মৃত্যু পরোয়ানা

টমাস, লর্ড লিটলটনের কাছে রাতে যে এসেছিল, আর ভয়ঙ্কর সতর্কসংকেত দিয়েছিল, সে কি ভূত ছিল নাকি স্বপ্নের কোনো চরিত্র, তা কখনও জানতে পারব না আমরা। এ নিয়ে লেখালেখিও হয়েছে বিস্তর। কিছু লোক ভূতে বিশ্বাস করেন, আবার অনেকে করেন না। এমনকি যখন ভবিষ্যদ্বাণীটা এল তারপরও মনে হয়েছিল ওটা আসলে কিছুই না। এমনকী মৃত্যুর আধ ঘণ্টা আগে লর্ড লিটলটন নিশ্চিন্ত হয়ে গিয়েছিলেন ভুতুড়ে অতিথি স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নন। আসলেই কি তাই?

১৭৭৯ সালের নভেম্বরের এক সন্ধ্যা। লর্ড লিটলটন তাঁর খাস ভৃত্যকে ডেকে বললেন তিনি ঘুমাতে যাবেন। ভুরু কুঁচকে উঠল ভৃত্যের। এত তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাওয়ার অভ্যাস নেই তার মালিকের। সাধারণত বিছানায় যান মধ্যরাতের পরে, কখনও কখনও বাড়িতে অতিথি থাকলে তো ভোর পর্যন্ত আড্ডা চলে। কাজেই কামরা ছাড়ার আগে একটু দ্বিধা করল সে।

আশা করি, আপনি অসুস্থ হয়ে পড়েননি? বলল সে।

না, উইলিয়াম। সেরকম কিছু না। আমি বেশ ভাল আছি। তবে আমার মনে হয় এখন ঘুমাতে যাওয়া উচিত। ক্লান্তি লাগছে, তাছাড়া আবহাওয়াটা কেমন দেখেছ তো। ভারি আর স্যাঁতস্যাঁতে। মনে হচ্ছে যেন একটা ঝড় আসতে চলেছে।

স্নায়ুগুলোকে শান্ত করার জন্য একটা ওষুধ খেলেন লর্ড লিটলটন। তারপর বিশাল খাটটায় শুয়ে পড়লেন। উইলিয়াম খাটের চারধারের পর্দা টেনে দিল। তারপর বাতি নিভিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে পা টিপে টিপে বেরিয়ে গেল কামরা থেকে। একটার পর একটা মিনিট পেরিয়ে যেতে লাগল। বাইরের গুমোট আবহাওয়ায় হঠাৎ করেই দমকা বাতাস বইল। বাগানের গাছগুলোতে খস খস শব্দ তুলে বয়ে গেল, আর জানালায় ডালপালা বাড়ি খাওয়ার শব্দ হলো। আর এই শব্দ নিরুদব একটা ঘুমের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াল। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে লাগলেন লর্ড লিটলটন। মাথায় নানান চিন্তা এসে জট পাকিয়ে যাচ্ছে। তারপর আবার শুরু হয়েছে মুষলধারে বৃষ্টি। এর সঙ্গে তাকে জাগিয়ে রাখার দায়িত্ব নিয়েছে প্যারিস চার্চের ঘড়ির ঢং ঢং শব্দ।

এভাবে মনে হয় কয়েকটা ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। আস্তে-আস্তে ঘুমে জড়িয়ে আসছে লিটলটনের চোখ। এসময়ই একটা অন্যরকম শব্দে তন্দ্রা ভাব কেটে গেল। মনে হয় যেন দড়িতে টার্ন পড়েছে এভাবে বিছানায় উঠে বসলেন, আর অন্ধকারের দিকে চেয়ে রইলেন। শব্দটাকে বিশাল কোনো পাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজের মত লাগল। তবে এটা আসছে কামরার ভিতর থেকে। কিন্তু কোনো পাখি ঘরের ভিতর ঢুকবে কীভাবে, ভাবলেন তিনি। হৃৎপিণ্ডের গতি দ্রুততর হলো তাঁর। ওটা কী? সাহস করে বিছানা ছেড়ে উঠে দেখবেন? নাকি উইলিয়ামকে ডাকবেন?

