রাতে জঁ শার্ল বারথেয়ার খাওয়াবে আমাকে। জিল চলে গেছে জিলের বান্ধবীর বাড়ি। সে ক্লান্ত। বারথেয়ার, দোমিনিক আর আমি মোঁপারনাসে ক্লজারি দ্যা লিলা নামের একটি বিখ্যাত রেস্তোঁরায় খেতে গেলাম। এটি বিখ্যাত এই জন্য যে, এখানে একসময় কবি সাহিত্যিক শিল্পীরা আড্ডা দিতেন। উনিশ শতকের শুরুর দিকে আমেরিকায় মদ নিষিদ্ধ করার ফলে অনেক আমেরিকান লেখক প্যারিসে চলে এসেছিলেন। তাঁরা এই বাধানিষেধহীন স্বপ্নপুরীতে বসে মহানন্দে মদ খেতেন। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তো এই রেস্তোরাঁয় বসে পুরো একটি বই লিখেছেন। প্যারিসে এরকম বহু ক্যাফে আছে, যেখানে শিল্পী সাহিত্যিক দার্শনিকরা ক্যাফে সংস্কৃতির শুরু করেছিল।

রেস্তোরাঁটিতে দেখছি ছেলেমেয়েরা মদ খাচ্ছে, পরস্পরকে জড়িয়ে ধরছে, চুমু খাচ্ছে। কেউ ওদের দিকে তাকাচ্ছে না। আমি তাকাই। চোখ মেলে দেখি সব। কি চমৎকার পরিবেশ। ইচ্ছেগুলোকে কেউ দমন করছে না। চুমু খেতে ইচ্ছে করছে, খাচ্ছে। চোখ কপাল কুঁচকে মুখে রাগ ঘৃণা হিংসা নিয়ে বসে থাকা ঝগড়া করা মানুষ দেখার চাইতে তো হাসি মুখের খুশি মুখের প্রেম দেখা চুমু দেখা অনেক ভাল। মন ভাল হয়ে যায়। পৃথিবীকে বড় সুন্দর মনে হয়। দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয়।

বরফের থালায় আমাদের জন্য ঝিনুক এল। দেখে আঁতকে উঠি। কি রে বাবা ঝিনুক খাবে কে! বারথেয়ার আর দোমিনিক ওয়াও ওয়াও বলে একের পর এক ওগুলো খেতে শুরু করল। ভেবেছিলাম ওয়াও শব্দটির পর বলবে কি বাজে। কিন্তু বলল ওয়ান্ডারফুল। কি করে এই বিদঘুটে জিনিসটি ওয়াণ্ডারফুল হয় জানি না। বহু কষ্টে গলায় উঠে আসা বমি আটকে রাখি। দুজনই আমাকে সাধাসাধি করে খেতে। আমি সোজা না বলে দিই। আমার না এ কাজ হয় না। দোমিনিক আমাকে যে করেই হোক ঝিনুকের স্বাদ নেওয়াবেই। আমার চোখ বন্ধ করল ওরা, নাক বন্ধ করল, এরপর মুখটি হাঁ করিয়ে ঢুকিয়ে দিল একটি আস্ত ঝিনুক। গলা বেয়ে সুরসুর করে চলে গেল জিনিসটি, যেন কারও একদলা থিকথিকে সর্দি গিলে ফেললাম। বারথেয়ারের অনেক খরচ হয়ে গেল এই রেস্তোরাঁয়। আমি টাকা দিতে চাইলে, বারথেয়ার আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তোমার বই অনুবাদ করার জন্য ম্যালা টাকা পেয়েছি আমি।

রাত দেড়টায় আমরা বেরোলাম রেস্তোরাঁ থেকে। রেস্তোরাঁ তখনও জমজমাট। প্যারিস কি ঘুমোয় রাতে! আমার মনে হয় না। বিদায় নেওয়ার সময় দোমিনিক আর বারথেয়ার জড়িয়ে ধরে চুমু খেল গালে। একদিনের পরিচয়ে গালে চুমু খাওয়া এ দেশে কোনও ব্যাপারই নয়। দোমিনিক আমাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে যায়। রাতে ভাল ঘুম হয় আমার। আন্তয়ান দ্য গুডমারকে ফোন করেছিলাম। আমি প্যারিসে শুনে খুশিতে চেঁচিয়ে বলল, ইনক্রিডবল। ইনক্রিডবল শব্দটি এরা খুব ব্যবহার করে। ক্রিশ্চান বেসকে ফোন করলেও ও বলেছে, ইনক্রিডবল, তুমি প্যারিসে! সকালে আন্তোয়ান এল হোটেলে। আমাকে নিয়ে কাছেই একটি ক্যাফেতে গেল নাস্তা খেতে। ঝকঝকে রোদ উঠেছে। আন্তোয়ান রোদ দেখে বারবারই বলছে, আহ, কি চমৎকার দিন আজ। কি সুন্দর রোদ!

উফ, রোদ আমার ভাল লাগে না। আমি রোদ থেকে গা বাঁচিয়ে ছায়া ধরে হাঁটি।

কি বল! রোদ ভালবাসো না তুমি!

–নাহ।

–আমাদের এখানে উৎসব শুরু হয়ে যায় রোদ উঠলে। বসন্তের প্রথম রোদ। তুমি যেন তোমার দেশের চমৎকার রোদ এই ঠাণ্ডা মেঘলা স্যাঁতসেঁতে প্যারিসে নিয়ে এলে! তোমাকে ধন্যবাদ।

–রোদ নিয়ে কী ভীষণ উচ্ছাস তোমাদের। আমি রোদের দেশের মানুষ। রোদ আমাদের গা পুড়িয়ে দেয়।

