কিশোর! ডাক শোনা গেল মেরিচাচীর। এদিকে আয়। রডগুলো বেড়ার ধার ঘেঁষে তুলে রাখবি? মুসা.রবিন, তোমরা একটু সাহায্য কর বন্ধুকে।
কড়া রোদ। ইয়ার্ডে ব্যস্ততা। রবিনের পা ভাঙা, ভারি কাজ তার পক্ষে সম্ভব না। উল্টে রাখা পুরানো একটা বাথটাবে আরাম করে। বসে রডের হিসেব রাখছে সে। গত দুদিন ধরেই খুব কাজ হচ্ছে ইয়ার্ডে। কবে। আবার হেডকোয়ার্টারে আলোচনায় বসতে পারে তিনজন কে জানে! মিস্টার ফিসফিসের সঙ্গে দেখা করে আসার পর আর এগোয়নি তদন্ত। আসলে সময়ই পায়নি। ইয়ার্ডে ব্যস্ত থেকেছে। কিশোর। মুসার বাড়িতে কাজ ছিল, সারতে হয়েছে। লাইব্রেরিতে রবিনেরও কাজের চাপ পড়েছিল বেশ।
গত দুদিন খুব কম সময়ই বাড়িতে থাকতে পেরেছেন রাশেদ চাচা। বড়সড় একটা নিলাম হচ্ছে এক জায়গায়। ওখানে মাল কিনতে ব্যস্ত তিনি। ট্রাক বোঝাই হয়ে কেবলই মালের পর মাল এসে জমা হচ্ছে ইয়ার্ডে। কবে যে শেষ হবে, কে জানে!
একটানা কাজ করে গেল ওরা খুশিমনেই। মেরিচাচীর কাজ করে দিতে দ্বিধা নেই তিন গোয়েন্দার। প্রচুর চুইংগাম কিংবা টিফির লোভ আছে। সঙ্গে আছে মেরিচাচীর হাতে তৈরি কেক। বয়ে বয়ে বেড়ার কাছে নিয়ে রড জমা করছে মুসা আর কিশোর। বাথটাবে বসে ওগুলোর হিসেব রাখছে। রবিন। দুপুরের দিকে ফুরসত মিলল কিছুক্ষণের জন্য। বড় ট্রাকটা দেখা গেল। ইয়ার্ডের গেটে। রাশেদ চাচা এসেছেন। ছোটখাট হালকা পাতলা মানুষ, ঈগলের মত বাঁকানো বিরাট নাকের তলায় পেল্লাই গোঁফ। ট্রাক বোঝাই মালপত্রের স্তুপের ওপর একটা পুরানো ধাঁচের চেয়ারে বসে আছেন রাজকীয় ভঙ্গিতে।
পুরানো জিনিস কিনতে গেলে, যা যা চোখে পড়ে কিছুই ফেলে আসেন না রাশেদ চাচা। কাজে লাগবে কি লাগবে না, বিক্রি হবে। কিনা, ওসব নিয়ে মাথা ঘামান না। কিনে নিয়ে আসেন। পরে দেখা যাবে কি করা যায়।
ইয়ার্ডের চত্বরে এসে থামল ট্রাক। মালের দিকে একবার চেয়েই স্বামীর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন মেরিচাচী, তুমি…তুমি পাগল হয়ে গেছ, ওটা এনেছ কেন?
পায়ে পায়ে চাচীর কাছে এসে দাঁড়িয়েছে তিন কিশোর। দাঁতের ফাঁক থেকে পাইপটা নিয়ে ওদের দিকে একবার দোলালেন রাশেদ চাচা। হাসলেন।
অবাক চোখে এক গাদা ধাতব পাইপের দিকে চেয়ে আছে তিন কিশোর। আট ফুট উঁচু একটা পাইপ অর্গান।
অর্গানটা কিনেই ফেললাম, মেরি, গলা খুব ভারি রাশেদ চাচার। বোরিস….রোভার ধর তো। নামিয়ে ফেলি। খুব সাবধানে নামাতে হবে। ভেঙেটেঙে ফেল না আবার।
লাফ দিয়ে মাটিতে নেমে এলেন রাশেদ চাচা। অর্গানটা নামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল বোরিস আর রোভার।
পাইপ অর্গান… কথা আটকে গেল মেরিচাচীর। যেশাস! পাগল হয়ে গেছে লোকটা! …অর্গান, পাইপ-অর্গান দিয়ে কি হবে!