এসময়ই ডানা ঝাপটানোর শব্দ থেমে গেল। নীরব হয়ে গেল চারপাশ। এটা আরও ভয়াবহ। কামরায় তিনি ছাড়া আরও একটা অশুভ উপস্থিতির আভাস পাচ্ছেন লর্ড। সাহায্যের জন্য জোরে চিৎকার করার তাগিদ অনুভব করলেন। চেষ্টা চালালেন, কিন্তু মুখ ফুটে কোনো আওয়াজ বেরোল না।

খাড়া হয়ে বসা লিটলটনের দৃষ্টি চলে গেল বিছানার কিনারার পর্দার দিকে। তারপরই তাঁর আতঙ্কিত চোখের সামনে ওটা নড়তে শুরু করল। একসময় সরে গেল। দেখা গেল সেখানে অপার্থিব একটা আলোয় দাঁড়িয়ে আছে আগন্তুক। তাঁর সারা জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দরী, মোহনীয় এক নারী সে। আবার কথা বলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোনো বোল বেরোল না। তিনি কেবল জায়গাতেই স্থির হয়ে বসে, তাকিয়ে থাকলেন দীঘল শরীরের রহস্যময় নারীটির দিকে।

তারপরই কথা বলে উঠল নারীটি, টমাস, লর্ড লিটলটন, আমার কথাগুলো মনে গেঁথে নাও। মিষ্টি একটা কণ্ঠ, তবে অবশ্যই মানুষের গলার শব্দ না। কণ্ঠটা শুনলে বাতাস আর ঢেউয়ের কথা মনে পড়ে। আবার হালকা একটা প্রতিধ্বনি হয় এর, মনে হয় একই সঙ্গে সব দিক থেকে আসছে। শব্দটা যেন শোনার সঙ্গে সঙ্গে অনুভবও করছেন তিনি।

আমার কথাটা মনে রাখো আর নিজে নিজে প্রস্তুত হও। তিন দিন সময়, তৃতীয় দিন রাত ঠিক বারোটার সময় তুমি মারা যাবে।

প্রস্তুত হও…

আতংকে শিউরে উঠলেন লিটলটন। মুখ বেয়ে ঘাম নামছে টপটপ করে, যখন তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করছেন এই ভবিষ্যত্বক্তাকে প্রশ্ন করার। কিন্তু দুর্বোধ্য একটা কর্কশ আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই বেরোল না তাঁর মুখ থেকে।

প্রস্তুত হও…প্রস্তুত হও… আস্তে-আস্তে মিলিয়ে গেল রহস্যময় নারীর কণ্ঠস্বর, সেই সঙ্গে গায়েব হয়ে যেতে শুরু করল সে-ও। পর্দাটা ফিরে এল আগের জায়গায়। আবার নীরব হয়ে গেল চারধার। ভয়ে, যন্ত্রণায় বিহ্বল লিটলটন শরীরটা বিছানায় ছেড়ে দিলেন, তারপর নিস্তেজ ভাবে পড়ে রইলেন সেখানে।

সকালে উইলিয়াম এল লর্ডকে ঘুম থেকে জাগাতে। বিছানায় মড়ার মত পড়ে থাকা কাঠামোটাকে দেখে তার মনে হলো, মালিকের নিশ্চয়ই রাতে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত লর্ডকে জাগিয়ে তুলতে পারল উইলয়াম। কিন্তু তাকে মোটেই স্বাভাবিক দেখাচ্ছে না। উইলিয়াম বুঝে উঠতে পারল না কী করবে। সে কি এখনই একজন ডাক্তারের কাছে যাবে? কিন্তু তাহলে বিধ্বস্ত এই মানুষটাকে একা রেখে যেতে হবে। বিছানায় পড়ে আছেন এখন তিনি, চোখ বড় বড়, শরীর এমনভাবে কাঁপছে যেন জ্বর এসেছে। উদ্বিগ্ন উইলিয়ামের প্রশ্নেরও কোনো ভাল উত্তর দিতে পারলেন না। না, তিনি অসুস্থ নন, তবে ভাল নেই। নানান ধরনের অসঙ্গতিপূর্ণ কথা বলতে লাগলেন। একবার বলেন পুরো কামরাটা খুঁজে দেখতে, একবার জানালা বন্ধ করতে বলেন তো আবার তার পরেই জানালা খোলার আদেশ দেন। এই বলেন ডাক্তর ডাকো, পরমুহূর্তেই ডেকো না।

তবে ধীরে-ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠতে শুরু করলেন লিটলটন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে উইলিয়াম বলল সে বরং মালিকের জন্য এক বাটি গরুর মাংসের স্যুপ নিয়ে আসছে। তার মনে হয় এখন এটাই লর্ডের জন্য সবচেয়ে দরকারি। ফ্যাকাসে আর বিধ্বস্ত চেহারার লিটলটন সম্মতি জানালেন, হ্যাঁ, মনে হয় স্যুপটা ভাল লাগবে আমার। তাঁর কণ্ঠটা এখন বেশ স্বাভাবিক।

আর মালিক, একজন ডাক্তার ডাকব. কি?

