কি বুঝলি, কিশোর? মেরিচাচী বললেন। পারবি?

ওয়ার্কশপের কোণে রাখা পুরানো ওয়াশিং মেশিনটার দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। আগের দিন কিনে এনেছেন ওটা রাশেদ চাচা। এককালে বোধহয় সাদা রঙ ছিল, এখন হলদে হয়ে গেছে, জাগায় জায়গায় চলটা ওঠা। জায়গায় জায়গায় বাকাচোরা, টেপ খাওয়া। কিশোরের মনে হলো, দোমড়নো কাগজ হাত দিয়ে চেপেচুপে আবার সোজা করা হয়েছে। মোটরটার অবস্থা কি হবে, আন্দাজ করা যাচ্ছে। বলল, চেষ্টা করে দেখতে পারি। সারা দিন লাগত।

চাচী হাসলেন। দুশ্চিন্তা অনেকটা দূর হলো। কিশোরের চেষ্টা করা মানেই তিনি ধরে নিলেন, হয়ে গেছে। নগদ পয়সা দিয়ে একটা জিনিস কিনে এনে বিক্রি হবে না, এ-দুঃখ কি সওয়া যায়? অন্তত মেরিচাচীর জন্যে এটা রীতিমত মনঃকষ্টের ব্যাপার।

কর বাবা, কাজে লেগে যা, ঠিক করে ফেল, খুশি হয়ে বললেন তিনি। তোকে আজ স্পেশাল লাঞ্চ খাওয়াব।

বেশি করে বেঁধ্যে, চাচী। নইলে মুসা এসে শুনলে হার্টফেল করবে।

হেসে চলে গেলেন চাচী।

এসব কাজে সারাদিন কেন সারা বছর ব্যয় করতেও কোন আপত্তি নেই। কিশোরের, অকেজো যন্ত্রপাতি মেরামত করে আবার চালু করার মধ্যে দারুণ আনন্দ আছে।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই জংধরা সমস্ত ঔ খুলে মেশিনটাকে টুকরো টুকরো করে ফেলল কিশোর, মোটরটা আলগা করে ফেলল। বেজায় ভারি, ওয়ার্কবেঞ্চের ওপর হাতে বেশ কসরত করতে হলো। যতখানি আশঙ্কা করছিল, তত খারাপ অবস্থায় নেই। অনেক পুরানো মডেল, তিরিশ বছরের কম হবে না। তবে জিনিস বানাত বটে তখন, যত্ন করে ব্যবহার করলে একজনের সারা জীবন চলে যাবে একটাতেই। এখনকার মত এত কমার্শিয়াল ছিল না প্রস্তুতকারকরা।

একটা ড্রাইভিং বেল্ট দরকার, ডাবল কিশোর, বানিয়ে নিতে হবে। ওয়ার্কশপের জঞ্জালের সুপ খুঁজতে শুরু করল সে, শক্ত রবার দরকার। একই সঙ্গে ভাবনা চলছে, মেশিনটার কথা নয়, ভাবছে তাদের নতুন কেসের কথা। আগামীকাল সকালে টিনহার সঙ্গে দেখা করার কথা তিন গোয়েন্দার, সৈকতের এক জায়গায় একটা খাঁড়ির কাছে, টিনহার মেকসিকান বন্ধুদের সাহায্যে রোভারকে নিয়ে যাওয়া হবে ওখানে। তিন গোয়েন্দা আর রোভারকে নিয়ে দুবহু বোটটা খুঁজতে যাবে টিনহা।

হঠাৎ স্থির হয়ে গেল কিশোর। ওয়ার্কবেঞ্চের ওপরে ঝোলানো লাল আলোটা জ্বলছে-নিড়ছে, তারমানে ফোন বাজছে হেডকোয়ার্টারে। এই বিশেষ ব্যবস্থাটা কিশোরই করেছে।

