ল্যান্ড করার অনুমতি পাওয়ার আগে ইউএস এয়ার ফোর্স এসএইচ-গ্ৰী সী কিং হেলিকপ্টারটা ল্যান্ডিং প্যাডের মাথার ওপর বার কয়েক চক্কর দিল। মূল বেস থেকে খানিকটা দূরে প্যাডটা, ইউএস এয়ার ফোর্সের এক স্কোয়াড মিলিটারি পুলিস অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক পাশে, সঙ্গে দুজন সিভিলিয়ানও আছে। হেলিকপ্টারে একজন ভিআইপি আসছেন, তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যেই এই আয়োজন।

অনেক দিন পর আবার জাপানে এল রানা। এর আগে ওকিনাওয়া-তে মাত্র একবার এসেছে ও। সী কিং থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল ওকে, পরনে রয়্যাল নেভীর ইউনিফর্ম। ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের অনারারি উপদেষ্টা ও, ফিল্ডে ওদের এজেন্ট হয়ে কাজ করার জন্যে কাভার হিসেবে এখনও কমান্ডার পদটা ব্যবহার করতে দেয়া হয় ওকে। মিলিটারি পুলিসরা ওকে স্যালুট করল, সাড়া দেয়ার জন্যে খায়রুল কবিরের লাল বাক্সটা বাম হাতে নিল রানা।

সার্জেন্ট হুঙ্কার ছাড়ল, অ্যাট ঈজ!

দীর্ঘদেহী একজন সিভিলিয়ান, দেখেই বোঝা যায় সিআইএ, এগিয়ে এল। হাই, নারা। অনেক দিন পর দেখা। কথাটা ভুলিনি, তোমার কাছে আমি ঋণী লোকটার কথায় টেক্সাসের টান।

রবার্ট মিথের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করল রানা। অতীতে একসঙ্গে কাজ করেছে ওরা, রাশিয়ায়। সিআইএ-তে রানার অনেক শক্ৰ থাকলেও বন্ধুর সংখ্যাও কম নয়, রবার্ট মিথ তাদেরই একজন। রানার নাম উল্টো করে উচ্চারণ করা তার একটা উদ্ভট খেয়াল। তবে এজেন্ট হিসেবে প্রথম শ্রেণীর সে, সর্ব মহলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে।

ওটা তুমি আনতে পেরেছ? জানতে চাইল রানা।

মারভিন লংফেলো স্বয়ং আমাকে ফোন করেছেন, বাড়িতে, দাত বের করে হাসছে মিথ। এ যে আমার জন্যে কত বড় সম্মান! পাশে দাঁড়ানো দ্বিতীয় সিভিলিয়ানের দিকে তাকাল সে। নারা, ইনি ড. রেমন্ড, আমাদের ল্যাব প্রধান–ওঁর ল্যাবেই গোটা ব্যাপারটা তৈরি হয়েছে। ড. রেমন্ডের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করল রানা।

ঠিক আছে, রেমন্ড, বের করো ওটা, হাসিখুশি মিথ নির্দেশ দিল।

এমন আঁতকে উঠে মিথের দিকে তাকালেন রেমন্ড, মিথ যেন পাগল হয়ে গেছে। বের করব? এখানে? কি বলছ!

ঠোঁট টিপে অসহায় ভঙ্গি করল মিথ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা এয়ার ফোর্স বেসে রয়েছি আমরা। সঙ্গে রয়েছে বিশজন সশস্ত্র গার্ড। তুমিই বলো এখানে কি ঘটতে পারে?

