পূর্ব পুরুষদের কাঁচারি বাড়িটা মূল বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে। সেটা এতদিন এমনি পড়েছিল। রুকসানা সেখানে কুটির শিল্পের কারখানা করেছে। কাঁচারী বাড়ির সামনে অনেকখানি ফাঁকা জায়গা বন জঙ্গলে ভরেছিল। কারখানায় শ্রমিকদের নিয়ে পরিষ্কার করে ফুলের বাগান করেছে। কারখানার প্রায় পঞ্চাশ ষাটজন কাজ করে। তাদের মধ্যে অর্ধেক মেয়ে। তারা সবাই একই কারখানায় কাজ করলেও মেয়েদের বিভাগ আলাদা। সেখানে কোনো পুরুষ কাজ করে না। দুই বিভাগের মাঝখানে তিনটে অফিস রুম। মাঝ খানের রুমে রুকসানা বসে। অন্য দুটোর একটায় মেয়েদের পরিচালক রাবিয়া ও অন্যটায় পুরুষদের পরিচালক কায়সার বসে। দুজনেই একই গ্রামের অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে। কলেজে পড়ার সময় মন দেওয়া নেওয়া হয়েছিল। লেখাপড়া শেষ করে বিয়ে করেছে। তারা রুকসানার সহপাঠী ছিল। গ্রামে ফিরে তিন জনে মিলে সমাজ কল্যাণে নেমেছে। রাবিয়াও কায়সার আর্থিক সহযোগিতাও করেছে। যা কিছু করেছে তিন জনে পরামর্শ করেই করেছে।

আজ রুকসানা অফিসে আসার ঘণ্টাখানেক পরে রাবিয়া এসে বলল, পলাশপুরের সাজেদা তিন দিন কাজে আসেনি। কাল ঐ গ্রামের আনোয়ারকে খোঁজ নিতে বলেছিলাম? কিছুক্ষণ আগে সে বলল, সাজেদার খুব অসুখ।

রুকসানা বলল, তাই নাকি? তা হলে তো তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা দরকার। বিকেলে তুই ও কায়সার আলতাফ ডাক্তারকে নিয়ে যাস।

রাবিয়া বলল, ও তো আজ আসেনি। বিকেলে আমার ননদকে দেখার জন্য ছয় সাতজন লোক আসবে। আমাকে তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছে। তুই না হয় ডাক্তার নিয়ে যাস।

রুকসানা বলল, ঠিক আছে, তাই যাব।

বিকেলে রুকসানা আলতাফ ডাক্তারকে নিয়ে পলাশপুর গেল। আলতাফ ডাক্তার। সাজেদাকে দেখে প্রেসক্রিপশন করে দিয়ে পাশের গ্রামে রুগী দেখার জন্য চলে গেল।

সাজেদা বিয়ের পাঁচ বছর পর বিধবা হয়ে দুটো ছেলে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসে। বাবা আবেদ খেটে খাওয়া মানুষ। তার তিন ছেলে বিয়ে করে আলাদা সংসার করেছে। আবেদের বয়স হয়েছে। তেমন খাটা খাটনি করতে পারে না। তাছাড়া। বছরের প্রায় অর্ধেক দিন গ্রামে কাজ পাওয়া যায় না। কোনো রকমে এক বেলা এক সন্ধ্যে খেয়ে দিন কাটাচ্ছিল। সাজেদা দুটো ছেলে নিয়ে বিধবা হয়ে আসার পর সংসারে আরো বেশি অভাব দেখা দেয়। রুকসানা জানতে পেরে সাজেদাকে। কারখানায় লাগিয়েছে।

সাজেদার কাছ থেকে ফেরার পথে রুকসানা রাস্তার পাশে একটা বাঁধা ষাঁড়কে পাশ কেটে কিছুটা এগিয়েছে এমন সময় হঠাৎ ষাঁড়টা বোরখা পরা রুকসানাকে দেখে গোঁ গোঁ করে উঠে লাফালাফি করে রশি ছেঁড়ার চেষ্টা করল। রুকসানা তা বুঝতে। পেরে ভয় পেয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগল, আর একবার করে পিছন ফিরে ষাঁড়টার দিকে তাকাতে লাগল। কয়েক সেকেণ্ডর মধ্যে ষাঁড়টা রশি ছিঁড়ে তার দিকে দৌড়ে আসছে দেখে ভয় পেয়ে রুকসানাও প্রাণপণে দৌড়াতে লাগল। কিন্তু বোরখা পরে থাকার কারণে ষাঁড়টার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারল না।

হাসান রুকসানার বিপরীত দিক থেকে আসছিল। দূর থেকে একটা ষাঁড়কে বোরখা পরা একটা মেয়েকে তাড়া করছে দেখতে পেয়ে খুব দ্রুত দৌড়ে আসতে লাগল।

ষাঁড়টা যখন রুকসানার খুব কাছাকাছি এসে গেল তখন হাসানও সেখানে পৌঁছে গেল। রোকসানাকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তা থেকে ক্ষেতে ফেলে দিয়ে ষাঁড়টার দুটো শিং ধরে প্রাণপণ শক্তিতে ঝাঁকি দিল।

