মায়ানমারে রানার আজ চারদিন।

কুউউ করে হুইসেল বাজিয়ে ছুটে চলেছে মান্দালয় এক্সপ্রেস। ঘুম ভাঙার পর চোখ মেলে রানা দেখল কমপার্টমেন্টে আলো জ্বলছে। তাড়াতাড়ি হাতঘড়িতে চোখ বুলাল। সাড়ে পাঁচটা।

 তারমানে আর মাত্র আধঘণ্টা পর থাজিতে পৌঁছাবে ওরা। স্লিপারের নীচ থেকে ক্রল করে বেরিয়ে এল রানা, সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙল।

চোখ বুজে বিছানায় শুয়ে রয়েছে নন্দিনী। হাত বাড়িয়ে তার কাঁধ ধরে মৃদু ধাক্কা দিল রানা। সঙ্গে সঙ্গে চোখ মেলল সে।

ভোর, বিড় বিড় করল রানা।

গুড মর্নিং। হাই তুলল নন্দিনী, হাত দুটো মাথার উপর তুলল। কটা বাজে?

সাড়ে পাঁচ। শোনো, আমার কমপার্টমেন্ট থেকে সুটকেস আনতে হবে। মানে, যদি এখনও ওখানে থাকে আর কী। আমি ফেরা মাত্র করিডরে বেরিয়ে যাবে তুমি, পোর্টারকে জিজ্ঞেস করবে ট্রেন কখন থাজিতে পৌঁছাবে। ঠিক আছে?

মাথা ঝাঁকাল নন্দিনী। আমি তা হলে এখনই কাপড় পরে নিই।

দরজার দিকে এগোল রানা।

পিছন থেকে নন্দিনী বলল, সাবধানে কিন্তু।

 স্লাইডিং ডোর টেনে সামান্য একটু খুলল রানা। তারপর ধীরে। ধীরে মাথাটা বাইরে বের করল। পোর্টার যাই বলে যাক, করিডরে কোন সৈনিক বা কারবাইনের ছায়া পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। সাবধানে বেরিয়ে এল ও, নিঃশব্দ পায়ে এগোচ্ছে।

কোন বাধা ছাড়াই পৌঁছে গেল নিজের কমপার্টমেন্টের সামনে। টেনে স্লাইডিং ডোর খুলল, ভিতরে একবার তাকাল, পরমুহূর্তে প্রচণ্ড শক্তিতে একটা ফ্লাইং কিক মারল। সৈনিকটার হাত থেকে ছিটকে পড়ল কারবাইন, জোরাল ধাতব শব্দ হলো মেঝেতে। গুঙিয়ে উঠে কুঁজো হলো লোকটা, হারানো অস্ত্রটা কুড়ানোর চেষ্টা করছে।

এই কাজ কেউ করে না, ভাবল রানা।

যেই লোকটা সামনের দিকে ঝুঁকেছে, মেঝেতে পড়ে থাকা কারবাইনটার নাগাল পেতে যাচ্ছে, ভাঁজ করা হাঁটু দিয়ে তার পাঁজরে গুঁতো মারল রানা।

নিশ্চয় কিডনিটা ফাটিয়ে দিয়েছে। কারণ মুখ থুবড়ে পড়ার। পর উঠতে পারছে না সে, মেঝেতে ক্রল করে দূরে সরে যাবার। চেষ্টা করছে। পরমুহূর্তে রানা বুঝল, লোকটা পাকা অভিনেতা। গুরুতর আহত, এরকম একটা ভান করে কোমর থেকে ছুরিটা টেনে নিল সে, তারপর ছেড়ে দেওয়া প্রিঙের মত লাফ দিয়ে। সিধে হলো, এক পাশ থেকে ফলাটা চালিয়ে দিয়েছে রানার গলা লক্ষ্য করে।

তৈরিই ছিল রানা। ঝপ করে বসে পড়ে হামলাটা এড়াল। ছুরির ফলা ওর মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। মেঝেতে বসেই গায়ের জোরে লাথি মারল লোকটার উরুসন্ধিতে। ও চাইছে-জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকুক, তা হলে আর মেরে ফেলতে হয় না।

প্রায় উড়ে গেল লোকটা। স্লিপারের পাশের দেয়ালে মাথাটা খুব জোরে ঠুকে গেছে। অঁক-অঁক শব্দ করে বমি করল সে, তারপর জ্ঞান হারিয়ে অসাড় হয়ে গেল।

নিজের লাগেজ নিয়ে করিডরে বেরিয়ে এল রানা। কারও চোখে ধরা না পড়ে নন্দিনীর কমপার্টমেন্টেও ফিরে এল। সুটকেসটা হালকা লাগছে না, তারমানে ফলস বটমে রাখা জিনিসগুলোয় কারও হাত পড়েনি।

করিডরে বেরিয়ে পোর্টারের সঙ্গে কথা বলব? ফিসফিস করে জানতে চাইল নন্দিনী।

মাথা ঝাঁকাল রানা।

পাঁচ মিনিট পরই ফিরে এল নন্দিনী। বলতে হয়নি, যাবার সময় বাইরে থেকে দরজায় তালা দিয়ে গিয়েছিল। বলল থাজিতে ছটা দশে পৌঁছাবে ট্রেন। ভালো না খারাপ?

খারাপ নয়, বলল রানা। তবে ঝুঁকি প্রচুর। তুমি নিশ্চিত-মানে, পারবে? বলতে চাইছি, আমার সঙ্গে এভাবে জড়াচ্ছ। নিজেকে, পরে আবার পস্তাবে না তো? তুমি ফ্রি ল্যান্সার, স্বাধীন এজেন্ট। তোমাকে আমি কোন কাজে বাধ্য করতে পারি না।

একবার তো বলেছি-আছি আমি তোমার সঙ্গে, জবাব দিল নন্দিনী, কণ্ঠস্বরে দৃঢ়তার কোন অভাব নেই। একবার কাউকে কথা দিলে সেটা আমি রাখতে চেষ্টা করি। নিজেকে তুমি নির্দোষ বলেছ, মনে আছে তো?

তারমানে তুমি আমাকে বিশ্বাস করছ?

বিশ্বাস না করলে সাহায্য করতে রাজি হব কেন!