না, এখন আমি ঠিক আছি। খুব সম্ভব আমি একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি। এর কোনো ওষুধ ডাক্তারের জানা আছে কিনা এ ব্যাপারে সন্দেহ আছে আমার। তবে আমার কিছু বন্ধুকে আমি দেখতে চাই। মি.এজ, মি. এইসকফ, মি পিগউ-এদের খবর পাঠাতে হবে। যেসব বন্ধুদের পাশে পেতে চাই তাদের সবার নাম আমি তোমাকে পরে বলছি। এখন স্যুপটা নিয়ে এসো। তারপর আমি বিছানা ছাড়ব।

একা হয়ে যেতেই বার-বার রাতের ঘটনাটা নিয়ে ভাবলেন। এটা কি একটা স্বপ্ন? ঘটনাটা সত্যি বলে মনে হচ্ছিল, কিন্তু এটাও ঠিক-স্বপ্ন সত্যিই মনে হয়। বিছানা থেকে নেমে সাবধানে পর্দাগুলো পরীক্ষা করলেন। গত রাতের রহস্যময় মহিলাটি এখানে দাঁড়িয়ে ছিল তার কোনো প্রমাণই নজরে এল না। তবে এখনও মনের ভিতর জ্বলজ্বল করছে সে। তার চেহারা, কণ্ঠ এমনকী তার বলা কথাগুলো-সব কিছু।

আর স্মৃতিটা মনে পড়তেই কেঁপে উঠলেন। তিনি মরতে চান। এখনও বয়স বেশি হয়নি তার। জীবনটা উপভোগ করছেন। এখন একটা কাজই করার আছে তা হলো বন্ধুদের সঙ্গে এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলা।

সকাল হতেই লিটলটনের ডাকে একজনের পর একজন বন্ধু হাজির হতে লাগলেন হিল স্ট্রীটের বাড়িটায়। তাদের প্রত্যেককে গত রাতের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার গল্প শোনালেন লিটলটন। মনেমনে আশা করেছিলেন হেসে উড়িয়ে দিয়ে তাঁকে আশ্বস্ত করবেন তাঁরা। ঘটলও তাই। সবাইই গল্পটায় দারুণ মজা পেলো।

সে কি সুশ্রী ছিল, টমাস? জানতে চাইলেন মাইলস এণ্ড্রুজ।

সুশ্রী নয়, সুন্দরী। জবাব দিলেন লিটলটন।

হেসে গড়িয়ে পড়লেন বন্ধুরা। সুন্দরী? সুন্দরী নারীর স্বপ্ন দেখেছ? যতদূর বোঝা যাচ্ছে তিন দিনের মধ্যে তোমার বিয়ে হবে, মরবে না। সন্দেহ নেই এটা একটা স্বপ্নই। আশা করব কুসংস্কার তোমাকে পেয়ে বসবে না।

আর বন্ধুদের কথা-বার্তা আর যুক্তি শেষ পর্যন্ত লিটলটনকে আশ্বস্ত করল তাঁদের কথাই ঠিক। মন মরা ভাব কেটে যেতে লাগল তার। যদিও যখনই একা হন মহিলার চেহারা আর কথাগুলো হামলে পড়ে স্মৃতিতে। তাই ঠিক করলেন দুশ্চিন্তাটা ঝেটিয়ে মাথা থেকে দূর করে দেবেন, অন্তত তিন দিন পার না হওয়া পর্যন্ত। বাড়িটা তাই লোকজনে ভরপুর করে রাখলেন। সকালের নাস্তা, দুপুরের লাঞ্চ আর রাতের খাবার খেলেন বন্ধুবান্ধবদের নিয়েই।

পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত কাজে লাগল। ধন্যবাদ অবশ্য পাবেন লিটলটনের চমৎকার বন্ধুরা। তারা এমন হাসি-ঠাট্টায় লর্ডকে মাতিয়ে রাখলেন যে, আবার আগের সেই লিটলটন হয়ে উঠেছেন তিনি। হাসি-খুশি, প্রাণবন্ত।

তৃতীয় দিন সকালে খুব ধীরে হেঁটে ডাইনিংয়ে ঢুকলেন লিটলটন। ঘড়িতে তখন সাড়ে দশটা। খুব শান্তভাবে ইতোমধ্যে এখানে উপস্থিত হওয়া বন্ধুদের স্বাগত জানালেন। তার শরীর কেমন জিজ্ঞেস করা হলে কেবল মাথা ঝাকলেন। অন্য বন্ধুদের সঙ্গে উপস্থিত আছেন জনাথন গ্রেভস নামের এক জাদুকর এবং চার্চের অর্গান বাজিয়ে। লর্ডকে নিয়ে আবার দুশ্চিন্তাটা পেয়ে বসেছে তাঁকে। কারণ তাঁর জাদু কিংবা অর্গান বাজানো লিটলটনের ওপর কোনো প্রভাবই ফেলছে না। আবার মন মরা হয়ে গেছেন লর্ড।