রবার খোঁজা বাদ দিয়ে এক টানে সরিয়ে ফেলল দুই সুড়ঙ্গের মুখের লোহার পাত। হামাগুড়ি দিয়ে আধ মিনিটেই পৌঁছে গেল অফিসে। ছোঁ মেরে তুলে নিল বিসির।

হাল্লো, হাঁপাচ্ছে, কিশোর পাশা।

আলো, কিশোর, পরিচিত কণ্ঠস্বর, তিমিটার খোজ পেরেছ? খোজকে বলল খো-ওজ।

ফোন করছেন, ভালই হয়েছে, স্যার, কিশোর বলল। অনেক এগিয়েছি। আমরা। আশা করি, কাল সকাল সাতটা নাগাদ রোডারকে ছেড়ে দিতে পারব সাগরে!

দীর্ঘ নীরবতা।

হালো? জোরে বলল কিশোর। হালো?

হালো, ভাল সংবাদ, জবাব এল। খুব ভাল।

থ্যাংক ইউ।

ও হ্যাঁ, একশো ডলার পুরস্কার দেব বলেছিলাম।

হ্যাঁ,বলেছিলেন। নাম-ঠিকানা যদি দেন, বিল পাঠিয়ে দেব। তিমিটা যে সাগরে ছাড়ছি, তার একটা ফটোগ্রাফও দেব। কাজ করেছি, তার প্রমাণ।

আরে না না, তার দরকার নেই। তোমার মুখের কথাই যথেষ্ট। আসলে, আগামী কিছু দিন শহরের বাইরে থাকব আমি, আজ বিকেলেই যদি দেখা করো, টাকাটা দিয়ে দিতে পারি। কারও পাওনা আটকে রাখা পছন্দ না আমার।

তাহলে তো খুবই ভাল হয়, বলল বটে, কিন্তু সন্দেহ জাগল কিশোরের, টাকা দেয়ার জন্যে এত আগ্রহ কেন? নাম ঠিকানাই বা জানাতে চায় না কেন? আর তিন গোয়েন্দাকেই বা এত বিশ্বাস কিসের, মুখের কথায়ই টাকা দিয়ে দেয়? কোথায় দেখা করব আপনার সঙ্গে, স্যার?

বারব্যাংক পার্ক চেনো?

চেনে কিশোর। অনেক বছর আগে একটা জনপ্রিয় জায়গা ছিল। পার্কের মাঝখানে পুরানো একটা ব্যাণ্ডস্ট্যাও আছে, এককালে নামকরা বাজিয়েরা বাজনা বজাত সেই মঞ্চে উঠে, চারপাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে লোকে শুনত। আস্তে আস্তে সরে চলে এল রকি বীচ শহর, এলাকা ছেড়ে চলে এল লোকে। পার্কটা এখনও আছে ওখানে কিন্তু কদর নেই, অযরে লম্বা লম্বা ঘাস গজিয়ে ঢেকে দিয়েছে ফুলের বাগান, পথ। আগাছা আর ছোট ছোট ঝোপঝাড়ের জঙ্গল এখন ওখানে। রাতের বেলা আর ওদিক মাড়ায় না এখন কেউ।

সন্ধ্যা আটটায় আসবে ওখানে, বলল লোকটা। তোমার বন্ধুদের আনার দরকার নেই। তুমি একলা। ব্যাণ্ডস্ট্যান্ডের কাছে অপেক্ষা করব আমি। ব্যাণ্ডস্ট্যাণ্ড উচ্চারণ করল বেই-অ্যাণ্ড স্টেই-অ্যাও।

স্যার… আর কোন ভাল জায়গায় দেখা করা যায় কিনা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল কিশোর, কিন্তু লাইন কেটে গেল।

