শব্দ হচ্ছে। কেমন সুন্দর ছিমছাম সবুজ চারধারে। জয়তী জিজ্ঞাসা করল, কী বলবে?

খামটা দেখাল জয়তীকে গৌরব, ইন্টাভিউ দিয়েছিলাম, আজ এই অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার এসেছে। পড়ে দেখবে?

জয়তী উজ্জ্বল মুখে হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিল। পড়ে বলল, কনগ্রাচুলেশন।

 কিন্তু আমার মন চাইছে না এখানে চাকরি করতে।

 কেন?

এখানকার কাজের আবহাওয়ার সঙ্গে আমি বোধহয় খাপ খাইয়ে নিতে পারব না। সব ব্যাপারে এত মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

চাকরি করতে হলে কিছু কিছু মেনে নিতেই হয়।

সেটা জানি। কিন্তু চারপাশের মানুষগুলো যদি কোনো না কোনো অজুহাতে ঝামেলা তৈরি করার জন্যেই চাকরি করেন তাহলে? আমি একতরফা দোষ দিচ্ছি না। হয়তো মালিক পক্ষের আচরণ ওঁদের ইন্ধন যোগাচ্ছে।

জয়তী একটু চুপ করে রইল। তারপর বলল, তোমার যা ভালো লাগে করো।

 গৌরব নিশ্বাস ফেলল, এখন আর আমার কি ভালো লাগবে? কিচ্ছু না।

আমি থাকতেও না? জয়তী অজান্তে প্রশ্নটা করে ফেলল।

জয়তীর মুখের দিকে তাকাল গৌরব, সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। মা বেঁচে থাকলে তুমি আজ এ বাড়িতে থাকতে। একটা মৃত্যু–!

এটা আমার প্রশ্নের উত্তর হলো না।

গৌরব হাসল, মা চলে যাওয়ার পর তুমি এমন প্রশ্ন করতে পারছ?

মানে?

এই সময় পিওন ভদ্রলোকটি চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলেন। কোনো দিকে না তাকিয়ে বাগানটা পেরিয়ে গেট খুলে আবার বন্ধ করে চলে গেলেন। ওরা চুপচাপ মানুষটির যাওয়া দেখল।

গৌরব বলল, তোমার জন্মদিন এসে গেল।

জয়তী কথা বলল না। গৌরব জিজ্ঞাসা করল, ওই দিন কি আমরা বিয়ে করতে পারি? ওই দিন?

জয়তী মাথা নামাল, তোমার যা ইচ্ছে।

 কিন্তু জয়তী মা চলে গিয়েছেন কদিন আগে, ওঁর ইচ্ছে ছিল আমাদের বিয়েটা দেখে যেতে, সেটা হলো না। আমার তাই একদম ইচ্ছে নেই কোনো বড় আয়োজন করার। লোকজন নেমন্তন্ন করে খাওয়ানোর কোনো বাসনা হচ্ছে না।

বুড়ো বয়সে বিয়ে করছি, ওগুলো তো বাহুল্য।

 বুড়ো বয়স?

নয় তো কী।

কিছুক্ষণ চুপচাপ। এবার গৌরব বলল, এই কয়েক মাসে এখানকার জীবন নানাভাবে দেখলাম। হয়তো পৃথিবীর সব দেশেই মানুষ মানুষের সঙ্গে এমন আচরণ করে থাকে। বিদেশে থাকতে ভাবতাম দেখে ফিরে গিয়ে সবাইকে নিয়ে বেশ হৈচৈ করে থাকব। দেশে সবাই বেশ মজায় আছে। এখানে এসে দেখলাম যে যার মতো এক একটা গর্ত করে তার মধ্যে ঢুকে রয়েছে। আমার দাদার সঙ্গে আত্মীয়স্বজন কারো সম্পর্ক নেই। ওর মতো প্রায় সবাই। এ কলকাতায় না থেকে বুলগেরিয়ায় থাকলেও ওর কোনো অসুবিধা হতো না। এই চাকরি নিয়ে আমি এমনভাবে থাকতে পারি যাতে কারো সঙ্গে সম্পর্ক না থাকে। বড় আশা ভঙ্গ হলো, জানো!

