নিজের রুম থেকে বেরিয়ে শিলা চলে এল ড্রয়িংরুমে।

দূর থেকে রেখা তাকে দেখতে পেয়েছিল। সেও এল। এসে কোনও ভনিতা ছাড়া বলল, সেতুর ওপর যত রাগই আমাদের হোক, সে যে ভুল করেছে সেই ভুল কিন্তু আমাদের করা ঠিক হবে না।

শিলা ভ্রু কোঁচকাল। তোমার কথা আমি বুঝতে পারিনি।

বলছিলাম কী, আমরা যেহেতু ব্যাপারটা জেনেছি, আমাদের উচিত আজই সেতুর ভাইদেরকে জানিয়ে দেয়া।

ঠিকই বলেছ, তা না হলে তারা আমাদেরকে দোষারোপ করবে। বলবে জেনেও আমরা কেন তাদেরকে জানাইনি।

অন্য ঝামেলাও আছে। এক্ষুনি এনগেজম্যান্ট না ভাঙলে কেলেংকারি হয়ে যাবে।

রানি খুবই ব্যস্ত ভঙ্গিতে ড্রয়িংরুমের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, দোতলার ড্রয়িংরুমটি একটু খোলামেলা ধরনের, দুইজাকে নিভৃতে কথা বলতে দেখে ফেলল সে। সকাল থেকেই বাড়ির দুইবউ এবং সেতুর আচরণে কী রকম যেন অস্বাভাবিকতার গন্ধ পেয়েছে সে। কী যেন একটা হয়েছে বাড়িতে। ব্যাপারটা কী জানার জন্য ড্রয়িংরুমের বাইরে এমন একটা জায়গায় দাঁড়াল রানি, যেখান থেকে রুমের ভেতরকার কেউ তাকে দেখতে পাবে না কিন্তু সে শুনতে পাবে তাদের সব কথা।

রানির একা একা কথা বলার স্বভাব আছে। শিলা এবং রেখার কথা শুনতে দাঁড়িয়ে সে ফিসফিস করে বলল, বাড়িতে হইছে কী? এত গুজুর গুজুর, ফুসুর ফুসুর কীসের?

রানিকে এই অবস্থায় দেখে ফেলল টুপলু। সে যাচ্ছিল মুন্নির রুমের দিকে। রানিকে দেখে কিছু একটা সন্দেহ হল, পা টিপে টিপে নিঃশব্দে এসে রানির পেছনে দাঁড়াল সে। আচমকা বলল, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কী করছ?

টুপলুর যেহেতু জোরে কথা বলার অভ্যেস, রানি একেবারে আঁতকে উঠল। ও মাগো, ডরাইয়া গেছি।

তারপর থুথু করে নিজের বুকে থুতু দিল।

টুপলু আবার বলল, কথা বলছ না কেন? এখানে দাঁড়িয়ে কী করছ?

সঙ্গে সঙ্গে মিথ্যে বলতে শুরু করল রানি। না, দাঁড়াই নাই তো! আমি তো যাইতাছিলাম।

মিথ্যে কথা বলো না। আমি আম্মুকে বলে দেব।

কী, কী বলবা?

তা তোমাকে বলব না।

মুন্নির রুমের দিকে চলে গেল টুপলু। রানি ভাবল নিশ্চয় তাদের কথা শিলা এবং রেখা শুনতে পেয়েছে, এখুনি ড্রয়িংরুম থেকে বেরিয়ে ধরবে তাকে, ভয়ে সেই প্রায় দৌড়ে কিচেনের দিকে চলে গেল।

.

আম্মু, তুমি আর চাচি যখন কথা বলছিলে…

সন্ধের পর রেখাকে মাত্র কথাটা বলতে শুরু করেছে টুপলু, স্বপন এসে ঢুকল। স্বপনকে দেখে সব ভুলে লাফিয়ে উঠল টুপলু। এই তো বাবা এসে পড়েছে।

তারপর ছুটে এসে স্বপনের দিকে দুহাত বাড়িয়ে দিল। কোলে নাও।

রেখা কর্কশ গলায় বলল, এখন কোলে উঠতে হবে না, যাও।

কিন্তু মেয়েকে কোলে নিল স্বপন। উঠুক না, তোমার অসুবিধা কী!

রেখা কথা বলল না। চিন্তিত চোখে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েকে আদর করতে লাগল স্বপন, রেখার চিন্তিত হওয়া চোখেই পড়ল না তার।

কিন্তু নিজের রুমে ঢুকেই শিলার থমথমে মুখ দেখতে পেল মামুন। মুন্নির মাথা আঁচড়ে দিচ্ছে শিলা, মামুন যে অফিস থেকে ফিরল, মা মেয়ের একেবারে কাছে এসে দাঁড়াল শিলা যেন তা দেখতেই পেল না।

ব্যাপার কী? নিজের অজান্তে কি আবার কোনও ভুল করে ফেলেছে মামুন!

অনেক ভেবেও ভুলটা বের করতে পারল না মামুন। ড্রেসিংরুমে না ঢুকে বলল, ব্যাপার কী, সারাদিন পর বাড়ি ফিরলাম আর তুমি একবারও আমার দিকে তাকাচ্ছ না!

শিলা কথা বলল না।

মুন্নি বলল, আম্মু বোধহয় রেগে আছে।

সঙ্গে সঙ্গে মেয়েকে ধমক দিল শিলা। চুপ কর, তোকে বলেছি, রেগে আছি!

মেয়েকে ধমকাচ্ছ কেন? মুন্নি, যা তো মা, রানিকে বল চা দিতে।

আচ্ছা।

বারান্দায় রাখা টেলিফোনটা বাজল এ সময়। পাশাপাশি দুটো সেট। একটা কডলেস। বাবলু আসছিল মা বাবার বেডরুমের দিকে, শব্দ পেয়ে কডলেস ফোনটা ধরল। হ্যালো।

ওপাশ থেকে অত্যন্ত বিনয়ি গলায় কে একজন বলল, সেতুকে দেয়া যাবে?

সিওর। একটু ধরুন।

ফোন নিয়ে সেতুর রুমে এল বাবলু। ফুপি, তোমার ফোন।

টেলিফোন সেট হাতে নিল সেতু। কে করেছে?

এক ভদ্রলোক, আমি নাম জিজ্ঞেস করিনি।

বাবলু চলে গেল।

সেতু বলল, হ্যালো।

ওপাশ থেকে অত্যন্ত রোমান্টিক গলায় ভেসে এল, আমি তোমাকে খুব ভালবাসি।

সঙ্গে সঙ্গে যাবতীয় উৎকণ্ঠা, বিষণ্ণতা কেটে গেল সেতুর। গভীর আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল মুখ। বুকের অনেক ভেতর থেকে সে বলল, আমিও তোমাকে খুব ভালবাসি।

তারপর একটু থেমে বলল, কিন্তু খুব টেনশানে আছি। ভাবীরা জেনেছে, আজ রাতের মধ্যেই ভাইয়ারা জেনে যাবে।

শুনে শুভ যেন ভয় পেল। তোমার কথা শুনে আমারও বুক কাঁপতে শুরু করেছে। ইস্ কী যে হবে!

সেতুর মন একটু খারাপ হল। কিছু একটা বলতে যাবে সে তার আগেই শুভ বলল, আমি তোমার সঙ্গে ফান করলাম। শোন, একদম নার্ভাস হবে না তুমি, একটুও ভয় পাবে না। আমি আছি।

ভয় আমি পাচ্ছি না। যদি কেউ কোনও বাড়াবাড়ি করে, সোজা তোমার কাছে চলে আসব।

ঠিক এ সময় সেতুর রুমের সামনে এসে দাঁড়াল মামুন। অফিসের পোশাক ছেড়ে বাড়ির পোশাক পরেছে সে। সেতুর টেলিফোনে কথা বলাটা খেয়াল করল না। বলল, সেতু, কী করছিস?

