মজার কাজ করছেন, রবিন বলল।
জেটির কিনারে দাঁড়িয়ে আছে সে। শুক্রবারের সকাল। জোয়ার নেমে গেছে। বিল রয়েছে টিনার ডেকে, হুইলহাউসের দেয়াল রঙ করছে। জবাব দিল না লোকটা। এমনকি মুখ তুলেও তাকাল না।
গত বছর আমাদের বাড়ি রঙ করা হয়েছিল, আবার বলল রবিন। মিস্ত্রিদের সাহায্য করেছিলাম। জানালার চৌকাঠগুলো রঙ করেছিলাম আমি।
ফিরে তাকাল বিল। হাতের ব্রাশের দিকে তাকাল একবার। হুইল হাউসের কাছ থেকে সরে এসে ওটা বাড়িয়ে দিল রবিনের দিকে।
লাফ দিয়ে ডেকে উঠল রবিন। হেসে ব্রাশটা নিয়ে রঙ.শুরু করল। তার কাজ দেখছে বিল।
কয়েক মিনিট নীরবে ব্রাশ ঘষল রবিন। তারপর বলল, বাহ, বোটে রঙ করা তো আরও মজার।
ঘোঁৎ করল শুধু বিল।
একবার বোটে করে বেড়াতে গিয়েছিলাম, রবিন বলল। বন্ধুর চাচার সঙ্গে। কি যে দারুণ লাগছিল না। হঠাৎ ঝড় এসে সব মজা নষ্ট করল। বানিয়ে বানিয়ে সমুদ্র যাত্রার রোমাঞ্চকর এক গল্প বলতে লাগল সে। বিল না হাসা পর্যন্ত বলেই গেল।
হ্যাঁ, একে বলে সী-সিকনেস, বলল বিল। বমি আর পেসাব-পায়খানা করে সব নষ্ট করে ফেলে। আমার অবশ্য কখনও ওরকম হয়নি।
বিলও একটা ভয়াবহ ঝড়ের গল্প শোনাল। শুনে অবাক হওয়ার ভান করল রবিন। যেন সমুদ্র সম্পর্কে কোন জ্ঞানই নেই এমন ভাব করে নানারকম প্রশ্ন করল। কিন্তু দরকারি কিছু জানার আগেই জেটিতে এসে দাঁড়াল দুজন লোক। স্প্যানিশ ভাষায় ডাকল। ফিরে তাকাল বিল। রবিনের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে একজন ইশারা করল বিলকে, নেমে গেল সে। হাঁটতে হাঁটতে দূরে চলে গেল।
কথা বলছে তিনজনে। এতদূর থেকে শোনা যায় না। কিন্তু ওদের ভাবভঙ্গি লক্ষ্য করল রবিন। হাত তুলে তীরের দিকে দেখাল একজন। আরেকজন দেখাল উত্তরে, যেন বোঝাচ্ছে ওদিক থেকে উপকূল ধরে কিছু আসছে। শ্রাগ করল বিল। হাত তুলে ঝাঁকাল একজন। অন্যজন ঘড়ি দেখিয়ে জরুরি কিছু বলল বিলকে।
অবশেষে ঘুরে দাঁড়াল বিল। অন্য দুজন হাঁটতে লাগল পুরানো একটা ছোট কেবিনের দিকে। রবিন অনুমান করল, ওরাই বিলের রুমমেট।
রবিনের কাজের প্রশংসা করল বিল।
দারুণ স্প্যানিশ বলেন তো আপনি, রবিন বলল। আপনার বন্ধুরাও।
আমার সেকেণ্ড ল্যাংগুয়েজ। আমার বন্ধুরা এসেছে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে, ভাল ইংরেজি বলতে পারে না। তাই ওদের সঙ্গে স্প্যানিশই বলতে হয়।
পার্কিং লটের কাছে বাড়িটা থেকে মিসেস নিকারোকে বেরোতে দেখল রবিন। হাতের ট্রেতে একটা থার্মোস জগ আর কয়েকটা কাপ। বাড়ি আর ছোট অফিসটার মাঝামাঝি পৌঁছে এদিকে ফিরে তাকাল মহিলা। রবিনের হাতে ব্রাশ দেখেই বুঝে থমকে দাঁড়াল এক মুহূর্ত। প্রায় তিরিশ মিটার দূর থেকেও মহিলার চেহারার উত্তেজনা নজর এড়াল না রবিনের।
