ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর হাতে অফুরন্ত সময়। তার উপর কয়েকদিন থেকে রফিকের পাত্তা নেই। পাশাপাশি বাড়ি হলেও আরিফ আহ্বা-আম্মার কথা মত কোনদিন রফিকদের বাড়িতে যায় না। যেখানে যেখানে তারা ঘুরে বেড়ায়, আড্ডা দেয়, সেসব জায়গায় আরিফ খোঁজ করেও তাকে পেল না। ভাবল, সে হয়ত কোন আত্মীয়ের বাড়ি গেছে। কিন্তু তাকে না বলে সে তো কোনদিন কোথাও যায় না। কোন অসুখ-টসুখ করেনি তো? এই কথা মনে হতে তাদের চাকরকে জিজ্ঞেস করল।
চাকরটা বলল, সে তো কয়েকদিন আগে তার নানার বাড়ি গেছে।
শুনে তার প্রতি আরিফের অভিমান হল। আরো তিন-চার দিন পর এক সকালে রফিকের সাথে দেখা হতে বলল, কিরে আমাকে না বলে যে, নানার বাড়ি চলে গেলি? কবে ফিরলি?
রফিক বল, কাল সন্ধ্যায় ফিরেছি। চল মক্তবের বারান্দায় বসি, তোর সাথে কথা আছে।
মক্তবের বারান্দায় বসে রফিক বলল, তোকে কয়েকটা কথা বলব, কিছু মনে করবি। আমি কথাগুলো আগে জানতাম না, কয়েকদিন আগে জেনেছি।
আরিফ বলল, তোর কথায় কিছু মনে করব কেন? বল কি বলবি?
তোর আসল পরিচয় কি তুই জানিস?
আসল পরিচয় আবার কি?
তুই যাদেরকে মা-বাবা বলে জানিস, তারা কিন্তু তোর আসল মা-বাবা নয়। তারা হল তোর ফুফা-ফুফি। তুই হলি গোফরান চাচার ছোট শ্যালক জাকিরের ছেলে। তোদের বাড়ি এনায়েতপুরে। তোর মা-বাবা তোকে খুব ছোট রেখে মারা যায়। এই ফুফা-ফুফি তোকে ছেলের মত মানুষ করেছে।
আরিফ চমকে উঠে খুব অবাক হয়ে বলল, দুর! এসব একদম বাজে কথা। তোকে কে বলেছে বল তো?
রফিক বলল; বাজে কথা নয়, বিশ্বাস না হলে গোফরান চাচাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারিস। আর শোন, তোর নানার অনেক জ্বীন-পরী বশ ছিল। সে একটা পরীকে বিয়ে করেছিল। তার দেশ কোথায় কেউ জানে না। কবরস্থানের পাশে যেখানে আমরা ডাব খেতে যাই, সেখানে তোর নানা বেশ কয়েক বছর বসবাস করেছিল। তাদের একটা মেয়ে ছিল, সেই মেয়ে তোর মা। আর ঐখানে যে কবরটা আমরা দেখেছি, সেটা তোর মায়ের।
আরিফ আর একবার চমকে উঠে খুব গম্ভীর হয়ে চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে রইল।
বেশ কিছুক্ষণ পর রফিক বলল, কি রে কিছু বলছিস না কেন?
আরিফ মাথা তুলে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তুই এত কথা কার কাছে শুনেছিস?
আব্বার কাছে।
আরিফের তখন ছোট বেলার কথা মনে পড়ল, রফিকের আব্বা সামসু চাচা একদিন তাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। সে কথা আব্বা-আমাকে বলতে তারা বলেছিল, সামসু আমাদের ও তোর দুশমন, তাই তোকে মেরে ফেলতে চায়। সেই থেকে তারা তাকে রফিকের সঙ্গে মিশতে নিষেধ করে আসছে। আরিফ বলল, ঠিক আছে এসব কথা যদি সত্য হয়, তাহলে একদিন না একদিন তা আমি জানতে পারব। এখন চলি পরে দেখা হবে। এই কথা বলে আরিফ ঘরের দিকে রওয়ানা দিল।
ঘরে এসে আব্বাকে পেল না। মাকে সংসারের কাজ করতে দেখে তাকে ঘরে নিয়ে এসে রফিক যা বলেছিল, তা সব বলল।
সুফিয়া বেগম, শুনে আঁৎকে উঠে বলল, সব মিথ্যে কথা। কে তোকে এসব কথা বলেছে?r
আরিফ বলল, এই কিছুক্ষণ আগে রফিক বলেছে। তাকে নাকি তার আব্বা বলেছে।
সুফিয়া বেগম আরিফকে বুকে জড়িয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, ওরা আমাদের দুশমন। তুই ওদের কথা একদম বিশ্বাস করবি না। আমরা তোক সেই ছোট বেলা থেকে রফিকের সঙ্গে মিশতে মানা করে আসছি। তুই তো আমাদের কথা শুনিসনি। তার মনে নেই, রফিকের বাপ তোকে একবার গলা টিপে মেরে ফেলতে চেয়েছিল? তখন না পেরে এখন ছেলেকে দিয়ে মিথ্যে কথা বলে আমাদের প্রতি তোর মন ভাঙাতে চাচ্ছে। আত্মীয়স্বজনরা সবাই আমাদের দুশমন। তুই কারো কথায় কান দিবি না। তারপর আরিফের একটা হাত নিজের মাথায় রেখে বলল, ওয়াদা কর। তুই যদি আমাকে মা বলে জানিস, তাহলে এখন থেকে জীবনে আর কোনদিন রফিকের সাথে মিশবি না, কারো কথায় কান দিবি না।
মায়ের চোখে পানি দেখে আরিফের চোখেও পানি এসে গেল। ভিজে গলায় বলল, হ্যাঁ আম্মা, আমি ওয়াদা করলাম।
সুফিয়া বেগম নিজের ও ছেলের চোখ মুছে তার মাথায় ও গালে চুমো খেয়ে বলল, মন দিয়ে পড়ানা কর। তোকে আমরা মানুষের মত মানুষ করব। গ্রামের কোন ছেলেরই সঙ্গে মেলামেশা করবি না।
তারপর থেকে আরিফ ও রফিকের মধ্যে বন্ধুত্বের ফাটল ধরলেও রফিকের কথাগুলো তাকে খুব ভাবিয়ে তুলল। তার প্রায়ই মনে হয়, ওরা শত্রু হলেও কথাগুলো সত্য বলেছে। এরপর তার স্বভাব-চরিএের আমূল পরিবর্তন। এতদিন গোফরান সাহেব ও সুফিয়া বেগম তাকে নামাজ পড়ার জন্য কত বুঝিয়েছে; কিন্তু তাদের কথা কানে নেয়নি। এখন সে নিয়মিত নামাজ-কালাম পড়তে শুরু করল। ডানপিটে স্বভাবটাও আর নেই। বেশ ধীর ও গভীর হয়ে গেল। আব্বার যত বাংলায় ধমীয় কেতাব ছিল, সব পড়তে শুরু করল।
গোফরান সাহেব ও সুফিয়া বেগম মনে করল, ছেলে বড় হবার সাথে সাথে স্বভাব চরিত্র পাল্টে গেছে। আরিফ ম্যাটিকে খুব ভাল রেজাল্ট করে সিরাজগঞ্জ কলেজে আই. এস, সি তে ভর্তি হয়ে মন দিয়ে পড়াশুনা করতে লাগল। যে সময়গুলোতে রফিকের সঙ্গে ঘুরে বেড়াত, সেই সময়গুলো আরিফের যেন কাটতে চায় না। তার প্রায় সেই কবরটার কথা মনে পড়ে। সেখানে যেতে মন চায়।
একদিন বিকালে ওমরের সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়ে কবরস্থানের দিকে যেতে লাগল।
ওমর বলল, ওদিকে যাচ্ছ কেন? ওদিককার জায়গা ভাল নয়।
আরিফ বলল, কেন? ভাল নয় কেন?
সে সব তোমার না শোনাই ভাল।
নাই ভাল হোক, তবু তুমি বল।
ওমর হাত বাড়িয়ে কবরস্থানের পাশের জায়গাটা দেখিয়ে বলল, ঐ জায়গায় জীন পরীরা থাকে।
আরিফ বলল, আমি ও রফিক ওখানে প্রায় ডাব খেতে যেতাম। সে সময় একটা পাকা কবর দেখেছি। দেখে মনে হল, একদম নতুন। কবরের চারপাশে কেউ যেন প্রতিদিন ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে। জীন-পরী থাকলে ওখানে কেউ এসে ঝাড়ু দিতে পারত না। আচ্ছা ওমর চাচা, তুমি কি জান, ওটা কার কবর?