রিসিভার রেখে দিয়ে ডেস্কের দিকে চেয়ে ভাবতে লাগল কিশোর। একা যেতে বলল কেন লোকটা? আর এমন বাজে একটা জায়গায় কেন? সন্দেহ গাঢ় হলো তার। আবার রিসিভার তুলে মুসা আর রবিকে ফোন করল, জানাল সব। তারপর ফিরে এল ওয়ার্কশপে।

বিকেল পাঁচটা নাগাদ মোটর ঠিক হয়ে গেল। নতুন স্কু দিয়ে জায়গামত জুড়ে দিল সেটা। মেরিচাচীকে ডেকে এনে উদ্বোধন করল মেরামত করা যন্ত্রের। সকেটে প্লগ চুকিয়ে দিয়ে বলল, সুইচ টেপো, চাচী।

গো-ওঁওঁওঁ করে স্টার্ট নিল মোটর, আস্তে আস্তে শব্দ বাড়তে লাগল, শেষে গর্জে উঠল ভীষণ ভাবে। এত জোরে কাঁপতে লাগল, মনে হচ্ছে ভূমিকম্প কাঁপছে। যা-ই হোক, চাল তো হয়েছে, মেরিচাচী এতেই খুশি। তার মতে এই ভয়ঙ্কর জিনিস নেয়ার মত হাড়কিপটে লোকও পাওয় যাবে এ শহরে।

তুই সত্যি একটা ভাল ছেলে, কিশোর, উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন মেরিচাচী। হোর মত ছেলে আর একটাও নেই দুনিয়ায় (সব সময়ই মেরিচাচীর এই ধারণা, কিন্তু বলেন না। আজ এতই খুশি হয়েছেন, চেপে রাখতে পারলেন না আর)। কাজ অনেক হয়েছে। চল, হাতমুখ ধুয়ে খাবি। হাত ধরে কিশোরকে নিয়ে চললেন চাচী।

প্রায় ডিনারের সময় লাঞ্চ খেতে বসল কিশোর। ভরপেট খাওয়ার পর বেশ বড় সাইজের একটা আইসক্রীম শেষ করল। সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে এল ইয়ার্ড থেকে।

পড়ন্ত আলোয় বেশ বড় জঙ্গল মনে হচ্ছে বারব্যাংক পার্ককে। কাছে এসে সাইকেল থেকে নামল কিশোর। পকেট থেকে সাদা চক বের করে পথের ওপর বড় একটা আশ্চর্যবোধক চিহ্ন আঁকল।

তিন গোয়েন্দার তিনজনেই পকেটে চক রাখে, একেকজন একেক রঙের। কিশোর রাখে সাদা, রবিন সবুজ, মুসা নীল। কোন কেসের তদন্তের সময় কেউ

কোন বিপদে পড়লে অনেক কাজে লাগে এই চক আর আশ্চর্যবোধক চিহ্ন।

পার্কে ঢোকার পথের সন্ধান পাওয়া গেল। রাস্তা দেখা যাচ্ছে না, তবে দু-ধারে স্ট্রীট লাইট দেখে অনুমান করে নিল, পথটা কোথায় থাকতে পারে। কাছে এসে দেখল, দুপাশ থেকে এসে পথের প্রায় পুরোটাই ঢেকে দিয়েছে আগাছা আর লতা ঝোপ, মাঝখানের সরু একটুখানি শুধু বাকি। এগিয়ে চলল সে। খানিক পর পরই একটা করে আশ্চর্যবোধক একে দিচ্ছে গাছের গায়ে, কিংবা ভাঙা কোন বেঞ্চিতে।

কল্পনা-বিলাসী নয় কিশোর। বাস্তবতার বাইরে কোন কিছুই বিশ্বাস করে না। ঝোপকে ঝোপই মনে করে, লুকানোর খুব ভাল জায়গা, বিষাক্ত সাপখোপ থাকতে পারে ভেতরে, তবে তৃত থাকে না।

