নিজের তাঁবুতে ফিরে বিজয়ী নাইট দেখলে অনেকেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তার জন্যে। সবাই বর্ম খোলায় তাকে সাহায্য করতে চাইলো। সে আজ ওদের সম্মান বাঁচিয়েছে। তাছাড়া সে আসলে কে তা জানার আগ্রহও তাদের কম নয়।
কিন্তু সবাইকেই সবিনয়ে ফিরিয়ে দিলো নাইট। বললো, আপনারা কেন খামোকা কষ্ট করবেন? আমার ভূত্যই যথেষ্ট আমাকে সাহায্য করে জন্যে।
হতাশ মনে সবাই চলে গেল তবু ছেড়ে। তরুণ নাইটের ভূত এগিয়ে এলো তাবুর প্রবেশমুখটা বন্ধ করে দিলো। মনিবের গা থেকে একে একে খুলে নিতে লাগলো যুদ্ধের পোশাকু।
বোকা বোকা চেহারা ভূত্যের। মাথায় এক ধরনের নরম্যান টুপি, যাতে তার মুখের বেশিরভাগই ঢাকা পড়ে গেছে। প্রভুর মতো সে-ও বোধহয় সবার অচেনাই থাকতে চায়।
বর্ম শিরোস্ত্রাণ ছেড়ে হালকা পোশাক পরে নিলো নাইট। তারপর খেতে বসলো। খাওয়া সবেমাত্র শেষ হয়েছে, ভৃত্য এসে জানালো, পাঁচজন লোক তার সাথে দেখা করতে চায়। তাদের সবাই একটা করে যুদ্ধের ঘোড়া নিয়ে এসেছে সাথে করে।
তাড়াতাড়ি মুখের ওপর হুড টেনে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো নাইট।
লোক পাঁচজন আর কেউ নয়, পরাজিত পাঁচ চ্যালেঞ্জারের পার্শ্বচর। পরাজিত নাইটদের ঘোড়া ও অস্ত্রশস্ত্র বিজয়ীর হাতে তুলে দিতে এসেছে। বিজয়ী নাইট হয় ওগুলো রেখে দেবে নয়তো ওগুলোর বদলে উপযুক্ত মূল্য গ্রহণ করবে।
আমার নাম বদোয়া, প্রথমজন বললো, স্যার ব্রায়ান দ্য বোয়াগিলবার্টের পার্শ্বচর আমি। আমার প্রভু আজকের টুর্নামেন্টে যে ঘোড়া ও অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করেছেন সেগুলো তুলে দিতে এসেছি আপনার হাতে। টুর্নামেন্টের নিয়ম অনুযায়ী হয় আপনি ওগুলো গ্রহণ করবেন, না হয় আমার প্রভুকে আবার ওগুলো আপনার কাছ থেকে কিনে নেয়ার সুযোগ দেবেন।
অন্য চারজনও একই কথা বললো। তারপর তারা অপেক্ষা করতে লাগলো বিজয়ীর সিদ্ধান্ত শোনার জন্যে।
তোমাদের চারজনের জন্যে আমার একই জবাব, বদোয়া ছাড়া অন্য চার পার্শ্বচরের দিকে তাকিয়ে বললো নাইট। তোমাদের প্রভুদের ঘোড়া এবং অস্ত্রশস্ত্র আমি নেবো না। ওগুলোর কোনো প্রয়োজন আমার নেই। তবে, আমি গৃহহীন এবং কপর্দকশূন্য, ওগুলোর বিনিময়ে উপযুক্ত মূল্য দিলে আমি নিতে পারি।
আমাদের ওপর নির্দেশ আছে, ঘোড়া ও অস্ত্রশস্ত্র যদি আপনি না নিতে চান, এত্যকে একশো করে স্বর্ণমুদ্রা দেবে আপনাকে। টাকা আমরা সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছি।
ওরে বাবা, সে তো অনেক! জবাব দিলো নাইট। না, না, অত আমার দরকার নেই। অর্ধেক দাও আমাকে। বাকি অর্ধেক তোমরা রেখে দাও। ইচ্ছে হলে মনিবদের ফেরত দিও, না হলে রেখে দিও নিজেরা।
এত পুরস্কার পাবে কল্পনাও করেনি পার্শ্বচররা। মাথা নুইয়ে তারা সম্মান ও কৃতজ্ঞতা জানালো।
তরুণ নাইট এবার ব্রায়ান দ্য বোয়া-গিলবার্টের অনুচরের দিকে ফিরলো।