তারপর রুমে ঢুকল। সেতু থতমত খেয়ে ফোন অফ করল। দেখে মামুন বলল, রাখার দরকার নেই, কথা শেষ কর, আমি নাহয় পরে আসব।

বুকটা কাঁপছে সেতুর, মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কোনও রকমে সে বলল, না, ঠিক আছে।

তখন আবার ফোন বাজল। হাত বাড়িয়ে ফোনটা ধরল মামুন। সঙ্গে সঙ্গে কেটে গেল লাইন। মামুন বিরক্ত হল। আমি ধরলাম আর ফোনটা ছেড়ে দিল। কে ফোন করেছিল?

সেতুর গলাটা শুকিয়ে গিয়েছিল, সে একটা ঢোক গিলল। তুমি যখন ধরলে তখন কে করল জানি না, আগে করল দোলন।

আমি যখন ধরলাম তখন দোলন করেনি, দোলন হলে আমার সঙ্গে কথা বলতো!

তারপরই প্রসঙ্গটা ভুলে গেল সে। উচ্ছল গলায় বলল, শোন, তোর কিছু চাওয়ার থাকলে আমার কাছে চেয়ে ফেল। খুব মুডে আছি, যা চাইবি, পেয়ে যাবি।

সেতু একটু উদাস হল। এজন্যই আমার রুমে এসেছ?

হ্যাঁ। আসলে মনটা খারাপ। তোর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, তুই যে বাড়িতে থাকবি না সেই বাড়িতে আমি কেমন করে থাকব!

কথা বলার ফাঁকে জলে চোখ ভরে এল মামুনের। সেতুর মুখের দিকে সে আর তাকাতে পারল না।

সেতু ভাবল এই সুযোগটা নেবে কি না। কোনও না কোনওভাবে শুভর সঙ্গে তার বিয়ের কথাটা বলে দেবে কি না?

কিন্তু বড়ভাইকে নিজের বিয়ের কথা কেমন করে বলা যায়?

ভেতরে ভেতরে লজ্জা পেল সেতু। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

মামুন বলল, ঠিক আছে, আমি তোর সঙ্গে পরে কথা বলব। এখন মন খুব খারাপ হয়ে গেছে।

চোখ মুছতে মুছতে সেতুর রুম থেকে বেরিয়ে গেল সে।

.

স্বপন বলল, সেতুর বিয়ের ব্যাপারে ভাইয়ার সঙ্গে আমার মতের খুব মিল হচ্ছে।

কথাটা যেন শুনতে পেল না রেখা। আনমনা হয়ে আছে সে। চিন্তিত হয়ে আছে।

ব্যাপারটা খেয়াল করল স্বপন। বিরক্ত হল। তুমি আমার কথা শুনছ না?

স্বপনের চোখের দিকে তাকিয়ে রেখা বলল, শুনতে চাচ্ছি না।

কেন?

বিয়ের ব্যাপারটা…

কথা শেষ না করে মাথা নিচু করল রেখা।

স্বপন গম্ভীর গলায় বলল, কথা শেষ কর।

এবার রেখাও একটু বিরক্ত হল। তোমার সঙ্গে কথা বলাই মুশকিল। শুরুর আগেই রেগে যাও।

কথার ধরনে মনে হচ্ছে তুমি খুব খারাপ কিছু বলবে।

স্বপনের একটা হাত ধরল রেখা। আগেই রেগে যেও না, কথাটা আগে শোন।

স্বপন ভুরু কোঁচকাল। তুমিই বা এত ভনিতা করছ কেন? কী হয়েছে পরিস্কার বললেই পার।

সেতুর বিয়ের চিন্তাভাবনা আপাতত বাদ দিতে হবে!

কী?

পাত্রপক্ষকে মানা করে দাও।

অপলক চোখে রেখার মুখের দিকে তাকাল স্বপন। শীতল গলায় বলল, তুমি বুঝতে পারছ তুমি কী বলছ? পরশু এনগেজম্যান্ট। সব রেডি। এই সময়ে কোনও রকমের ঠাট্টা মশকরা করার চেষ্টা করো না।

তা আমি করছিও না। এনগেজম্যান্ট হবে না। যেমন করেই হোক ওটা বন্ধ করতে হবে কারণ শুভ নামের একটি ছেলের সঙ্গে সেতুর বিয়ে হয়ে গেছে।

সঙ্গে সঙ্গে নিজের কাছে নিজে একেবারেই অচেনা হয়ে গেল স্বপন। কখন উঠে দাঁড়াল বুঝতে পারল না, কখন ঠাস করে রেখার গালে চড় মারল বুঝতে পারল না।

.

জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে সেতু।

টের পায়নি কখন কাঁদতে শুরু করেছে, কখন চোখের জলে গাল ভাসতে শুরু করেছে। বাড়িতে কী হচ্ছে কিছুই এখনও বুঝতে পারছে না সে। বড়ভাই যে এখনও শোনেনি বুঝতে পেরেছে, ছোটভাই শুনেছে কী না বুঝতে পারছে না। কাউকে জিজ্ঞেস করারও উপায় নেই।

এ সময় টুপলু এসে ঢুকল সেতুর রুমে। ফুপি, ফুপি, আম্মু বলেছে তোমার বিয়েতে আমাকে খুব সুন্দর একটা ড্রেস কিনে দেবে। দুধের মতো সাদা। পরলে আমাকে একদম। পরির মতো দেখাবে।

সেতু কথা বলল না, চোখও মুছল না। অন্যদিকে তাকিয়ে রইল।

ফুপিকে কথা বলতে না দেখে টুপলু তার হাত ধরল। কী হল ফুপি, তুমি আমার দিকে তাকাচ্ছ না কেন?

এবার ওড়না দিয়ে চোখ মুছল সেতু। টুপলুর দিকে তাকাল।

টুপলু অবাক। তুমি কাঁদছ? কেন, কাঁদছ কেন? তোমাকে কেউ বকেছে ফুপি?

টুপলুকে কোলের কাছে টেনে সেতু বলল, না মা, কেউ বকেনি।

তাহলে কাঁদছ কেন?

এমনি।

তারপর নিজেকে সামলাল সেতু। চটপটে গলায় বলল, আম্মু তোমাকে সাদা ড্রেসের কথা কবে বলেছে?

দুতিনদিন আগে।

সেতু মনে মনে বলল, তাই তো! সব জানার পর তো বলার কথা নয়।

মুখে বলল, শোন, যদি আম্মু তোমাকে সাদা ড্রেস কিনে না দেয় তাহলে আমি তোমাকে কিনে দেব। পরলে সবাই তোমাকে বলবে ছোট্টপরি টুপলু। এখন যাও, মা।

আচ্ছা।

টুপলু প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল।

.

মামুন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ভেবেছিলাম সেতু কিছু চাইবে। ডায়মন্ডের গহনা বা এই ধরনের কিছু। খুব মুড নিয়ে কথা শুরু করলাম, কিন্তু সব কথা বলতে পারলাম না, মনটা খারাপ হয়ে গেল। ওকে যে আমি কী ভালবাসি, কী রকম টান যে ওর জন্য আমার, আমি কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারব না। একটা কথা আজ বলি। তুমি মন খারাপ করো না, রেগে যেও না। নিজের মেয়ের চেয়েও সেতুকে আমি অনেক বেশি ভালবাসি।

পিঠের কাছে দুটো বালিশ দিয়ে বিছানায় বসে আছে শিলা। মুখটা থমথম করছে। মামুনের কথা শুনে গম্ভীর গলায় বলল, ঠিক হয়নি।

কথাটা বুঝতে পারল না মামুন। কী ঠিক হয়নি?

এত ভালবাসা।

তাই বল।

অতিরিক্ত আল্লাদ ভাল না। কিছু মানুষ থাকে বানরের মতো। বানরকে লাই দিলে মাথায় ওঠে।

আমার বোনকে তুমি বানর বলছ?

পারলে বানরের চেয়েও খারাপ কিছু বলতাম।

মামুন টের পেল কোথায় যেন একটা প্যাঁচ লাগতে যাচ্ছে। সেদিনের পর থেকে শিলার ব্যাপারে খুবই সাবধানতা অবলম্বন করে আছে সে। শিলার সঙ্গে খোঁচাখোচি লাগতে পারে এমন প্রসঙ্গ যত্নে এড়িয়ে চলছে। শিলা বাঁকা করে কথা বলতে চাইলেই নিজে হয়ে যাচ্ছে অতিরিক্ত সরল।

এখনও হল। হাসিমুখে, আদুরে গলায় বলল, এই, কী হয়েছে তোমার?

