মুক্তবাজার অর্থনীতি গ্রহণ করার পর ইন্দোনেশিয়া সরকার বিদেশী পুঁজি আকৃষ্ট করার জন্যে আন্তর্জাতিক উদ্যোক্তাদের নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধে দেয়ার কথা ঘোষণা করে, সেটা কাজে লাগিয়ে হঙকঙ থেকে জাকার্তায় উঠে এসেছে এফএমজিএন। শুধু যে জাকার্তায় অফিস বিল্ডিং তৈরি করেছে তারা, তা নয়, ইন্দোনেশিয়ার কয়েক হাজার ছোট-বড় দ্বীপ থেকে বাছাই করে বেশ কয়েকটা দ্বীপও তারা লীজ নিয়েছে।
জাকার্তার সুহার্তো এভিনিউয়ে পঞ্চাশতলা একটা বিল্ডিঙে এফএমজিএন-এর হেডকোয়ার্টার, বিল্ডিঙটা এখনও পুরোপুরি তৈরি হয়নি, দুপাশে বাঁশ দিয়ে বানানো বিশাল আকারের মাচা ঝুলছে। তবে বিল্ডিঙের সামনের দিকটা কাচ দিয়ে মোড়ার কাজ শেষ হয়েছে। তিন থেকে পাঁচতলা পর্যন্ত লম্বা প্ৰকাণ্ড একটা ব্যানার ঝুলছে ওখানে, তাতে ম্যাডডক ফাউলারের ছবি শোভা পাচ্ছে।
বিল্ডিঙের ছাদে ল্যান্ড করল ওদের হেলিকপ্টার। হাতে এখনও হাতকড়া। কপ্টার থেকে নেমে একটা এলিভেটরে চড়ল রানা ও লীনা, সামনে আর পিছনে পাহারায় থাকল সশস্ত্র গার্ড।
দশতলায় নামল ওরা। করিডর ধরে হাঁটার সময় সাফারি পরা এক চীনা ভদ্রলোককে পাশ কাটাল, তাকে দেখে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকল লীনা। জেনারেল ফুয়াং চুকে দেখেই চিনতে পেরেছে সে। আচ্ছা, চীন থেকে পালিয়ে এসে জেনারেল তাহলে ম্যাডক ফাউলারের হেডকোয়ার্টারে লুকিয়ে আছেন! কিন্তু না, এই মুহুর্তে তার কিছু করার নেই। জেনারেল ফুয়াং চু হাতকড়া পরা রানা বা লীনার দিকে ভুলেও একবার তাকালেন না, করিডর ধরে সোজা হেঁটে চলে গেলেন।
একটা বাক ঘুরল ওরা। আরেকজন চীনাকে ও দেখা গেল, পোশাক-আশাক আর ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হয় মাইকেল জ্যাকসনকে নকল করছে।
ফাউলারের অফিসের সামনে দাড় করানো হলো ওদেরকে।
দুজন গার্ডকে মেনাচিম বলল, এদের ওপর নজর রাখো। দরজা খুলে অফিসের ভেতর ঢুকল সে।
সাফারি পরা ভদ্ৰলোককে আপনি বোধহয় চিনতে পেরেছেন ফিসফিস করল রানা। কে ভদ্রলোক?
ঋণ খেলাপি, নিচু গলায় বলল লীনা।
দরজা খুলে ভেতরে ঢোকার ইঙ্গিত দিল মেনাচিম। অফিসের ভেতরটা হামবুর্গ নিউজরূমের খুদে সংস্কারণই বলা যায়। আসলে বিলাসবহুল প্রাইভেট নিউজ স্টুডিও। বড় একটা কনফারেন্স টেবিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানচিত্র দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে।।আরেকটা ম্যাপে বঙ্গোপসাগর সহ বাংলাদেশকে দেখানো হয়েছে। প্রথম ম্যাপে খুদে মডেলের সাহায্যে চীন আর ব্রিটেনের যুদ্ধজাহাজগুলোর পজিশন বোঝানো হয়েছে। সুমাত্রা থেকে একশো বিশ মাইল দূরে, ছোট একটা ইন্দোনেশিয়ান দ্বীপ দেখা যাচ্ছে, দ্বীপের গায়ে সোনালি টিক চিহ্ন। রানার ভুরু কুঁচকে উঠল বাংলাদেশের ম্যাপে একটা লাল ক্রস চিহ্ন দেখে। চিহ্নটা ঢাকাকে কলঙ্কিত করছে।
অফিসের আরেক প্রান্তে রয়েছে ফাউলার, মনিটরের ক্রীনে চোখ। একটা ডেস্কের সামনে বসে রয়েছে খায়রুল কবির, একটা পিসি নিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত।
এগিয়ে গিয়ে ফাউলারের কানে ফিসফিস করল মেনাচিম।
সত্যি? ফাউলার বলল। ঠিক আছে, দেখা যাবে।
সরে এল মেনাচিম, চোখ নামিয়ে মেঝের দিকে তাকাল। ঘুরে রানা আর লীনার দিকে ফিরল ফাউলার।
এই যে, মি. রানা, বলল সে, মাত্র গতকাল আমার স্ত্রীকে আপনার বিছানায় মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। আর দুনিয়ার অর্ধেকটা ঘুরে আজই আপনি চলে এসেছেন আমার অফিসে মরার জন্যে? কী চমৎকার, তাই না? আপনার আসল পরিচয় আগে যদি জানতাম, আপনার ব্যবস্থা অন্যভাবে করা হত।
চট করে একবার রানার দিকে তাকাল লীনা। সুদৰ্শন বাঙালী ভদ্রলোক সাধারণ কেউ নয়, এটুকু তার জানা আছে, কিন্তু আসল পরিচয় সম্পর্কে কোন ধারণা নেই।
লীনার দৃষ্টি লক্ষ করে ফাউলার বলল, এ-ও কি সম্ভব যে পরস্পরের আসল পরিচয় এখনও আপনারা জানেন না? মাসুদ রানা, বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের অন্যতম এজেন্ট, শোনা যায়, এসপিওনাজ জগতে কিংবদন্তীর নায়ক, আন্তর্জাতিক
অপরাধী মহলের পরম শক্র বা ত্রাস। উনি অন্য দেশের হয়েও ভাড়া খাটেন, এই এখন যেমন ব্রিটেনের হয়ে খাটছেন। আর পরমাসুন্দরী লীনা ওয়াং, পিপলস এক্সটার্নাল ইন্টেলিজেন্স ফোর্সের অন্যতম স্পাই, জাল ফেলে দলছুট গুপ্তচর ধরায় এক্সপার্ট, বোধহয় সেজন্যেই তাঁকে বিষাক্ত মাকড়সা বলা হয়। আপনারা কি খবরের কাগজ পড়েছেন? জানেন আপনারা যে দুই দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন তারা পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে?