হাতঘড়ি দেখল রানা। যাবার সময় হয়েছে। আবার দেখা না হওয়া পর্যন্ত-গুডবাই, মিস অপরূপা।

স্থির দাঁড়িয়ে থাকল নন্দিনী, আড়ষ্ট আর ঋজু; চিবুক উঁচু করা, চোখে-মুখে গাম্ভীর্য। তার কপাল থেকে এক গোছা চুল সরাল রানা, চুমো খেল চোখে, তারপর ঠোঁটেও, সবশেষে পিছিয়ে এল।

 প্লিজ, ফিসফিস করে বলল মেয়েটা। একটাই অনুরোধ: শুধু…শুধু আহত হয়ো না তুমি।

যথাসাধ্য চেষ্টা করব। নিজের সুটকেস নন্দিনীর কাছে রেখে তার কমপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে এল রানা, উঁকি দিয়ে আগেই দেখে নিয়েছে করিডরে কেউ নেই।

পুলম্যান কার-এর একেবারে শেষ মাথায় টয়লেটটা। ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল রানা। মেঝের গোলাকার গর্তের নীচে আড়াআড়িভাবে ফেলা কাঠগুলোকে ছুটে যেতে দেখল ও, দেখল। রেললাইন থেকে আগুনের ফুলকি ছুটছে। ট্রেনের স্পিড এখনও। কমছে না, যদিও থাজি ডিপোয় পৌছাতে আর বোধহয় দশ। মিনিটও লাগবে না।

টেনে গরাদহীন জানালার কাঁচ নীচে নামাল রানা। ধুলো আর মাকড়সার জাল জমেছে জানালার ভিতর দিকের কারনিসে, ওই। জায়গাটার কিনারায় উঠল রানা, তৈরি হয়ে বসে থাকল-দুই হাতে শক্ত করে জানালার ফ্রেম ধরে আছে, হাঁটু দুটো সেঁটে আছে বুকের। সঙ্গে। ক্রমশ বাঁকা নিষ্প্রভ সবুজ দিগন্তরেখা, ওঠানামা করছে। কিছুক্ষণ পর পর সোনালি গম্বুজ নিয়ে একটা করে বৌদ্ধমন্দিরকে পিছনে ফেলে আসছে ট্রেন। ভোর হচ্ছে দেখে কোথায় বহুদূরে একটা মোরগ বাঁক দিল। ভোরের আলো ভালো করে ফুটতে দেরি করছে, কারণ হালকা কুয়াশায় খেত আর পুকুর-ডোবা ঢাকা পড়ে আছে। সব মিলিয়ে একটা পিকচার-পোস্টকার্ড, একটা আকাক্ষা-ইস, কী ভালোই না হত এখানে যদি কটা দিন বেড়াতে পারতাম।

থাজি! থাজি! বন্ধ দরজার বাইরে পোর্টার চেঁচিয়ে উঠল।

জানালা দিয়ে আবার বাইরে তাকাল রানা। ধীরে ধীরে ট্রেনের গতি কমে আসছে। এইবার, রানা! এখন তোমার ছোট একটা পরীক্ষা। হয়তো কিছুই ঘটবে না, লাফ দিয়ে সরাসরি নরম মাটিতে পড়বে, আবার হয়তো লাফটা কায়দা মত দিতে না পারায় বা স্রেফ দুর্ভাগ্যবশত একটা পাথরে ঠুকে যাবে মাথাটা-মগজ বেরিয়ে আসবে, তবে তুমি মারা যাবে তার আগেই।

আঁটসাঁট স্প্রিঙের মত নিজেকে গুটিয়ে নিল রানা, তারপর লাফ দিল। ওর চারদিকে আকাশ আর জমিন যেন ডিগবাজি খেতে শুরু করল। ভাবছে, লাইন থেকে যদি সরে যেতে না পারি…বাঁশের তৈরি বাক্সে ভরে লাশটা শ্রীলঙ্কায় পাঠিয়ে দেবে ওরা, সেখান থেকে দেশে ফিরবে, সবাই স্মরণ করবে কত ভালো একজন লোক ছিলে তুমি।

ভালো লোকটা, সবার প্রিয় এমআরনাইন, নুড়ি পাথর ছড়ানো একটা জায়গার ঢালু কিনারায় নামল, রেললাইন থেকে মাত্র আধ হাত দূরে। তবে ওখানে থেমে থাকল না। যেভাবেই হোক শরীরটাকে গড়িয়ে দিয়েছে ও।

গড়াতে গড়াতে শুকনো একটা নালার মধ্যে এসে স্থির হলো রানা। ওর পিছনে সগর্জনে ছুটছে ট্রেন, তবে গতি কমে আসছে। শরীরের নীচে জমিন কাঁপতে শুরু করল। দশ-বারোটা পাথরকে গড়িয়ে নেমে আসতে দেখল ও। সরে যাবার সময় পেল না, একটা। পিঠে এসে লাগল। আরেকটা লাগল পায়ে। তৃতীয় পাথরটা। একটুর জন্য মাথায় লাগল না। তারপর সব স্থির আর নীরব হয়ে গেল।

ট্রেনটাও চলে গেছে। এখন শুধু পাখির কিচিরমিচির শুনতে। পাচ্ছে রানা। কিছু ভেঙেছে কিনা পরীক্ষা করে আপনমনে হাসল। পুরানো লোহা! কোথাও একটা আঁচড় পর্যন্ত লাগেনি।

এতক্ষণে নিজের চারদিকে তাকাল রানা। সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে উঠল। চারদিকে ঘন জঙ্গল ছাড়া আর কিছু দেখার নেই।

ওর সঙ্গে একটা ম্যাপ আছে ঠিকই, কিন্তু একটা রাস্তা খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত সেটা খুব একটা কাজে আসবে না।

সিধে হয়ে গায়ের ধুলো ঝাড়ল রানা, তারপর নালা থেকে উঠে এসে ম্যাপটায় একবার চোখ বুলাল। উত্তর দিকে এগোতে হবে। ওকে, মাইলখানেক হাঁটলে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে একটা সরু রাস্তার দেখা পাবে।

সাপের কথা মনে রেখে সাবধানে হাঁটছে রানা। সাপের মতই। বিপজ্জনক আরেকজনের কথা মনে পড়ে গেল ওর। রহস্যময় সেই। চতুর্থ ব্যক্তি।

এই যে এত কষ্ট করছে রানা, তার ফলও তো পাচ্ছে। আর। কিছু না হোক, চার নম্বর লোকটাকে অবশেষে ফাঁকি দিতে পেরেছে ও।

লোকটা এমনকী যদি ট্রেনেও উঠে থাকে, রানার সঙ্গে সময়ের হিসাবে হেরে গেছে সে। জাতীয় মিউজিয়ামেও বোধহয় দেরি করে ফেলাতেই সুবিধে করতে পারেনি।

