পরদিন সকালে মাথায় ঝম ঝম বৃষ্টি নিয়ে সৈকতে পৌঁছুলাম আমরা। মেঘগুলো একেবারে পাহাড় চূড়ার কাছে নেমে এসেছে, ঘন কালো উঁচু বাঁধের মত দেখাচ্ছে ওগুলোকে, দিগন্তরেখার নিচ থেকে ভাঁজ খুলে আরও আসছে স্তরের পর স্তর, মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাবার সময় ঢল বইয়ে দিচ্ছে দ্বীপের গায়ে।

সাগরের বুকে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো পড়েই বিস্ফোরিত হচ্ছে, পানির কণা তারের সাদা একটা জালের মত ঢেকে রেখেছে। সাগরের শরীর। কয়েকশো গজ পর বাকি সব অস্পষ্ট, ঝাপসা।

হোয়েলবোট থেকে পানি ছেচে কূল করতে পারছে না ল্যাম্পনি। বোটের সব কিছু ভিজে সপসপে হয়ে গেছে, পানির ঢল গড়াচ্ছে প্রতিটি জিনিসের ওপর। স্টার্নে দাঁড়িয়ে আছে রডরিক, বৃষ্টির বর্শা থেকে বাঁচার জন্যে চোখ দুটো ঢেকে রেখেছে হাত দিয়ে। চ্যানেল ধরে এগোচ্ছি আমরা। 

প্রবাল প্রাচীরের পাশে উজ্জ্বল কমলা রঙের বয়াটা পানির পিঠে লাফালাফি করছে এখনও। সেটাকে ধরে লাইনে টেনে বোটে তুললাম আমরা হোস পাইপের শেষ প্রান্তটা। পাম্পের মাথার সঙ্গে জোড়া লাগানো হল সেটা। একই সঙ্গে নোঙরের কাজ করছে হোসটা, হোয়েলবোটের ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল রডরিক।

পানিতে নেমে বৃষ্টির খোঁচা থেকে বাঁচা গেল। ঝাপসা নীলের ভেতর দিয়ে পুলের নিচে নেমে এলাম আমি আর রাফেলা।

আভাসে হুমকি আর প্রকাশ্যে কিছু ঘুষ দিয়ে আমি আর। রডরিক শেষ পর্যন্ত আদায় করতে পেরেছি ল্যাম্পনির কাছ থেকে। তার শখের কম্বলটা। পানিতে একবার ভালভাবে ভেজার পর আমাদের সঙ্গে সেটা খুব দ্রুত নেমে এল নিচে। ভাঁজ করে, রশি দিয়ে বেঁধে নিয়ে এসেছি ওটাকে আমি, তাই গানডেকে ঢোকাতে কোন অসুবিধে হল না। গানডেকে নামিয়ে, সেখান থেকে প্যাসেঞ্জার ডেকে নিয়ে এসে বাঁধন খুলে ভাঁজ মুক্ত করলাম। কম্বলটা। তারপর রাফেলাকে নিয়ে চলে এলাম হোল্ডে, এখানে। দেখতে পেলাম ঠিক যেভাবে রেখে গিয়েছিলাম সেভাবেই রয়েছে বাঘের মাথাটা-একটা মাত্র অন্ধ চোখের কোটর নিয়ে আক্রোশে মুখ ভেঙচাচ্ছে, টর্চের আলোয় দৃশ্যটা দেখে নিজের অজান্তেই গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেল আমার।

দশ মিনিটের চেষ্টায় খড়ের আশ্রয় থেকে বের করে আনা গেল মাথাটাকে। যা ভেবেছিলাম, কাঁধের কাছেই শেষ হয়েছে। অংশটা, কিনারাটা নিখুঁত ভাবে খাজ কাটা, পরিষ্কার বোঝা যায় সিংহাসনের পরবর্তী অংশের আরেক প্রস্থ খাজের সঙ্গে খাপে খাপে এঁটে যাবে।

মাথাটা ধরে একদিকে কাত করে আরেকটা ব্যাপার আবিষ্কার করলাম আমি। কেন যেন ধরে নিয়েছিলাম মূর্তিটা নিরেট সোনা নিয়ে তৈরি, কিন্তু এখন দেখছি তা নয়, ভেতরটা ফাঁপা।

এক ইঞ্চি পুরু সোনা দিয়ে গড়া হয়েছে মূর্তিটা, ভেতর দিকটা খরখরে আর উঁচু-নিচু। সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য এও বুঝলাম যে নিরেট সোনা হলে এটার ওজন হত কয়েক টন, আর তাজমহলের মত কীর্তি নির্মাণ করার সাধ্য রয়েছে যাদের তাদের পক্ষেও নিরেট সোনার এতবড় একটা সিংহাসন তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। একটা ব্যাপার। ধাতুর ছাল এত পাতলা হওয়ায় স্বভাবতই কাঠামোটা খুব শক্তিশালী হয়নি, সেজন্যে মাথাটা এরই মধ্যে এক। জায়গায় আহত হয়েছে।