পরস্পরকে অবশ্যই চিনি আমরা, বলল রানা। দুজন একসঙ্গেই কাজ করছি। আপনার প্লান সম্পর্কে সবই আমরা জানি। দুই হেডকোয়ার্টারেই রিপোর্ট পাঠিয়েছি। কালকের হেডলাইন আপনি লিখবেন না। বরং আপনাকে নিয়েই ওটা লেখা হবে।
বুকে হাত দিয়ে ঢলে পড়ার ভঙ্গি করলেন ফাউলার, ব্যথায় বিকৃত হয়ে উঠল চেহারা। ওহ মাই গড! সৰ্বনাশ হয়ে গেছে! অাত্নসমর্পণ না করে উপায় নেই! মাথার ওপর হাত তুললেন তিনি। তার কৌতুক ধরতে না পেরে খানিক ইতস্তত করল মেনাচিম, তারপর সে-ও হাত তুলল।
বিশুদ্ধ বাংলায় গালি দিল খায়রল কবির, ব্যাটা উজবুক কোথাকার! তারপর জার্মান ভাষায় বলল, হের ফাউলার কৌতুক করছেন, গাধা!
বিব্রত মেনাচিম কবিরের দিকে চোখ গরম করে তাকাল।
মেনাচিমের বৈশিষ্ট্য অন্য ক্ষেত্রে, ওকে ছোট করে দেখাটা ভুল, বিশ্বস্ত খুনীর পক্ষ নিয়ে বলল ফাউলার। রানা ও লীনার দিকে তাকাল। লক্ষ করুন, এর মধ্যে চমক আছে।
ডেস্ক থেকে রুপোলি ও ধারাল একটা লেটার ওপেনার তুলল ফাউলার। মেনাচিমকে দিল সেটা। পায়ে এটা গাঁথো, মেনাচিম।
লেটার ওপেনার নিয়ে উরুর মাংসে গাথল মেনাচিম, যতটা গভীরে সম্ভব, নির্দিধায় ও অনায়াসে। এভাবে? জিজ্ঞেস করল সে, যেন হাত নেড়ে একটা মাছি তাড়াল।
দেখলেন? হাসছে ফাউলার। মেনাচিমকে স্বাভাবিক বলা যাবে না, তার বৈশিষ্ট্যই হলো সবাই যাতে ব্যথা পায় সে তাতে আনন্দ অনুভব করে। সেজন্যেই ওকে আমি নিখুঁত একটা কিলিং মেশিন বানাতে পেরেছি। মেনাচিমের দিকে ফিরল। ওটা তুমি বের করতে চাও, নাকি রেখে দিতে চাও?
রাখার অনুমতি দেবেন, জিজ্ঞেস করল মেনাচিম, রীতিমত সিরিয়াস, আরও কিছুক্ষণ, প্লীজ?
এই অস্ত্রপীড়ন মেনাচিমের এক ধরনের মানসিক খোরাক, বলল ফাউলার। দিনে সাতবার নিজেকে এভাবে ক্ষতবিক্ষত করার অনুমতি চায় সে। কিন্তু তা কি…
ও কানা হয়ে যাবে, বিদ্রুপ করল রানা।
ভেরি ফানি। তবে এর মধ্যে মিস লীনার জন্যে কোন ফান নেই। যৌন উত্তেজনায় খুব কমই কাতর হয় মেনাচিম, কিন্তু যখন হয়…কি বলব, আমার সংগ্রহে যে ভিডিওটেপগুলো আছে দেখলে আপনাদের হার্ট অ্যাটাক হবে।
আপনার তাহলে সাবধান হওয়া উচিত, বলল রানা। কানা হয়ে যেতে পারেন।
ফাউলার গায়ে মাখলেন না। সাধারণ নিয়ম ধরে এগোলে, তথ্য আদায়ের জন্যে আপনাদের দুজনকে মেনাচিমের হাতে তুলে দেয়া উচিত আমার। কিন্তু আপনারা কি জানেন না জানেন তা নিয়ে আমার কোন দুশ্চিন্তা নেই। কাজেই আপনাদের ওপর মেনাচিম টর্চার করবে স্রেফ মজা পাবার জন্যে। মিস লীনার জন্যে সাংঘাতিক দুঃসংবাদ, কারণ ওকে তার খুব পছন্দ হয়েছে।
কিন্তু এই না আপনি বললেন মেনাচিম ব্যথা পেতে ভালবাসে।
বাসে, তবে দিতে ভালবাসে আরও বেশি–দশগুণ।
রানা বলল, আমরা জানি নটিংহামকে বিপথে সরিয়ে নেয়ার পর ওটা থেকে ওঅরহেড ফিট করা একটা ক্রুজ মিসাইল চুরি করেছেন আপনারা।
তাই নাকি? জিজ্ঞেস করল খায়রুল কবির। কিভাবে?
তোমরা তোমাদের স্যাটেলাইট ব্যবহার করে ব্রিটিশ ফ্রিগেটকে চীন উপকূলে সরিয়ে নিয়ে গেছ, চুরি করা একটা অ্যাকসেস ডিভাইসের সাহায্যে….