এক সেকেন্ড চিন্তা করে মাথা ঝাকালেন রেমন্ড। এগিয়ে এসে সার্জেন্টকে কিছু বললেন। সার্জেন্ট সগর্জনে নির্দেশ দিল। গার্ডরা একটা আর্মারড ট্রাক থেকে নিচে নামাল। বড় আকৃতির একটা কার্ট।

রানাকে একপাশে টেনে নিল মিথ। তুমি তো ব্রিটিশদের বন্ধু। আচ্ছা বলো তো, কোন বুদ্ধিতে ওরা চীনের বিরুদ্ধে লাগতে যাচ্ছে? সংখ্যায় তারা এক বিলিয়ন বেশি, এটা ব্রিটিশরা ভুলে বসে আছে? চাইনীজ মিগ বেসের কাছাকাছি ছটা যুদ্ধ জাহাজ পাঠানো বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে।

এই একই কথা বলায় মারভিন লংফেলো চাকরি হারাতে যাচ্ছিলেন, জবাব দিল রানা।

আচ্ছা আচ্ছা তাই তো বলি–তারমানে সরকারের সঙ্গে সিক্রেট সার্ভিসের মতের মিল হচ্ছে না, কাজেই যা করার সিক্রেট সার্ভিসকে একা করতে হচ্ছে বুঝলাম।

ড. রেমন্ড ওদেরকে ডাকলেন, আসুন দেখে যান।

কার্ট-এর ওপর বসে রয়েছে একটা জিপিএস ডিভাইস। হুবহু এই রকমই একটা  নটিংহামেও ছিল। ডিভাইসটার পাশে একটা সেফ রয়েছে। সেটা খুলে ভেতর থেকে আরেকটা ডিভাইস বের করলেন ড. রেমন্ড–অ্যাটমিক ব্লক সিগন্যাল এনকোডিং সিস্টেম ডিভাইস। জিনিসটা কার্ট-এর ওপর রাখলেন তিনি। আঁতকে ওঠার জন্যে দুঃখিত, তবে কথা হলো এই যে যুক্তরাষ্ট্র সরকার অত্যন্ত সতর্ক প্রহরায় যে-কটা জিনিস গোপন রেখেছে, এটা তার মধ্যে অন্যতম, গম্ভীর সুরে বললেন এই ডিভাইস মাত্র বাইশটা..আ-আ-আ-আ! এমন চিৎকার জুড়ে দিলেন, হঠাৎ যেন বিষধর সাপ দেখেছেন।

লাল বাক্স থেকে নিজের অ্যাকসেস ডিভাইসটা বের করে প্রথমটার পাশে রাখল রানা।

মাই গড! মিথের চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল।

এটা হলো তেইশ নম্বর, বলল রানা। সিআই-কে আমার তরফ থেকে উপহার। এটা তুমি রেখে দিতে পারো, মিথ, তবে এখন থেকে আমার নাম ঠিকভাবে উচ্চারণ করতে হবে।

বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে নিয়ে নিজের জিপিএস ইকুইপমেন্টে দুটো অ্যাকসেস ডিভাইসই ফিট করলেন ড. রেমন্ড। রানা ও মিথ তার কাধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে থাকল। জ্যান্ত হয়ে উঠল মনিটর। একটার ওপর একটা, দুটো বৃত্ত ফুটল স্ক্রীনে, তবে  হুবহু এক নয় দুটো। কেউ এটার ওপর কারিগরি ফলিয়েছে,বললেন রেমন্ড। দেখুন।

ওটা কি একটা জাহাজকে কোর্স থেকে দূরে নিয়ে যেতে পারে? জানতে চাইল রানা।

হ্যাঁ, বললেন রেমন্ড। এই সিগনাল আপনি যদি একটা স্যাটেলাইট থেকে পাঠাতে পারেন।

ডোবার সময় ক্যাপটেনের ধারণা অনুসারে জাহাজটা কোথায় ছিল তা যদি আপনাকে আমি জানাই, আপনি বলতে পারবেন আসলে ঠিক কোথায় ওটা ডুবেছে?

