চতুর্থ অধ্যায়
১ম প্রকরণ—বিদ্যাসমুদ্দেশ; বার্তা ও দণ্ডনীতি স্থাপনা
কৃষি, (গবাদি) পশুপালন ও বাণিজ্য—এই তিন বিষয়ই বার্তা-নামক বিদ্যাদ্ধারা প্রতিপাদিত হয় এবং এই বিদ্যা, ধান্য, পশু, হিরণ্য, কুপ্য (স্বর্ণরৌপ্যাতিরিক্ত তাম্রাদি তৈজস ও সারদারু প্রভৃতি অতৈজস দ্রব্য), ও বিষ্টি (কৰ্ম্মকর) প্রদানে সহায়তা করে বলিয়া সমাজের উপকার সাধন করিয়া থাকে। (রাজা) এই বিদ্যার প্রভাবে উৎপাদিত কোষ ও দণ্ড (সেনা) দ্বারা স্বপক্ষ ও পরপক্ষকে বশে রাখিতে পারেন।
আধীক্ষিকী, ত্রয়ী ও বার্তা—এই তিন বিদ্যার যোগ ও ক্ষেম সাধন করিতে দণ্ডই সমর্থ হয় (অর্থশাস্ত্রে সামাদি উপায়-চতুষ্টয়ের অন্যতম উপায়ের নামও দণ্ড ও দণ্ডধর রাজাও দণ্ডস্থানীয় বলিয়া কল্পিত হয়)। এই দণ্ড-নামক বিদ্যার যাহা নীতি বা স্বরূপের প্রতিপাদনকারী তত্ত্ব তাহার নাম দণ্ডনীতি (বা রাজনীতি) শাস্ত্র। এই দণ্ডনীতি অলব্ধ বস্তুকে লাভ করায়, লব্ধ বস্তুকে রক্ষা করায়, রক্ষিত বস্তুকে বৰ্দ্ধিত করায় এবং বৃদ্ধিপ্রাপ্ত বস্তুকে উপযুক্ত পাত্রে বিনিযুক্ত করায়। লোকযাত্রা (সমাজ-ব্যবহার) এই দণ্ডনীতির উপরই নির্ভর করিয়া থাকে। অতএব, যে রাজা লোকযাত্রার সম্যক্ অনুষ্ঠানে তৎপর, তিনি নিত্যই উদ্যতদণ্ড অর্থাৎ দণ্ডপ্রণয়নে উদ্যুক্ত রহিবেন।
(কৌটিল্যের নিজ) আচার্য্যের মত এই যে, দণ্ড ব্যতিরেকে অন্য কোন প্রকার সাধন তেমন কার্য্যকর হইতে পারে না—যাহা দ্বারা সকলকে বশে রাখা যায়। কিন্তু, কৌটিল্য (দণ্ডমাত্রকেই তেমন সাধন) বলিয়া মনে করেন না। কারণ, তাহার মতে, যে রাজা তীক্ষ্ণদণ্ড (অর্থাৎ যিনি অল্পাপরাধে উগ্ৰ দণ্ড প্রণয়ন করেন), তিনি সকল প্রাণীরই উদ্বেগ উৎপাদন করেন। আবার যে রাজা মৃদুদণ্ড (অর্থাৎ যিনি মহাপরাধে মৃদু দণ্ড প্রণয়ন করেন), তিনি স্বয়ং পরাভব প্রাপ্ত হয়েন। কিন্তু, যে রাজা যথার্হদণ্ড (অর্থাং যিনি অপরাধাতুরূপ উচিত দণ্ড প্রণয়ন করেন), তিনি সকলের পূজা লাভ করেন। কারণ, যে দণ্ড শাস্ত্র হইতে উত্তমরূপে জ্ঞাত হইয়া প্রণীত বা প্রযুক্ত হয়—তাহা প্রজাজনকে ধৰ্ম্ম, অর্থ ও কাম এই ত্রিবর্গ দ্বারা যুক্ত করিতে পারে। কাম ও ক্রোধবশঃ কিংবা অজ্ঞানবশতঃ যে দণ্ড দুষ্প্রণীত (অর্থাৎ অযথাবৎ প্রযুক্ত) হয়—তাহা বানপ্রস্থ ও পরিব্রাজকদিগেরও কোপ উৎপাদন করে—সুস্থগণের ত কথাই নাই। আবার, যদি দণ্ড অপ্রণীত বা অপ্ৰযুক্তই রহে, তাহা হইলে ইহা মাৎস্যন্যায় উৎপাদন করে (অর্থাৎ বড় বড় মৎস্য যেমন ছোট ছোট মৎস্যগুলিকে গ্রাস করিয়া ফেলে—তেমন তখন সবল লোকের দুর্বল ও অবল লোকদিগকে গ্রাস করিয়া ফেলে)। কারণ, দণ্ডধর বা দণ্ডপ্রণেতা রাজার অভাবে, বলবান লোক বলশূন্য লোককে গ্রাস করিয়া থাকে (অর্থাৎ কষ্ট দিয়া থাকে)। (অতএব), দণ্ডদ্বারা গুপ্ত বা রক্ষিত (রাজা) প্রভাববিশিষ্ট হইয়া থাকেন। (কেহ কেহ ‘দণ্ডদ্বারা রক্ষিত দুর্বল প্রজা বা সমাজ সবল হয়’ এরূপ ব্যাখ্যাও করেন)।
চারি বর্ণ ও চারি আশ্রমের লোকেরা রাজাদ্বারা দণ্ডের প্রভাবে পালিত হইলে, নিজ নিজ ধর্ম্মে ও কৰ্ম্মে অভিরত থাকিয়া স্বগৃহে (বর্ত্মসু-পাঠে স্ব স্ব পথে) সুখে থাকিতে পারে ॥১৷৷
কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে বিনয়াধিকারিক নামক প্রথম অধিকরণে বিদ্দাসমূদ্দেশনামক প্রকরণে বার্তা ও দণ্ডর্নীতি স্থাপন নামক চতুর্থ অধ্যায় সমাপ্ত।