রানার কথা শেষ হলো না, শুরু করল লীনা, ….আর ইনভেস্টিগেট করতে আসা দুটো চীন মিগকে আপনারা গুলি করে নামিয়েছেন, উদ্দেশ্য ছিল চীন আর ব্রিটেনের মধ্যে একটা….
আমরা আরও জানি, বলল রানা, চীন হুমকি দিয়েছে আজ মাঝরাতের মধ্যে ব্রিটিশ জাহাজ প্রত্যাহার করা না হলে তারা ওগুলোর ওপর হামলা চালাবে। চীন যদি হামলা না-ও করে, আপনারা চুরি করা ক্রুজ মিসাইলটা বেইজিঙে ফেলবেন, চীন যাতে লন্ডনে হামলা চালায়।
ভুল, মি. রানা, ভুল, সহাস্যে বলল ফাউলার।
আন্দাজে ঢিল ছুঁড়েছেন আপনারা, তবে ভুলটা করছেন অন্যখানে। ওই রকম একটা প্ল্যান আমরা করেছিলাম ঠিকই, কিন্তু সেটা বাতিল করা হয়েছে। এখন আমরা নিউক্লিয়ার ওঅরহেডটাকে ঢাকায় পাঠাব।।মাঝরাত পর্যন্ত অপেক্ষাও করব না, তার আগেই….
চমকে উঠল রানা, তবে সন্দেহ হলো ভুল শুনেছে কিনা। কি বললেন?
প্ল্যানটা বদল করা হয়েছে, মি. রানা, বললেন ফাউলার। বোমাটা ঢাকাতেই আমরা ফেলতে যাচ্ছি। তবে বলতে পারবেন না যে অকারণে। প্রথমে আপনি আমার এত সাধের রাজকীয় পার্টিটা পন্ড করে দিয়েছেন। তারপর ভাগিয়ে নিয়ে গেছেন আমার স্ত্রীকে। সবশেষে আমার কয়েকজন বিশ্বস্ত বডিগার্ডকে খুন করেছেন, আহত করেছেন আরও বেশি লোককে। থামুন, আমার কথা শেষ হয়নি। একা শুধু আপনাকে আমি শত্রু হিসেবে দেখছি, তা নয়। আমার অনুগত বন্ধু খায়রুল কবির আমাকে জানিয়েছেন,।আপনাদের বিসিআই নাকি দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন এই নীতিটাকে আদর্শ হিসেবে নিয়েছে। এখন কথা হলো, জেনারেল ফুয়াং চুর কাছ থেকে যে টেকনলজি পেয়েছি আমরা তার সাহায্যে আমাদের প্লেন বা জাহাজ পৃথিবীর কোন রেডারে ধরা পড়বে না। আর টেকনোটেরোরিস্ট মি. কবিরের কাছ থেকে পেয়েছি একটা প্রোবিং মেশিন সীঈল ও জিপিএস। এগুলোর সাহায্যে গভীর সমুদ্রের যে-কোন জাহাজকে আমরা কোর্স থেকে দূরে নিজেদের সুবিধেমত জায়গায় সরিয়ে আনতে পারব। এর তাৎপর্য কি বুঝতে পারছেন তো?
তাৎপর্য হলো, যে-কোন জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে সমস্ত কার্গো সরিয়ে আনতে পারব আমরা। এত লাভজনক ব্যবসা দুনিয়ায় আর দ্বিতীয়টি নেই। কিন্তু যেহেতু বিসিআই এ-সব বিষয়ে অনেক কিছু জেনে ফেলেছে, ব্যবসাটা আমরা নির্বিঘ্নে করতে পারব না। সেজন্যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি বাংলাদেশকে কেটে সাইজ করা হবে।
রানা কিছু বলার আগেই রিভলভিং চেয়ারটা ঘোরাল ফাউলার, প্যানেলের একটা বোতামে চাপ দিল। মনিটরে খবর পাঠিকাকে দেখা গেল, খবর পড়ছে, …আজ রাত নটার দিকে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার নিরীহ নাগরিকদের ওপর খোদার গজব নেমে
এসেছে। নিক্ষেপের উৎস সম্পর্কে কেউ কিছু বলতে পারছে না, তবে নিশ্চিতভাবে জানা গেছে একটা ব্রিটিশ ক্রুজ মিসাইল নিউক্লিয়ার ওঅরহেড সহ আঘাত হেনেছে ঢাকার জিরোপয়েন্টে। সেক্রেটারিয়েট, হাইকোর্ট, প্রথম স্টেডিয়াম, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, গোটা ক্যাম্পাস, পাঁচটা হাসপাতাল, কমলাপুর রেলস্টেশন, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল এবং শহরের সমস্ত উঁচু বিল্ডিঙ মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। বলাই বাহুল্য গণভবন আর বঙ্গভবনও এই তালিকায় আছে। ঢাকার বাইরে থেকে আমাদের রিপোর্টাররা জানিয়েছেন, প্রথম দশ সেকেন্ডের মধ্যে রাজধানীর পঞ্চাশ লাখ লোক শুধু শক ওয়েভেই মারা গেছে। ত্রিশ মাইল পরিধির মধ্যে আগুন ছাড়া আর কিছুই নাকি দেখা যাচ্ছে না। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও সিকিমে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদ বিশেষ অধিবেশন ডেকে…
এ-সব আপনার মিডিয়ার আগাম খবর, ঢোক গিলে বলল রানা। বানানো ও ভুয়া।
কিন্তু আপনাকে স্বীকার করতে হবে বর্তমানে আমিই দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষ, কারণ বানানো বা ভুয়া খবর বাস্তবে পরিণত করার ক্ষমতা রাখি।
সবচেয়ে শক্তিশালী পাগল, বিড়বিড় করল লীনা।
যতই শক্তিশালী হন, তারপরও তো আপনি নিজের আসল পরিচয় মুছে ফেলতে পারবেন না, বলল রানা। আপনার মা ছিল বেশ্যা। আপনি একটা বেজন্মা বড় হয়েছেন নর্দমায়। আপনি সবার উপহাসের পাত্র।
ঢাকা যখন শক-ওয়েভে ধ্বংস হয়ে যাবে, তখনও কি আপনি আমাকে উপহাস করবেন, মি. রানা?