কিছুই হয়নি।

তাহলে এমন করছ কেন?

কী করছি?

আমি অবশ্য বুঝেছি।

কী বুঝেছ, বল!

বোনের ব্যাপারে মন খারাপ করে আছি দেখে ঠাট্টা করে আমার মন ভাল করার। চেষ্টা করছ।

শিলা চোখ তুলে স্বামীর দিকে তাকাল।

মামুন বলল, দরকার নেই। তুমি সামনে থাকলে আমার মন এমনিতেই ভাল থাকে।

শিলা গম্ভীর গলায় বলল, তোমার মন নিয়ে আমি ভাবছি না, আমি তোমার সঙ্গে ঠাট্টা মশকরাও করছি না। স্বপনকে বল আজ রাতেই পাত্রপক্ষকে ফোন করতে।

কেন?

এনগেজম্যান্ট হবে না।

কথাটা একদম পাত্তা দিল না মামুন। ধুৎ, ঠাট্টা করো না।

আগের চেয়েও গম্ভীর গলায় শিলা বলল, একবার বলেছি, আমি তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করছি না। তোমার বোনের বিয়ে হয়ে গেছে।

কী?

এই যে বিয়ের ছবি।

বলেই পিঠের দিককার বালিশের তলা থেকে সেতুর দেয়া ছবির খামটা বের করল শিলা। মামুনের হাতে দিল।

মামুন ততোক্ষণে পাথর হয়ে গেছে।

.

গেট খুলেই খিলখিল করে হাসতে লাগল দোলন।

শুভ অবাক হল। কী হল, হাসছ কেন?

এ কথায় দোলনের হাসি আরও বাড়ল। হাসতে হাসতে বাঁকা হয়ে যাচ্ছিল সে।

শুভ কিছুই বুঝতে পারল না। বলল, আরে! কী হয়েছে?

দোলন হাসতে হাসতে বলল, এ সময় ভিক্ষুকরা এসে কলিংবেল বাজায়।

বুঝলাম, তাতে হাসার কী আছে?

আমি আপনাকে তাই ভেবেছি।

মানে ভিক্ষুক?

হ্যাঁ।

এবার শুভও হাসল। খারাপ ভাবনি। আমার অবস্থা ভিক্ষুকের মতোই।

দোলন হাসি থামাল। যাহ্, বাজে কথা বলবেন না। ভেতরে আসুন।

না, এখানেই বলি।

অবশ্য মা বাবা এসে পড়েছেন। তবু ভেতরে আপনি আসতে পারেন। অসুবিধা হবে না।

দরকার নেই ঝামেলার। শোন, কথাটা সেতু ওদের বাড়িতে বলে দিয়েছে। কী ধরনের রিয়্যাকশান হয়েছে, জানি না। অনেকবার ফোন করেছি, সেতু ফোন ধরছে না। আর আগে কখনও যা হয়নি আজ তাই হচ্ছে, সেতুকে চাইলেই নামধাম সব জিজ্ঞেস করছে বাড়ি থেকে। মিথ্যে বলতে বাঁধো বাধো লাগছে বলে ফোন ছেড়ে দিচ্ছি আমি।

ভাল করেছেন। তাছাড়া প্যারালাল লাইনে আপনাদের কথা শুনেও ফেলতে পারে কেউ।

হ্যাঁ। এসব কারণে আমার খুব নার্ভাস লাগছে।

বুঝেছি। আমি কী করতে পারি বলুন?

তুমি একটু ওদের বাড়িতে যাও। অবস্থাটা বুঝে এস। আমি বিকেলে এসে খবর নেব।

ঠিক আছে।

তারপর মাথা নিচু করে শুভ বলল, যখন তখন এসে তোমাকে খবু বিরক্ত করি, আমাদের জন্য অনেক করছ তুমি, তোমার কাছে খুব ঋণী হয়ে গেলাম।

সব ঠিক হয়ে গেলে ঋণ শোধ করে দেবেন।

শুভ হেসে বলল, বিল করে রেখ।

কিন্তু সেতুদের বাড়ি ঢুকেই স্বপনের মুখোমুখি পড়ে গেল দোলন।

মামুন এবং স্বপন কেউ আজ অফিসে যায়নি। কপালে হাত দিয়ে নিজের রুমে শুয়ে আছে মামুন আর বাড়ির সামনের দিককার বারান্দায় বেতের চেয়ারে রাগি মুখ করে বসে আছে স্বপন। হাতে হাসানের পত্রিকা। হাসিঠাট্টা বিষয়ক পাতাটা বেরিয়েছে আজ। সকাল থেকে বহু চেষ্টা করে একটি লাইনও পড়তে পারেনি স্বপন।

এ সময় দোলন এসে ঢুকল।

দোলনের স্বভাব হচ্ছে অতি দ্রুত হাঁটার। স্বপনকে দেখেও দ্রুত হেঁটে দোতলার সিঁড়ির দিকে যাচ্ছিল সে। স্বপন তাকে ডাকল। দোলন, শোন।

দোলন এসে তার সামনে দাঁড়াল। জ্বী?

তুমি কেন এসেছ আমি জানি।

কী করে জানলেন?

তা তোমাকে বলব না। এও জেনেছি যে ব্যাপারটার সঙ্গে তুমি জড়িত।

দোলন বুঝে গেল কেলেংকারি যা হওয়ারা এই বাড়িতে হয়ে গেছে। ব্যাপারটির সঙ্গে তাকেও জড়ানো হয়েছে। হোক, তাতে কিছু যায় আসে না। সে যা করেছে জেনে বুঝেই করেছে। সেতু তার বন্ধু, বন্ধুর জন্য বন্ধু করবে না!

কিন্তু স্বপনের কথা বলার ধরনটা বিশ্রি। এই ভঙ্গিতে কথা বলা একদমই সহ্য করতে পারে না দোলন। গা একেবারে জ্বলে গেল তার। তবু নিজেকে সংযত রাখল সে। যেন কিছুই জানে না এমন গলায় বলল, কোন ব্যাপারটার সঙ্গে আমি জড়িত?

দাঁতে দাঁত চেপে স্বপন বলল, আমাকে দিয়ে বেশি কথা বলিও না।

এবার দোলনও গম্ভীর হল। আপনি আমার সঙ্গে অত্যন্ত বাজে ব্যবহার করছেন?

আরও বাজে ব্যবহার তোমার সঙ্গে আমার করা উচিত।

কেন?

বলতে চাই না, আমার মেজাজ আরও খারাপ হবে। সেতুর সঙ্গে আমার দেখা হবে না। তুমি এসো।

স্বপনের চোখের দিকে তাকিয়ে দোলন বলল, নিজেদের বাড়িতে এতটা অপমান আমাকে না করলেও পারতেন। অপমানটা একদিন আপনার কাছে ফিরে আসতে পারে।

যে গতিতে হেঁটে সেতুদের বাড়ি ঢুকেছিল দোলন তারচেও দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল।

স্বপনের এই আচরণের কথা সেতুকে জানাল মুন্নি। কী কাজে নিচে এসেছিল সে, স্বপন এবং দোলনের শেষদিককার কথাগুলো শুনতে পেয়েছিল। দোলন বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এল সেতুর রুমে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, তুমি কিছু শুনেছ, ফুপি?

সেতু শুয়ে ছিল। উঠে বসল। না তো! কী হয়েছে?

দোলন ফুপি এসেছিল তুমি জানো?

না। কোথায় সে?

চলে গেছে।

আমার সঙ্গে দেখা না করেই চলে গেল?

এজন্যেই তো বললাম, তুমি কিছু শুনেছ কি না? দোলন ফুপিকে চাচা খুব বকেছে।

কী?

হ্যাঁ, দুজনে খুব তর্কাতর্কি হয়েছে। দোলন ফুপি তারপর তোমার সঙ্গে দেখা না করেই চলে গেছে।

রাগে ক্রোধে মুখ লাল হয়ে গেল সেতুর। আমি বুঝেছি কেন দোলনের সঙ্গে সে অমন ব্যবহার করেছে?