তোমার মনিবের কাছ থেকে আমি কিছুই নেবো না, বললো সে। ঘোড়া এবং অস্ত্রশস্ত্র তো নয়-ই, টাকাও না। ওর সাথে আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখনও শেষ হয়নি। তোমার প্রভুকে বোললা, এর পরের বার যখন আমরা লড়বো, দুজনের একজন অবশ্যই মরবে। সেই একজন তোমার প্রভুরই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
আপনি নেন না নেন এগুলো আমি এখানেই রেখে যাবো, বললো বদোয়া। নিয়ম অনুযায়ী এসব এখন আপনার সম্পত্তি। আমার মনিব আর কখনও এগুলো ব্যবহার করবেন না।
বেশ, তোমার মনিব যদি না নিতে চায় তুমিই নিয়ে নাও। আমি দিচ্ছি তোমাকে।
ব্যাপারটা রীতিমতো অপ্রত্যাশিত দোয়ার কাছে। অন্য চার ভৃত্যের মতো সে-ও শতকণ্ঠে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানালো তরুণ নাইটকে। তারপর সঙ্গীদের নিয়ে চলে গেল নিজেদের তাবুতে।
এ পর্যন্ত ভালোই চললো, কি বললা, গাৰ্থ? নিজের ভৃত্যের দিকে তাকিয়ে বললো নাইট। স্যাক্সন নাইটরা কি করতে পারে দেখিয়ে দিয়েছি কি না?
তা আর বলতে? আমার ভূমিকাটা কেমন হলো বলুন তো? শুয়োর চরানো স্যাক্সন রাখাল, অভিনয় করলাম নরম্যান চাকরের, মোটামুটি উত্তরে গেছি তাই না?
উৎরে গেছ মানে? তুখোড় অভিনয় করেছো তুমি। তবে আমার ভয় কি জানো?-কবে না তুমি ধরা পড়ে যাও।
কি যে বলেন! ওয়াম্বা ছাড়া আর কারো সাধ্য নেই আমাকে ধরে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
বেশ তা না হয় থাকলাম, কিন্তু, গাৰ্থ, এবার যে আরেকটা কাজ করতে হবে তোমাকে।
একটা কেন একশোটা বলুন।
একশো না, আপাতত এই একটা করো, তাতেই চলবে। একটা থলে দিলো নাইট গার্থের হাতে। এই থলেটা ইহুদী আইজাককে দিতে হবে, পারবে?
খুব পারবো, কোথায় আছে বুড়ো?।
অ্যাশবিতেই। কিন্তু কার বাড়িতে আমি জানি না, তোমাকে খুঁজে বের করতে হবে। ওর কাছ থেকে আমি যুদ্ধের ঘোড়া, অস্ত্র, পোশাক সব ধার করেছি। কথা ছিলো ওগুলো ফেরত দিতে না পারলে দাম দেবো। এই থলেতে আশি স্বর্ণমুদ্রা আছে। তুমি গিয়ে দিয়ে এসো।
এ আর এমন কি কাজ, আমি এক্ষুণি রওনা হচ্ছি।
এই নাও আরো দশ স্বর্ণমুদ্রা, এগুলো তোমার।
.
অ্যাশবির এক ধনী ইহুদীর বাড়িতে উঠেছেন আইজাক মেয়ে রেবেকাকে নিয়ে।
শহরের লোকজনের কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করে ঠিকই বাড়িটা খুঁজে বের করে ফেললো গাৰ্থ। যখন সে বাড়িটার সামনে, ঘোড়া থেকে নামলো তখন বেশ রাত হয়ে গেছে। ওর টোকার জবাবে এক ভৃত্য এসে দরজা খুললো।
ইয়র্কের আইজাক আছেন এ বাড়িতে? জিজ্ঞেস করলো গাৰ্থ।
হ্যাঁ।
গিয়ে বলল, আমি তার সাথে দেখা করতে চাই।
আপনি দাঁড়ান, আমি বলছি গিয়ে দরজা বন্ধ করে চলে গেল ভৃত্য।
এক খ্রীষ্টান আপনার সাথে দেখা করতে চায়, আইজাকের কাছে গিয়ে বললো ভৃত্য।
ভেতরে নিয়ে এসো, বললেন বৃদ্ধ।
দোতলার চমৎকার সাজানো গোছানো একটা কামরায় নিয়ে যাওয়া হলো গাৰ্থকে। কয়েকটা রূপার লণ্ঠনের আলোয় আলোকিত ঘরটা। মাথার টুপিটা একটু টেনে দিলো গার্থ। এতক্ষণ কেবল চোখ ঢাকা ছিলো, এবার নাক ও মুখের খানিকটাও ঢাকা পড়ে গেল।
বৃদ্ধকে চেনে গাৰ্থ। তবু জিজ্ঞেস করলো, আপনিই তো ইয়র্কের আইজাক, তাই না?
