আমার নৌকা, বিড়বিড় করে বলল পাপালো। জোর করে ঠেকিয়ে রেখেছে চোখের পানি। নৌকা নেই। গুপ্তধন খোঁজার আশা শেষ।

তই তো! পাপালোর কত বড় ক্ষতি হয়ে গেছে, এতক্ষণে বুঝতে পারল যেন রবিন। কিন্তু একাজ করল কেন লোকটা? দুর্ঘটনা, নাকি ইচ্ছে করেই?

ইচ্ছে করে! রাগ প্ৰকাশ পেল পাপালোর গলায়। নইলে থামত ও। এসে জিজ্ঞেস করত, বোটটা কার। দুঃখ প্রকাশ করত।

ঠিকই বলেছ বলল রবিন। কিন্তু কেন? তোমার নৌকা ভেঙে দিল কেন? কার কি লাভ?

আমি মোহর খুঁজে বেড়াই, এটা লোকের পছন্দ না, কাঁদো কাঁদো গলায় বলল পাপালো। জেলেরা দেখতে পারে না। আমাকে। এই উপসাগর ওদের। এতে বাইরের কারও ভাগ বসানো সইতে পারে না। দীর্ঘ এক মুহূর্ত নীরবতা। যতদূর চোখ যায়, কোন নৌকা বা জাহাজের চিহ্নও নেই। আর কতক্ষণ থাকতে হবে এ-দ্বীপে?

তোমার নৌকা গেল, অবশেষে বলল রবিন। দামি অনেক জিনিসপত্র গেল আমাদেরও।

হ্যাঁ, গম্ভীর হয়ে আছে মুসা। অনেক দামি। একে অন্যের দিকে চেয়ে আছে দুই গোয়েন্দা। দুজনের মনে একই ভাবনা। এক সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল দুজনে, ওগুলো তো তুলে আনতে পারি। আমরা!

বিষণ্ণতা ঝেড়ে ফেলল পাপালো। হাসল। নিশ্চয় পারি। চল। আমি সাহায্য করব তোমাদেরকে।

মুসা। পানিতে নামল। হেঁটে চলল। ডুব দিল গভীর পানিতে এসে।

পানির ওপরে রোদ। ছোট ছোট ঢেউ। তলার বালিতে শুয়ে থাকা নৌকার গায়ে বিচিত্র ভঙ্গিতে নাচছে সূর্যের আলো। ফ্লিপার নাচিয়ে দ্রুত নেমে চলেছে। রবিন আর মুসা। পাপালোর ওসব দরকার নেই। ভারি একটা পাথর ধরে রেখেছে দুহাতে। দুই সঙ্গীর চেয়ে অনেক দ্রুত নামছে

পাথরের ভারে।

নৌকার কাছে পৌঁছে গেল পাপালো। অর্ধেক পথও নামতে পারেনি এখনও অন্য দুজন। এক পাশে কাত হয়ে আছে নৌকাটা। জিনিসপত্র ভেতরে কিছু কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আশপাশে। দুহাতে যা পারল, নিয়ে রওনা হয়ে গেল। আবার ওপরে।

পাশ দিয়ে নামার সময় পাপালোকে হাসতে দেখল দুই গোয়েন্দা। সাগরের শান্ত তলদেশে এসে কেমন এক ধরনের অনুভূতি জাগল। বিপদে পড়েছে, ভুলেই গেল। পাশাপাশি নেমে এল নৌকাটার ধারে। সাপের মত নাচছে পালের দড়ি। দড়ির কাছ থেকে দূরে থাকল রবিন। কি জানি, আবার যদি পায়ে পেচিয়ে যায়! নিজের একটা প্যান্ট পড়ে থাকতে দেখে তুলে নিল। পাপালোর জুতো জোড়া তুলে নিল মুসা। আরও জিনিসের জন্যে চাইল এদিক ওদিক।

খুব ধীরে ধীরে এপােশ ওপােশ দোল খাচ্ছে নৌকাটা, ছেড়া পালটাও দুলছে তালে তালে। বেশ জোরালো স্রোত বইছে পানির তলায়।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই যা তোলার, তুলে ফেলল ওরা। অগভীর পানিতে এসে দাঁড়াল। তিনজনেরই দুহাত বোঝাই জিনিসপত্রে।

মনে হয়। আর কিছু নেই, হেসে বলল পাপালো। সবই তুলে এনেছি।

তই তো মনে হচ্ছে, বলল মুসা। ছপাৎ ছপাৎ আওয়াজ তুলে হেঁটে চলল। ওরা তীরের দিকে। তীরে পৌঁছে ভেজা জিনিসপত্র নামিয়ে রাখল। বসে পড়ল। ওগুলোর পাশে।

হঠাৎ কি মনে পড়তেই কাপড়ের স্তুপে খুঁজতে শুরু করল পাপালো। পেল না। আরে! আমার কম্পাস কই! তোমরা তোলনি?