ষাঁড়টা তাতেও দমল না। হাসানকে ঠেলে এগিয়ে নিয়ে চলল। হাসান এবার একটা হাতে শিং ধরে রেখে অন্য হাতের আঙ্গুলগুলো দু’নাকের ভিতর ঢুকিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ঘাড়ে মোচড় দিয়ে ষাঁড়টাকে মাটিতে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করল। ষাঁড়টা বোধ হয় প্রতিপক্ষের শক্তি বুঝতে পেরে নিজেকে দাঁড় করিয়ে রাখার চেষ্টা করল।

ততক্ষণ পথচারীরা যে যা পেল, তাই দিয়ে আঁড়টাকে মারতে লাগল। আর দু তিন জন রশি ধরে টানতে লাগল।

ষাঁড়টা বেগতিক দেখে কয়েক পা পিছিয়ে এল। এমন সময় ষাড়ের মালিক জহুর এসে ষাঁড়টাকে আদর করে রশি ধরে হাসানকে বলল, এবার ছেড়ে দিন স্যার।

হাসান ছেড়ে দিয়ে বলল, এরকম মার কুত্তো ষাঁড়কে রাস্তায় বেঁধে রাখা আপনার ঠিক হয়নি।

জহুর বলল, এ আমার ঘরের গাইয়ের বাছুর। খুব শান্ত। কখনো কাউকে গুতোয়। তারপর রুকসানার দিকে তাকিয়ে বলল, বোরখা পরা মেয়েকে দেখে হয়তো আজ এই কাণ্ড করল। আমার ছোট ছেলেটা দূর থেকে দেখে আমাকে ডাকার জন্য ঘরে গিয়েছিল। আমি ও পাড়ায় গিয়েছিলাম। ফিরে এসে শুনে ছুটে এসেছি।

ষাঁড়টাকে তার পিছনে ছুটতে দেখে রুকসানা ছুটার সময় দেওয়া ইউনুছ পড়ছিল, ষাঁড়টা যখন তার খুব কাছে এসে গিয়েছিল তখন তার মনে হয়েছিল, ষাঁড়টা তাকে শিং দিয়ে গুতিয়ে ফালা ফালা করে ফেলবে। তাই মনে মনে বলেছিল, আল্লাহ গো, তুমি আমাকে রক্ষা কর। হাসান ধাক্কা দেওয়ার আগেই জ্ঞান হারাবার উপক্রম হয়েছিল। ক্ষেতে পড়ে হাতে পায়ে কিছু আঘাত পেলেও তার মনে হল, যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে কেউ বাঁচাল। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে হতভম্ব হয়ে এতক্ষণ ষাঁড় ও মানুষের লড়াই দেখছিল। আর হাসান স্যারের সাহস ও শক্তি দেখে খুব অবাক হল। জহুর ষাঁড় নিয়ে চলে যাওয়ার পর তাদের একজন জিজ্ঞেস করল, আপনার কোথাও লাগেনি তো স্যার?

হাসান বলল, না আমার কিছু হয়নি। আপনারা এবার যান। তারপর রুকসানার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাকে ধাক্কা দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। তবু ক্ষমা চাইছি। তারপর জিজ্ঞেস করল, পড়ে গিয়ে নিশ্চয় আঘাত পেয়েছেন?

রুকসানা বলল, আঘাত পেলেও তা সামান্য। আপনাকে ধন্যবাদ দেওয়ার ভাষা আমার নেই। শুধু এটুকু বলব, আপনি আমাকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে এনেছেন। ভাবছি আঘাত পেয়েছেন কিনা?

হাসান সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল, আল্লাহ আপনাকে বাঁচিয়েছেন, আমি ওসিলা মাত্র। তারপর বলল, একা যেতে পারবেন, না পৌঁছে দেব?

রুকসানা বলল, আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না, একাই যেতে পারব।

ঠিক আছে, আসি তা হলে বলে হাসান হাঁটতে শুরু করল।

ততক্ষণে লোকজন সব চলে গেছে। রুকসানা বলল, শুনুন।

হাসান কিছুটা চলে গিয়েছিল। ফিরে এসে বলল, কিছু বলবেন?

রুকসানা বলল, লোকজন আপনাকে স্যার বলছিল। আপনি কী স্কুলের টিচার?

হাসান বলল, হ্যাঁ।

আপনার নামটা বললে খুশি হতাম।

হাসান।

বাড়ি?

হাসান কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বলল, আমি ঢাকা থেকে এসে কয়েক মাস হল এখানকার গার্লস হাই স্কুলে জয়েন করেছি।

রুকসানার তখন সামাদের কথা মনে পড়ল। ফুকরা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ঢাকা থেকে একটা ভালো টিচার এসেছেন। ভাবল, ইনিই সেই টিচার ননতো? বলল, আপনি ফুকরা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক?