ঘাড়ের একদিকের নিচু কিনারায় চোট লেগেছে, কিনারা টুকু চটে গেছে এক জায়গায়। ভারতীয় জঙ্গলের ভেতর দিয়ে গোপন পরিবহনের সময়, নাকি সাইক্লোনের মুখে পড়ে ভোরের আলো যখন জীবন-মরণ যুদ্ধ করেছিল তখন এই দুঃখজনক ঘটনাটা ঘটেছে-নিশ্চিতভাবে এখন আর কিছু বলার উপায় নেই।

হোল্ডের ভেতর পা রাখার জন্যে শক্ত একটা জায়গা বেছে নিলাম আমি, তারপর মাথাটার ওজন পরীক্ষা করার জন্যে ঝুঁকে পড়লাম ওটার দিকে। একটা শিশুকে দুহাতের ওপর তুলে নেবার ভঙ্গিতে ধরলাম মাথাটা। ধীরে ধীরে একটু একটু করে গায়ে জোর বাড়িয়ে তুলে নিচ্ছি ওটাকে। উঠে আসছে-বুঝতে পেরে বিস্মিত হচ্ছি না, আনন্দ অনুভব করছি।

সন্দেহ নেই, সাংঘাতিক ভারী মূর্তিটা, শক্ত জায়গায় দাঁড়িয়ে গায়ের সবটুকু জোর খাটিয়ে তবেই তুলতে পেরেছি-তবে, সেই সঙ্গে এটাও প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে যে এত ভারী নয় যে তোলা অসম্ভব। আমার সতর্ক অনুমান, তিনশো পাউণ্ডের বেশি হবে না এটার ওজন। ধীরে ধীরে ঘুরে যাচ্ছি আমি। রাফেলা আমাকে টর্চের আলো ফেলে পথ দেখাচ্ছে। দুপা এগিয়ে ডেকে বিছানো মোটা কম্বলের ওপর ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়ে নামিয়ে রাখলাম মূর্তিটা। ধাতুর তীক্ষ্ণ কিনারাগুলো দাঁত বসিয়ে দিয়েছে আমার হাতে, আর ওজনের চাপে টনটন করছে পেশীগুলো। হাত দুটোর যত্ন নেবার ফাঁকে সাগ্রহে কষে ফেললাম অঙ্কটা।

তিনশো পাউণ্ড। ষোলো আউন্সে এক পাউণ্ড। তার মানে চার হাজার আটশো আউন্স। এক আউন্স যদি পাঁচশো হয়, চার হাজার আটশো আউন্সে কত হয়? চব্বিশ লক্ষ টাকা! এটা শুধু একটা অংশ, শুধু মাথাটার মূল্য। সিংহাসনের আরও তিনটে অংশে রয়েছে। সেগুলো সম্ভবত এটার চেয়ে বেশি বড় আর ভারী। এরপর রয়েছে পাথরগুলো। সব যোগ করলে যোগফল দাড়াবে মাথা ঘুরিয়ে দেবার মত। এখানেই শেষ নয়, যোগফলের সঙ্গে যোগ হবে শিল্পগুণ আর ঐতিহ্যের মূল্য-দ্বিগুণ অথবা তিনগুণ বেড়ে যেতে পারে সিংহাসনের সামগ্রিক মূল্যমান।

নিজেকে ক্ষান্ত করলাম আমি, এখন হিসেব করার সময় নয়। বাঘের মাথাটা কম্বল দিয়ে মুড়ছে রাফেলা, সেটাকে রশি দিয়ে বাঁধতে ওকে সাহায্য করলাম। কপিকলের সাহায্য নিয়ে কম্প্যানিয়নওয়ে মইয়ের কাছে নামিয়ে আনলাম বোঝাটাকে আমরা, ওখান থেকে আবার কপিকলের সঙ্গে বেঁধে ধীরে ধীরে গানডেকে নামিয়ে দিলাম।

গানপোর্টের অল্প পরিসর দিয়ে বোঝাটাকে বাইরে বের করে আনতে হিমশিম খাচ্ছি আমরা। দুজন ধরেছি ওটাকে, এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে এগোচ্ছে রাফেলা, আর পিছু হটছি আমি। অবশেষে কোথাও ধাক্কা না খেয়ে বেরিয়ে আসতে পারলাম। নাইলন কার্গো নেটের সঙ্গে বেঁধে ফেললাম বোঝাটাকে, এয়ারব্যাগে বাতাস ভরে সেগুলোও নেটের সঙ্গে বাধার কাজ শেষ। করলাম। তারপর আবার আমাদেরকে হোয়েলবোটের ওপর মাস্তুল খাড়া করতে হল বোঝাটাকে ওপরে তোলার জন্যে।