কয়েক সেকেণ্ড পর গিয়ে অফিসে ঢুকল মিসেস নিকারো। একটু পরেই অফিস থেকে বেরিয়ে জেটির দিকে এগিয়ে এল এলসি। গায়ে নীল ওঅর্ক শার্ট, গলার কাছটায় খোলা। একটা নীল-সাদা রুমাল বাঁধা গলায়। পরনে রঙচটা জিনস, পায়ে মলিন স্নিকার। রেগে আছে মনে হল।
রঙ তো তোমার করার কথা, কাছে এসে বলল এলসি। গলা চড়াল না বটে, তবে কণ্ঠে ঝাঁঝ ঠিকই প্রকাশ পেল।
ছেলেটা সাহায্য করতে চাইল, তাই, মিনমিন করে বলল বিল। রঙ করতে নাকি ভাল লাগে।
ঠিকই, ম্যাডাম, খুব ভাল লাগে আমার।
বেশ, যা করেছ করেছ, বাকিটা বিল করবে। আমার শাশুড়ি দেখা করতে। বলেছে তোমাকে।
আমাকে? নিজের বুকে হাত রাখল রবিন।
অফিসে আছে, অফিসটা দেখাল এলসি। তোমাকে ডেকে নিয়ে যেতে বলল। ব্রাশটা দিয়ে চলে এস। বিল, শোন, বেশি দেরি কর না। লারমারদের ওখানে গিয়ে তেল আনতে হবে আমাদের। তেতাল্লিশজন লোক আসবে কাল সকালে, সাতটায়। সময় বেশি নেই হাতে। সব রেডি রাখতে হবে।
আচ্ছা, বলে জোরে জোরে ব্রাশ ঘষতে আরম্ভ করল বিল।
হাসল রবিন। বুঝল, আদেশ দিতে এবং সেটা মানাতে পছন্দ করে এলসি নিকারো। আগে আগে প্রায় লাফাতে লাফাতে চলল সে, হাঁটার তালে তালে নাচছে লাল চুল। পিছে চলল রবিন। ওরা ঢোকার আগেই দরজায় এসে দাঁড়াল মিসেস নিকারো।
বাড়িতে যাচ্ছি, বউকে বলল মহিলা। রবিনের দিকে ইশারা করে বলল, ইয়াং ম্যান, তুমি এস আমার সঙ্গে।
চলল রবিন। অবাক হয়ে ভাবছে, ঘটনাটা কি? লিভিং রুমে নিয়ে এল তাকে মহিলা। বিদেশী গন্ধ যেন সব কিছুতেই লেগে রয়েহে, এমনকি পিঠ উঁচু আর্মচেয়ার আর লম্বা, বিচ্ছিরি দেখতে সোফাগুলোতেও।
বস, একটা চেয়ার দেখিয়ে বলল মহিলা।
দুজনেই বসল। মিসেস নিকারোর পরনে কালো পোশাক। কোলের ওপর ভাঁজ করে রাখল হাত। রবিনের দিকে তাকাল। চোখের সে-তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সইতে পারল না রবিন, মুখ ফেরাল।
তোমাকে আগে দেখেছি, মহিলা বলল।
আ-আমার মনে হয় না।
না হলে কি হবে, আমি দেখেছি। স্বপ্নে। বাস্তবে দেখব ভাবিনি।
জবাব আশা করছে মিসেস নিকারো। কিন্তু কি জবাব দেবে রবিন? কথা হারিয়ে ফেলেছে যেন। খানিক পর জোর করে মুখ দিয়ে যা বের করল, সেটা কাশি আর কোলাব্যাঙের ঘড়ঘড়ানির মিশ্রণ। কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, আমি…আমি শুধু সাহায্য করছিলাম…আগে আর কক্ষণও এখানে আসিনি…। থেমে গেল সে। মিসেস নিকারো ভুল করছে, একথা প্রমাণ করে তার মনে কষ্ট দেয়ার ইচ্ছে নেই রবিনের কিন্তু মহিলা ভয় পাইয়ে দিয়েছে তাকে। বিশ্বের এই আধুনিকতম শহরে এই শতাব্দিতে যেন মানায় না মহিলাকে। তার জন্মানো উচিত ছিল পৌরাণিক আমলে, গুহায় বসে লোকের ভূত-ভবিষ্যৎ বলত আর তাদেরকে হুঁশিয়ার করত।
ঘরটা গরম। তবু শীত শীত লাগল রবিনের।
হাত কোলের ওপর রেখেই সামনে ঝুঁকল মহিলা। মুখে বয়েসের ভাঁজগুলো স্পষ্ট হল আরও। এখানে থাকার কথা নয় তোমার। নিশ্চয় কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছ। সেটা কী?