–আমাদের সূর্য ভাল লাগে।

–আমাদের চাঁদ ভাল।

–এখানে রোদ মানে আনন্দ। রোদ মানে সুখ।

–ওখানে রোদ মানে জ্বালা পোড়া, রোদ মানে অশান্তি। ছায়া আমাদের প্রাণ জুড়োয়।

কি পার্থক্য তাই না! আবহাওয়া নিয়েই গুডমার কথা বলল আধঘন্টা। বৃষ্টি ভাল লাগে আমার। বৃষ্টি অসহ্য গুডমারের। মেঘলা দিনকে গুডমার,কেবল গুডমার নয়, এখানকার সবাই, বলে খারাপ দিন। আমি বলি চমৎকার দিন। গুডমার আমাকে তার পত্রিকা দিল, লিবারেশন। এটি ফ্রান্সের বামপন্থী পত্রিকা। লিবারেশনে আমার প্যারিসে আসার খবর ছাপা হয়েছে। গুডমার ঢাকায় গিয়ে আমার যে সাক্ষাৎকার নিয়েছিল, সেটি যে দু পাতা জুড়ে বিশাল করে ছাপা হয়েছিল এ পত্রিকায়, সে লেখাটিও দিল। পত্রিকা খুলে নিজের ছবি আর নাম ছাড়া কোনও কিছু আমার পক্ষে চেনা সম্ভব হয় না। ভাষা রোমান হরফে, কিন্তু ভাষার খুব বেশি কিছু উদ্ধার করতে আমি পারি না। ক্যাফে থেকে হোটেলে ফিরে দেখি ক্রিশ্চান বেস আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। ক্রিশ্চানের বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে, অত্যাধুনিক পোশাক পরা সোনালী চুলের মাদাম, ফরাসি অ্যারিস্টোক্রেট। কিন্তু গাম্ভীর্যের বিন্দু মাত্র কিছু নেই। হই হই করা মানুষ তিনি। চকাশ চকাশ করে দু গালে চুমু খেয়ে তিনি আমাকে কাছের আরেকটি ক্যাফেতে নিয়ে গেলেন নাস্তা খেতে। ক্যাফের ভেতরে যেতে চাইলে না না করে উঠলেন ক্রিশ্চান। বাইরের রোদে বসবেন তিনি। ক্যাফের সামনে রাস্তার ওপরের ফুটপাতে চেয়ার পাতা, ওখানে রোদ পড়েছে, রোদে বসে গুডমারও খেয়েছে, ক্রিশ্চানও খেলেন। প্যারিসের এই হল সৌন্দর্য। গরম শুরু হতে না হতেই ক্যাফে রেস্তোরাঁগুলোর বাইরে পাতা চেয়ার টেবিলে খেতে বা পান করতে কিলবিল ভিড় লেগে যাবে।

লম্বা একধরনের রুটি আছে, ফরাসিরা এই রুটিকে বাগেত বলে। এটি তাদের খুব প্রিয় রুটি। বগলে করে একটি বাগেত নিয়ে লোকেরা রাতে বাড়ি ফেরে। অথবা সকালে ঘুম ঘুম চোখে বেরিয়ে মোড়ের বুলোনজরি থেকে একটি সবে বানানো গরম বাগেত কিনে বগলে করে বাড়ি যায়। বাগেত খেতে আর যে কোনও রুটির মতই স্বাদ। আমি জানি না, কেন ছোট রুটি না বানিয়ে দু হাত লম্বা রুটি বানাতে হয় এদের। ট্রাডিশন বলে একটি ব্যাপার আছে, ফরাসিরা তা সহজে হারাতে চায় না। কত রকম যে রুটি আছে এই দেশে! ক্রিশ্চান সকালে ক্রোসোঁ বলে একটি শঙ্খের মত দেখতে রুটি খাচ্ছেন, সঙ্গে কালো কফি। এই হল তাঁর সকালের নাস্তা। অনর্গল বকতে পারেন তিনি। ইংরেজি বলেন কড়া ফরাসি উচ্চারণে। বার বার করে জানতে চাইছেন আমার ফ্রান্সের প্রোগ্রাম। কবে হবে, কখন হবে, কোথায় হবে, কী হবে — সব তিনি জানতে চান। আমি, সত্যি কথা বলতে কি জানিও না আমার কখন কোথায় কি অনুষ্ঠান আছে। ক্রিশ্চানকে বড় আন্তরিক মনে হয়। দুজন খেয়ে দেয়ে হোটেলে ফিরে দেখি বারথেয়ার অপেক্ষা করছে। মোটা একটি বই এনেছে রবীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রনাথের আঁকা একটি ছবি দেখালো, এটি নাকি লজ্জার পঈচ্ছদ হবে। এরপরই জিল এল আমাকে নিতে। বারথেয়ারকে বিদায় দিয়ে জিল ট্যাক্সি ডাকল, সোজা আমাকে নিয়ে গেল রেডিও ফ্রান্সে। রেডিওতে সাক্ষাৎকার দিতে হল। জিল বলল যে তিন তারিখে রেডিওতে নাকি আমার আরেকটি সাক্ষাৎকার আছে। জিল জানে সব।ও জানে কখন কোথায় আমাকে যেতে হবে। রেডিও থেকে নিয়ে গেল একটি পত্রিকা আপিসে। সুন্দর গোছানো ছিমছাম আপিস। বড়। গাদাগাদি করে বাংলাদেশের পত্রিকা আপিসে যেমন সাংবাদিকরা বসে, সেরকম নয়। ওখানেও সাক্ষাৎকার। এরপর দুজন বেরিয়ে ক্যাফের বাইরে বসে দুপুরের খাবার খেলাম। খেয়ে হোটেলে ফেরার পর দেখি সিগমা নামের ফটো এজেন্সি থেকে ফটোগ্রাফার এসে বসে আছে, ফটো তুলবে আমার। হোটেলে তুলবে না, বাইরে তুলবে। বাইরের রোদে। ফটোগ্রাফার তার গাড়ি করে আমাদের নিয়ে গেল ল্যুভর মিউজিয়ামের সামনের বাগানে। কচি কলাপাতা রঙের সবুজ ঘাসে ফুটে আছে শাদা শাদা ফুল। গায়ে অনেক পাপড়ি। প্রেমিক প্রেমিকারা এই ফুলের পাপড়িগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে একটি খেলা খেলে। পাপড়ি ছেঁড়ে আর বলে, তোমায় আমি ভালবাসি, খুব ভালবাসি, পাগলের মত ভালবাসি, ভালবাসি না। ছিঁড়তে ছিঁড়তে যে পাপড়িটি একদম শেষে গিয়ে ছিঁড়বে সেটিই হবে মনের কথা। ছবির জন্য বিভিন্ন মূর্তির সামনে দাঁড়াতে হচ্ছে, আর আমার থেকে থেকে চোখ চলে যাচ্ছে ফুলের দিকে। বাগানের ভেতর যুবক যুবতী চুমু খাচ্ছে। খাচ্ছে তো খাচ্ছেই। গভীর চুমু। এই চুমুর নামই বোধহয় ফরাসি চুমু। দীর্ঘক্ষণ এত ঘন হয়ে বসে এইযে নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে গভীর করে চুমু খাচ্ছে, খেয়েই যাচ্ছে, তড়িঘড়ি কোনও কর্ম সারার কথা, দেখে মনে হয়, মোটেও ভাবছে না। পাশ দিয়ে এত লোক হেঁটে যাচ্ছে, কেউ একবার ফিরেও তাকাচ্ছে না চুমু খাওয়া জোড়ার দিকে। বাংলাদেশে হলে ভিড় লেগে যেত। জোড়া তো ছাড়াতোই লোকে, দুজনের হাত পায়ের জোড়াও ভেঙে দিত মেরে।