তবে রাতের খাবারের সময় মেঘ কেটে গেল লিটলটনের চেহারা থেকে। খাওয়া শেষে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে অতিথিদের তাকিয়ে হেসে বললেন, বন্ধুরা, আমি আবার আগের আমি হয়ে গেছি। তোমাদের ধন্যবাদ।

কিন্তু একটু পরেই আবার বিষণ্ণ হয়ে উঠলেন লর্ড। তিনি যখন কামরা থেকে বেরিয়ে গেলেন তখন গ্রেভস বললেন, কথা বলে আর ঠাট্টা-মস্করা করে তাকে আর খুশি রাখতে পারব না আমরা। বরং আমার মনে হয় এখন একটা প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।

প্রতারণা? বললেন মি.এইসকফ, তুমি কী বোঝাতে চাচ্ছ?

একবার দরজার দিকে তাকালেন গ্রেভস, তাঁদের আমন্ত্রণদাতা কথাগুলো শুনতে পাবেন না এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য। এটা তেমন কিছু না, খুব নিচু কণ্ঠে বলে চললেন, টমাস মনমরা হয়ে আছে, কারণ সে ভাবছে মাঝরাতে মারা যাবে সে। তার মনে হবে বাড়ির প্রতিটি ঘড়ি তার দিকে তাকিয়ে আছে, বলছে রাত বারোটায় তোমার বারোটা বাজাব আমরা। চার ঘণ্টা, তিন ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা এভাবে সময় গুণতে গুণতে তার অবস্থা আরও কেরোসিন হয়ে যাবে। মাঝরাত যখন আসবে তখন দেখা যাবে হতভাগা লিটলটন দুশ্চিন্তাতেই মরেই গেছে। কিন্তু যদি এমন হয় যখন মাঝরাত আসবে, তখন সে যদি শান্তিতে বিছানায় ঘুমায়, তখন বিপদ কেটে যাবে।

কিন্তু কীভাবে মধ্যরাতের আগেই দুশ্চিন্তামুক্ত করতে পারব তাঁকে? জানতে চাইলেন মি. এইসকফ।

অন্যদের দিকে ঝুঁকে পড়ে গ্রেভস বললেন, বাড়ির প্রতিটি ঘড়িকে আমরা আধ ঘণ্টা এগিয়ে দেব। এই বলে নিজের ঘড়িটা পকেট থেকে বের করে সাবধানে ওটার সময় আধ ঘণ্টা এগিয়ে দিলেন। কিছু সময় তর্ক-বিতর্কের পর সবাই মেনে নিলেন বুদ্ধিটা ভালই কেঁদেছেন গ্রেভস। তা ছাড়া এতে তাদের বন্ধুকে চূড়ান্ত সময়ে আধ ঘণ্টা কম দুশ্চিন্তায় থাকতে হবে। তারপর সবাইই নিজেদের ঘড়ি আধ ঘণ্টা করে এগিয়ে দিলেন। এবার জনাথন গ্রেভস বেল টিপে উইলিয়ামকে ডেকে আনলেন। তারপর তাকে পুরো পরিকল্পনাটা খুলে বলে জানতে চাইলেন সে কি বাড়ির সবগুলো ঘড়ির সময় পাল্টে দিতে পারবে কিনা।

হ্যাঁ, স্যর। চিন্তা করবেন না একটুও। এমনকী ড্রেসিং টেবিলের ওপর মালিকের নিজের যে ঘড়িটা আছে, ওটার সময়ও কেমন সুন্দর পাল্টে দিই দেখুন। বলল উচ্ছ্বসিত পরিচারক।

তারপরই লর্ড লিটলটন ফিরে এলেন। আলাপ চলতে লাগল। সাড়ে এগারোটার দিকে লর্ড লিটলটন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন এখন ঘুমাতে যাবেন তিনি। সবাইকে শুভরাত্রি জানিয়ে শান্তভাবে কামরা ছাড়লেন।

