রকি বীচ বন্দরের ওপর কুয়াশা যেন ঝুলে রয়েছে। সাইকেল চালিয়ে এসে দেখল তিন গোয়েন্দা, হাজির রয়েছে এড, ওদেরই অপেক্ষা করছে। সাইকেল তুলে নিয়েছে প্রফেসরের বোটে। আঠাল ঠাণ্ডা গায়ে কাঁপুনি তুলে দিয়েছে তার।

তিন গোয়েন্দাকে দেখে হাসল এড। সারারাত ধরে ভেবেছি, বুঝেছ। আমি শিওর, নৌকা বোঝাই করে গুপ্তধনই নিয়ে গিয়েছিল বাওরাড ডাই। আমার ধারণা, আজ দ্বীপে গেলেই পেয়ে যাব।

আমি তা মনে করতে পারছি না, এড, কিশোর বলল। এত…

ইঞ্জিনের শব্দ শোনা গেল। তীরের কাছে এসে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল স্টেশন ওয়াগন। লাফিয়ে নেমে প্রায় ছুটে এলেন প্রফেসর। সরি, বয়েজ, দেরি হয়ে গেল। আজ সকালে একটা গণ্ডগোল হয়েছে হিসটোরিক্যাল সোসাইটিতে। লিটল মারমেইডের ফাইল চুরির চেষ্টা হয়েছিল। কালো দাড়িওয়ালা এক লোক।

টিক ব্রাউন! একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল বরিন আর মুসা।

মাথা ঝাঁকালেন প্রফেসর। আমারও তাই মনে হয়।

কিন্তু কেন? এডের জিজ্ঞাসা। লিটল মারমেইডের ইতিহাস তো সবাই জানে।

হয়ত সবার চোখেই কিছু এড়িয়ে গেছে, অনুমান করল কিশোর। স্যালভিজ ইয়ার্ডেও যে চোর এসেছিল, জানাল সবাইকে।

চমকে উঠলেন প্রফেসর, জার্নালও তাহলে পেয়ে গেছে টিক! চোরটা হয়ত ইতিমধ্যেই রওনা হয়ে গেছে, আমাদের আগেই গিয়ে হাজির হবে দ্বীপে। সাগরের ওপরের কুয়াশার দিকে তাকলেন তিনি। কিন্তু এই আবহাওয়ায় কি আমরা যেতে পারব?

মাথা ঝাঁকাল মুসা। তীরের কাছে ঘন বটে, তবে আমার ধারণা, যতই দূরে যাব পাতলা হয়ে যাবে কুয়াশা। এসময়ে এখানটায় কুয়াশা কিছু বেশিই থাকে, জানেনই তো। আর অসুবিধে কি? যথেষ্ট বড় আপনার বোট।

চল তাহলে। তাড়াতাড়ি করতে হবে।

পঁচিশ ফুট লম্বা সুন্দর একটা সেইলিং বোট। উঠল সবাই। অকজিলারি ইঞ্জিন স্টার্ট দিলেন প্রফেসর। দ্রুত তীরের কাছ থেকে সরে এল বোট। হাল ধরল মুসা, কোর্স সেট করল উত্তরে। ছেলেদের নিয়ে কেবিনে গাদাগাদি করে বসলেন প্রফেসর। প্রচণ্ড শীত। ভারি সোয়েটারেও বাগ মানছে না ডিসেম্বরের কনকনে ঠাণ্ডা।

দ্বীপটা ছোট, মুসা বলল। খুব সুন্দর। এখন পরিত্যক্ত। চমৎকার একটা গুহাও আছে।

বাতাস কম, পাল তুলে লাভ নেই। তাই ইঞ্জিনের ওপরই ভরসা করল মুসা। নিচে কেবিনেই রয়েছে অন্যেরা, তাদেরকে বলল সে, ওই যে, দেখা যাচ্ছে।

সামনে, প্রায় মাইলখানেক দূরে কুয়াশার ভেতর মাথা তুলেছে দ্বীপটা, যেন সাগর থেকে উঠে এসেছে কমলো কিম্ভুত এক দানব। আরও কাছে এগোলে চোখে পড়ল গাছ, রাশি রাশি সাইপ্রেস। পেছনের দুটো পাহাড় চূড়ার একটাকে ছাড়িয়ে উঠেছে লম্বা চিমনি। জনহীন, পাথুরে এলাকা। তার ওপাশে আকাশ থেকে সাগরে নেমে গেছে যেন কুয়াশার ভারি চাদর।