জ্বি।

আমি আব্দুল মতিন চৌধুরীর বড় মেয়ে রুকসানা। একদিন আমাদের বাড়িতে আসুন না। বাহিরবাগ গ্রামে গিয়ে যে কাউকে চৌধুরী বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলে দেখিয়ে দেবে।

হাসান কয়েক সেকেণ্ড একদৃষ্টে তার কালো চশমা পরা চোখের দিকে চেয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলল, আসব। এবার আসি, তারপর আল্লাহ হাফেজ বলে হাঁটতে লাগল।

রুকসানাও আল্লাহ হাফেজ বলে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর ফেরার পথে ভাবতে লাগল, ভদ্রলোক যেমন শক্তিশালী তেমনি সাহসী। উনি যদি ঠিক সময়ে এসে না পড়তেন, তা হলে কি হত ভেবে শিউরে উঠল। ঘরে এসে আব্বা আম্মাকে ঘটনাটা জানাল।

আজিজা বেগম বললেন আল্লাহ লোকটার ভালো করুক। তোকে কতবার বলেছি একা কোথাও যাবি না, কাউকে সঙ্গে নিবি।

আব্দুল মতিন বললেন, লোকটাকে চিনিস?

রুকসানা বলল, না। তবে পরিচয় জেনেছি। নাম হাসান। সেদিন সামাদ মনিরাদের স্কুলের যে একজন ভালো টিচারের কথা বলেছিল, মনে হয় উনিই তিনি।

আব্দুল মতিন বেশ অবাক হয়ে বললেন, তাই নাকি? একটা শহরের লোক ষাঁড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে তোকে বাঁচাল, খুব আশ্চর্য ব্যাপার তো?

হ্যাঁ আব্বা, শুধু আমি নই, রাস্তার যত লোক ছিল সবাই খুব অবাক হয়েছে।

তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলি না কেন?

উনি আমাকে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন, আমি না করেছি? তবে একদিন আসতে বলেছি।

সামাদ যার কথা বলেছিল, উনি যদি তিনি হন, তা হলে এলে মনিরাকে পড়াবার ব্যবস্থা করিস।

ঠিক আছে, তাই করব বলে, রুকসানা নিজের রুমে এসে কাপড় পাল্টে মনিরাকে ডেকে বলল, তোদের স্কুলে ঢাকা থেকে একজন ভালো টিচার এসেছে। শুনলাম, তার নাম কি বলতো?

মনিরা বলল, পুরো নামতো জানি না। সবাই হাসান স্যার বলে। জান বড় আপা, স্যার খুব ভালো পড়ায়; কিন্তু ভীষণ কড়া, কোনো ছাত্রী যদি বেয়াদবি করে অথবা। পড়া না করে আসে তা হলে আর রক্ষে নেই। সে যত বড় লোকের মেয়ে হোক না। কেন, সারা পিরিয়ড বেঞ্চে দাঁড় করিয়ে রাখেন।

রুকসানা বলল, ভাবছি, তোকে পড়াবার জন্য ওঁকেই রাখার ব্যবস্থা করব।

ওরে বাবা, উনি যা কড়া টিচার। ওঁর দিকে তাকালেই ভয় লাগে। পড়ব কি করে? না বাবা না, আমি ওঁর কাছে পড়ব না।

তুই তো নিজেই বললি, উনি খুব ভালো টিচার। শোন, ভালো টিচাররা একটু কড়া হন। বেয়াদবি মোটেই পছন্দ করেন না। তুই ওঁর সঙ্গে বেয়াদবি না করলে তোকে কিছু বলবেন না।

মনিরা কিছু বলতে যাচ্ছিল, মাগরিবের আজান হচ্ছে শুনে রুকসানা বলল, যা নামায পড়তে যা, আমিও পড়ব।

পরের দিন রুকসানা অফিসে কাজ করছিল। পিয়ন আতাহার এসে একটা স্লিপ দিয়ে বলল, এই ভদ্র লোক আপনার সাথে দেখা করতে চান।

রুকসানা স্লিপের উপর চোখ বুলিয়ে বলল, নিয়ে এস।

হাসান রুমে ঢুকে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?

রুকসানা সালামের উত্তর দিয়ে বসতে বলে বলল, ভালো আপনি?

আমিও ভালো বলে হাসান পকেট থেকে একটা ছোট ওষুধের প্যাকেট বার করে। টেবিলের উপর রেখে বলল, দিনে কয়েক ফোঁটা করে চারবার খাবেন। প্যাকেটের ভিতর ড্রপারও আছে।

রুকসানা অবাক কণ্ঠে বলল, ওষুধ খাব কেন?

কাল পড়ে গিয়ে নিশ্চয় আঘাত পেয়েছিলেন। লজ্জায় আমার কাছে স্বীকার করেন নি। এটা পঞ্চাশ হাজার পাওয়ারের আরনিকা। খেলে যে কোনো আঘাতের ব্যথা সেরে যায়।

আমি তো তেমন আঘাত পাইনি, তবু খেতে হবে?

হ্যাঁ, তবু খেতে হবে। কারণ আঘাত পাওয়া জায়গাটা বেশি বয়সে অসুবিধা সৃষ্টি করবে। বিশেষ করে যদি কেউ ছোট বেলায় অথবা বড় বেলায় মাথায় আঘাত পায়। তাহলে বয়সকালে সে পাগলও হয়ে যেতে পারে।

রুকসানা আরো অবাক হয়ে বলল, আপনি ডাক্তার নাকি?