তারপর বিছানা থেকে নামল সেতু। এটা সে ঠিক করেনি। অন্যায় করে থাকলে আমি করেছি, বকতে হলে আমাকে বকবে, দোলনকে কেন?

সেতু তারপর স্বপনের রুমে এসে ঢুকল।

স্বপন এবং রেখা দুজনেই আছে রুমে। রেখার দিকে তাকাল না সেতু, স্বপনের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, দোলনকে তুমি অপমান করেছ কেন? আমার বন্ধুকে তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে দাওনি কেন?

সেতুর দিকে তাকাল না স্বপন, যেমন বসেছিল তেমনি বসে থেকে কঠিন গলায় বলল, আমি তোর সঙ্গে কোনও কথা বলব না, তুই আমার সামনে থেকে যা।

সেতু দৃঢ় গলায় বলল, না আমি যাব না। পরিস্কার ভাষায় তোমাকে বলতে হবে দোলনের সঙ্গে বাজে বিহেভ তুমি কেন করেছ?

যা করেছি তা তেমন কোনও বাজে বিহেভ নয়, আমার উচিত ছিল ওর দুগালে দুটো চড় মারা। ওর ভাগ্য ভাল যে ও মেয়ে। ছেলে হলে শুধু চড় মারাই নয়, ওর দাঁতগুলো আমি ভেঙে ফেলতাম।

আমার অবাক লাগছে, তুমি আমার ভাই! কোনও শিক্ষিত, ভদ্র পরিবারের মানুষ ছোটবোনের বন্ধুর সঙ্গে অশোভন ব্যবহার করে, দেখা তো দূরের কথা, কেউ কখনও বোধহয় শোনেওনি।

সেতুর কথা শুনে চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে স্বপনের। রেখার দিকে তাকিয়ে সে বলল, রেখা, ওকে এখান থেকে যেতে বল। নিজেকে আমি আর কন্ট্রোল করতে পারছি না, এক্ষুনি আমি ওকে মারব।

একথা শুনে মাথা যেন খারাপ হয়ে গেল সেতুর। কয়েক পা এগিয়ে স্বপনের একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। তোমার পক্ষে সবই সম্ভব। মারো, মারো আমাকে! দেখি কত মারতে পার!

একেবারে সিনেমার কায়দায় উঠে দাঁড়াল স্বপন। সেতুকে মারার জন্য হাত তুলল। চট করে সেই হাত ধরে ফেলল রেখা। তীক্ষ্ণস্বরে বলল, খবরদার বোনের গায়ে হাত তুলবে না। চুপ, একদম চুপ করে বস। সেতু ঠিকই বলেছে, দোলনকে কেন তুমি অপমান করবে? সে কোনও অন্যায় করেনি। তোমার বন্ধুর ক্ষেত্রে এই ধরনের পরিস্থিতি হলে তুমিও নিশ্চয় বন্ধুকে সাহায্য করতে।

তারপর সেতুকে ঠেলে বের করে দিতে চাইল রেখা। তুমি যাও, তুমি এখান থেকে যাও।

সেতু নড়ল না, রেখার দিকে ফিরেও তাকাল না। আগের মতোই স্বপনের চোখের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় গলায় বলল, আমি যা করেছি আমার নিজের ইচ্ছেয়, নিজের ভাললাগার কারণে করেছি। কেউ সাহায্য না করলেও এ আমি করতামই। এই পৃথিবীতে আমার সবচে প্রিয় যে মানুষ তার সঙ্গে সারাজীবন কাটাব বলেই তাকে আমি বিয়ে করেছি। তোমাদের যার যা ইচ্ছে করতে পার, চাইলে আমাকে মেরেও ফেলতে পার, কিন্তু আমি যা করেছি, যার হাত সারাজীবনের জন্য ধরেছি, সেই হাত আমি কখনও ছাড়ব না।

এসব বলতে বলতে ভালবাসার গভীর অহংকারে সুন্দর হয়ে গেল সেতুর মুখ। আস্তে ধীরে হেঁটে নিজের রুমের দিকে চলে গেল সে।

.

আমি তোমাকে খুব ভালবাসি। খুব।

বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে সেতুর ছবির দিকে তাকিয়ে কথাটা যখন বলেছে শুভ, নাহিদ এসে দরজার সামনে দাঁড়াল। শুভ তাকে দেখতে পেলো না। খানিক দাঁড়িয়ে শুভকে দেখল নাহিদ তারপর মৃদু শব্দে গলা খাকারি দিলো। চমকে দরজার দিকে। তাকাল শুভ। তারপর ব্যস্ত ভঙ্গিতে সেতুর ছবি বালিশের তলায় লুকোতে গিয়েই হেসে ফেলল। ও তুই? আমি ভেবেছিলাম কে না কে?

তারপরও ছবিটা বালিশের তলায় রাখল সে। তোরা যাসনি?

নাহিদ এসে শুভর সামনে দাঁড়াল। না, যে ডাক্তারকে দেখালাম তিনি আরেকজন ডাক্তারের কাছে রেফার করলেন। অনেক কষ্টে সেই ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েনম্যান্ট করেছি। কাল সন্ধ্যায় দেখবেন।

চিন্তিত চোখে নাহিদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল শুভ। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নিজেকে আমার খুব স্বার্থপর মনে হচ্ছে। আমার জীবনের সবচে’ বড় ডিসিশানটার সময় তুই আমাকে সাহায্য করেছিস। আর তোর এরকম বিপদের সময় আমি তোর পাশে দাঁড়াতে পারছি না। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে।

বিছানা থেকে নেমে আলনার সামনে গিয়ে দাঁড়াল শুভ। শার্ট নিয়ে পরতে লাগল।

নাহিদ বলল, শার্ট পরছিস কেন?

শুভ গম্ভীর গলায় বলল, এই মুহূর্ত থেকে আমি তোর সঙ্গে আছি। যদিও সেতুদের বাড়িতে খুব ঝামেলা যাচ্ছে, আমি খুব টেনশানে আছি, তারপরও আমি তোর সঙ্গে থাকতে চাই।

দরকার নেই। আমি সব সামলাতে পারছি।

তোর কোনও কথাই আমি আর শুনব না। চল আমার সঙ্গে, দেখি কোন ডাক্তার দেখাতে হয় বর্ষাকে।

নাহিদের হাত ধরে নিজের রুম থেকে বেরুল শুভ।

.

এই হোটেলটি পুরনো আমলের।

সামনে বিশাল বাগান, প্রচুর ফুল পাতাবাহারের ঝোঁপ। বিকেলবেলা বাগানে এসে ঢুকেছে বর্ষা। এখন একটা ঝোঁপের সামনে দাঁড়িয়ে আঙুলের ডগায় আলতো করে ফুল এবং পাতা নাড়ছে। নাড়ছে ঠিকই কিন্তু দেখতে পাচ্ছে না কী নাড়ছে সে। কারণ তার চোখ এখানে, মন অন্যকোথাও।

আস্তেধীরে হেঁটে নাহিদ এবং শুভ এসে তার পেছনে দাঁড়াল। পায়ের শব্দ পেয়েও পেছনে ফিরে তাকাল না বর্ষা। আগের মতোই আনমনা ভঙ্গিতে ফুল এবং পাতা নাড়তে লাগল।

নাহিদ বলল, বর্ষা, দেখ কে এসেছে?

আলতো করে মুখ ফেরালো বর্ষা। নির্বিকার গলায় বলল, কোথায় কে এসেছে?

শুভকে দেখাল নাহিদ, এই যে।

উদাস চোখে শুভর মুখের দিকে তাকাল বর্ষা, তারপর তাকাল নাহিদের দিকে। কে?

চিনতে পারছিস না?

শুভ হাসিমুখে বলল, কী করে চিনবে! বর্ষা তো আমাকে কখনও দেখেনি!

কিন্তু আমার মুখে তোর কথা অনেক শুনেছে।

তারপর বর্ষার দিকে তাকাল নাহিদ। ভেবে দেখ তো কার কথা আমার মুখে সবচে’ বেশি শুনেছিস তুই?