এদিক ওদিক মাথা নাড়ল দুই গোয়েন্দা।

তোমরা বস। আমি নিয়ে আসছি। আবার পানিতে নামল গিয়ে পাপালো।

কাপড়গুলো চিপে ছড়িয়ে দেয়া দরকার। শুকাক। বলল মুসা।

মাথা বুকিয়ে সায় দিল রবিন।

কাপড় শুকাতে দিয়ে এসে আবার আগের জায়গায় বসল ওরা।

খবর পাঠানোর কোন উপায় নেই সাগরের দিকে চেয়ে বলল রবিন। রাফাত চাচা গাধা ভাববেন আমাদেরকে। বোকার মত আবার আটকা পড়েছি এসে এই দ্বীপে।

এটা আমাদের দোষ নয়, পাপালোরও না, ভারি একটা টর্চের পানি ঝাড়তে ঝাড়তে বলল মুসা। এখন না পারলেও অন্ধকার হলে পারব। টর্চের সাহায্যে।

কিন্তু অন্ধকার হতে এখনও অনেক দেরি, আকাশের দিকে তাকাল একবার রবিন। খিদেয় পেট জ্বলছে। এতক্ষণ সইব কি করো

কাপড়গুলো শুকাক আগে। খিদের ব্যাপারটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে, পাপালো আসুক।

এই সময় মনে হল ওদের, পাপালো গেছে অনেকক্ষণ। এতক্ষণ ফিরে আসার কথা তার। ফিরে তো এলই না, একবার ভাসেওনি এপর্যন্ত। সঙ্গে গ্যাস ট্যাংক নেই। একটানা পনেরো মিনিট দিম আটকে রাখতে পারে না কোন মানুষ সতর্ক হয়ে উঠল ওরা। বিপদের গন্ধ পেল। নিশ্চয়, বিড়বিড় করে বলল রবিন। নিশ্চয় কোন বিপদে পড়েছে!

কোন কিছুতে আটকে যায়নি তো! ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুসার মুখ। জলদি চল, দেখি কি ঘটেছে।

দ্রুত আবার ডুবুরির সরঞ্জাম পরে নিল দুজনে। পানিতে এসে নামল। হেঁটে চলে এল গভীর পানির ধারে। সবুজ পানিতে উজ্জ্বল রোদ নিচের দিকে তাকাল ওরা একবার। পেছন ফিরে চিত হয়ে পড়ল পানিতে। ডুব দিল।

আগের মতই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে তলার বাকি। কিন্তু পাপালো কোথায়? নৌকাটাও নেই। দ্রুত নেমে চলল দুজনে। ধড়াস ধড়াস করছে বুকের ভেতর।

ওপরের দিকে কয়েক ফুট ঢালু হয়ে নেমেছে পাথরের দেয়াল, তারপর একেবারে খাড়া। ছোটবড় অনেক গর্ত দেয়ালে। ওগুলোর পাপালোকে টেনে নিয়েছে, ভাবল রবিন।

না, নৌকাটা আছে। আগের জায়গায় নয়। ওখান থেকে বিশ ফুট দূরে। দেয়ালের গা ঘেঁষে পড়ে আছে। দুলছে ধীরে ধীরে। বাড়ি খাচ্ছে পাথুরে দেয়ালে।

তাড়াতাড়ি নৌকার দিকে সাঁতরে চলল দুই গোয়েন্দা। কাছে চলে এল। কিন্তু কোথায় পাপালো? নৌকার তলায় মরে পড়ে নেই তো?

বালিতে এসে ঠেকল রবিন। ভয়ে ভয়ে উঁকি দিল নৌকার তলায়। না, নেই। ওখানে পাপালো। গেল কোথায়! এখানকার পানিতে হাঙর নেই, জানা আছে। রবিনের। অক্টোপাস বা ওই ধরনের কোন ভয়াবহ সামুদ্রিক জীবও নেই। তাহলে?

