ম্লান হতে হতে এক সময় মিলিয়ে গেল নীল আলো। গাঢ় অন্ধকার চেপে ধরল যেন মুসাকে। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল সে আরেকবার। পারল না। আরও বেশি শক্ত হল জালের জন্ট। টর্চটা খসে গেছে হাত থেকে। খুঁজে বের করার উপায় নেই।
কায়দামত আটকেছি—ভাবল মুসা। বুড়ো এক অভিনেতাকে ধরতে এসে নিজেরাই ধরা পড়ে গেছে। খুব সুবিধের লোক মনে হল না দুই আরবকে। ওরা তাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল অন্ধকারে।
হ্যানসন আর রবিনের কথা ভাবল মুসা। গিরিখাতে বাঁকের ওপাশে অপেক্ষা করছে ওরা। ওদের সঙ্গে কি আর কখনও দেখা হবে? আর কোন দিন কি বাড়ি ফিরে যেতে পারবে সে? মা-বাবার সঙ্গে দেখা হবে?
জীবনে এমন বিপদে আর পড়েনি মুসা। ভাবছে। এইসময় দেখা গেল আলো। এগিয়ে আসছে দুলেন্দুলে। কাছে এসে দাঁড়াল লম্বা এক লোক। হাতে একটা বৈদ্যুতিক লণ্ঠন। সিল্কের আলখেল্লা গায়ে।
বুকল লোকটা। হাতের লণ্ঠন তুলে ভাল করে দেখল মুসাকে। নিষ্ঠুর এক জোড়া চোখ, কেমন ঘোলাটে চাহনি।
হাসল লোকটা। ঝকঝাঁক করে উঠল সোনার দাঁত। বোকা ছেলে! আর সবার মত ভয় পেয়ে চলে গেলেই ভাল করতে। এখন মরবো। জবাই করার ভঙ্গিতে নিজের গলায় আঙুল চালাল লোকটা। বিচ্ছিরি ঘড়ঘড়ে একটা আওয়াজ করল।
ইঙ্গিতটা বুঝল মুসা। দুরুদুরু করে উঠল। বুকের ভেতর। কে আপনি? গলা দিয়ে কোলা ব্যাঙের আওয়াজ বেরোল তার। এখানে কি করছেন?
কি করছি? হাসল লোকটা। পাতালে গেলেই বুঝতে পারবে।
লণ্ঠন নামিয়ে রাখল লোকটা। উবু হয়ে দুহাতে ধরে তুলে নিল মুসাকে। যেন একটা কোলবালিশ, এমনি ভাবে, কাঁধে ফেলল মুসার ভারি দেহটা। লণ্ঠনটা আবার হাতে তুলে নিয়ে এগোেল যেদিক থেকে এসেছিল।
কাঁধে ঝুলে থেকে চলেছে, কোথায় চলেছে, বুঝতে পারল না। মুসা। একটা দরজা পেরোল লোকটা, প্যাসেজ পেরোল। একটা সিঁড়ির মাথায় এসে পৌঁছুল। ঘুরে ঘুরে নেমে গেছে সিঁড়ি। নেমে চলল। লোকটা। অনেক ধাপ পেরিয়ে একটা করিডরে এসে পৌঁছুল। বাতাস ঠাণ্ডা, কেমন ভেজা ভেজা। করিডর পেরোল, আরও কয়েকটা দরজা পেরিয়ে এসে ছোট একটা ঘরে ঢুকল। জেলখানার সেলের মত ঘর। নিশ্চয় মাটির তলায় অনুমান করল মুসা। দেয়ালে গাঁথা মরচে পড়া কয়েকটা রিং-বোল্ট।
সাদা বস্তার মত কি একটা পড়ে আছে এক কোণে। কাছে বসে আছে। একজন আরব, বেঁটোটা। বিশাল এক ছুরিতে শান দিচ্ছে।
আবদাল কোথায়? আলখেল্লাধারী লোকটা জিজ্ঞেস করল। ধপাস করে সাদা বস্তাটার পাশে নামিয়ে রাখল মুসাকে।
সিলভিয়াকে ডাকতে গেছে, ভারি গলা আরবটার। ঘড়ঘড়ে আওয়াজ বেরোয় কথা বলার সময়। সিলভিয়া আর জিপসি কাটি লুকিয়ে রেখেছে মুক্তাগুলো। ছেলেদুটোকে নিয়ে কি করা যায়, সবাই বসে আলোচনা করব।
কিছুই করার দরকার নেই। বলল এশিয়ান। এই ঘরে রেখে বাইরে থেকে দরজায় তালা দিয়ে চলে যাব। কেউ কখনও খুঁজে পাবে না ওদেরকে। মরে ভূত হয়ে যাবে শিগগিরই। টেরর ক্যাসল আগলে রাখবে।
মন্দ হবে না, হাসল আরব। গলায় কফ আটকে আছে যেন। তবে, ছুরিটায় কষ্ট করে শান দিয়েছি। একটু ব্যবহার না করলে কেমন দেখায়?