এই একটু-আধটু প্র্যাকটিস করি আর কি।

তাই বলুন। আপনার কথা শুনে মনে করেছিলাম, আপনি পাশ করা ডাক্তার। তারপর বলল, আপনি এসে ভালই করেছেন। নচেৎ আমাকেই আপনার কাছে যেতে হত।

তাই নাকি? তা হলে কারণটা বলুন।

মনিরাকে চেনেন? আপনার স্কুলের ক্লাস নাইনের ছাত্রী।

ছাত্রীকে চিনব না কেন?

কতটা চেনেন?

ভালো ছাত্রী, তবে অঙ্কে একটু কাঁচা। আর একটু চঞ্চল।

মনিরা আমার ছোট বোন। আপনি ঠিকই বলেছেন, ও অঙ্কে একটু কাঁচা, পাকা করার দায়িত্ব দেওয়ার জন্য আপনার কাছে একদিন যাব ভাবছিলাম।

দেখুন, আমি কোনো ছাত্র ছাত্রীকে প্রাইভেট পড়াই না। তা ছাড়া এখান থেকে দক্ষিণ ফুকরা প্রায় পাঁচ-ছয় কিলোমিটারের কম না?

বাড়িতে এসে পড়াবেন, একথা তো বলিনি। ছুটির পর স্কুলেই পড়াবেন।

তাও সম্ভব নয়।

কেন?

স্কুলের টাইমের আগে ও পরে ডাক্তারী করি। পড়াবার সময় কোথায় বলুন।

ডাক্তারী করে মাসে কত আয় করেন?

আয় করার জন্য আমি ডাক্তারী করি না।

মানে?

মানে গ্রামের অভাবী লোকদের সেবা করা।

বাড়িতে কে কে আছে আপনার?

কেউ নেই।

রুকসানা কয়েক সেকেণ্ড তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আপনাকে খুব চেনা চেনা লাগছে মনে হচ্ছে কোথাও যেন দেখেছি, আপনার বাড়ি কোথায়?

হাসান দীর্ঘ নিশ্বাস চেপে রেখে বলল, হয়তো আমার মতো কাউকে কোথাও দেখেছেন। এবার আসি তাহলে?

রুকসানা বলল, প্লিজ, আর একটু বসুন। তারপর মেয়ে পিয়ন আসিয়াকে ডেকে বলল, দু’কাপ চা করে নিয়ে এস। তারপর হাসানকে বলল, বাড়ি কোথায় বললেন না যে?

বাড়ি থাকলে তো বলব।

ঠাট্টা করছেন?

ঠাট্টা করব কেন? যা সত্য তাই তো বললাম।

জন্মস্থানের নাম নিশ্চয় জানেন।

জানি।

সেটাই বলুন।

বলতে পারব না।

কেন?

মাফ করবেন, তাও বলতে পারব না।

এমন সময় আসিয়া দু’কাপ চা নিয়ে এলে রুকসানা এক কাপ তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নিন। তারপর অন্য কাপটা নিয়ে চুমুক দিয়ে বলল, মনিরাকে তাহলে সাহায্য করতে পাবেন না?

হাসান কোনো কথা না বলে চা খাওয়া শেষ করে কাপ পিরিচ টেবিলের উপর রেখে বলল, ঠিক আছে, ছুটির পর স্কুলেই ঘণ্টাখানেক পড়াতে পারি। অবশ্য মনিরা যদি পড়তে চায়।

সে ব্যবস্থা আমি করব। আপনি থাকেন কোথায়?

ফুকরা স্কুলে জয়েন করার পর কিছু দিন সেক্রেটারীর কাঁচারী বাড়িতে ছিলাম। তারপর দক্ষিণ ফুকরা গ্রামের মরহুম কাজেম সেখের ভিটায় দু’টো ঘর তুলে আছি। একটা ডিসপেন্সারী আর অন্যটাতে আমি থাকি।

কাজেম সেখের নাম শুনে রুকসানা চমকে উঠল। সেই সাথে ইকবালের কথা মনে পড়ল। হাসানের মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ তার মনে হল, ইকবালের মুখের সঙ্গে অনেক মিল। ভাবল, তাই বোধ হয় হোসেনকে চেনাচেনা মনে হচ্ছে। বলল, ঠিক আছে মনিরা ছুটির পর স্কুলেই আপনার কাছে পড়বে।

এবার তাহলে আসি। ওষুধটা ঠিক মতো খাবেন বলে, ইকবাল যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল।

রুকসানা বলল, এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? আপনাকে তো একটা কথা বলাই হয়নি। কাল ঘরে এসে আব্বা-আম্মাকে আমার বিপদের কথা বলে আপনি কিভাবে। আমাকে রক্ষা করলেন বললাম। শুনে তারা আপনাকে অনেক দোয়া করলেন। তারপর আমাকে বললেন, আবার দেখা হলে নিয়ে আসবি। চলুন না, আমাদের বাড়িতে।