আমরা জোন অব আর্কের ঘোড়ায় বসা সোনালী মূর্তির কাছেই একটি ক্যাফেতে বসি। এও বাইরে। ফটোগ্রাফার ভাল ইংরেজি জানে না। আধো আধো করে বলার চেষ্টা করল কিছু। এখানে, ফ্রান্সে, বেশির ভাগ মানুষই ইংরেজি ভাষাটি জানে না। সভ্য হতে গেলে যে ইংরেজি জানতে হয় না, তা ফ্রান্সে এসে আমার বেশ ভাল করেই বোধ হয়। উপমহাদেশেই এই ধারণাটি বদ্ধমূল, দুশ বছর ইংরেজ শাসনে থেকে এই হয়েছে মানসিকতা। প্রভুর ভাষা শিখে জাতে ওঠার তপস্যা।

সন্ধেটা হোটেলে বিশ্রাম নিতে গিয়ে দেখি ঘুমে ঢলে পড়ছি। কিন্তু অসময়ে ঘুমোলে চলবে কেন! এখানকার সময়ের সঙ্গে আমার শরীরকে মানিয়ে নিতে হবে। রাত নটায় জিল এসে ডেকে নিয়ে গেল। হোটেল থেকেই ট্যাক্সি ডাকে জিল। দু মিনিটের মধ্যে ট্যাক্সি এসে দরজার সামনে দাঁড়ায়। আমরা চলে যাই দূরে কোথাও। ঝলমলে রেস্তোরাঁ এলাকায়। খেতে খেতে দুজন রাজ্যির গল্প করি। বিকেলে ক্রিশ্চান এসেছিল হোটেলে, আমাকে পায়নি। চিঠি লিখে গেছে, যে ভিলেজ ভয়েজ এর এক সময়ের মোস্ট ইম্পর্টেন্ট নারীবাদী লেখক মারিন ওয়ারনার আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে। শুনে জিল বলে, কিছু হলেই বলে ফেলে মোস্ট মোস্ট মোস্ট। ওই লেখকের নাম আমি কখনও শুনিনি। ক্রিশ্চানের সব উচ্ছাসকে জিল বলে, সব টাকার জন্য, সব ব্যবসার কারণে। যারা আন্দোলন করছে, নারীর জন্য লড়াই করছে, বই তাদের দেওয়া উচিত, আদর্শ বলে কথা। ব্যবসায়ী প্রকাশককে তোমার বই দিও না। জিল যখন ক্রিশ্চানের সামনে বলেছিল যে আমাকে স্ট্রাসবুর্গ যেতে হবে, ক্রিশ্চান লাফিয়ে উঠেছিল আনন্দে, জিল ওই আনন্দকেও বলেছে, ছো! সব টাকার জন্য। তোমাকে খুশি করে তোমার কাছ থেকে বই বাগাতে চাইছে। এই উদ্দেশ্য। টাকা টাকা টাকা। জিল হেসে, হঠাৎ বলল, আমি এই নতুন চাকরিতে ভাল করতে পারছি না।

–নতুন চাকরি?

–হ্যাঁ তোমার প্রাইভেট সেক্রেটারির চাকরি।

জিলের মপোলিয়েঁ ফিরে যাবার কথা ছিল। কিন্তু আমার জন্য চার তারিখ পর্যন্ত থেকে যাচ্ছে ও প্যারিসে। রাত তখন সাড়ে বারো। ভিড় উপচে পড়ছে রেস্তোরাঁগুলোয়। ছেলে মেয়েরা হাতে হাত ধরে রাস্তায় হাঁটছে। ঝলমলে আনন্দ চারদিকে। হঠাৎ দেখি নাকের সামনে একটি তাজা লাল গোলাপ। গোলাপটি বাড়িয়ে ধরে থাকা লোকটিকে দেখি। চোখে চোখ পড়ে। লোকটিকে বাঙালি মনে হচ্ছে। ফুল কিনব কি কিনব না তা না জেনেই লোকটি দ্রুত সরে গেল সামনে থেকে। লক্ষ করি, দূর থেকে আবার পেছন দিকে তাকাল আমার দিকে। লোকটি কি চিনতে পারল আমাকে! সম্ভবত! অথবা আমি যে তার দেশ অথবা তার পাশের দেশ থেকে এসেছি, সে সম্পর্কে সে নিশ্চিত। –লোকটি কি বাংলাদেশি! জিল জিজ্ঞেস করে।

–আমার কিন্তু তাই মনে হচ্ছে।

চারদিকে কলকলে আনন্দের মধ্যে, শাদা শাদা হাস্যোজ্জ্বল ফরাসিদের মধ্যে একটি বিষণ্ন বাদামী মুখ, ফুলঅলাটির মুখটি মনে পড়তে থাকে।

–আমার খুব খারাপ লাগে, খুব কষ্ট হয় যখন দেখি আমাদের দেশের ছেলেরা ইওরোপ আমেরিকায় এসে রেস্তোরাঁয় বাসন মাজে, রাস্তায় ফুল বিক্রি করে। শিক্ষিত লোকেরাও সোনার হরিণের সন্ধানে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

জিল চোখ বড় বড় করে বলে, বাহ! খারাপ লাগবে কেন! তুমি তো পছন্দ কর দেশের বাইরে যাওয়া।

বললাম, সে তো বেড়াতে। এরকমভাবে, বাসন মাজতে, ঝাড়ু দিতে, ময়লা পরিষ্কার করতে আমাদের দেশের শিক্ষিত লোকেরা ধনী দেশগুলোয় দৌড়োচ্ছে।

জিল বলল, বোধহয় কাজ নেই দেশে, তাই।

একটু জোরেই বলি, দেশে থেকে কাজ করার জন্য চেষ্টা তো করতে হবে। কাজ যেন পাওয়া যায় দেশে, সেরকম অবস্থা করার জন্য সংগ্রাম তো করতে হবে। যে লোকটিকে দেখলাম, সম্ভবত সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার ডিগ্রি করে এ দেশে এসেছে, এখন ফুল বিক্রি করছে। ফুল বিক্রি করার জন্য কি পদার্থবিজ্ঞান জানার দরকার হয়! মেধাগুলো পাচার হয়ে যাচ্ছে গরিব দেশ থেকে ধনী দেশে। দেশে থেকে দেশের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক অবস্থা পরিবর্তনের জন্য কে তবে চেষ্টা করবে যদি যুব সমাজ কি করে খানিকটা বেশি টাকা কামাবে, সেই কারণে যদি বিসর্জন দেয় সব আদর্শ!

