এত নিচে নামা সম্ভব না,ককপিটে উলফের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে টিনহা। ওই বোট পর্যন্ত যেতে পারব না।
তাহলে?
যা বলছি, শুনুন। রোভারকে দিয়ে কাজ করাতে হলে ফালতু একটা কথা বলবেন না। যা যা জিজ্ঞেস করব, বলবেন। সব ইনফরমেশন চাই। ওকে?
টিনহার চোখে চোখে চেয়ে রইল উলফ, লোকটার দৃষ্টিতে আগুন দেখতে পাচ্ছে কিশোর। আরও প্রশ্ন? বেশ, কি জানতে চাও?
ঠিক কোন জায়গায়? ক্যালকুলেটর ভরা বাক্সটা আছে কোথায়?
হুঁ… চোখ সরিয়ে নিল উলফ, টিনহার দিকে তাকাতে পারছে না। কেবিন। বাংকের তলায়।
বাধা? আই মিন, কোন কিছুর সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে?
না, উসখুস করছে উলফ। ভেলা ভাসাতে চেয়েছিল তোমার বাবা। তাহলে বাক্সটা সঙ্গে নিতে পারতাম। কিন্তু সময়ই পেলাম না। তার আগেই তলিয়ে গেল। বোট, তিক্ত হয়ে উঠল কণ্ঠস্বর। বাক্স আর নিতে পারলাম না, জান বাঁচানোই মুশকিল হয়ে উঠল।
কেবিনের দরজায় তালা আছে?
নাহ্। তুমি তো জানোই…
মাথা ঝাঁকাল টিনহা। বোটটার প্রতিটি ইঞ্চি চেনা তার। দশ বছর বয়েস থেকেই ওই বোটে করে মাছ ধরতে গিয়েছে বাবার সঙ্গে। জানি দরজা খোলা। রাখত বাবা, যাতে ইচ্ছে হলেই চট করে গিয়ে ঢুকতে পারে। বীয়ারের প্রচণ্ড নেশা তো, দেরি সইতে পারে না।
হ্যাঁ, টিনহার দিকে তাকাতে পারল আবার উলফ।
বাক্সটা দেখতে কেমন?
সবুজ রঙের। ইস্পাতে তৈরি। দু-ফুট লম্বা, এক ফুট চওড়া, আর নয় ইঞ্চি পুরু।
হ্যানডেল আছে?
আছে।…বাক্সটাইয়ে, মানে, ক্যাশবক্সের মত দেখতে। ডালায় লাগানো হ্যাণ্ডেল।
হুঁ, বাক্সটা কি করে বের করে আনবে ভাবছে টিনহা। দড়ি লাগবে। সরু, শক্ত দড়ি। আর একটা তারের কাপড় ঝোলানোর হ্যাঙ্গার।
যাচ্ছি, বলল উলফ। কিশোর, হুইলটা ধরো তো।
দড়ি আর হ্যাঙ্গার আনতে দেরি হলো না।
হ্যাঙ্গারটাকে বাঁকা করে চৌকোনা করে নিল টিনহা। বকা হুকটা দাঁড়ানো রয়েছে একটা বাহুর ওপর। শক্ত মাইলনের দড়ির এক মাথা বাঁধল হ্যাঙ্গারের সঙ্গে।
ওকে, এবার যাওয়া যায়।
মুসা এগিয়ে এল। আমি আর যেতে চায় না সে, যা ঘটে গেছে খানিক আগে, এরপর আজ আর পানিতে ডুব দেয়ার ইচ্ছে হচ্ছে না। কিন্তু একেবারেই কিছু না বললে ভাল দেখায় না, কিছু যদি মনে করে বসে টিনহা, তাই বলছে। আমিও যাব…
হেসে তাকাল টিনহা। তুমি থাকো। দরকার হলে আসতে বলব।
মনে মনে হাপ ছেড়ে বাঁচল মুসা, হাসল। সরাসরি না বলে দিতে পারত টিনহা, তা না বলে ঘুরিয়ে বলেছে। এতে তার অনেকখানি হালকা হয়ে গেছে মূসার। অঘটনটা ঘটার পর থেকেই নিজেকে দোষী ভাবছে, যদিও দোষটা মোটেই তার নয়।
