সোজা হয়ে বসলাম। আমি আমার বিছানায়, নিজের কামরায়।
কাঁধে সাঙ্ঘাতিক ব্যথা। সারা দেহ ঘামে ভিজে গেছে।
ঘড়ির দিকে চাইলাম। সকাল ৭:২৫।
আচমকা চাচা-চাচী হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল।
কিশোর, কিশোর, তোর ঘুম ভেঙেছে, তুই ঠিক আছিস, আল্লাকে হাজারও শুকরিয়া! চাচী প্রায় ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল।
কেমন ফীল করছিস? রাশেদ চাচা প্রশ্ন করল। ডাক্তার ঠিকই বলেছিল। জ্বরটা শেষমেশ কাটল।
জ্বর? ডাক্তার? বালিশে মাথা রাখলাম। কাঁধের ব্যথায় গুঙিয়ে উঠলাম।
ব্যথাটা কয়েকদিন থাকবে। বিশ্রীভাবে পড়ে গিয়েছিলি কিনা, চাচা বলল।
চাচা, চাচী…কী ঘটছে বলো তো? মনে হচ্ছে আমি…কিছু জিনিস…মিস করছি…।
তবে শোন, বলল চাচী, কালকে ফুটবল প্র্যাকটিসের পর টিমমেটদের সাথে তুই নতুন চাইনিজ ফাস্ট ফুডের দোকানটায় গিয়েছিলি।
ফু লিং? প্রশ্ন করলাম, জানি জবাবটা কী হবে।
হ্যাঁ, চাচা বলল। তোরা কটা এগ রোলের অর্ডার দিয়েছিলি, সস সহ তোদেরকে সেগুলো সার্ভ করা হয়। তুই তোর এগ রোলটায় সস মাখিয়ে দুটো কামড় দিয়েছিলি, তারপরই শুরু হয়ে যায় অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন।
তুই জ্ঞান হারাস, চাচী বলল। পড়ে গিয়ে বাঁ কাঁধে ব্যথা পাস, যে জন্যে ওটা এত টাটাচ্ছে।
ওরা হাসপাতাল থেকে তখুনি অ্যাম্বুলেন্স আনায়। ডাক্তার বলেন ভর্তি করার দরকার নেই। বাসায় শুয়ে ঘুমোলেই ঠিক হয়ে যাবে। উনি বলেন রাতটা হয়তো খারাপ কাটবে, কিন্তু সকালে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
চাচী আমার ভ্রূ ঘষল, এখনও ভেজা রয়েছে।
রাতটা কি খারাপভাবে কেটেছে, বাপ? দেখে তো তাই মনে হচ্ছে।
চাচীর দিকে চাইলাম।
চাচী, এত ভাল আমার এর আগে আর কখনও লাগেনি, বলে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। তুমি ভাবতেও পারবে না কতটা ভাল লাগছে!
চাচী হেসে উঠে পাল্টা জড়িয়ে ধরল আমাকে।
যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি! বলল।
আমি নিজেও কম ভয় পাইনি, বললাম।
সত্যিই? কীভাবে? তোর তো জ্ঞানই ছিল না, চাচা বলল।
ওসব কথা থাক, চাচা। এগ রোল সসের অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখায়। আমার শরীর আউট হয়ে গেলেও মন হয়নি।
মাথা ঝাকাল চাচা।
যাক, জ্বরটা কেটে গেছে। দুঃস্বপ্ন আর নেই। বাস্তব দুনিয়ায় ফিরে এসেছিস তুই।
ফিরতে পেরে খুব ভাল লাগছে, বললাম। আমি ক্লান্ত, কিন্তু এত খুশি জীবনে আর কখনও হইনি।
চাচা ঘড়ি দেখল।
অফিসে যাওয়ার সময় হলো। টেক ইট ইযি, চ্যাম্প। ডাক্তার বলেছেন পুরোপুরি সেরে না ওঠা পর্যন্ত ফুটবল বন্ধ।
ঠিক আছে, বলে কাঁধ ডললাম। চাচা বেরিয়ে গেল। চাচী দরজার দিকে এগোল।