জিল মাথা নাড়ল। সায় দিল আমার কথায়।

কথা ছিল আমি আর জিল নৌকো নিয়ে সেইন নদীতে ঘুরে বেড়াবো। কিন্তু আর ইচ্ছে করেনি সেইনে ভাসতে।

পরদিন উনত্রিশ তারিখ। উনত্রিশে এপ্রিলের ডায়রি আমাকে লিখতে হবে প্যারিসের বিখ্যাত পত্রিকা লা নভল অবজারভেতর এর জন্য। পত্রিকাটির সম্পাদক জঁ দানিয়েল ঢাকায় আমাকে অনেকগুলো ফ্যাক্স পাঠিয়েছেন ডায়রি লেখার জন্য অনুরোধ করে। পৃথিবীর বিখ্যাত সব লেখক ওতে লিখবেন। উনত্রিশ তারিখটি তাঁরা কেমন কাটিয়েছেন, তার বর্ণনা করে। এই দিনটিতেই আমাকে স্ট্রাসবুর্গে যেতে হবে। ক্রিশ্চান সকালেই ফোন করেছিল। শুভসকাল জানিয়ে বললেন কাল আসবেন তিনি আমাকে নিতে আরেকটি টিভি প্রোগ্রামের জন্য। সিগমার আরেকজন ফটোগ্রাফার আবার আসবে। সকালে গরম জলে গোসল করে গোলাপি একটি শাড়ি পরে নিই। প্যারিসে এই প্রথম আমার শাড়ি পরা। শাড়ি পরে শেষ করিনি, নিচ থেকে ফিলিপ ডেমেনএর আসার খবর দেওয়া হল। লা ভি নামে এক পত্রিকার সাংবাদিক এই ফিলিপ। হোটেলের নিচতলায় একটি ক্যাফে আছে, ক্যাফেতে বসি দুজন। নাস্তা খেতে খেতে সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তর দিই। একই রকম প্রশ্ন, একই রকম উত্তর। এর মধ্যে জিল আসে বড় একটি লিস ফুলের তোড়া নিয়ে। কি যে ভাল লাগল চমৎকার ফুলগুলো দেখে। ফুল দেখলেই আমার নাক কাছে নিয়ে ঘ্রাণ নেওয়ার অভ্যেস। লক্ষ করেছি, ফরাসিরা ফুলের সৌন্দর্য দেখে, ঘ্রাণ নেওয়ার জন্য নাক বাড়ায় না তেমন। এখানকার ফুলে ঘ্রাণও খুব কম থাকে। বাণিজ্যিক কারণে ফুল ফোটানো হলে তাতে ঘ্রাণ কোথায় থাকবে! ফিলিপ তখনও যায়নি, এল লা ফিগারো পত্রিকার সাংবাদিক সঙ্গে ফটোগ্রাফার নিয়ে। হোটেলের কাছের রাস্তায় ছবি তুলল ফটোগ্রাফার। আমার হোটেলের নাম মারসেলিয়র অপেরা, অবশ্য যদি আমি উচ্চারণ করি। আমার উচ্চারণ শুনে একটি ফরাসিও বোঝে না কি বলছি আমি। আমাকে বানান করে দিতে হয় হোটেলের নাম। ওরা মাসেই অপেয়া জাতীয় কিছু একটা বলে। ফিগারোর সাংবাদিক মারি এমিলি লোমবার্ড সঙ্গে কথা বলার আমার সময় নেই, কারণ আমাকে যেতে হবে স্ট্রাসবুর্গ। জিল যাচ্ছে না স্ট্রাসবুর্গে, যেহেতু অন্য সাংবাদিকরাও যাচ্ছেন টিভি প্রোগ্রামের জন্য। তাছাড়া মারি এমিলি যাচ্ছে আমার সঙ্গে। জিল বলে দিল, অবশ্যই যেন স্ট্রাসবুর্গের ক্যাথিড্রালটি দেখি। মারি এমিলি আর আমি প্যারিসের অরলি বিমানবন্দর চলে গেলাম। মারিকে পথে জিজ্ঞেস করলাম, তোমারও কি কোনও প্রোগ্রাম আছে টিভিতে?

মারি হেসে বলল, না, আমি কেবলই তোমার সাক্ষাৎকার নেবার জন্য যাচ্ছি। তুমি এত ব্যস্ত যে যদি অন্য সময় সময় না পাও, তাই বিমানে বসে সাক্ষাৎকার নেব। বিমান বন্দরেই পরিচয় হয় আলজেরিয়ার আর ক্যামেরুনের সাংবাদিকের সঙ্গে। ক্যামেরুনের বিশাল দেহী সাংবাদিকটি কিছু ইংরেজি জানলেও আলজেরিয়ার সাংবাদিক একটি ইংরেজি শব্দও বলতে পারেন না। ভেবেছিলাম বিমানের জানালা দিয়ে দেখতে দেখতে যাবো পাখির চোখে ফ্রান্স। কিন্তু মারির প্রশ্নের জ্বালায় তা সম্ভব হয় না। ভেবেছিলাম প্যারিসের বাইরে কোনও এক ছোট মফঃস্বল শহর স্ট্রাসবুর্গ, তেমন আহামরি কিছু দেখতে হবে না। কিন্তু পৌঁছে চারদিক দেখে আবারও বিস্ময় জাগে। নিখুঁত শহর। রূপের কোনও কমতি নেই। দুটো গাড়ি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল বিমান বন্দরে। একটিতে আমি, মারি, আর ক্যামেরুনের সাংবাদিকটি। আরেকটিতে বাকিরা। ক্যামেরুনের লোকটি লম্বা একটি রঙিন আলখাল্লা পরেছে, মাথায় একটি রঙিন টুপিও লাগিয়েছে। বলল, পোশাকটি ক্যামেরুনের মুসলমানদের পোশাক, যদিও সে খ্রিস্টান, এ পোশাক তার ভাল লাগে বলে পরেছে। বিমানে বসে জ্যঁ শার্ল বারথেয়ারের দেওয়া প্যাকেটটি খুলি, সকালেই জ্যঁ শার্ল হন্তদন্ত হয়ে প্যাকেটটি হাতে দিয়ে বলে গেছেন, এটি বিমানে উঠে খুলবে, তার আগে নয়। প্যাকেটের ভেতরে একটি নিনা রিচি নামের সুগন্ধী, আরেকটি চকোলেটের বাক্স। চকোলেটের বাক্সটি কাউকে দিয়ে দেব, চকোলেট আমার পছন্দ নয়। ফরাসিদের তিনটে জিনিস খুব প্রিয়, এবং এই তিনটে জিনিসই আমার একদম সয় না, কফি, চকোলেট, চিজ। ওদের আমি বলেছিও তোমাদের তিনটে জিনিস আমার কাছে অখাদ্য, তিনটিই শুরু সি দিয়ে। নামগুলো বললে ওরা ভিমড়ি খায়। আমাকে আদৌ মানুষ বলে ভাবে কি না কে জানে।