বর্ষা আগের মতোই উদাস গলায় বলল, আমার কিছু মনে পড়ে না।

বর্ষার গলায় গভীর অসহায়ত্ব। শুভর মনটা অন্যরকম হলো। নাহিদকে বলল, অযথা ওর মনের ওপর প্রেসার দেয়ার দরকার নেই। তারচে’ আমিই আমার পরিচয় দিয়ে ফেলি।

হাসি হাসি মুখ করে বর্ষার দিকে তাকাল শুভ। বর্ষা, আমি শুভ।

বর্ষা তবু চিনতে পারল না।

শুভ বলল, নাম বলার পরও বোধহয় আমাকে তুমি চিনতে পারনি। আমি নাহিদের বন্ধু।

এবার সামান্য চঞ্চল হলো বর্ষা, ও। জানেন বাদল, বাদল মারা গেছে।

তারপর আর কোনওদিকে তাকাল না, একটিও কথা বলল না, আস্তেধীরে হেঁটে হোটেল বিল্ডিংয়ের দিকে চলে গেল।

বর্ষা চলে যাওয়ার পর শুভ আর নাহিদ এলো রিসিপসানে।

রিসিপসানের অদূরে গেস্টদের বসার জন্য সুন্দর কয়েকটি সোফা রাখা আছে। দুটো সোফায় মুখোমুখি বসল ওরা। বর্ষার সঙ্গে কথা বলার পর থেকেই বেশ চিন্তিত শুভ। এখন নাহিদের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, বর্ষাকে দেখে, বর্ষার কথা শুনে মনে হলো সে কিছুটা এবনরমাল হয়ে গেছে।

নাহিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিছুটা না, অনেকটা।

যমজ ভাই বোনদের ব্যাপারটা আমি জানি। আমার সঙ্গে স্কুলে দুটো যমজ ভাই পড়ত। একজন টিচার ছিলেন, ইসলাম স্যার, কথায় কথায় বেত দিয়ে মারতেন আমাদেরকে। যমজ ভাই দুটোর নাম ছিলো কিসলু আর খসরু। তাদের একজনকে মারলে অন্যজনও কেঁদে ফেলতো।

বাদল-বর্ষার ক্ষেত্রে এটা কোনও ব্যাপারই ছিল না। ওদের একজনের জ্বর হলে প্রায় সাথে সাথে আরেকজনের হতো। বড় হওয়ার পর এসব একটু একটু করে কমতে শুরু করেছিল।

এই অবস্থায় একজন আরেকজনকে ছেড়ে গেলে সেই শোক সামলানো প্রায় অসম্ভব। বর্ষাকে দেখে আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেছে।

কিন্তু আমি মন খারাপ করতে পারছি না। আমাকে ভাবতে হচ্ছে তিনজন মানুষের কথা। মা বাবা বর্ষা। বাদল মারা গেল, আমার ভাই, অসুখের সময় দিনরাত আগলে রাখার চেষ্টা করেছি তাকে…

কথা শেষ করতে পারল না নাহিদ। কেঁদে ফেলল। চোখ মুছতে মুছতে ধরা গলায় বলল, ওর কথা ভাববার এখন সময়ও নেই আমার।

শুভ উঠে এসে নাহিদের পাশে বসল। তার কাঁধে হাত দিল। তুই এমন করিস না নাহিদ। আমার খুব অসহায় লাগছে। কী করব কিছু বুঝতে পারছি না। আমি বরং যাই।

চোখ মুছে নাহিদ বলল, মা বাবার সঙ্গে দেখা করে যা।

দেখা করে কী হবে? তাঁদের মুখ দেখে, কষ্টের কথা শুনে মন আরও খারাপ হবে। ওদিকে সেতুদের বাড়িতে কী হচ্ছে কিছুই জানি না। আমার ভাল লাগছে না।

জীবন এরকমই। সব দুঃখ কষ্টকেই সামাল দিতে হবে। আয় আমার সঙ্গে।

ওরা দুজন উঠল।

.

সোফায় বসে নিঃশব্দে কাঁদছেন হাদি সাহেব।

চোখের জলে গাল ভেসে যাচ্ছে তাঁর। মিনু দাঁড়িয়ে আছেন স্বামীর সামনে। স্বামীকে এভাবে কাঁদতে দেখে খুবই অসহায়বোধ করলেন তিনি। তবু তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলেন। তুমিও যদি এমন ভেঙে পড়, আমার ওইটুকু ছেলে কী করে এতগুলো লোককে সামলাবে?

দুহাতে চোখ মুছলেন হাদি। ভাঙাচোরা গলায় বললেন, তিনটি ছেলে মেয়ের একটি নেই, এ আমি ভাবতেই পারি না। আমার বুক ফেটে যায়।

এবার স্বামীর কাঁধে হাত দিলেন মিনু। তুমি এমন করলে আরেকটিকেও হারাতে হবে। একটু শক্ত হও। যে গেছে তার কথা না ভেবে যারা আছে তাদের কথা ভাব।

কথা বলতে বলতে নিজেও কেঁদে ফেললেন তিনি। আমাকে দেখছ না তুমি! আমি কী রকম পাষাণ হয়ে গেছি, দেখছ না!

টুক টুক করে দরজায় শব্দ হলো এসময়।

সঙ্গে সঙ্গে চোখ মুছলেন হাদি। এই শব্দটা তিনি চেনেন। নাহিদের। দরজার দিকে তাকিয়ে বললেন, আয়।

দরজা ঠেলে নাহিদ এবং শুভ ঢুকল।

হাদির দিকে তাকিয়ে নাহিদ বলল, বাবা, এই হচ্ছে শুভ।

তারপর মিনুর দিকে তাকাল সে। মা, শুভর কথা তো তুমি জানই।

বলেই মা এবং বাবার ভেজাচোখ দেখে ফেলল নাহিদ। একটু যেন বিরক্ত হল। নিশ্চয় তোমরা আবার কান্নাকাটি করেছ! আচ্ছা তোমরা এরকম করলে আমি কী করি বল তো?

তারপর যেন চমকাল নাহিদ, বর্ষা কই?

মিনু বললেন, ওই রুমে।

ওকে একা রেখে তোমরা দুজন এই রুমে বসে আছ কেন?

তোর বাবা কাঁদছিলেন, এজন্য আমি..

মায়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই শুভর দিকে তাকিয়ে নাহিদ বলল, তুই এখানে বস। আমি বর্ষার রুমে আছি।

শুভ কিছু বলার আগেই বেরিয়ে গেল নাহিদ।

সঙ্গে সঙ্গে শুভর দিকে তাকালেন হাদি। কাতর গলায় বললেন, আমাদের ফ্যামিলির কারও কখনও ডায়াবেটিস ছিল না। এত কম বয়সে বাদলের যে কেমন করে হল?

স্বামীর পাশে বসে মিনু বললেন, ছোটবেলা থেকেই ও একটু রোগা ছিল। হজমে গণ্ডগোল হতো, ঘনঘন জ্বর হতো। দুবার জন্ডিস হল। বছরখানেক আগে স্পাইনাল কর্ডে টিবি হল। একটানা মাস চার চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতে হল ছেলেটার।

তারপরই বললেন, সারাজীবন শুয়ে থেকেও যদি বেঁচে থাকত…!

কথা শেষ করতে পারলেন না তিনি। কেঁদে ফেললেন।

শুভ খুবই বিব্রত হল। আপনাদেরকে সান্ত্বনা দেয়ার উপযুক্ত আমি নই, তবু দুএকটি কথা বলি। বর্ষার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। ওর যা অবস্থা, আপনারা দয়া করে ওকে নিয়ে ভাবুন। যে চলে গেছে তার কথা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করুন।

মিনু বললেন, ভুলে যেতে চাই বাবা, সত্যি ভুলে যেতে চাই। পারি না। কিছুতেই পারি না।

তবু পারতে হবে। মন শক্ত করতে হবে। ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।

উঠে দাঁড়াল শুভ। আমার একটু কাজ আছে। আপনারা তো আরও তিন চারদিন। আছেন, এর মধ্যে আমি আবার আসব।

.