হোয়েলবোটে নিরাপদে তুলে আনার পর বাঘের মাথাটাকে ঢেকে রাখতে হবে, মাথার দিব্যি দিয়ে এ-ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি। করেনি কেউ। তাই আবার আমার আর রাফেলার এবং এই প্রথম। রডরিক আর ল্যাম্পনির নয়ন সার্থক করার জন্যে কম্বলের ঘোমটা। সরিয়ে দিয়ে মাথাটাকে উন্মুক্ত করলাম আমি।

ঘোমটা খোলার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত কদাকার পাহাড়ের গাম্ভীর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছিল রডরিক। আর ল্যাম্পনি নিশ্চলক চোখে আমার হাত দুটোর দিকে তাকিয়ে ছিল।

কম্বলটা সরে গিয়ে মাথাটা বেরিয়ে পড়তেই সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল রডরিক। আমরা সবাই দেখলাম, চিৎকার করে কেঁদে ফেলতে যাচ্ছে সে। তারপরই তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনতে পেলাম ল্যাম্পনির। পরমুহূর্তে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে দেখলাম কান্নার ছাপটা রডরিকের মুখে হাসির ছাপে পরিণত হচ্ছে।

আনন্দ এবং লোভ চকচক করছে ওদের দুজনের চোখে। এই কদিনের অবরুদ্ধ উত্তেজনা বাধ ভাঙা বন্যার মত বেরিয়ে আসছে ওদের গলা থেকে। ঝাড়া দেড় মিনিট বিচিত্র, দুর্বোধ্য ধ্বনি সহযোগে প্রলাপ বকল রডরিক, চোখ উল্টে গেল ওর, মুখের মাংস ভাজের ওপর ভাঁজ খেল, এমন ঘন ঘন হাঁপাচ্ছে যেন পাঁচ মাইল দৌড়ে এসেছে, আর ল্যাম্পনি খুশিতে বারবার দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকছে নিজের, সারা শরীর কাঁপছে প্রচণ্ড উত্তেজনায়, ঝম ঝম বৃষ্টির সঙ্গে ধুয়ে যাচ্ছে ওর চোখের পানি।

বুদ্ধি করে, এই উৎসব মুহূর্তের কথা মনে রেখেই আমার গিয়ার ব্যাগে ভরে নিয়ে এসেছি স্কচ হুইস্কির একটা বোতল। উদার হস্তে সবার গ্লাস ভরে দিলাম আমি। এখন ওদের সঙ্গে হাসছে রাফেলাও, আমিও বাদ যাইনি।

এক সময় খালি গ্লাসটা পাশে নামিয়ে রেখে রিস্টওয়াচ দেখলাম আমি। আরেকবার ডাইভ দেব আমরা, সিদ্ধান্ত নিয়ে বললাম আমি। পাম্পটা আবার তুমি চালু করতে পার, রডরিক।

এখন আমরা জানি ঠিক কোথায় তল্লাশি চালাতে হবে। যে বাক্সটায় মাথাটা ছিল সেটার বাকি অংশ ভেঙে সরিয়ে ফেলার পর পেছনের ফাঁকটায় আরেকটা একই আকৃতির বাক্স দেখতে পেলাম আমি। সামনে এগোবার আগে হোস পাইপটা সেদিকে বাড়িয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করে নিলাম।

এর আগে জেনি বার দিয়ে প্রথম বাক্সের বাকি অংশ ভাঙার জন্যে ঠোকাঠুকি করতে গিয়ে আমি সম্ভবত পেছনের বাক্সটার পচা প্ল্যাঙ্কগুলো আলগা করে ফেলেছিলাম, এবার হোস পাইপের একটু ছোঁয়া লাগতেই ভারী একটা পাঁচিলের মত ভেঙে পড়ে গেল কয়েকটা প্ল্যাঙ্ক। দ্রুত পিছিয়ে আসতে পারলাম বলে দুর্ঘটনা এড়াতে পারলাম, কিন্তু কাদায় এমনই ঘোলা হয়ে গেল পানি যে সম্পূর্ণ অন্ধের মত হাতড়াচ্ছি আশপাশটা, কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।

অন্ধকারে রাফেলাকে খুঁজছি আমি, আমাকেও খুঁজছে ও–আমাদের একটা করে হাত পরস্পরকে ছুঁয়েই শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। একটু চাপ দিয়ে আশ্বাস দিয়ে জানাল রাফেলা আহত হয়নি ও। আবার আমি হোসপাইপ ঘুরিয়ে ঘোলা পানি পরিষ্কার করতে লেগে গেলাম।

পাঁচ মিনিটের মধ্যে বেশ খানিকটা পরিষ্কার হয়ে এল পানি, নতুন কার্গোটার আকৃতি দেখতে পাচ্ছি। পাশে রাফেলাকে নিয়ে টর্চের আলোয় পথ দেখে হোল্ডের আরও ভেতরে ঢুকলাম আমরা।

