০১. বাবলু, বিলু, ভোম্বল

বাবলু, বিলু, ভোম্বল তিনটি ছেলে। বাচু-বিচ্ছু দুটি মেয়ে। এই নিয়ে ওরা পাঁচজন। আর ওদের সঙ্গে আছে কালো একটি দেশি কুকুর, নাম পঞ্চু। কুকুরটির এক চোখ কানা বলে ওকে ওরা কানা-পঞ্চু বলে। আর লোকে ওদের বলে পঞ্চপাণ্ডব।

এই পাঁচটি ছেলেমেয়ে এবং ওই কালো কুকুরটি একজোটে সর্বত্র ঘুরে বেড়ায়। এই ক’জনে কেউ কাউকে ছাড়া থাকে না। যেমনই দস্যি, যেমনই ডানপিটে আর তেমনই লেখাপড়ায়।

গ্ৰীষ্মের ছুটির এক দুপুরে ওরা পাঁচজনে পঞ্চুকে নিয়ে মিত্তিরদের বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ঘুরতে ঘুরতে পোড়ো ভাঙা একটা বাড়ির কাছে এসে থমকে দাঁড়াল ওরা। বাড়িটা দোতলা। একদিকের ছাদ নেই। একদিকের দেওয়াল ধসে পড়েছে। একদিকের ছাদে ছোট ছোট বটগাছ, অশ্বখগাছ ইত্যাদি গজিয়েছে। বাড়ির ভেতর আর বাইরেটায় ঘন ঘাস আগাছা ইত্যাদির বন হয়ে আছে। একটা মস্ত গুলঞ্চগাছ তার শাখা-প্ৰশাখা নিয়ে ঝুকে আছে বাড়ির ভাঙা দালানের গায়ে।

ওরা পাঁচজনে সেইখানে এসে বসল।

বাবলুপ্যান্টের পকেট থেকে বার করল দুটো কাঁচা আম। বিলুর সঙ্গে ছিল নুন আর লঙ্কা। ভোম্বলের কাছে ছিল ছোট একটা ছুরি। তাই দিয়ে আমাটাকে কুচি কুচি করে নুন লঙ্কা মাখিয়ে বেশ জুতসই একটা চিজ তৈরি করে ফেলল ওরা।

বাচ্চু আর বিচ্ছু মেয়েদুটি নেহাতই ছোট বলে ওরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল।

যখন ভাগ হল তখন সবার ভাগেই সম পরিমাণ পড়ল। বাচ্চু-বিচ্ছু ছোট বলে যে ওদের ভাগে কম পড়ল তা কিন্তু হল না।

আমের কুচি খেয়ে বিলু আর ভোম্বল সেই আঁকা-বাঁকা গুলঞ্চগাছের ডালে উঠে ঠেস দিয়ে বসে রইল।

বাচ্চু-বিচ্ছু শুয়ে গড়াগড়ি দিতে লাগল ঘাসের ওপর।

আর বাবলু করল কী পঞ্চুর সামনেকার পাদুটো ধরে তাকে নিয়ে নানারকম কেরামতি করতে লাগল। পষ্ণুর সঙ্গে খেলা করতে করতেই বাবলুর মাথায় হঠাৎ একটা বুদ্ধি এল। যেই না আসা বাবলু আমনই নিজের মনেই হয়াতে টুসকি দিয়ে চেঁচিয়ে বলল, দ্যাটস আইডিয়া।

বিলু-ভোম্বল টুপটাপ করে গাছের ডাল থেকে নেমে পড়ল।

বাচ্চু-বিচ্ছুও শোওয়া ফেলে গায়ের ধুলো ঝেড়ে উঠে বসিল ঘাসের ওপর।

পঞ্চুও তাকাল বাবলুর মুখের দিকে।

বিলু বলল, কীসের আইডিয়ারে বাবুলু?

বাবলু চোখদুটো উজ্জ্বল করে বলল, একটা চমৎকার প্ল্যান এসেছে মাথায়।

ভোম্বল বলল, কীসের প্ল্যান?

অ্যাডভেঞ্চারের।

বিলু বলল, মাথা খারাপ। এই মিত্তিরদের বাগানে বসে অ্যাডভেঞ্চার করা যায় নাকি?

সাহস থাকলে ঠিকই যায়।

ভোম্বল বলল, তা ছাড়া অ্যাডভেঞ্চারের একটা পরিবেশ তো চাই।

পরিবেশ তৈরি করে নেব।

কী করে নিবি?