বাহুতে ছোঁয়া লাগতেই প্ৰায় চমকে উঠল রবিন। ফিরে চাইল মুসা। দুটো আঙুল জড়ো করে দেখাল গোয়েন্দা সহকারী। ইঙ্গিতটা বুঝল রবিন। পাশাপাশি থাকতে বলছে। আঙুল তুলে একটা গর্ত দেখােল মুসা। তারপর সাঁতরাতে শুরু করল ওদিকে।

পাশাপাশি কয়েকটা গর্ত। উঁকি দিয়ে দেখল দুজনে। ভেতরটা অন্ধকার। টর্চ আনা উচিত ছিল। গর্তের মুখে পানিতে হাত দিয়ে নাড়া দিয়ে দেখল। কোন জবাব এল না। বেরিয়ে এল শুধু ছোট মাছের দল।

বড় বড় কিছু গর্তের মুখে ঘন হয়ে জন্মেছে শেওলা। ওপরের দিকে মাথা তুলে দুলছে তালে তালে। দুহাতে ওগুলো সরিয়ে উঁকি দিতে হচ্ছে ওসব গর্তের ভেতরে। কিন্তু অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে না।

পাঁচ মিনিট পেরিয়ে গেল। দেয়ালের ধার ধরে ধরে প্রায় শখানেক ফুট চলে এসেছে ওরা নৌকার কাছ থেকে। কিন্তু পাপালোর কোন চিহ্নই নেই।

থেমে গেল ওরা। মুখ কাছাকাছি নিয়ে এল। মাস্কের ভেতরে দুজনের চোখ দেখতে পাচ্ছে দুজনে। মুসার চোখ বড় বড় হয়ে গেল, দেখল রবিন। উদ্বেগ প্রকাশ পাচ্ছে। বুড়ো আঙুল তুলে উল্টো দিক দেখাল সে। মাথা ঝোঁকাল মুসা। দুজনে আবার এগিয়ে চলল নৌকাটার দিকে।

নৌকার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে ওরা। এই সময় দেখতে পেল ওকে। দ্রুত উঠে যাচ্ছে ওপরে পাপালো। আশ্চর্য বিশ মিনিট পানির তলায় দম আটকে রাখতে পারলা অবাক হল দুই গোয়েন্দা। ওরাও উঠতে শুরু করল ওপরের দিকে।

ভুসস করে মাথা তুলল দুই গোয়েন্দা। কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে আছে পাপালো। হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছে জোরে জোরে। অক্ষতই মনে হচ্ছে। ওদেরকে দেখে হাসল।

পাপালোর পাশে চলে এল দুই গোয়েন্দা। ঠেলে মুখের একপাশে সরিয়ে দিল মাস্ক।

পাপু হাঁপাতে হাঁপাতে বলল মুসা। ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে আমাদেরকে।

কোথায় ছিলে তুমি? বন্ধুকে সুস্থ দেখে হাসি ফুটেছে। রবিনের মুখে। কি হয়েছিল?

হাসল আবার পাপালো। একটা জিনিস পেয়েছি। বলত কি?

তোমার কম্পাস?

এদিক ওদিক মাথা নাড়ল গ্ৰীক কিশোর। জ্বলজ্বল করছে কালো চোখের তারা। হয়নি। আবার বল।

বুঝেছি! মোহর চেঁচিয়ে উঠল মুসা।

হাসছে পাপালো। ডান হাত বাড়াল। মুঠো খুলল। এক টুকরো সোনা। মুদ্রা ছিল এককালে। বেঁকেচুরে গেছে ধারগুলো।

মোহরের সিন্দুকটা পেয়েছ নাকি? জানতে চাইল রবিন।

না। দেয়ালের একটা গর্ত দিয়ে মাছ ঢুকতে বেরোতে দেখলাম। ভাবলাম, মাছেরা যদি পারে, পাপুও পারবে। ঢুকে পড়লাম ভেতরে। চুপ করল পাপালো। নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল, দ্বীপের তলায় এক গুহা আবিষ্কার করেছি। ওখানেই পেয়েছি। এই সোনার টুকরো। বাজি ধরে বলতে পারি, আরও অনেক মোহর আছে ওখানে।

<

Super User