টেলিভিশনের বাড়িটি চমৎকার। আমাদের জন্য ওখানেও অপেক্ষা করছিল অনেকে। একজন হাত বাড়িয়ে বলল, আমি ফ্রেড্রিক গারডেল। ফ্রেড্রিকই তো আমাকে আর্তে টেলিভিশন থেকে আমন্ত্রণ পত্র পাঠিয়েছিলেন। দুজন বাঙালি মেয়ে দেখি গুটি গুটি হেঁটে আসছে আমার দিকে। কাছে এসে বলল, আমরা আপনার অনুবাদক। এতদিন পর কারো মুখে স্পষ্ট বাংলা শুনলাম, মন নেচে ওঠে, কলকল করে আমি বাংলায় কথা বলে উঠি, পাখি যেমন মনের আনন্দে বসন্ত এলে গান গাইতে থাকে, তেমন। প্যারিসে কার মুখে শুনব বাংলা! বারথেয়ার দাবি করছে সে বাংলা জানে। এখনও শোনা হয়নি একটি শব্দও। মেয়ে দুজনকে প্যারিস থেকে টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ আনিয়েছেন। ফ্রেড্রিক ফরাসিতে বলে যাচ্ছেন পুরো অনুষ্ঠানটি কি হবে, কি জিজ্ঞেস করা হবে, কোন কোন তথ্যচিত্র দেখানো হবে মাঝখানে, কে আমাদের প্রশ্ন করবে, সব। দোভাষীদুজন −ফ্রড্রিকের কথাগুলো অনুবাদ করে দিল। দুপুরের খাবারের আয়োজন করা হল ওখানে। খাবার বলতে এক হাত লম্বা একটি স্যান্ডুউইচ। ওটি আমার পক্ষে খাওয়া সম্ভব হয়নি। মেকআপ রুমে নিয়ে যাওয়া হল আমাকে। ওখানে এসে অনুষ্ঠানের প্রযোজক দেখা করে গেলেন। ফ্রেড্রিক আমার জন্য, যেহেতু কফি খাই না, চা নিয়ে এলেন, আর দেখে শুনে ছোট আর নরম রুটির স্যান্ডুউইচ। মেকআপ শেষ হতেই স্টুডিও। আলোয় ফেটে পড়ছিল ঘরটি। এই প্রথম ইউরোপের কোনও স্টুডিওতে বসে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা। দানিয়েল লাকন্ত বসলেন মাঝখানে। দানিয়েল অনুষ্ঠান পরিচালনা করবেন। তাঁর বাঁ পাশে আমি। ডানে আলজেরিয়ার সাংবাদিক। আমার বাঁ পাশে ক্যামেরুনের সাংবাদিক। ক্যামেরুন সরকার যাঁকে সরকারের বিরুদ্ধে লেখার কারণে জেলে পাঠিয়েছিল। আলজেরিয়ার সাংবাদিককে মুসলিম মৌলবাদীরা দিয়েছিল হত্যার হুমকি, গুলিও করেছিল। অবশ্য প্রাণে বেঁচে গেছেন তিনি। একজন কার্টুনিস্ট বসেছেন সামনে। কার্টুন এঁকে যাচ্ছেন আপন মনে। তাঁর আঁকা কার্টুনগুলো আমরা আবার সামনে রাখা মনিটরে দেখতে পাচ্ছি। সবার কানে কানফোন লাগানো আছে। আমার কানফোনে বাংলায় শুনতে পাচ্ছি যারা যে কথাই বলছে। হোবিয়া মিনা বসেছে আমাদের থেকে দূরে, এক কোণে। জার্মানি থেকে এসেছে এক সাংবাদিক, নাম ক্রিশ্চিনা। অনুষ্ঠানের সকলে ফরাসি বলছে। ক্রিশ্চিনা জার্মান বলছে, আমি বাংলা। কিন্তু সবার কথাই আমরা নিজের ভাষায় শুনতে পাচ্ছি। তড়িৎ গতিতে অনুবাদের আয়োজন। ক্রিশ্চিনার আর আমার কথাগুলো ফরাসি ভাষায় অনুবাদ হয়ে যাচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে। প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতা বিষয়ে প্রশ্ন শুরু হল। মাঝে মাঝে তথ্যচিত্র দেখানো হচ্ছে। মেক্সিকোতে এক সাংবাদিক ড্রাগ মাফিয়ার বিরুদ্ধে লিখতে গিয়ে ভয়ংকর অসুবিধেয় পড়েছে, কারণ মেক্সিকোর সরকার ড্রাগ ব্যবসায় জড়িত। মোট তেষট্টি জন সাংবাদিককে সারা বিশ্বে মেরে ফেলা হয়েছে। ১২৪ জন সাংবাদিক হুমকির সম্মুখিন। আলজেরিয়ার সাংবাদিক বলল, ওখানে সাংবাদিকরা মৌলবাদিদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। মৌলবাদিরা যখন তখন যাকে তাকে মেরে ফেলছে। বিশেষ করে সেইসব সাংবাদিকদের যারা মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে লিখছে।

এরপর প্রশ্ন হল, যেহেতু এটি বাক্‌ স্বাধীনতার প্রশ্ন, মৌলবাদীদের স্বাধীনতা থাকা উচিত কি না যা কিছু বলার।