ইয়াঙ্গুনকে রানার মনে হচ্ছে তিনশো মাইল নয়, তিন হাজার মাইল দূরে।

আরেকবার ম্যাপ দেখল রানা। উত্তর-পশ্চিমে লম্বা যে রাস্তাটাকে মেজর হাইওয়ে বলা হচ্ছে, ওটা ধরে থাজি থেকে মেকটিলা যাবে, তারপর ইরাবতী পর হয়ে বিচ্ছিন্ন, খুদে একটা গ্রাম পেগানে পৌঁছাবে।

বিশ মিনিট হাঁটার পর ঝোপগুলো হালকা হয়ে এল, জঙ্গলও এখন আর তেমন ঘন মনে হচ্ছে না। তারপর একটা মেটো রাস্তায় উঠে এল রানা, তবে এটাই খুঁজছে কিনা আরেকবার ম্যাপ না দেখে বলা সম্ভব নয়।

সবজি ভর্তি একটা ট্রাক ধুলোর মেঘ উড়িয়ে ছুটে গেল উত্তর দিকে। ম্যাপ খুলে আরেকবার দেখল রানা। ট্রাকটার পিছু নিলে, অর্থাৎ ডানে এগোলে আরেকটা রাস্তা পাবে ও। ওই রাস্তাতেই ওর সঙ্গে দেখা করার কথা নন্দিনীর। তার সঙ্গে কথা হয়েছে, থাজি থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করবে সে, তারপর সেটাকে মেকটিলার দিকে ছোটাবে, মাঝপথ থেকে তুলে নেবে ওকে। ওখান থেকে। পেগান পর্যন্ত যাবে ওরা, তারপর নিজের জন্য আলাদা একটা গাড়ির ব্যবস্থা করবে রানা, মায়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে পৌছানোর জন্য।

মায়ানমারের রাজধানী যে এখন নিরাপদ জায়গা নয়, এটা পরিষ্কার। কালো নকশা কোথায় আছে, দেরিতে হলেও এ তথ্য। আগ্রহী ইন্টেলিজেন্সগুলো এতক্ষণে পেয়ে গেছে। তারমানে মায়ানমারে পিল পিল করে স্পাই ঢুকতে শুরু করেছে। কাজেই ইয়াঙ্গুন হয়ে চিনে যাবার আইডিয়াটা বাতিল করে দিয়েছে রানা। তবে মাইক্রোফিল্মটা সরাসরি চিনা সিক্রেট সার্ভিসের হাতে তুলে দিতে হবে, সম্ভব হলে চিফ লিউ ফুঁ চুঙের হাতে। দেশে পৌঁছে জরুরি মেসেজ পাঠিয়ে প্রিয় বন্ধুকে ঢাকায় ডেকে পাঠাতে পারে। রানা।

দালিয়াকে নিয়েও কোন চিন্তা নেই রানার। আপাতত কিছুদিন সেফ হাউসেই থাকবে সে, তারপর তার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তাভাবনা করা যাবে। সেটা যে অসম্ভব উজ্জ্বল, তাতে আর সন্দেহ কী। কর্তৃপক্ষ খুব ভালো করেই উপলব্ধি করবে যে জিজিয়ানা দালিয়ানের দেশপ্রেম চিনকে কত বড় বিপদ থেকে বাঁচিয়ে। দিয়েছে।

অবশ্যই তার প্রতিদান পাবে দালিয়া। হয়তো তথ্য মন্ত্রণালয়ের বড় কোন পদ দেওয়া হবে তাকে। যে পদ পেলে। আমেরিকানরাও তার গায়ে হাত দেওয়ার কথা ভাবতে সাহস পাবে না।

ডান দিকে হাঁটছে রানা। ওর রোলেক্সের সঙ্গে একটা কম্পাস। আছে, সেটা দেখে উত্তর দিক চিনতে পারছে ও। মেটো হলেও, বেশ চওড়া রাস্তা, এক ধার ঘেঁষে এগোচ্ছে ও। তবে ওই একটাই ট্রাক গেছে, আর কোন গাড়ি বা লোকজন চোখে পড়ছে না।

 সূর্য ধীরে ধীরে উপরে উঠছে। বহুদূর থেকে ঢংঢং করে ঘণ্টা। পড়ল। এরকম মাঝে মধ্যেই শুনতে পাচ্ছে রানা। বোধহয় মন্দির থেকে আসছে।

পাত্তা না দিলেও কত রকমের ভয় জাগে মনে।

নন্দিনী যদি না আসে, খুব খারাপ অবস্থায় পড়ে যাবে ও। না, সেরকম কিছু ঘটবে না। মেয়েটা তাকে সাহাযয করেছে, কাজেই শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করার কোন মানে হয় না।

আচ্ছা, এ কেমন রাস্তা যে একটা গরুর গাড়িও চলে না?

নন্দিনী ঠিকই ওর জন্য অপেক্ষা করবে, নিজেকে বারবার আশ্বস্ত করছে রানা।

পুলিশ নিয়ে?

আরে নাহ!

ধ্যেত, তার কথা আর আমি ভাববই না।

চৌরাস্তায় পৌছাল রানা, ট্রেন থেকে পালাবার দুই ঘণ্টা পর। ধুলোয় প্রায় সাদা হয়ে গেছে কাপড়চোপড়। তার উপর দরদর করে ঘামছে। দেখে মনে হচ্ছে একটা ভূত, ভয় না পাবার কোন কারণ নেই। কিন্তু নন্দিনী অপরূপার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। পুরানো আর তোবড়ানো একটা জিপের ব্যাকসিটে বসে আছে সে। চোখাচোখি হতেই লাফ দিয়ে নেমে এল জিপ থেকে, ঠিকই চিনতে পেরেছে।

রানার দিকে ছুটে আসছে নন্দিনী, চেঁচাচ্ছে। সম্ভব, সত্যি তুমি অসম্ভব! চিন্তায় আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম না কী করব, কী ভাবব…

পানি আছে? ফিসফিস করল রানা, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।

মাথা ঝাঁকাল নন্দিনী। আমরা একটা ক্যানটিন এনেছি।

আমরা?

লবুয়াং লোবু আর আমি। আমাদের ড্রাইভার। গোটা থাজি খুঁজে ওকেই শুধু পেলাম, যে পেগান পর্যন্ত যেতে রাজি হয়েছে। নিজের হাতটাকে হুক বানিয়ে রানার একটা হাত আটকে নিল নন্দিনী, জিপের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ওকে।

ব্যাকসিটে বসে ক্যানটিন থেকে সরাসরি পানি খেল রানা। কৃতজ্ঞ বোধ করল ও। ধন্যবাদ দিল। কিন্তু নন্দিনী একনাগাড়ে বকে চলেছে, ধন্যবাদ গ্রহণ করার সময় কোথায় তার। মায়ানমারের মফস্বলে ড্রাইভার যোগাড় করা আর বাঘের দুধ। পাওয়া, একই কথা। আবার নিজের গাড়ি আছে, এমন ড্রাইভার পাওয়া তো আরও কঠিন।

আপনারা রেডি? লবুয়াং লোবু জানতে চাইল। গাড়ি। ছাড়ব?