ইকবাল বলল, আজ সম্ভব নয়, অন্য একদিন আমি নিজেই যাব। তারপর সালাম বিনিময় করে সেখান থেকে বেরিয়ে এল।

হাসান স্যার বেরিয়ে যাওয়ার পর রুকসানার কেন যেন মনে হল, উনি ইকবাল নয় তো? প্রায় বিশ বছর তাকে দেখিনি, তার উপর দাড়ি রেখেছে। তাই হয়তো চিনতে পারিনি। তা না হলে স্কুল থেকে তিন চার কিলোমিটার দূর দক্ষিণ ফুকরায় কাজেম চাচার ভিটেয় ঘর তুলে থাকতে যাবে কেন? হঠাৎ আসমার কথা মনে পড়ল। দাইহানের সঙ্গে বিয়ে হয়ে সে তো কাজেম চাচার ঘরের পাশে আছে। খবর দিলে দু’জনেই আসবে। তাদের কাছে হাসান স্যারের পরিচয় নিশ্চয় জানা যাবে। আমি তাদের বিয়ের ব্যাপারে যে সাহায্য করেছি সে কথা মনে রাখলে তারাও আমাকে সাহায্য না করে পারবে না। তখন তাদের বিয়ের ঘটনা রুকসানার মনের পাতায় ভেসে উঠল।

এস.এস.সি পরীক্ষা শেষ হওয়ার মাস খানেক পর একদিন আসমার ভাইয়া শাকিল রুকসানাদের সদর বাড়িতে এসে একজন লোককে বলল, আমি দক্ষিণ ফুকরা থেকে এসেছি, চৌধুরী হুজুরের বড় মেয়ে রুকসানার কাছে।

লোকটা সামসু। জিজ্ঞেস করল তোমার নাম কি?

শাকিল।

কার ছেলে তুমি?

গেঁদু মুন্সীর।

তোমাদের নাম বললে বড় আপা চিনবেন?

জি চিনবেন।

ঠিক আছে, বস, আমি খবর দিচ্ছি। তারপর ভিতর বাড়িতে গিয়ে রুকসানাকে বলল, দক্ষিণ ফুকরা থেকে গেঁদু মুন্সীর ছেলে শাকিল আপনার কাছে এসেছে।

রুকসানা বলল, নিচে ড্রইংরুমে বসাও আমি আসছি।

শাকিলও দাইহান সময় পেলেই মাঝে মধ্যে ছুটির সময় স্কুলে এসে আসমাকে নিয়ে যেত। প্রথম যেদিন আসে, সেদিনই আসমা রুকসানার সঙ্গে, পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। তাই শাকিল এসেছে শুনে ভাবল, নিশ্চয় আসমা পাঠিয়েছে। কিছুক্ষণ পরে ড্রইংরুমে এল।

শাকিল সালাম দিল।

রুকসানা সালামের উত্তর দিয়ে বলল, কী ব্যাপার শাকীল ভাই, হঠাৎ এলে যে?

শাকিল বলল, আব্বা দাইহান ও আসমার সম্পর্কের কথা জানতে পেরে গুপিনাথপুরে আসমার বিয়ের সব কিছু ঠিকঠাক করে ফেলেছে। তারপর পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে তার হাতে দিয়ে বলল, তুমি তো ওদের কথা সবই জান। তাই আসমা তোমার কাছে সাহায্য চেয়ে এটা দিয়েছে।

আসমার চিঠিটা নিয়ে বলল, তুমি বস, আমি আসছি। তারপর যাওয়ার সময় সামসুকে বলল, চাচা, একে নাস্তা দাও। উপরে নিজের রুমে এসে চিঠি পড়তে লাগল–