আমি আপত্তি করলাম। বললাম-–‘না, মৌলবাদীদের বেলায় আমি এই ছাড় দিতে রাজি নই। আমাদের দেশের মৌলবাদীরা ধনী আরব দেশগুলোর টাকা পেয়ে এখন অস্ত্রবান হয়েছে। সমাজটাকে নষ্ট করে ফেলছে। দেশজুড়ে এক ভয়াবহ অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছে। মানুষকে বিনা দ্বিধায় মেরে ফেলছে, হাত পায়ের রগ কেটে দিচ্ছে। অবাধে ধর্ম প্রচার করে যাচ্ছে। নিরীহ মানুষগুলোকে ধর্মের বাণী শুনিয়ে বোকা বানিয়ে দলে ভেড়াচ্ছে। একসময় আমাদের দেশে এদের কোনও অধিকার ছিল না রাজনীতি করার। এখন তারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার অধিকার পেয়ে দেশজুড়ে তান্ডব চালাচ্ছে। একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রকে এখন ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য উন্মাদ হয়ে গেছে। ধর্মীয় শিক্ষা ছড়িয়ে ধর্মীয় আইন জারি করে দেশটিকে ধ্বংস করে দিতে চাইছে। সময় থাকতে এই সর্বনাশকে রুখে দাঁড়াতে হবে।’ এরপর আলজেরিয়ার সাংবাদিকের কাছে একই প্রশ্ন রাখা হল। তিনি বললেন, জ্ঞআগে তসলিমার মত এরকম আমাদের দেশেও ভাবা হত। কিন্তু এখন এই ভাবনার পরিবর্তন হয়েছে। আমরা যারা মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছি, তারাই বলছি, মৌলবাদীদেরও স্বাধীনতা থাকা উচিত মত প্রকাশের জন্য। গণতন্ত্রের নিয়মই তো এই।’ আরও অনেকক্ষণ প্রশ্নোত্তর চলল। শেষ প্রশ্নটি আমাকে করা হয়, ফ্রান্স আর জার্মানির বাকস্বাধীনতা নিয়ে এই যে তথ্যচিত্র দেখলে, যেখানে বলা হচ্ছে এখানেও সাংবাদিকরা অনেক কিছু বলছে না বা বলতে পারছে না, কারণ সংবাদপষেনর বিজ্ঞাপনদাতাদের অনুমতি না পেলে সমাজের অনেক অন্যায় সম্পর্কে মুখ খোলা যায় না। এটি আমাদের দেশের তুলনায় কেমন? আমি বললাম, ‘এখানেও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হচ্ছে, অবশ্যই। তবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতা আরও বেশি কম। রেডিও টেলিভিশন সরকারি মালিকানায় থাকায় এগুলো সরকারি প্রচারের জন্য ব্যবহৃত হয়। সংবাদপত্র বেশির ভাগ যদিও ব্যক্তি মালিকানাধীন, তারওপরও কোনও সংবাদপষেন যদি সরকার বিরোধী কিছু প্রকাশ পায়, সরকার সময় সময় তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে,তাদের গ্রেফতার করতে, এমন কী পত্রিকা বন্ধ করে দিতে দ্বিধা করে না। বেসরকারি পত্রিকাগুলোকেও বাঁচতে হয় সরকারি বিজ্ঞাপনে, সুতরাং বিজ্ঞাপনের জন্য অনেক সংবাদপত্রই সরকারি আদেশ মান্য করতে বাধ্য হয়।’

অনুষ্ঠান শেষে জার্মানির ক্রিস্টিনা আমাকে একটি সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য অনুরোধ করল। সময় নেই। অল্প কিছুক্ষণ কথা বলে দৌড়ে অপেক্ষমান গাড়িতে চড়ে বসতে হল। সোজা বিমানবন্দর। ম্যারিও ফিরল প্যারিসে আমার সঙ্গে। আঠার মত লেগে থেকে আমার কিছু কবিতা ফটোকপি করে নিল। ঘুমে আমার শরীর ভেঙে আসছিল। এই হচ্ছে প্রতি বিকেলে। প্যারিসের সময়ের সঙ্গে শরীর খাপ খাইতে চাইছে না। এখনও দেশের সময়ে শরীর নেতিয়ে পড়ছে, শরীর আড়মোড়া ভাঙছে। জিল ফোন করলে বলে দিই, না বাবা, এখন কোথাও যাবো না, ঘুমোবো।

জিলের দশটায় আসার কথা থাকলেও সে তার বান্ধবী নাতালিকে নিয়ে আগেই চলে আসে হোটেলে। আইফেল টাওয়ার দেখতে যেতে হবে। নাতালি মেয়েটির ডাগর ডাগর চোখ, মুখে মিষ্টি মিষ্টি হাসি। মেয়েটিকে আমার বেশ ভাল লাগে। জিল বলেছিল যদিও তারা একসঙ্গে থাকে, এখনও নাকি তার সঙ্গে নাতালির গভীর কোনও ভালবাসা হয়নি। এ খুবই সত্য কথা যে একসঙ্গে থাকলেই এক বিছানায় ঘুমোলেই ভালবাসা গড়ে ওঠে না। আমরা কিছুদূর হেঁটে একটি ট্যাক্সি নিয়ে আইফেল টাওয়ারের কাছে গেলাম। তিনতলা বন্ধ হয়ে গেছে টাওয়ারের, উঠলে তিনতলায় ওঠাই ভাল। আমার কিন্তু অত চুড়োয় ওঠার কোনও তীব্র ইচ্ছে নেই। দূর থেকেই দেখি না কেন! আলো ঝলমল পরিবেশটি আমার ভাল লাগে। আজদাহা টাওয়ারটি লোহা লককরের একটি স্তম্ভ। জানি না কেন লোকে এটি পছন্দ করে। প্যারিসের লোকেরা অবশ্য এটিকে জঘন্য একটি জিনিস বলে ছো! ছো! করে। ১৮৮৯ সালে প্যারিসের আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর জন্য গুস্তাব আইফেল নামের এক লোক এটি বানিয়েছিলেন, তিনশ মিটার লম্বা টাওয়ারটি, সাত হাজার টন ওজন। কথা ছিল প্রদর্শনীর পর এটি তুলে ফেলা হবে। কিন্তু শেষ অবদি তোলা হয়নি, রয়ে গেছে। এলাকাটি, জিল বলে, ধনী। ধনীর ছেলেরা একটুকরো চাকাঅলা কাঠের ওপর চড়ে ভয়ংকর ভাবে দৌড়োচ্ছে। গরম পড়তেই নাকি এখানে এমন শুরু হয়ে যায়। আমরা নৌকো চড়ব বলে নদীর কাছে গিয়ে দেখি নৌকো নেই। এ কারণে যে মন খারাপ হবে তা নয়। আমার ওরকম হাঁটতেই ভাল লাগছিল। পাশাপাশি তিনজন। ভাল লাগছিল রকমারি মানুষের ভিড়। আনন্দিত মুখ। হাঁটতে হাঁটতে আমরা আর্ক দ্য ট্রায়াম্ফএর কাছে পৌঁছে যাই। জিল আর নাতালি দুজন বাড়িতে খেয়ে এসেছে। আমার রাতের খাওয়া তখনও হয়নি বলে শাঁর্লস এ লিজের এক রেস্তোরাঁয় বসি। ভেতরে নয়, বাইরে, তেরাসে। অনেক রাত অবদি। রাত গভীর হলেও বোঝার উপায় নেই। হৈ হুল্লোড়, মানুষের ভিড়, যানবাহনের ভিড়। কি অদ্ভুত এক অন্যরকম জগতের মধ্যে আমি!