কিন্তু হাজার হোক মানুষের মন, হোক না সেটা কিশোর পাশার। নির্জন জংলা পার্কের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে অকারণেই গা ছম ছম করে উঠল তার। মনে হলো, আশেপাশের সব কিছুই যেন জীবন্ত, নড়ছে, কথা বলছে ফিসফিস করে। গাছের বাকা ডালগুলো যেন কোন জীবের পঙ্গু হাত-পা। ছোট ছোট শাখাগুলো আঙুল, তাকে আঁকড়ে ধরে ছিনিয়ে যাওয়ার জন্যে হাত বাড়িয়ে আছে, ধরতে পারলেই টেনে নিয়ে গিয়ে ভরবে অন্ধকার জঠরে।

অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। সামনে মঞ্চটা দেখতে পেল কিশোর। ছাউনি ধসে পড়েছে, চারপাশে আগাছার জঙ্গল, আর কিছুদিন পর একেবারে ঢেকে যাবে। তখন মনে হবে ঘাসের একটা উঁচু ঢিপি।

মঞ্চের গায়ে সাইকেল ঠেস দিয়ে রেখে ভাঙা একটা কাঠের বোর্ডে আশ্চর্যবোধক চিহ্ন আঁকল।

কিশোর পাশা।

এতই চমকে উঠল কিশোর, ঘুরতে গিয়ে হাতের ধাক্কায় আরেকটু হলেই ফেলে দিয়েছিল সাইকেলটা। চারপাশের বিষঃ অন্ধকারে লোকটাকে খুঁজল তার চোখ, কিন্তু দেখা গেল না।

কে কোনমতে বলল।

খসখস শব্দ শোনা গেল। লম্বা ঘাসের ভেতর দিয়ে এগিয়ে আসছে। গজখানেকের মধ্যে আসার পর একটা মানুষের অবয়ব চোখে পড়ল কিশোরের।

খুব লম্বা, মাথায় হ্যাটের কিনারা নিচু হয়ে নেমে এসেছে কানের ওপর। চোখ দেখা যাচ্ছে না, চেহারাও বোঝা যাচ্ছে না, নাক মুখ কিছুই যেন নেই, লেপটানো। অদ্ভুই।

লোকটা বিশালদেহী। গায়ে উইণ্ডব্রেকার, কাঁধ এত চওড়া, আর এত মোটা বাহু, কিশোরের মনে হলো একটা গরিলা, মানুষ নয়।

এগোও, কিশোর, বলল লোকটা। যা নিতে এসেছ নিয়ে যাও। কথাবার্তাও জানি কেমন।

আগে বাড়ল কিশোর।

চোখের পলকে তার কাঁধ চেপে ধরে এক ঝটকায় তাকে লাঠুর মত ঘুরিয়ে ফেলল লোকটা। ঘাড় চেপে ধরল। পেছনে হাত নিয়ে গিয়ে লোকটার বাহু খামচে পরে ছাড়ানোর চেষ্টা করল কিশোর। অদ্ভুত একটা অনুভূতি। নরম পাউরুটির ভেতরে দেবে গেল যেন তার আঙুল।

ছটফট শুরু করল কিশোর, ঝাঁকুনি দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা চালাল। লোকটার আরেক হাত গলা চেপে ধরল তার। হাতের আঙুলগুলো হাভিডসর্বস্ব। অবাক কাণ্ড! এত মোটা লোকের এই আঙল।

পুরো অসহায় হয়ে গেল গোয়েন্দাপ্রধান।

যা করতে বলব, ঠিক তাই করবে, বলল আগন্তুক।

মাথা নুইয়ে আচ্ছা বলার চেষ্টা করল কিশোর, পারল না। হ্যামারলকে আটকে ফেলা হয়েছে তাকে।

যদি না করো, কানের কাছে গোঙাল লোকটা, যা বলব যদি না করো, ঘাড় মটকে দেব। ঘাড় মটকের উচ্চারণ মনে হলো অনেকটা ঘাড়ম-টকে।

<

Super User