দক্ষ হাতে হুইল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একটা খাড়ির ভেতরে বোট ঢোকাল মুসা। পুরানো কাঠের জেটিতে বাঁধল। হুড়াহুড়ি করে নামল সবাই। দেখতে লাগল জনমানবশূন্য পাথুরে দ্বীপটা। যেখানে সেখানে জন্মে রয়েছে বুড়ো সাইপ্রেস, ওগুলোর মাঝের খোলা জায়গা দখল করে নিয়েছে ঘন ঝোপঝাড়। ক্রমাগত ঝড়ো বাতাসের কারণে বিচিত্র ভঙ্গিতে বেঁকে গিয়েছে বড় বড় গাছগুলো।

সর্বনাশ! হতাশ কণ্ঠে বলল রবিন। বুড়ো বাওরাড এখানেই যদি গুপ্তধন লুকিয়ে থাকে, কি করে বের করব? যেখানে খুশি থাকতে পারে। শত বছর খোঁড়াখুঁড়ি করলেও খুঁজে পাব না।

না, রবিন, কিশোর বলল। কাল রাতে অনেক ভেবেছি এসব নিয়ে। আমার ধারণা, মাটির তলায় গুপ্তধন লুকাননি বাওরাড। কারণ, তিনি জানতেন, লিটল মারমেইডের ক্যাপ্টেন তার পিছু নিয়েছে। সদ্য খোঁড়া মাটি তার নজরে পড়ে যেতে পারে। যে কারই চোখে পড়তে পারে। তাছাড়া, তিনি চেয়েছেন, সহজেই যাতে খুঁজে বের করতে পারে নোরিয়া। মাটিতে পুঁতে রাখলে সেদিক থেকেও অসুবিধে। খুব তাড়াতাড়িই নতুন মাটি পুরানো মাটির সঙ্গে মিশে এক হয়ে যায়, আলাদা করে চেনা মুশকিল হয়ে পড়ে। মাথা নাড়ল সে। না, ওরকম জায়গায় লুকাননি। আর যেখানেই লুকিয়েছেন, স্পষ্ট চিহ্ন দিয়ে রেখেছেন, দীর্ঘদিনেও যা নষ্ট হবার নয়। কারণ তিনি শিওর ছিলেন না, ধাঁধার মানে বুঝে গুপ্তধন বের করতে কতদিন লাগবে তাঁর স্ত্রীর।

এই দ্বীপে কিছু বানিয়ে যায়নি তো বাওরাড?এড বলল। নোরিয়াকে চমকে চেয়ার জন্যে হয়তো জায়গা কিনে কিছু বানিয়েছে।

সেকথাও ভেবেছি। কাঠ দিয়ে তৈরি জিনিসের দিকে চোখ রাখতে হবে। আমাদের। আর, ডাইদের চিহ্ন বহন করে এমন কিছু।

চিঠিতে বলেছেন, তাঁর নির্দেশ অনুসরণ করতে, রবিন বলল। তার দিনগুলো কিভাবে তৈরি হয়েছে পড়ার জন্যে। ভূত আর আয়নার কথা বলেছেন। ইঙ্গিত আর চিহ্ন বোধহয় ওগুলোই।

ঠিক, একমত হল কিশোর। জার্নালে উল্লেখ আছে, এই দ্বীপের মালিকের কাছে একটা প্রস্তাব দিয়েছেন বাওরাড, হয়ত কোন জিনিস লুকানোর অনুমতি চেয়েছেন। কাজেই, ওই চিমনিওয়ালা বাড়িটা থেকে খোঁজা শুরু করব। রেকর্ড থাকতে পারে ওখানে।