কো-ক্কোন উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, জোরে কথা বলতে ভয় পাচ্ছে রবিন। এমনি…এমনি এসেছি…সময় কাটাতে…। চোখ সরিয়ে নিল আরেকদিকে। ভয়, মহিলা তার মনের কথা পড়ে ফেলবে।
বিপদের মধ্যে রয়েছ তুমি চলে যাও। আর কখনও এখানে আসবে না। আমার কথা না শুনলে বড় বিপদে পড়বে। সাংঘাতিক দুর্ঘটনা ঘটবে। আমার স্বপ্নে ভয়াবহ ঝড়ের মধ্যে দেখেছি তোমাকে। প্রচণ্ড শব্দ হল। ঝড়ের কেন্দ্র থেকে নিচে পড়তে লাগলে তুমি, নিচে, নিচে, আরও নিচে…ফাঁক হয়ে গেল ধরণী, তলিয়ে গেলে তুমি।
হাত কাঁপছে রবিনের। শান্ত করার চেষ্টা করল। কিশোরের মুখে শুনেছে, মহিলার স্বপ্ন নাকি ফলে যায়। কিশোরও অবশ্য শুনেছে অন্যের মুখে। ধরণী ফাঁক হয়ে গেল বলে কি বোঝাতে চাইল? ভূমিকম্প? তাহলে আর হুঁশিয়ার করে লাভ কি? শুধু জেটিতে না এলেই কি ভূমিকম্প থেকে বেঁচে যাবে রবিন?
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল মহিলা, যেন ফুঁসে উঠল একটা সাপ। নিশ্চয় ভাবছ আমি পাগল। তোমাকে বলা হয়ত উচিত হয়নি। ফিরে গিয়ে ছেলেমেয়ের দল নিয়ে আসবে হয়ত, পাগলি বুড়ি; ডাইনী বুড়ি, ইটালিয়ান ভূত বলে খেপাবে আমাকে। কিন্তু সত্যি বলছি, তোমাকে স্বপ্নে দেখেছি আমি। তোমার মৃত্যুর সময় ওখানে হাজির ছিলাম!
সামনের দরজা খুলে গেল। ঘরে ঢুকল এক ঝলক বিশুদ্ধ হাওয়া। কাছে এসে দুজনের মুখের দিকে তাকাল এলসি। জোর করে হাসল। কি ব্যাপার? নিশ্চয় আরেকটা দুঃস্বপ্ন, নাকি?
যদি হয়, কি করবে? ভুরু কোঁচকাল বৃদ্ধা। রবিনের হাঁটু ছুঁল। আমি বুঝেছি, এই ছেলেটা ভাল, পরিশ্রমী। সেজন্যেই চলে যেতে বলছি। ওর ভাল চাইছি বলে। নইলে আমার কি ঠেকা? উঠে দাঁড়াল মিসেস নিকারো। যাই। অনেক কাজ। বিকেলেই মেহমান আসছে। সব কিছু গুছিয়ে রাখতে না পারলে…।
তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেল মিসেস নিকারো।
তোমার কোন অসুবিধে হচ্ছে না তো? এলসি জিজ্ঞেস করল।
না, ঠিক আছি। থ্যাংক ইউ।
ঘরটা আর সহ্য করতে পারছে না রবিন। মনে হল, তার গায়ের চামড়ায় কিলবিল করছে হাজারখানেক শুয়োপোকা। দমকা হাওয়ার মত ঘর থেকে বেরিয়ে এল সে।
<