দড়ির বাণ্ডিল কাঁধে ঝুলাল টিনহা, মাস্ক ঠিক করল, তারপর নেমে গেল আবার সাগরে।
কয়েক গজ দূরে ঝিমোচ্ছিল রোভার, শব্দ শুনে চোখ মেলল। এগিয়ে এল টিনহার দিকে।
রোভারের পিঠে চাপড় দিল টিনহা, পুরো এক মিনিট তার গায়ে গাল ঠেকিয়ে রইল।
মুসা দেখছে। বুঝতে পারছে, তিমিটার সঙ্গে কথা বলছে টিনহা। কিন্তু কি বলছে, শোনা যাচ্ছে না।
পরে অনেক ভেবেছে মূসা। কিন্তু কিছুতেই তার মাথায় আসেনি, কিভাবে কি করতে হবে, তিমিটাকে কি করে বুঝিয়েছে টিনহা। মানুষের মনের ঘোরপ্যাঁচ কি করে বুঝল একটা জন্তু!
মনিটরের দিকে চেয়ে আছে কিশোর।
সাদা আলোর চক্র ফুটল পর্দায়, রোভারের মাথার লাইট জ্বেলে দিয়েছে টিনহা। তীব্র আলোয় পানিকে দেখাচ্ছে ধােয়াটে সাদা মেঘের মত। ফুটে উঠল এক আঁক রঙিন মাছ চোখে ভয়, দ্রুত সরে গেল ওগুলো।
আবার দেখা গেল সাগরের তলদেশ। নুড়ি আর বালিময় গোল একটুকরো জায়গার পাশে একটা পাথর, শামুক ছেয়ে আছে।, কিশোরের পেছনে হুইলে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে উলফ, তার চোখও পর্দার দিকে। উত্তেজনায় সোজা হয়ে গেছে সে, না চেয়েও টের পেল কিশোর।
বোটের সামনের দিকটা খুঁজে পেয়েছে ক্যামেরার চোখ।
ওই যে, কিশোরের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মুসা, বলে উঠল উত্তেজিত কণ্ঠে।
বড় হচ্ছে বোটের গলুই, ভরে দিচ্ছে আলোর চক্র। হঠাৎ সরে গেল, গাড়ির পাশ দিয়ে যেভাবে সরে যায় থাম কিংবা গাছ, সেভাবে। ডেক দেখা গেল, এক ঝলকের জন্যে হুইলটা ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল, মেঘে ঢাকা পড়েছে সাদা চক্র। সরে গেল মেঘ, আগের চেয়ে উজ্জ্বল হলো আলো, স্পষ্ট হলো ছবি। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে একটা চেয়ার, একটা পোর্টহোল।
সোজা কেবিনে ঢুকে পড়েছে রোভার।
কয়েক সেকেণ্ড পর্দায় এত তাড়াতাড়ি নানারকম আকৃতি ফুটল, ঝাকুনি খেলো ছবি, কিছুই বোঝা গেল না। টানটান হয়ে গেছে উলকের স্নায়ু, উত্তেজনায় শক্ত হয়ে গেছে পেশী।
ছবির উন্মাদ নাচ ঝিমিয়ে এল এক সময়, স্থির হলো, স্পষ্ট হলো আবার। চেনা যাচ্ছে এখন। ধাতব বাক্সটা দেখা যাচ্ছে।
ওটাই, হইলের ওপর ঝুঁকে পড়েছে উলফ, মনিটরের পর্দা থেকে ছোঁ মেরে তুলে আনবে যেন।
বড় হচ্ছে বাক্সটা…আরও…আরও বড়, ভরে দিল আলোর চক্র, বাক্সের খুব। কাছে চলে গেছে ক্যামেরার চোখ।