ওমর সব কিছু জানে। আরিফকে কোন কিছু জানাতে গোফরান সাহেবের নিষেধ। তাই বলল, শুনেছি এটা কোন পরীর কবর। তাদেরই কেউ হয়তো প্রতিদিন ঝাড় দিয়ে যায়। ততক্ষণে তারা সেই জায়গার কাছাকাছি এসে পড়েছে। ওমর দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ওখানে গিয়ে কাজ নেই, অন্য দিকে যাই চল।
আরিফ ওমরের কথার মধ্যে রফিকের কথার যেন একটু মিল খুঁজে পেল। বলল, চল না চাচা, এতদূর যখন এসেছি কবরটা একবার দেখে যাই, কবরটা দেখতে খুব ইহে করছে। তারপর সে চলতে শুরু করল।
ওমর এক রকম বাধ্য হয়ে তার সঙ্গে এগোল।
ফেরার পথে ওমর বলল, তুমি যেন একা একা এখানে আর কোনদিন এসো না। আর আজ যে এসেছিলে, সে কথা তোমার আব্বা-আমাকে বলো না।
ওমর চাচার কথা শুনে আরিফের মায়ের সাবধান বাণীর কথা মনে পড়ল, সেও তাকে এদিকে আসতে নিষেধ করেছে। কিন্ত তার মন যে মানে না। প্রতিদিন কবরের কাছে আসতে তার মন চায়। সেই জন্যে ওমরকে অন্য কাজে পাঠিয়ে প্রায়ই একাকি ঐ কবরের কাছে আসে। জীন-পরীর ভয়ের কথা তার মনেই পড়ে না। এভাবে দুবছর পর আই. এস. সি. পাস করে আরিফ ঢাকায় ভার্সিটিতে জুওলজীতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হল।
গোফরান সাহেব নিজে ঢাকায় এসে একতলা, তিন কামরা সেপারেট বাসা ভাড়া নিয়ে আরিফের থাকার ব্যবস্থা করে দিল। তাকে দেখাশুনা ও রান্না করে খাওয়ানোর জন্য এমরকে তার কাছে রেখে গেল।
সে সব আজ থেকে ছয় বছর আগের ঘটনা। এ বছর আরিফের মাস্টার্স কোর্সের পরীক্ষা হবার কথা। কিন্তু সেসন জটের জন্য পিছিয়ে গেছে।
আজ যখন আরিফ খাওয়া-দাওয়ার পর ওমরকে জিজেস করল, কারো দিকে তাকালে কখনো কখনো তার ভূত-ভবিষ্যৎ দেখতে পাই এবং কারো কারো মনের খবর বুঝতে পারি। তখন সে কি উত্তর দেবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে বসে এই সব চিন্তা
আরিফ বলল, কি হল ওমর চাচা, কিন্তু বলছ না কেন?
ওমর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি মূর্ণ মানুষ, কি করে বলব বাবা? আপনি আরো একটু ঘুমান, এত রোদে কোথাও যাবেন না।
আরিফ বলল, ঠিক আছে তুমি এবার খেতে দাও।
আরিফ ভাত খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল। যখন তার সুম ভাঙল তখন বেলা সাড়ে চারটে। আসরের নামাজ পড়ে হাসপাতালে এসে প্রথমে খায়ের সাহেবকে বেড়ে দেখতে না পেয়ে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল, তিনি সুস্থ হয়ে বাসায় চলে গেছেন। তারপর ফাল্গুনীর বেডের কাছে গেল।
চারটের সময় রুগীদের লোকজনদের আসতে দেখে ফাল্গুনীর চোখ আরিফকে খুজতে লাগল। শেষে যখন পাঁচটা বেজে গেল তখন হতাশ হল, ভাবল, সে হয়তো আসবে না। আকাশীকে জিজ্ঞেস করল, খালা, ঐ ছেলেটা এল না কেন বলতো?
আকাশী বলল, কি করে বলব মা, হয়তো কোন কাজে আটকা পড়েছে। এমন সময় আরিফকে দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখে বলল, এ তো আসছে।
ফাল্গুণী এখন বেশ সন্তু। সে বলল, আমাকে ধরে বসাও।
আকাশী তাকে বসিয়ে দিল।
আরিফ এসে বলল, বেশ দেরি করে ফেললাম, এখন আপনাকে সকালের চেয়ে একটু সুস্থ দেখছে। আলাহ পাকের রহমতে নিয় আগের থেকে ভাল আছেন?
ফাল্গুনী সকালে রাত জাগা উসকো-খুসকো আরিফকে দেখেছিল। এখন ফ্রেশ দেখে মুগ্ধ হল। বলল, জী, আগের থেকে সুস্থ বোধ করছি।
আকাশী বেডের তলা থেকে একটা চুল টেনে দিয়ে বলল, বসুন বাবা বসুন।
আরিফ বসে বলল, আসবার সময় আপনাদের বাসা হয়ে এলাম। আসগর বলল আপনার বাবা রাতে ফোন করেছিলেন। বলেছেন তোরে রওয়ানা দেবেন। এতক্ষণে তো এসে যাবার কথা। হয়তো ফেরীর কারণে দেরি হচ্ছে।
ফাল্গুনী বলল, আপনি চলে যাবার পর আসগর চাচা এসে সে কথা বলে গেছে। আপনার পরিচয়টা বললে খুশি হব।
আরিফ নাম বলে বলল, আমি জুলজীতে মাস্টার্স করছি, বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার সমেশপুর গ্রামে।
হলে থাকেন?
না, একটা বাসা বাড়া নিয়ে থাকি। এবার আপনারটা বলুন।
আমার নাম ফাল্গুণী। বাংলায় অনার্স করছি।
আপনার চেহারার মত নামটাও খুব সুন্দর। আল্লাহপাক আপনার নামের অর্থের মত আপনাকে সৌন্দর্য দান করেছেন, ভাল নাম নিশ্চয় আছে?
ফাল্গুণী এর আগে অনেকের কাছে তার রূপের প্রশংসা শুনেছে, কিন্তু এরকম ভাবে কেউ করেনি। লজ্জায় তার মুখটা রাঙা হয়ে গেল। মৃদু হেসে বলল, আসমা বিনতে ইলিয়াস।
আরিফ সুবহান আল্লাহ বলে বলল, এক্সেলেন্ট। দুটো নামই সার্থক। ফাল্গুনী আরো বেশি লজ্জা পেয়ে বলল, আসমার অর্থটা বলল।
অতুলনীয়।
আপনার নামের অর্থটা জানতে খুব ইচ্ছা করছে।
আমার ডাক নাম আরিফ, আরিফের দুটো অৰ্থ-পবিত্র ও জ্ঞানী। আর আমার আসল নাম আরিফুল্লাহ। তার অর্থ হল, আল্লাহ পবিত্র অথবা আল্লাহ জ্ঞানী। এবার আসি তাহলে?
ফাল্গুনী বলল, এই তো এলেন, এক্ষুনি চলে যাবেন?
না মানে, আপনি তো এখনো অসুস্থ। আপনার বিশ্রামের প্রয়োজন।
ফাল্গুনী ভিজে গলায় বলল, আপনি থাকলেই বরং সুস্থ বোধ করব।
এমন সময় ইলিয়াস সাহেব সেখানে এসে পৌঁছালেন। তিনি বাসায় না গিয়ে ডাইরেক্ট এখানে এসেছেন।
ফাল্গুনী আব্বা বলে তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। আর কোন কথা বলতে পারল না।
ইলিয়াস সাহেবেরও চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। নিজেকে কিছুক্ষণের মধ্যে সামলে নিয়ে মেয়ের মাথায় ও পিঠে হাত বুলাতে বুলোত বললেন, চুপ কর মা প কর। আম্লাহ পাকের কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া জানাই, তিনি তোকে সুস্থ করে দিয়েছেন। রাজশাহী অফিসের ম্যানেজারের কাছে তোর অসুখের খবর শুনে সারারাত আল্লাহর দরবারে দোয়া চেয়েছি, তিনি যেন তোকে হায়াতে তৈয়েবা দান করেন, তোক সুস্থ করে দেন।
ফাল্গুনী বাবাকে ছেড়ে দিয়ে চোখ মুখ মুছে আরিফকে দেখিয়ে বলল, পরিচয় করিয়ে দিই, ও আরিফ সাহেব, জুওলজীতে মাস্টার্স করছেন। তারপর আরিফের দিকে চেয়ে বলল, আমার আব্বা।
আরিফ আগেই বুঝতে পেরে উঠে দাঁড়িয়েছিল। সালাম বিনিময় করে বসতে বলল।
ইলিয়াস সাহেব বসে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, এখন যেন আমি?
দুপুরের পর থেকে ভাল আছি। জান আব্বা আরিফ সাহেব সাহায্য না করলে আমি বাঁচতাম কিনা জানি না। ওঁর সাহায্যেই একরকম বেঁচে গেছি।
আরিফ তাকে বাধা দিয়ে বলল, ওরকম কথা বলবেন না। বাঁচা মরা আল্লাহ পাকের হাত। মানুষ হিসাবে যতটুকু করার আমি করেছি
ইলিয়াস সাহেব আরিফের সঙ্গে হাত মোসাফা করে বললেন, তবু আপনি যা করেছেন সে জন্য আন্তরিক মোবারকবাদ জানাচ্ছি।
আরিফ বলল, এবার আমি আসি। তারপর সালাম বিনিময় করে চলে যেতে উদ্যত হলে ইলিয়াস সাহেব বললেন, সময় করে বাসায় আসবেন।
জ্বী আসব বলে আরিফ ফাল্গুনীর দিকে তাকিয়ে দেখল, মিনতিভরা চোখে তার দিকে চেয়ে আছে। বলল, এখন চলি ইনশাল্লাহ আবার দেখা হবে। তারপর দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে চলে এল।
আরিফ হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আবসারের বাসায় গেল। খায়ের সাহেবের সঙ্গে দেখা করে চলে আসতে চাইলে আবসার বলল, সে কিরে কিছু না খেয়ে চলে যাবি?