কোন সমস্যাই নয়।

ভুলের মার্জিন খুব অল্প পরিসরের মধ্যে হতে হবে, বলল রানা। ধরুন, এখান থেকে রানওয়ের কিনারা।

তারমানে পঞ্চাশ গজের মত। হাত দুটো তুলে একটা মাপ দেখালেন রেমন্ড, বড় একটা মাছের আকৃতি। এরচেয়ে বেশি এদিক ওদিক হবে না।

তাহলে তো দারুণ! মিথের দিকে ফিরল রানা। ওহে আমার আরও একটা উপকার করতে হবে।

ইউএস এয়ার ফোর্সের সি-ওয়ানহানড্রেড থারটি সী লেভেল থেকে পাঁচ মাইল ওপরে উঠে এসেছে, ম্যাক্সিমাম সিলিঙ-এর কাছাকাছি। ওকিনাওয়া থেকে সকালে রওনা হয়েছে ওরা, এখন দুপুর, পৌছে গেছে দক্ষিণ-পূব এশিয়ার এয়ার স্পেসে।

খোলা দরজার কাছে ডাইভিং গিয়ার পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে রানা, বুকে স্ট্রাপ দিয়ে আটকানো ফিন আর পিঠে একটা প্যারাস্যুট। দুই কব্জিতেও দুটো ডিভাইস রয়েছে–অলটিমিটার ও জিপিএস রিসিভার।

চীন আর ব্রিটিশ জাহাজের রেডারকে ফাকি দেয়ার জন্যে পাঁচ মাইল ওপর থেকে জাম্প করতে হবে রানাকে, ওই একই কারণে প্যারাস্যুট খুলতে হবে পানির কাছাকাছি নামার পর।

আর দশ সেকেন্ড! ঘোষণা করল পাইলট।

গুনে গুনে দশ সেকেন্ড পর প্লেন থেকে লাফ দিল রানা।

মেঘের ওপর পরিবেশটা বরফ বললেই হয়। লাফ দেয়ার সময় চোখ বুজে ছিল রানা, বিশ সেকেন্ড পর চোখ খুলে প্রথমেই কজিতে বাধা অলটিমিটারের দিকে তাকাল। কাটাটা জিরো-র দিকে সরে যাচ্ছে। এরপর তাকাল জিপিএস ডিভাইসটার দিকে। ক্রীনে ক্রস হেয়ার টার্গেট আছে, লাল একটা আলোকিত বিন্দু সেন্টার থেকে অনেক দূরে মিটমিট করছে।

শূন্যে শরীর ঝাকিয়ে টার্গেটের কাছাকাছি যাবার চেষ্টা করল রানা। ধীরে ধীরে ক্রস হেয়ার সেন্টারের দিকে লাল বিন্দুটা এগোল, এই মুহুর্তে মেঘের ভেতর ঢুকছে ও। মেঘের এক একটা স্তুপ আকারে বহুতল ভবনের মত, সেগুলোকে ভেদ করে নিচে খসে পড়ছে শরীরটা। হঠাৎ করেই খুলে গেল মেঘের পর্দা, চোখ ধাধানো নীল সাগর দেখা গেল নিচে। অবিশ্বাস্য বেগে ছুটে আসছে ওর দিকে।

প্যারাস্যুট খুলতেই একটা ঝাকি খেলো রানা। পতনের গতি অকস্মাৎ কমে গেল। তারপরই পানিতে পড়ল ও, একদম খাড়াভাবে। ছলকে উঠল পানি, তবে আশপাশে কোন মানুষজন বা জলযান নেই। যে ওকে দেখতে পাবে।

মাথা ওপরে, নিচে পা, এভাবে একশো ফুট নামার পর নিজেকে উল্টো করে নিল রানা। তারপর ফিন আটকাল পায়ে। দৃষ্টিসীমা মাত্র ছয় মিটারের মত। জলজ প্রাণীর সংখ্যা খুব বেশি নয়, কারণটা সম্ভবত পরিবেশ-দূষণ। শব্দ বলতে নিঃশ্বাস ফেলার ফলে মাউথপীস থেকে বেরুনো বুদ্বুদের ছন্দোবদ্ধ বিস্ফোরণ। অচেনা অদ্ভুত এক জগতে বহিরাগত ও সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ লাগছে নিজেকে। রানা ধারণা করল মহাশূন্যে বিচরণ করার সময়ও এই একই অনুভূতি হবে ওর।