পরদিন। সকালে ক্যামেরুনের সাংবাদিকের সঙ্গে নাস্তা খাওয়ার কথা। ধুৎ কি নাস্তা খাব। সকালে বিছানায় বসে চা খাচ্ছি আরাম করে। ক্যামেরুনের কথা আপাতত ভুলে যাই। ক্রিশ্চান বেস অপেক্ষা করছেন নিচে। আবার জিলের ফোন। ক্রিশ্চান এসেছে খবরটি দিলে জিল বলল, ‘তাহলে তুমি ক্রিশ্চানকে নিয়েই রেডিওতে চলে যাও। আমি তোমাকে নিয়ে আসতে গেলে দেরি হয়ে যেতে পারে। আমি আমার এখান থেকেই তাহলে সোজা রেডিওতে চলে যাচ্ছি।’ খানিক পর আবার জিলের ফোন। জ্ঞপ্রযোজক নেই এখন রেডিওতে, তোমার ওখানে গেছে কী না, খানিকক্ষণ অপেক্ষা কর।’ ক্রিশ্চানের সঙ্গে চা কফি নিয়ে বসলাম আধঘন্টা মত। ক্রিশ্চান বার বারই একটি কথা বলল, ‘আমি তোমার নামের জন্য তোমার বই ছাপতে চাইছি না। ছাপতে চাইছি তোমার সাহিত্যের জন্য। লেখক হিসেবে তোমাকে চাইছি। তোমাকে ফতোয়া দিয়েছে, তোমার এখন চারদিকে নাম, সেজন্য তাড়াহুড়ো করে তোমার একটি বই ছেপে হটকেকের মত বিক্রি করে তোমায় ভুলে যেতে চাইছি না। সত্যি কথা বলতে কী, তুমি যে লেখক, তুমি যে ভাল একজন লেখক, তা মানুষকে জানাতে চাইছি।’ রেডিওর লোকের জন্য বসে থাকতে ইচ্ছে করে না। আমরা উঠে পড়ি। ক্রিশ্চান আমাকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যেতে এসেছেন। ছোট্ট একটি লাল গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেলেন তাঁর প্রেসিডেন্ট উইলসন রোডের বাড়িতে। অসম্ভব রকম কর্মঠ তিনি, অবসর বলতে কিছু তাঁর জীবনে নেই। ক্রিশ্চান অনর্গল কথা বলেন। কোনও একটিও কিন্তু বাজে কথা নয়। ফরাসিরা কথা বলতে গেলে হাত পা মুখ মাথা ঠোঁট চোখ খুব নাড়ে। এটা ওদের সম্ভবত জাতীয় অভ্যেস। এডিশন দ্য ফামের মহিলা মিশেল ইডেল ফোন করছে, দেখা করতে চাইছে শুনে ক্রিশ্চান নাক সিঁটকে বলল, জ্ঞনারীবাদ নারীবাদ নারীবাদ। উফ! অসহ্য। নারীবাদ নিয়ে যারা লাফায়, আমি তাদের সহ্য করতে পারি না। এ হচ্ছে একধরনের সীমাবদ্ধতা। এও আরেক ধরনের মৌলবাদ। যে কোনও কিছুতেই আমরা নারী আমরা নারী। নারীর এই হয়নি সেই হয়নি। এই চাই সেই চাই। এই হতে হবে সেই হতে হবে। এ আবার কী! মানুষের কথা ভাব, মানুষের জন্য বল, মানুষের জন্য কর, নারী পুরুষ শিশু সবার কথা ভাব! কেবল নারীরই কি সব সমস্যা? শিশুদের নেই? পুরুষের নেই? হু!নারীবাদীদের উদ্দেশ্য নারী নিয়ে ব্যবসা করা, আর কিছু নয়।’