হ্যাঁ, কারণ তখনও আপনি বেজন্মাই থেকে যাবেন বলল রানা, ফাউলারকে খেপিয়ে তোলার চেষ্টায়। আচ্ছাআপনার সঙ্গে খায়রুলের মত ঠাণ্ডা মাথার একটা সাপ রয়েছে, সে-ও বলেনি যে আপনি আসলে মানসিক প্রতিবন্ধী? বলেনি, স্যাডিস্ট মেনাচিমের চেয়েও অধম আপনি?
মনিবের এই অপমান মেনাচিম সহ্য করতে পারল না। মারমুখো হয়ে সামনে বাড়ল সে, অমনি রানা ও লীনার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। এক হাতে লীনাকে পেচাল রানা। সিকি পাক ঘোরাল, লীনা যাতে হাত লম্বা করে মেনাচিমের উরুতে গাঁথা লেটার ওপেনারটা ধরতে পারে। মাংস থেকে ওটা বের করেই কবিরের দিকে লাফ দিল সে, রানাকে টেনে নিচ্ছে। মেনাচিম যেই খপ করে ধরতে গেল রানাকে, কবিরের পাঁজরে ব্লেডটা ঢুকিয়ে দিল লীনা।
না! গর্জে উঠল ফাউলার। মেনাচিম স্থির হলো, কিন্তু রানার গতি আরও বেড়ে গেল। কাছাকাছি দাঁড়ানো একজন গার্ডের গলা হাত দিয়ে পেঁচিয়ে নিজের বুকে টেনে নিল ও। গার্ডের হাতে বিস্ফোরিত হলো মেশিন গান, কামরার চারদিকে এক পশলা বুলেট বৃষ্টি হলো। ফাউলারকে লক্ষ্য করে ডাইভ দিল মেনাচিম, মনিবকে বাঁচানোর জন্যে নিজেকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করবে, এই সময় কামরার ভেতর হুড়মুড় করে আরও কয়েকজন গার্ড ঢুকে পড়ল। সরাসরি রানাকে লক্ষ্য করে গুলি করল তারা।
মি. কবিরকে যেন গুলি না লাগে! চেঁচিয়ে উঠল ফাউলার।
রানা যাকে নিজের সামনে ধরে রেখেছে, গার্ডদের গুলি খেয়ে মারা গেল সে। আরও এক পশলা গুলি রানার পিছনের জানালা ভেঙে ফেলল, চুরমার হয়ে গেল শার্সির সমস্ত কাঁচ, বাইরে দেখা যাচ্ছে আকাশ ছোয়া সারি সারি বিল্ডিং। লীনাকে নিয়ে ধীরে ধীরে
পিছু হটছে রানা। লীনা রানার পাশেই রয়েছে, কবিরকে এখনও ছাড়েনি, হাতের লেটার ওপেনার এখনও কবিরের পাঁজরে গাথা।
সং সেজে দাঁড়িয়ে থেকো না! গার্ডদের উদ্দেশে চেচাচ্ছে ফাউলার। ওদের ধরো!
চারজন গার্ড ছুটে এল। জানালার কার্নিসে পিঠ ঠেকতে ঘাড় ফিরিয়ে নিচেটা একবার দেখে নিল রানা। তারপর দুজন মিলে ধাক্কা দিল কবিরকে। ভারী বস্তার মত গার্ডদের ওপর পড়ল কবির। ওই একই সময়ে হাতকড়া পরা দুই এজেন্ট জানালা দিয়ে লাফ দিল নিচে।
সরাসরি দশতলা থেকে নিচের রাস্তায় পড়ার কথা ওদের, তবে আগেই রানা দেখে নিয়েছে মাত্র বিশ ফুট নিচে সবুজ একটা নেট আছে। নেটের পাশে ঝুলছে প্ৰকাণ্ড একটা ব্যানার, তাতে ফাউলারের ছবি আঁকা।
এখান থেকে নামব কিভাবে? জিজ্ঞেস করল লীনা।
লীনার হাত থেকে লেটার ওপেনারটা নিয়ে ব্যানারটা চিরে ফেলল রানা, ফাউলার বিভক্ত হয়ে গেল। ছেড়া অংশটুকু বাম হাতে জড়াল রানা। অপর হাতে বুকে টেনে নিল লীনাকে, তারপর লাফ দিল নেট থেকে। ফড় ফড় করে ছিড়তে শুরু করল ব্যানার, সেই সঙ্গে ছেড়া প্রান্তটা ওদের দুজনকে নিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। তিনতলার একটা মাচায় নিরাপদেই নামল ওরা, সেখান থেকে মই বেয়ে পড়ল রাস্তায়। রাস্তায় প্রচুর লোকজন, ভাঙা জানালা থেকে উঁকি দিয়ে ওদের দুজনকে দেখতে পেলেও মেনাচিম বা তার গার্ডরা গুলি করতে সাহস পাচ্ছে না।
ফুটপাথ ধরে ছুটছে ওরা, না চাইতেই একটা ট্যাক্সি পাশে এসে দাঁড়াল। ট্যাক্সিতে ওঠার তিন মিনিট পর মাথার ওপর হেলিকপ্টারের আওয়াজ পেল রানা, তবে ধীরে ধীরে দূরে সরে গেল সেটা। সামনে থেকে চীনা ড্রাইভার বলল, সাহায্য করলাম আপনার বান্ধবী আমার স্বদেশী তাই। তবে বিনা পয়সায় নয়। শহরের ভেতর থাকলে পাঁচশো মার্কিন ডলারের কম নেব না।
আরও একশো ডলার বেশি পাবে, বলল রানা। তবে জেনে রাখো আমরা জাকার্তা পুলিসের বন্ধু।
তাহলে মিটারে যা ওঠে তাই দিলেই চলবে।
বকশিশ নেয়ার কোন অপরাধ নেই, মন্তব্য করল লীনা।
রানা বলল, লীনা, কথাটা আমি স্বীকার করছি।
লীনা অবাক। কি কথা?
