হাতের ওয়াটারপ্রুফ ঘড়ির দিকে তাকাল রবিন। পঁচিশ মিনিট।

পঁচিশ মিনিট ধরে রোভারের গান বাজাচ্ছে সে। আর পাঁচ মিনিট পরেই শেষ হয়ে যাবে ফিতে, আবার শুরুতে পেঁচিয়ে এনে তারপর প্লে করতে হবে।

পানিতে নেমে উবু হয়ে পানির নিচে ধরে রেখেছে বাক্সটা। একবার এপায়ের ওপর ভর রাখছে, একবার ও-পায়ের ওপর। পা নাড়াতেই হচ্ছে, নইলে যা ঠাণ্ডা পানি, জমে যেতে চায়। বাকা হয়ে থাকতে থাকতে কোমর ধরে যাচ্ছে।

সামান্য সোজা হলো রবিন। এই সময় দেখতে পেল তীর থেকে শ-খানেক গজ দুরে স্থির পানিতে মৃদু নড়াচড়া, নিচ দিয়ে ড় কিছু একটা আসছে, ওখানকার পানি অস্থির। সত্যিই দেখছে তো, নাকি কল্পনা?

না, সত্যিই দেখছে। আবার দেখা গেল নড়াচড়া। এবার বেশ জোরে। উত্তেজনায় পা নড়াতে ভুলে গেল রবিন। সাগরের দিকে চেয়ে আছে, চোখে পলক পড়ছে না।

সবার আগে চোখে পড়ল ধাতব বাক্সটা। রবিনের মাত্র কয়েক ফুট দূরে ভেসে উঠল। মুহূর্ত পরেই ভুসস করে ভাসল রোভারের মাথা। নিঃশব্দে ভেসে চলে এল রবিনের কাছে, হাঁটুতে নাক ঘষল।

রোভার! রোভার! ঠাণ্ডার তোয়াক্কাই করল না রবিন, ঝাপিয়ে পড়ল পানিতে, তিমিটাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগল। রোভার, দিয়েছ কাম সেরে।

রবিনকে দেখে রোভারও খুশি। শরীর উঁচু করে, লেজের ওপর প্রায় দাঁড়িয়ে

সরি, রোভার, আন্তরিক দুঃখিত মনে হলো রবিনকে, তোমাকে ধোকা দিয়েছি।

ভাবছে সে-পথের শেষে কি দেখবে আশা করেছিল তিমিটা? আরেকটা তিমি? নিজের কণ্ঠস্বর চিনতে পেরেছিল? নাকি স্রেফ কৌতূহল? দূরে নিজের কণ্ঠ শুনলে রবিনের যে-রকম লাগবে, তেমনি কোন ব্যাপার?

কিছু মনে কোরো না, রোভার। লক্ষ্মী ছেলে। দাঁড়াও তোমার লাগাম খুলে দিই, তারপর খুশি করে দেব তোমাকে।

সকালে আসার সময় এক বালতি মাছ নিয়ে এসেছে টিনহা।

কয়েক সেকেণ্ডেই রোভারের লাগাম খুলে নিল রবিন, বাক্সটা খুলে নিল। আরে, বেশ ভারি তো! তবে আরও অনেক গরি হবে মনে করেছিল সে। দাঁড়াও এখানে। আমি তোমার খাবার নিয়ে আসছি।

দু-হাতে বাক্সটা বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে ঘুরল সে, উঠে আসতে শুরু করল পানি থেকে।

শুকনো বালিতে প্রায় পৌঁছে গেছে, এই সময় চোখে পড়ল লোকটাকে। সৈকতের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে এদিকেই চেয়ে আছে।

লম্বা, গায়ে উইণ্ডব্রেকার, চোখের ওপরে নামিয়ে দিয়েছে হ্যাট। প্রথমেই লোকটার কাঁধ দৃষ্টি আকর্ষণ করল রবিনের। তারপর অস্বাভাবিক মোটা বাহু।

এগিয়ে আসতে শুরু করল লোকটা। অবাক কাণ্ড! মুখ কোথায়? আরও কাছে আসার পর বোঝা গেল, মাথার ওপর দিয়ে নাইলনের কালো মোজা টেনে দিয়েছে।

শুড, বলল লোকটা। দাও, কেসটা দাও। কেসটা উচ্চরণ করল কেস

চেনা কণ্ঠস্বর, আগেও শুনেছি রবিন, এই লোকই ফোন করেছিল তাদেরকে, একশো ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। কিশোরকে কিডন্যাপ করেছিল। মুসা এর পেটে তো মেরেই চিত করে ফেলেছিল মড়মড়ে কাঠের মেঝেতে।

দাও, হাত বাড়াল লোকটা। দ্রুত এগিয়ে আসছে, মাত্র দুই গজ দূরে রয়েছে।

চুপ করে রইল রবিন। কি বলবে? বাক্সটা আরও শক্ত করে বুকে চেপে ধরে পিছিয়ে আসতে শুরু করল।

দাও। গতি বাড়াল লোকটা।

হাঁটু পানিতে চলে এসেছে রবিন। লোকটাও কাছে এসে গেছে। থাবা দিয়ে ক্সটা ছিনিয়ে নিতে গেল।

আরও পিছানোর চেষ্টা করল রবিন, কিন্তু তার আগেই বাক্স ধরে ফেলল দৈত্যটা। রবিনের হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে চাইল।