কাঠের বহিরাবরণটা প্রায় অর্ধেক খসে পড়ে গেছে, আর। ভেতরে দেখতে পাচ্ছি চুপচাপ স্লান চেহারা নিয়ে বসে রয়েছে লোহার সিন্দুকটা। মরচে ধরে প্রায় ঝুরঝুরে বালির মত হয়ে গেছে সিন্দুকের বাইরের দেয়ালটা, হাত দিতেই খরখরে খড়িমাটির মত লাল আয়রন অক্সাইডের গুঁড়ো খসে পড়ল।

কেসটার দুদিকে ভারী দুটো আঙটা রয়েছে, এককালে এদুটো অনায়াসে ঘোরানো যেত, কিন্তু এখন সিন্দুকের মরচে ধরা গায়ের সঙ্গে শক্ত ভাবে আটকে গেছে। তবু আঙটার ভেতর হাত ঢোকাতে পারলাম আমি, অনেক টানা-হ্যাচড়া করে বাক্স আর। কাদার ভেতর থেকে বের করে আনলাম। জঞ্জাল সরিয়ে অনায়াসে শূন্যে তুলে নিলাম ওটাকে। আমার অনুমান, সব মিলিয়ে দেড়শো পাউণ্ডের কাছাকাছি হবে এটার ওজন, তার বেশি নয়। এই ওজনের বেশির ভাগটাই দখল করে রেখেছে লোহা, সন্দেহ নেই।

প্রকাণ্ড বাক্সটার তুলনায় এটা খুবই ছোট একটা বোঝা, জাহাজের ভেতর থেকে এটাকে বের করে আনতে কোন অসুবিধেই হল না আমাদের। একটা মাত্র এয়ার ব্যাগের সাহায্যে। সহজে তুলেও আনা গেল পানির ওপর।

বিপদের নোটিস নিয়ে গানফায়ার রীফ-এর পাঁচিল টপকাচ্ছে। স্রোত আর সাদা ফেনা, আমরা যখন সিন্দুকটা তুলতে চেষ্টা করছি হোয়েলবোট তখন এলোপাতাড়ি দুলছে, অস্থির ভাবে বাঁধন ছিঁড়ে ছুটে যেতে চাইছে। বো-এর কাছে ক্যানভাস ঢাকা স্কুবা-বটলের ওপর রাখলাম ওটাকে আমরা। ইতিমধ্যে মোটর থেকে হোস খুলে ফেলে দেয়া হয়েছে পানিতে, ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে বোটের নাক ঘুরিয়ে নিতে দেরি করল না রডরিক।

উত্তেজনার চরমে রয়েছি এখনও আমরা, মদের বোতলটা দ্রুত হাত বদল হচ্ছে আমাদের মধ্যে।

এখন রীতিমত একজন ধনী লোক তুমি, রডরিক, চিৎকার করে বললাম ওকে আমি। কি রকম লাগছে তোমার?

বোতলটা থেকে দুঢোক গিলে নিয়ে প্রথমে বিষম খাওয়া থেকে রক্ষা করল নিজেকে, তারপর খকখক করে কিছুক্ষণ কেশে নিয়ে নিঃশব্দে হাসল রডরিক।

বলল, আগের মতই আছি আমি, ম্যান। কোন পরিবর্তন নেই।

কিন্তু এভাবে এড়িয়ে যেতে দিল না ওকে রাফেলা, জেদের সুরে জানতে চাইল ও, তোমার ভাগটা কি করবে তুমি, রডরিক?

হ্যাঁ, বল, জানতে চাইলাম আমি, এই অগাধ সম্পদ কি কাজে লাগাবে তুমি?

ভাগটা তোমরা আমাকে অনেক দেরি করে দিলে, ম্যান, রডরিকের কদর্য চেহারায় বিষাদের ছায়া ফুটে উঠল। এই ভাগটা যদি আজ থেকে পনেরো-বিশ বছর আগে পেতাম, হ্যাঁ, তখন এটা কাজে লাগত বটে। বোতল থেকে আরেক ঢোক খেল সে। এই-ই আসলে হয়। যখন তুমি যুবক, তখন শত চেষ্টা করলেও পাবে না। আর যখন বুড়ো হতে চলেছ তখন না চাইতেই পেয়ে যাবে। তোমাদের বেলায় অবশ্য উল্টোটা ঘটেছে।

তোমার বক্তব্যটা কি, ল্যাম্পনি? জানতে চাইল রাফেলা।

কোঁকড়ানো লম্বা চুল ভিজছে ল্যাম্পনির, দুহাত দিয়ে মুখের দুপাশ থেকে সেগুলো সরাল সে। কিন্তু চুপ করে আছে, যেন শুনতেই পায়নি রাফেলার প্রশ্ন। কি হল, বল! তাড়া লাগাল রাফেলা। তুমি তো এখনও যুবক, নিশ্চয়ই কোন স্বপ্ন আছে তোমার?

নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে না পেরে ফিক করে হেসে ফেলল ল্যাম্পনি। বলল, মিস রাফেলা, সেই থেকে এখানে বসে ওই কথাই ভাবছিলাম এতক্ষণ। ইতিমধ্যেই একটা তালিকা তৈরি করেছি যেটা এখান থেকে সেন্ট মেরী, সেন্ট মেরী থেকে এখানে, তারপর আবার সেন্ট মেরীতে গিয়ে পৌঁছবে-এত লম্বা।

সৈকত থেকে গুহায় দুবার যাওয়া-আসা করতে হল আমাদেরকে বাঘের মাথা আর লোহার সিন্দুকটা বয়ে নিয়ে যাবার জন্যে। একটা গুহা আমরা স্টোররুম হিসেবে ব্যবহার করছি, তাতে ঢুকিয়ে দিয়ে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচানো হল ওগুলোকে।

একটা হ্যাক-স আর জেনি বার নিয়ে সিন্দুকটার তালার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমি আর রডরিক। কাজটা সহজ তো নয়ই, বরং সাংঘাতিক কঠিন লাগছে। মরচের নিচে আশ্চর্য শক্ত হয়ে গেছে লোহা। প্রথম আধঘন্টায় তিনটে হ্যাকস ব্লেড ভাঙলাম আমরা। আর রাগের মাথায় আমার মুখ থেকে যেসব গালিগালাজ। বেরিয়ে এল সেগুলো প্রচুর হাসির খোরাক হয়ে উঠল রাফেলার জন্যে। কিন্তু একটু পর ওই একই জিনিস লজ্জায় লাল করে তুলল ওর মুখের চেহারা। আমার সহকর্মীদের উৎসাহ বাড়াবার জন্যে ওকে একটা হুইস্কির বোতল খুঁজে আনতে পাঠিয়ে দিলাম আমি।

বিশ্রাম নেবার পর নতুন উদ্যমে কাজে হাত দিলাম আবার আমরা। মূল তালাটা এতবড় আর মোটা যে সেটা ভাঙার চেষ্টাই করছি না আমরা। সিন্দুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা দুপাশের তিনটে তিনটে মোট ছয়টা রডের সঙ্গে ঝুলছে সেটা, এই রডগুলোকে কেটে ফেলে তালাটাকে আলাদা করতে হবে আমাদেরকে। কাজটা সাংঘাতিক কঠিন। মাত্র দুটো রড কাটতেই সন্ধ্যা উতরে গেল। পরিশ্রম বিবেচনা করে আরেকবার বিরতি ঘোষণা করলাম আমি।

কফির জায়গা আজ পুরোপুরি দখল নিয়েছে স্কচ হুইস্কি, এতে সবচেয়ে বেশি খুশি রডরিক। সবার চেয়ে বেশি ঢালছে সে গলায়, আরও দাবি করছে। আলোচনার সময় সবার পরামর্শ চাইলাম আমি, ল্যাম্পনি বলল, হাফস্টিক জেলিগনাইট ব্যবহার করলে কেমন হয়, স্কিপার?

সত্যি, কেমন হয়? দ্রুত জানতে চাইল রডরিক, বিস্ফোরণ ঘটাবার লোভে চকচক করছে চোখ দুটো ওর।

এদিক ওদিক মাথা দুলিয়ে নিরাশ করলাম ওদেরকে আমি।

আসলে আমাদের একটা ওয়েল্ডিং টর্চ দরকার, বলল ল্যাম্পনি।

চমৎকার! এতটা বিরক্ত বোধ করছি যে বিদ্রুপ না করে পারলাম না। সবচেয়ে কাছের ওয়েল্ডিং সেটটা এখান থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে রয়েছে-কথা খুঁজে পেলে না আর?

দুটো গ্যাস লণ্ঠন জ্বলছে গুহার ভেতর, সিন্দুকটাকে ঘিরে বসে আছি আমরা। সোনার মাথাটা সম্মানের উঁচু একটা আসনে বসে হিংস্র ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। গুহার পেছনের দিকে দেয়ালের একটা শেলফে তুলে রেখেছে ওটাকে রডরিক। আমরা সবাই হতাশ হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছি, একা সিন্দুকটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে রয়েছে রাফেলা, কি যেন আবিষ্কার করতে চাইছে ও।

অবাক কাণ্ড, সত্যি সত্যি সিন্দুকটা খোলার একটা উপায় আবিষ্কার করে ফেলল ও।

দুভাবে খোলা যায় সিন্দুকটা, এটা কিভাবে যেন বুঝতে পারে রাফেলা। ঢাকনির গায়ে একই মাপের পাশাপাশি এবং কয়েক সারি খাঁদ রয়েছে, খাদের ওপর রয়েছে লোহার সেতু। সবগুলো সেতুকে পেঁচিয়ে এগিয়ে গেছে একটা রড, রডটা ঢাকনির কিনারার কাছে একটা গর্তের ভেতর ঢুকে গেছে। এই গর্তের ভেতর দিকের দেয়ালে একটা ছোট্ট ফুটো আবিষ্কার করেছে। রাফেলা। আঙুল দিয়ে স্পর্শ করেই বুঝলাম এটা একটা চাবির গর্ত।