রীমাও সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, আরিফ ভাই বসুন, চা-নাস্তা খেয়ে যাবেন, কথা আছে।
আরিফ আর আপত্তি করল না।
কিছুক্ষণের মধ্যে রীমা চা-নাস্তা নিয়ে এসে পরিবেশন করে, আরিফকে জিজ্ঞেস হলে, আপনার সেই রুগিনীর খবর কি?
আরিফ বলল, ভাল আছেন।
তার সঙ্গে কিছু কথাবার্তা হয়েছে নিশ্চয়?
হওয়া তো স্বাভাবিক।
আবসার বলল, হ্যারে তার বাবার খবর কি?
আমি হাসপাতালে থাকতেই উনি এসেছেন।
ও তার সঙ্গেও পরিচয় হয়েছে নিশ্চয়?
তা হয়েছে। ভদ্রলোককে বেশ ধার্মিক মনে হল।
রীমা মৃদু হেসে বলল, তাহলে তো ভালই।
আরিফ একটু অবাক হয়ে বলল, তার মানে?
মানে আবার কি? বাবা ধার্মিক হলে, মেয়েও ধার্মিক হবে। আপনার সঙ্গে বনবে ভাল।
আরিফ লজ্জা পেয়ে বলল, ভাবি যে কি
কি আবার, সত্যি করে বলুন তো, মেয়েটা পছন্দ করার মত কিনা?
ভাবি আপনি কিন্তু অন্য সেন্সে কথা বলছেন।
আবসার বলল, তুই মেয়েটার জন্যে অনেক করেছিস। সে জন্যে তোর কাছে সে ঋণী।
আরিফ বলল, কি আর করেছি, তার জায়গায় অন্য কেউ হলেও করতাম। এটাই মানব ধর্ম। যাক এখন আসি। তারপর তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এল।
পরের দিন আরিফ একটা চিঠি পেল। চিঠিটা রফিক দিয়েছে। বেশ অবাক হয়ে খুলে পড়তে লাগল
আরিফ, আজ সাত আট বছর আমাদের
দুজনের কোন সম্পর্ক নেই।
কিন্তু ছোট বেলা থেকে
আমরা দুজনে একবৃন্তে দুটো ফুলের মত জীবন কাটিয়েছি। তোকে তোর আসল পরিচয় বলার
পর থেকে তুই আমার সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করে দিলি। কারণটা জানতে চাই না। তবে একটা অনুরোধ করছি, সে দিন তোকে যে তোর আসল পরিচয় বলেছিলাম, মনে হয় তুই তা বিশ্বাস করিস নি। কিন্তু আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি তা সব সত্য। তুই
ই করলে এনায়েতপুরে গিয়ে তার বড় চাচার সঙ্গে দেখা করে সত্য মিথ্যা যাচাই করতে পারিস। তার নাম খলিল। তোর আব্বা ব্যবসা করে অনেক বিষয়-সম্পত্তি করেছি। সেই সব সম্পত্তি
ও ব্যবসা তোর বড় চাচা ভোগ
করছেন। তিনি খুব ভাল মানুষ। আমি বেশ কিছু দিন আগে তার সঙ্গে দেখা করে
তোর আসল পরিচয় বলে সত্য। মিথ্যা জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি চোখের পানি ফেলতে ফেলতে স্বীকার করে
বললেন, তোর ফুফা-ফুফির (গোফরান চাচা ও তার স্ত্রীর) কোন ছেলে মেয়ে হয়নি। তাদের অনুরোধে তিনি
তোর সঙ্গে যোগাযোগ
রাখেননি। তবে তার ছেলেটার আচার-ব্যবহার তেমন ভাল নয়। তোর বড় চাচা খুব কঠিন অসুখে ভুগছে। মনে হয় বেশি দিন বাঁচবে
না। আমি গোফরান চাচার চাচাতো ভাইয়ের ছেলে শুনে বললেন আরিফকে মরবার আগে একবার
দেখতে চাই। আর তার বাপের বিষয়-সম্পত্তিও বুঝিয়ে দিতে চাই। তাকে বলল সে যেন তাড়াতাড়ি আমাকে একবার দেখতে আসে। তুই উচ্চ শিক্ষা নিসি শুনে তোকে কত দোওয়া করলেন। এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছিস, কেন এত বছর পরে তোকে চিঠি লিখলাম। আশা করি তুই তোর চাচাকে
দেখা দিয়ে তার শেষ ইচ্ছা পূরণ করবি। আর বিশেষ কি লিখব।
ইতি
রফিক
চিঠি পড়ে আরিফের মনের মধ্যে ঝড় উঠল। চিন্তা করল, হয়তো রফিক সত্যি কথাই জানিয়েছে। সিদ্ধান্ত নিল দুএকদিনের মধ্যে এনায়েতপুর যাবে। ওমরকে ডেকে বলল, আমি কাল সকালে ঢাকার বাইরে যাব। ফিরতে দুচারদিন দেরি হতে পারে। তুমি চিন্তা করো না।
ওমর বলল, আমাকে সঙ্গে নেবেন না?
না, আমি একাই যাব।
কিন্তু আপনার আব্বা-আম্মার হুকুম… কথাটা সে শেষ করতে পারল না। আরিফের চোখের দিকে চেয়ে থেমে গেল। তার চোখ দুটো দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে পড়ছে।
আরিফ গম্ভীর স্বরে বলল, আব্বা-আম্মার মত তুমিও আমার কাছে অনেক কিছু গোপন করেছ। এবার আমি নিজেই সেই গোপনতত্ত্ব আবিষ্কার করব।
ওমর তার হাতে চিঠি দেখে ভাবল, চিঠি পড়ে হয়তো তার মন খারাপ হয়েছে। ভয়ে সে কথা জিজ্ঞেস করতে পারল না। কাচুমাচু হয়ে বলল, আপনি ওরকম করে চেয়ে রয়েছেন কেন? আর গোপন করার কথা কি বলছেন, আমি তো কিছু বুঝতে পারছি।
আরিফ দৃষ্টি সংযত করে ভিজে গলায় বলল, কেউ বুঝেও না বুঝার ভান করলে তাকে বুঝা যায় না। অবশ্য এতে তোমার কোন দোষ নেই। ঠিক আছে, তুমি এখন যাও।
খোদার কি সান, ঐ দিন সন্ধের আগে গোফরান সাহেব ও সুফিয়া বেগম এসে, গেলেন।
গত মাসে আরিফের পঁচিশ বছর পূর্ণ হয়েছে। সুফিয়া বেগম স্বামীকে সে কথা জানিয়ে আরিফের গলায় আর একটা তাবিজ বাধার কথা বলে তাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি আসার জন্য চিঠি দিতে বলেন।
গোফরান সাহেব বললেন, এত তাড়াহুড়া করছ কেন? ও এখন পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। তা ছাড়া নেসার ফকির তো বলেছিল, আরিফ নিজের পরিচয় জানতে চাওয়ার পর গলায় তাবিজ বাঁধতে।
সুফিয়া বেগম বললেন, তবু আমি বাঁধতে চাই আমাদের কাছ থেকে জানার আগে যদি আরিফ কারো কাছ থেকে জেনে গিয়ে আমাদেরকে কিছু জিজ্ঞেস করে তখন কি করবে?
গোফরান সাহেব বললেন, ঠিক আছে, আমি তাকে বাড়ি আসার জন্য চিঠি দিচ্ছি।
পনের-বিশদিন পার হয়ে যাবার পরও যখন আরিফ এল না, তখন একদিন সফিয়া বেগম স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার চিঠি পেয়েও আরিফ আসছে না কেন?
গোফরান সাহেব তখন স্ত্রীর কাছে চিঠি দেবার কথা বললেও সংসারের কাজের চাপে সে কথা একদম ভুলে গেছেন। বললেন, আরিফের আর দোষ কি? আমি তাকে চিঠি দিতে ভুলে গেছি। আজই লিখব।
সুফিয়া বেগম অভিমান করে বললেন, এ রকম ভুল করা তোমার ঠিক হয়নি। যাই হোক তোমাকে আর চিঠি লিখতে হবে না। আগামী কাল ঢাকা যাবার ব্যবস্থা কর। আমিও তোমার সঙ্গে যায়। সেখানেই তার গলায় তাবিজটা পরিয়ে দেব।
গোফরান সাহেব এর কথার কোন প্রতিবাদ করতে পারলেন না। তবে সংসারে কাজের কথা বলে এক সপ্তাহ পরে রওয়ানা দিলেন। সহে ওমরের বৌ আনোয়ারাকেও নিলেন।
আরিফ বাসাতেই ছিল। তাদেরকে দেখে আগের মত খুশি হতে পারল না। তবু সালাম ও কুশলাদি বিনিময় করে কদমবুসি করল।
ছেলের পরিবর্তন এদের চোখ এড়াল না। সুফিয়া বেগম গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে জিএস করলেন, তোর কি হয়েছে বাবা? তোকে যেন কেমন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে।
আরিফ গম্ভীর মুখেই বলল, কিছু একটা হয়েছে, তবে সেটা ঠিক আমি বুঝতে পারছি না।
ঃ নিশ্চয় খাওয়া-দাওয়া ও ঘুমের অনিয়ম করেছিস?