বাক্স ছাড়ল না রবিন, বুঝতে পারছে, লাভ হবে না। লোকটার বুক আর বাহুর আকার দেখে হতবাক হয়ে গেছে। ওর সঙ্গে পারবে না সে।

কিন্তু সহজে বাক্স ছাড়ল না। টানাহেঁচড়া চলল, পিছিয়ে আসছে সে ধীরে পীরে। কোমর পানিতে চলে এল। লোকটা তার গায়ের ওপর এসে পড়েছে। চাপ আরেকটু বাড়লেই চিত হয়ে পড়ে যাবে, তার ওপর পড়বে দৈত্যটা। তখন আর বাক্স না ছেড়ে পারবে না।

ভারসাম্য হারাল রবিন। এই অবস্থায়ই দেখতে পেল, উঠতে শুরু করেছে লোকটার শরীর। হঠাৎ প্রচণ্ড ঝাকুনি দিয়ে শূন্যে উঠে পড়ল, চার হাত-পা ছড়িয়ে চিত হয়ে ঝপাস করে পড়ল পানিতে। তার নিচেই দেখা গেল তিমির প্রকাণ্ড মাথা।

ঝাড়া মেরে আবার লোকটাকে শূন্যে তুলে ফেলল রোভার। অতি সহজে। টেনিস বল লোফালাফি করছে যেন বাচ্চা ছেলে। বার বার ছুঁড়ে মেরে তাকে নিয়ে চলল গভীর পানির দিকে।

চেঁচাচ্ছে দৈত্যটা, সাহায্যের জন্যে। পানিতে দাপাদাপি করছে, ভেসে থাকার চেষ্টায়।

আবার লোকটার পিঠের নিচে মাথা নিয়ে গেছে রোভার, শূন্যে ছুঁড়বে আবার। চেঁচামেচিতে থমকে গেল। পানি থেকে মাথা তুলে স্থির দৃষ্টিতে দেখল এক মুহূর্ত, তারপর তীরের দিকে ঠেলে আনতে শুরু করল লোকটাকে।

ভেসে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে লোকটা, পারছে না। বুকে যেন জগদ্দল পাথর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, তারের চোটে তলিয়ে যাচ্ছে পানিতে। হাত-পা ঘেঁড়াছুঁড়ি করে ফল হচ্ছে না।

এই খানিক আগেও পরম শত্রু ভেবেছিল লোকটাকে রকি। কিন্তু এখন দুঃখ হচ্ছে তার জন্যে। তার ডুবে মরা দেখতে পারবে না চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে।

সৈকতে উঠে এক দৌড়ে এসে একটা পাথরের আড়ালে আগে বাক্সটা লুকাল সে। তারপর আবার ছুটে ফিরে এসে নামল পানিতে।

এতক্ষণে প্রায় ডুবেই গেছে নোকটা। পানির ওপরে রয়েছে শুধু মোজায় ঢাকা মুখ। তার পাশে ভাসছে রোভার। চোখে বিস্ময়।

ওর নিচে ঢোকো, নোভাৱ, রবিন বলল। ভাসিয়ে রাখতে পারো কিনা দেখো।

তিমিটা তার কথা বুঝল কিনা কে জানে, কিন্তু রবিন যা বলল ঠিক তা-ই করল। না বললেও বোধহয় করত। তিমি আর ডলফিনের স্বভাব এটা-ডুবন্ত মানুষকে ঠেলে তুলে তীরে পৌঁছে দিয়ে যাওয়ার অনেক কাহিনী আছে। দৈত্যটার বিশাল বুক ভেসে উঠল পানির ওপরে। খামচে টেনে উইণ্ডব্রেকারটা ছিড়ে ফেলার চেষ্টা করছে। পারছে না। চেনখোলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো।

লোকটাকে ঠেলে কাছে নিয়ে এল রোভার।

চেন খুলে অনেক টানাটানি করে লোকটার গা থেকে উইণ্ডব্রেকার খুলে আনল রবিন। বাক হয়ে গেল। এতক্ষণে বুঝল, কিসের ভারে ডুবে যাচ্ছিল লোকটা। উইণ্ডব্রেকারের ভেতরের দিকে কোম-বারের পুরু আস্তরুণী, স্পঞ্জের মত পানি শুঁষে ফুলে ঢোল হয়ে উঠেছে, ভীষণ ভারি!

উইণ্ডব্রেকার খুলতেই নোকটার আসল রূপ বেরিয়ে পড়ল। হালকা-পাতলা দুর্বল একজন মানুষ, বেচারার দুরবস্থা দেখে করুণা হচ্ছে রবিনের। রোভারের সাহায্যে পানির একেবারে কিনারে নিয়ে এল নোকটাকে। তারপর ঠ্যাং পরে টেনে এনে ফেল বালিতে।

চিত হয়ে পড়ে হাঁপাচ্ছে নোকটা। এত কাহিল, ওঠার ক্ষমতা নেই। হ্যাট খুলে পড়ে গেছে পানিতে। মাথার ওপর টেনে দেয়া মোজাট রয়েছে।

টেনে মোজা খুলে রবি।

বেরিয়ে পড়ল লম্বা, ধারাল নাক। সামান্য বসা গাল। ডান চোখের নিচে কুঁচকানো দাগ।

নীল বনেট।

<

Super User