আরেকটু ঘুমিয়ে নে, তারপর তোকে নাস্তা দেব, চাচী বলল। বেডরুমের দরজায় থমকে দাঁড়িয়ে আমার দিকে ঘুরে চাইল। ওহ, ভুলেই গেছিলাম। ফু লিঙের লোকেরা এই ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছে। চিকিৎসার সমস্ত খরচ ওরা দিতে চেয়েছে আর আমাদেরকে যে কোন সময় ডিনারের দাওয়াত দিয়ে রেখেছে।
ভাল। তবে এর পরেরবার আমি আর এগ রোল সস খাব না, বললাম।
হ্যাঁ, চাচী বলল, ওরা খুব ভাল মানুষ। ওরা এমনকী একটা গেট-ওয়েল গিফটও পাঠিয়েছে। তোর ড্রেসারে রয়েছে।
চাচী বেরিয়ে গিয়ে পিছনে দরজা লাগিয়ে দিল। আমি উঠে বসে চারধারে নজর বুলালাম। গোটা ব্যাপারটাই স্বপ্ন ছিল। কিন্তু এতই বাস্তব যে আমি আর অমন স্বপ্ন দেখতে চাই না।
ড্রেসারের দিকে চাইলাম। চাচী সাদা এক ন্যাপকিন রেখেছে ওটার উপরে। উপহারটা কী কে জানে।
আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে ড্রেসারের কাছে গেলাম।
ন্যাপকিনটা খুললাম। ভিতরে এক ফরচুন কুকি।
ন্যাপকিনটা মেঝেতে পড়তে দিলাম। কুকিটা তুলে ধরলাম। ভেঙে খুলে ফেললাম ওটাকে। কুকিটা মেঝেতে পড়ে গেলে কাগজটার দিকে চাইলাম।
ওতে লেখা, আজ তুমি সম্পূর্ণ নতুন একজন মানুষ হিসেবে দিন শুরু করবে। অনুভব করলাম নাড়ির গতি দ্রুততর হলো। অস্পষ্ট হাসির শব্দ কানে এল। সরাসরি বেডরুমের আয়নার দিকে চাইলাম। নিজের প্রতিবিম্বটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম।
এসময় তাঁকে দেখতে পেলাম। আমার দিকে চেয়ে মৃদু হাসছেন। মুহুর্তের জন্য। কিন্তু কোন সন্দেহ নেই এটি তিনিই। আয়না থেকে আমার দিকে পাল্টা চেয়ে ছিলেন মিস লি। মুখে স্মিত হাসি।
এবার উধাও হয়ে গেলেন তিনি। হাসির শব্দটা মিলিয়ে গেল।
নড়তে সাহস পাচ্ছি না আমি। আয়নায় নিজের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছি। দুঃস্বপ্নটা কি সত্যি শুরু হতে যাচ্ছে? এই ঘর থেকে বেরনোর পর কেউ কি আমাকে চিনবে না?
বেডরুমের দরজা খুললাম। নীচে, কিচেনে চাচী আর ডন কথা বলছে, হাসছে।
ধীরে সুস্থে সিড়ি ভেঙে নেমে গেলাম। নীচে এখন আমি, কিচেনের দরজার কাছে। ভিতরে পা রাখলাম। চাচী আর ডন কথা থামিয়ে আমার দিকে চাইল। চেয়ে রয়েছে একদৃষ্টে।
হাই, আমি বললাম। সামান্য বিরতি, কেউ কিছু বলল না। এবার চাচীর মুখে হাসি ফুটল।
খিদে পেয়েছে? প্রশ্ন করল। ডন দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল আমাকে।
সে আর বলতে! বললাম। হাতে শক্ত করে ধরে থাকা ফরচুনটা দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে মারলাম ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে। দারুণ লাগছে আমার, চাচী, বলে প্রাণ খোলা হাসি দিলাম। মনে হচ্ছে আমি নতুন একজন মানুষ, বলতে গিয়ে চেপে গেলাম।
আমার আসলে পুরানো কিশোর পাশার মতই অনুভূতি হচ্ছে। এবং আমার জন্য সেটাই যথেষ্ট।
***
<