ফাউলার মিথ্যে বলেনি। আমি সত্যি ব্যাংকার নই। বিসিআই এজেন্ট। তবে বিএসএস-কে সাহায্য করছি।
তাহলে আমাকেও সত্যি কথা বলতে হয়। আমার প্রসঙ্গেও ফাউলার মিথ্যে কথা বলেনি।
দেখা যাচ্ছে দুজন আমরা একই কাজ করছিলাম।
করছিলাম? এখন আর করছি না?
রানা বলল, না। কারণ ফাউলার তার প্ল্যান বদল করায় চীন আর ব্রিটেনের মধ্যে যুদ্ধটা বাধছে না। ফাউলারের টার্গেট এখন বাংলাদেশ। এটা এখন আমার একার অ্যাসাইনমেন্ট।
ইচ্ছে হলে আমাকে তুমি পার্টনার হিসেবে নিতে পারো, রানা, বলল লীনা। বলার সুরে সামান্য একটু আবেদনও থাকল। তোমার কাছাকাছি থাকতে আমার খারাপ লাগবে না।
সুন্দরী মেয়েদের এ-ধরনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা সত্যি খুব কঠিন হেসে উঠে বলল রানা। তার ওপর তুমি অত্যন্ত যোগ্য স্পাই। এক সেকেন্ড চিন্তা করল ও। আন্দাজ করছি, জাকার্তায় তোমার নিরাপদ কমিউনিকেশন লিঙ্ক আছে। ধার দেবে? আমার বসের কাছে জরুরী রিপোর্ট পাঠাতে হবে।
ঠিক আছে সে-ব্যবস্থা হবে। আর কোন সাহায্য?
ফাউলার যে রেডার টেকনলজি সম্পর্কে বলল , এ-সম্পর্কে কি জানো তুমি? জিজ্ঞেস করল রানা।
কান থেকে একটা ইয়ারিং খুলে রানার হাতকড়ার তালা খোলার কাজে ব্যবহার করল লীনা। দেখো, আমাকে পার্টনার হিসেবে নিলে কত লাভ তোমার। ইয়ারিংটা রানার হাতে ধরিয়ে দিল সে।
রানা লীনার হাতকড়া খুলছে, সে বলল, রেডার টেকনলজি সম্পর্কে অনেক কথাই জানি আমি। কেন?
মিগগুলোকে গুলি করে নামানো হয়েছে, কিন্তু নটিংহাম দায়ী নয়। তুমি তো দেখেছই। বড় একটা দ্রুজ মিসাইল গায়েব হয়ে গেছে, কিন্তু ছোটগুলোর একটাও ফায়ার করা হয়নি।
অথচ মিগগুলোর রেডারে ব্রিটিশ ফ্রিগেট ছাড়া আর কিছু ধরা পড়েনি।
নটিংহামের রেডারেও তোমাদের মিগ ছাড়া অন্য কিছু ধরা পড়েনি। কিন্তু নটিংহামকে তোমাদের মিগ ডোবায়নি। অবশ্য তোমরা যদি নতুন ধরনের টর্পেডো আবিষ্কার করে থাকো, যে গুলো বিস্ফোরিত হয় না, তাহলে আলাদা কথা।
না, আমাদের হাতে এমন টর্পেডো নেই যেগুলো বাঁক ঘুরতে পারে বা টর্পেডো রূমকে পাশ কাটিয়ে যায়।
তারমানে ওখানে অন্য কিছু একটা ছিল, সম্ভবত অদৃশ্য একটা বোট।
লীনা গম্ভীর হয়ে গেল। রাশিয়া এমন ধরনের লো-ইমিশন রেডার ডেভলপ করেছে, যেটা কোন প্লেনে ব্যবহার করলে অন্য কোনও রেডারে ওই প্লেন ধরা পড়বে না। যেভাবেই হোক, ওগুলোর একটা আমরা পেয়ে যাই। কিন্তু সেটা চুরি গেছে জেনারেল ফুয়াং চুর বেস থেকে। খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারি ওটা হামবুর্গে আছে। এভাবেই তোমার সঙ্গে আমার দেখা হলো।
আমি বাজি ধরে বলতে পারি, রেডারটা খায়রুল কবিরের হাত হয়ে ফাউলারের কাছে পৌছেছে, বলল রানা। আর ফাউলার তার নিজের একটা বোটে ওই রেডার ব্যবহার করছে।
আর আমি বাজি ধরছি, এরইমধ্যে ওই বোটে চড়ার জন্যে রওনা হয়ে গেছে ফাউলার।
রানার চেহারা থমথম করছে। মাথার চুলে আঙুল চালাল বলল, আমার ধারণা, আজ রাতে সন্ধের পর মাত্র এক ঘণ্টা সময় আছে আমার হাতে, তার আগেই বোটটা ডুবিয়ে দিতে হবে। বোটটা যেহেতু অদৃশ্য ক্রুজ মিসাইলটা ওতেই আছে।
আমি তোমার সঙ্গে একমত, বলল লীনা। তবে ভুলে যেয়ো না, চীন বাংলাদেশের বন্ধু, এই বিপদে তোমার সঙ্গে আমিও আছি। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে, রানা। চলো যাই, আগে আমাদের সেফ হাউসে উঠি।