নাক-মুখ দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া ছাড়লেন রাশেদ চাচা। রসিকতা করলেন, বাজানো শিখব। পার্ট টাইম চাকরি করা যাবে। সার্কাসে। হাসলেন তিনি। হাত লাগালেন বোরিস আর রোভারের সঙ্গে।
বোরিস আর রোভার দুই ভাই। বাভারিয়ার লোক। দুজনেই ছয় ফুট চার ইঞ্চি লম্বা, সেই অনুপাতে চওড়া। মাথার চুল সোনালি। গায়ে মোষের জোর। সহজেই ধরে ধরে নামিএয় আনছে ভারি পাইপগুলো।
শোবার ঘরের কাছে বেড়ার ধারে অর্গানটা বসানোর সিদ্ধান্ত নিলেন রাশেদ চাচা। ওখানেই নিয়ে গাদা করে রাখা হল অর্গানের পাইপ আর অন্যান্য যন্ত্রপাতি। পরে জুড়ে দেয়া যাবে।
খুব ভাল জিনিস, তিন কিশোরকে বললেন রাশেদ চাচা। লস আঞ্জেলেসের পুরানো এক থিয়েটার হাউজ থেকে এনেছি।
খুব ভাল করেছ। গোমড়া মুখে বললেন মেরিচাচী। কপাল ভাল, কাছেপিঠে প্ৰতিবেশী নেই। কাজ করতে চলে গেলেন তিনি।
অনেক বড় অডিটোরিয়ামের জন্যে তৈরি হয়েছিল অর্গানটা, ছেলেদেরকে বললেন রাশেদ চাচা। জোরে বাজালে কানের পর্দা ফেটে যাবে মানুষের। চাইলে খুব নিচুতে নিয়ে আসা যায়। এর শব্দ। এতই নিচু, মানুষের কানেই ঢোকে না সে-আওয়াজ।
না-ই যদি শোনা গেল, ওটা আবার শব্দ হল নাকি? চাচার দিকে চেয়ে বলল কিশোর।
মানুষের কানে ঢেকে না, সার্কাসের হাতির কানে ঢুকবে, মুচকে হাসলেন রাশেদ চাচা। চলে গেলেন সেখান থেকে।
কান তো সবারই এক, বলল মুসা। মানুষের কানে না। ঢুকলে হাতির কানে ঢুকবে নাকি?
চুকতেও পারে, জবাবটা দিল রবিন। কুকুরের হুইসেলের নাম শোনোনি? মানুষের কানে ঢোকে না, কিন্তু কুকুর ঠিকই শুনতে পায় ওই বাঁশির আওয়াজ।
সাবসোনিক, যোগ করল কিশোর। বিলো সাউন্ডও বলে একে। ভাইব্রেশন বেশি না হলে মানুষের কানে ঢেকে না শব্দ। একটা বিশেষ রেঞ্জের কােপন হলে তবেই শুনতে পায় মানুষ।
পাইপ অর্গান আর শব্দ-রহস্য নিয়ে এতই মগ্ন ওরা, গেটের কাছে দাঁড়াল এসে নীল স্পোর্টস কারটা, খেয়ালই করল না। ড্রাইভার—টিং-টিঙে রোগাটে শরীর, লম্বা এক তরুণ। জোরে হর্ন বাজাল।
চমকে ফিরে চাইল তিন কিশোর।
তিন গোয়েন্দাকে চমকে দিতে পেরে খুব মজা পেল যেন গাড়ির আরোহীরা। জোরে হেসে উঠল ড্রাইভার আর তার দুই সঙ্গী।
শুটিকে টেরি লম্বা তরুণকে ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে আসতে দেখে বলে উঠল মুসা।
ওর এখানে কি? বিড় বিড় করল রবিন।
বছরের একটা বিশেষ অংশ রকি বীচে কাটাতে আসে ডয়েল পরিবার, সারা বছর থাকে না। কিন্তু ওই কয়েকটা মাসই যথেষ্ট। জ্বলিয়ে মারে কিশোর, মুসা আর রবিনকে। খালি পেছনে লেগে থাকে।
নিজের বুদ্ধির ওপর অগাধ আস্থা টেরিয়ার ডয়েলের, অন্য কেউ সেটা মানল কি মানল না, তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। নিজের গাড়ি নিজেই ড্রাইভ করে। বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কিশোর বয়েসী। ছেলেছোকরাদেরকে অধীনে রাখার চেষ্টা করে। রকি বীচের বেশির ভাগ ছেলেমেয়েই পাত্তা দেয় না। তাকে, এড়িয়ে চলে। তবে বখে যাওয়া কিছু ছেলেকে দলে টানতে পেরেছে। টেরিয়ার। প্রায়ই পার্টি দেয়, ওদেরকে দাওয়াত করে। তার গাড়িতে তুলে ঘোরায় সারা শহর। দরাজ হাতে খরচ করে।
এগিয়ে আসছে টেরিয়ার। হাতে একটা জুতোর বাক্স। গাড়িতে বসা দুই সঙ্গীর চোখ তার ওপর। তিন গোয়েন্দাও দেখছে তাকে। কাছাকাছি এসেই পকেটে হাত ঢোকাল সে। ঝটকা দিয়ে বের করে। আনল আবার। হাতে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস। রাশেদ চাচা আর দুই বাভারিয়ান ভাইয়ের দিকে তাকাল। পাইপ অর্গানটা নিয়ে ব্যস্ত তারা। এখান থেকে তার কথা শুনতে পাবে না। বিশেষ কায়দায় ভুরু কুঁচকাল সে। গুরুগম্ভীর একটা ভাব ফুটিয়ে তুলল চেহারায়। ম্যাগনিফাইং গ্লাসের ভেতর দিয়ে পুরো ইয়ার্ডে চোখ বোলাল একবার। ভুল জায়গায় এসে পড়লাম না তো!