কিন্তু জাহাজটা কোথায়? এখানেই কোথাও থাকার কথা ওটার। ওর আর মারভিন লংফেলোর সন্দেহ যদি মিথ্যে হয়, তাহলে তো নটিংহাম ডোবার জন্যে চীনকেই দায়ী করতে হবে। অলটিমিটারের দিকে তাকাল রানা, দুশো মিটার মার্কে পৌঁছুতে যাচ্ছে।

আরও গভীরে নেমে এসে খোজাখুঁজি শুরু করল ও। কাছাকাছি আসতে প্রবাল বা পাথরের মত একটা স্তুপ দেখা গেল। তারপর বোঝা গেল, না, ওটা আসলে একটা বিধস্ত মিগের নাক। সাগরের মেঝেতে আরও সব ভাঙা টুকরো ছড়িয়ে রয়েছে। পরীক্ষা করে দেখল রানা, মিসাইল আঘাত হানার সমস্ত লক্ষণ স্পষ্ট চোখে পড়ল। প্লেনের বাকি অংশের খোঁজ পাওয়া গেল না।

নাকটার পিছন দিয়ে ককপিটে ঢুকল ও। সীটেই রয়েছে পাইলট, ট্রাপ দিয়ে আটকানো। হাত দুটো পানিতে ভাসছে, দেখে মনে হচ্ছে উড়তে চায়। ছোট মাছেরা চোখ দুটো খেয়ে ফেলেছে। উইন্ডক্রীন আর কন্ট্রোল প্যানেল চুরমার হয়ে গছে।

মিগটাকে পাওয়ায় ওর আর বিসিসি চীফের সন্দেহ সত্যি প্রমাণিত হলো। নটিংহাম যেখানে আছে বলে দাবি করেছিল চীনারা সেখানেই ওটা ডুবেছে। ভুল তথ্য দিয়ে বিপথে আনা হয় তাদের, তারা মনে করেছিল আরেক জায়গায় আছে। এর জন্যে যদি ফাউলার দায়ী হয়, তার উদ্দেশ্যটা কি? চীন ও ব্রিটেনের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়ে কি লাভ তার? তাহলে কি গুজবটা সত্যি? হঙকঙ হস্তান্তর হওয়ায় খেপে গেছে ফাউলার? রানা তা বিশ্বাস করে না। এর পিছনে অন্য কোন কারণ অবশ্যই আছে। ফাউলারকে যতটুকু চিনেছে ও, লোকটা শুধু টাকা আর ক্ষমতা বাড়াবার ব্যাপারে আগ্রহী।

ককপিট থেকে বেরিয়ে এসে আবার সাগরের তলায় খোজাখুঁজি শুরু করল রানা। সামনে গাঢ় রঙের একটা আকৃতি লক্ষ্য করে একঝাক মাছকে ছুটতে দেখল ও। কৌতুহল হওয়ায় নিজেও এগোল সেদিকে। ছোট একটা পাহাড়ের চূড়া মনে হলো আকৃতিটাকে। তবে কাছে আসতে পরিষ্কারই চেনা গেল। জাহাজটাকে পেয়েছে রানা। এইচএমএস নটিংহাম কাত হয়ে পড়ে রয়েছে সাগরের তলায়। পাশেই গভীর একটা খাদের কিনারা।

