বৃষ্টি থেমেছে। কিন্তু পর্বতের ওপরে এখনও ইতিউতি ঘুরছে কালো মেঘের ভেলা যে-কোনো সময় ঝরঝর করে নামার পাঁয়তাড়া কষছে যেন। কাঁচা রাস্তা ধরে সাইকেল চালিয়ে বাঁধের দিকে চলেহে দুই গোয়েন্দা আর পিনটু। শুকনো অ্যারোইওর কাছে একজায়গায় মোড় নিয়েছে পথটা, সেখানে এসে থামলো পিনটু।
আমি যতদূর বুঝলাম, সে বললো, এই পাহাড়ের শেষ মাথায় চূড়াটাকেই বলা হতো কনডর ক্যাসল। ওটার ওপাশেই সান্তা ইনেজ ক্রীক।
রাস্তার ধারের ঝোপের মধ্যে সাইকেলগুলো লুকিয়ে ফেললো ওরা। তারপর চ্যাপারালের ঘন ঝোপ ঠেলে এগোলো গভীর অ্যারাইওর কিনারার দিকে। বাঁয়ে রয়েছে বাধটা, এখান থেকে চোখে পড়ে না-ঝোপঝাড়ে ঢাকা ঢিবিটার জন্যে, যেটা অ্যারোইওর মুখ বন্ধ করে দাঁড়িয়েছে।
উঁচু চূড়াটার দিকে মুখ তুলে তাকালো ছেলেরা।
ওটাই! পিনটু বললো। ম্যাপ তা-ই বলে।
এখন কি নাম ওটার? মুসা জানতে চাইলো। ভিজে মাটি নরম হয়ে গেছে, প্রায় কাদা। সেটা ধরে সাবধানে নেমে চলেছে।
বলতে পারবো না।
অ্যারোইও থেকে উঠে পাহাড়ে চড়তে আরম্ভ করলো ছেলেরা। ঢাল কোথাও ঢালু, কোথাও খাড়া। ওপরে উঠতে উঠতে হাঁপ ধরে গেল ওদের।
এই তাহলে কনডর ক্যাসল! বিস্ময়ে গলা কেঁপে গেল রবিরে।
অতো ওপরে দাঁড়িয়ে আশপাশের পুরো এলাকাটা চোখে পড়ছে শুধু উত্তর দিক ছাড়া। সেদিকে অনেক ওপরে উঠে গেছে পর্বতের চূড়া যেন আকাশ ছোঁয়ার চেষ্টায়। পর্বতের গোড়ায় বাধ আর ক্রীকের কাছে ছড়িয়ে রয়েছে পোড়া অঞ্চল।
পশ্চিমে দেখা যাচ্ছে রাস্তা আর গভীর অ্যারোইও, একেবারে হাসিয়েনডার ধ্বংস্তুপের কাছে এগিয়ে গেছে। অনেক দূরে চোখে পড়ছে সাগর, ধূসর এই মেঘলা দিনে কালচে হয়ে আছে। দক্ষিণ-পশ্চিমে বাঁকা হয়ে পড়ে আছে যেন সান্তা ইনেজ ক্রীক, কিছু পানি চকচক করছে এখন তাতে। তার পরে প্রায় মাইলখানেক দূরে দেখা যায় ডয়েল র্যাঞ্চের বাড়িঘর আর কোরাল। দক্ষিণ থেকে একটা রাস্তা ডয়েল র্যাঞ্চ হয়ে চলে গেছে উত্তরে পর্বতের দিকে।
জায়গাটাকে কনডর ক্যাসল বলে কেন? মুসার প্রশ্ন। না দেখছি কনডর, না দুর্গ।
কনডর মানে জানো তো? রবিন বললো। এক ধরনের শকুন।
আমার মনে হয় নামটা দেয়া হয়েছে বার্ডস-আই ভিউ থেকে, অনুমান করলো পিনটু। অর্থাৎ পাখির চোখ থেকে দেখা। অনেক ওপর থেকে দেখা আরকি।
জানি। হতে পারে। তবে নাম নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। এসো তলোয়ার খুঁজি। কোথায় লুকানো হয়েছে বলো তো?
