রাত্ৰিবেলা বাচ্চু আর বিচ্ছু পাশাপাশি শুয়েছিল। দু’জনেই ঘুমোচ্ছিল অঘোরে। এমন সময় গুমোট গরমে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল বিচ্ছুর। বিছানায় শুয়ে তাই এপাশ-ওপাশ করতে লাগল। দুপুরবেলার ঘটনাগুলোও মনে আসতে লাগল সব।

হঠাৎ মনে পড়ল, আরে! পলিথিনের বালতিটা তো সেই ভাঙা বাড়িটার ভেতরেই ফেলে রেখে এসেছে। সেটা তো আনা হয়নি।

মনে পড়তেই বুকটা ধড়াস করে উঠল।

কেন না কাল সকালে যখন বালতির খোজ পড়বে তখন যদি মা বালতি না পান তা হলেই সব ফাঁস হয়ে যাবে। আগে তো দুম দাম করে ঘা কতক দিয়েই দেবেন। ওকে, তার পরে অন্য কথা।

বিচ্ছু যে কী করবে কিছু ভেবে পেল না।

পাশ ফিরে দেখল বাচ্চু অঘোরে ঘুমোচ্ছে।

রাত এখন কত তাই বা কে জানে?

বিচ্ছুর মনে হল বাচ্ছকে একবার ডাকে। কিন্তু কেন কে জানে ওর এই আরামের ঘুমটা নষ্ট করতে খুব মায়া হল বিচ্ছুর। তাই বার বার উশখুশ করতে লাগল। তারপর একবার ডাকব কি ডাকব না ভাবতে ভাবতে মৃদু একটু টিপনি দিয়ে ডেকেই ফেলল বিচ্ছু, এই দিদি। দিদি?

বাচ্চু ঘুমের ঘোরেই বলল, উঁ?

বাচুর ঘুম ভেঙে গেল। তবুও সে তন্দ্ৰ জড়ানো গলায় বলল, কী?

শোন না ভাল করে।

বাচ্চু বিরক্ত হয়ে বলল, বল না কী বলছিস?

একটা খুব ভুল হয়ে গেছে রে।

বাচ্চু এবার চোখ মেলল, কী হয়েছে?

বালতিটা সেখানেই পড়ে আছে। নিয়ে আসা হয়নি।

ঘুমের ঘোর ক্ষণিকের জন্য কেটে গেল বাঙ্গুর। বলল, কী হবে তা হলে?

তুই বল না কী হবে? মা সকালবেলা বালতি দেখতে না পেলে খুব বকবে। তা ছাড়া মায়ের রাগ জানিস তো? আগেই মেরে দেবে দুম দাম করে।

মারবার আগেই তুই কেঁদে দিবি। তা হলে কিছু হবে না। বলে পাশ ফিরে শুল বাচ্ছু!

বিচ্ছু বলল, বালতিটা যদি কেউ চুরি করে নিয়ে যায়?

যায় যাবে। যেমন নিয়ে গেছিস তুই। বুঝবি এবার ঠ্যালা।

বিচ্ছুর খুব ভয় হল এবার। সে ভয়ে ভয়ে বলল, তুই একবার আমার সঙ্গে যাবি রে দিদি?

বাচু অবাক হয়ে বলল, কোথায়!

সেইখানে।

তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে! এই রাত্তিরে সেখানে আবার কেউ যায় নাকি?

বালতি না পেলে কাল সকালে কী কাণ্ডটা হবে বুঝতে পারছিস তো।

যা হয় হবে। এখন চুপচাপ শুয়ে থাক দিকি। আমার ঘুম পাচ্ছে। এই বলে বাচ্চু পাশ ফিরে শুল।

বিচ্ছু আর কী করে সেও চুপ করে শুয়ে রইল একপাশে। শুয়ে রইল। কিন্তু ঘুম এল না। একটা দুশ্চিন্তা বার বার ওর মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল। সে শুয়ে শুয়ে শুধু সেই বালতিটার কথাই ভাবতে লাগল। তারপর একসময় যখন পাশে শুয়ে-থাকা বাঙ্গুর নাক ডাকার শব্দ শুনতে পেল তখন বুঝল বাচ্চু বেশ গভীর ঘুমেই মগ্ন হয়ে গেছে।

বিচ্ছু ততক্ষণে মনস্থির করে ফেলেছে।

সে আর বাঙ্গুকে কোনওরকম বিরক্ত না করে চুপি চুপি উঠে বসল। তারপর আস্তে আস্তে দরজার কাছে গিয়ে খিলটা খুলে নেমে এল রাস্তায়।