নাহিদ বলল, আমি ভেবেছিলাম শুভর সাথে তুই অনেক কথা বলবি। তুই কিছুই বললি না। কেন বললি না? ও কী ভাবল বল তো?

এসব কথা যেন শুনতেই পেল না বর্ষা। জানালার সামনে উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ করেই বলল, ভাইজান, বাদল কি এতদিনে কঙ্কাল হয়ে গেছে? কবরের অন্ধকারে একা একা কেমন করে আছে সে? অন্ধকারে বাদল খুব ভয় পেত। এখন ওর ভয় করে না?

হাত ধরে বর্ষাকে চেয়ারে বসাল নাহিদ। এসব বললে আমি খুব কষ্ট পাই। তুই কি ইচ্ছে করে আমাকে কষ্ট দিচ্ছিস?

নাহিদের কথা কিছুই শুনল না বর্ষা। বলল, মৃত্যুর পরও নাকি মানুষের মাথার চুল, নখ বড় হয়! ভাইজান, বাদলের চুলগুলো কি অনেক বড় হয়ে গেছে? ঘাড় ছাড়িয়ে নেমেছে? আর নখগুলো কি ওর বড় হয়ে গেছে? ওতো নিজ হাতে নখ কাটতে পারত না। আমি কেটে দিতাম। ভাইজান, কবরে ওর নখ কেটে দেবে কে?

নাহিদ অসহায় গলায় বলল, তোকে আমি কতবার বলব এসব বলিস না। চল, ঐ রুমে যাই। সবাই মিলে চা খাই।

বর্ষা নড়ল না। আগের মতো করেই বলল, বাদল কি এখন বিকেলের চা খায়? কে করে দেয় ওর চা?

দুহাতে বর্ষার দুটো হাত ধরল নাহিদ। আমি তোকে কিছু কথা বলি…

নাহিদের কথা শেষ হওয়ার আগেই বর্ষা বলল, বাদলের কথা বল ভাইজান, শুধু বাদলের কথা বল। অন্য কারও কথা শুনতে আমার ভাল লাগে না।

এবার আশ্চর্য রকমের এক অভিমান হল নাহিদের।

কেন শুধু বাদলের কথা বলব? বাদল ছাড়া আর কেউ নেই তোর? আমি নেই? আমি তোর ভাই নই? তুই যখন শুধুই বাদলের কথা বলিস আমার খুব কষ্ট হয়। বাদল নেই সেই কষ্ট কিন্তু নয়। অন্য রকমের কষ্ট। মনে হয় আমি তোর ভাই নই, শুধু বাদলই তোর ভাই। আমি মরে গেলেও তুই কোনও কষ্ট পাবি না।

শুনে আপাদমস্তক কেঁপে উঠল বর্ষা। না না, না। মৃত্যুর কথা বল না, তুমি আর মৃত্যুর কথা বল না ভাইজান। আমি সহ্য করতে পারি না। আমার বুক ফেটে যায়। মৃত্যুর সময় যে রকম কষ্ট পেয়েছে বাদল ঠিক সেরকম কষ্ট পেতে থাকি আমি। মনে হয় আমি নিজেই যেন মরে যাচ্ছি।

একটা কথা তোর বোঝা উচিত, বাদলের জন্য যে রকম কষ্ট পাচ্ছিস তুই, তারচে অনেক বেশি কষ্ট পাচ্ছি মা, বাবা আর আমি, আমরা তিনজন। আমাদের কষ্টটা শুধু বাদলকে নিয়ে নয়, তোকে নিয়েও। বাদল চলে গিয়ে যে কষ্ট আমাদেরকে দিয়েছে, বেঁচে থেকে তুই তারচে কম কষ্ট আমাদেরকে দিচ্ছিস না। আমরা কেউ বুঝতে পারছি না, কী করলে তুই ভাল থাকবি।

কিছু করতে হবে না, কিছু করতে হবে না আমার জন্য। বাদলকে এনে দাও, তোমরা শুধু বাদলকে আমার কাছে এনে দাও। আমি আর কিছু চাই না।

বর্ষা হুহু করে কাঁদতে লাগল। বাদল কেন মরে গেল? কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেল?

.

জীবনে এত অপমান আমি কখনও হইনি। এতটা অপমান কেউ আমাকে কখনও করেনি।

রাগে ক্রোধে থমথম করছিল দোলনের গলা। বিরক্তিতে বিশ্রী দেখা যাচ্ছে সুন্দর মুখ। সেই মুখের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মরে যাচ্ছিল শুভ। তার জন্য, শুধু তার জন্য এমন হয়েছে। কেন সে সেতুদের বাড়িতে দোলনকে শুভ পাঠিয়েছিল?

কিন্তু এখন তো আর কিছু করার নেই। যে অপমান দোলনকে করা হয়েছে, কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে তা মুছে দেওয়া যায় তার মন থেকে!

শুভ কাতর গলায় বলল, পরিস্থিতিটা এরকম হবে আমি কল্পনাই করিনি। তাহলে কিছুতেই তোমাকে পাঠাতাম না।

দোলন রুক্ষ গলায় বলল, আপনি পাঠাতেন কি, এরকম অপমান হতে হবে জানলে আমি নিজেই যেতাম না।

একটু থেমে তীব্র ঘৃণায় মুখ বিকৃত করল দোলন। ছি ছি ছি! ছোট বোনের বান্ধবীর সাথে কেউ এরকম ব্যবহার করে? তাও ওরকম সফিসটিকেটেড ফ্যামিলির ছেলে!

ছোট বোনের লুকিয়ে বিয়ে করে ফেলাটা মেনে নিতে পারছে না।

কেন পারবে না? একটি সৎ চরিত্রের মেয়ে তার পছন্দে বিয়ে করে ফেলেছে তাতে কী হয়েছে?

আমার ইচ্ছে করছে এক্ষুণি সেতুদের বাড়ি যাই। গিয়ে ছোট ভাইকে জিজ্ঞেস করি, দোলনের সাথে এই ব্যবহারটা আপনি কেন করেছেন? কিছু বলার থাকলে আমাকে। বলুন।

তাতে লাভ কী? আমার অপমানটা তো আর কেটে যাবে না।

দোলনের কথা বলার ভঙ্গিতে শুভ নিজেও খুব অপমানবোধ করছিল। যদিও বুঝতে পারছিল এটাই স্বাভাবিক। যার জন্য অপমান হয়েছে তাকে তো মনের ঝাল কিছুটা ঝাড়বেই দোলন। তবু মনটা শুভর খারাপ হচ্ছিল। সে উঠে দাঁড়াল। আমি খুব দুঃখিত।

দোলন সঙ্গে সঙ্গে বলল, আপনি দুঃখিত হয়ে কী করবেন? আপনার কি কিছু করার আছে?

না মানে আমার জন্য এরকম অপমান হলে তুমি!

এই অপমানের শোধ আপনি নিতে পারবেন না।

তা হয়ত পারব না, তবে অন্য একটা কাজ করতে পারব। চেষ্টা করব এসবের মধ্যে যেন তোমাকে আর না জড়াতে হয়।

দরজার দিকে পা বাড়াল শুভ।

দোলন বলল, শুনুন।

শুভ ঘুরে দাঁড়াল।

ছোট ভাইর আচরণে আমি বুঝেছি, ব্যাপারটা কিছুতেই ওরা মেনে নেবে না। যতো রকমের ঝামেলা করতে হয় করবে।

শুভ শান্ত গলায় বলল, তা আমিও বুঝেছি। দেখা যাক।

.

দাঁতে দাঁত চেপে স্বপন বলল, না তুমি কিছু বোঝনি! এখন থেকে আমি আর কারও কথা শুনব না। নিজে যা ভাল বুঝব তাই করব।

স্বামীকে শান্ত করার জন্য রেখা বলল, তুমি আমার কথা শোন।

কী কথা শুনব তোমার?

