শুনেছি, কিশোর। ওভার অ্যাণ্ড আউট!
ওয়াকি টকির সুইচ অফ করে পাশের পাথরের ওপর রেখে দিল রবিন।
এখান থেকে উলফের বোট দেখা যাচ্ছে না। কতদূরে আছে, তা-ও বোঝার উপায় নেই। তবে তিমির শ্রবণশক্তি খুবই তীক্ষ্ণ, এটা জানা আছে, জেনেছে বই। পড়ে। সাধারণ দৃষ্টিতে তিমির কান চোখে পড়ে না, কাছে গিয়ে ভাল করে দেখলে দেখা যাবে, চোখের ঠিক পেছনে সুচের ফোঁড়ের মত অনেকগুলো ছিদ্র।
রেডিওর স্পীকারের সামনে যেমন তারের জাল বা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া। হর, তিমির কানও তেমনিভাবে ছিদ্রওয়ালা চামড়ায় ঢাকা। মানুষের কানের চেয়ে অনেক অনেক বেশি শক্তিশালী কান। অসাধারণ আরেকটা ক্ষমতা আছে ওই কনেক-সোনার সিসটেম, শব্দের প্রতিধ্বনি শুনেই বলে দিতে পারে, কি জিনিসে আঘাত খেয়েছে শব্দ, জিনিসটা কত বড় এবং কত দূরে আছে, একশো গজ দূর থেকেও সেটা নির্ভুলভাবে বুঝতে পারে তিমি। পানির নিচে একে অন্যের ডাক কয়েক মাইল দূর থেকেও শুনতে পায় ওরা।
তাড়াহুড়ো করে সোয়েটার আর জুতো খুলে নিল রবিন। বাতাসনিরোধক বাক্সে ভরা টেপরেকর্ডারটা তুলে নিয়ে এসে নামল সাগরে। পানিতে ডুবিয়ে টিপে দিল প্লে করার বোতাম। ধীরে ধীরে ঘুরতে শুরু করল ক্যাসেটের চাকা, ফিতে পেঁচাচ্ছে। ফুল ভলিয়ুমে সাগরের পানিতে ছড়িয়ে দিচ্ছে রোভারের রেকর্ড করা কণ্ঠ।
মানুষের কান সে শব্দ শুনতে পাবে না, কিন্তু রোভারের কানে হয়তো পেছবে, অনেক দূর থেকেও।
বোটের পেছনে আগের জায়গায়ই রয়েছে কিশোর। তাড়াতাড়ি আবার লকারে লুকিয়ে ফেলল ওয়াকি-টকিটা।
বিশ গজ দূরে এখনও পাশাপাশি ভাসছে টিনহা আর রোভার। বাক্সটা নিয়ে আসার জন্যে থেমে থেমে চেঁচিয়েই চলেছে উলফ।
হাত তুলে সিগন্যাল দিল কিশোর। আগেই বলে রাখা আছে টিনহাকে, এর অর্থ : রবিনকে খবর পাঠানো হয়েছে।
হাত নেড়ে জবাব দিল টিনহা ও বুঝতে পেরেছে। রোভারের মাথায় আলতো চাপড় দিল। এক সঙ্গে ডাইভ দিল দুজনে।
রেলিঙে সোজা হলো উলফ। কি হচ্ছে? হচ্ছেটা কি? চেঁচিয়ে উঠে দৌড়ে গিয়ে ককপিটে চুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল মুসাকে। বনবন করে হুইল ঘুরিয়ে বোটের নাক ঘুরিয়ে দিল একটু আগে টিনহা আর রোভার যেখানে অদৃশ্য হয়েছে সেদিকে।
জায়গাটায় প্রায় পৌঁছে গেছে বোট, এই সময় মাথা তুলল টিনহা। বোট থামিয়ে হুইল আবার মুসার কাছে ফিরিয়ে দিল উল। ধরে রাখো, বলেই ছুটে বেরোল ককপিট থেকে।
বাক্সটা কোথায়? রেলিঙে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল উলফ।
জবাব দিল না টিনহা। এক হাতে ক্যামেরা আর সার্চ লাইট, আরেক হাতে রেলিঙ ধরে উঠছে পানি থেকে।
তিমিটা কোথায়? আবার বলল উলফ।
তবু জবাব নেই। ধীরে সুস্থে মাস্ক খুলল টিনহা, এয়ার ট্যাংকটা পিঠ থেকে খুলে রাখল ডেকে।
কোথায়? রাগে লাল হয়ে গেছে উলফের মুখ। বাক্স কোথায়? তিমি কোথায়?