তিনি চলে যাওয়াতে হাঁফ ছাড়লেন বন্ধুরা। এবার মনের ভিতরের কথাগুলো খোলাখুলি আলাপ করতে পারলেন তাঁরা। একটা প্রেতাত্মা লর্ড লিটলটনকে সতর্ক করে দিয়েছে এটা বিশ্বাস করতে বাধছে সবারই। এটা স্বপ্ন ছিল, এর চেয়ে ভাল ব্যাখ্যাও কেউ দিতে পারলেন না।

আমার মনে হয় আমাদের ঘড়ির সময় এবার ঠিক করে নিতে পারি। মন্তব্য করলেন জনাথন গ্রেভস। ও, ঈশ্বর, এখন বাড়ি ফিরব আমি। বুঝতে পারলেন এখন প্রায় মধ্যরাত +

আমিও, বললেন মি. এইসরুফ। আর আমার বন্ধু শান্তিতে ঘুমাচ্ছে এটা জেনে খুশিমনে বাড়ি ফিরছি।

তাই যেন হয়, বললেন আরেকজন অতিথি। তাঁরা সবাই চললেন তাদের কোট যেখানে রাখা হয়েছে সেই ক্লোকরুমের দিকে।

এসময়ই হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত একটা ঘণ্টা পড়ার শব্দ হলো। নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন তাঁরা, আতংক নিয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকালেন। আরেকটা ঘণ্টা পড়ল।

এই একটা ঘড়ির সময় বদলাতে পারিনি আমরা, ফিসফিস করে বললেন গ্রেভস। প্যারিস চার্চের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম…

একটার পর একটা ঘণ্টা বেজেই চলল, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত…আর ঠিক তখনই ওপর থেকে একটা চিৎকার শোনা গেল।

তাড়াতাড়ি আসুন, মালিক মারা যাচ্ছেন…।

আট, নয়, ঘণ্টা বেজেই চলেছে। সিঁড়ি বেয়ে পড়িমরি করে ছুটলেন তারা, দেখলেন লর্ড লিটলটনের বেডরুমের দরজার সামনে ফ্যাকাসে চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে উইলিয়াম। দশ, এগারো… ঘরের ভিতর ঢুকে গ্রেভস, এইসকাফ আর অন্যরা দেখলেন যন্ত্রণায় মোচড় খাচ্ছে লিটলটনের দেহ। বারো, মধ্যরাতের শেষ ঘণ্টা বাজল। আর তাদের চোখের সামনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন লর্ড।

পরে লাইব্রেরিতে জড় হওয়া অতিথিদের পুরো ঘটনাটা খুলে বলল উইলিয়াম।

মালিক তার কামরায় ঢুকে ঘুমানোর জন্য তৈরি হতে শুরু করলেন। তার কাপড় সরাবার সময় দেখলাম বার-বার নিজের ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছেন। আমি চাচ্ছিলাম যতক্ষণ সম্ভব এখানে থাকতে। কারণ খুব আস্তে-ধীরে সব কিছু করছিলেন। বিছানায় গিয়ে বললেন লাগোয়া পর্দাগুলো টেনে দিতে। তারপর আবার নিজের ঘড়ির দিকে তাকালেন, বারোটা বাজতে কয়েক মিনিট বাকি। এবার আমার ঘড়িটা দেখতে বললেন, যখন সময়টা মিলে গেল তখন আশ্বস্ত হলেন। এবার দুটো ঘড়িই কানের কাছে নিয়ে নিশ্চিত হলেন দুটোই চলছে। ওগুলোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন, মাঝরাত পার হওয়া পর্যন্ত। এবার আমার ঘড়িটা ফিরিয়ে দিয়ে তাঁর ওষুধ তৈরি করতে বললেন। যখন গ্লাস নিয়ে ফিরে এলাম তখন সোয়া বারোটা ( আসলে পৌনে বারোটা)। জোর করে একটা হাসি ফুটিয়ে বললেন, রহস্যময় নারী মোটেই ভাল ভবিষ্যত্বক্তা নন। আর অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। আমার ওষুধ দাও। ওটা খেয়ে ঘুমানোর তদ্বির করব।

ধীরে-সুস্থে ওষুধটা পান করে আমাকে শুভরাত্রি জানালেন। কিন্তু যখনই ঘুমাতে যাবেন গির্জার ঘড়ি বাজতে শুরু করল। এসময়ই মালিকের দমবন্ধ হয়ে এল। আমাকে কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন। কী বলতে চেয়েছিলেন তা বলতে পারব না, দরজার দিকে দৌড়ে গেলাম আপনাদের, তাঁর বন্ধুদের ডাকতে।

ওহ! রহস্যময় নারী আসলেই ভবিষ্যতে জানত, বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন জনাথন গ্রেভস, আর সে তার কথা রেখেছে…

<

Super User