ক্রিশ্চান রাস্তার কিনারে গাড়ি রেখে তাঁর বাড়ির সামনের সড়কদ্বীপে বাজার বসেছে, সেখানে যায়। বাজারটি এই দ্বীপে বুধবার আর শনিবারে বসে। দুপুরের মধ্যেই বাজারটি উঠে যাবে। আবার সব ঝকঝকে তকতকে আগের মত। বিকেলে দেখলে কারও বোঝার উপায় থাকবে না এখানে একটি জমজমাট বাজার ছিল সকালবেলা। আমাদের কাঁচা বাজারের মত নয় এটি। সবকিছুর এখানে নির্ধারিত দাম। আমাদের দেশের মত চিৎকার করে দরদাম করতে হয় না। ক্রিশ্চান ফুল কেনে। লিলি অব দ্য ভ্যালি। চমৎকার ঘ্রাণ ফুলের, ছোট শাদা ফুল। ক্রিশ্চানের বাড়িটি তিনতলায়। এমন সুন্দর বাড়ি আমি জীবনে কমই দেখেছি। যেন বাড়ি নয়, আস্ত একটি মিউজিয়াম। সাতশ সিসি মেফেয়ার গাড়িটি দেখে মনেই হয়নি তাঁর বাড়িতে আছে খৃষ্টপূর্ব চারশ শতাব্দির প্রাচীন মূর্তি, ব্যাবিলিয়ন, সুমেরিয়ান সভ্যতার অমূল্য সব সম্পদ। প্রাচীন সব রঙিন পাথরের অলংকার। মিশরের গুহা থেকে তুলে আনা সেই আমলের জিনিসপত্র। আমি থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি মূর্তিগুলোর সামনে, যেমন থ হয়ে ছিলাম ল্যুভরে। বাড়িটির দেয়ালে দেয়ালে যত তেলচিত্র আছে, সবই বড় বড় শিল্পীর। সবই আসল, নকল বলতে কিছু নেই। বাড়ির আসবাবপত্রগুলোও শিল্পীর তৈরি। যে কাপে চা খেতে দিল, সেটিও কয়েকশ বছর আগের। অ্যান্টিকে বাড়িটি ভর্তি। একটি অ্যান্টিক ল্যাণ্ডও আছে। অমিতাভ ঘোষের অ্যান্টিক ল্যাণ্ড বইটি ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেছেন ক্রিশ্চান নিজে। বইটির নামে ইজিপ্ট দেখে আমি ধন্দে পড়ি। ক্রিশ্চান বললেন বাণিজ্যিক কারণে তিনি নামটি পাল্টে দিয়েছেন। বাণিজ্যিক শব্দটি উচ্চারণ করতে এখানে কারও কোনও গ্লানি নেই। আমার চা খাওয়া শেষ হয়নি। টেলিভিশনের লোকেরা এল। জ্যঁ শার্ল বারথেয়ারও এল। একবার বাংলায় একবার ইংরেজিতে সাক্ষাৎকার নিল ওরা। এরপর নিচে, খানিকটা হেঁটে গিয়ে মডার্ন মিউজিয়ামের বারান্দায় আরেক দফা সাক্ষাৎকার। হাঁটছি, কথা বলছি, ক্যামেরা আমার প্রতি অঙ্গভঙ্গি তুলে রাখছে।

প্যারিস কেমন লাগছে?

এত সৌন্দর্য প্যারিসের, তা আমি আগে কল্পনাও করিনি।

জ্যঁ শার্ল বারথেয়ারকে অনুবাদক হিসেবে নিয়েছে টিভির লোকেরা। একসময় আমি মনিক আতলাঁকে, সাংবাদিক পরিচালক দুটোই তিনি, বলি যে বাংলা থেকে ফরাসিতে অনুবাদ হলে, আমি ইংরেজিতে একই প্রশ্নের উত্তরে যা বলেছি, সেটির সঙ্গে যেন মিলিয়ে দেখে নেন বক্তব্য ঠিক আছে কি না। লক্ষ করিনি জ্যঁ শার্ল আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল। বলল, আপনি বিসওয়াস খরেন না? চমকে উঠি। তাকিয়ে বারথেয়ারের মুখ দেখি বিষণ্ন মুখ। বড় অপ্রস্তুত হই! বলি, ‘না না আপনাকে আমি বিশ্বাস করি। তবু এই আর কী! আপনার তো কিছু ভুল হতে পারে। যেমন ধরুন অনেক কঠিন কঠিন বাংলা শব্দ যদি না বুঝতে পারেন, তাই।’ আমার এই সান্ত্বনায় বারথেয়ারের বিষণ্নতা দূর হয় না। মায়া হয় মানুষটির জন্য। এমন ভাবে বলাটা বোধহয় উচিত হয়নি। ক্রিশ্চান বেস আর মনিক আতলাঁ হাঁটছি কথা বলতে বলতে, ফাঁকে ফাঁকে আমার ব্যাগ আর চশমা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বারথেয়ারের বিষণ্ন মলিন মুখটি দেখছি। নীল চোখ তার, ঘাড় অবদি সোনালী চুল, পরনে জিনসের জ্যাকেট — খানিকটা গবেট গবেট মনে হয় তাকে, বারথেয়ারকে, এত স্পর্শকাতর হবে ভাবিনি। কোনও ফরাসি পুরুষ এমন অভিমান করে মলিনতার চাদরে নিজেকে ঢেকে ফেলতে পারে, এই প্রথম দেখলাম। ক্রিশ্চানের গাড়ির কাছে যেতে যেতে সবার থেকে নিজেকে আলগোছে সরিয়ে দু কদম পিছিয়ে নিয়ে বারথেয়ারের সঙ্গে কথা বলতে থাকি আমি। এমনি কথা। ছোটোখাটো কথা। এতদিন আসলে বারথেয়ারকে বিষম এড়িয়ে চলেছি। ক্রিশ্চান যখন আমাকে নিয়ে গাড়িতে উঠবে, বারথেয়ারকে বললাম, আপনিও চলুন আমাদের সঙ্গে, আমরা দুপুরের খাবার খেতে যাচ্ছি, চলুন। বারথেয়ারের মুখটি মুহূর্তের জন্য উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিন্তু ক্রিশ্চান তাকে ফরাসিতে কিছু বলল, কি বলল জানি না। সঙ্গে সঙ্গে বারথেয়ার আমাকে থতমত ঠাণ্ডা গলায় বলে দিল যে সে যেতে পারছে না, জরুরি কিছু কাজ আছে তার। তবে তিনি বারথেয়ার অপেরায় নিয়ে যাবেন আমাকে, অপেরার টিকিট কেটে এনেছিলেন। তিনি বললেন, সাতটায় হোটেলে যাবেন আমাকে অপেরায় নিয়ে যেতে। ক্রিশ্চান আমাকে লেবানিজ একটি রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেলেন। মুরগির কাবাবমত, আর কাঁচা বাধাকপি, নানা রকম কাঁচা পাতা, যা কখনও কাঁচা খাওয়া যায় বলে আমার ধারণা ছিল না। খেতে খেতে ক্রিশ্চানের সঙ্গে কথা বলি ফরাসি সাহিত্য নিয়ে। ফরাসি সাহিত্যিকরা কেমন লিখছেন, কী লিখছেন! ক্রিশ্চান সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট উল্টে বললেন, বাজে বাজে বাজে। নতুন প্রজন্মের সবাই আমবিলিকাসের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবে সবই তো আছে তাদের। তারাই তো জনক শিল্পের সাহিত্যের। সুতরাং নতুন কিছুর আর কী দরকার! ক্রিশ্চান খুবই হতাশ ফরাসি লেখকদের নিয়ে। বললেন, জ্ঞআমি অনেক পাণ্ডুলিপি পাই ফরাসি লেখকদের। সবই অখাদ্য। কেবল বর্ণনা। কিছুই নতুন নয়। নতুন ভাষা নেই। নতুন বক্তব্য নেই।’

Taslima Nasrin ।। তসলিমা নাসরিন