লোকটা পিছন ফিরে ওদের দিকে তাকাল। ত্রিশ-বত্রিশ বছর বয়স হবে, ঘন ভুরু যেন ঝুলে আছে চোখের উপর। একটা চোখে তারা বলে কিছু নেই, সম্পূর্ণটাই দুধের মত ঘোলা আর মাত্র। অর্ধেকটা খোলে, দুই কান পর্যন্ত বিস্তৃত হাসি থাকলেও, ওই চোখের কারণে নিষ্ঠুর আর নীচ বলে মনে হচ্ছে তাকে। প্রকৃতি কারও কারও বেলায় অবিচার করে বটে; এই লোকটা হয়তো সেই অবিচারের শিকার। উই গো নাও, হোকে? আবার জিজ্ঞেস করল সে।

হোকে, বলল রানা। ওর উচ্চারণ শুনে হেসে উঠল নন্দিনী। শুধু হাসল না, রানার গায়ের সঙ্গে সেঁটে এল সে; হাবভাব দেখে। মনে হচ্ছে ফুর্তি যেন ধরে না। ব্যাগেজ কারের দরজায় দাঁড়ানো মেয়েটার ছবি ভেসে উঠল রানার চোখের সামনে, অবিশ্বাস আর। বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে আছে চোখ জোড়া-সেই মেয়ে আর এই মেয়ে, পরিবর্তনটা নাটকীয়ই বলতে হবে।

সিটে হেলান দিয়ে আপনমনে মিটিমিটি হাসল রানা। ইগনিশনে চাবি ঘোরাল লোবু, ইমার্জেন্সি ব্রেক রিলিজ করল, তারপর পা রাখল গ্যাস পেডালে। রওনা হয়ে গেল ওরা।

নন্দিনীর দিকে ফিরল রানা, জানতে চাইল, এবার বলো। থাজিতে ট্রেন থেকে নামার পর কী ঘটল?

তুমি কল্পনাও করতে পারবে না কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম, প্রবল উৎসাহে শুরু করল নন্দিনী। প্লাটফর্মে সশস্ত্র সৈনিকরা মহড়া দিচ্ছে। সারি সারি জিপ দাঁড়িয়ে আছে। ভাগ্য ভালো যে তারা আমার ব্যাগ চেক করেনি-আমি আসলে সেই কাস্টমস অফিসারকে ধরি, ওই যে, যাকে সিগারেট ঘুষ দিয়েছিলাম। সেই আমাকে ঝামেলা থেকে বাঁচায়। ঘাড় ফিরিয়ে নিজেদের সুটকেসগুলো একবার দেখে নিল সে। তোমার ব্যাগ ওরা না খোলায় আমরা কী ভাগ্যবান?

ভাগ্যবান? ভুরু কেঁচকাল রানা। ওর বুঝতে ভুল না হলে, মেয়েটার এখনও ধারণা চিনাদের কালেকশান থেকে কিছু চুরি করেছে ও।

আমি কি বলতে চাইছি তুমি জানো, বলল নন্দিনী।

না, সত্যি বলছি, জানি না। আমার ব্যাগে কাপড়চোপড় ছাড়া আর কিছু নেই, জবাব দিল রানা। তবে তুমি একজন পুরুষের ওয়ার্ডোব নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ দেখলে তাজ্জব হয়ে যেত ওরা।

নার্ভাস ভঙ্গিতে একটু হাসল নন্দিনী।

তুমি এখনও আমাকে একজন ক্রিমিন্যাল বলে মনে করো, তাই না, নন্দিনী?

না, কে বলল। সুটকেসটার কথা জিজ্ঞেস করেছি বলেই তুমি ধরে নেবে…

ঠিক আছে, এ প্রসঙ্গ বাদ দাও, নন্দিনী। তুমি পৌঁছেছ, এটাই আসল কথা। আমি সত্যি কৃতজ্ঞ।

ধন্যবাদ। রানার চোখের দিকে তাকাচ্ছে না নন্দিনী। তবে গাড়ি সহ একজন ড্রাইভার পাওয়া, একা একটা মেয়ের পক্ষে, মোটেও সহজ কাজ ছিল না। থাজির বেশিরভাগ লোক ঘোড়ার গাড়ি চড়ে। লবুয়াং লোবুকে পাবার আগে চার জায়গায় ঢুঁ মারতে হয়েছে আমাকে।

ড্রাইভারের দিকে তাকাল রানা। নাক বরাবর সোজা তাকিয়ে। আছে লোকটা, দুটো হাতই হুইলে। ও কি ইংরেজি জানে? গলা খাদে নামিয়ে জানতে চাইল রানা।

বেশি না, জবাব দিল নন্দিনী। তারপর হাসতে লাগল। ওর সামনে কথা বলতে বাধা নেই তোমার। রানার কাঁধে মাথা রাখল সে। আমাকে দেখে খুশি হয়েছ?

অসম্ভব।

আমি সুখী। রানার কাঁধে আর গলায় মুখ ঘষল নন্দিনী। আমি শুধু নিজের কথাই বলে যাচ্ছি, জানতে চাইছি না তোমার সময়টা কীভাবে কাটল। 

সব ঠিকঠাক মতই ঘটেছে। লাফ দিয়ে রেললাইন থেকে দূরে। পড়াটাই ছিল সবচেয়ে কঠিন। তবে ও-সব এখন থাক। সামনের দিকে ঝুঁকে লবুয়াং লোবুর কাঁধে টোকা দিল রানা। রিয়ারভিউ মিররে ধরা পড়ে গেছে লোকটা-বারবার ওর দিকে তাকাচ্ছে। পেগানে পৌছাতে কতক্ষণ লাগবে বলতে পারো?