সই,

সালামান্তে আন্তরিক ভালোবাসা নিস। আশা করি, আল্লাহর রহমতে ভালো আছিস। কামনাও তাই। তারই কৃপায় আমিও ভালো আছি। পরে জানাই যে, আব্বা আমার ও দাইহানের সম্পর্কের কথা জেনে গিয়ে একদিন আমাকে খুব রাগারাগি করে। তারপর গোপনে গুপিনাথপুরে বিয়ের ব্যবস্থা করেছে। কিছু দিন আগে ঐ পাত্র দেখতে এসে অনেক কিছু দাবি করেছিল বলে আব্বা, রাজি হয়নি। এখন তাদের সব। দাবি মেনে নিয়েছে। তুই তো জানিস দাইহান ভাইয়ার বন্ধু। আর ভাইয়া যে আমাকে কত ভালবাসে তাও জানিস। তাই অনেক সময় আমাদের দেখা সাক্ষাৎ ভাইয়া দেখে ফেললেও কখনো কিছু বলেনি। বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেছে জেনে ভাইয়া আমাকে জিজ্ঞেস করল, আব্বা যে তোর বিয়ে ঠিক করেছে, জানিস? আমি বললাম না। তারপর ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। ভাইয়া বন্ধুর হাতে আমাকে দিতে চায়। তাই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে প্রবোধ দিতে দিতে বলল, আমি যদি আগে জানতে পারতাম, তাহলে আব্বাকে এটা করতে দিতাম না। আমাকে যখন আব্বা জানাল তখন অনেক কিছু সুবিধা অসুবিধার কথা বলে বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে দাইহানের সঙ্গে বিয়ে দিতে বললাম। শুনে আব্বা ভাইয়াকে খুব রাগারাগি করে বলল, তুই মূর্খ। লেখাপড়া না করে একটা গাধা হয়েছিস। নচেৎ নিজের শিক্ষিত বোনকে একটা মূর্খ কামলার সাথে বিয়ে দিতে চাইতিস না। বংশের মান ইজ্জতের জ্ঞান ও তোর। নেই। যদি থাকত, তাহলে তুই কামলার পুত কামলার সঙ্গে বন্ধুত্বও করতিস না। তাকে আমার সীমানায় আসতে নিষেধ করে দিস। কামলার পুতের এতবড় সাহস, আমার মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। এ ব্যাপারে যদি আর একটা কথা বলিস, তাহলে তোকে ত্যাজ্যপুত্র করব। এই পর্যন্ত বলে ভাইয়া চোখ মুছে বলল, আমি তোদের জন্য বোধহয় কিছুই করতে পারব না। হঠাৎ তোর কথা মনে পড়ল, ভাবলাম, আমার বিপদের কথা শুনে তুই নিশ্চয় সাহায্য করবি। তাই এই চিঠি লিখে ভাইয়াকে পাঠালাম। তুই তো জানিস, দাইহানকে ছাড়া আমি বাঁচব না। অন্য জায়গায় বিয়ে। হওয়ার আগে বিষ খাব। আমি আত্মঘাতী হব, এটা সই হয়ে নিশ্চয় চাইবি না। তাই যা কিছু করার একটু তাড়াতাড়ি করিস। একজন আত্মঘাতাঁকে বাঁচালে আল্লাহ নিশ্চয়। তোকে সুখী করবেন। আমি ক্রমশ মনের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছি। কি লিখলাম না লিখলাম বুঝতে পারছি না। ভাইয়ার হাতে যা হোক কিছু দু’লাইন লিখে দিস। জীবনে তোর সাথে আর দেখা হবে কিনা আল্লাহ মালুম। আর কলম চলছে না আল্লাহ হাফেজ।

ইতি
তোর প্রাণপ্রিয় সই
আসমা।

চিঠি পড়ে রুকসানা অনেকক্ষণ চুপ করে বসে চিন্তা করল, কিভাবে আসমাকে বাঁচাবে। কিন্তু কোনো কিছুই মাথায় এলনা। হঠাৎ মনে হল, আব্বাকে জানালে কেমন হয়? আসমাকে ভালোভাবেই চিনে। নিশ্চয় কিছু একটা ব্যবস্থা করবে। চিঠিটা হাতে নিয়ে আব্বার ঘরে গেল।

আব্দুল মতিন স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। মেয়েকে দেখে বললেন, আয় বস।

রুকসানা আব্বার পাশে বসে বলল, একটা ব্যাপারে তোমার কাছে পরামর্শ নিতে এসেছি শুনে রেগে যাবে না বল?

প্রথম সন্তান বলে আব্দুল মতিন রুকসানাকে অন্য ছেলেমেয়েদের চেয়ে একটু বেশি ভালোবাসেন। অবশ্য সব মা বাবাই তা করে থাকেন। আব্দুল মতিন মৃদু হেসে বললেন, পরামর্শ চাইবি এতে রাগ করব কেন? তাছাড়া আমি বা তোর মা। কোনোদিন তোকে রাগারাগি করেছি?

রুকসানা মা-বাবা দুজনকেই উদ্দেশ্য করে বলল, আমার সই আসমার কথা তোমাদের মনে আছে?

আজিজা বেগম বললেন, মনে থাকবে না কেন? সে তো অনেকবার তোর সঙ্গে এসেছে। পরীক্ষার কয়েকদিন আগে এসে আমাদেরকে সালাম করে দোয়া নিয়ে গেল।

স্ত্রী থেমে যেতে আব্দুল মতিন বললেন, আমারও মনে আছে, দক্ষিণ ফুকরার কৃপন গেঁদু মুন্সীর মেয়ে তো?

রুকসানা বলল, হ্যাঁ আব্বা।

আব্দুল মতিন বললেন, পরামর্শ নিতে এসে তার কথা বলছিস কেন?

রুকসানা বলল, সে একটা চিঠি পাঠিয়েছে। পড়ে শোনাচ্ছি। শোনার পর তোমরা পরামর্শ দেবে। তারপর চিঠিটা পড়ে শোনাল।

পড়া শেষ হওয়ার পর আব্দুল মতিন ও আজিজা বেগম অনেক্ষণ চুপ করে রইলেন।

রুকসানা বলল, তোমরা কিছু বলছ না কেন?