ঃ না আম্মা, ওসব কিছু নয়, এখন তোমরা বিশ্রাম নাও, পরে বলব। এমন সময় মাগরিবের আযান শুনে বলল, আমি মসজিদে যাচ্ছি। তারপর সে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।
গোফরান সাহেব ওমরকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই কিছু জানিস?
ওমর বলল, ছোট সাহেব দুদিন ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করেননি। এক রাত্রে বাসায়ও ছিলেন না। আজ একটা চিঠি এসেছে। চিঠি পড়ার পর আরিফ তাকে যা কিছু বলেছে সব বলল।
গোফরান সাহেব বললেন, ঠিক আছে, তুই আমাদের অজুর পানি দিয়ে নামাজ পড়তে যা।
মাগরিবের নামাজের পর সবাই যখন একসঙ্গে চা-নাস্তা খাচ্ছিল তখন সুফিয়া বেগম আরিফকে বললেন, এবার বলতো বাবা তোর কি হয়েছে?
আরিফ কয়েক সেকেও চুপ করে থেকে বলল, আমি এমন কিছু কথা জানতে পেরেছি, যেগুলো তোমরা আমার কাছে গোপন রেখেই।
সুফিয়া বেগম ছলছল নয়নে বললেন, তুই কি আমাদেরকে অবিশ্বাস করিস?
আরিফ বলল, অবিশ্বাস করার প্রশ্নই উঠে না। আমি শুধু জানতে চাই, তোমরা আমার কাছে কিছু গোপন করেছ কি না?
সুফিয়া বেগম কিছু বলার আগে গোফরান সাহে র ধরে বললেন, আজ আমরা খুব ক্লান্ত। এ ব্যাপারে কাল তোমার সাথে কথা বলব।
আরিফ আর কোন কথা না বলে নিজের রুমে চলে গেল।
খাওয়া-দাওয়ার পর সুফিয়া বেগম দুধের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে আরিফকে খাইয়ে নিজেরা জেগে রইলেন।
রাত একটার সময় গোফরান সাহেব ও সুফিয়া বেগম নেসার ফকিরের কথামত তাজিবটা আরিফের গলায় আগের তাবিজের সঙ্গে বেধে দিলেন।
সকালে আরিফ মসজিদ থেকে ফজরের নামাজ পড়ে এসে পড়তে বসল।
বেলা আটটার সময় ওমর এসে বলল, বেগম সাহেব আপনাকে নাস্তা খেতে
আরিফ পড়া বন্ধ করে এসে মা-বাবার সঙ্গে নাস্তা খেতে লাগল।
গোফরান সাহেব ও সুফিয়া বেগম ছেলের মুখের দিকে চেয়ে বুঝতে পারলেন, গতকালের চেয়ে আজ তাকে বেশ স্বাভাবিক দেখাচ্ছে।
নাস্তা খাওয়ার পর গোফরান সাহেব আরিফকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুমি গতকাল যে কথা জানতে চেয়েছিলে, তা এখন বলব। তুমি উচ্চ শিক্ষা নিচ্ছ, ভালমন্দ বোঝার জ্ঞানও তোমার হয়েছে। যা বলব তা শুনে উত্তেজিত না হয়ে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করবে। যার কাছ থেকে যা কিছু শুনে থাক না কেন, সেগুলো সব সত্য নাও হতে পারে। আমাদের কথাগুলো সত্য জানবে। তারপর তার মা-বাবা, নানা-নানী ও চাচা চাচীর এবং যখন থেকে তাকে নিয়ে এসেছে সবকিছু বললেন। আরো বললেন, রফিকের বাবা সামসুর কুমতলবের কথা। সে তোমাকে ছোট বেলায় গলা টিপে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। সেই জন্য আমরা তোমাকে তার ছেলে রফিকের সনে মিশতে নিষেধ করেছিলাম। এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছ, আমরা তোমার ফুফা-ফুফি? তোমার মা মারা যাবার পর তোমার নানা নেসার ফকির যে রাতে আমাদের গ্রাম থেকে তোমার নানীকে নিয়ে চলে যান, সে রাতে যাবার আগে তোমার ব্যাপারে যা-যা করতে বলেছিলেন, আমরা সে সব পালন করেছি। নিজেদের ইমত কিছু করিনি। আমাদের কোন সন্তান নেই বলে শুধু তোমাকে ছেলে করে নিয়েছি। তুমি বড় হয়ে নিজের পরিচয় জানতে না চাওয়া পর্যন্ত তোমাকে জানাতে তোমার নানার নিষেধ ছিল। তাই এতদিন না জানিয়ে এখন জানালাম। তারপর গোফরান সাহেব চুপ করে গেলেন।
আরিফ নিজের পরিচয় শুনতে শুনতে চোখের পানিতে বুক ভাসাচ্ছিল। গোফরান সাহেব থেমে যেতে উঠে এসে তাদেরকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমার আব্বা-আম্মাকে আরাহপাক দুনিয়া থেকে তুলে নিয়েছেন। তোমাদেরকেই আমি আব্বা-আম্মা বলে জানি, আর চিরকাল তাই জানব। আমাকে তোমরা দূরে সরিয়ে দিয়ো না।
সুফিয়া বেগম আরিফকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, এরকম কথা বলতে পারলি? দূরে সরিয়ে দেবার জন্য কি তোকে তোর সাড়ে তিন বছর বয়স থেকে লালন-পালন করে আসছি? তুই আমার পেটে না হলেও পেটের ছেলের মত তোকে মানুষ করেছি। তোকে ছাড়া আমরা বাঁচব কি করে। তোর ফুফা তার সমস্ত সম্পত্তি তোর নামে উইল করে দিয়েছে। তাই তো রফিকের আব্বা আমাদের সবার দুশমন। কিছুদিন আগে যেদিন তোর ফুফা উইল করার জন্য সিরাজগঞ্জ কোর্টে যাচ্ছিল তখন রফিকের আব্বা গুণ্ডা লাগিয়ে তাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। আল্লাহপাকের অসীম দয়ায় কিছু করতে পারেনি।
এই কথা শুনে আরিফ কান্না থামিয়ে ফুফাঁকে বলল, তুমি এর কোন প্রতিকার করনি?
গোফরান সাহেব বলল, আমি কোন ঝামেলায় যেতে চাইনি। আল্লাহপাকের বিচার আল্লাহপাকই করবেন। আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। ক্ষমাকারীকে আলাহপাক খুব ভালবাসেন। এটা কোরআন-হাদিসের কথা।
ঃ কিন্তু দুষ্টের দমন করাও কোরআন-হাদিসের কথা নচেৎ তাদের সাহস আরো বেড়ে যাবে। তাদের সংখ্যা বেড়ে গেলে সমাজের অনেক ক্ষতি হবে।
: তা আমি জানি। তবে অপরাধীকে ক্ষমা করে ভাল হবার সুযোগ দেওয়াও কোরআন-হাদিসের কথা। আমি সামসুর জন্য সব সময় আলাহপাকের কাছে দোওয়া চাই, তিনি যেন তাকে হেদায়েৎ দান করেন। নিজের ভুল বোঝার তওফিক দেন। আমাদের রসুল (দঃ)ও তাই করতেন।
: কি রসুল (দঃ) অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোরও ছিলেন?