ভালো ইংলিশ স্পিকিং আমার হয় না, সার।

প্রশ্নটা এরপর বার্মিজ ভাষায় করল রানা। সঙ্গে সঙ্গে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করা চওড়া হাসি দেখা গেল লোবুর মুখে।

হয়তো আরও সাত ঘণ্টার মত, সার। এক চোখ দিয়ে। রিয়ারভিউ মিররে তাকিয়ে আছে লোবু।

ধন্যবাদ। লোবু চোখটা সরিয়ে নিতে সিটে হেলান দিল রানা, তারপর পেশিতে ঢিল দেওয়ার চেষ্টা করল। কী কারণে বলা। মুশকিল, স্নায়ুতে টান অনুভব করছে ও।

রাস্তার ধারে, চুলো থেকে উঠে আসা ধোঁয়া দেখতে পাচ্ছে রানা। ঘরগুলো বস্তির অংশ বলে মনে হলো-বাঁশ আর দরমার। তৈরি কুঁড়ে।

তুমি কিন্তু এখনও আমাকে বলোনি পেগানে পৌছানোর পর কী করবে তুমি।

নন্দিনীর দিকে তাকাল রানা। দেখি লোবুকে পটাতে পারি কিনা। সে যদি সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দেয়, সবচেয়ে খুশি হই।

সীমান্ত মানে-ইন্ডিয়া?

মাথা নাড়ল রানা। ইন্ডিয়ার চেয়ে বাংলাদেশ কিছুটা কাছে। পেগান থেকে সীমান্তে পৌছাতে হলে কয়েকশো মাইল পাহাড়ী এলাকা পেরুতে হবে। ক্লান্তিকর জার্নি। সীমান্তে একটু ঝুঁকিও আছে-দুই পক্ষই যার যার এলাকায় টহল দিচ্ছে। কী জানি, ড্রাইভার রাজি হবে কিনা। তার অবশ্য সীমান্ত না পেরুলেও চলবে। রাজাউন পাড়া হয়ে ফকিরা বাজার পর্যন্ত গেলেই হবে, ওখান থেকে চট্টগ্রামের গর্জনিয়া বা মোনাইচারা চলে যাব আমি।

একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল নন্দিনী। বলছ তুমি নাকি নির্দোষ, অথচ এখনও পালিয়ে বেড়াচ্ছ। কিছু মনে করলে করবে, কিন্তু কথাটা না বলেও পারছি না-চিরকাল কেউ পালিয়ে বেড়াতে পারে না, সম্ভব।

হেসে উঠল রানা। চিরকাল পালিয়ে বেড়াতে যাব কেন? আমি শুধু একটা ভুল বোঝাবুঝির কারণে মায়ানমার থেকে পালাচ্ছি-ব্যস।

ব্যস? নন্দিনী বিস্মিত। মাথাটা একটু কাত করে কৌতূহলী দৃষ্টিতে দেখছে রানাকে। তুমি মানুষটা কেমন, এখনও আমি জানতে পারিনি। বোধহয় কোনদিন জানাও হবে না।

এরপর নন্দিনী চুপচাপ হয়ে গেল, রানাও তাকে আর বিরক্ত করল না।

বিকেল সাড়ে তিনটের দিকে ইরাবতীর ঘোলাটে পানি দেখতে পেল রানা। নদীটা এদিকে যথেষ্ট চওড়া, তবে স্রোতের গতি খুব। ধীর, ওপারেই পেগান। থাজি আর মেকটিলার জঙ্গল আর ধান। খেত অনেক আগেই হারিয়ে গেছে ওদের পিছনে, তার বদলে শুরু হয়েছে শুকনো খটখটে অনুর্বর মাঠ, যতদূর দৃষ্টি যায়।

ওদিকে তাকাও, বলল নন্দিনী। উত্তেজিত দেখাচ্ছে তাকে, হাত তুলে নদীর দিকটা দেখাচ্ছে।

 দৃশ্যটা অদ্ভুত, পাঁচ হাজার পরিত্যক্ত প্রাচীন মন্দির, প্যাগোডা,। মনুমেন্ট, আর ওগুলোর ধ্বংসাবশেষ দাবার ভাঙা খুঁটির মত সাজানো। পরিবেশটায় অলৌকিক কী যেন একটা আছে, আর আছে বিষন্নতা; সময় এখানে স্থির।

আমার গা ছমছম করছে, ফিসফিস করল নন্দিনী, ওরা যেন। নিষিদ্ধ বা পবিত্র কোন এলাকায় ঢুকছে।

একা শুধু লবুয়াং লোবু নির্বিকার, দৃশ্যটা দেখে তার কোন। প্রতিক্রিয়াই হলো না। ধীরে ধীরে মোচড় নেওয়া রাস্তা ধরে সাবধানে জিপ চালিয়ে নদীর কিনারায় এসে থামল সে। এক ঝাঁক। সরু জেলে নৌকা দেখা গেল, চারদিকে আসা-যাওয়া করছে।

আশ্চর্য একটা ম্যাজিকাল জায়গা, তাই না? বিড়বিড় করল নন্দিনী। আমি এখানকার কয়েকশো ফটো আর ডজন ডজন ড্রয়িং দেখেছি। তবে নিজের চোখে দেখা সম্পূর্ণ অন্যরকম অভিজ্ঞতা। এ-সবের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমার কল্পনা করতে ইচ্ছে করছে। নয়শো বছর আগে কেমন দেখতে ছিল এই জায়গাটা, রাজা অনুরাধা কীভাবে তাঁর দেশ চালাতেন… মাথাটা এদিক-ওদিক দোলাল সে, আবেগে এতই বিহ্বল হয়ে পড়েছে যে কী বলবে বুঝতে পারছে না।

আর তারপরই, ১২৮৭ সালে কুবলাই খান এসে দখল করে নিল রাজধানী। রয়ে গেল শুধু এগুলো।

তবে এর ইতিহাস সমৃদ্ধ। সব পরিত্যক্ত হলেও, ভেঙে পড়লেও, সত্যিকার অর্থে প্রাণহীন নয়।

কথা আর না বাড়িয়ে ড্রাইভারের দিকে তাকাল রানা। এরপর কী, লোবু?

আমরা ফেরি ধরে নদী পার হব, সার, জবাব দিল ড্রাইভার, হাত তুলে ডকটা দেখাল, ওদের পার্ক করা জিপ থেকে কোন রকমে দেখা যাচ্ছে সেটা।

তারপর?

কাঁধ ঝাঁকাল ড্রাইভার, এক চোখে তাকাল রানার দিকে। তারপর আমি জানি না। পেগানে থাকার মত দুটো জায়গা আছে, তবে আপনারা কেউ আমাকে বলেননি কোনটায় যেতে হবে।

নন্দিনী, তোমার কোন প্ল্যান আছে?

কোন্ ব্যাপারে?