দেখছে মুসা, বুড়ো আঙ্গুলে ছুরির ধার পরীক্ষা করছে আরবটা। সামান্য নড়ে উঠল সাদা বস্তা। আড়চোখে দেখল মুসা। বুঝল, ওটা বস্তা নয়। জালে আটকানো গোয়েন্দাপ্রধান কিশোর পাশা।
বড় দেরি করেছ, বলল আরবটা। যাই দেখি সিলভিয়া কোথায়, উঠে দাঁড়াল সে। ছুরিটা ঢুকিয়ে রাখল কোমরের খাপে। একবার চাইল মেঝেতে পড়ে থাকা ছেলে দুটোর দিকে। আলখেল্লাধারীকে বলল, এস আমার সঙ্গে। গোপন পথটা পরিষ্কার করতে হবে। আমরা এসেছিলাম, তার কোন প্ৰমাণ থাকা চলবে না। এদেরকে নিয়ে ভাবনা নেই। বেরোতে পারবে না জাল থেকে।
ঠিক। তাড়াতাড়ি করা দরকার আমাদের, লণ্ঠনটা দেয়ালের বোল্ট রিঙে ঝোলাল আলখেল্লা। আলো পড়ছে এখন ছেলেদুটোর ওপর।
বেরিয়ে গেছে লোকদুটো। মিলিয়ে গেল ওদের পায়ের আওয়াজ। ভারি পাথর ঘষা লাগার আওয়াজ হল। তারপর সব চুপচাপ।
মুসা, ডাকল কিশোর, ঠিকঠাক আছ?
ঠিকঠাক বলতে কি বোঝাতে চাইছ? নিরস গলায় বলল মুসা। হাড়টাড় ভাঙেনি, এটুকু ঠিক আছি।
ভাল, কিশোরের গলায় ক্ষোভ, নিজের প্রতি! বোকার মত তোমাকে এই বিপদে এনে ফেললাম! নিজের বুদ্ধির ওপর খুব বেশি। ভরসা ছিল আমার!
খামোকা ভেবে মন খারাপ কোরো না, বলল মুসা। একদল ডাকাত এসে আস্তানা গেড়েছে টেরর ক্যাসলে, কি করে জানবে? কোন প্ৰমাণ তো পাওয়া যায়নি আগে।
হাঁ। আমি শিওর ছিলাম, টেরর ক্যাসলের সব কিছুর মূলে শুধু জন ফিলবি। কল্পনাই করিনি, আর কেউ থাকতে পারে। যা হবার হয়ে গেছে, ওসব নিয়ে ভেবে লাভ নেই। তা হাত-পা নাড়াতে পারছ কিছু?
পারছি। শুধু বাঁ হাতের কড়ে আঙুল।
আমি ডান হাত নাড়াতে পারছি, বলল কিশোর। নিজেকে ছাড়াতে পারব মনে হয়। ঠিক জায়গায় পোঁছাচ্ছি কিনা, দেখ।
কাত হয়ে পড়ে আছে কিশোর। মুসা আছে চিত হয়ে। শরীরিটাকে বান মাছের মত বাঁকিয়ে-চুরিয়ে অনেক কষ্টে কাত হল। কিশোরের পিঠ এখন তার দিকে। দেখল, কোমরের বেল্টে আটকানো সুইস ছুরিটা খুলে ফেলতে পেরেছে কিশোর। বিভিন্ন আকারের ছোটবড় আটটা ব্লেড, ছোট একটা স্ক্রু-ড্রাইভার আর একটা কাঁচিও লাগানো আছে বিশেষ কায়দায়।
কাঁচি দিয়ে জালের কয়েকটা ঘর কেটে ফেলল। কিশোর। কাটা জায়গা দিয়ে বের করতে পারছে ডান হাত।
বাঁ পাশে কাটতে পাের। কিনা দেখ, ফিসফিস করে বলল মুসা। ওই হাতটা বের করতে পারলেই কেল্লা ফতে।
ছোট্ট কাঁচি। নাইলনের শক্ত সুতায় তৈরি জাল। এগোতে চাইছে না। কাজ। থামল না কিশোর। চেষ্টা চালিয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত মুক্ত করে ফেলল দুই হাত। কোমরের কাছে কাটা শুরু করল। নিচের দিকে ফুট খানেক কেটে ফেলেছে, এই সময় শোনা গেল পায়ের আওয়াজ। তাড়াতাড়ি কাটা জায়গাটা টেনে পিঠের দিকে নিয়ে গিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল সে। দুহাত ঢুকিয়ে নিল জালের ভেতর।
কয়েক মুহূর্ত পরেই ঘরে এসে ঢুকল এক বুড়ি। হাতে বৈদ্যুতিক লণ্ঠন। পরনে জিপসি আলখেল্লা। কানে সোনার বড় বড় রিঙ।
বেশ বেশ, হাঁসের মত প্যাঁকপ্যাঁক করে উঠল যেন বুড়িটা। খুব আরামেই আছ দেখছি, বাছারা। জিপসি কাটির হুঁসিয়ারি তো মানলে না, বিপদে পড়বেই। আমার কথা শুনলে আর এ-অবস্থা হত না।