আমারও সেই প্রশ্ন, মিস্টার উলফ, সাগরের দিকে চেয়ে বলল টিনহা।
মানে? পাই করে কিশোরের দিকে ফিরল উলফ। এই বিনকিউলার নিয়ে তুমি কি করছ? দেখি, আমাকে দাও।
বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে সাগরে আঁতিপাতি করে তিমিটাকে খুঁজল সে। রোভারের চিহ্নও নেই।
তিমির স্বভাবই ওরকম, বোঝানোর চেষ্টা করল টিনহা। উলফ এদিকে পেছন করে আছে। কিশোরের দিকে চেয়ে মুচকি হেসে চোখ টিপল টিনহা। সঙ্গে আছে, আছে, হঠাৎ করে হাওয়া। একেবারে গায়েব। মুক্তির নেশায় পেয়ে বসে, না কী, কে জানে। যায় তো যায়ই, আর আসে না।
বিনকিউলার চোখ থেকে সরাল উলফ। হারামজাদা আমার বাক্স নিয়ে গেছে। ওটার মাথায় বেঁধেছিল কেন? টিনহার দিকে তাকাল, চোখে সন্দেহ। কেন?
কাঁধ ঝাঁকাল টিনহা, মুখ বাঁকাল হতাশ ভঙ্গিতে। উপায় ছিল না। আর কোনভাবে তুলে আনতে পারতাম না। ভাল কাজ দেখিয়েছে, এটা তো অস্বীকার করতে পারবেন না। কেবিনে ঢুকে কি সহজেই না বাংকের তলা থেকে বাক্সটা বের করে আনল। হ্যাঙ্গারটা মুখে করে নিয়ে গিয়ে হ্যাণ্ডেলে হুক লাগিয়ে টেনে বের করে আল বাক্স। তারপর দড়ি ধরে টেনে তুলেছি আমি…
বোটে আনলে না কেন?
বোকার মত কথা বলবেন না। অনেক নিচে নেমে, অনেকক্ষণ পানিতে ডুবে থেকেছি, ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। এরপর ভারি একটা বোঝা নিয়ে সঁতরে
তত ভারি নয় বাটা…
তবু ঋমোকা কথা বলছেন। উঠে দাঁড়িয়ে কোমরে দু-হাত রাখল টিনহা। ইস্পাতের একটা বাক্স, ভেতরে ক্যালকুলেটর বোঝাই, ভারি নয় তো কি হালকা? রোভারের মাথায় বেঁধে আনাটাই তো সহজ নাকি? রেলিঙে ঝোলানো তোয়ালে তুলে নিয়ে চুল মুছতে শুরু করল সে। খারাপ কি আমারও কম লাগছে? আপনার যেমন অর্ধেক গেছে, আমারও তো গেছে।
গেছে না! উলফের কণ্ঠে তিক্ত হতাশা। বিনকিউলারটা আবার চোখে গল। কোথায়? কোথায়, পাজি, নচ্ছাড়, হারামীর বাচ্চা হারামী, পোকাখেকো জানোয়ারটা? গেল কোথায় বেঈমান মাছটা?
কিশোরের দিকে চেয়ে নিরীহ গলায় বলল টিনহা, কিশোর, কোথায় গেল, হতে পারো?
হয়তো পারি, দ্রুত ভাবনা চলেছে গোয়েন্দাপ্রধানের মাথায়। পনেরো মিনিট পেরিয়ে গেছে, পুরোদমে এঞ্জিন চালালেও পিছু নিয়ে ওটাকে এখন ধরুত পারবে না উলফ। তার আগেই তীরে পৌঁছে যাবে রোভার। রবিন একলা রয়েছে খাঁড়ির ধারে, তার হয়তো সাহায্য দরকার হতে পারে। শুধুই অনুমান। আমার মনে হয় তারে চলে গেছে রোভার, খাঁড়ির দিকে। ওখানেই তো সকালে সাগরে নামানো। হয়েছিল তাকে।
ঝট করে বিনকিউলার নামিয়ে ফিরে চাইল উলফ। চোখে সন্দেহ। কেন তা করতে যাবে?
বাড়ি ফেরার প্রবণতা, শান্ত কণ্ঠে বলল কিশোর। বলেইছি তো, মিস্টার উলফ, এটা আমার অনুমান।
ওঁমম… তীরের দিকে তাকিয়ে কি বল উলফ। যাও, গিয়ে হুইল ধরো। খাঁড়ির দিকে চালাও।
সামনের ডেকে চলে এ উলফ। মুসার হাত থেকে হুইল নিল কিশোর।
ফুল স্পীড! আদেশ দিল উলফ।
আই আই, স্যার, দারুণ মজা পাচ্ছে কিশোর, খুশিতে দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। পুরো বাড়িয়ে দিল এঞ্জিনের গতি। নষ্ট হলে উলফের হবে, তার কি? সে তো আদেশ পালন করছে মাত্র। তবে বাড়িতে তাড়াতাড়ি পেীছানোর ব্যাপারে উলফের চেয়ে কম উদ্বিগ্ন নয় সে। দেখতে চায়, তার প্ল্যানমাফিক সব হয়েছে কিনা। নিজের গাওয়া গানের প্রতি সাড়া দিয়ে সত্যিই তীরে ছুটে গেছে কিনা রোভার। সবার আগে বাক্সটা খুলতে চায় কিশোর। দেখতে চায়, কি আছে ভেতরে।
<