থাকার ব্যবস্থা, ঘুমাবার জায়গা, ব্যাখ্যা করল রানা। তোমাকে পাঁচ হপ্তা থাকতে হবে এখানে। লজিং-এর কথা সরকার কিছু জানায়নি?

মাথা নাড়ল নন্দিনী। না। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আমার নিজের। ভেবেছিলাম পৌছাবার পর যা হোক একটা কিছু করা যাবে। দেখতে দাও গাইড বুকে কী লেখা আছে। হাতব্যাগ হাতড়ে বইটা বের করল সে।

গাইড বুকের পাতা উল্টে আবার বলল, আসলেও থাকার জন্যে মাত্র দুটো জায়গা আছে। প্রথমটা বড় একটা আধুনিক হোটেল, পুরোপুরি এয়ারকন্ডিশনড-ওয়েলকাম বার্মা।

কত বড়?

আবার বইটা পড়তে হলো নন্দিনীকে। কামরার সংখ্যা ছাব্বিশ।

দ্বিতীয়টা?

গেস্ট হাউস, খ্রিস্টানরা চালায়। খরচ খুব কম।

গেস্ট হাউস সাধারণত নিরাপদও হয়, গা ঢাকা দিয়ে থাকার। জন্যও ভালো। তোমার যদি আপত্তি না থাকে, গেস্ট হাউসে। উঠতে চাই আমি।

হেসে ফেলল নন্দিনী। আমিও তাই চাই।

গেস্ট হাউস? জানতে চাইল লোবু।

হ্যাঁ।

দুটো আলাদা কামরা ভাড়া করল ওরা। ড্রাইভার লোবুর একই জিদ, সে জিপে ঘুমাবে, শুধু খাবে ওদের সঙ্গে।

গেস্ট হাউসে ওরা দুজন ছাড়া আর কোন গেস্ট নেই, তা। সত্ত্বেও স্বাভাবিকভাবে নিঃশ্বাস ফেলার জন্য যে স্বস্তিটুকু না থাকলে নয়, তা-ও পাচ্ছে না রানা। স্নায়ু টান টান হয়ে আছে। কোন কারণ ছাড়া তো এমন হবে না। কিন্তু সেই কারণটা রানা খুঁজে পাচ্ছে না।

এত দূরে মিলিটারি এসে খুঁজবে ওকে, এরকম মনে হয় না। তারা জানবে কীভাবে, যে-লোকটা ব্যাগেজ কার ঘাঁটাঘাঁটি করেছিল সে এখন পেগানের গেস্ট হাউসে ঠাঁই নিয়েছে?

দ্রুত শাওয়ার সেরে ফ্রেশ হয়ে নিল রানা। কাপড় পাল্টাবার। পর নিজেকে আবার ভদ্রলোক বলে মনে হচ্ছে। নন্দিনী প্রস্তাব রাখল, দিনের আলো যেটুকুই থাকুক, নষ্ট না করে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ দেখে আসা যায়। রাজি হয়ে গেল রানা, কারণ লবুয়াং লোবুর সঙ্গে কথা বলার একটা সুযোগ দরকার ওর।

গেস্ট হাউসের ম্যানেজার রানাকে জানিয়েছে, পেগানে মাত্র দুটো জিপ ভাড়া খাটে, তবে কখনোই দূরে কোথাও যায় না ওগুলো।

কাজেই রানা ভাবছে লোবু যেহেতু সেই থাজি থেকে ওদের সঙ্গে রয়েছে, ওকে সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার জন্য বুঝিয়েশুনিয়ে রাজি করানো যাবে।

লোবু ওদেরকে শয়েজিগন প্যাগোডা দেখতে নিয়ে এল, ওটার প্রতি ইঞ্চি সারফেস সোনার পাত দিয়ে মোড়া। উত্তেজনা আর উল্লাসে অস্থির হয়ে ভিতরে ঢুকল নন্দিনী, লোবুর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দিয়ে বাইরে রেখে গেল রানাকে।

আমি রাজাউনপাড়া হয়ে ফকিরা বাজারে যেতে চাই, তাকে বলল রানা।

ফকিরা বাজার? সে তো বহু দূর, বলল ড্রাইভার। ওদিকের রাস্তা খুব খারাপ, সার। অত্যন্ত কষ্টকর জার্নি হবে।

সেজন্যেই তো ভালো টাকা দেব।

খালি গোড়ালি বালিতে ঘষছে ড্রাইভার, তাকিয়ে আছে নীচের দিকে। ভালো টাকা কত টাকা, সার?

তুমিই বলো।

ডলার।

বেশ।

এক হাজার মার্কিন ডলার, সার। এরচেয়ে এক পয়সা কম হলেও আমি রাজি না।

পাবে, বলল রানা। পেট্রল যোগাড় করতে সমস্যা হবে? জানতে চাইল ও।

মাথা নাড়ল লবুয়াং লোবু। জিপে অতিরিক্ত ট্যাংক আছে।

গুড। আমরা কাল সকালে রওনা হচ্ছি, লোবু। ঠিক আছে?

হোকে। বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসল লোবু।

.

মায়ানমারে রানার আজ পাঁচদিন।

ডাইনিং রুমে একা বসে ব্রেকফাস্ট সারছে রানা, সেই সঙ্গে মাথা ঘামিয়ে বের করার চেষ্টা করছে নন্দিনীর কাছ থেকে কীভাবে বিদায় চাওয়া যায়। ওর জন্য অনেক কিছু করেছে মেয়েটা, কাজেই। তাকে জানাতে হবে-ও কৃতজ্ঞ আর ঋণী। অচেনা, সম্পূর্ণ অজ্ঞাত একজন আগন্তুককে বিশ্বাস করেছে সে, তার বিপদের সঙ্গে নিজেকেও জড়িয়েছে। না, এই ব্যাপারটাকে রানা কিছুতেই হালকাভাবে নিতে পারে না।

কিন্তু ব্রেকফাস্ট খেতে টেবিলে না এলে কিছুই নন্দিনীকে। বলতে পারছে না রানা।

পেগান পুরোপুরি গ্রাম নয়, আবার পুরোপুরি শহরও নয়। এখানে ইউনিফর্ম পরা ছেলেমেয়েরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়তে যায়, আবার রাস্তার কিনারায় ধান শুকাতেও দেওয়া হয়।

হাতঘড়ি দেখল রানা। এরইমধ্যে সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। আটটার মধ্যে রওনা হতে চায় ও। লোবু জানিয়েছে রাস্তার অবস্থা খারাপ বলে সীমান্তে পৌছাতে দুদিন লেগে যাবে ওদের।

আরেক কাপ কফি ঢেলে নিল রানা। ব্যস্ত পদশব্দের আওয়াজ ভেসে এল কানে। হঠাৎ করেই দৃষ্টিপথে উদয় হলো লোবু। হাঁপিয়ে গেছে সে, কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম ফুটে আছে। দুটো হাতই টেবিলে রেখে রানার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকাল সে, একটা মাত্র চোখ প্রবল উত্তেজনায় বিস্ফারিত হয়ে আছে।

উনি ওখানে নেই, বলল সে, হাঁপানোর মাঝখানে কোন রকমে উচ্চারণ করতে পারল।

চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াল রানা। কী বলতে চাও? মিস নন্দিনী তার কামরায় নেই?