: না, তিনি কখনও কঠোর ছিলেন না। প্রথমে অপরাধীকে ক্ষমা করে ভাল হবার সুযোগ দিতেন। তাতে সংশোধন না হলে তখন তার বিচার করে শাস্তি দিতেন।
আরিফ আর কিছু না বলে পকেট থেকে রফিকের চিঠিটা বের করে তার হাতে দিয়ে বলল, গতকাল পেয়েছি।
গোফরান সাহেব পড়ে স্ত্রীকে দিলেন।
সুফিয়া বেগম পড়ে আরিফের দিকে চেয়ে বললেন, রফিক নেসার ফকিরের সম্বন্ধে কিছু জানে না। তাই তার ও আমাদের সম্বন্ধে মনগড়া কথা লিখেছে। তবে বাকি যা লিখেছে, সেসব তো আমরা তোমাকে বললাম।
আরিফ বলল, আমি আজ এনায়েতপুর যাব বলে ঠিক করেছিলাম।
সুফিয়া বেগম স্বামীর দিকে তাকালেন।
গোফরান সাহেব আরিফের দিকে চেয়ে বললেন, তোমার চাচা মাসখানেক আগে মারা গেছে। তার অসুখের খবর আমরা জানতাম না। মারা যাবার খবর পেয়ে তোমার আম্মা ও আমি গিয়েছিলাম। তোমাকে গোপন করে আমরা বরাবর তার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি। অসুখের খবরটা কেন যে দিল না বুঝতে পারিনি। তবে মনে হয় তোমার চাচা হয়তো আমাদেরকে খবর দিতে তার ছেলে সাজ্জাদকে বলেছিল। সে দেয়নি। আমরা সে কথা জিজ্ঞেস করতে সাজ্জাদ চুপ করে ছিল। তোমার চাচা খুব ভাল লোক ছিল। কিন্তু তার ছেলে সাজ্জাদ তত ভাল নয়। সে তার মায়ের মত হয়েছে। তারা বিষয় সম্পত্তি ও ব্যবসাপত্র যা কিছু ভোগ করছে তা প্রায় সবই তোমার বাপের। তার হাবভাবে যা বুঝলাম, সে তোমাকে তোমার বাপের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে চায়। আমরা কাল এসেছি। তোমার সঙ্গে যাবার ইচ্ছা থাকা সত্তেও যেতে পারব না। তুমি ই করলে ওমরকে সাথে নিয়ে একবার ঘুরে আসতে পার। তবে একটু সাবধানে থাকবে। দু একদিনের মধ্যে ফিরে এল।
আরিফ বলল, আমি একাই যাব। আর দুএকদিনের মধ্যে ফিরে আসতে না পারলে তোমরা দুশ্চিন্তা করো না, আল্লাহপাক যেন আমাকে হেফাজত করেন সেই দোওয়া করো।
সুফিয়া বেগম আতঙ্কিত হয়ে বললেন, তোর হেফাজতের জন্য তো সব সময় দোওয়া করি। কিন্তু তোকে তারা কেউ চিনে না, এমনকি পাড়াপড়শীরাও চিনে না। তুই তো অনেক অসুবিধায় পড়বি।
আরিফ বলল, সব রকম অসুবিধা কাটিয়ে উঠার তওফিক আল্লাহপাক আমাকে দিয়েছেন। তোমরা দেখে নিয়ো, ইনশাআল্লাহ আমি সহিসালামতে ফিরে আসব। আমি তো তাদের সঙ্গে ঝগড়া বা মারামারি করতে যাচ্ছি না যে, তারা আমাকে দুশমন ভেবে আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করবে?
সুফিয়া বেগম বললেন, তোর আব্বা এখানে থাকুক, আমি তোর সঙ্গে যাব।
আরিফ বলল, তা কি করে হয়? আব্বার অসুবিধে হবে। নিজের বাড়িতে যাব। তাতে দুশ্চিন্তা করছ কেন?
সুফিয়া বেগম কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। গোফরান সাহেব তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আরিফ ঠিক কথা বলেছে। ও একাই যাক। ওর একা যাওয়া দরকার আছে বলে আমি মনে করি।
সুফিয়া বেগম স্বামীর কথার উপর কোনদিন কথা বলেননি। আজও বললেন না। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে আরিফকে বললেন, তাড়াতাড়ি ফিরবি কিন্তু।
আরিফ বলল, তাতে ফিরবই। তবে দেরি হলেও কোন চিন্তা করো না। তারপর তৈরি হয়ে আব্বা-আম্মাকে কদমবুসি ও সালাম বিনিময় করে রওয়ানা দিল।
আরিফ যখন এনায়েতপুরে গিয়ে পৌঁছাল তখন মাগরিবের আযান হচ্ছে। মসজিদে নামাজ পড়ে ইমাম সাহেবের কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, আপনি যদি মেহেরবানী করে আমার চাচাতো ভাই সাজ্জাদকে কাউকে দিয়ে ডেকে পাঠান, তাহলে বড় উপকৃত হতাম।
ইনি সেই আগেরই ইমাম সাহেব। যিনি আরিফের আবা জাকিরের সবকিছু জানেন। ওঁর এখন বেশ বয়স হয়েছে। আরিফের পরিচয় পেয়ে সুবহান আল্লাহ বলে বললেন, তুমি এত বড় হয়েছ? ভোমাকে সেই তিন সাড়ে তিন বছরের দেখেছিলাম। বুঝতে পারছি, তুমি আর কোনদিন এখানে আসনি। ঠিক আছে, তুমি বস, আমি ব্যবস্থা করছি। তোমার আব্বার দানেই তো মসজিদ-মাদ্রাসা চলছে। আল্লাহ তার রুহের মাগফেরাত দিক। জাকিরের মত লোক দুনিয়ায় খুব কম জন্মায়। তোমার চাচাও খুব ভাল লোক ছিলেন। এই তো মাসখানেক হল মারা গেলেন। তারপর মসজিদের খাদেমকে বললেন, সাজ্জাদকে ডেকে নিয়ে এস।
সাজ্জাদ এসে ইমাম সাহেবকে সালাম দিয়ে আরিফকে দেখিয়ে বলল, ইনাকে তো চিনতে পারছি না।
ইমাম সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে আরিফের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
সাজ্জাদ যেন ভুত দেখার মত চমকে উঠে মুখটা কালো করে আরিফের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখতে লাগল।
আরিফ তার পরিবর্তন লক্ষ্য করে মনে মনে হাসল। তারপর বলল, তোমরা সব কেমন আছ? চাচী আম্মা ভাল আছেন?
সাজ্জাদ খুব চালাকচতুর ছেলে। ম্যাট্রিক পাস করার পর আর পড়েনি। চাষ বাস ও বাবার সঙ্গে ব্যবসা দেখানা করত। বাবা মারা যাবার পর তাকেই সবকিছু দেখাশুনা করতে হবে। তার মনে হল আব্বা মারা গেছে শুনে আরিফ তার বাবার সম্পত্তি নিতে এসেছে। সেই জন্য আরিফের পরিচয় পেয়ে মুখ কালো হয়ে গেছে। আরিফের কথা শুনে বলল, হ্যাঁ সবাই ভাল আছি।
ইমাম সাহেব বললেন, আরিফ ঢাকা থেকে এসেছে বাড়িতে নিয়ে যাও। খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা কর।
সাজ্জাদ মনে মনে রেগে গেলেও তা প্রকাশ না করে আরিফকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে এল। তারপর মাকে খবরটা জানাল।
নিহারবানুও শুনে চমকে উঠলেন। হঠাৎ খবর না দিয়ে আরিফ আসবে তিনি যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না। বললেন, তাকে কোথায় বসিয়েছিস?
সাজ্জাদ বলল, বৈঠকখানায়।
নিহারবানু বললেন, যা তাকে নিয়ে আয়। আমি ওর মায়ের রুম খুলে দিচ্ছি। সাজ্জাদ চলে যাবার পর নিহারবানু ছোট জায়ের ঘর খুলে সুইচ টিপে খুব অবাক হয়ে গেলেন। আরিফের বাবা জাকির মারা যাবার পর থেকে ঐ ঘর চাবি দেওয়া আছে। নিহারবানু নিজে ঐ ঘরে থাকতে চেয়েছিলেন, কিন্তু থাকতে পারেননি। স্বামীর নিষেধ সত্ত্বেও নিহারবানু যখন একরাতে ঐ ঘরে সাজ্জাদকে নিয়ে ঘুমাতে গেলেন, কিন্তু ঘুমাতে পারেননি। চোখ বন্ধ করলেই যেন মনে হয়, সাদিয়া ঘরের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করছে। তখন এনায়েতপুরে কারেন্ট যায়নি। হারিকেন জেলেই শুয়ে ছিলেন। সাদিয়া হাঁটাহাঁটি করছে মনে হলে চেয়ে দেখেছেন, কিন্তু তাকে দেখতে পাননি। শেষে ভয় পেয়ে সাজ্জাদকে নিয়ে নিজের রুমে চলে আসেন। তারপর থেকে সেই যে চাবি দিয়ে রেখেছিলেন এত বছর আর খুলেননি। আজ খুলে দেখলেন, সব কিছু পরিপাটি। এতটুকু ধুলো পর্যন্ত বিছানায় বা অন্য আসবাবপত্রে পড়েনি। আরিফের বাবা ও মায়ের কাপড় চোপড় আলনায় যেমন গোছান ছিল, ঠিক তেমনি রয়েছে, সেগুলোতেও কোন ধুলো বালি নেই। মনে হয় যেন একটু আগে কেউ ঘরটা ঝেড়েকুড়ে পরিষ্কার করেছে। আগের মতই ঘর থেকে আতর গোলাপের খবুই বেরোচ্ছে। সাজ্জাদের সঙ্গে আরিফকে আসতে দেখে দরজা থেকে পাশে সরে তার দিকে চেয়ে রইলেন। বাপের মতন আরিফের মুখের গড়ন হলেও রংটা মায়ের মত সাদা ধবধবে। এত সুন্দর ছেলে নিহারবানু আর দেখেননি। হঠাৎ তার মনে পড়ল, একেই ছোট বেলায় বিষ খাইয়ে এবং গলা টিপে মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম।
সাজ্জাদ মায়ের কাছে এসে আরিফকে উদ্দেশ্য করে বলল, ইনি আমার মা।
আরিফ নিহারবানুকে কদমবুসি করে বলল, কেমন আছেন চাচী আম্মা?