রাস্তায় নেমে চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখল বিচ্ছু। চারদিক নিস্তব্ধ। শুধু লাইট পোস্টের আলোগুলো সেই ঘন অন্ধকারের যবনিকায় ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে।

বিচ্ছু পায়ে পায়ে বাবলুদের বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল। বাবলুদের বাড়ির কাছে আসতেই দেখতে পেল বাবলুদের রকে বেশ খোশ-মেজাজে কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে আছে পঞ্চু।

পঞ্চু শুয়ে শুয়ে এক চোখে পিট পিট করে একবার দেখে নিল বিচ্ছুকে। তারপর বিচ্ছু ডাকবার আগেই আনন্দে লাফিয়ে লেজ নেড়ে নেড়ে ছুটে এল বিচ্ছুর কাছে। এই অসময়ে বিচ্ছুর সঙ্গটা ওর কাছে সত্যিই অপ্রত্যাশিত ছিল। পঞ্চু একবার বিচ্ছুর পায়ের কাছে গড়াগড়ি খেয়ে কুঁই কুঁই করতে লাগল।

বিচ্ছু পঞ্চুর গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, চল পঞ্চু। তোতে আমাতেই যাই। সেই ভাঙা বাড়িতে গিয়ে বালতিটা নিয়ে আসি।

পঞ্চু কী বুঝল কে জানে, এই রাতদুপুরে একটা অভিযানের গন্ধ পেয়েই বুঝি সারা গা ঝাড়া দিয়ে খাড়া হয়ে দাঁড়াল।

বিচ্ছু পঞ্চুকে নিয়ে এগিয়ে চলল মিত্তিরদের বাগানের দিকে।

রাতের অন্ধকারে বাগানের এক কোণে ভাঙা বাড়িটা যেন প্রেতপুরীর মতো থম থম করছিল। একে রাত্রির অন্ধকার। তার ওপর ছায়া ছায়া কালো গাছপালাগুলো দেখলে বুকের ভেতরটা যেন ছাৎ করে ওঠে। নেহাত পষ্ণু রয়েছে তাই। না হলে এই অন্ধকারে একা আসতে বিচ্ছুর সত্যিই খুব ভয় করত।

অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

বিচ্ছু আর পঞ্চু নিঃশব্দে বাগান পার হয়ে সেই ভাঙা বাড়িতে গিয়ে জুটল। ঘরের ভেতরটা তখন ঘন অন্ধকারে ঢাকা ছিল বলে বালতিটা যে ঠিক কোনখানে আছে তা দেখতে পেল না বিচ্ছু।

আর পঞ্চুও ঠিক বুঝতে পারল না বিচ্ছুর এখানে কীসের জন্য আসা।

বিচ্ছু অনেকক্ষণ ধরে এদিক সেদিকে খোঁজাখুঁজি করতে লাগল বালতিটাকে।

এমন সময় সিঁড়ির ওপর থেকে হঠাৎ এক জোরালো টর্চের আলো ওর মুখে এসে পড়ল। আর কে যেন একজন গভীর গলায় বলে উঠল, কে রে তুই?

সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চুও ক্রুদ্ধ গলায় চিৎকার করে উঠল, ভৌ ভৌ। ভৌ-উ-উ৷ তারপরই আলো লক্ষ্য করে তিরের মতো ছুটে গেল সে।

বিচ্ছু তখন ভয়ে কাঠ হয়ে গেছে।

সে বুঝতে পারল না। রাতদুপুরে এই লোকটা কে?

পঞ্চু ছুটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে ভয়ে কেঁদে উঠল।

বিচ্ছুর কান্না শুনে ওর কোনও বিপদ হয়েছে মনে করেই লোকটাকে ছেড়ে পঞ্চু আবার ছুটে এল ওর কাছে। আর ঠিক তখনই মনে হল কে বা কারা যেন ছাদের ওপর দিয়ে ছুটতে ছুটতে বাগানের দিকে লাফিয়ে পড়ল।

পঞ্চুকে পেয়ে বিচ্ছুর মনে আবার সাহস ফিরে এল। সে তখন কোনওরকমে বালতিটা খুঁজে নিয়ে পঞ্চুর সঙ্গে বাড়ির দিকে দৌড়-দৌড়-দৌড়।

Super User