মাথা ঝাঁকিয়ে নিজের পিছন দিকটা দেখাল লোবু। ওদিকের একটা কামরায় নন্দিনীকে নিয়ে কাল রাত কাটিয়েছে রানা। প্রথমে দরজায় নক করি আমি, সাড়া না পেয়ে ভেতরে ঢুকে দেখি তিনি নেই…কামরা খালি।

হয়তো হাঁটতে বেরিয়েছে…কিংবা গেছে কোথাও, বলল রানা, ড্রাইভারকে শান্ত করতে চাইছে, সেই সঙ্গে নিজেকেও। তারপরও লোবুর পিছু নিয়ে ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে এল ও।

দরমা আর বাঁশ দিয়ে ঘেরা একটা ছোট্ট লাউঞ্জকে পাশ কাটাল ওরা। চওড়া করিডরের দুপাশে কামরাগুলো। নন্দিনীর ঘরের দরজা এখনও একটু খোলা। ঠেলে সেটা পুরোপুরি খুলে ভিতরে ঢুকল রানা, ওর ঠিক পিছনেই রয়েছে লোবু।

দৃশ্যটা ভালো লাগল না রানার।

কামরার সমস্ত কিছু এলোমেলো হয়ে আছে। বিছানার কাছের ল্যাম্পটা ফেলে দেওয়া হয়েছে মেঝেতে। ড্রেসার-এর ড্রয়ারগুলো খোলা, নন্দিনীর জিনিস-পত্র ছড়িয়ে রয়েছে সারা ঘরে। ধাতব ড্রেসারের কাছে নিঃসঙ্গ জানালাটা হাঁ করে খোলা। তারের জালটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে দেখে রানার তলপেটে কী যেন ডুবে যাবার অনুভূতি হলো-বুঝল, নন্দিনী কোথাও হাঁটতে বেরোয়নি বা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতেও যায়নি।

এর মানে কী? ভাবছে রানা। কেউ কি পিছু নিয়ে এসেছিল?

যাকে একবারও দেখেনি, অজ্ঞতাপরিচয় সেই রহস্যময় চতুর্থ ব্যক্তি আবারও ওকে বোকা বানিয়েছে? কয়েক মিনিট আগে। কামরাটা কি এরকম ছিল? লোবুকে জিজ্ঞেস করল রানা।

মাথা ঝাঁকাল লোবু৷ জী, সার।

কামরাটার এদিক-ওদিক ঘুরে ভালো করে সব দেখছে রানা। এরকম বিশৃংখলার যুক্তিসঙ্গত একটা ব্যাখ্যা পেতে চাইছে ও। কিন্তু ড্রেসারের উপর পড়ে থাকা এক টুকরো কাগজকে বাতাসে নড়তে দেখে নন্দিনীর নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তাটা লাফ দিয়ে কয়েকগুণ বেড়ে গেল। দুআঙুলে ধরে কাগজটা তুলল ও। লিপস্টিক দিয়ে মাত্র একটা লাইন লেখা হয়েছে:

মানাহা সমাধি। ওর কাছে পিস্তল আছে।

তোমার গাড়ি রেডি? জিজ্ঞেস করল রানা, ঝট করে ড্রাইভারের দিকে তাকাল।

উপর-নীচে মাথা দোলাল লোবু। সমস্যা, সার?

মিথ্যে বলার কোন কারণ নেই। সেরকমই মনে হচ্ছে, বলল। রানা, নিজের ব্যাপারে নন্দিনীকে জড়ানোয় রাগ হচ্ছে নিজের উপর।

ঠিক যা ঘটবে বলে ভয় পেয়েছিল, দেখা যাচ্ছে ওর নাকের। সামনে এরইমধ্যে তা ঘটে গেছে। পরিষ্কার বুঝতে পারছে রানা, অস্ত্রের মুখে কামরা থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। নন্দিনীকে। সন্দেহ নেই মাইক্রোফিল্মটা তাদের হাতে তুলে না। দেওয়া পর্যন্ত জিম্মি করে রাখা হবে তাকে। এরাই নিশ্চয় চৌ মিন, থৌ মিন আর তাদের ম্যানেজারকে খুন করেছে, মাইক্রোফিল্মটা। পাবার জন্য আরেকটা খুন করতে এতটুকু দ্বিধা করবে না।

মানাহা সমাধিটা চেনো তুমি, যেতে পারবে?

এক মুহূর্ত চিন্তা করল লোবু, তারপর মাথা ঝাঁকাল। আমরা কি এখনই রওনা হব, সার?

হ্যাঁ, এখনই। লোবুর পিছু নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে জিপে চড়ল রানা, রহস্যময় মিস্টার এক্স রক্তপাত ঘটাতে চাইলে শোল্ডার-হোলস্টারের পিস্তলটা কাজে লাগানো যাবে।

বাইরে এরই মধ্যে রোদ খুব তেতে উঠেছে। রানা ব্যাকসিটে উঠে বসতে গাড়ি ছেড়ে দিল লোবু।

যেটাকে ফুল-প্রুফ একটা প্ল্যান বলে মনে হচ্ছিল, এখন তাতে অসংখ্য ফুটো দেখতে পাচ্ছে রানা। এমন এক কনফ্রন্টেশানে যেতে হচ্ছে ওকে, যেটাকে প্রথম থেকে এড়াতে চেয়েছে ও। তবে এ ছাড়া কিছু করার নেই ওর। নন্দিনী শত্রুদের হাতে বন্দি, তাকে মুক্ত করে আনার জন্য সম্ভাব্য সব কিছু করতে হবে ওকে।