কিন্তু চাবি পাব কোথায়! দুই ইঞ্চি লম্বা একটা পেরেক গর্তটার ভেতর ঢোকালাম আমি, জানি এতে কাজ হবে না, কিন্তু পেরেকটা একটু ঘোরাতেই খট করে শব্দ বেরিয়ে এল ভেতর থেকে, সঙ্গে সঙ্গে সব কটা সেতু মাঝখান থেকে দুভাগ হয়ে গিয়ে খাদের ওপর থেকে দুপাশে সরে গেল। এরপর বাঁকানো রডটাকে খাদ থেকে তুলে ফেলতে কোন অসুবিধেই হল না।

ঢাকনিটা এখন তুলে ফেলা যেতে পরে। কিন্তু ইচ্ছা করে। দেরি করছি আমি, সবাইকে আরও কিছু উত্তেজনা উপভোগ করার সুযোগ দিচ্ছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসল রাফেলা। তিন সেকেণ্ডের বেশি যদি দেরি কর, তোমার। বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনব আমি…।

আমরা আপনাকে সমর্থন করব, জানিয়ে দিল রডরিক।

আর ল্যাম্পনি সেকেণ্ড গুণতে শুরু করে দিল, এক…দুই…

ঢাকনিটা তুললাম আমি। একটা দুর্গন্ধ ঢুকল নাকে। ঢাকনির উল্টোদিকের গায়ে সেঁটে আছে গাঢ় রঙের পচা কাপড়। সিন্দুকের ভেতর দেখতে পাচ্ছি কাপড়ের একটা স্তর, ভিজে নিরেট একটা হঁটের মত দেখাচ্ছে। স্তরটা সিন্দুক থেকে বের করতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম এটার নিচে একই ধরনের আরেকটা কাপড়ের নরম স্তর রয়েছে।

সাবধানে, রানা! সর্তক করে দিয়ে বলে উঠল আমার ঘাড়ের। ওপর থেকে রাফেলা। কাপড়গুলো শুধু ঢাকনি নয়, ওগুলোই প্যাকেট-ভেতরে কিছু আছে। সরবে তুমি? নরম হাতে নাড়াচাড়া করা দরকার ওগুলো। উদারচিত্তে সুযোগটা দান করলাম ওকে আমি। একটু সরে জায়গা ছেড়ে দিলাম।

হাত নাড়ার জায়গা করার জন্যে দুপাশ থেকে সবাইকে সরিয়ে দিল রাফেলা, আলতোভাবে ধরে সিন্দুকের ভেতর থেকে তুলে আনল ওপরের ভিজে কাপড়ের স্তরটা।

প্রত্যেকটি সুতো দিয়ে বাঁধা, ছুঁতে না ছুঁতেই ছিঁড়ে যাচ্ছে সুতোগুলো। প্রথম প্যাকেটটা হাতে নিয়েছে রাফেলা, এক সেকেণ্ড পরই কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে গেল সেটা। মোনাজাতের ভঙ্গিতে দুই হাত এক করে ভেঙে যাওয়া পার্সেলটা ধরে আছে ও, সেটাকে ধীরে ধীরে নামিয়ে রাখল সিন্দুকের পাশে ভাঁজ করা তারপুলিনে। পার্সেল থেকে বেরিয়ে পড়েছে খুদে আকৃতির অসংখ্য শক্ত জিনিস, দিয়াশলাই শলাকার মাথার চেয়ে একটু বড় থেকে শুরু করে পাকা আঙুরের সমান পর্যন্ত আছে। প্রতিটি কাগজ দিয়ে মোড়া, কাপড়ের মতই পচে গেছে। এর একটা বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে তুলে নিয়ে মৃদু চাপ দিয়ে ঘষল রাফেলা, পচা কাগজ কাদার মত সরে গিয়ে বেরিয়ে পড়ল বড় একটা নীল পাথর, চৌকো করে কাটা, মাত্র একটা দিক পালিশ করা।

স্যাফায়ার? জিজ্ঞেস করল ও। ওর হাত থেকে পাথরটা নিলাম আমি, গ্যাস লণ্ঠনের আলোয় পরীক্ষা করে দ্বিমত প্রকাশ করলাম।

না। এটা সম্ভবত ল্যাপিজ লাজুলাই। নীল কাগজের কণা এখনও লেগে রয়েছে পাথরটার গায়ে, পাথরের রঙ তাতে একটু নীলচে দেখাচ্ছে। কাগজের মোড়কে কালি দিয়ে কিছু লিখে রেখেছিল কর্নেল গুডচাইল্ড, যাতে পাথরগুলো আলাদাভাবে চেনা যায়, অর্থাৎ সিংহাসনের নির্দিষ্ট জায়গায় পাথরগুলো যাতে আবার বসাতে কোন অসুবিধে না হয়।