যেখানেই রহস্যের গন্ধ পাব সেখানেই ছুটে যাব আমরা।

বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, কাজটা কিন্তু খুব কঠিন।

বাবলু বলল, হোক কঠিন। চেষ্টা তো করব।

বিলু বলল, এ তা হলে এক ধরনের শখের গোয়েন্দাগিরি হবে, কী বল?

ঠিক তাই।

ভোম্বল বলল, মন্দ নয়। দেখাই যাক না একটু চেষ্টা করে?

বিলু একটুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ উৎসাহিত হয়ে বাবলুর পিঠ চাপড়ে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, লেগে পড়। জয় মা কালী। তার ওপর তুই যখন আমাদের লিডার তখন আর ভাবনা কী?

বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, ওঃ কী দারুণ মজা!

ভোম্বল আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল, ওঃ কী দারুন মজা!

সবাই সমস্বরে বলে উঠল, হিপ হিপ হুরর রে।

পঞ্চুও আমনই আনন্দে ডেকে উঠল, ভৌ। ভৌ। ভৌ।

বাবলু। পঞ্চুকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুইও আমাদের দলে থেকে সাহায্য করবি। পারবি তো?

পঞ্চু ডাকল, ভৌ ভৌ।

বাবলু বলল, এবার কিন্তু আমাদের এই গ্রুপটার একটা নাম দিতে হবে। এবং এই বাগানেই এই পোড়ো বাড়ির ভেতর ঘাঁটি হবে আমাদের।

বিলু বলল, কী নাম দিবি দলটার?

ভোম্বল বলল, সবাই যখন আমাদের পঞ্চপাণ্ডব বলে তখন আমাদের দলের নামও তাই হবে। পঞ্চপাণ্ডব অ্যান্ড কোং।

বাবলু বলল, তুই একেবারে রাম বুদ্ধ। অ্যান্ড কোং আবার হয় নাকি?

বাচ্চু বলল, তুমিই বলে বাবলুদা।

বিচ্ছু বলল, শুধু পঞ্চপাণ্ডব নামটা কেমন?

বাবলু বলল, না। নামটাকে আরও একটু মডার্ন করতে হবে। আমাদের দলের নাম হবে পাণ্ডব গোয়েন্দা।

বাচু-বিচ্ছু চেচিয়ে বলল, ওয়ান্ডারফুল।

ভোম্বল বলল, আমি এখনই আমাদের পাড়ার ঘ্যাঁচাদাকে দিয়ে একটা সাইনবোর্ড করিয়ে আনছি। যাতে লেখা থাকবে আমাদের দলের নাম পাণ্ডব গোয়েন্দা।

বাবলু বলল, সেই ভাল। আজ থেকেই তা হলে আমাদের কাজ শুরু হয়ে যাক। ভোম্বল, তুই সাইনবোর্ড তৈরি করগে যা। আমরা ততক্ষণে ঘরটা পরিষ্কার করে ফেলি।

ভোম্বল চলে গেল।

বিলু বলল, ঘর তো পরিষ্কার করবি। কিন্তু একটা বঁ্যাটা তো চাই। তারপর জল ছিটোবার জন্যে চাই একটা বালতি।

বাবলু বলল, ঝ্যাঁটা না হলেও চলবে। কালকাসুন্দের ঝাড় দিয়ে ঝ্যাঁটা বানিয়ে নেব। কিন্তু বালতি কোথায় পাব?

বিচ্ছু বলল, আমাদের পলিথিনের বালতিটা নিয়ে আসব বাবুলদা?

বাচ্চু বলল, কী করে আনবি? মা যদি দেখতে পায়?

সে আমি ঠিক নিয়ে আসব। লুকিয়ে। এই বলে বিচ্ছু চলে গেল।

ততক্ষণে বাবলু, বিলু আর বাচ্চু ঘর পরিষ্কারের কাজে লেগে গেছে।

একটু পরে বিচ্ছু বালতি নিয়ে ফিরে এলে সেই বালতি করে পাশের পুকুর থেকে জল এনে ঘরময় ছেটানো হল।

ভোম্বলও ফিরে এল ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে। ওর হাতে চমৎকার একটি সাইনবোর্ড। যাতে লেখা ‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’। সেই বোর্ডটা ওরা ভাঙা বাড়ির দেওয়ালে পেরেক ঠুকে লাগিয়ে দিল।

দেখতে দেখতে সন্ধে হয়ে এল।

কাজেই ওরা আর কেউ রইল না। সেখানে।

পঞ্চুকে নিয়ে যে যার ঘরে ফিরে গেল।

Super User