হ্যালোজেন টর্চ জ্বেেল ফ্রিগেটটার দিকে এগোল রানা। ওটার ভেতরে ঢোকার আগে ডাইভ কমপিউটর চেক করে নিল। সারফেস থেকে তলায় নামতে তিন মিনিট লেগেছে, মিনিট পাঁচেক ব্যয় হয়েছে মিগের ককপিটে। খুব বেশি হলে আর দশ মিনিট সাগরের তলায় থাকতে পারবে। বেন্ড-এর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে হলে থেমে থেমে সারফেসের দিকে উঠতে হবে ওকে, পঁয়তাল্লিশ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা সময় নিয়ে। নটিংহাম কাত হয়ে থাকায় ভেতরে ঢোকার পর দিশেহারা বোধ করল রানা। চেয়ার টেবিলগুলো পাশের দেয়ালে গাঁথা। দেয়ালটাই এখন মেঝে। কয়েকটা দরজাকে পাশ কাটাল ও। কি ধরনের ক্ষতি হয়েছে দেখার পর একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেল, এ-সবের জন্যে কোন টর্পেডো দায়ী নয়। টর্পেডো বাক ঘোরে না, সিড়ি বেয়ে ওঠা-নামাও করে না। করিডরগুলো ক্ষতবিক্ষত, যেন প্ৰকাণ্ড কোন সামুদ্রিক দানব দাঁত দিয়ে ভেঙেচুরে নিজের পথ করে নিয়েছে, কিংবা কোন ড্রিল মেশিন ক্ষতবিক্ষত করেছে জাহাজটাকে। শুধু তাই নয়, সেটা এমন একটা ঢিল, যেন তার নিজস্ব চোখ বা বুদ্ধি আছে, জানত কোথেকে কোথায় যাচ্ছে।

একটা সিঁড়ি বেয়ে অন্ধকারে ডুব দিল রানা। টর্চের হলদেটে আলো ভৌতিক একটা পরিবেশ তৈরি করল, ছায়াগুলো জ্যান্ত প্রাণীর মত নড়াচড়া করছে। খাদের কিনারায় থাকায় মাঝে-মধ্যে নিজে থেকেই নড়াচড়া করছে ফ্রিগেট। রানার ভয় হলো, ওর নড়াচড়ায় ভারসাম্য হারিয়ে যেতে পারে, সেক্ষেত্রে ওকে নিয়েই অতল গহবরে খসে পড়বে জাহাজটা। লোয়ার ডেকের মেইন করিডর ধরে এগোচ্ছে ও, উদ্দেশ্য মিউনিশন রুমে যাওয়া। ভেতরে ঢোকার আগে বড় একটা ধাতব বাক্স পা দিয়ে ঠেলে সরাতে হলো। দরজাটা ভাঙা, ঢুকতে আর কোন বাধা নেই। কিন্তু পা বাড়াতেই ওর সামনে চলে এল একটা হাত। চমকে উঠে হাতটার কজি চেপে ধরল রানা, তারপর মোচড়াতে গিয়ে উপলব্ধি করল হাতটা আসলে মরা এক নাবিকের। লাশটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকল ও।

ভেতরে আরও অনেক লাশ ভাসছে। ঝাক ঝাক ছোট মাছ খাচ্ছে ওগুলোকে। টর্চটা ঝাকাতে ছুটে পালাল তারা। আরেকটা দরজা পেরিয়ে মিউনিশন রুমে ঢুকল রানা, ড্রিল মেশিনের দাগ এখানে এসে থেমে গেছে। টর্চের আলোয় ছটা ক্রুজ মিসাইল দেখল রানা। তবে কাছাকাছি প্যাডটা, সাত নম্বর, খালি  ক্ল্যাম্পগুলো পরীক্ষা করল রানা, ওয়েল্ডারের টর্চ দিয়ে কাটা হয়েছে ওগুলো। আচ্ছা তাহলে এই ব্যাপার! এখন আর ব্যাপারটাকে সাধারণ সঙ্কট বলা যাবে না। যে-ই দায়ী হোক, তার হাতে এখন একটা ক্রুজ মিসাইল আছে। রানা যেহেতু এসপিওনাজ এজেন্ট, ওর জানা আছে ব্রিটেনের ফ্রিগেট শ্রেণীর যুদ্ধজাহাজে অন্তত একটা ক্রুজ মিসাইলে নিউক্লিয়ার ওঅরহেড থাকেই।