লুকানোর জায়গা আছে নিশ্চয়, মুসা বললো। গর্ত, ফাটল। গুহাটুহাও থাকতে পারে। এসো, খুঁজি।
ছড়িয়ে পড়ে খুঁজতে আরম্ভ করলো ওরা। কিন্তু কোনো ফাটল বা গর্ত চোখে পড়লো না, গুহা তো দূরের কথা। মার্বেলের মতো মসৃণ পিঠ এখানে পাহাড়ের। প্রতিটি ইঞ্চি পরীক্ষা করে দেখলো ওরা। খাড়া ঢালের কিনারে যতোদূর যাওয়া সম্ভব গিয়ে উঁকি দিয়ে নিচে তাকালো। একেবারে নিরেট পাথর।
নাহ্, এখানে কিছু লুকানো যাবে না, মাথা নাড়লো মুসা। চলো চূড়ার নিচে ঢালে খুঁজে দেখি।
চলো, রবিন বললো। তুমি খোজো কীকের দিকটায়, আমি আর পিনটু অ্যারোইওর দিকটায়।
দুই দিক মোটামুটি ঢালু, ততোটা খাড়া নয়। আবার খোঁজা শুরু হলো। মুসা যেদিকে নামলো সেদিকে কিছু বড় বড় পাথর দেখা গেল, কোনো খাঁজটাজ বা ফাটল নেই। ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলো। রবিন আর পিনটু তখনও খুঁজছে। ওদের কাছে চলে এলো সে।
না, লুকানোর জায়গা এখানেও নেই, রবিন বললো। গাল চুলকালো পিনটু। মাটিতে পুঁতে রাখেনি তো?
খাইছে! তাহলে সর্বনাশ! আঁতকে উঠলো মুসা। সমস্ত পাহাড় খুঁড়তে হবে তাহলে! অস!
আমার মনে হয় না মাটিতে পোঁতা হয়েছে, ধীরে ধীরে বললো রবিন। তাড়াহুড়োর মধ্যে ছিলেন তখন ডন। পুঁততে সময় লাগে। এতো সময় নিশ্চয় পাননি। তাছাড়া যেখানে পুঁতবেন সেখানে চিহ্ন দিয়ে রাখতে হবে, নইলে কিভাবে খুঁজে বের করবে স্যানটিনো? আর চিহ্নতে ডগলাসের চোখেও পড়ে যাওয়ার কথা।
মাথা নাড়লো রবিন। না, পুঁতে রাখেননি তলোয়ারটা। তবে কনডর ক্যাসলের কাছেই কোথাও লুকানো হয়েছে, যেখানে খুঁজে পাওয়ার কথা স্যানটিনোর। এমন কোনো জায়গা, যেটা তৈরি করতে হয়নি তখন, আর যেটাতে চিহ্ন দেয়ার দরকার পড়েনি।
কিন্তু, চারপাশে চোখ বোলালো মুসা, কোথায়?
কনডর ক্যাসলে নেই, এটা বোঝা গেল, বললো রবিন। তাহলে টাকে একটা চিহ্ন হিসে চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে। কাছেই কোনো জায়গা আছে, মনে হয়, যেখানে ডন আর স্যানটিনো প্রায়ই যেতো। পিনটু, তেমন কোনো জায়গা…
বাঁধটা হতে পারে।
বাঁধ? হ্যাঁ, হতে পারে।
পথ দেখিয়ে বাঁধের কাছে দুই গোয়েন্দাকে নামিয়ে নিয়ে এলো পিনটু। সেন্টার গেট দিয়ে পানি গিয়ে পড়ছে তিরিশ ফুট নিচের নালায়। বারে যতোটা ওপরে ওঠা স উঠে দেখলো ওরা। হাজার হাজার ছোট পাথর একসাথে চুণ-সুরকি দিয়ে গেঁথে তৈরি হয়েছে ওটা।
একেবারে ইস্পাত হয়ে গেছে, মুসা বললো। কুড়াল দিয়ে কুপিয়েও কাটা যাবে না।
দুশো বছর আগে স্থানীয় ইনডিয়ানদের সাহায্যে এটা তৈরি করেছিলো আলভারেজরা, পিনটু জানালো।
এখানেও তো কোনো ফাঁকফোকর দেখছি না, রবিন বললো। ওইই নিচে দেখা যাচ্ছে অবশ্য কয়েকটা। কিন্তু ওখানে নামতে হলে দড়ির মই দরকার। ডন পিউটোর কাছে নিশ্চয় তখন ওরকম মই ছিলো না।
মুসাও একমত হলো তার সঙ্গে।
কোথায় যে রাখলো! নিরাশা ঢাকতে পারলো না রবিন। আরও সূত্র যদি পেতাম!।
সূত্রই বা আর কোথায় পাবো, বলো? ডন পিউটো চিঠি তো লিখেছিলেন মোটে একটা।
গণ্যমান্য লোক ছিলেন তিনি। নিশ্চয় অনেক বন্ধু ছিলো তার। হয়তো কারও কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছেন। কেউ তাকে দেখে থাকতে পারে। এমন কিছু সূত্র খুঁজে রে করা দরকার, যাতে বোঝা যায় পালানোর দিনটিতে কি কি করেছিলেন তিনি।
কিভাবে? বিশেষ আশা করতে পারলো না পিনটু। সে-অনেক বছর আগের কথা।
হ্যাঁ, তা ঠিক। তবে ওই সময়ে টেলিফোন ছিলো না। লোকে চিঠির মাধ্যমেই যোগাযোগ করতো। লোকে ডায়রি রাখতো এখনকার চেয়ে অনেক বেশি। হয়তো এই এলাকায় খবরের কাগজও ছিলো একআধটা। কিছু না কিছু পেয়ে যাবোই…
আবার সেই হিসটোরিক্যাল সোসাইটি! গুঙিয়ে উঠলো মুসা। পুরানো কাগজ ঘটতে আর ভাল্লাগে না!