পাহাড়ে চড়ল ওরা। চূড়ার কাছে একটা ছোট গুহামত রয়েছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় তাতে আশ্রয় নেয়া চলে। কাছাকাছি খানিকটা সমতল জায়গা। বিশাল চিমনি মাথা তুলেছে ওখান থেকেই। পাথরের মস্ত ফায়ারপ্লেস আছে, পাথরের চুলা আছে, চারপাশে পাথরের ছড়াছড়ি, কিন্তু বাড়ি নেই। বড় বড় পাথরের চাঙড়, চাড় দিয়ে তুলে ফেলা হয়েছিল, বোঝা যায়, জায়গামত রেখে দেয়া হয়েছে আবার।

ওগুলো দেখে বলে উঠলেন প্রফেসর, কেউ এসে দেখে গেছে আমাদের আগেই। বেশিক্ষণ হয়নি।

অস্বস্তিতে ভুগতে শুরু করল ওরা। বার বার তাকাচ্ছে বাকাচোরা সাইপ্রেস বনের দিকে, নির্জন পাহাড়ের চূড়া আর ঢালের দিকে। কেউ নেই। শুধুই কুয়াশা, যেন ঝরে পড়ছে পুঞ্জ পুঞ্জ ধোঁয়াটে মেঘ।

দেখি তো, কি আছে ওটার তলায়, বলে একটা চাঙড়ের দিকে এগোল রবিন। সে আর মুসা মিলে সরিয়ে ফেলল ওটা। শূন্য গর্তটার দিকে তাকাল সবাই।

কিচ্ছু নেই, বলল মুসা। থাকার কথাও না অবশ্য। বিশেষ করে লোকটা এসে দেখে যাওয়ার পর।

হুঁ, মাথা দোলাল কিশোর। চুলার ভেতরেও খুঁজেছে। নিচেও। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে চারপাশ থেকে মাটি সরিয়েছে, দেখেছ।

কিন্তু খাঁড়িতে তো আর কোন নৌকা দেখলাম না। তবে ছোট একটা সৈকত আছে ওধারে।

চল, ছড়িয়ে পড়ে খোঁজা শুরু করি ওকে, প্রস্তাব দিলেন প্রফেসর। আমি মাঝে থাকছি। তোমরা চারজন চার দিকে যাও। খুব সতর্ক থাকবে। কিছু দেখলে জোরে ডাকবে।

নতুন বা আকর্ষণীয় কোন চিহ্ন দেখলেও জানাবে, কিশোর বলল। কোন গুহা, পাথরের স্তূপ, পাথরে বা পাহাড়ে খোদাই করা কোন নকশা…কি বলছি, বুঝেছ?

নার্ভাস ভঙ্গিতে মাথা দোলাল অন্য তিনজন। রওনা হয়ে গেল একেকজন একেক দিকে। কুয়াশা ঘন হতে আরম্ভ করেছে। এডের চোখে আবছা হয়ে এল মুসার মূতি, দ্বীপের বা ধারে চলে এসেছে সে। অন্য তিনজন কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না এখন কুয়াশার জন্যে।

এড এসেছে পশ্চিমধারে, পাহাড়ের গোড়ায়, দ্বীপের এই ধারটা বেশি উঁচু। বায়ে সাগরের ওপর কুয়াশা খুবই ঘন কুয়াশার একটা মেঘ ভেসে এসে ঘিরে ফেলল তাকে, ফলে মুসাকেও দেখতে পেল না আর। ভীষণ অস্বস্তি লাগছে তার, বুক কাঁপছে। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, কান খাড়া। সামনে কিছু দেখা যায় না। অন্ধের মত পা বাড়াতে গিয়ে পড়ে গেল সে। পাথরের ধস সৃষ্টি করে গড়িয়ে পড়তে লাগল ঢাল বেয়ে।

ব্যথা লাগতে আঁউক করে উঠল। বাড়ি লেগেছে কোন কিছুতে, পাথরেই হবে। উঠে বসল। এই সময় চোখে পড়ল ওটা।

ভূতুড়ে একটা মূর্তি, ঢালে দাঁড়িয়ে কুয়াশার মধ্যে দিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কালো মূর্তি, পিঠে কুজ, ছুঁচালো কুৎসিত মুখ, বাঁকা নাক, বড় বড় চোখ।

ভূত! ভূত! চিৎকার করে উঠল এড়। বাঁচাও!

নড়ে উঠল ভূত। লম্বা হাত বাড়িয়ে দিল যেন এডকে ধরার জন্যে।

<

Super User