নিহারবানু তার মাথায় হাত বুলিয়ে চুমো খেয়ে বললেন, বেঁচে থাক বাবা, আল্লাহ তোমাকে বাঁচিয়ে রাখুক। তুমি ভাল আছ বাবা?
আরিফ বলল, জী ভাল আছি।
নিহারবানু বললেন, তোমার ফুফু-ফুফা ভাল আছে? তারা এল না কেন?
আরিফ বলল, জী ভাল আছে। তারা পরে সময় করে আসবে।
নিহারবান বললেন, তুমি যদি কিছুদিন আগে আসতে বাবা, তাহলে তোমার চাচা তোমাকে দেখে শান্তিতে মরতে পারত। মারা যাবার আগে পর্যন্ত তোমাকে দেখতে চেয়েছিল।
আরিফ বলল, সব কিছু আল্লাহ পাকের ইশারা।
নিহারবানু বললেন, এটা তোমার মা-বাবার ঘর। তুমি ভিতরে গিয়ে বস, আমি তোমার খাবার ব্যবস্থা করি। তারপর সাজ্জাদকে নিয়ে চলে গেলেন।
আরিফ ঘরের ভিতরে ঢুকে মনের মধ্যে এক ধরনের শান্তি অনুভব করল। তার মনে হল, সে যেন তার মায়ের কোলে এল। মায়ের কথা তার মনে নেই। আতর গোলাপের খশরুই পেয়ে ভাবল, এই খুশবুইয়ের উৎস কোথায়? ঘরের চারপাশে তাকিয়ে কিছুই বুঝতে পারল না। অনেছে তার মা পরী ছিল ডাবল পরীর সঙ্গে কি মানুষের বিয়ে হয়? আবার ভাবল, হয়তো হবে। আল্লাহ পাকের কুদরত মানুষের বোঝার অসাধ্য। পরীরা খুব সুন্দরী হয়। তাহলে তার মাও নিশ্চয় খুব সুন্দরী ছিল। এই সব ভাবতে ভাবতে এক সময় তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল।
কয়েক মাস আগে রফিক যখন এনায়েতপুরে আরিফের খোঁজ নিতে এসেছিল তখন খলিল সাহেব আরিফকে গোপনে আসার জন্য রফিককে বলেছিলেন, সে কথা নিহারবান এনেছিলেন। রফিক চলে যাবার পর ছেলেকে সে কথা জানিয়ে তার সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন, আরিফ এলে মেরে গুম করে ফেলা হবে।
সাজ্জাদ মায়ের মত কুটিল হয়েছে। সেও তাই চায়। সে জন্যে বাজারের দুজন ওকে হাত করে রেখেছে।
আজ নিহারবানু আরিফকে তার মায়ের ঘরে রেখে সাজ্জাদকে নিয়ে রান্না ঘরে এসে বললেন, শক্ত হাতের মুঠোয় এসেছে। এই সুযোগ আর পাবি না। কি করে কি করবি, ঠিক করে রেখেছিস তো?
সাজ্জাদ বলল, হ্যাঁ ঠিক করে রেখেছিলাম, কিন্তু সে প্ল্যান করা যাবে না। আরিফ যে এসেছে তা মসজিদের ইমাম ও খাদেম জানে। তাই ভেবেছি, এখানে কিছু করা ঠিক হবে না। মনে হয়, এসেছে যখন তখন হয়তো দুচারদিন থাকবে। এর মধ্যে বাইরে নিয়ে গিয়ে কাজটা করতে হবে। আমরা সেই সুযোগের অপেক্ষায় থাকবো।
নিহারবানু বললেন, যা কিছু করবি, খুব সাবধানে করবি। আর শোন, আরিফের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করতে হবে। সে তোর ছোট হলেও তোর চেয়ে অনেক বেশি লেখাপড়া করেছে। তুই-তোকারি করে কথা বলবি না। মোট কথা এমন ব্যবহার দেখাতে হবে সে যেন বুঝতে না পারে তার প্রতি আমরা অসন্তুষ্ট। একটা কথা মনে রাখবি, সে এখানকার প্রায় সবকিছুর এখন মালিক। তোর আব্বার আর কতটুকু আছে।
সাজ্জাদ বলল, তোমাকে আর বেশি কিছু বলতে হবে না। যা যা বললে সেই মত করব।
সে রাতে আরিফ ঘুমাতে পারল না। সারারাত নফল নামাজ ও কোরান তেলাওয়াত করে আব্বা-আম্মার রুহের মাগফেরাতের জন্য দোয়া চাইল।
পরের দিন সাজ্জাদ আরিফকে তার বিষয় সম্পত্তি ও ব্যবসাপত্র দেখিয়ে বেড়াল। ধান চাল ও পাটের আড়তের কর্মচারীরা আরিফের পরিচয় পেয়ে খুব আনন্দিত।
আরিফ প্রথম দিন সাজ্জাদের সঙ্গে পরিচয় হবার সময় তার মুখের দিকে চেয়ে যা বুঝতে পেরেছিল, পরের দিন সকাল থেকে তার বিপরীত দেখে বিপদের গন্ধ পেল। তার মনে হল, এত খাতির-যত্নের পিছনে নিশ্চয় কোন কুমতলব আছে। তখন তার আব্বার কথা মনে পড়ল, খুব সাবধানে থাকবে। এখানে এসে কি করবে, তা সিদ্ধান্ত নিয়েই এসেছে। তাই পরের দিন আব্বার কবর জিয়ারত করল। তার পর গ্রামের সবার সঙ্গে পরিচিত হতে লাগল। দু তিন দিন পর উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য কাউকে কিছু না বলে সিরাজগঞ্জ কোর্টে গেল। সানোয়ার একজন নামকরা উকিল। আরিফ লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করে তার কাছে গিয়ে নিজের ইচ্ছার কথা বলল।
সানোয়ার উকিলের বাড়ি এনায়েতপুরে। টাউনে বাড়ি করে ফ্যামিলী নিয়ে থাকেন। তিনি আরিফের বাপ-চাচাদের চিনেন। গোফরান সাহেবকেও চিনেন। আরিফের কথা শুনে বললেন, আপনি জাকিরের উপযুক্ত সন্তান। আপনার নানা-নানী ও মায়ের সঙ্গে অনেক কিংবদন্তি আছে। আপনি কি সেসব জানেন?
আরিফ বলল, কিছু কিছু জানি। ওসব কথা থাক। আমি আপনাকে যা কিছু বললাম, সেগুলো একটু তাড়াতাড়ি করবেন। আমাকে সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ঢালয় ফিরতে হবে। সামনে আমার পরীক্ষা। আর শুনুন। একথা আপনি কাউকে জানাবেন
সানোয়ার উকিল বললেন, আপনি চিন্তা করবেন না আমি সবকিছু তৈরি করে আপনাকে খবর দেব। আপনি এসে রেজি িকরে দেবেন। দুএকদিনের মধ্যে পারতাম, কিন্তু আপনি তো কোন দলিলপত্র দিতে পারছেন না। তাই সেগুলো কোর্ট থেকে তুলতে সময় লাগবে।
আরিফ তাকে বেশ কিছু টাকা দিয়ে ফিরে এল।
সাজ্জাদ যে দুজন গুপ্তাকে ঠিক করেছিল তাদের নাম খালেক ও মালেক। আরিফ আসার পরের দিন শুণ্ডা দুজনকে তাকে চিনিয়ে দিয়ে বলেছিল, আরিফ একা গ্রামের বাইরে কোথাও গেলে সুযোগ মত মেরে গুম করে দিবি। তারপর দশ হাজার টাকা দিয়ে বলল, অর্ধেক দিলাম বাকিটা কাজ হাসিল করার পর পাবি। কিন্তু খুব সাবধান, কেউ যেন টের না পায়। সেই থেকে তারা আরিফকে চোখে চোখে রেখেছে।
আজ আরিফ যখন সিরাজগঞ্জ কোর্টে যায় তখন তারাও পিছু নেয়। ফেরার সময়ও তার সঙ্গে ছিল। কিন্তু মার্ডার করার কোন সুযোগ পেল না। আরিফের ফিরতে বিকেল হয়ে গেল।
নিহারবানু অনুযোগসুরে বললেন, সারাদিন না খেয়ে কোথায় ছিলে বাবা? খাওয়া দাওয়া ঠিকমত না করলে অসুখ-বিসুখ করবে। তখন তো সুফিয়া বুবু ও গোফরান ভাই আমাকে দোষ দিবে।
আরিফ বলল, সিরাজগঞ্জে একটা কাজে গিয়েছিলাম।
নিহারবানু বললেন, সে কথা বলে যেতে পারতে বাবা। দিনকাল ভাল নয়, সাজ্জাদ হয় তোমার সাথে যেত। আর কোন দিন একা একা কোথাও যেও না। তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে এস, খেতে দেব। সাজ্জাদ তোমার জন্য অপেক্ষা করে এই কিছুক্ষণ আগে যেয়ে আড়তে গেল।