টেরিয়ারের অভিনয়ে খুব মজা পেল তার দুই সঙ্গী, হেসে উঠল হো হো করে।
কি চাই এখানে, শুটকি?
মুসার কথা যেন শুনতেই পেল না টেরিয়ার। ম্যাগনিফাইং গ্রাসের ভেতর দিয়ে তাকাল কিশোরের দিকে। অনেক কষ্টে যেন চিনতে পারল। গ্লাসটা আবার ভরে রাখল পকেটে। এই যে কিশোর হোমস, পৃথিবী বিখ্যাত গোয়েন্দা। দেখা করতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। একটা কেস নিয়ে এসেছি আপনার কাছে, স্যার। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডও বিমূঢ় হয়ে গেছে, কোন সুরাহা করতে পারেনি। কেসটা। শেষ পর্যন্ত আপনার শরণাপন্ন হতে হল। নির্দয়ভাবে খুন করা হয়েছে বেচারাকে। আশা করি এই জটিল রহস্যের সমাধান করতে পারবেন। বাক্সটা বাড়িয়ে ধরল সে।
টেরিয়ারের বলার ভঙ্গিতে হেসে লুটোপুটি খেতে লাগল তার দুই বন্ধু।
বিচ্ছিরি গন্ধ আসছে বাক্সের ভেতর থেকে। কি আছে, আন্দাজ করতে পারল তিন গোয়েন্দা। হাত বাড়িয়ে বাক্সটা নিল। কিশোর। ডালা খোলার আগে একবার চাইল টেরিয়ারের দিকে।
হাসছে টেরিয়ার। অপেক্ষা করছে।
ডালা খুলল কিশোর। নাকে এসে যেন বাড়ি মােরল পচা গন্ধ। বিরাট এক সাদা হঁদুর, পচে ফুলে ঢোল হয়ে আছে।
কি মনে হয়, মিস্টার হোমস? সামান্য সামনে বুকে এল টেরিয়ার। ভয়াবহ এই খুনের কিনারা করতে পারবেন? আসামীকে ধরতে পারলে বড় পুরস্কার পাবেন। পঞ্চাশটা স্ট্যাম্প।
হাসির রোল উঠেছে গাড়িতে।
আড়চোখে সেদিকে একবার চাইল কিশোর। চেহারায় কোন পরিবর্তন হল না। গম্ভীর চোখ মুখ, আস্তে করে মাথা ঝোঁকাল। গাড়িতে বসা টেরিয়ারের দুই বন্ধুকে শুনিয়ে জোরে জোরে বলল, আপনার মনের অবস্থা আমরা বুঝতে পারছি, মিস্টার শুটকি। খুবই দুঃখ পেয়েছেন। পাবেনই তো? হাজার হোক, নিহত জীবটা আপনার খুব প্রিয় বন্ধু ছিল।
হঠাৎ থেমে গেল হাসির শব্দ। সতর্ক হয়ে উঠেছে গাড়িতে বসা ছেলে দুটো। চোখ মুখ লাল হয়ে উঠেছে টেরিয়ারের।
বেচারার মৃত্যুর কারণ অনুমান করতে পারছি, আবার বলল কিশোর। বদহজম। খইল খেয়েছিল এক গরু বন্ধুর সঙ্গে, একই গামলায়। গরুটার নামের আদ্যাক্ষর দুটো জানি। টি ডি। ভুরিভোজনের পরই হয়তো টেরর ক্যাসলে গিয়েছিল, ভূতের তাড়া খেয়ে প্যাণ্ট নষ্ট করতে করতে ফিরেছে।
নিজেকে খুব চালাক মনে কর, না? হিসিয়ে উঠল টেরিয়ার।