আব্দুল মতিন সোফায় হেলান দিয়ে বসেছিলেন। সোজা হয়ে বসে বললেন, আজকালের ছেলেমেয়েরা বড় হওয়ার আগেই এমন কিছু ছেলেমানুষি কাজ করে ফেলে, যা তাদের করা মোটেই উচিত নয়।

কিন্তু আব্বা ছোটরাই তো ছেলেমানুষি করে। তাছাড়া বড়রাও অনেক সময় ভুল করে থাকে।

তোর কথা অস্বীকার করব না, তবে কি জানিস মা, বড়রা যা ভুল করে, তা সংশোধনের চেষ্টাও তারা করে। কিন্তু অপ্রাপ্তবয়স্করা তাদের ভুল যেমন স্বীকার করে না, তেমনি সংশোধন করার কথা মানতেই চায় না।

তা হয়তো ঠিক। এখন আমি কিভাবে আমার সইকে বাঁচাব তার পরামর্শ দাও।

খুব চিন্তায় ফেলে দিলি মা, ভেবে চিন্তে দেখি কি করা যায়। আচ্ছা, চিঠিটা তুই পেলি কি করে? ডাকে এসেছে?

না, আসমা তার ভাইয়ার হাতে পাঠিয়েছে। তার হাতে দুলাইন লিখে দিতেও বলেছে। তাই নিচে বসিয়ে রেখেছি।

তার ভাইয়াকে তুই চিনিস?

হ্যাঁ।

গেঁদু মুন্সীর ছেলেমেয়ে কটা?

এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে বড়।

তাকে নাস্তা দিতে কাউকে বলেছিস?

হ্যাঁ সামসু চাচাকে বলেছি।

আব্দুল মতিন চিন্তা করলেন কিছু একটা করা উচিত। নচেৎ চিঠিটা যেভাবে লিখেছে, যদি সত্যি সত্যি আত্মহত্যা করে বসে? বললেন, চলতো তার সঙ্গে কথা। বলে দেখি।

শাকিল আব্বার মুখে বাহিরবাগ গ্রামের চৌধুরীদের পূর্বপুরুষদের দূর-দবার কথা অনেক শুনেছিল। জমিদারী চলে গেলেও এখনো তাদের প্রতিপত্তি যে কমেনি তাও। শুনেছে, আব্দুল মতিন চৌধুরী যে দশ গ্রামের বিচার আচার করেন তাও জানে। নাস্তা খেয়ে ঘরের দামি দামি আসবাবপত্র দেখছিল। রুকসানার সঙ্গে একজন লোককে আসতে দেখে অনুমান করল, নিশ্চয় ওর আব্বা আব্দুল মতিন চৌধুরী। দাঁড়িয়ে সালাম দিল।

আব্দুল মতিন সালামের উত্তর দিয়ে বসতে বলে নিজেও বসলেন। তারপর বললেন, আমি রুকসানার আব্বা, ওর মুখে তোমার পরিচয় পেয়েছি। তুমি কতদূর। লেখাপড়া করেছ?

শাকিল লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে বলল, প্রাইমারী পর্যন্ত পড়ে আর পড়িনি। আমার মাথা মোটা, তাই আব্বাও পড়ায় নি।

বড় ভাই হয়ে ছোটবোনের অন্যায়কে প্রশ্রয় দিলে কেন?

শাকিল উত্তর দিতে না পেরে চুপ করে রইল।

তোমার বন্ধুর কি নাম যেন?

দাইহান। সে কতদূর লেখাপড়া করেছে?

সেও প্রাইমারী পর্যন্ত পড়েছে।

তোমাদের বন্ধুত্ব কতদিনের?

ছোট বেলা থেকে।

দাইহান কার ছেলে?

ফজল শেখের।

তার অবস্থা কেমন?

ভালো না। জমি জায়গা অল্প।

তোমার আব্বা তো ঠিক কথা বলেছেন, দাইহান তোমার বন্ধু হতে পারে, তাই বলে জেনে শুনে নিজের শিক্ষিত বোনকে একটা অল্প শিক্ষিত গরিব ছেলের সঙ্গে তুমি বিয়ে দিতে চাও কেন? তা ছাড়া তোমার বাবার অবস্থা ভালো। তার মান সম্মান আছে।

শাকিল বলল, আমি ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত বুঝি না। আমার একটাই বোন। তাকে খুব ভালোবাসি। সে যাকে পেয়ে সুখী হতে চায়, তার হাতেই দিতে চাই। আর দাইহান গরিব অশিক্ষিত হলেও তার মতো ভালো ছেলে আমি দেখিনি। তাছাড়া আব্বার সম্পত্তি অনেক। আব্বা অন্য ছেলেকে যা কিছু দিতে চাচ্ছে, তা দাইহানকে দিলে সে আর গরিব থাকবে না।

আব্দুল মতিন বুঝতে পারলেন শাকিলের সত্যি মাথা মোটা, আর খুব সহজ সরল। বললেন, কিন্তু তোমার আব্বা তো দাইহানকে পছন্দ করেন না। মা-বাবারা ছেলে মেয়েদের ভালো চান। তোমার আব্বার কথা তোমাদের মেনে নেয়াই তো উচিত।

উচিত অনুচিত বোঝার জ্ঞান থাকলে আপনাদের কাছে আসতাম না। তারপর উঠে এসে আব্দুল মতিন চৌধুরীর পায়ে হাত দিয়ে বলল, আপনি আমার বোনকে বাঁচান। তার কিছু হলে আমি সহ্য করতে পারব না।