আরিফ খেয়ে উঠে বাবা মাকে চিঠি লিখে জানাল, তার ফিরতে হয়তো দশবার দিন দেরি হবে। সে জন্য কোনরকম দুশ্চিন্তা যেন না করে।
এদিকে সুফিয়া বেগম আরিফের ফিরতে দেরি দেখে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। স্বামীকে বললেন, আমরাও যাই চল।
গোফরান সাহেব বললেন, আরিফ তো বলে গেল, ফিরতে দেরি হলে আমরা যেন চিন্তা না করি।
কিন্তু আমার মনে বোধ নিচ্ছে না। কেবলই মনে হচ্ছে, সে কোন বিপদে পড়েছে। আমাকে না হয় বাড়িতে রেখে তুমি এনায়েতপুরে যাবে।
তুমি মা, মায়েরা সন্তানের বিপদের কথা বেশি ভাবে। আমি বাপ আমরাও ভাবি; তবে বাপেরা মায়েদের মত অত উতলা হয় না। আরিফ এক সপ্তাহের কথা বলে গেছে, আরো দুএকদিন দেখব; এর মধ্যে না ফিরলে তুমি যা বললে তাই করব।
আরিফ যাবার দুতিন দিন পর আবার তার খোঁজে এল।
গোফরান সাহেব ও সুফিয়া বেগম তাকে চেনেন। আপ্যায়ন করবার পর বললেন, আরিফ দেশের বাড়ি গেছে, সপ্তাহ খানেক পরে ফিরবে।
আবসার কয়েক দিন পরে আসবে বলে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রিল্লা করে ফিরে আসছিল। নিউ এলিফেন্ট রোডের জুতোর দোকানগুলোর সামনে থেকে আসার সময় রীমার কথা মনে পড়ল। সে কয়েক দিন থেকে এক জোড়া স্যান্ডেল কেনার কথা বলছে, ঘোড়ার ডিম মনেই থাকে না। রিক্সাওয়ালাকে বলল, এই ভাই দাঁড়াও তো। রিক্সাওয়ালা রিক্সা থামাবার পর বলল, তুমি একটু অপেক্ষা কর, আমি একজোড়া স্যাভেল কিনব। অবশ্য, এর জন্য ভাড়া বেশি দেব।
রিক্সাওয়ালা বলল, একটু তাড়াতাড়ি করবেন সাহেব।
আবসার একটা দোকানে ঢুকে দেখল সেখানে কয়েক জন যুবতী জুতো কিনছে। সে একজন সেলসম্যানকে একজোড়া লেডিস স্যান্ডেল দেখাতে বলল।
ততক্ষণে যুবতীরা জুতো কিনে বেরোতে যাবে এমন সময় তাদের মধ্যে একজন আবসারের দিকে চেয়ে বলল, কিছু মনে করবেন না, আপনাকে মহাখালী কলেরা হাসপাতালে দেখেছিলাম। আপনি আরিফ সাহেবের বন্ধু না?
আবসার প্রথমে তাকে চিনতে পারল না। কারণ আজ তার মাথায় কালো রুমাল বাঁধা। গায়ে কালো রংয়ের বড় চাদর জড়ানো। তার দিকে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থেকে চিনতে পেরে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, যা আপনি ঠিক বলেছেন।
ঃ আমি বাইরে অপেক্ষা করছি, আপনি কাজ সেরে আসুন, কথা আছে।
আবসার জুতো কিনে দোকানের বাইরে এলে সেই যুবতীটি বলল, আরিফ সাহেবের ঠিকানাটা দেবেন?
আবসার একটা কাগজে ঠিকানা লিখে তার হাতে দিয়ে বলল, আমি এখন তার বাসা থেকে ফিরছি। সে দেশের বাড়িতে গেছে। সপ্তাহ খানেক পরে ফিরবে।
যুবতীটি ধন্যবাদ জানিয়ে সাথীদের নিয়ে চলে গেল।
ঐ যুবতীটি ফাল্গুনী। সে তিন দিনের দিন সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে আসে।
ফাল্গুনী যখন আরিফের সাহায্য করার কথা সব তার বাবাকে বলে তখন ইলিয়াস সাহেব বললেন, ছেলেটাকে আমি দেখেই বুঝতে পেরেছি, খুব বনেদী ঘরের।
তুই তার ঠিকানা জানিস?
ফাল্গুনী বলল, তার নাম আরিফ, দেশের বাড়ি সিরাজগঞ্জের সমেশপুর গ্রামে। ভাসিটিতে জুওলজিতে মাস্টার্স করছে। কিন্তু ঢাকার ঠিকানা জানার সময় পেলাম না। আজ ঠিকানা পেয়ে বাসায় এসে আব্বাকে বলল, আরিফ সাহেবের বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়েছি।
ইলিয়াস সাহেব বললেন, ঠিক আছে আমাকে মনে করিয়ে দিন, কয়েকদিন পরে হয় যাওয়া যাবে।
সাত আট দিন পর ফাল্গুনী আব্বাকে সঙ্গে নিয়ে একদিন বিকেলে আরিফের বাসায় গেল।
কলিংবেলের শব্দ পেয়ে গোফরান সাহেব ওমরকে বললেন, দেখ তো কে এল। ওমর দরজা খুলে আগন্তুকদের চিনতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, কাকে চান?
ইলিয়াস সাহেব বললেন, এখানে আরিফ সাহেব থাকেন?
জ্বী থাকেন।
তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
কিন্তু ছোট সাহেব তো এখনো দেশের বাড়ি থেকে ফেরেন নি।
বাসায় আর কে কে আছেন?
বড় সাহেব ও বেগম সাহেব আছেন।
আমরা তাদের সঙ্গে দেখা করতে চাই।
ওমর কারো সঙ্গে কথা বলছে বুঝতে পেরে গোফরান সাহেব ভিতর থেকে বললেন, ওমর কে এসেছে রে?
ওমর বলল, একজন সাহেব আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে চান। সঙ্গে একজন মেয়েও আছে।
গোফরান সাহেব বললেন, ঠিক আছে ওঁদেরকে ড্রইংরুমে বসা, আমি আসছি।
ওমর আগন্তুকদের বলল, আপনারা ভিতরে এসে বসুন। তারপর ইলিয়াস সাহেব ও ফাল্গুনীকে ড্রইংরুমে এনে বসতে বলে ভিতরে চলে গেল।
একটু পরে গোফরান সাহেব ড্রইংরুমে এসে সালাম দিয়ে বসে বললেন, আপনাদের তো চিনতে পারলাম না।
ইলিয়াস সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, আমরা তো পরিচিত লোক নই যে চিনবেন। আপনার ছেলের সঙ্গেও আমাদের তেমন পরিচয় নেই। কিন্তু তিনি আমাদের যা উপকার করেছেন, তা কোন দিন ভুলতে পারবো না। তাই আপনাদের সবার সঙ্গে পরিচিত হতে এলাম।
গোফরান সাহেব মৃদু হেসে বললেন, ছেলেটার স্বভাবই ঐরকম, তা আপনাদের কি এমন উপকার করেছে?
ইলিয়াস সাহেব মেয়েকে দেখিয়ে বললেন, এ আমার একমাত্র সন্তান। কয়েকদিন আগে এর কলেরার মত হয়েছিল। আমি সে সময় রাজশাহী গিয়েছিলাম। তারপর আরিফ দুদিন কিভাবে তার মেয়েকে সাহায্য করেছিল, সে সব বলে বললেন, ঐ দিন আপনার ছেলে সাহায্য না করলে আমার মেয়ে হয়তো মারাই যেত। তিনি আমাকে টেলিফোন করে খবরটা দেন। আমি আসার পর পর হাসপাতাল থেকে চলে আসেন। পরিচয় নেবার সময়টুকু পর্যন্ত আমাকে দেননি।
গোফরান সাহেব বললেন, সে তো নেই। কয়েকদিন আগে দেশের বাড়ীতে গেছে। তাড়াতাড়ি ফেরার কথা ছিল। আজই তার চিঠি পেলাম, লিখেছে ফিরতে আরো কয়েক দিন দেরি হবে। ইলিয়াস সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝে তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে ফাল্গুনীর অপূর্ব রূপলাবণ্য দেখে গোফরান সাহেব খুব অবাক হলেন। তার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কি মা?
আসমা বিনতে ইলিয়াস, ডাক নাম ফাল্গুনী।
সুবহান আল্লাহ, দুটো নামই খুব সুন্দর।
নিশ্চয় পড়াবনা করছ?