সাগরের তলায় রানার কাজ শেষ হয়েছে। এখন ওর কাছে প্রমাণ আছে ডোবার সময় নটিংহাম আসলেই আঞ্চলিক জলসীমার ভেতর ছিল। আরও জানা গেছে কোন চীনা মিগ মিসাইল ছুড়ে ফ্রিগেটটাকে ডোবায়নি। টর্চ উঁচু করে কামরাটা থেকে বেরিয়ে আসতেই একটা স্পিয়ার গানের ডগা ঠেকল ওর বুকে, গানের অপরপ্রান্তে রহস্যময় এক ডাইভার। আগন্তুকের এক হাতে স্পিয়ার গান, অপর হাতে টর্চ।

দুই হাত উঁচু করল রানা। বোঝাতে চাইল সে নিরস্ত্র, সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে পিছাতে শুরু করল। রহস্যময় ডাইভার এখনও ওর বুকের দিকে ম্পিয়ার গান তাক করে আছে। স্যাৎ করে একটা অন্ধকার প্যাসেজে ঢুকে পড়ল রানা, দেয়ালে বসানো পিস্তল-বক্স থেকে ঝট করে একটা গান তুলে নিল হাতে। ডাইভারের দিকে একটা ফ্লেয়ার ফায়ার করল ও। আগন্তুকের চোখ ধাধিয়ে গেল। ঝট করে সামনে এগিয়ে ম্পিয়ার গানটা কেড়ে নিল রানা, টান দিয়ে খুলে নিল ফেস মাস্ক।

লীনা ওয়াংকে চিনতে পেরে হাঁ হয়ে গেল রানা। লীনাও কম অবাক হয়নি। ফেস মাস্কটা পরতে সাহায্য করল রানা, তারপর হাত তুলে ওপর দিকটা দেখাল। ইঙ্গিত বুঝতে পেরে মাথা ঝাকাল লীনা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সারফেসে পৌঁছুতে হবে ওদেরকে। বরাদ্দ সময় শেষ হয়ে আসছে।

জাহাজ থেকে বেরিয়ে ওপরে ওঠার সময় চল্লিশ ও ত্রিশ ফুটে কয়েক মিনিট করে থামল ওরা। বিশ ফুটে থামল ত্ৰিশ মিনিট। অবশেষে দুজন একসঙ্গে পানির ওপর মাথাচাড়া দিল। গরম রোদ লাগল মুখে।

ব্যাংকিং ব্যবসার এই এক মজা বলল রানা। যেখানে খুশি বেড়ানো যায়।

হেসে উঠে লীনা বলল, তবে খরচের দিকটাও মনে রাখা দরকার। তা না হলে কোম্পানী দেউলিয়া হয়ে যাবে। ইঙ্গিতে একটা চাইনীজ জাঙ্ক দেখাল রানাকে, কাছাকাছি ভাসছে। লীনাকে নিতে আসছে ওটা।

জাঙ্কটা সাধারণ একটা চীনা বোট। পোল মাস্ট খুব উঁচু। ডেকের কিনারায় একজন চীনাকে দেখা গেল, লীনার উদ্দেশে হাত নাড়ছে। রানা ভাবল, লীনার সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ায় ভালই হলো। রবার্ট মিথ কথা দিয়েছিল ওকে পানি থেকে তুলে নেবে ভিয়েতনামী একটা জেলে নৌকা, মাঝি লোকটা সিআইএ-র কাজ করে। কিন্তু আশপাশে আর কোন বোটই দেখা যাচ্ছে না। মিথ হয়তো মাঝির সঙ্গে সময়মত যোগাযোগ করতে পারেনি।