বিশ্বাস হচ্ছে না? দাঁড়াও, দেখাচ্ছি, বলেই ঘুরল কিশোর। একছুটে গিয়ে ঢুকল ঘরে। কয়েক মুহূর্ত পরেই বেরিয়ে এল।
এই যে, আদ্যাক্ষর খোদাই করা আছে এটাতে, টর্চটা টেরিয়ারের দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল কিশোর। আগে একটা এস থাকলেই তোমার পুরো নাম হয়ে যেত। শুটকি টেরিয়ার ডয়েল।
হা হা করে হেসে উঠল মুসা। টািৰ্চটা শুটকিকে দিয়েই দাও না, কিশোর। একটা এস বসিয়ে নেবে।
থাবা মেরে কিশোরের হাত থেকে টৰ্চটা নিয়ে নিল টেরিয়ার। ঘুরে দাঁড়াল। গটমট করে হেঁটে চলে গেল গাড়ির কাছে। ড্রাইভিং সিটে উঠে বসে ফিরে চাইল। আহাহা, তিন গোয়েন্দা! শুনলেই হাসি পায়! শহরের ছেলেদের কারই জানতে বাকি নেই ভড়ঙের কথা। কেউ হাসি ঠেকাতে পারছে না।
জবাবে তালে তালে হাততালি দিতে লাগল কিশোর, মুসা আর রবিন।
আরও খেপে গেল টেরিয়ার। রাগে ভাষা হারিয়ে ফেলল। ঝাল। মেটাল গাড়িটার ওপর। বন বন করে ঘুরে উঠল স্টিয়ারিং।। কৰ্কশ আর্তনাদ উঠল টায়ারের। ঘুরে গেল নীল স্পোর্টস কারের নাক। জোর এক ঝাঁকুনি খেয়েই লাফ দিল সামনে। তীব্ৰ গতিতে ছুটে চলে গেল।
লাইব্রেরিতে আমার কার্ড ও-ব্যাটাই চুরি করেছে, কথা বলল রবিন। আমরা কাজে নেমেছি, জেনে গেছে ব্যাটা।
জানুক, লোককে জানাতেই তো চাই আমরা, বলল কিশোর। তবে, কাজটা আরও জরুরি হয়ে পড়ল আমাদের জন্যে। প্রথম কেসে ফেল করা চলবে না কিছুতেই।
পেছনে ফিরে চাইল একবার কিশোর। পাইপ অর্গান নিয়ে ব্যস্ত এখন রাশেদ চাচা, বোরিস আর রোভার। চাচীকে দেখা যাচ্ছে না। নিশ্চয় টেবিলে খাবার সাজাতে গেছেন।
একটু সময় পাওয়া গেল, বলল কিশোর। চল, লাঞ্চের ডাক পড়ার আগেই মীটিং শেষ করে ফেলি।
দুই সুড়ঙ্গের দিকে এগিয়ে চলল তিন গোয়েন্দা।
তাড়াহুড়ো করে এগোতে গিয়ে অঘটন ঘটাল কিশোর। মাটিতে পড়ে থাকা একটা আলগা পাইপে পা দিয়ে বসল। গড়িয়ে চলে গেল পাইপ। তাল সামলাতে না পেরে বেকায়দা ভঙ্গিতে পড়ে গেল সে।
তাড়াতাড়ি দুদিক থেকে গোয়েন্দা প্রধানকে তুলে বসাল রবিন আর মুসা।
প্ৰচণ্ড ব্যথায় দাঁতে দাঁত চেপে আছে কিশোর। আমার পা! …ভেঙেই গেছে বোধহয়। গুঙিয়ে উঠল সে। উফফ, এই যে, এখানে!
দেখা গেল, ইতিমধ্যেই ফুলে উঠতে শুরু করেছে ডান পায়ের গোড়ালির ওপরের গাঁট।
ভীষণ ব্যথা! বিকৃত হয়ে গেছে কিশোরের মুখ। উফফ, বোধহয় ডাক্তারই ডাকতে হবে!
<