রানা আশা করছে দেরি হয়ে যায়নি।

ধুলোময় ফাঁকা রাস্তা। কুঁচকে সরু হয়ে থাকা চোখ দিয়ে একদিকে ধানখেত, আরেকদিকে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ দেখছে রানা। ওদিকেই কোথাও বাগিয়ে ধরে রেডি রাখা হয়েছে একটা অটোমেটিক। ভাঙাচোরা এক ঝাক মনুমেন্টের মাঝখানে কোথাও একটা খুঁটি হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে আর্কিওলজির ছাত্রী, ভারতীয় নাগরিক নন্দিনীকে। গ্র্যান্ডমাস্টার তার চাল দিয়েছে। এবার রানার পালা, বাজিমাত নিশ্চিত করতে হবে ওকে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

স্পিড বাড়িয়ে গাড়ি ছোটাচ্ছে লোবু। ধুলোর পাহাড়ে গ্রামটা হারিয়ে গেল। ভাবতে গেলে রানার বিস্ময় বাধ মানছে না। কীভাবে ওদের পিছু নিল সে? থাজি স্টেশনে তখনও পৌঁছায়নি ওরা, ট্রেন থেকে লাফ দেয় ও। নিশ্চয় আক্ষরিক অর্থেই নিখুঁত ছিল তার সময়ের হিসাব, কারণ ট্রেন থেকে ও গায়েব হয়ে যাওয়া। সত্ত্বেও পিছু নিতে কোন সমস্যা হয়নি তার, সমস্যা হয়নি নন্দিনীকে কিডন্যাপ করতেও। ঝুঁকি আছে বলে নন্দিনীকে সাবধান করেছিল ও, তবে তার জন্য এরকম একটা বিপদ। অপেক্ষা করছিল, তা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি।

মেটো রাস্তায় বাক নিল লোবু। নতুন পথ ধানখেতের মাঝখান। দিয়ে এগিয়েছে-সরু, আগাছায় প্রায় ঢাকা। দূরে মানাহা দেখতে। পাচ্ছে রানা, শোকেসে সাজিয়ে রাখা সাদা আর সোনালি কেকের মত দেখতে। ফাঁকা ধানখেতের মাঝখানে ওটা যেন একটা দুর্গ। দাঁড়িয়ে আছে-ঝক ঝক ঝুল-বারান্দা, সরু সিঁড়ি, প্রাচীর আর। গোলকধাধার মত প্যাসেজের সমষ্টি।

খালি খেতের উপর দিয়ে ছুটছে জিপ। তারপর ধীরে ধীরে স্পিড কমাল লোবু। পরিত্যক্ত সমাধির প্রবেশপথ থেকে বিশ গজ। দূরে থামল ওরা।

ব্যাকসিট থেকে পিছলে নীচে নামার সময় মাথাটা নিচু করে। রাখল রানা, জিপটাকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করছে। মনুমেন্টের গায়ে অনেকগুলো চৌকো জানালা দেখা যাচ্ছে, ফলে ভিতর থেকে। চারপাশের মাঠে নজর রাখা যায়। সমাধি সৌধের সামনে ইট আর সিমেন্টের প্লাস্টার দিয়ে তৈরি একজোড়া পবিত্র সিংহ পাহারা দিচ্ছে-মৌন, চোখে সতর্ক দৃষ্টি, যেন সর্বজ্ঞ।

নামো, তারপর নিচু হয়ে থাকো, গলা খাদে নামিয়ে লোবুকে বলল রানা।

সঙ্গে সঙ্গে জিপ থেকে নেমে কুঁজো হয়ে গেল লোবু। আর যাই হোক, লোকটা কোন প্রশ্ন না তুলে, বিনা দ্বিধায় মেনে চলেছে ওর প্রতিটি নির্দেশ।

রানা সিদ্ধান্ত নিল, ঝুঁকিটা নেবে। কিছুই বলল না, আড়াল ছেড়ে হঠাৎ বেরিয়ে পড়ল, তারপর খোলা মাঠ ধরে সমাধির দিকে ছুটল।

কিছু ঘটল না। একটা সিংহ মূর্তি আড়াল দিল ওকে। ওখানে। দাঁড়িয়ে সমাধির দেয়ালে কোথায় ফাঁক আছে খুঁজছে।

কোথাও কিছু নড়ছে না। নন্দিনী? ডাকল রানা। নন্দিনী, তুমি কোথায়?

রানার প্রতিপক্ষ এখনও দেখেনি সমাধির সামনে একটা জিপ এসে থেমেছে। এখনও হয়তো ওর পৌছানোর জন্য অপেক্ষা করছে সে, জানে না এরইমধ্যে পৌঁছে গেছে ও। এক ঘণ্টাও হয়নি। তার অপতৎপরতা যে সংকট তৈরি করেছে, সেটা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য অস্থির হয়ে আছে রানা। কিন্তু যতক্ষণ না জানছে। লোকটা আসলে কে, কার সঙ্গে লাগতে হবে, তেমন কিছু করার নেই ওর।

তারপর হঠাৎ চাকার দাগ দেখতে পেল রানা।

দাগগুলো সরাসরি সমাধি সৌধের ভিতরে ঢুকেছে, তারপর আবার বেরিয়েও এসেছে, ফিরতি পথ ধরে চলে গেছে লোবুকে নিয়ে এই মাত্র যেদিক থেকে এল রানা-গেস্ট হাউস আর পেগানের দিকে।

সিংহের পিছন থেকে না বেরিয়ে টায়ারের দাগগুলো ভালোভাবে পরীক্ষা করার জন্য সামনের দিকে খানিকটা ঝুঁকল রানা। টায়ারের খাজগুলো কোনরকমে দেখতে পেল ও।

অবশ্য একবার শুধু চোখ বুলাবারই দরকার ছিল রানার। ঝট করে সিধে হয়ে লাফ দিল ও, কারও আগ্নেয়াস্ত্রের সহজ টার্গেট হতে রাজি নয়। আঁকাবাঁকা একটা পথ তৈরি করে ছুটল, অক্ষত শরীরে পৌঁছে গেল জিপের নিরাপদ আশ্রয়ে। ঘুরে বাহনটার আরেক দিকে চলে এল রানা, চোখ বুলাচ্ছে লোবুর তোবড়ানো। জিপের তৈরি টায়ারের দাগে। দেড় মিনিট আগে দেখা টায়ারের সঙ্গে হুবহু মিল রয়েছে এটার।

আর কিছু চিন্তা করার সময় নিল না, পিস্তল বের করার জন্য জ্যাকেটের ভিতর হাত ঢোকাল রানা।

তোমার জায়গায় আমি হলে কাজটা করতাম না, রানা, লবুয়াং লোবু কথা বলছে, তার মার্কিনি উচ্চারণের ইংরেজি নিখুঁতই বলতে হবে। আর হাতের ভারী পিস্তলটা .৩৫৭ ম্যাগনাম প্যারাবেলাম।

<

Super User