হেসে উঠলো রবিন। তোমার অসুবিধে হবে না। ওসব দলিলের বেশির ভাগই স্প্যানিশে লেখা। পড়ার কষ্ট করতে হবে না তোমাকে। আজ যাচ্ছি না আর আমরা, কাল কিশোরকে নিয়ে যাবো। এ-হপ্তার হোমওয়ার্ক করেছো?
আবার গুঙিয়ে উঠলো মুসা। সর্বনাশ! তাই তো! মনেই ছিলো না! আমারও না। আজ সারতে হবে। সাইকেলগুলোর কাছে ফিরে চললো ওরা।
ডান দিকে চোখ পড়তে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো মুসা। সরে বাঁধের ওপর থেকে নেমেছে ওরা। পিনটু, বললো সে, তোমাদের র্যাঞ্চের কারো কুকুর আছে? চারটে, বড় বড় কালো কুত্তা?
কুকুর? না তো…
আমিও দেখেছি, রবিনের কণ্ঠে অস্বস্তি।
দীঘির ওপারে আলভারেজদের সীমানার মধ্যেই ঘোরাফেরা করছে চারটে বিরাট কুকুর। লাল টকটকে জিভ বের করা, জ্বলন্ত চোখ।
বিকট চেহারা… কথা শেষ করতে পারলো না রবিন। তার আগেই শোনা গেল তীক্ষ্ণ হুইসেল। পাই করে ঘুরলো মুসা। সংকেত! জলদি দৌড় দাও!।
দাঁত বের করে লাফিয়ে উঠে বাঁধের দিকে দৌড় দিলো কুকুরগুলো।
পড়িমড়ি করে আবার বাঁধের ওপর উঠে পড়লো ছেলেরা। প্রাণপণে ছুটলো সামনে পঞ্চাশ গজ দূরের কতগুলো ওক গাছের দিকে।
অনেক…দূর..! হাঁপাচ্ছে রবিন।
পারবো না…! পিনটুরও কথা আটকে গেল।
জলদি করো! আরো জোরে! তাগাদা দিলো মুসা।
মুসাআ! পেছনে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলো পিনটু। দেখো, সাঁতরাচ্ছে!
দীঘির পাশ দিয়ে ঘুরে না এসে তাড়াতাড়ি আসার জন্যে পানিতেই লাফিয়ে পড়েছে কুকুরগুলো। দ্রুত সঁতরে আসছে। শিগগিরই উঠে আসবে এপাশে। ধরে ফেলবে ছেলেদের।
তবে ভুল করেছে কুকুরগুলো। পানিতে না নেমে যদি ঘুরে আসতো তাহলে আরও তাড়াতাড়ি করতে পারতো। কিছুটা সময় পেয়ে গেল ছেলেরা। এবং সেটা কাজে লাগালো।
পৌঁছে গেল গাছগুলোর কাছে। কোনোদিকে না তাকিয়ে গাছে উঠতে শুরু করলো। উঠে বসলো ওপরের ডালে, কুকুরের নাগালের বাইরে।
পৌঁছে গেল জানোয়ারগুলো। শিকার হাতছাড়া হয়েছে দেখে খেপে গেল ভীষণ। তুমুল ঘেউ ঘেউ করে লাফালাফি শুরু করলো। ধরতে পারলে ছিঁড়ে ফেলবে এমন ভাব।
গাছের ওপর আটকা পড়লো তিন কিশোর।
<