রাফেলার পাশে এসে থামলাম আমি, আমার নিজের মাউথপিসটা খুলে দিলাম। শ্লথ হয়ে গেছে ওর নড়াচড়া, শক্তি ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত-মাউথপিসটা ধরল, কিন্তু ধরে রাখতে পারল না, পিছলে বেরিয়ে এল হাত থেকে। ওপর দিকে উঠে যাচ্ছে সেটা, এঁকেবেঁকে বেরিয়ে আসছে বাতাস। খপ করে ধরে ফেলে টেনে নামিয়ে আনলাম সেটাকে রাফেলার মুখের কাছে, পরিয়ে দিলাম দ্রুত।
বাতাস টানতে শুরু করেছে ও। বুকটা উঠছে আর পড়ছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে শক্তি আর আশা ফিরে পেল ও। সন্তুষ্ট হয়ে পিছিয়ে এলাম আমি। খালি একটা সেট থেকে ডিমাণ্ড ভালভ খুলে নিলাম। ক্ষতিগ্রস্ত সেটের ডিমাণ্ড ভালভের সঙ্গে বদল করলাম এটা। রাফেলার পিঠে বেঁধে দেবার আগে আধ মিনিট বাতাস টানলাম নতুন চার্জ করা সেটটা থেকে। তারপর ওর কাছ থেকে ফিরিয়ে নিলাম আমার মাউথপিস।
পানির নিচে যেটা না থাকলেই নয় সেই বাতাস রয়েছে এখন আমাদের কাছে। দীর্ঘ বিরতি নিয়ে উঠে যাবার জন্যে যথেষ্ট। রাফেলার চোখে চোখ রেখে অভয় দিয়ে হাসলাম আমি। ম্লান একটু হাসি দেখলাম ওর ঠোঁটের কোণে। স্পিয়ার থেকে বিস্ফোরিত হেডটা ফেলে দিয়ে তাজা হেড ফিট করে নিলাম আমি। তারপর আবার একবার গানপোর্টের নিরাপদ আশ্রয় থেকে উঁকি দিয়ে তাকালাম পুলের খোলা পানির দিকে।
বেশির ভাগ মরা আর অচেতন মাছ চালান হয়ে গেছে। হাঙ্গরদের পেটে, ঝাঁক বেঁধে ফিরে গেছে হাঙ্গররাও। রক্তঘোলা পানিতে বড়সড় দুএকটা আকৃতি দেখা যাচ্ছে শুধু, সাংঘাতিক লোভী ওরা, এখনও পানিতে তোলপাড় তুলে খোরাক খুঁজছে। তবে চলাফেরার ভঙ্গিতে আলসেমি ফুটে রয়েছে ওদের। রাফেলাকে নিয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা এখনই করা যেতে পারে।
রাফেলার একটা হাত ধরলাম আমি, একটু চাপ দিয়ে অভয় দিলাম ওকে। মৃদু চাপ দিয়ে সাড়া দিল ও। ওকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম গানপোর্ট থেকে।
বাঁশ-বনের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে দ্রুত চলে এলাম আমরা প্রবাল প্রাচীরের কাছে।
প্রাচীরের দিকে পেছন ফিরে পরস্পরের হাত ধরে পাশাপাশি রয়েছি আমরা, ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছি পুলের ওপর দিকে।
আলোর রেশ আরেকটু যেন বাড়ল। এক সময় মুখ তুলে ওপর দিকে তাকালাম আমি। ওপরে, অনেক উঁচুতে চুরুটের মত একটা আকৃতি অস্পষ্টভাবে, ঝাপসা দেখতে পাচ্ছি। উৎসাহ এবং সাহস বেড়ে গেল আমার। চিনতে পারছি হোয়েলবোটটাকে।
ষাট ফুটের মাথায় ডি কমপ্রেশনের জন্যে থামলাম আমরা। একটা পেটমোটা আলবাকোর শার্ক আমাদের পাশ কেটে সাতরে গেল, কিন্তু নজর দিল না এদিকে-দূরে ঝাপসা হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে, স্পিয়ারটা নামিয়ে নিলাম আমি।
দূরত্ব চল্লিশ ফুট থাকতে দ্বিতীয়বার ডি-কমপ্রেশনের জন্যে থামলাম। ঝাড়া দুই মিনিটের বিরতি এখানে। আমাদের রক্তের নাইট্রোজেনকে ফুসফুসের মধ্যে দিয়ে একটু একটু করে ক্রমশ বেরিয়ে যেতে দিচ্ছি। এরপর রওনা হলাম বিশ ফুট দূরত্বে পরবর্তী বিরতিতে থামার জন্যে।
উঁকি দিয়ে রাফেলার ফেস-মাস্কের ভেতর তাকালাম একবার, আমাকে উদ্দেশ্য করে চোখের মণি দুটো একপাক ঘোরাল ও, হাসল। সাহস এবং শক্তি দুটোই ফিরে পেয়েছে ও ইতিমধ্যে। সবকিছু ঠিকঠাক মত চলছে এখন। প্রচুর বাতাস রয়েছে আমাদের সঙ্গে। হোয়েলবোট বেশি দূরের ব্যাপার নয় আর। ধারে কাছে কোন বিপদও দেখতে পাচ্ছি না। বলা যায় প্রায় বাড়িতে পৌঁছে গেছি, চুমুক দিচ্ছি চায়ের কাপে-আর মাত্র বারো মিনিটের ব্যাপার।
হোয়েলবোটটাকে এত কাছে দেখাচ্ছে, আমি যেন স্পিয়ারটা দিয়ে ছুঁতে পারি ওটাকে। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি রডরিক আর ল্যাম্পনির দুটো মুখ কিনারা থেকে ঝুঁকে পড়েছে, কখন আমরা পানির গা ছুঁড়ে উঠব তার জন্যে অধীর উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করছে।
ওদের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে আরেকবার সতর্কতার। সঙ্গে নিজেদের চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছি আমি। আমার দৃষ্টিসীমার সর্বশেষ প্রান্তে, যেখানে ঘোলা আর ঝাপসা পানি নিচ্ছিদ্র গাঢ় নীলে পরিণত হয়েছে, কি যেন নড়তে দেখলাম আমি। সন্দেহের একটা ছায়াও হতে পারে, ঠিক বুঝতে পারছি না। মনে হল আসাযাওয়া করছে ছায়াটা…চোখের ভুল হলে তা কেন মনে হবে? পরিষ্কার নয় এখনও কিছু, তবু ভয়ে গায়ের রোম দাঁড়িয়ে গেল আমার।
পানিতে স্থিরভাবে ঝুলছি। সম্পূর্ণ সজাগ হয়ে উঠেছি আরেকবার। খুঁজছি, বুঝতে চাইছি-আর ওদিকে দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। সেকেণ্ড আর মিনিটগুলো।
আবার চলে গেল ছায়াটা, এবার পরিষ্কার দেখা দিয়ে গেল। মুহূর্তের জন্যে এক নজর দেখতে পেলাম, কিন্তু অসম্ভব দ্রুত গতি। আর আকৃতির আভাস লক্ষ করে বুঝতে পারলাম ওটা আলবাকোর শার্ক নয়। ক্যাম্পফায়ারের চারদিকে ছায়ায় টহলরত একটা হায়েনার আকৃতি আর আক্রমণোদ্যত একটা সিংহের আকৃতির মধ্যে যে পার্থক্য লক্ষ করা যায়, এক্ষেত্রেও সে ধরনের পার্থক্য দেখতে পেয়েছি আমি।
অকস্মাৎ পানির ধোঁয়াটে নীল পর্দা ভেদ করে বেরিয়ে এল দুনাম্বার হোয়াইট ডেথ শার্ক। সে এল ঝড়ের বেগে আর নিঃশব্দে, পঞ্চাশ ফুট দূর দিয়ে চলে গেল, যেন আমাদেরকে দেখেও গুরুত্ব দিতে চাইছে না। যেতে যেতে প্রায় আমাদের দৃষ্টিসীমার শেষ বিন্দুতে পৌঁছে গেল, মনে হল এই বুঝি অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। তারপর একটা মাত্র ঝটকায় আধপাক ঘুরেই ফিরে আসতে শুরু করল তীরবেগে আগের পথ ধরে। এই একই ভঙ্গিতে বারবার যাওয়া আসা করছে খাঁচায় বন্দী বাঘের মত।
ভয় পেয়ে আমার গায়ের সঙ্গে সেঁটে গেল রাফেলা। কয়েকবার হাত ঝাড়া দিতেও মুঠো আলগা করল না ও। ওর দিকে তাকিয়ে মাথা কঁকালাম আমি। এবার ছেড়ে দিল আমার হাত।
পায়চারি করছে যেন হোয়াইট ডেথ। পরের বার ফেরার সময় সে তার আসা-যাওয়ার গতিপথ বদল করল, বিরাট একটা বৃত্ত রচনা করে ছুটছে এখন, চক্কর মারতে শুরু করেছে আমাদেরকে মাঝখানে রেখে। লক্ষণ খারাপ। আক্রমণের পূর্ব প্রস্তুতি এটা তার। এরপর আর একবার মাত্র দিক বদল করবে সে।
ঘুরছে তো ঘুরছেই, চক্কর মারার মধ্যে কোন বিরাম নেই। সারাক্ষণ হলুদ, ক্ষুধার্ত চোখ দুটো দিয়ে চেয়ে আছে আমাদের দিকে।
আচমকা অন্য একটা বিষয় দৃষ্টি কেড়ে নিল আমার। ওপর থেকে ধীর গতিতে নামছে কি সব। কাছে নেমে এল সেগুলো, এবার চিনতে পারলাম। জনি পিলের প্লাস্টিক কনটেইনার, ডজনখানেকের কম হবে না। আমাদের বিপদ আঁচ করতে পেরে রডরিক নিশ্চয়ই পুরো বাক্সটা উল্টে দিয়েছে কিনারা থেকে। নাগালের মধ্যে দিয়ে নেমে যাচ্ছে একটা, হাত বাড়িয়ে খপ করে। ধরলাম সেটা, গুঁজে দিলাম রাফেলার হাতে।
হু হু করে নীল ডাই ছাড়ছে ওটা রাফেলার হাত থেকে। আবার আমি পুরোপুরি মনোযোগ দিলাম হোয়াইট ডেথের দিকে। বু ডাই দেখতে পেয়ে একটু ঘাবড়ে গেছে হাঙ্গরটা, সতর্ক হয়ে একটু কমিয়ে এনেছে গতি, কিন্তু এখনও মাঝখানে আমাদেরকে রেখে চক্কর দিয়ে চলেছে সে, মুখ ভরা নিঃশব্দ হাসি নিয়ে তাকিয়ে। আছে আমাদের দিকে।
দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম রিস্টওয়াচে। আরও তিন মিনিট বিরতি নিলে তারপর ওপরে ওঠা নিরাপদ হবে। তবে আমার আগে রাফেলাকে ওপরে পাঠাবার ঝুঁকিটা আমি নিতে। পারি। ওর রক্তে এখনও একবারও বুদবুদ সৃষ্টি হয়নি সুতরাং আর এক মিনিট বিরতি নিয়ে ওপরে উঠে গেলে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে না ওর।
এইবার একটু একটু করে বৃত্তটাকে ছোট করে আনছে হোয়াইট ডেথ। এত কাছে ও, এত বেশি কাছে যে ওর চোখের কালো ছুঁচালো মণি দুটোর গভীরতা দেখতে পাচ্ছি আমি, পড়তে পারছি কুৎসিত মতলবটা।
দ্রুত আরেকবার চোখ বুলালাম রিস্টওয়াচে। এক মিনিট পেরোয়নি এখনও, কিন্তু আর দেরি না করে রাফেলাকে ওপরে পাঠাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। ওর কাঁধে চাপড় মেরে ওপরের। দিকে জরুরী ভঙ্গিতে ইঙ্গিত করলাম আমি।
ইতস্তত করছে রাফেলা। তর্জনী খাড়া করে ওপর দিকটা দেখালাম ওকে আবার। নির্দেশটা মেনে নিল ও। উঠতে শুরু করল ওপর দিকে।
ঠিক যেভাবে উচিত, ধীর গতিতে উঠে যাচ্ছে রাফেলা। কিন্তু ওর ঝুলন্ত পা দুটো পানিতে বাড়ি মারছে আমন্ত্রণের ভঙ্গিতে। আমাকে অগ্রাহ্য করে রাফেলার সঙ্গে একই ভাবে ধীর গতিতে উঠে যাচ্ছে হাঙ্গরটাও।
ওদের দুজনেরই নিচে এখন আমি। দ্রুত পেডাল করে একপাশে সরে যাচ্ছি, এই সময় দেখতে পেলাম হোয়াইট ডেথের লেজে শক্ত একটা ভাব এসে গেছে। আক্রমণের পুর্ব-লক্ষণ এটা।
হোয়াইট ডেথের ঠিক নিচে পৌঁছেছি, কিন্তু দম ফেলার ফুরসত পেলাম না, দেখলাম রাফেলাকে আঘাত হানার জন্যে ঘুরে যাচ্ছে সে। উন্মত্তের মত পা ছুঁড়ে আরও একটু উঠে এলাম আমি। নরম তুলতুলে গলায় স্পিয়ার হেডটা ঢুকে যেতেই চাপ দিলাম ট্রিগারে।
দেখতে পেলাম ঝাঁকি খেল ওর গলার সাদা মাংস, পলকের জন্যে একটা ফাটল দেখতে পেলাম সেখানে আমি। লেজের কয়েকটা বিদ্যুৎগতি বাড়ি মেরে অকস্মাৎ পিছিয়ে গেল সে, প্রায় খাড়াভাবে রকেটের মত উঠে যাচ্ছে ওপর দিকে। পানির গা ছুঁড়ে শূন্যে বেরিয়ে গেল তার সম্পূর্ণ শরীর, পর মুহূর্তে দড়াম করে আছড়ে পড়ল ফেনা আর বুদবুদের উঁচু বেদীর ওপর।
প্রচণ্ড উত্তেজনা আর উদ্বেগে আমার মাথার খুলি ফেটে যাবে বলে মনে হচ্ছে, দেখতে পাচ্ছি রাফেলা তার মাথা ঠাণ্ডা রেখে অলস ভঙ্গিতে উঠে যাচ্ছে হোয়েলবোটের দিকে। পানির গা ফুড়ে নেমে এল বিশাল দুটো কালো থাবা রাফেলাকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে।
পানিতে ফিরে এসেই লাটিমের মত দ্রুত পাক খেতে শুরু করেছে হাঙ্গরটা, সেই সঙ্গে আবার বৃত্ত রচনা করে ঘুরছে। চারদিকে। ঝক ঝক মৌমাছি ছেকে ধরেছে যেন তাকে, তীব্র যন্ত্রণায় আর আক্রোশে উন্মাদ হয়ে গেছে। বারবার চোয়াল দুটো খুলছে আর ঝপ করে বন্ধ করে ফেলছে সে।
কালো দুই থাবার নাগালে পৌঁছে যাচ্ছে রাফেলা। মোটা কলার মত আঙুলগুলো রাফেলার আঙুলের ফাঁকে ঢুকে গেল, ইস্পাতের হুকের মত সেগুলো আটকে নিয়ে বিস্ময়কর শক্তির এক টানে পানি থেকে তুলে নিল ওকে।
এখন শুধু আমাকে নিয়ে সমস্যা। আরও কয়েক মিনিট পানিতে থাকতে হবে আমাকে। তারপর রাফেলাকে অনুসরণ করে বোটে উঠে যাবার চেষ্টা করতে হবে। বিস্ফোরণের ধাক্কাটা কাটিয়ে। উঠছে হাঙ্গরটা। এখন আর সে লাটিমের মত পাক খাওয়াচ্ছে না নিজের শরীরটাকে। কিন্তু বৃত্ত ধরে চক্কর মারার গতি বাড়িয়ে দিয়েছে আরও।
প্রতিটি চক্করের সঙ্গে বৃত্তটাকে ছোট করে আনছে সে।
পরবর্তী এক মিনিটে তিনবার রিস্টওয়াচ দেখলাম আমি। ডিকমপ্রেশনের জন্যে যথেষ্ট বিরতি নেয়া শেষ করেছি, এখন পানির ওপর উঠে গেলে আমার কোন ক্ষতি হবে না।
সামান্য একটু উঠলাম আমি। হাঙ্গরটার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যে থামলাম। শরীর মচকাবার তীব্র যন্ত্রণা মনে পড়ে যাচ্ছে। আমার। আর যাই করি, দ্রুত ওপরে উঠে যেতে রাজি নই আমি। ধীরে ধীরে উঠছি।
কিন্তু আরও কাছে, কাছ থেকে আরও কাছে সরে আসছে। হোয়াইট ডেথ।
হোয়েলবোটের দশ ফুট নিচে আরেকবার থামলাম আমি। সঙ্গে সঙ্গে সন্দেহ করল হাঙ্গরটা, খানিক আগে গলার কাছে। ভীতিকর বিস্ফোরণের কথা মনে পড়ে গেছে তার। চক্কর মারা বন্ধ। করে স্নান পানিতে চুপচাপ স্থির পাথর হয়ে গেছে সে, পেকটোরাল। ফিনের চওড়া ছুঁচালো ডানার ওপর ভর দিয়ে ঝুলছে পানিতে।
পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছি আমরা। নিঃশব্দে। দুজনের মাঝখানে পনেরো ফুট ব্যবধান। কারও চোখে পলক নেই কয়েক সেকেণ্ড।
কিন্তু পরিষ্কার অনুভব করছি, প্রকাও নীল পশুটা চূড়ান্ত আঘাত করার জন্যে তৈরি হতে শুরু করেছে।
স্পিয়ার ধরা হাতটা যতদূর সম্ভব বাড়িয়ে দিলাম আমি ওর দিকে। হালকা ভাবে পেডাল করছি ফিন জোড়া দিয়ে। ধীর গতিতে এগোচ্ছি ওর দিকে। ভয়ে কাঁপছে বুক, হার্টবিট বেড়ে গেছে আমার। কিন্তু নিজেকে এই বলে ভরসা দিচ্ছি, এখন যদি তেড়েও আসে ও, ওর দিকে তাক করা স্পিয়ারের ডগার সঙ্গে ধাক্কাটা খাবে আগে। আরেকবার আহত হবে।
কিন্তু তাকিয়ে আছে শুধু, তেড়ে আসছে না। এমন আশ্চর্যভাবে স্থির হয়ে আছে, যেন চোখ মেলে ঘুমাচ্ছে ও। ওর মুখের নিচে নাকের লম্বা ফাটলের এক ইঞ্চির মধ্যে পৌঁছে গেছে স্পিয়ারের মাথায় পরানো এক্সপ্লোসিভ হেড।
ট্রিগার টিপে দিলাম আমি।
বিস্ফোরণের কড়াক শব্দে কানের পর্দা নড়ে উঠল আমার। চমকে উঠে পিছিয়ে যাচ্ছে হোয়াইট ডেথ, একটা গড়ান দিয়ে উন্মত্ত গতিতে বাঁক নিতে শুরু করেছে। স্পিয়ারটা ফেলে দিয়েই প্রাণপণে ওপর দিকে উঠে যাচ্ছি আমি।
আহত সিংহের মত খেপে উঠেছে হোয়াইট ডেথ, আঘাতগুলোর তীব্র যন্ত্রণা তাড়া করছে ওকে। প্রকাণ্ড একটা নীল পাহাড়ের মত পিঠ নিয়ে আর বিশাল গুহার মত মুখটা হাঁ করে ধাওয়া করেছে আমাকে সে। জানি, এবার ওকে কোনভাবে ফেরানো যাবে না।
আমার মাথার ওপর কালো দুটো বিশাল থাবা দেখতে পাচ্ছি। কি যে ভাল লাগল রডরিককে! ডান হাতটা মাথার ওপর তুলে দিলাম ওর একটা থাবার দিকে। আর মাত্র কয়েক ফুট দূরে হাঙ্গরটা, তীরবেগে এই শেষ দূরত্বটুকু পেরিয়ে আসছে সে। অনুভব করছি আমার কব্জিতে পেঁচিয়ে যাচ্ছে রডরিকের লোহার মত আঙুলগুলো। টান আমাকে! আমার সমস্ত অস্তিত্ব নিঃশব্দ আবেদনে কেঁপে উঠল।
পরমুহূর্তে আমার চারদিকে বিস্ফোরিত হল পানি। হাতে প্রচণ্ড একটা টান অনুভব করলাম আমি, একই সঙ্গে হাঙ্গরটা পানি। দুফাঁক করে আমার কাছে পৌঁছে গেল। পানিতে প্রচণ্ড একটা আলোড়ন উঠল, কিন্তু সেই আলোড়নের ধাক্কাটা পুরোপুরি অনুভব করার আগেই দেখলাম হোয়েলবোটের ডেকে পিঠ দিয়ে শুয়ে আছি আমি-হোয়াইট ডেথের খোলা চোয়ালের ভেতর থেকে। ছিনিয়ে এনেছে আমাকে রডরিক।
তোমার খুব নেওটা ওরা, মাসুদ, তিক্ত, ঝাঁঝালো গলায় বলল রডরিক, চমৎকার পোষ মানিয়েছ!
মাথা তুলে দ্রুত চারদিকে তাকালাম রাফেলার খোজে। ভিজে, রক্তশূন্য মুখে স্টার্নে বসে আছে ও। ঠিক আছ তুমি, রাফেলা? জানতে চাইলাম আমি।
কথা বলতে পারল না, একদিকে শুধু একটু কাত করল। মাথাটা।
উঠে দাঁড়ালাম আমি। হারনেসের রিলিজ পিন খুলে স্কুবার ভারমুক্ত হচ্ছি। রডরিক, ডাক দিয়ে দ্রুত বললাম ওকে, জেলিগনাইটের একটা স্টিক রেডি কর-তাড়াতাড়ি।
মাস্ক আর ফিন খুলে ফেলে হোয়েলবোটের কিনারা থেকে উঁকি দিয়ে পুলের দিকে তাকালাম আমি। এখনও আমাদের সঙ্গ ত্যাগ করেনি বড়লাট। আক্রোশে আর হতাশায় উন্মাদ হয়ে গেছে। সে, হোয়েলবোটকে মাঝখানে রেখে চক্কর মারছে অবিরাম। পানির গা ভেদ করে তুলে দিয়েছে সে তার ডরসাল ফিনের সবটুকু দৈর্ঘ্য। আমি জানি, ইচ্ছে করলেই তো মেরে শূন্যে তুলে দিতে পারে সে হোয়েলবোটটাকে, সে শক্তি তার আছে।
ওকে তাড়াও! রানা, যেভাবে পার ওকে বিদায় কর! কণ্ঠস্বর ফিরে পেয়ে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল রাফেলা।
ভয় নেই, তাড়াচ্ছি, আশ্বাস দিলাম রাফেলাকে।
হোয়াইট ডেথের ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি আমি, কিন্তু তার আগে কিছু একটা দিয়ে ব্যস্ত রাখতে হবে ওকে, যাতে আমি তৈরি হবার আগেই আক্রমণ করে না বসে।
ল্যাম্পনি, মোরে ঈল আর একটা বেইট-নাইফ দাও আমাকে, চেঁচিয়ে উঠলাম আমি।
ঠাণ্ডা, পিচ্ছিল ঈলের ধড়টা ল্যাম্পনির হাত থেকে নিলাম। প্রায় দশ পাউণ্ড ওজনের এক টুকরো মাংস কেটে ছুঁড়ে দিলাম পুলের পানিতে। বাঁক নিয়ে চোখের পলকে ছুটে এল টুকরোটার দিকে হোয়াইট ডেথ, গতি এতটুকু মন্থর না করে খোলা চোয়ালের ভেতর ঢুকিয়ে নিল সেটা। হোয়েলবোটের খোলের সঙ্গে ঘষা খেল পাশ কেটে বেরিয়ে যাবার সময়। টালমাটাল অবস্থা হল বোটের। আমরা সবাই ঝাঁকি খেলাম।
তাড়াতাড়ি কর, রডরিক, চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। মাংসের আরেকটা টুকরো ছুঁড়ে দিলাম হাঙ্গরটাকে। পানিতে সেটা পড়তে পড়তে খপ করে মুখে পুরে নিল সে। এবার পিঠ নিচু করে বেরিয়ে গেল খোলের নিচ দিয়ে-কিন্তু আবার ধাক্কা লাগল, প্রচণ্ডভাবে দুলে উঠল বোট। টলে উঠলাম আমরা, আর তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার বেরিয়ে এল রাফেলার গলা থেকে। ডাইভ দিয়ে পড়ল ও, বোটের গানেল ধরে ঝাকুনি সামলাচ্ছে।
রেডি, বলল রডরিক।
ঈলের দুই ফুট লম্বা একটুকরো মাংস দিলাম রডরিককে আমি, টুকরোটার সঙ্গে ব্যাগের মত ঝুলছে নাড়িভুড়ির একটা অংশ। স্টিকটা ভরো এর ভেতর, রডরিককে বললাম। তারপর মুড়ে বেঁধে দাও।
নিঃশব্দে হাসতে শুরু করেছে রডরিক। খুব পছন্দ হয়েছে প্ল্যানটা আমার, মাসুদ, জানাল সে।
পানির দানবটাকে মাংসের টুকরো দিয়ে ভুলিয়ে রাখছি আমি, ওদিকে আরেক টুকরো মাংসের ভেতর জেলিগনাইট ঢুকিয়ে নিখুঁত একটা প্যাকেট তৈরি করছে রডরিক। ইনসুলেটেড তামার তার বেরিয়ে এসেছে ওটার ভেতর থেকে। প্যাকেটটা আমার হাতে তুলে দিল রডরিক।
তারের এক ডজন লুপ তৈরি করলাম আমার বাঁ হাতে, রডরিককে বললাম, জুড়ে দাও এবার।
এক মুহূর্ত পর রডরিক জানাল, রেডি আমি। নিঃশব্দে হাসছে ও।
মাংস আর এক্সপ্লোসিভের প্যাকেটটা হোয়াইট ডেথের চক্কর মারার পথের ওপর ছুঁড়ে দিলাম আমি। গতি বেড়ে গেল হাঙ্গরটার, নীল চকচকে চওড়া পিঠটা ভেসে উঠল পানির ওপর। চোয়াল দুটো খুলে যাচ্ছে। পরমুহূর্তে প্যাকেটটা সেঁধিয়ে গেল উন্মুক্ত গহ্বরের ভেতর। সঙ্গে সঙ্গে বোটের কিনারা থেকে দ্রুত বেরিয়ে যেতে শুরু করল তামার তার। রীল থেকে আরও কিছুটা ছাড়াচ্ছি আমি।
গিলে নিতে দাও, পরামর্শ দিলাম আমি রডরিককে। পেটের ভেতর পৌঁছুতে দাও।
মস্ত ঘাড় নেড়ে সায় দিল রডরিক।
পাঁচ সেকেণ্ড পর আবার বললাম, ঠিক আছে, রডরিক, এবার। বিদায় কর বড়লাটকে।
ফিন তুলে পানির ওপর ভেসে উঠছে হোয়াইট ডেথ। দিক বদলে আবার চক্কর মারা শুরু করতে যাচ্ছে, আধখানা চাদের মত। মুখের কোণে দেখা যাচ্ছে তামার তার।
সুইচ টিপে দিল রডরিক। হাঙ্গরটার পেটটা লাল একটা তরমুজের মত বিস্ফোরিত হল। স্তম্ভের আকৃতি নিয়ে খাড়া হয়ে গেল রক্তাক্ত মাংসের কণাগুলো, পানি থেকে শূন্যে পঞ্চাশ ফুট পর্যন্ত সোজা উঠে গিয়ে ছড়িয়ে যেতে শুরু করল চারদিকে। বৃষ্টির মত ঝম ঝম করে নেমে এল রক্ত আর মাংস পুলের পানিতে। হোয়েলবোটেও আছড়ে পড়ল কিছুটা।
ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়া হাঙ্গরের খোলসটা পানির ওপর ঝুঁকি খাচ্ছে, তারপর গড়িয়ে চিত হয়ে গিয়ে ডুবে যেতে শুরু করল।
গুড বাই, বড়লাট জনি আপটেইল, উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল। ল্যাম্পনি। আর পানির দিকে তাকিয়ে কদাকার, বীভৎস করে তুলল রডরিক তার বিকট চেহারাটাকে-হাসি আসছে।
চল, ফেরা যাক এবার, বললাম আমি, সামুদ্রিক ঢেউ এরই মধ্যে রীফ টপকাতে শুরু করে দিয়েছে। ভয় হচ্ছে, একটু অন্যমনস্ক হলেই হোয়েলবোট থেকে ছিটকে পড়ে যাব আমি পানিতে।
সাফ-সুতরো হয়ে নিজেদের গুহায় বসে আমরা হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিচ্ছি, এই সময় মৃদু গলায় বলল রাফেলা, আমার প্রাণ রক্ষার জন্যে তোমাকে আমার ধন্যবাদ দেয়া উচিত…।
না, ডারলিং, তার কোন দরকার নেই। কতটুকু কৃতজ্ঞ তুমি কাজে দেখাও।
সানন্দে রাজি হল রাফেলা। আধ ঘন্টার মধ্যেই কৃতজ্ঞ করে ফেলল আমাকে ও।
<