লণ্ঠন তুলে দেখছে বুড়ি। হঠাৎই মনে হল তার, বড় বেশি স্থির হয়ে আছে ছেলেদুটো। কােন কথা বলছে না, নড়ছে না চড়ছে না। সন্দেহ হল। মুসার কাছে এসে দাঁড়াল। সন্দেহজনক কিছু দেখল না। ঘুরে কিশোরের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। তুমি একটু কাত হও তো বাছা, প্যাঁকপ্যাঁক করে উঠল। হাসের গলা। পারছি না? বেশ এই যে, আমি সাহায্য করছি। লণ্ঠনটা নামিয়ে রাখল সে।
জালের কাটা দেখে ফেলল বুড়ি। কিশোরের ডান হাতের কজি চেপে ধরল। মোচড় দিয়ে মুঠো থেকে নিয়ে নিল ছুরিটা। বাহ চমৎকারী পালানোর চেষ্টা করছিলে, ছানারাঃ হঠাৎ গলা চড়িয়ে ডাকল সে, সিলভি। দড়ি, দড়ি নিয়ে এস! শক্ত করে বাঁধতে হবে। ছানাদুটোকে, নইলে উড়ে যাবে।
আসছি, সাড়া এল মহিলাকণ্ঠে। কথায় ব্রিটিশ টান।
খানিক পরেই লম্বা একটা মেয়ে এসে দাঁড়াল দরজায়। হাতে দড়ির বাণ্ডিল।
চালাক, ভীষণ চালাক ছানাদুটো, বলল বুড়ি। শক্ত করে। বাঁধতে হবে। এস, সাহায্য করা আমাকে।
অসহায় ভাবে চেয়ে চেয়ে সব দেখল মুসা। কোন সাহায্যই করতে পারল না বন্ধুকে। কিশোরের মাথা, গলা আর পিঠের জাল কাটল ওরা প্ৰথমে। দুহাত পিঠের কাছে নিয়ে শক্ত করে বাঁধল দড়ি দিয়ে। টেনে হিঁচড়ে জল খুলে নিল। তারপর বাঁধল পা। কব্জির বাঁধনের ওপর আরেক টুকরো দড়ি বাঁধল। একটা রিং বোল্টের সঙ্গে বেঁধে দিল দড়ির আরেক মাথা।
লম্বা এক টুকরো দড়ি দিয়ে মুসাকে বাঁধা হল এরপর। ওর জাল কাটা নেই কোন জায়গায়। কাজেই জাল ছাড়িয়ে নেবার দরকার মনে করল না বুড়ি। ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে আনল কয়েক প্যাঁচ। বেঁধে দিল দড়ির দুই প্রান্ত।
আর পালাতে পারবে না। ছানারা, বলল হাঁস-গলা। কোন দিনই আর বেরোতে পারবে না। এখান থেকে। ওরা জবাই করে। ফেলতে চাইছে, কিন্তু তার দরকার হবে বলে মনে হয় না। বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে গেলে, এই পাতাল থেকে কখনই আর বেরোতে পারবে না এরা।
আমার দুঃখ হচ্ছে ওদের জন্যে, বলল। ইংরেজ মেয়েটা। চেহারা দেখে ভাল ছেলে বলেই মনে হচ্ছে।
খামোকা দরদ দেখিও না, তীক্ষা হল হাঁসের গলা। সবাই একমত হয়েছে, ওদেরকে ছেড়ে দেয়া চলবে না। দলের সবার বিরুদ্ধে যেতে পার না তুমি। চল, কেটে পড়ি। সময়ই নেই। চিহ্নটিহ্নগুলো মুছে দিয়ে যেতে হবে। আবার।
দেয়ালে ঝোলানো লণ্ঠনটা নামিয়ে নিল বুড়ি। বেরিয়ে গেল।
মেঝেতে রাখা লণ্ঠনটা তুলে ছেলে দুটোর দিকে আবার তাকাল মেয়েটা। কেন এলে, ছেলেরা? কেন আর সবার মত দূরে থাকলে না? অর্গানের বাজনা একবার শুনেই পালায় লোকে, আর ফেরে না। কিন্তু তোমরা ঠিক ফিরে এলে আবার।
তিন গোয়েন্দা কখনও হাল ছাড়ে না, গম্ভীর গলা কিশোরের।
অনেক সময় হাল ছেড়ে দেয়াই ভাল, বলল মেয়েটা। তো থাক, আমরা যাই। আশা করি, অন্ধকারে ভয় পাবে না। গুডবাই।
যাবার আগে, বলল কিশোর। আশ্চর্য শান্ত গলা। অবাক হল মুসা। একটা প্রশ্নের জবাব দেবে?