এসব ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করে কোনও লাভ হয় না।

লাভ লোকসানের কথা আমি ভাবছি না।

ভাবতে হবে। এটা তোমাদের ফ্যামিলির প্রেস্ট্রিজ। এজন্য ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে কাজ করতে হবে।

চিন্তা আমি করতে পারছি না। আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

এবার স্বপনের একটা হাত ধরল রেখা। তুমি একটু স্থির হও, স্থির হয়ে বস। আমি তোমার মাথা মেসেজ করে দিই।

ঝটকা মেরে রেখার হাত ছাড়িয়ে দিল স্বপন। রাখ তোমার মাথা মেসেজ! যত্তসব ফালতু চিন্তা। জান, কী অপমানটা আমি হয়েছি। পাত্রপক্ষের সঙ্গে কথা বলছিলাম আমি।

তা তো আমি জানিই।

কিন্তু অপমানটা বোধহয় তুমি ফিল করতে পারছ না। এই মুখে একবার যা হা করেছি, তাই আমাকে আবার না করতে হয়েছে। এনগেজম্যান্টের যাবতীয় ব্যবস্থা। করেছিলাম, সেসব ভেঙে দিতে হয়েছে। লোকে এখন নানা রকমের কথা বলছে, এই অপমানটা শুধু আমার। আর কারও না।

রেখা সরল গলায় বলল, সেতুর ভুলটা হল এসব সে আমাদেরকে আগেই জানিয়ে দিলে পারত। সব ঠিকঠাক হওয়ার পর…!

রেখার কথা শেষ হওয়ার আগেই বেশ জোরে তাকে ধমক দিল স্বপন। চুপ কর।

তারপর গটগট করে বেরিয়ে সেতুর রুমে এসে ঢুকল। হাঁটুতে মুখ গুঁজে বিছানায়। বসে আছে সেতু। মায়ের চোখের সামনে দাঁড়াবার পরও চোখ তুলে তাকাল না।

ক্রোধে ফেটে পড়া গলায় স্বপন বলল, ইচ্ছে করছে এখন মারি তোকে, মেরে দাঁতগুলো ভেঙে ফেলি তোর, হাড়গুলো ভেঙে ফেলি। হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে পা দুটো ভেঙে দিই তোর, যাতে কোনদিন বাড়ি থেকে বেরুতে না পারিস। হাত দুটো ভেঙে দিই, যাতে কোনদিন টেলিফোন ধরতে না পারিস। তোর জিভটাও কেটে দেয়া উচিত যাতে মানুষের সঙ্গে আর কথা বলতে না পারিস।

সেতু একটিও কথা বলল না। চোখের জলে ভাসতে লাগল।

.

সন্ধ্যারাতে নিজের বেডরুমে মন খারাপ করে শুয়ে আছেন মামুন।

শিলা গিয়েছিলেন মুন্নির রুমে। ফিরে এসে স্বামীকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে যা বোঝার বুঝে গেলেন। অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে স্বামীর পা মোছালেন তিনি। তার বাহুর কাছটায় হাত রাখলেন। তুমি একটু বেশি ভেঙে পড়েছ।

মামুন হতাশ গলায় বললেন, বেশি মানে কী? আমার মনে হচ্ছে আমি একেবারেই শেষ হয়ে গেছি।

এভাবে বল না।

সত্যি। বাবা মার মৃত্যুতেও এতো কষ্ট আমি পাইনি।

তা আসলে ঠিক নয়। মানুষ যখন সে দুঃখটা পায় সেটাকেই বড় করে দেখে।

এরকম কাজ সেতু কেমন করে পারল?

শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবলেই এরকম কাজ মানুষ করতে পারে। একবারও আমাদের কথা ওর মনে হল না?

মনে হলে কী আর এরকম কাজ করে? মানুষের নিয়মই এই, যে সংসারে বড় হয়, যাদের আদরে ভালবাসায় বড় হয়, একদিন তাদের দিকেই আর ফিরে তাকায় না। নিজের স্বার্থটাকেই বড় করে দেখে।

এটা কেমন স্বার্থ দেখা?

নিজের পছন্দে বিয়ে করা মানেই তো নিজের স্বার্থ দেখা।

কিন্তু ওই ছোকরাটার খবর আমি নিয়েছি। অতি বাজে পরিবার, হতদরিদ্র। ওইটুকু একটা বাড়ি ছাড়া কিছু নেই। কেরানিগিরি করে জীবন চালাতে হবে। আমার বোন হবে কেরানির বউ।

এ কথায় স্বামীর মন খারাপের কথা ভুলে গেলেন শিলা। স্বামীর ঠাট্টা প্রবণতার কথা মনে পড়ল। ফলে নিজের অজান্তেই যেন গলায় এসে তার ভর করল ঠাট্টার সুর। হবে না, হয়ে গেছে।

স্ত্রীর এই ভঙ্গিটা পছন্দ করলেন না মামুন। বিরক্ত হলেন। কথাটা বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে।

সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভুল বুঝতে পারলেন শিলা। মাথা নিচু করে বললেন, সরি।

মামুন বললেন, নিজের স্বার্থটাও সেতু বোঝেনি। বুঝলে এরকম জায়গায় নিজেকে জড়াত না। মানুষ সব সময় নিজের ভাল চায়। সেতু কী চাইল?

কেউ কাউকে ভালবাসলে এত নিজের করে বাসে না।

মামুন খর চোখে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। চুপ কর। ভালবাসা শব্দটার ওপর আমার ঘেন্না ধরে গেছে।

বাইরে থেকে রানী এক সময় বলল, ছোট সাহেব ড্রয়িংরুমে বসে আছে।

মামুন উঠলেন। শিলাকে কিছু না বলে বেডরুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে ঢুকলেন।

স্বপন গম্ভীর মুখে বসে আছে।

মামুন তার মুখোমুখি বসলেন। কী হয়েছে?

স্বপন থমথমে গলায় বলল, প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে আমার। ওকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে।

রাগারাগি করে লাভ নেই।

তাহলে কী করব? হুজুর হুজুর করব ওকে?

মামুন কথা বললেন না।

স্বপন বলল, ভাইয়া, আজ তোমাকে কিছু কথা আমি না বলে পারছি না। তোমার অতিরিক্ত আদরে এতোটা বখে যাওয়ার সাহস পেয়েছে সেতু। বোনকে আদরেরও একটা সীমা থাকে, যেই সীমাটা তোমার ছিল না। তীক্ষ্ণ চোখে স্বপনের দিকে তাকালেন মামুন, তোর ছিল? তুই কি সেতুকে কম আদর করেছিস?

তোমার মতো করিনি।

সেতুর কথা একা বলছিস কেন? তোকেই কি কম আদর করেছি আমি! বড় ভাই পিতার মতো। তোদের দুজনকে পিতার স্নেহে বড় করেছি আমি।

তা অস্বীকার করছি না।

তাহলে আমার অপরাধটা কোথায়? আমার দায়িত্ব ছিল তোদেরকে ভালবেসে বড় করা। আমি তা করেছি। বড় হয়ে তুই যদি আমার বুকে ছুরি মেরে দিস তাহলে আমার কী করার থাকে!

এসব ইমোশনাল কথা বলে লাভ নেই। এখন কী করবে, কীভাবে এটা সামাল দেবে তাই বল।

এখন কিছুই করতে চাইছি না।

মানে?

তোর চেয়ে রাগ আমারও খুব কম নয়। কিন্তু রাগের মাথায় আমি কিছু করব না। তাহলে ভুল হবে। কয়েকটা দিন যাক, রাগটা একটু কমে আসুক। তারপর যা করার করব।

তার মানে এখন হাত পা গুটিয়ে বসে থাকব?

এছাড়া কিছু করার নেই।

একটু থেমে মামুন বললেন, কিছু করার নেই কথাটা ঠিক নয়। আছে।

কী আছে বল।

আমি তোর ভাবীকে বলে দেব, তুইও রেখাকে বলবি সেতুর দিকে খেয়াল রাখতে, আরও কিছু কী করতে হবে, তোর ভাবী সেসব করবে।

ঘণ্টাখানেক পর শিলা এসে ঢুকলেন সেতুর রুমে।

সেতু শুয়েছিল। শিলাকে দেখে উঠে বসল।

শিলা কোনও ভণিতা করলেন না। রুক্ষ গলায় বললেন, তোমাকে কিছু বলতে এসেছি। কথাগুলো আমার নয়, তোমার ভাইদের। মন দিয়ে শুনবে। নাম্বার ওয়ান, এখন থেকে বাড়ির বাইরে তুমি যেতে পারবে না। নিষেধ। টু, টেলিফোন ধরতে পারবে না। নিষেধ। থ্রি, কোনও রকমের চালাকি কিংবা অন্য কিছু করলে আমাদের সাথে তোমার কোনও সম্পর্ক থাকবে না। ফিরে এলেও আমরা তোমাকে আর চিনব না।

সিনেমার রাগী মহিলাদের ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেলেন শিলা। সেতু অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল। চোখ দুটো জলে ভরে গেছে তার।

.