আমেরিকার অফিসে তোমার ছুটি আর কত দিন?

যা নিয়েছিলাম তা শেষ। এখানে এসে বারংবার এক্সটেন্ড করে যাচ্ছি। আর করা যাবে না।

কী করবে তাহলে?

দ্যাখো, যদি ভারতবর্ষে পাকাপাকি থেকেও যাই তবু একবার ওখানে যেতেই হবে। বারো বছরে অনেক দায় জমিয়ে ফেলেছি।

গৌরব, তুমি ওখানে স্বচ্ছন্দ?

হ্যাঁ। কারণ কাজের সময় মনের ওপর চাপ পড়ে না। কিন্তু কাজের বাইরে নিজেকে ভীষণ একা লাগে।

আমি যদি সঙ্গে থাকি?

তুমি? তুমি আমার সঙ্গে যাবে?

একদিন নিজের অহঙ্কার নিয়েছিলাম। এই বাগানে মা যখন আমাদের আশীর্বাদ করলেন তখন থেকে এসব ধুয়েমুছে গিয়েছে গৌরব।

তাহলে?

যদি তুমি আমাকে নিয়ে যেতে চাও আমি যাব। যদি তোমার মনে হয় আমাকে নিয়ে ওখানে ভালো আছ তাহলে তাই থাকব। আজ নিউইয়র্ক আর কোলকাতার কোনো ব্যবধান নেই। তুমিই তো একথা বলেছ।

কিন্তু তোমার মা?

আমি জানি না। বিয়ের পর আমি এ বাড়িতে এলে ওখানে একা থাকবেন। আমি হয়তো সপ্তাহে দুতিনদিন দেখতে যাওয়ার সময় পাব। মনে রেখো, শুধু দেখতে যাওয়া। অর্থাৎ আমি বাইরের মানুষ হয়ে যাব।

তা ঠিক। তবু তো এক শহরে থাকলে খবর পেলেই ছুটে যেতে পারবে। বিপদের সময় পাশে দাঁড়ানো সম্ভব।

এটা কোনো কথা হলো? বিপদ আসার আগে যদি প্রতিরোধ না করতে পারি তাহলে বিপদ চলাকালীন পাশে দাঁড়িয়ে আমি কি শান্তি পাব?

জয়তী!

বলো?

উনি যদি আমাদের সঙ্গে যান?

 মানে?

 তোমার মাকে যদি আমার প্রয়োজন হয়? আমি যদি নিয়ে যেতে চাই?

এমন কাজ করো না যা তোমাকে পরে আফসোস করাতে পারে।

আমি ভেবেচিন্তেই কথা বলেছি।

বেশ। মায়ের সঙ্গে কথা বলো।

গৌরব জয়তীর হাত আঁকড়ে ধরল। এক মুহূর্তে নিঃশব্দে যেন অনেক কথা বলা হয়ে গেল। এইসময় বাড়ির ভেতর থেকে মানুষজন বেরিয়ে এল। অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গিয়েছে। মাসীমা চুপচাপ বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। সবাই কথা বলছে।

গৌরব বলল, চলো, এখন আমাদের যাওয়া উচিত।

 জয়তী বলল, সবাই এভাবে দেখলে কী ভাববে?

গৌরব হাসল, কী আবার ভাববে। আজ মায়ের কাজের দিনে তার সব চেয়ে বড় ইচ্ছেটা পূর্ণ করতে আমরা একমত হলাম। এতে কে কী ভাবল তা আমি মোটেই কেয়ার করি না। তুমি করো?

জয়তী উত্তর দিলো না। তারপর হাত ছাড়িয়ে বলল, চলো।

জবাব দিলে না যে!

আমরা কিন্তু নিজেদের ইচ্ছে প্রথমে পূর্ণ করলাম না। মা এই ইচ্ছেটাকে সমর্থন করেছিলেন, তাই না?

তাই।

ওরা দু’জন পাশাপাশি আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের দিকে এগিয়ে চলল।

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার