আই লাভ ইউ, ম্যান-১
মাসুদ রানা সিরিজ
কাজী আনোয়ার হোসেন
০১.
বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স।
হেড অফিস-মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা।
শনিবার।
শেষ ফাইলটা দেখা শেষ করে রিস্টওয়াচে চোখ বুলাল মাসুদ রানা। দুটো বাজতে এক মিনিট বাকি। নিজের অজান্তেই দরজার দিকে তাকাল একবার। কুঁচকে উঠল ভুরু জোড়া। সোহানার আজ হয়েছে কি? ভাবছে ও। কোন প্রোগ্রাম থাকলে আধঘন্টা আগে এসে ঘাড়ে চেপে বসে থাকে, কাজে মন বসাতে দেয় না, কিন্তু আজ সময় পেরিয়ে যেতে চলেছে, অথচ আসার নাম নেই ব্যাপারটা কি? নাকি ভুলেই গেছে…অসম্ভব! অনেক মান-অভিমান ইত্যাদি নারীসুলভ কৌশল খাটিয়ে লাঞ্চের প্রতিশ্রুতি আদায় করেছে ওর কাছ থেকে সোহানা, ভুলে যাবার প্রশ্নই ওঠে না।
চেয়ার ছেড়ে একটা হাই তুলল রানা, আড়মোড়া ভাঙল, তারপর আবার তাকাল দরজার দিকে। বিরক্তির চিহ্ন ফুটে উঠল ওর চেহারায়, একটা বেনসন অ্যান্ড হেজেস ধরিয়ে পা ঝুলিয়ে বসল টেবিলের কিনারায়। আজ একশো একটা জরুরী কাজ সারতে হবে ওকে। একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, একজন অ্যাডভোকেট এবং একজন আর্কিটেক্টের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে ওর। ঢাকা এবং লায়নস ক্লাব, দুজায়গায় মীটিং। এছাড়াও অন্তত দুটো পার্টিতে হাজিরা না দিলেই নয়। এতসবের মধ্যে বাধ্য হয়ে রাজি হয়েছে ও সোহানাকে নিয়ে লাঞ্চ খেতে। অথচ! চোখের সামনে আবার হাত তুলল ও। আঁতকে উঠে টেবিল থেকে নেমে পড়ল। সর্বনাশ! দুটো পাঁচ! সোহানা আজ ডোবাবে। কিন্তু হল কি ওর? ভাবতে ভাবতে নিজের কামরা থেকে বেরিয়ে পড়ল সে, মুখ তুলে তাকাল টাইপ-রতা সেক্রেটারি, মৃদু মাথা ঝাঁকিয়ে পাশের কামরা পেরিয়ে চলে এল রানা করিডরে। দ্রুত এগোচ্ছে।
পর্দা ঝুলছে সোহানার কামরায়। খুক করে একটু কেশে ভিতরে ঢুকল রানা। ঢুকেই থমকে গেল। নিজের চেয়ারে বসে আছে সোহানা, কামরায় আর কেউ নেই। টেবিলের উপর মাথা ঠেকে আছে তার, কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুলে ঢাকা পড়ে গেছে মুখ। পায়ের শব্দেও নড়ল না। ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে একটা হাত রাখল রানা তার কাঁধে।
কে মেরেছে, কে ধরেছে, কে দিয়েছে গাল? সোহানা, কি হয়েছে?
কিছু না, টেবিল থেকে মাথা না তুলেই বলল সোহানা।
কিছু না তো এভাবে বসে আছ কেন? শরীর খারাপ?
না।
তবে?
ঝট করে হঠাৎ মুখ তুলল সোহানা। অভিমান, ক্ষোভ আর দুঃখের ছায়া দেখল তাঁর মুখে রানা। জানো, প্রচণ্ড অভিযোগের সুরে বলল সে, আমি নাকি একেবারে জঘন্য ভাবে ব্যর্থ হয়েছি আমার দায়িত্ব পালনে। আমি যেসব ভুল করেছি সেগুলো নাকি লজ্জাজনক, নতুন এজেন্টরাও নাকি এ ধরনের ভুল করে না।
তার মানে? এসব কি বলছ তুমি? কিছুই বুঝতে আরছে না রানা।
আরও শুনবে? কার উপর যেন ফুঁসে উঠল সোহানা। আমি নাকি বিয়ে আর ঘর-সংসার বাঁধার কথাই সবসময় ভাবি, তাই কাজে মন বসাতে পারি না…তারপর-থাক। সে-সব কথা শুনে তোমার দরকার নেই। বিশ্বাস কর, ডেকে পাঠিয়ে ঝাড়া দুটি ঘন্টা শুধু বকেছে আমাকে…
বকেছে? কে বকেছে?
ওই বুড়ো।
এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হো হো করে হেসে উঠল রানা।
তুমি হাসছ? আহত বিস্ময়ে চেহারা কালো হয়ে গেল সোহানার।
একটু বকুনি খেয়েছ, তাতেই এই? বলল রানা।
একটু নয়, ঝাড়া দুঘন্টা, একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সোহানা, তোমাকে এসব কথা বলে লাভ নেই। জীবনে কখনও এই পরিস্থিতিতে পড়নি তো। আমার মত যদি কখনও বকুনি খেতে, তবে বুঝতে কেমন লাগে…
বুড়ো শুধু বকাঝকা করেছেন তোমাকে, বলল রানা। কিন্তু। মারধর করেননি। নাকি তাও করেছেন?
শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে গেল সোহানার। রেগে কাই হয়ে গেছে। তুমি আমার সাথে ঠাট্টা করছ?
কিংবা, হাসছে রানা। কোন শাস্তি দেননি তো?
একটা হাত লম্বা করে দরজার দিকে আঙুল দেখাল সোহানা। তুমি এখন যেতে পার, রানা।
লাঞ্চ কি তবে…।
সরি, আজ আমার মুড নেই।
দ্রুত রিস্টওয়াচ দেখে নিয়ে ভাবল রানা, সোহানা মত পাল্টাবার আগেই কেটে পড়া উচিত। ওর অভিমান ভাঙাবার আরও অনেক সময় পাওয়া যাবে। ঠিক আছে, চললাম তাহলে, বলে ঘুরে দাঁড়াল রানা, এগোল দরজার দিকে।
সত্যি চলে যাচ্ছ? প্রায় কাঁদ-কাদ গলায় পিছন থেকে বলল সোহানা।
এই সেরেচে, ভাবতে ভাবতে থামল রানা, ঘুরে দাঁড়াল। বলল, তো কি করব? তুমিই তো বললে…
ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে উঠল সোহানার চেহারা। ঠাট্টা নয়, রানা। এই অপমানের একটা প্রতিশোধ নিতে চাই আমি।
চোখ কপালে উঠে গেল রানার। অপমান? প্রতিশোধ?
হ্যাঁ, দৃঢ় কণ্ঠে বলল সোহানা। টান দিয়ে টেবিলের ড্রয়ার খুলে একটা এনভেলাপ বের করল সে। আমি রিজাইন দেব। ধমক খেয়ে চাকরি করা আমার পোষাবে না। রিজাইন লেটার টাইপ করে রেখেছি…
মাই গড! দ্রুত টেবিলের কাছে ফিরে এল রানা। তুমি পাগল হয়েছ, সোহানা? আমাকে যা বলার বলেছ, আর কাউকে বোলো না-শুনলে সবাই হেসে খুন হয়ে যাবে।
বকুনি আমি খেয়েছি, অপমান আমাকে করা হয়েছে…
বকুনি খায়নি কে? সোহানাকে থামিয়ে দিয়ে বলল রানা, এই অফিসে এমন কেউ আছে যে বলতে পারবে চীফের ধমক আর বকাঝকা খেয়ে নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে চুপিচুপি কাঁদেনি? তোমাকে অন্য রকম চোখে দেখেন, তাই কখনও বকাঝকা করেননি চীফ, কিন্তু…।
তুমি ঠিক জান সবাইকেই এভাবে বকেন?
যাকে খুশি জিজ্ঞেস করে দেখতে পার। বোকা, চীফের ধমক না খেলে কেউ আমরা মানুষ হতে পারতাম ভেবেছ? শুধু বকেন না, কঠোর শাস্তিও দেন তিনি।
শাস্তি?
আমার কথাই ধর না, বলল রানা। চাকরিতে ঢোকার প্রথম দিকের কথা। সাংঘাতিক একটা ভুল করে ফেলেছিলাম। ব্যস, আর যায় কোথায়, এমন শাস্তি দিলেন যে তা মাথা পেতে নেয়ার চেয়ে আত্মহত্যা করে মরে যাওয়া ভাল। অন্তত তখন তাই মনে হয়েছিল। একেবারে দ্বীপান্তর!
হোয়াট! চোখ দুটো বড় বড় হয়ে উঠল সোহানার। বল কি! দ্বীপান্তর? সোহানার চোখে অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টি।
রিস্টওয়াচ দেখে আঁতকে উঠল রানা, সর্বনাশ!
কি অপরাধে দ্বীপান্তর, বলছ না কেন?
সময় নেই, আরেক দিন বলব, বলল রানা। আমি এখন…
হাতের এনভেলাপটা দেখিয়ে জানতে চাইল সোহানা, এটা তাহলে কি করব? তুমি বলছ সবাইকেই উনি এভাবে…
এক্ষুনি ছিড়ে ফেলে দাও ওটা, বলল রানা। কেউ দেখে ফেলবার আগেই। তোমার সাথে কাল ডিনার খাবার কথা থাকল। জরুরী কাজ আছে, চললাম।
ইস্, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সোহানা। চললাম বললেই হল! লাঞ্চ চুলোয় যাক, তোমার দ্বীপান্তরের কথাটা শুনতেই হবে আজ আমাকে। মেয়েদের কৌতূহল কেমন জিনিস, জানো না? রানার হাত ধরল ও। বাইরে যাবার দরকার নেই, পিয়নকে দিয়ে লাঞ্চ আনিয়ে নিচ্ছি-তুমি বস।
ভয়ে বিকৃত হয়ে উঠল রানার চেহারা। লোকজনকে কথা দিয়েছি, যেতেই হবে আমাকে-বিশ্বাস কর, কথা দিচ্ছি, আরেক দিন সময় করে…
উঁহু, এদিক ওদিক মাথা নাড়ছে সোহানা। আজই শুনব আমি।
স্রেফ আপাতত মুক্তি পাবার জন্যে শেষ পর্যন্ত রাজি হল রানা, বলল, ঠিক আছে, আজই। তবে এখন নয়।
কখন?
রাতে।
কোথায়? জানতে চাইল সোহানা।
তোমার বাড়িতে, বলল রানা। কাজ সেরে রাত দশটায় যাব আমি।
ঠিক?
ঠিক।
বেশ, বলল সোহানা। তারপর রানার হাত ধরে দরজার দিকে ওকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল, তাই বলে লাঞ্চটা ফাঁকি দেবে, সেটি হচ্ছে না!
প্রতিবাদ করতে গিয়েও লাভ নেই জেনে চুপ করে গেল রানা। ভাবছে, এখন না হয় লাঞ্চ খাইয়ে বিদায় করা যাবে, কিন্তু রাতে? গল্প শোনার ভূত একবার ঘাড়ে চাপলে ভোর না হওয়াপর্যন্ত নামানো যাবে না। অসম্ভব! সারারাত জেগে অতীত রোমন্থন করা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। তাহলে উপায়? হঠাৎ মাথায় সহজতম বুদ্ধিটা এল। কথা দিয়েছে ঠিক, কিন্তু কথা না রাখলেই তো ঝামেলা চুকে যায়।
তাই করবে ও। আজ রাতে সোহানার বাড়িতে যাবে না।
রাত দশটা পর্যন্ত খুবই ব্যস্ততার মধ্যে কাটল রানার। তিনটে পার্টির একটাতেও যাওয়া হয়নি, শরীর সাংঘাতিক ক্লান্ত, এখন। আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। এখন বাড়ি ফিরে যাচ্ছে, নাকে মুখে দুটো গুঁজেই বিছানা নেবে, কাল রবিবার, বেলা বারোটা পর্যন্ত নাক ডেকে ঘুমাবে ও।
রান্নাবান্না করে রেখে আজ বিকেলে দেশে গেছে রাঙার মা। বাড়ি খালি। গ্যারেজে গাড়ি রেখে ক্লান্ত পায়ে হেঁটে এল ও, বারান্দায় উঠে দাঁড়াল দরজার সামনে। কী-হোলে চাবি ঢুকিয়ে তালা খোলার সময় সোহানার কথা ভেবে আপন মনে একটু হাসল ও। পথ চেয়ে অপেক্ষা করছে সে ওর জন্যে। আরও কিছুক্ষণ দেখবে, তারপর ফোন করবে ওকে। কিন্তু ফোন ধরবে না ও। সাড়া না পেয়ে ভাববে, বাড়িতে নেই ও। সাংঘাতিক খেপে যাবে,সন্দেহ নেই। শ্রাগ করল রানা, কিছু করার নেই ওর।
দরজা খুলে বেডরুমে ঢুকল রানা। অন্ধকারে হাতড়ে বোতাম। টিপে আলো জ্বালল। ছাৎ করে উঠল বুক। ফর্সা দুটো পা দেখা যাচ্ছে বিছানায়। মুখের দিকে তাকাতেই রক্তশূন্য হয়ে গেল ওর। চেহারা-যেন ভূত দেখছে!
তুমি!
চিৎ হয়ে রানার বিছানায় শুয়ে আছে সোহানা। হাসছে। বলল, জানতাম ফাঁকি দেবার চেষ্টা করবে। অপেক্ষা করে ঠকতে মন চাইল না, তাই এখানে চলে এসেছি, বিছানার উপর উঠে বসল সে। হাত-মুখ ধুয়ে ডাইনিংরুমে এস, তোমার সাথে খাব বলে আমিও খেয়ে আসিনি। বিছানা থেকে নেমে দরজার দিকে এগোচ্ছে সোহানা। কার পাল্লায় পড়েছ সে-খবর রাখো না! কথা দিয়ে গল্প শোনাবে না-চালাকি! রানার বিস্মিত দৃষ্টির সামনে দিয়ে রাজনন্দিনীর মত গর্বিত ভঙ্গিতে চলে গেল সে।
খেতে বসে আন্তরিকতার সাথে, মৃদু কণ্ঠে বিনয়াবনত ভঙ্গিতে শুরু করল রানা, দেখ, সোহানা, সেটা আমার কাঁচা বয়সের কথা, শাস্তিটা ছিল দ্বীপান্তর, প্রায় চারটে বছর কি যন্ত্রণা ভোগ করেছিসেসব আমি স্মরণ করতে চাই না। যা চাও তাই দেব, কিন্তু সেগল্প দয়া করে তুমি শুনতে চেয়ো না। বলার মত তেমন কিছুই ঘটেনি সেখানে। তাছাড়া, আজ আমি ক্লান্ত, ঘুমাতে না। পারলে…প্লীজ…
চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে সোহানার। রানার আবেদন যেন তার কানেই ঢোকেনি। সবিস্ময়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল সে, দ্বীপান্তর! মেজর জেনারেল রাহাত খান শাস্তি দিয়ে তোমাকে দ্বীপান্তরে পাঠিয়েছিলেন? চটাস করে টেবিলের উপর চাপড় মারল সে, এ গল্প আমার শুনতেই হবে।
সোহানা… করুণ চেহারা দাঁড়িয়েছে রানার।
সবজান্তার ভঙ্গিতে, অতি উৎসাহের সঙ্গে মাথা নেড়ে বলল সোহানা, চাকরিতে ঢোকার প্রথম দিকে প্রায় চারটে বছরের কোন রেকর্ড নেই তোমার ফাইলে-এখন বুঝতে পারছি, ওই সময়টা দ্বীপান্তর ভোগ করেছিলে তুমি। মাই গড! অ্যাদ্দিন এ খবর তুমি চেপে রাখলে কিভাবে? এর জন্যে তো আরও কঠিন শাস্তি পাওনা হয় তোমার-আমার তরফ থেকে। নাও, শুরু করো…
দূর ছাই! চরম বিরক্তির সাথে বলল রানা। কথা বুঝতে চাও না কেন? এতবার করে বলছি সে-সময় উল্লেখযোগ্য কিছুই ঘটেনি..
কিছুই ঘটেনি? তীক্ষ্ণ হল সোহানার দৃষ্টি। চারটে বছর একটা দ্বীপে তুমি কাটালে, অথচ কিছুই ঘটল না-একথা আমাকে বিশ্বাস করতে বল?
সোহানার অন্তর্ভেদী দৃষ্টির সামনে কেমন যেন অপ্রতিভ বোধ করল রানা। ওকে ইতস্তত করতে দেখে সোহানা উত্তেজিত হয়ে উঠল, খবরদার, মিথ্যে কথা বলে আমাকে এড়াতে পারবে না। তোমার চেহারা বলছে কিছু না কিছু ঘটেছিল-এখনও অস্বীকারকরবে?
হেসে ফেলল রানা।
উত্তর দাও, ঘটেনি কিছু?
চাপের মুখে পড়ে সত্যি কথাটাই বলতে হল রানাকে। ছোট্ট একটা ঘটনা ঘটেছিল-কিন্তু আমার অফিশিয়াল দায়িত্বের সাথে তার তেমন কোন সম্পর্ক ছিল না। চারটে বছরের এই সামান্য ঘটনাটাই শুধু আজও মনে আছে আমার-মনে পড়লেই প্রতিটা খুঁটিনাটি পরিষ্কার জ্বলজ্বল করে ওঠে, বাকি সব ঝাঁপসা, ভুলে গেছি।
জ্বলজ্বল করে ওঠে? ব্যগ্র কৌতূহলে খাওয়ার কথা ভুলে হাত গুটিয়ে বসে আছে সোহানা। তাহলে নিশ্চয়ই সেটা সাংঘাতিক কোন ঘটনা? রানা, প্লীজ, আর আমাকে কষ্ট দিয়ো না-খাওয়া হল তোমার? উঠে পড়, আমি কড়া কফি তৈরি করে আনছি, শুয়ে শুয়ে শুনব তোমার দ্বীপান্তরের কাহিনী।
কিন্তু…
এই শালা, কানে তোমার কথা যায় না? ঝট করে উঠে দাঁড়াল সোহানা চেয়ার ছেড়ে। আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে হাত রাখল দুকোমরে। অ্যায়সা এক বক্সিং মারব…
একসাথে ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠল দুজনেই। কিন্তু দ্রুত মুখের চেহারা গম্ভীর করে ফেলল রানা। ঘাড় থেকে ভূত নামানো যাবে না, বুঝতে পেরেছে ও। রাতটা জেগেই কাটাতে হবে। কিন্তু এর বিনিময়ে কিছু আদায় করে নেবার একটা সুযোগ সে-ই বা ছাড়বে কেন!
সোহানা, বলল ও। আমার একটা শর্ত আছে।
তোমার যে কোন শর্ত… রানাকে লোভাতুর দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঘোর ভাঙল সোহানার, শর্তটা কি তা বুঝে নিল এক নিমেষে। লজ্জায় লাল হয়ে উঠল মুখটা। তবে রে… টেবিল ঘুরে তেড়ে গেল সোহানা। পাজি, শয়তান, সুযোগ-সন্ধানী, ব্ল্যাকমেইলার… রানার বুকের উপর গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে, তারপর কানে কানে নিচু গলায় বলল, তোমার শর্তটা কি তা আমি শুনতে চাই না। তবে যাই হোক পূরণ করব। কিন্তু গল্প শোনার পর।
বেডরুমের আলো অফ করে দিয়ে অন্ধকারে মুখোমুখি বসে আছে ওরা। পাশেই জানালা, গ্রিল ছুঁয়ে একফালি স্লান চাঁদের আলো ঢুকে পড়েছে কামরার ভিতর। ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে আছে রানা বাগানের দিকে। ফুরফুরে বাতাস লাগছে মুখে, চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বারবার। মনটা কেমন উদাস লাগছে। ওর।
খুব কি করুণ কাহিনী, রানা? ফিসফিস করে জানতে চাইল সোহানা। তবে না হয় থাক। কষ্ট পাবে মনে করলে না হয়…
বাগান থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল রানা। আবছা অন্ধকারে সোহানার মুখের দিকে তাকিয়ে ম্লান একটু হাসল ও। বলল, আবার সব নতুন করে মনে পড়ে গেছে, সোহানা, এখন যদি কাউকে বলতে না পারি, দম ফেটে মরে যাব আমি–রাতের পর রাত ঘুমাতে পারব না। না, এখন আর বাধা দিয়ো না। বলতে দাও আমাকে…কিন্তু, কোথা থেকে শুরু করব, বল তো?
চুপ করে ভাবছে রানা। সোহানাও ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করছে।
তারপর একসময় সোহানাই নিস্তব্ধতা ভাঙল। একটানা চার বছরের শাস্তি, একেবারে দ্বীপান্তর-কি এমন অপরাধ করেছিলে তুমি যার জন্যে এতবড় শাস্তি পেতে হল তোমাকে?
শাস্তি বটে, কিন্তু অনেক পরে জেনেছি, সেটা ছিল আমার জন্যে আশীর্বাদ, বলল রানা। ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠানো হচ্ছিল আমাকে। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গিয়েছিল পাকিস্তান সরকারের, শুধু কার্যকরী করা বাকি ছিল। মেজর জেনারেল রাহাত খান ব্যাপারটা টের পেয়ে তড়িঘড়ি নিজের ঘাড়ে সব দায়িত্ব নিয়ে আমাকে পাঠিয়ে দিলেন দ্বীপান্তরে, সেন্ট মেরী দ্বীপে-আসলে প্রাণে বাঁচিয়ে দিলেন তিনি আমাকে।
ফায়ারিং স্কোয়াড! গলাটা কেঁপে গেল সোহানার। কেন? কি করেছিলে তুমি?
নড়েচড়ে বসল রানা। একটা সিগারেট ধরাল। বলল, তাড়াতাড়ি আসল কাহিনীটা শুরু করতে চাই, তাই সংক্ষেপে তোমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি আমি, কেমন? যেখানে বুঝবে না সেখানে প্রশ্ন করে পরিষ্কার হয়ে নেবে।
ঠিক আছে, বলল সোহানা। প্রথম প্রশ্ন-ফায়ারিং স্কোয়াড কেন? রেকর্ডে তো নেই এসব কথা?
সেটা ছিল আমার ট্রেনিং পিরিয়ড, শুরু করল রানা। সেজন্যেই এ সময়ের ঘটনাগুলো আমার রেকর্ড ফাইলে নেই।
কোথায় ট্রেনিং নিচ্ছিলে?
লণ্ডনে। কোর্সের শেষ পর্যায়ে আকস্মিকভাবে আমি কিছু মূল্যবান তথ্য পেয়ে যাই। সিডনি শেরিডান নামে একজন মিলিওনিয়ার পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে প্রচুর টাকা খাচ্ছিল, বিনিময়ে পাকিস্তান তার কাছ থেকে নানান গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচ্ছিল। পি. সি. আই. অত্যন্ত খাতির করত লোকটাকে। হঠাৎ আমি টের পেয়ে যাই এই সিডনি শেরিডান ডাল এজেন্টের ভূমিকা পালন করছে। সে ভারতের কাছ থেকেও প্রচুর টাকা খেয়ে পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ সমস্ত তথ্য পাচার করছে। ব্যাপারটা জানতে পেরে আমার ইমিডিয়েট বসদেরকে বললাম, কিন্তু কেউ আমাকে পাত্তা দিল না। আমার হাতে কোন তথ্য প্রমাণ ছিল না, তাই দমে গেল মনটা। এই সময় আরেকটা ঘটনা ঘটে। এক লর্ডের ছেলে, হেসটিংস আমাকে ডায়মণ্ড স্মাগলারদের একটা গোপন আস্তানায় নিয়ে গিয়ে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। গুরুদয়াল সিং, একজন ভারতীয় ডায়মণ্ড স্মাগলার-সবাইকে আমার এই পরিচয় দেয় হেসটিংস। ওরা বিশ্বাস করেছিল। ওখানে আবার আবিষ্কার করলাম সিডনি শেরিডানকে। ডায়মণ্ড স্মাগলারদের রিঙ-লিডার সে। খোঁজ নিয়ে জানলাম বন্ধু সেজে যে লোকটা পাকিস্তানের চরম ক্ষতি করছে এই শেরিডান সেই শেরিডানই। প্রথমে আমার পরিচয় জানতে পারেনি ও, ভারতীয় মনে করে খুব খাতির করত আমাকে। না চাইতেই অত্যন্ত মূল্যবান সব তথ্য পেতাম আমি ওর কাছ থেকে। এবং সে-সব তথ্য পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের অ্যাকটিভ এজেন্টদেরকে আমি গোপনে জানিয়ে দিতাম। এভাবেই চলছিল। কিন্তু আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবে না বলে কাউকে কিছু না জানিয়ে গোটা রিঙটাকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করে বসলাম। এক ঢিলে দুটো পাখি মারার ইচ্ছে ছিল আমার। সিডনি শেরিডানের মুখোশ উন্মোচনটাই মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। তখন বয়স অল্প, বুঝিনি যে অফিশিয়াল অনুমতি না নিয়ে এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া ঘোরতর অন্যায়। যাই হোক, সমস্ত তথ্য আমি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড, লণ্ডন পুলিস এবং ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসকে জানিয়ে দিই। একই দিনে আরেকটা দুঃসাহসের পরিচয় দিই আমি, এবং প্রফেশন্যাল লাইফের প্রথম ভুলটা করি। হেসটিংসও একজন স্মাগলার ছিল, তাকে বিশ্বাস করা উচিত হয়নি আমার। দুজনে ফাঁদ পেতে সিডনি শেরিডানের একটা ব্রিফকেস ভর্তি দুলক্ষ পঁচিশ হাজার পাউণ্ড স্টার্লিং দামের ডায়মণ্ড ছিনতাই করি আমরা। শেরিডানকে হাতেনাতে ধরার ইচ্ছে ছিল আমার, ফাঁদটা সেজন্যেই পাতা হয়েছিল, কিন্তু গায়ে আঁচড়টি কাটার সুযোগ না দিয়ে ফসকে গেল সে এবং টের পেল, আমি তার আসল পরিচয় জেনে ফেলেছি। যাই হোক, হেসটিংসকে ওর বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে দুঘন্টা পর হোটেলে ফিরে এলাম আমি…
কামরায় ঢুকে দেখ হেসটিংস তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে?
হ্যাঁ, বলল রানা। হাতে পিস্তল। স্রেফ আত্মরক্ষার জন্যেই যা কিছু করলাম আমি, কিন্তু লোকটা যে সাততলার ব্যালকনি থেকে একেবারে নিচে পড়ে যাবে তা ভাবতেই পারিনি।
হোটেল থেকে পালিয়ে কোথায় গেলে তুমি?
ছদ্ম পরিচয় নিয়ে অন্য হোটেলে, বলল রানা। পরদিন সমস্ত খবরের কাগজে বড় বড় হেডিংয়ে খবরটা বের হল। একজন বাদে স্মাগলার চূড়ামণিরা ধরা পড়েছে সবাই। পলাতকের নাম গুরুদয়াল সিং। লর্ড-পুত্র হেসটিংসকে খুন করার অভিযোগও আনা হল আমার বিরুদ্ধে। সাংবাদিকরা ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের একজন কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে আভাস দিল গুরুদয়াল সিং এবং তার সহকর্মীদেরকে একটি দেশের স্পাই বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। আমি বুঝলাম শেরিডানই এসব তথ্য সরবরাহ করছে ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসকে।
ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল সোহানা, সিডনি শেরিডানের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নাওনি তুমি?
ওর বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ জোগাড় করতে পারিনি আমি, বলল রানা। লোকটা সাংঘাতিক চতুর, কোন অপরাধের প্রমাণ রাখত না। এর নিষ্ঠুরতা সম্পর্কেও বিচিত্র সব কাহিনী শুনতাম, একটাও অবিশ্বাস করিনি। সিডনি শেরিডানকে ভয় করে না ব্রিটিশ আণ্ডার গ্রাউণ্ডে এমন কেউ ছিল না তখন। আমি নিজেও লোকটাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতাম।
তারপর?
কত বড় ভুল করেছি, বুঝলাম পরদিন, বলল রানা। আমি তখন ব্রিটিশ পুলিসকে ফাঁকি দেবার জন্যে আতঙ্কিত ইঁদুরের মত ছুটোছুটি করছি। এই সময় পি. সি. আই-এর একটা মেসেজ পেলাম। মেসেজে ক্ষতির পূর্ণ বিবরণ জানলাম আমি। গোটা ইউরোপ-জোড়া ইন্টেলিজেন্স নেটওঅর্ক আমাদের খতম হয়ে গেছে। আমার সূত্র ধরে পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের সমস্ত এজেন্ট, অপারেটর এবং কর্মকর্তাদের পরিচয় প্রকাশ হয়ে গেছে। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ইংল্যাণ্ড, জার্মানী, ফ্রান্স আর সুইডেন ত্যাগ করতে বলা হয়েছে তাদেরকে। আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে নিজের চেষ্টায় ইমিডিয়েটলি ইংল্যাণ্ড ত্যাগ করে অস্ট্রেলিয়ায় যেতে হবে। ওখানে গেলে পরবর্তী আদেশ পাব আমি।
ব্রিফকেসটা ছিল তোমার কাছে…
দুই লক্ষ পঁচিশ হাজার পাউণ্ড স্টার্লিং দামের ডায়মও ছিল। ওতে, বলল রানা। ওগুলো নিয়ে ইংল্যাণ্ড ত্যাগ করা সম্ভব নয়, আবার ফেলে রেখে যেতেও মন চায়নি। তখন অবৈধ ডায়মণ্ডের সবচেয়ে বড় ক্রেতা বলতে সিডনি শেরিডানকেই বোঝাত। এত টাকা দামের ডায়মও একমাত্র তার পক্ষেই কেনা সম্ভব।
কিন্তু সে তো তখন তোমার প্রাণের দুশমন, বলল সোহানা। নিশ্চয়ই তার কাছে প্রস্তাব নিয়ে যাওনি?
সাহস করে তাই গিয়েছিলাম, বলল রানা। ব্রিটিশ ওভারসীজ ব্যাঙ্কের একজন কর্মকর্তার গোপন চেম্বারে সিডনি শেরিডানের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম আমি। এল সে, এবং আমাকে দেখে আপাদমস্তক চমকে উঠল। দেরি না করে কাজের কথা পাড়লাম আমি। চলতি বাজার দর হিসেবে ডায়মণ্ডের মোট যা দাম হয় তার চেয়ে পঞ্চাশ হাজার পাউণ্ড স্টার্লিং কম দেবে সে আমাকে। ব্যাঙ্কার ভদ্রলোক পাবেন দশ পার্সেন্ট কমিশন। এই মুহূর্তে নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে আমার অ্যাকাউন্টে মোট পাওনার একটা চেক লিখে জমা দিতে হবে তাকে। ভুরু কুঁচকে বেশ কিছুক্ষণ ভাবল শেরিডান। ব্যবসায়ী লোক, প্রস্তাবটা মেনে নিল অবশেষে। কিন্তু সবজান্তা ঢংয়ের হাসি ঠোঁটে নিয়ে আমার কানে কানে বলল, মনে রেখ, আমার ডায়মণ্ড আমি কিনে নিলাম। এই ব্যাঙ্কার ভদ্রলোকের সম্মানে আজ তোমাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি আমি। কিন্তু ভবিষ্যতে খুব সাবধানে থেকো, গুরুদয়াল। তোমাকে আমি আবার খুঁজে বের করব। মৃদু হেসে বিদায় নিলাম আমি। আমার গ্যারান্টি ছিল ওই ব্যাঙ্কার ভদ্রলোক। কথা দিয়েছিল শেরিডানকে অন্তত একটি ঘন্টা তার চেম্বারে গল্পগুজবের মধ্যে আটকে রাখবে সে।
এবং ইংল্যাণ্ড ত্যাগ করার জন্যে ওই একটি ঘন্টা তোমার পক্ষে যথেষ্ট ছিল।
হ্যাঁ, বলল রানা। জাল পাসপোর্ট তৈরিই ছিল, শুধু চেহারা বদল করে নিতে যা একটু দেরি হল। তারপর লণ্ডন থেকে জুরিখ হয়ে প্যারিসের ওরলি এয়ারপোর্ট, সেখান থেকে প্যান অ্যামে চড়ে সোজা সিডনি চলে এলাম। এয়ারপোর্টে আমাকে রিসিভ করলেন স্বয়ং যমদূত-মেজর জেনারেল রাহাত খান।
ওহ, গড!
হোটেলে পৌঁছুবার আগে পর্যন্ত একটা কথাও বলেননি চীফ, বলল রানা। কিন্তু গাড়িতে দুবার অসুস্থ বোধ করলাম আমি, প্রতিবার মনে হল আমি বোধহয় মারা যাচ্ছি। হোটেল কামরার দরজা নিজের হাতে বন্ধ করে পকেটে হাত ভরলেন চীফ, অমনি ছ্যাৎ করে উঠল বুকটা। কিন্তু গুলি-টুলি করলেন না। তবে যা বললেন, তখন মনে হচ্ছিল এর চেয়ে মরে যাওয়াও হাজার গুণে ভাল। আমার দেয়া রিপোর্টটা নিঃশব্দে পড়া শেষ করলেন তিনি। তারপর ভুরু কুঁচকে বললেন, শেরিডান ডাবল এজেন্ট, তুমি প্রমাণ করতে পারবে? জান, পাকিস্তানের কত বড় উপকারী বন্ধু সে? আমি বললাম, না, স্যার। বন্ধু নয়, শত্রু-আরও কিছুদিন সময় পেলে আমি প্রমাণ করতে পারব। চীফ বললেন, আমি বিশ্বাস করলাম তোমার কথা-কিন্তু আর কে বিশ্বাস করবে? আমার ইজ্জতটা শেষ করে দিয়েছ, বোকা ছেলে! সরকারকে আমার জবাবদিহি করতে হয়, একথা জান না? একশোবার করে বলে দিয়েছি যেহেতু বাঙালী, প্রতিটা কাজে দ্বিগুণ সাবধান হবে, ভাবনা চিন্তা করে পা ফেলবে-গর্দভ! এখন তোমাকে বাঁচাব কিভাবে বলে দাও!
ফায়ারিং স্কোয়াডের কথা বললেন না?
না। সম্ভবত ভয় পাব বলে কথাটা প্রকাশ করেননি। অস্থিরভাবে পায়চারি করছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত জানতে চাইলেন, টাকাটা কি করেছ? বললাম, আছে। বললেন, কি করতে হবে কালকে জানতে পারবে। বলেই ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলেন। কামরা থেকে।
তারপর?
পরদিন বিস্তারিত সব জানানো হল আমাকে। আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের কাছাকাছি ভারত মহাসাগরে ছোটখাট একটা দ্বীপ, নাম সেন্ট মেরী, সেখানে অনির্দিষ্টকালের জন্যে পোস্টিং দেয়া হয়েছে আমাকে। সুয়েজ তখন বন্ধ, তাই সারা দুনিয়ার তেলবাহী জাহাজ ওই সমুদ্র পথ দিয়ে যাওয়া আসা করে। সব দেশের এসপিওনাজ নেটওঅর্ক তৎপর ওখানে। তাছাড়া, এলাকাটা আন্তর্জাতিক স্মাগলারদের স্বর্গ বিশেষ। আমার কাজ হবে সমস্ত এসপিওনাজ নেটওঅর্কের মেসেজ ইন্টারসেপ্ট করা এবং আরও নানান সূত্রে পাওয়া ইনফরমেশন হাই ফ্রিকোয়েন্সির অয়্যারলেসের মাধ্যমে কায়রোর পি. সি. আই-এর ব্রাঞ্চ অফিসে পাঠানো। প্রতিষ্ঠানের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করার ব্যাপারে কঠোর ভাবে নিষেধ করে দেয়া হল আমাকে। মনটা একেবারে দমে গেল আমার।
কেন?