জমজমাট একটা বাজারের মুখে ট্যাক্সি ছেড়ে দিল ওরা। লীনার সেফ হাউস বান্দুং ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে দেড় মাইল দূরে, একটা রিকশা গ্যারেজের ভেতর। গ্যারেজটায় ঘন্টা হিসেবে সাইকেলও ভাড়া পাওয়া যায়। একজোড়া সাইকেল নিয়ে পথে নামল ওরা, এ-রাস্তা সে-রাস্তা ঘুরল কিছুক্ষণ। যখন দেখল কেউ ওদের পিছু নেয়নি, আবার ফিরে এল গ্যারেজে। ভেতরের একটা দরজা খুলে সেফ হাউসে ঢুকল লীনা। রানা তাকে অনুসরণ করল। সেফ হাউস মানে বড় একটা কামরা। ভেতরে কমপিউটর, মনিটর, একাধিক টেলিফোন ও ভিডিও ক্যামেরা আছে। অস্ত্র ও রসদ বোঝাই একটা টেবিল ও কেবিনেটও দেখা গেল।
জাকার্তায় বাংলাদেশ সরকারের সব কটা অফিস বা রানা এজেন্সির শাখায় নজর রাখার ব্যবস্থা করবে ফাউলার, এটা ধরে নিয়ে লীনার সেফ হাউস থেকে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ করাটাই নিরাপদ বলে মনে করছে রানা। লীনা ওকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলল, ফোনটা একশো ভাগ নিরাপদ।
ঢাকা হেডকোয়ার্টারে ফোন করে অ্যাসিস্ট্যান্ট চীফ (অপারেশনালস) সোহেল আহমেদকে পেল রানা। পরস্পরের প্ৰাণপ্রিয় বন্ধু ওরা। তবে দুজনের কেউই আজ কৌতুক বা হালকা রসিকতার ধার দিয়েও গেল না। রানার রিপোর্ট শুনে পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পারল সোহেল, মুহুর্তমাত্র দেরি না করে জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) রাহাত খানের লাইন পাইয়ে দিল ওকে। বস ও রানার আলোচনার পর কি সিদ্ধান্ত হয় তার জন্যে অপেক্ষায় না থেকে ঢাকায় উপস্থিত সব কজন এজেন্টকে ডেকে পাঠাল অফিসে, যারা ছুটিতে আছে তাদের ছুটি বাতিল করল, তারপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফোন করে অনুরোধ করল পুলিস, বিডিআর আর
সামরিক বাহিনীর প্রধানদের নিয়ে এখুনি যেন একটা জরুরী মীটিং ডাকা হয়। সবশেষে প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট ও প্রধান বিরোধী দলীয় নেত্রী কে কোথায় আছেন জেনে রাখল। প্রয়োজনে ওদের সঙ্গে বিসিআই চীফ স্বয়ং কথা বলবেন।
টেলিফোনে রাহাত খানের সঙ্গে একমত হলো রানা, মাত্র কয়েক ঘন্টার নোটিশে ঢাকাবাসীকে শহর ত্যাগ করতে বলা হলে যে আতঙ্ক আর উন্মত্ততা দেখা দেবে তাতে হাজার হাজার মানুষ মারা যাবার আশঙ্কা আছে। ব্যস্ততার দরুন শুধু যে দুর্ঘটনা ঘটবে, তা নয়, এক শ্রেণীর সমাজবিরোধী লোক লুঠপাট আর ডাকাতিতেও মেতে উঠবে। তাছাড়া, আশি লাখ থেকে এক কোটি মানুষ ঢাকার বাইরে আশ্ৰয়ই বা নেবে কোথায়? আবার কাউকে কিছু না জানালেও পাইকারী হত্যাকাণ্ডের দায় দায়িত্ব বর্তাবে বিসিআই-এর উপর। সব দিক বিবেচনা করে রাহাত খান বললেন, সিদ্ধান্তটা রাজনীতিকদের ওপর ছেড়ে দেয়াই ভাল।
তবে, মূল সঙ্কট প্রসঙ্গে রানাকে তিনি নির্দেশ দিলেন, হাতে যখন এখনও কয়েক ঘণ্টা সময় আছে, যা করার একাই তোমাকে করতে হবে। আমি বলতে চাইছি, জাকার্তায় যেহেতু আমাদের আর কোন দক্ষ এজেন্ট নেই, যেভাবে পারো ওঅরহেড মিসাইল যাতে ওরা ছুড়তে না পারে সেটা নিশ্চিত করা তোমার দায়িত্ব। এক্ষেত্রে তোমার ব্যর্থতা আমাদের সর্বনাশ ঘটাবে।
রানা চুপ করে থাকল, উপলব্ধি করল ওর দীর্ঘ কর্মজীবনে এত কঠিন ভাষা আগে কখনও ব্যবহার করেননি বস।
আমার কথা স্পষ্ট তো, এমআর নাইন? কঠিন সুরে জিজ্ঞেস করলেন রাহাত খান।
রানা বলল, আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করব, স্যার।
সাধ্যমত চেষ্টা করা যথেষ্ট নয়। আমি তোমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি, লোকজনসহ ঢাকার চেয়ে তোমার প্রাণের মূল্য কিছুই নয়।
জ্বী-স্যার, বলল রানা। আমি তা জানি।
খুশি হলাম। এবার দেখা যাক, বাইরে থেকে কোন সাহায্য পাওয়া যায় কিনা। তোমার কোন পরামর্শ আছে?