হ্যাঁ। কিন্তু তুমি কে?
আমার পরিচয় জানার কোনো প্রয়োজন নেই আপনার। আমি এসেছি একজনের প্রতিনিধি হয়ে।
প্রতিনিধি! কার?
আজকের টুর্নামেন্টে যিনি বিজয়ী হয়েছেন। তার বর্মের দাম পরিশোধ করতে এসেছি আমি। ঘোড়াটাও নিয়ে এসেছি। যে ছেলেটা দরজা খুলে দিয়েছে তার হাতে দিয়ে আস্তাবলে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমার প্রভু যেমন নিয়ে গিয়েছিলেন ঠিক তেমন অবস্থায় ফেরত দিয়েছেন ওটা। কোথাও কোনো চোট পায়নি। এখন বলুন, বর্ম আর অস্ত্রগুলোর জন্যে কত দিতে হবে?
এ নিয়ে পরে আলাপ করা যাবে, আগে গলাটা একটু ভিজিয়ে নাও।
আইজাকের নির্দেশে ভূত্য দুগ্লাস পানীয় নিয়ে এলো। একটা গ্লাস গার্থের দিকে এগিয়ে দিয়ে অন্যটিা নিজে নিলেন আইজাক। বললেন, নাও, খাও। অনেক দূর থেকে এসেছে, নিশ্চয়ই গলা শুকিয়ে গেছে?
গ্লাস তুলে চুমুক দিলো গার্থ। এবং এক চুমুকে শেষ করে ফেললো সবটুকু পানীয়। এত ভালো জিনিস জীবনে আর কখনো মুখে দেয়নি ও।
পান পর্ব শেষ হওয়ার পর আইজাক বললেন, তোমার মনিব, বুঝলে খুব ভালো লোক। সেদিনই আমি বুঝেছিলাম। এখন বলো তো, কত টাকা পাঠিয়েছেন উনি? তোমার থলেটা তো বেশ ভারি মনে হচ্ছে…
না, না, ভারি কোথায়! তাড়াতাড়ি বললো গার্থ।
ভারি না? তাহলে এমন পেট মোটা লাগছে কেন?
পেট মোটা! কি বলছেন, আপনি! এইটুকুন একটা থলে, তার আবার পেট মোটা পেট সরু।
বেশ, তোমার কথাই সই। এখন বললো, কত টাকা আছে ওতে?
খুব বেশি না।
কেন? পাঁচ পাঁচ জন নাইটকে হারিয়েছেন, তার তো আজ অনেক কিছু পাওয়ার কথা!
পেয়েছেনও। কিন্তু বেশির ভাগই উনি বিলিয়ে দিয়েছেন।
বিলিয়ে দিয়েছেন! এমন অবিবেচক মানুষ হয় নাকি আজকের দুনিয়ায়? এতগুলো ঘোড়া, এতগুলো অস্ত্র, বর্ম, বিক্রি করলে তো অনেক টাকা পাওয়া যেতো!
টাকার খুব একটা প্রয়োজন নেই আমার মনিবের।
কি বললে! টাকার প্রয়োজন নেই? একটা কথা হলো? যাকগে, কি আর করা যাবে, ওঁর জিনিস উনি বিলিয়ে দিয়েছেন, আমার কি? তুমি আমাকে আশি স্বর্ণমুদ্রা দাও, তাহলেই হবে।
আশি স্বর্ণমুদ্রা! তাহলে তো আমার মনিবের কাছে আর এক পয়সাও ধাঁকবে না। সত্তরটা নিন। না হলে আমি চললাম, মনিবকেই পাঠিয়ে দিই আপনার কাছে।
না, না! টেবিলের ওপর রাখো টাকাটা। আশিটাই দাও, বুঝলে, তাতে আমার এক পয়সাও লাভ থাকবে না। তাছাড়া, ঘোড়াটা জখম হয়েছে কিনা কে জানে?