ভারত মহাসাগরের এই এলাকায় শুধুমাত্র অযোগ্য অপারেটরদেরকে পাঠানো হত, বলল রানা। আসলে তেমন কোন কাজ ছিল না ওখানে-শুধু সময় কাটানো। যাই হোক, এরপর এল নির্দেশের বিশদ ব্যাখ্যা। একশো পঁচিশ হাজার পাউণ্ড স্টার্লিং দিয়ে একটা বোট কিনতে বলা হল আমাকে। সেন্ট মেরী দ্বীপে আমার পরিচয় হবে, আমি পাকিস্তানী বাইশ পরিবারের কোন এক পরিবারের এক অভিমানী ছেলে, মা-বাবার সাথে রাগ করে একটা বোট নিয়ে সেন্ট মেরী দ্বীপে এসে পড়েছি, এবং দ্বীপটা আমার ভাল লেগে গেছে। তাই স্থায়ী ভাবে থাকার জন্যে সেন্ট মেরীর নাগরিকত্ব পাবার জন্যে আবেদন জানিয়েছি।
এবং ঠিক তাই করলে তুমি?
হ্যাঁ, বলল রানা। তাই করলাম। কিন্তু সত্যি সত্যি প্রথম দর্শনেই ভাল লেগে গেল খুদে দেশটা আমার। দ্বীপটা খ্রিস্টান প্রধান, তবে অল্প কিছু বহিরাগত হিন্দু এবং মেইন ল্যাণ্ড থেকে আসা মুসলমানও আছে। স্থানীয় অধিবাসীরা সবাই নিগ্রো-গায়ের রঙ কালো, মাথায় কোঁকড়া চুল খুলি আঁকড়ে বসে আছে, কিন্তু চোখগুলো ধবধবে সাদা। দ্বীপবাসীরা সবাই সরল প্রাণ। ভালবেসে ফেললাম। বিনিময়ে পেলাম ওদেরও অকুণ্ঠ আতিথেয়তা এবং আন্তরিক প্রীতি। আমাকে ওদের ভাল লাগার কারণও ছিল। খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছিল কোটিপতির একমাত্র সন্তান আমি, অথচ জীবিকা অর্জনের জন্যে উদয়াস্ত অমানুষিক পরিশ্রম করি। ওদের চোখে আমি ছিলাম ভিনদেশী এক রাজপুত্র–যে সাধারণ প্রজাদের সাথে বসবাস করার জন্যে, তাদের দুঃখকষ্টের ভাগীদার হওয়ার জন্যে রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে নেমে। এসেছে পর্ণ কুটিরে।
দ্বীপটা কেমন, রানা? ফিসফিস করে জানতে চাইল। সোহানা।
স্বর্গ, এক কথায় জবাব দিল রানা। বোটে একগাদা ফুয়েল ড্রাম তুলে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া থেকে রওনা দিই আমি। এই দুহাজার মাইল পাড়ি দেবার সময় প্রেম হয় আমার সাথে জলকুমারীর…
জলকুমারী?
তোমার সতীন, মৃদু হেসে বলল রানা। ভয় পেয়ো না, বেঁচে নেই সে। গল্পটা আমার বোট এই জলকুমারীকে নিয়েই। আর… হঠাৎ খাদে নেমে এল রানার কণ্ঠস্বর, …আর দ্বীপে পা দিয়েই কুড়িয়ে পেলাম দুটো সোনার টুকরো-রডরিক আর ল্যাম্পনি। আমার গল্প ওদেরকে নিয়েও। একটু থেমে আবার শুরু করল রানা, দ্বীপে উঠেই কিনলাম পঁচিশ একর ছায়া সুনিবিড় শান্তি, সেখানে নিজের হাতে তৈরি করেছি চারটে কামরা, চওড়া একটা বারান্দা, বাগান আর লতা-ঝোপের বাউণ্ডারি ওয়াল। আম গাছ দিয়ে ঘেরা বাড়িটা থেকে সাদা সৈকত দেখতে পাওয়া যায়। শোনা যায় সাগরের উদাত্ত আহ্বান।
অপূর্ব-রানা, ওই দ্বীপে আমার যেতে ইচ্ছে করছে, ফিসফিস করে বলল সোহানা। তারপর?
তিন বছর কেটে গেল ওখানে, বলল রানা। এর মধ্যে তেমন কিছুই ঘটেনি। ইতিমধ্যে শুধু দ্বীপের একজন হয়ে উঠেছি আমি। সবাই ধরে নিয়েছে, এই দ্বীপ ছেড়ে কোথাও যাব না আমি। নিয়ম অনুযায়ী আবেদন করার ছয় বছর পর স্থায়ী। নাগরিকত্ব পাবার কথা। সবাই জানে, তখনই আমি নাগরিকত্ব পেয়ে গেছি, তিন বছর পর শুধু আনুষ্ঠানিকতাটুকু সম্পন্ন হবে।
তারপর?
সাঁতার কাটি, বোটটাকে ভাড়া খাটাই, মদ খাই, গান করি–তারপর এল মাছের মওসুম। সোহানা, গল্প শুরু হল। কিন্তু আজ এই পর্যন্তই থাক, কেমন? রাত তো অনেক হল। গৌরচন্দ্রিকা শেষ, আবার অন্য একদিন শুরু করা যাবে মূল কাহিনী, কি বল?
আমি কিন্তু কেঁদে ফেলব। কাঁদ-কাঁদ কণ্ঠস্বরটা রানার কানে অকৃত্রিম বলেই মনে হল।
হাসল রানা। ঠিক আছে, তবে শোনো। কিন্তু তার আগে…
আবার কি? অসহিষ্ণু কণ্ঠে জানতে চাইল সোহানা।
গরম কফি হলে জমত, কি বল?
এক্ষুনি, স্যার। চেয়ার ছেড়ে দমকা বাতাসের মত আঁচল উড়িয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে গেল সোহানা।
<