ভাই-ভাবীর বেডরুমের সামনে দাঁড়িয়ে শুভ বলল, ভাবী, আসব?

রুমে সুরমা একা! শুভর গলা শুনে বলল, আয়।

শুভ ভেতরে ঢুকল।

এক পলক দেবরের দিকে তাকিয়ে সুরমা বলল, বস!

শুভ বসল না। চিন্তিত গলায় বলল, তোমার সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার।

তীক্ষ্ণ চোখে শুভর মুখের দিকে তাকাল সুরমা। কী হয়েছে? তোকে এমন দেখাচ্ছে। কেন? সেতুকে নিয়ে কোনও ঝামেলা হয়েছে?

শুভ মাথা নাড়ল।

সুরমা উতলা গলায় বলল, কী হয়েছে?

ওকে বাড়ি থেকে বেরুতে দিচ্ছে না, ফোন ধরতে দিচ্ছে না।

আর?

দোলনকেও ঐ বাড়িতে যেতে মানা করা হয়েছে।

এবার উল্কণ্ঠা যেন একটু কমলো সুরমার। বলল, প্রথম প্রথম এরকমই হয়। ঠিক হয়ে যাবে।

কিন্তু আমার খুব নার্ভাস লাগছে।

নার্ভাস লাগার কিছু নেই।

সেতুর ছোট ভাইটা খুব রাগী।

তাতে কী? সেতু নিজে যদি ঠিক থাকে তাহলে কেউ কিছু করতে পারবে না।

কিন্তু এভাবে কতদিন?

কিছুদিন তো যাবেই।

সেতুর সাথে দেখা হবে না, কথা হবে না।

আপাতত না হোক।

কিন্তু কতদিন ওর সাথে কথা না বলে থাকব আমি, কতদিন দেখা না করে থাকব?

মনে হয় না বেশিদিন।

ভাবী, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।

সুরমা সুন্দর করে হাসল। ভালবাসার জন্য এই কষ্ট করতেই হবে। হাত ধরে নিজের পাশে শুভকে বসাল সুরমা। শোন, তুই চাকরি বাকরির কথা বলেছিস, শুনে তোর ভাই কিন্তু চিন্তিত হয়ে গেছেন। তুই একটু সাবধানে থাকিস।

শুভ অবাক হল। সাবধানে থাকব কেন?

যে রকম মন খারাপ করে ঘুরছিস, যে কেউ দেখে তোকে নিয়ে চিন্তিত হবে।

শুভ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ব্যাপারটা ঠিকঠাক না হওয়া পর্যন্ত মন আমার ভাল হবে না।

.

মালা ছুটে এসে বলল, তিনটি চিঠির জবাব আসেনি, জানিস, দুসপ্তাহ ধরে ফোনও করে না।

শুভ কোনও কথা বলল না। নিজের বিছানায় যেমন শুয়েছিল শুয়ে রইল।

মালা বলল, একটা ফ্যাক্স নাম্বারও আছে, এই ফুলস্কেপের পৃষ্ঠা আমেরিকায় ফ্যাক্স করতে কতো লাগে রে?

শুভ নির্বিকার গলায় বলল, জানি না, তুই এখন যা।

‘তুই’ শব্দটা শুনে আঁতকে উঠল মালা। চোখ কপালে তুলল মালা, তুই আমাকে তুই করে বলছিস কেন?

এবার বিরক্ত হল শুভ। আমার ইচ্ছে হয়েছে বলেছি। যা ভাগ!

সাথে সাথে ঠোঁট উল্টাল মালা। ইস্ ঢং! দাঁড়া এক্ষুণি গিয়ে মাকে বলছি।

যা বল গিয়ে। যা।

কিন্তু মায়ের কাছে আসার আগে চোখটা একটু ভিজিয়ে নিলো মালা। কাঁদতে কাঁদতে এল।

ডাইনিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে পেয়ালা প্লেট গোছাচ্ছিলেন মা। মালাকে দেখে। অবাক হলেন। কাঁদছিস না কি? কী হয়েছে?

মালা নাকের জলে চোখের জলে একাকার হয়ে বলল, তোমার ছোট ছেলে…

কথা শেষ হওয়ার আগেই গম্ভীর গলায় মা বললেন, কথা ঠিক মতো বল। আমার ছোট ছেলে মানে? আমার ছোট ছেলে তোর কী হয়?

আঁচলে চোখ মুছল মালা। হয়ত ভাইই, ছোট ভাই কিন্তু ব্যবহার করে পরের মতো।

ভণিতার দরকার নেই। কী হয়েছে তাই বল।

একটা কথা বলতে গেছি, তুই তোকারি শুরু করল। বড় বোনের সাথে কেউ এমন করে?

তুই বা যখন তখন ওর কাছে যাস কেন? কথায় কথায় যখন এত কান্না পায় তখন…

একথা শুনে কান্না ভুলে মালা একেবারে তেড়িয়া হয়ে উঠল। তুমি কেমন মা? তোমার কাছে এলাম বিচার দিতে আর তুমি উল্টো আমাকেই বকছ? আমি আজই আমেরিকায় ফোন করব। এই বাড়িতে আমি আর থাকব না।

শুনে মাও রাগলেন। না থাকলে তো বেঁচেই যাই। তুই যে রুমটা দখল করে আছিস ওটা ভাড়া দিলে কমপক্ষে দেড় হাজার টাকা পাব।

মালা ঠোঁট উল্টাল। ইস, দেড় হাজার টাকা।

তারপর নিজের রুমের দিকে পা বাড়াল।

মা বললেন, শোন।

মালা দাঁড়াল।

আমেরিকায় ফোন করতে হলে কার্ডফোন থেকে করবি। খবরদার এই বাড়ি থেকে ফোন করবি না।

মালা মুখ ঝাঁপটে বলল, কার্ডফোন থেকেই করব। তোমাদের ফোন থেকে করব না।

মালা চলে যাওয়ার পর হাতের কাজ ফেলে রেখেই শুভর রুমে এসে ঢুকলেন মা। কী, ব্যাপার কী?

শুভ যেন কিছুই জানে না এমন ভঙ্গিতে বলল, কী?

মালার সঙ্গে ঝগড়া করেছিস কেন?

কে বলল ঝগড়া করেছি?

যেই বলুক, কেন করেছিস?

ঝগড়া করিনি, তুই করে বলেছি।

কেন?

সব সময় চিঠিপত্র নিয়ে ঘ্যানঘ্যানানি ভাল লাগে না।

মুখ সামলে কথা বল। কীসের ঘ্যানঘ্যানানি? বড় বোনের কথাকে কেউ ঘ্যানঘ্যানানি বলে?

আমার মেজাজ খুব খারাপ হয়ে আছে মা। যত কথা বলবে মেজাজ তত খারাপ হবে। তারচে’ তুমি এখন যাও। যা বলার পরে বল।

এ কথায় খুবই রেগে গেলেন মা। কী, আমাকেও চলে যেতে বলছিস? এত বড় সাহস তোর? এই, কোন লাটবাহাদুর হয়ে গেছিস তুই? যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা! এক থাপ্পড় মারব।

এবার আস্তেধীরে বিছানা থেকে নামল শুভ। আলনা থেকে শার্ট নিয়ে পরল। ঠিক আছে, তুমি থাক, আমিই বরং বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই।

দরজার দিকে এগিয়ে গেল শুভ।

মা বললেন, পারলে চিরতরে চলে যা। তোর মুখ যেন আমার আর দেখতে না হয়।শুভ আর কথা না বলে বেরিয়ে গেল।

<

Super User