আব্দুল মতিন তার হাত ধরে তুলে বসতে বলে বললেন, আসমা আমার মেয়ের সই। তাকে আমিও মেয়ের মতো মনে করি। তুমি এখন যাও। আমি কাল তোমার আব্বার সঙ্গে দেখা করব।

শাকিল সালাম বিনিময় করে চলে এল। ঘরে এসে আসমাকে সব কথা জানিয়ে বলল, চিন্তা করিস না। আমার মনে হয়, চৌধুরী হুজুর আব্বাকে রাজি করাতে পারবেন।

পরের দিন আব্দুল মতিন দক্ষিণ ফুকরায় গিয়ে গেঁদু মুন্সীকে কি বলেছিলেন তা রুকসানা জানে না। ফিরে এসে শুধু বলেছিলেন, এমন ব্যবস্থা করে এসেছি গেঁদু মুন্সী গুপিনাথপুরের সম্বন্ধ ভেঙ্গে দিয়ে দাইহানকে জামাই করতে রাজি হয়েছে।

মাস খানেক পরে গেঁদু মুন্সী নিজে এসে আব্বাকে দাইহানের সঙ্গে মেয়ের বিয়ের দাওয়াত দিয়ে গিয়েছিলেন। আমাকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে বলেছিলেন। আব্বা নিয়েও গিয়েছিলেন। এক সময় আসমাকে জিজ্ঞেস করলাম, আব্বা এসে তোর আব্বাকে কি করে রাজি করাল বলতো।

আসমা বলল, আমি জানিনি। ভাইয়া বলল, চৌধুরী চাচা খুব নামি দামি লোক। উনি যা যা বললেন আব্বা সব মেনে নিলেন।

রুকসানা চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে এইসব ভাবছিল। এমন সময় রাবেয়া এসে তাকে ঐভাবে বসে থাকতে দেখে কপালে একটা হাত রেখে বলল, কিরে শরীর খারাপ লাগছে নাকি?

রুকসানার মনে হল এতক্ষণ সে স্বপ্ন দেখছিল, রাবেয়ার কথায় তা ভেঙ্গে গেল। তার হাতটা সরিয়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসে বলল, না শরীর ভালো আছে। এমনি একটু তন্দ্ৰামতো এসেছিল আর কি? তুই বস।

রাবেয়া বসে বলল, ডাক্তার নিয়ে পলাশপুর গিয়েছিলি?

হ্যাঁ গিয়েছিলাম। গিয়ে খুব বড় বিপদে পড়েছিলাম। নেহাৎ হায়াৎ ছিল বলে আল্লাহ বাঁচিয়ে দিয়েছেন।

রাবেয়া ভয়ার্তস্বরে বলল, তাই নাকি? কি হয়েছিল বলতে শুনি।

রুকসানা ষাঁড়ের ঘটনাটা বলে বলল, ঠিক সময় মতো হাসান স্যার যদি না এসে পড়তেন, তা হলে ষাঁড়টা শিং দিয়ে গুতিয়ে মেরেই ফেলত।

রাবেয়া আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, এইজন্যে লোকে বলে, “রাখে। আল্লাহ মারে কে?” তারপর বলল, কায়সারের মুখে শুনেছি, হাসান স্যার শুধু খুব ভালো টিচারই নন, এই কয়েক মাসের মধ্যে ডাক্তার হিসাবে গরিবদের মা বাপ হয়ে গেছেন। তা তোর কেমন মনে হল?

আমার দৃষ্টিতে ওঁর মতো লোক পৃথিবীতে খুব কমই আছে।

প্রশংসার মাত্রাটা একটু বেশি হয়ে গেল না?

তা জানি না। যা মনে হয়েছে তাই বললাম।

মনে হচ্ছে ভদ্রলোক তোকে বিপদ থেকে রক্ষা করে তোর মনের গহীনে ঢুকে পড়েছেন।

কি যা তা বকছিস? যা সিটে গিয়ে কাজ কর।

তা যাচ্ছি বলে রাবেয়া জিজ্ঞেস করল, আসিয়া বলল, কে একজন দাড়িওয়ালা দ্রলোক নাকি এসেছিলেন?

রুকসানা বলল, হ্যাঁ ঐ ভদ্রলোকই গতকাল বিপদ থেকে বাঁচিয়েছেন। তারপর টেবিলের উপর প্যাকেটটা দেখিয়ে বলল, আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন। তাই আঘাত পেয়েছি মনে করে ওষুধ দিতে এসেছিলেন।

তাই নাকি? তা হলে তো ভদ্রলোকের মনেও তুই ঢুকে পড়েছিস?

দেখ, বেশি বাজে কথা বলবি না বেরো এখান থেকে।

রাবেয়া যাওয়ার সময় হাসতে হাসতে বলল, দেখবি, বাজে কথাটাই একদিন সত্য হয়ে দাঁড়াবে।

রুকসানা কয়েক সেকেণ্ড তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে কাজে মন দিল।

<

Super User