জী বাংলায় অনার্স করছি।
আলহামদুলিল্লাহ।
এমন সময় ওমর দুজনের নাস্তা নিয়ে এসে টেবিলের উপর রেখে ফাল্গুনীর দিকে চেয়ে বলল, উনাকে বেগম সাহেব ভিতরে যেতে বলেছেন।
সুফিয়া বেগম স্বামীর সঙ্গে এসে দরজার পর্দা ফাঁক করে তাদের কথাবার্তা শুনছিলেন। ফাল্গুনীকে দেখে উনিও খুব অবাক হয়েছেন। তাই তাকে ভিতরে ডেকে পাঠিয়েছেন।
ওমরের কথা শুনে বাপ-বেটিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে দেখে গোফরান সাহেবের মুখে হাসি ফুটে উঠল। ফাল্গুনীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, যাও মা ভিতরে যাও, আরিফের আম্মা তোমাকে ডাকছে।
মেয়েকে ইতস্তত করতে দেখে ইলিয়াস সাহেব বললেন, বসে আছিস কেন যা।
ফাল্গুনী ওমরের সাথে পর্দা ঠেলে পাশের রুমে ঢুকে দেখল, একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। তার মনে হলো ইনিই আরিফ সাহেবের মা। সালাম দিয়ে কদমবুসি করতে গেলে সুফিয়া বেগম সালামের উত্তর দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, থাক মা থাক, কদমবুসি করতে হবে না। তারপর দোওয়া করে আনোয়ারাকে নাস্তা নিয়ে আসতে বলে ফাল্গুনীকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সঙ্গে কি আরিফের আগের থেকে পরিচয় ছিল?
ঃ জ্বী না, আমাকে আমাদের কাজের মেয়ে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল, তার মুখে শুনেছি আরিফ সাহেব আগের থেকে হাসপাতালের গেটের কাছে ছিলেন।
ঃ তোমার আম্মা নেই?
জ্বী না, আমার বয়স যখন দশ বছর তখন আম্মা মারা যান
তোমাদের দেশের বাড়ি কোথায়?
রাজশাহী।
ততক্ষণে ফাল্গুনীর খাওয়া শেষ হয়েছে। বলল, এবার আসি খালা আম্মা।
সুফিয়া বেগম ফাল্গুনীর চিবুক ধরে তার দুগালে চুমো খেয়ে বললেন, আমার মেয়ে নেই, তোমারও মা নেই। আজ থেকে তুমি আমার মেয়ে। যখনই ইচ্ছা হবে মাকে দেখতে চলে আসবে।
সুফিয়া বেগমের আদর-সোহাগে ফাল্গুনীর চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল, তখন তার নিজের মায়ের কথা মনে পড়ল। মা তাকে কত ভালবাসত। যখন মা মারা যায় তখন তার বয়স দশ বছর হলেও মায়ের মুখের ছবি বেশ মনে আছে।
তার চোখে পানি দেখে সুফিয়া বেগম জড়িয়ে ধরে গায়ে মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, মায়ের কথা মনে পড়ছে বুঝি? বললাম না, আজ থেকে তুমি আমাকে মা বলে ডাকবে?
ফাল্গুনী কদমবুসি করে জিজে গলায় বলল, আপনি দেখতে অনেকটা আমার মায়ের মত। তাই আপনাকে দেখে মায়ের কথা মনে পড়ছে।
সুফিয়া বেগম বললেন, ও মা তাই নাকি! তাহলে তো আমি তোমার মা হয়েই গেলাম।
ফাল্গুনী বলল, হ্যাঁ, আজ থেকে আপনাকে আমি আম্মা বলে ডাকব।
সুফিয়া বেগম আনোয়ারাকে বললেন, যা তো, আরিফের আব্বাকে ডেকে নিয়ে আয়।
আনোয়ারা ড্রইংরুমে এসে গোফরান সাহেবকে বললেন, বেগম সাহেব আপনাকে ডাকছেন।
গোফরান সাহেব ইলিয়াস সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, কিছু মনে করবেন না, এক্ষুনি আসছি। তারপর পাশের রুমে গেলেন।
স্বামীকে দেখে সুফিয়া বেগম তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমাদের তো কোন মেয়ে নেই। তাই ফাল্গুনীকে আমি মেয়ে করে নিয়েছি। ফাল্গুনীও আমাকে মা ডেকেছে। তুমি কি একে মেয়ে হিসাবে গ্রহণ করবে?
গোফরান সাহেব আলহামদুলিল্লাহ বলে বললেন, এমন মেয়েকে মেয়ে হিসাবে পাওয়া তো সৌভাগ্যের কথা।
ফাল্গুনী গোফরান সাহেবকেও কদমবুসি করে বলল, আপনাদের মেয়ে হতে পেরেছি সেটাও আমার কম সৌভাগ্য নয়। আপনারা আমাদের বাসায় যাবেন।
গোফরান সাহেব বললেন, নিশ্চয় যাব না। তারপর তাকে সঙ্গে করে ড্রইংরুমে এসে ইলিয়াস সাহেবকে বললেন, আজ থেকে ফাল্গুনী শুধু আপনার একার মেয়ে নয়, আমাদেরও মেয়ে। আমার ওয়াইফ একে মেয়ে করে নিয়েছে।
ইলিয়াস সাহেব ইঙ্গিতটা যেন একটু বুঝতে পারলেন। শোকর আলহামদুলিল্লাহ বলে বললেন, এ তো খুব ভাল কথা। আমার মেয়ের সৌভাগ্য আপনাদের মত পুণ্যবান ও পুণ্যবতীর মনে ধরেছে। আমি আপনাদের ছেলেকে মাত্র কয়েক মিনিট দেখেছি এবং তার সঙ্গে দুএকটা কথা বলেছি। তাতেই আল্লাহপাক আমার মনে যে আশার সঞ্চার করিয়েছেন, তা পূরণ হবার সুবনা হতে পারে ভেবে আবার সেই করুণাময়ের দরবারে শতশত শুকরিয়া জানাচ্ছি। আপনার ওয়াইফকে আমার সালাম জানিয়ে বলবেন, ফাল্গুনীকে মেয়ে করে নিয়েছেন জেনে আমি খুব খুশি হয়েছি। আজ তাহলে উঠি ভাই সাহেব বলে দাঁড়িয়ে একটা ভিজিটিং কার্ড গোফরান সাহেবের হাতে দিয়ে বললেন, আরিফ ফেরার পর তাকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের বাসায় এলে খুশি হব।
গোফরান সাহেব বললেন, আমাদেরকে অত বড় করে বলবেন না। আমরা গ্রামের সাধারণ মানুষদের একজন। আর যাবার কথা যে বলছেন, ইনশাআল্লাহ নিশ্চয় যাব। তবে আরিফের ব্যাপারে সিওর কিছু বলতে পারছি না। জানেন তো, ছেলে-মেয়েরা বড় হলে নিজস্ব মতামতে কাজ করে।
ইলিয়াস সাহেব বললেন, তা নিশ্চয় জানি। তবে আমি কিন্তু সিওর, আরিফ বাবা মার কথা কখনো অবহেলা করে না।
গোফরান সাহেব বেশ একটু অবাক হয়ে বললেন, আরিফকে তো আপনি মাত্র কয়েক মিনিট দেখেছেন, এমন কি তার সঙ্গে ভাল করে কথাবার্তাও বলেননি, তবু তার এবং আমাদের সম্বন্ধে এ রকম কথা বললেন কি করে?
ইলিয়াস সাহেব মৃদু হেসে বললেন, এতে আমার কোন কৃতিত্ব নেই। ফালনীকে দেখিয়ে বললেন, যা কিছু ওরই। ঐ তো আমাকে আরিফের সম্বন্ধে যা কিছু বলার বলেছে।
গোফরান সাহেব আরো একটু বেশি অবাক হয়ে বললেন, কিন্তু আপনি তো বললেন, আপনার মেয়ের সঙ্গেও আরিফের বেশি কথাবার্তা হয়নি?
ইলিয়াস সাহেব বললেন, আমার মেয়ের আল্লাহ প্রদত্ত এমন কিছু ক্ষমতা আছে যার ফলে সে ছোটবেলা থেকে যা কিছু বলে তা সত্য হয়।
কথাটা শুনে গোফরান সাহেব চমকে উঠলেন, চিন্তা করলেন, আরিফের মায়ের মত এই মেয়ের মাও কি পরীর মেয়ে?
ইলিয়াস সাহেব গোফরান সাহেবের পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন। বললেন, আমার কথা শুনে আপনি যেন কিছু চিন্তা করছেন?
গোফরান সাহেব বললেন, হ্যাঁ-না, মানে একটা কথা জিজ্ঞেস করব, কিছু মনে করবেন না। আপনার ওয়াইফও কি এই রকম কথা বলতেন?
ইলিয়াস সাহেব কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, সে আরো বেশি বলত, তারপর মেয়েকে বললেন, চল মা এবার ফিরি।
ফাল্গুনী সবাইর কথায় খুব লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ছিল। আব্বার কথা শুনে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, হ্যাঁ আব্বা চল।
ইলিয়াস সাহেব আর একবার বাসায় যাবার কথা বলে সালাম বিনিময় করে। মেয়েকে নিয়ে চলে গেলেন।
গোফরান সাহেব তাদেরকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে ফিরে এলেন।
ওরা বেরিয়ে যাবার পর সুফিয়া বেগম ড্রইংরুমে এসে বসেছিলেন। স্বামী ফিরে এলে বললেন, ফাল্গুনীকে আরিফের সঙ্গে দারুণ মানাবে।
গোফরান সাহেব তার পাশে বসে বললেন, আমিও তোমার সঙ্গে একমত। কিন্তু আরিফের মতামত না জানা পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না।
সুফিয়া বেগম বললেন, আমার মনে হয়, আরিফ অমত করবে না।
গোফরান সাহেব বললেন, আমারও তাই মনে হয়।
<