ভীষণভাবে দুলে উঠল বাক্সটা আচমকা, পরক্ষণেই হারিয়ে গেল। আর কিছু নেই পর্দায়, শুধু শূন্য গোল সাদা আলো।
কুটি করল কিশোর। ক্যামেরায় কোন গণ্ডগোল হলো? তারপর বুঝল, না ক্যামেরা ঠিকই আছে, নইলে আলো আসত না, আসলে সাদা দেয়ালের ওপর স্থির হয়ে রয়েছে যন্ত্রটার চোখ। নিশ্চয় বাংকের নিচে মাথা ঢুকিয়ে দিয়েছে রোভার।
কিছুক্ষণ প্রায় অনড় হয়ে রইল সাদা আলো, তারপর আবার দুলে উঠল। নানারকম অস্পষ্ট ছবি ঝড় তুলল আবার পর্দায়। কিশোরের মনে হলো, আবছাভাবে দেখতে পেয়েছে বোটের তামার রেলিঙ।
আবার আলোর সামনে ফুটল পরিচিত ধোয়াটে মেঘ। উঠে আসছে রোভার।
আস্ত একটা গর্দভ জানোয়ার! গলা কাপছে উলকের, হুইল এত জোরে চেপে ধরেছে সাদা হয়ে গেছে আঙুল। বাক্সটা তোলার চেষ্টাই করল না। রাগে ঝটকা দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল তীরের দিকে।
উলফের কথায় কান দিল না কিশোর। পলকের জন্যে পর্দায় একটা ব্যাপার দেখেছে, যা মিস করেছে লোকটা। ক্যামেরার চোখের সামনে অনেক বড় হয়ে ফুটেছিল একটা মানুষের হাত, নিশ্চয় টিনহার, সরে গেছে সঙ্গে সঙ্গেই। তার কয়েক মুহূর্ত পরই নিবে গেল গোল আলো। ক্যামেরা অফ করে দিয়েছে টিনহা।
এই, হুইল ধরো, মুসার বাহু ধরে টান দিল উলফ। সোজা রাখবে বোট, নড়ে না যেন।
ছুটে ডেকে বেরোল উলফ, রেলিঙে গিয়ে ঝুঁকে দাঁড়াল। তার পিছু নিল কিশোর, কিন্তু গঁড়াল না, পাশ কাটিয়ে চলে এল বোটের পেছনে, লকারের কাছে। সাগরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, অপেক্ষা করছে।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। বিশ গজ দূরে ভেসে উঠ টিনহার মাথা। কাধে দড়ির বাণ্ডিলটা নেই, এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে।
টিনহার পাশে ভেসে উঠেছে রোভার। আরেকটা ব্যাপার লক্ষ করল কিশোর, ক্যামেরা আর সার্চলাইট নেই, তার জায়গায় বাধা রয়েছে সবুজ ধাতব বাক্সটা।
লকার খুলে সার বকিয়ে রাখা প্লাসটিকের ব্যাগটা বের করল কিশোর। এক টানে ব্যাগের মুখ ছিড়ে ভেতর থেকে বের করল একটা ওয়াকিটকি। টেনে অ্যান্টেনা পুরো তুলে দিয়ে সুইচ অন করল।
যন্ত্রটা মুখের কাছে এনে জরুরী কণ্ঠে বলল, রবিন, প্লে করো! রবিন, প্লে করো!
ফিরে তাকাল উলফের দিকে। রেলিঙে ঝুঁকে রয়েছে লোকটা, আর সামান্য কলেই উল্টে পড়ে যাবে পানিতে, এদিকে নজরই নেই।
নিয়ে এসো! চেঁচিয়ে বলল উল। বাক্সটা নিয়ে এসো। এই মেয়ে, শুনছ?
রবিন, প্লে করো! আবার বলল কিশোর। রোভারের গান প্লে করো! রবিন, প্লে করো! রোভারের গান প্লে করো!
<