স্যার, বলল রানা, চীনা উপকূলে ব্রিটিশ আর চীনের যুদ্ধ জাহাজগুলো প্রায় মুখোমুখি অবস্থায় রয়েছে। আপনি ওদেরকে আসল পরিস্থিতি সম্পর্কে জানালে ওদের মধ্যে যে ভুল বোঝাবুঝি চলছে তার অবসান ঘটবে। তারপর আপনি ওদের সাহায্যও
চাইতে পারবেন। ওদেরকে বলতে হবে ওরা যেন অ্যালার্ট থাকে। ধারণা করছি, ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিমের কোন দ্বীপ থেকে মিসাইলটা ছোড়া হবে। রয়্যাল নেভীর যুদ্ধজাহাজে সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল থাকার কথা। ফাউলারের ছোড়া মিসাইল ট্রেস করা সম্ভব হলে মাঝ আকাশে ওটাকে বাধা দেয়া অসম্ভব নয়।
ঠিক আছে, বুঝতে পারছি। মারভিন লংফেলোর মাধ্যমে ব্রিটিশ নেভীর সঙ্গে কথা বলছি আমি। বেইজিংকেও সতর্ক করে দিচ্ছি। কথা বলে আর সময় নষ্ট করব না। তোমার যা করার করো তুমি, কয়েকটা টেলিফোন সেরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছি আমি। গুড লাক, মাই বয়।
ক্ৰেডলে রিসিভার নামিয়ে রাখল রানা। লীনা বলল, ইন্দোনেশিয়ার চারধারে মোট ছটা দ্বীপ লীজ নিয়েছে ফাউলার। তার মধ্যে কোনটায় তার অদৃশ্য বোট আছে জানার উপায় কি? এরইমধ্যে সে বেইজিঙে, তার বসকে রিপোর্ট করেছে।
ইন্দোনেশিয়ার উত্তর-পশ্চিমে যদি কোন দ্বীপ লীজ নিয়ে থাকে, বেশিরভাগ সম্ভাবনা ওখান থেকেই মিসাইলটা ছোড়া হবে, বলল রানা। সরাসরি বাংলাদেশকে টার্গেট হিসেবে পাবার জন্যে।
তাহলে দেখতে হয় ওদিকে ফাউলারের কোন দ্বীপ আছে কিনা। একটা কমপিউটর টার্মিনালের সামনে বসল লীনা। আমাকে মন দিয়ে কাজ করতে দাও। এই ফাঁকে আমাদের কি কি লাগবে বেছে বের করো তুমি।
চোপসানো একটা জোডিয়াক বোট, ডাইভ ইকুইপমেন্ট একজোড়া .৩৮ অটোমেটিক পিস্তল, অ্যামিউনিশন, ম্যাগনেটিক লিমপেট মাইন ইত্যাদি বাছাই করল রানা। ওগুলো দুভাগে ভাগ করল, একটা লীনার জন্যে, আরেকটা নিজের জন্যে।
সুমাত্রার উত্তর-পশ্চিমে ফাউলার যে দ্বীপটা লীজ নিয়েছে সেটার নাম লীলাবতী। ওটা মাত্রা বে-তে।
উপকূল থেকে কত মাইল দূরে? জানতে চাইল রানা।
একশো বিশ মাইল, মনিটরে চোখ রেখে বলল লীনা।
এবার তাহলে চেক করে দেখো, লীলাবতীর কাছাকাছি অস্বাভাবিক কোন ঘটনার রেকর্ড পাওয়া যায় কিনা। সলিল সমাধির ঘটনা, জেলে নৌকার অ্যাক্সিডেন্ট ইত্যাদি।
কিছুক্ষণ পর মনিটরে সারি সারি চীনা হরফ ফুটল। শোনো,রানা, ইন্টারেস্টিং তথ্য। ওদিকটায় চারটে বোট নিখোঁজ হয়েছে, আর জেলে নৌকা ডুবেছে তিনটে, কিন্তু কোন কারণ জানা যায়নি। আমার তো বিশ্বাস, অদৃশ্য বোটটা লীলাবতী বা আশপাশের কোন দ্বীপেই রাখা হয়।
কামরার ভেতর অস্থিরভাবে পায়চারি শুরু করল রানা, জানে রাহাত খান এই মুহুর্তে অত্যন্ত ব্যস্ত, ফোনে তাকে পাওয়া যাবে না। আধ ঘণ্টা পর নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না, ঢাকার নম্বরে ডায়াল করল আবার। বিসিআই হেডকোয়ার্টারে রাহাত খান নেই, প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে তিন বাহিনী প্রধানের সঙ্গে মীটিঙে বসেছেন তিনি। মীটিংটা কোথায় বসেছে তা জানা না গেলেও, রাহাত খানের সঙ্গে রানার যোগাযোগ ঘটিয়ে দেয়া হলো। নতুন তথ্যটা বসকে জানাল রানা, ওর ধারণা মাত্রা উপকূল থেকে একশো বিশ মাইল উত্তর-পশ্চিমের দ্বীপ লীলাবতী বা ওটার আশপাশের কোন দ্বীপ থেকে দ্রুজ মিসাইলটা ছোড়া হবে।
ভেরি গুড, এই তথ্যটাই আমরা জানতে চাইছিলাম, বস ওকে বললেন। তোমাকেও কয়েকটা তথ্য দিই, এমআর নাইন। আমাদের একটা সুসজ্জিত গানবোট শুভেচ্ছা সফরে শ্রীলংকায় ছিল, এরই মধ্যে সেটা ইন্দোনেশিয়ার দিকে রওনা হয়ে গেছে। সুখবর হলো, আমাদের গানবোটে সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল আছে।
খানিকটা স্বস্তিবোধ করছি, স্যার।
বেইজিং আর লন্ডনের সঙ্গেও কথা বলেছি আমরা বললেন রাহাত খান। ম্যাডক ফাউলারের কারসাজি ওরাও ধরতে পেরেছে, ফলে দুই দেশের মধ্যে এখন আর কোন ভুল বোঝাবুঝির ব্যাপার। নেই। তবে ওদের যে জাহাজ বহর মুখোমুখি ছিল সেগুলো আমাদের কোন সাহায্যে আসবে না, দূরত্ব অনেক বেশি হয়ে যায়। তবে আরও একটা ভাল খবর হলো, ভারত মহাসাগরে ব্রিটেনের একটা ফ্ৰিগেট, এইচএমএস নরফোক রুটিন টহলে ছিল, অনুরোধ করায় সেটাও ইন্দোনেশিয়ার দিকে রওনা হয়ে গেছে।
স্যার, ঢাকা সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্ত হলো?
তুমি তোমার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকো, কঠিন সুরে বললেন রাহাত খান। এদিকে কি করা হবে আমরা দেখব। রিপোর্ট করার দরকার ছিল, করেছ। এবার নিজের কাজে বেরিয়ে পড়ো।
ইয়েস, স্যার!