কি? জানতে চাইল মেয়েটা।
এখানে কি কুকাজ করছ তোমরা? কিসের দল?
বাহ, সাহস আছে তোমার, ছেলে! হাসল মেয়েটা। কুকাজ, না? হ্যাঁ, কুকাজই। আমরা স্মাগলার। এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে দামি জিনিসপত্র স্মাগল করে আনি, বিশেষ করে মুক্তো। টেরর ক্যাসল আমাদের হেডকোয়ার্টার। লোকে জানে ভূতুড়ে বাড়ি। ধারেকাছে ঘেঁষে না। লুকানোর দারুণ জায়গা। বহু বছর ধরে আছি আমরা এখানে।
কিন্তু ওই বিচিত্র পোশাক পরে আছ কেন? যেন সার্কাসের সং। লোকের নজরে পড়ে যাবে সহজেই।
আমাকে দেখলে তো নজরে পড়ব, বলল মেয়েটা। হয়েছে, আর না। একটার জায়গায় তিনটা প্রশ্নের জবাব দিয়ে ফেলেছি। এবার যেতে হচ্ছে। গুডবাই।
লণ্ঠন হাতে বেরিয়ে গেল মেয়েটা। শব্দ তুলে বন্ধ হয়ে গেল সেলের দরজা। ঘুটঘুটে অন্ধকার চেপে ধরল। দুই গোয়েন্দাকে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে মুসার। শুকনো ঠোঁটের ওপর একবার বুলিয়ে আনল জিভ।
কিশোরা খসখসে গলা মুসার। চুপ করে আছ কেন? কিছু বল। নইলে পাগল হয়ে যাব যা নীরব।
উ! আনমনা শোনাল কিশোরের গলা। ভাবছিলাম। খাপেখাপে মেলাতে চাইছি। কিছু ব্যাপার।
ভাবছিলে! এই সময়ো!
হ্যাঁ। খেয়াল করেছ, এখান থেকে বেরিয়ে ডানে ঘুরেছে জিপসি কাটি? ওদিকে করিডর ধরে এগিয়েছে?
তাতে কি?
আমরা যেদিক থেকে এসেছি তার উল্টো দিকে গেল। সিড়ি বেয়ে ওপরে উঠেনি। সে। আরও পাতালে নেমেছে। এর মানে কি? মাটির তলা দিয়ে বেরোনোর কোন গোপন পথ আছে। কোন গোপন সুড়ঙ্গ। ওই পথে বেরোলে লোকের চোখে পড়বে না।
কিশোরের মাথা ঠাণ্ডা রাখার ক্ষমতা দেখে অবাক না হয়ে পারল না মুসা। পাতালের এই সেলে, এই বিপদে থেকেও ঠিক খাটিয়ে নিচ্ছে মগজের ধূসর কোষগুলোকে!
অনেক কিছুই তো ভাবছ, বলল মুসা। এখান থেকে কি করে বেরোনো যায়, ভেবেছ কিছু?
না, সোজাসাপ্টা জবাব দিল কিশোর। ভেবে লাভ নেই। পরিষ্কার বুঝতে পারছি, বাইরের সাহায্য ছাড়া এখান থেকে বেরোনোর কোন উপায় নেই। আমাদের। বাস্তবকে স্বীকার করে নেয়াই ভাল। আমাকে ক্ষমা কর, মুসা। আমার ভুলের জন্যেই ঘটল এটা।
চুপ করে রইল মুসা। বলার নেই কিছুই। কি বলবে?
ঘুটঘুটে অন্ধকার। অখণ্ড নীরবতা। কাছেই কোথাও হুটোপুটি করছে একটা ইদুর, শোনা যাচ্ছে। আরেকটা একঘেয়ে শব্দও কানে আসছেঃ টুপ্… টুপ্… টুপ্…!
সময় নিয়ে খুব আস্তে আস্তে পড়ছে পানির ফোঁটা। তারই আওয়াজ।
<