এখন আর তা সম্ভব হবে না, বলল রাফেলা।

ঠিক বলতে পারছি না, বললাম আমি। কাজটা কঠিন হতে পারে, কিন্তু একেবারে অসম্ভব হবে বলে মনে করি না। চেষ্টা করলে পাথরগুলো নির্দিষ্ট খোপে বসিয়ে দিতে পারব।

প্লাস্টিকের কিছু প্যাকেট আনতে পাঠালাম ল্যাম্পনিকে। কাগজে মোড়া একটা করে পার্সেল বের করছে রাফেলা, তালুতে রেখে প্রতিটা পাথর ঘষে পরিষ্কার করছি আমরা, আর সেই পার্সেলের সমস্ত পাথর একটা আলাদা প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরে রাখছি।

তাড়াহুড়োর কাজ নয় এটা, সবাই মিলে দুঘন্টা খাটনি দেবার পর বারোটা প্যাকেটে কয়েক হাজার অমূল্য পাথর ভরতে পারলাম আমরা। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ল্যাপিজ লাজুলাই, ক্রাইসো বেরিল, টাইগারস আই, গারনেট, ভারডাইট, এমিথিস্ট। আরও ছয়টা প্লাস্টিকের প্যাকেট ভরেছি আমরা, কিন্তু এই পাথরগুলো পরিচিত নয় আমাদের।

পচা কাগজের শেষ স্তর থেকে একটা পার্সেল বের করছে রাফেলা, দেখেই বুঝলাম আমরা, এটার ভেতর বড় পাথরগুলো রয়েছে। রাফেলার হাত থেকে নিয়ে মোড়কটা খুললাম আমি, গ্যাস লণ্ঠনের আলোয় সবুজ তারার মত জ্বলজ্বল করছে আমার হাতে অনেকগুলো বড় আকৃতির এমারেল্ড। রুদ্ধ হয়ে গেছে আমাদের সবার নিঃশ্বাস, মুগ্ধ চোখে সম্মোহিতের মত তাকিয়ে। আছি পাথরগুলোর দিকে।

ধীরে ধীরে তারপুলিনের ওপর নামিয়ে রাখলাম আমি। এমারেল্ডগুলো। সিন্দুক থেকে শেষ পার্সেলটা বের করার জন্যে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে রাফেলা। অপেক্ষাকৃত ছোট একটা মোড়ক বের করে আনল ও। কাগজের পচা কাদা সরিয়ে দিতেই ছ্যাৎ করে উঠল আমার বুক। মোড়কে এই একটাই পাথর রয়েছে।

অঞ্জলির মাঝখানে ধরে আছে পাথরটা রাফেলা। হাত দুটো থরথর করে কাঁপছে ওর।

এটাই সেই গ্রেট মুঘল ডায়মণ্ড? কথাটা কানে ঢোকার পর আবিষ্কার করলাম শব্দগুলো আমার গলা থেকেই বেরিয়েছে।

মুরগির ছোট একটা ডিমের মত আকার পাথরটার। কয়েকশো বছর আগে এর যে বর্ণনা দিয়েছিল ব্যাপ্টিস্ট তাভেরনিয়ের তার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে।

একটু আগে পর্যন্ত যে-সব পাথর নাড়াচাড়া করেছি আমরা সেগুলোর সমস্ত উজ্জ্বলতা এক করলেও এই একটা পাথরের উজ্জ্বলতার কাছে তা ম্লান, নিশ্ৰুভ বলে মনে হবে। মাত্র একটা সূর্যের উদয় যেমন গোটা আকাশের সমস্ত তারার উজ্জ্বলতা ম্লান। করে দেয়, এ-ও যেন ঠিক তেমনি।

কাঁপা হাত দুটো ধীরে ধীরে ল্যাম্পনির দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে রাফেলা। পাথরটা ধরে পরীক্ষা করার সুযোগ দিতে চাইছে তাকে ও। কিন্তু বিদ্যুৎবেগে নিজের হাত দুটো সরিয়ে নিল ল্যাম্পনি, মুঠো করা হাত দুটো পিঠের আড়ালে লুকিয়ে ফেলেছে, এখনও পাথরটার দিকে তাকিয়ে আছে বিস্ফারিত, মন্ত্রমুগ্ধ দৃষ্টিতে।

গোটা শরীরের সঙ্গে ডায়মণ্ড ধরা হাত দুটো এবার রডরিকের দিকে ঘোরাল রাফেলা, বাড়িয়ে ধরল তার দিকে, কিন্তু রডরিকও গ্রেট মুঘল ছুঁতে রাজি হল না। গম্ভীর ভাবে বলল সে, মিস রাফেলা, আপনি মাসুদকে দিন ওটা। ওর অধিকার সবার আগে।

রাফেলার হাত থেকে নিলাম ওটা। এমন অপার্থিব একটা আগুনের ছোঁয়া এত ঠাণ্ডা লাগছে অনুভব করে আশ্চর্য হয়ে গেলাম আমি। উঠে দাঁড়ালাম, ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছি বাঘটার দিকে। লণ্ঠনের আলোয় ঝলমল করছে সোনা রঙ। প্রচণ্ড আক্রোশে মুখ ব্যাদান করে আছে বাঘটা, তার খালি কোটরে ঢুকিয়ে দিলাম আমি ডায়মণ্ড।

খাপে খাপে বসে গেল ডায়মণ্ডটা, বেইট-নাইফ দিয়ে সোনার হুকগুলো ঘুরিয়ে বসিয়ে দিলাম জায়গা মত। এই হুকগুলো প্রায় একশো বছর আগে কর্নেল গুডচাইল্ড সম্ভবত বেয়োনেটের ডগা দিয়ে খুলেছিল।

পিছিয়ে এলাম আমি, ওদের চেপে রাখা নিঃশ্বাস ছাড়ার শব্দ। পাচ্ছি। চাপা গলায় ফিসফিস করছে ওরা। গর্তে চোখটা ফিরে আসায় সোনার জানোয়ারটা জ্যান্ত হয়ে উঠেছে। তার চেহারা আর ভঙ্গির মধ্যে এখন শুধু অন্ধ আক্রোশ নয়, তার সঙ্গে প্রচণ্ড শক্তির একটা ভাব ফুটে উঠেছে। এই বুঝি তার বিকট গর্জনে সমস্ত গুহাটা থরথর করে কেঁপে উঠল।

পিছিয়ে এসে সিন্দুকের পাশে সবার সঙ্গে বসলাম আমি। সবাই মুখ তুলে তাকিয়ে আছি সোনার মাথাটার দিকে।

রডরিক, ভাই আমার, আমার প্রাণের বন্ধু! তোমার নামটা হৃদয়ে সোনার হরফে যদি লিখে রাখতে চাও-এই সুযোগটা হাতছাড়া কোরো না।

মুখের মাংস ভাঁজ খেয়ে চেহারাটা কদাকার হয়ে গেল রডরিকের, সঙ্গে সঙ্গে সাগ্রহে জানতে চাইল সে, কি করতে হবে আমাকে, মাসুদ?

স্রেফ হুইস্কির বোতলটা বাড়িয়ে দাও এদিকে, বললাম আমি।

একবার নিস্তব্ধতা ভেঙে যাওয়ায়, সবাই যেন নিজেদের কণ্ঠস্বর ফিরে পেল, একজন আরেকজনকে থামিয়ে দিয়ে কথা। বলে উঠতে চাইছে। বেশিক্ষণ কাটল না, শুকনো গলা ভেজাবার জন্যে হুইস্কির আরেকটা বোতল বরাদ্দের জন্যে অনুরোধ করতে হল আমাকে, আমার আবেদন সঙ্গে সঙ্গেই মঞ্জুর করল রাফেলা।

সেদিন অনেকরাত পর্যন্ত চালিয়ে গেলাম আমরা। এমন কি রাফেলা বার্ডেরও নেশা হল একটু। বৃষ্টিতে ভিজে নিজেদের গুহায় ফেরার সময় আমার গায়ে হেলান দিয়ে আছে ও।

সত্যি তুমি আমাকে নষ্ট করে ফেলছ, মাসুদ রানা, হোঁচট খেয়ে আমাকে নিয়ে পড়ে যাচ্ছিল রাফেলা, কোনমতে সামলে নিয়ে বলল ও। এই প্রথম মদ খেয়ে টলছি আমি।

নষ্টের দেখেছ কি, এই তো সবে শুরু, ওকে আরও কাছে টেনে নিয়ে বললাম আমি। একটু পরই দিচ্ছি তোমাকে নষ্টামীর পরবর্তী ট্রেনিং।

কেন যেন ভয় করছে আমার, রানা, হঠাৎ প্রসঙ্গ এবং গলার সুর বদলে আমাকে চমকে দিল রাফেলা।

কিসের ভয়, রাফেলা?

ভাবছি, বুমেরাং আর সিডনি শেরিডানের কথা মনে পড়ে যাওয়াতে ভয় পাচ্ছে রাফেলা। কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়।

অপ্রত্যাশিতভাবে সম্পূর্ণ নতুন প্রসঙ্গে কথা বলছে ও।

ভয় হচ্ছে এই ভেবে যে যদি কোনদিন আমাদের মধ্যেও ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়…দোষ যারই হোক, ধর আমিই না হয় দায়ী-তখন কি তুমি পারবে আমাকে ক্ষমা করতে?

হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন, রাফেলা? সাবধানে জানতে চাইলাম আমি।

একটু বেশি খেয়েছি তো, তাই আজেবাজে চিন্তা ঢুকছে মাথায়-ভুলে যাও, রানা।

ভাবছি, আসলেই কি তাই? রাফেলার ভয়টার পেছনে কি নিরেট কোন ভিত নেই? আজেবাজে বলে যেটাকে চেপে যেতে চাইছে তা কি সত্যি তাই?

আমি বিশ্বাস করি না।

<

Super User