ম্যাডক ফাউলার, খায়রুল কবির আর ডিক মেনাচিম সী ঈলের ভেতর দাঁড়িয়ে রওনা হবার প্রস্তুতি তদারক করছে। রেডারের চোখে অদৃশ্য এই বোট। কবিরের অধীনে ফাউলারের কারিগররা তৈরি করতে সময় নিয়েছে দুবছর। উপকূল থেকে একশো মাইল দূরে একটা পাথুরে দ্বীপের গুহার ভেতর লুকানো রয়েছে ওটা।
মাত্র কয়েক মিনিট আগে ব্যক্তিগত সী প্লেন নিয়ে এখানে পৌছেছে ফাউলার। জাকার্তা হেডকোয়ার্টার থেকে রানা ও লীনা পালাবার পর মিডিয়া সম্রাট বুঝতে পারে তার হাতে নষ্ট করার মত সময় নেই। চীন আর বাংলাদেশী এজেন্ট দুজন কি করতে পারে তা সে চাক্ষুষ করেছে, কাজেই আগে থেকে বলা মুশকিল আবার তারা কখন বা কোথায় মাথাচাড়া দেবে। অনেক গোপন তথ্যই
জেনে ফেলেছে ওরা। তবে সে ভয় পাচ্ছে না। প্ল্যান অনুসারে অপারেশনটা শেষ করা যাবে, এ বিশ্বাস তার আছে। তবুও রানা ও লীনা বাধা সৃষ্টি করতে পারে, এই আশঙ্কা টেনশনে ফেলে দিয়েছে তাকে। বার বার হাত তুলে চোয়ালের পেশী ডলছে। ডোজ বেশি হয়ে যাচ্ছে, তবু আরও দুটো ট্যাবলেট খেতে হলো।
মি. কবির, বলল সে, আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দুটো জিনিস প্রমাণ হয়ে যাবে–এক, সত্যি আপনি বিরল প্রতিভা কিনা দুই, আমার প্রতি আপনার আনুগত্য নির্ভেজাল কিনা।
হেসে উঠল কবির। আগেই জানিয়েছি–ঢাকা, বিসিআই বা মাসুদ রানা ধ্বংস হয়ে গেলে আমি কাঁদব না। তবে কেউ যদি আমার আনুগত্য পরীক্ষা করতে চায়, আমি প্রতিবাদ করব। কারণ, আমি আমার বাবার মতই স্বাধীনচেতা, আমাদের বংশে কারও বশ্যতা স্বীকার করা একেবারেই নেই। আপনি যদি আমাকে সম-মর্যাদায় বন্ধু হিসেবে চান, আমি রাজি।
ঠিক আছে, ভুলটা শুধরে নিচ্ছি, বলল ফাউলার। এটাকে তাহলে আমি বন্ধুত্বের পরীক্ষা হিসেবেই দেখব।
আর যদি প্রতিভার কথা বলেন, গর্বের সুরে বলল কবির, আমি মারা যাবার পর ওরা আমার মগজ নিশ্চয়ই কোন মিউজিয়ামে সংরক্ষণ করবে, এ-ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
তবে সেটা বাংলাদেশী কোন মিউজিয়াম হবে না, মন্তব্য করল ফাউলার। সী ঈলের ক্যাপটেনের দিকে ফিরল সে। তাড়াতাড়ি করুন, সূর্য ডুবতে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাকি।
সময় মতই প্রস্তুতি শেষ হবে, আশ্বস্ত করল ক্যাপটেন।
হাতে মেশিন গান নিয়ে এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে মেনাচিম। তার দিকে ফিরল ফাউলার। বোকার মত ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছ তুমি? রানা সম্পর্কে কিছু জানতে পারলে?
না, বস। আমরা যতটুকু জানি, এখনও সে জাকার্তায় আছে। দুঃখিত। আপনি চান আবার ওখানে আমাদের লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ করি? মাত্র কয়েক মিনিট আগে রিপোর্ট করেছে ওরা।
তুমি আমাকে হতাশ করলে, ডিক, ফাউলার তিক্ত সুরে বলল। ভেবেছিলাম ধরতে পারলে চীনা মেয়েটাকে তোমার হাতে তুলে দেব, কিন্তু এখন আর সে-কথা ভাবছি না…
বস, প্লীজ, এভাবে আমাকে বঞ্চিত করবেন না! অন্তত আরেকটা সুযোগ দিন আমাকে…
কবির বিড়বিড় করল, ধিক, মেনাচিম!
খুশি হই ওদেরকে যদি আর দেখতে না পাই। তবে ওরা যদি ধরা পড়ে, আর কৃতিত্বটা যদি তোমার হয়, তাহলে হয়তো উপহার হিসেবে মেয়েটাকে তুমি পেলেও পেতে পারো, বলল ফাউলার।
আপনি শুধু অপেক্ষা করুন, বস। ওদের চেহারা অবশ্যই আবার দেখা যাবে। আর ধরাও পড়বে আমার হাতে।
কিন্তু সাবধান, ডিক! এবার কিন্তু তোমার ব্যর্থতা আমি সহ্য করব না।
মেনাচিম হাসছে। রক্তারক্তি কান্ড পছন্দ করে সে, মৃত্যু তাকে আনন্দ দেয়, কিছু ধবংস করতে পারলে উল্লাস অনুভব করে। আজ রাতে এ-সবই ব্যাপক হারে ঘটবে বলে আশা করা যায়। বহু লোক মারা যাবে, বিস্ফোরিত হবে অসংখ্য জাহাজ। শোনা যাচ্ছে এক কোটি লোকবসতি সহ গোটা একটা শহর নাকি ধুলোর সঙ্গে মিশে যাবে। হিরোশিমা-নাগাসাকির পর এত বড় বিপর্যয় আর নাকি ঘটেনি। রীতিমত একটা ইতিহাস সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। সেই ইতিহাসে তার নামও থাকবে।
মেনাচিম হাসছে আপনমনে।
<