সত্যিই বলছি ঘোড়ার কিছু হয়নি, নিয়ে যাওয়ার সময় যেমন ছিলো এখনও তেমনি আছে। ইচ্ছে হলে আপনি নিজে দেখে আসতে পারেন আস্তাবলে গিয়ে। তাই বলছি, ঘোড়াটা যখন সম্পূর্ণ অক্ষত আছে, সত্তর নিয়েই সন্তুষ্ট হোন।
না, না, আশিই দাও। আমি বরং খুশি করে দেব তোমাকে।
গুনে গুনে গাৰ্থ আশিটা স্বর্ণমুদ্রা রাখলো টেবিলের ওপর। আইজ্যাক আবার গুনে গুনে সেগুলো ওঠাতে লাগলেন নিজের একটা থলেতে। সত্তর ~ পর্যন্ত দ্রুত গুনলেন বৃদ্ধ। তারপর মন্থর হয়ে এলো তার গোনার গতি। গার্থ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে, বুড়ো ইহুদী ওকে খুশি করবে কটা স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে?
একাত্তর, গুনে চলেছেন আইজাক, বাহাত্তর। তোমার মনিব, বুঝলে, খুব ভালো। তিহাত্তর। সত্যিই খুব ভালো লোক তোমার মনিব। চুহাত্তর, পঁচাত্তর। এটা একটু হালকা লাগছে। ছিয়াত্তর, সাতাত্তর। গাৰ্থ ভাবলো শেষ তিনটে মুদ্রা বোধ হয় দেবেন ওকে বৃদ্ধ। কিন্তু না! আইজাক শুনেই চলেছেন, আটাত্তর। তুমি লোকটাও খুব ভালো। ঊনআশি। কষ্ট করে টাকাগুলো নিয়ে এসেছে, তোমার কিছু পাওয়া উচিত। শেষ স্বর্ণমুদ্রাটার দিকে তাকালেন আইজাক। ঝকঝকে একেবারে নতুন। কি করে এটা দিয়ে দেবেন? অবশেষে গুনলেন, আশি। হ্যাঁ, সব ঠিক আছে। চিন্তা কোরো না, তুমি যে কষ্ট করলে এর জন্যে নিশ্চয়ই তোমার মনিব তোমাকে কিছু দেবেন।
হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে আছে গাৰ্থ। মনে মনে ভাবছে, একেই বলে ইহুদী।
টাকা বুঝে পেয়েছেন এই মর্মে একটা রশিদ লিখে সই করে গার্থের হাতে দিলেন আইজাক। কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো গাৰ্থ। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। সামনে একটা অন্ধকার কামরা, ওটা পেরোলেই বাড়ি থেকে বেরোনোর দরজা। অন্ধকার কামরাটার দিকে সবেমাত্র পা বাড়িয়েছে, এমন সময় শ্বেতবসনা এক মূর্তি এগিয়ে এলো ওর দিকে। হাতে ছোট একটা লণ্ঠন। মূর্তি আর কেউ নয়, রেবেকা।
বাবা এতক্ষণ ঠাট্টা করছিলেন তোমার সাথে, শান্ত কণ্ঠে বললো সে। তোমার মনিব আমার বাবার যে উপকার করেছেন, তার ঋণ কোনো দিনই শোধ করা সম্ভব নয়। টাকা নেয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। কত দিয়েছো বাবাকে?
আশি স্বর্ণমুদ্রা।
রেশমী একটা থলে এগিয়ে দিল রেবেকা গার্থের দিকে।
এতে একশো স্বর্ণমুদ্রা আছে, বললো সে। আশিটা তোমার মনিবকে ফেরত দিও। বাকিগুলো তোমার। যাও, এবার তাড়াতাড়ি পালাও। পথে সাবধানে থেকো। শহর বোঝাই চোর বাটপাড়, আর বন তো ডাকাতদের আস্তানা।
বিস্ময়ে কোনো কথা ফুটলো না গার্থের মুখে। অস্ফুট কণ্ঠে রেবেকাকে ধন্যবাদ জানিয়ে পথে নেমে এলো সে। মনে মনে বললো, এ তো ইহুদীর মেয়ে নয়, সাক্ষাৎ স্বর্গের দেবী। মনিবের কাছে পেয়েছি দশ স্বর্ণমুদ্রা, দেবীর কাছে পেলাম বিশ এই হারে পেতে থাকলে স্বাধীনতা কিনতে আর বেশি সময় লাগবে না আমার।
<