জাঙ্কটা কাছে চলে এল। চীনা লোকটা একটা লাইন ছুড়ে দিল পানিতে। লীনার সঙ্গে চীনা ভাষায় দুএকটা কথা বলল সে। তারপর হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্ৰপাতের মত, লোকটার বুক বিস্ফোরিত হলো, চারদিকে তীরবেগে ছুটে গেল রক্ত আর ছিন্নভিন্ন মাংস। তার পিঠ দিয়ে ঢুকে বুক চিরে বেরিয়ে এসেছে  একটা হার্পুন। চেহারায় অবিশ্বাস, ডেকের কিনারা থেকে ঢলে পড়ল লোকটা। পানিতে পড়ার আগেই মারা গেছে।

লোকটার পিছনে ছিল মেনাচিম, হাতে স্পিয়ার গান নিয়ে ডেকের কিনারায় এসে দাঁড়াল সে।

হাতকড়া পরাবার আগে ওদেরকে শুকনো কাপড় পরার অনুমতি দেয়া হলো। লীনার কাপড়চোপড় বোটেই ছিল–কালো ট্রাউজার, সাদা টি-শার্ট, লাল জ্যাকেট ও টেনিস শূ। রানাকে পরতে হলো নিহত এক নাবিকের নীল লিনেন শার্ট, কালো ট্রাউজার, টেনিস শূ। জুতো জোড়া সাইজে একটু ছোট হলো।

আমরা এখন ভ্রমণে বেরুব, হাসি হাসি মুখ করে বলল মেনাচিম।

কোথায় যাচ্ছি? জানতে চাইল রানা।

মি. ফাউলার আপনার সঙ্গে গল্প করতে চেয়েছেন। আমরা জাকার্তা হেডকোয়ার্টারে যাচ্ছি।&&

এই বোট নিয়ে ইন্দোনেশিয়ায় যাব?

কথা না বলে চুপচাপ বসে থাকুন! ধমক দিল মেনাচিম, স্পিয়ার গানটা তাক করল রানার দিকে। বোটের ডেকে বসে পড়ল ওরা। জার্মান স্যাডিস্টের পেশীতে ঢিল পড়ল। একটা হেলিকপ্টার আসছে। ঘুরে দুজন লোককে কাছে ডাকল সে, প্রত্যেকের হাতে একটা করে অটোমেটিক। কি নিয়ে আলাপ করছে বোঝা গেল না, তবে তিনজনই গলা ছেড়ে হেসে উঠল।

বোঝাই যায়, বোটের চীনা ক্রুদের সবাইকে খুন করেছে ওরা, লাশগুলো ফেলে দিয়েছে সাগরে। সংখ্যায় ওরা মাত্র তিনজন, কাবু করা কি একেবারেই অসম্ভব? চিন্তা করছে রানা। না, পালানোর চেয়ে ফাউলারের মুখোমুখি হওয়াটাই বেশি দরকার। লোকটার উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে।

নটিংহামে তো আপনিও ঢুকেছিলেন, খানিক পর লীনাকে জিজ্ঞেস করল রানা, কি দেখলেন?

একটা মিসাইল নেই। গর্তগুলো দেখে মনে হলো টর্পেডোর কাজ…

 

টর্পেডোই যদি হবে, এতসব ভাংচুরের পর বিস্ফোরিত হল না কেন? তাছাড়া, টর্পেডো কি বাক ঘুরতে পারে?

ভুরু কুঁচকে চিন্তা করছে লীনা। তাই ত!

কোন কথা নয়, একদম চুপ! ধমক দিল মেনাচিম।

বোট ছুটছে, সময় বয়ে যাচ্ছে। বিকেল হতে আর বেশি দেরি নেই। জার্মান ভাষায় নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে ওরা, জানা গেল যুদ্ধ জাহাজের বহরকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য ব্রিটেনকে বার ঘন্টা সময় দিয়েছে চীন।

<

Super User