দুদিন পর কাজে যোগ দিল জেমস অ্যালেন। ভোরে বেরিয়ে গেল বনভূমির উদ্দেশে। ওয়াগন রেখে যথারীতি কাজে নেমে পড়ল। টানা কাঠ কেটে চলল, কোন অসুবিধে হচ্ছে না। দুপুর পর্যন্ত মিনিট বিশের জন্যে একবার বিরতি নিল। দুটো দিন কামাই হয়েছে, বাড়তি পরিশ্রম করে পুষিয়ে নিতে হবে।
দূর থেকে ঘোড়সওয়ারকে দেখল জেমস, স্যাড়লে বসার ভঙ্গিটা অপরিচিত ওর খাবার নিয়ে নিকোলাস প্রাইসের অবশ্য এখুনি আসার কথা, প্রতিদিন এ সময়ে আসে সে। অশ্বারূঢ় কাছে আসতে থেমে গেল ওর হাত, অবাক হয়েছে রোজালিনা বার্থেজকে দেখে। দ্রুত পাশে রাখা শার্ট, তুলে নিয়ে খালি গায়ে চাপাল। মেয়েটা কাছে আসতে নড করল।
নিকোলাস প্রাইসের গ্রুলায় চেপেছে রোজালিনা। স্যাডলে বসার ভঙ্গি সাবলীল, বোঝা যাচ্ছে শহুরে মেয়ে হলেও স্যাডলে চেপে অভ্যস্ত।
একজন ভদ্রলোকের উচিত হচ্ছে কোন মহিলাকে তার বাহন থেকে নামতে সাহায্য করা! কপট সমালোচনা মেয়েটার হাস্যোজ্জ্বল মুখে, জেমসের চমকে যাওয়া অভিব্যক্তি ওকে আনন্দ দিচ্ছে। আমি অবিশ্বাস করব যদি বলো তুমি তা জানো না।
মাথা ঝাঁকিয়ে এগিয়ে গেল জেমস, নামতে সাহায্য করল মেয়েটিকে।
ধন্যবাদ, মি. অ্যালেন।
নড করে একটু দূরে সরে গেল ও।
স্যাডল ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করল মেয়েটা। অবাক হয়েছ, তাই? ওটা এগিয়ে দেয়ার সময় বলল। মার্কের সাথে স্কুল থেকে ফিরছিলাম, নিক মাত্র রওনা দিচ্ছিল। ওকে বাচিয়ে দিলাম, এই রোদুরে এতদূর আসতে হবে না বলে খুশি হয়েছে সে।
প্যাকেট নিয়ে চেলা দেয়া কাঠের ওপর রাখল জেমস। ক্রীক থেকে হাত-মুখ ধুয়ে এসে দেখল একটা শুকনো গাছের গুঁড়িতে বসেছে রোজালিনা। তুমি খেয়েছ, ম্যাম? প্যাকেট তুলে নিয়ে জানতে চাইল ও।
মাথা ঝাঁকাল মেয়েটা।
মার্ককে বোধহয় ক্যাফেতে নিয়ে গেছ তুমি, প্রশ্ন নয়, এমনিতে জানতে চাইল জেমস।
হ্যাঁ, ওখানেই লাঞ্চ করেছি আমরা।
খাওয়া শেষ করে সিগারেট ধরাল জেমস।
তুমি তো দারুণ লোক! লিয়ন সিটিতে এ মুহূর্তে সবচেয়ে আলোচিত লোক হচ্ছে জেমস অ্যালেন। একদিনে দুজনের নাক ফাটিয়ে দিয়েছ। লোকজন তো বিশ্বাসই করতে পারছে না কেউ স্যাভেজের অবস্থা এরকম করতে পারে।
চুপ করে থাকল জেমস। মেয়েটা কেন এসেছে, ভাবছে। মনে হচ্ছে খুব সহজে ওকে বিদায় করা যাবে না। তারমানে সময়টুকু অযথাই নষ্ট হবে। রোজালিনা এমন মেয়ে যাকে এড়িয়ে নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করা সম্ভব নয়। তুমি কি এমনিতে এসেছ, ম্যাম? একটু পর গাছের একটা গুড়িতে, কুড়ালের দুটো কোপ বসিয়ে বলল ও। দুটো দিন কামাই করেছি, শেষ করতে হলে আমাকে বেশি খাটতে হবে।
অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল রোজালিনা, ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না এভাবে সরাসরি এড়িয়ে যেতে চাইবে জেমস। কিছুক্ষণ কথা সরল না মুখে, অপমান বোধ হলো ওর। ঝট করে উঠে দাঁড়াল, এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়াল। তুমি কি আমাকে চলে যেতে বলছ? মুখিয়ে উঠল ও, অপমানে সুন্দর মুখ লালচে দেখাচ্ছে কিন্তু চোখে খানিকটা বিস্ময় লেগে আছে এখনও।
খানিক তাকিয়ে থাকল জেমস, বোঝার চেষ্টা করল সমস্যাটা ঠিক কোথায় হয়েছে। সৌন্দর্য অহঙ্কারের জন্ম দেয়, আঘাতটা বোধহয় সেখানেই লেগেছে। হাসল সে, মাথা নাড়ল। আমি বলতে চেয়েছিলাম তোমার যদি তাড়া না থাকে তো আমরা একসাথে ফিরতে পারি। আমার কাজ শেষ হতে বেশিক্ষণ লাগবে না। তুমি কি একটু অপেক্ষা করবে, ম্যাম?
রোজালিনার চোখে এবার খুশির দ্যুতি দেখা গেল, ঘুরে দাঁড়িয়ে চপল পায়ে চলে গেল আগের জায়গায়। কপট, মিথ্যুক। বিড়বিড় করে বলল বসার সময়।
কুঠার তুলে নিল জেমস, কোপ বসাল গাছেল গুড়িতে। অদ্ভুত একটা মেয়ে!
মার্শালের সাথে তোমার বাধন কি নিয়ে?
আমাকে পছন্দ হয়নি ওর।
হেনরী ক্রুশার?
সে-ও তাই।
তোমাকে পছন্দ হয়নি, এ জন্যে নিশ্চই মারামারি করেনি?
না। ওরা চেয়েছিল।
কেউ মার খেতে চায় নাকি?
শুরুর আগে কেউ কি বলতে পারে শেষপর্যন্ত কে মার খাবে? ওদের হিসাবে ভুল হয়েছিল। তবে স্যাভেজ বোধহয় আমাকে মেরেই ফেলত, তোমরা বাধ না দিলে ঠিক ঠিক এতক্ষণে বুটহিলে শুয়ে থাকতাম।
তোমার সাবধানে থাকা উচিত, মি, আলেন, উদ্বেগ প্রকাশ পেল মেয়েটার শোধ কণ্ঠে। পরেরবার হয়তো হাত বেঁধেই ক্ষান্ত হবে না। ওই জোড়াটাকে আমার খুব ভয়ঙ্কর মনে হয়।
ধন্যবাদ, ম্যাম। সাবধানে থাকব আমি।
তোমাকে ওরা পেল কি করে?
লেসলি উইলিয়ামসের সাথে কিছুক্ষণ ছিলাম আমি। বাইরে অপেক্ষা করছিল ওরা। পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসেছি, এগোতে ওদের খপ্পরে পড়তে হলো। নেবুরকে আমি দেখতেই পাইনি।
ওরা কি ক্রুশারকে পেটানোর জন্যে তোমার বিরুদ্ধে চার্জ এনেছিল?
না। দোষটা ক্রুশারেরই, কেভিন লপারসহ অন্তত বিশজন লোক ঘটনাটার সাক্ষী। আমাকে ফাসাতে চেয়েছিল স্যাভেজ, কিন্তু প্রমাণ করতে পারেনি। ব্যর্থতাই হয়তো ওর এত আক্রোশের কারণ।
লোকটার অহঙ্কার এখন হুমকির মুখে, ওই রাতের কথা সে কখনও ভুলবে না। তোমার বোধহয় ওকে এড়িয়ে চলা উচিত।
সায় জানাল জেমস। মনোযোগ দিল কাজে। এ মেয়ে মার্কের মতই, আনমনে ভাবল ও, একটার পর একটা প্রশ্ন করে যাচ্ছে। খুব বেশি কৌতূহলী।
কাঠ ফাড়া শেষ। ওয়াগন নিয়ে এসে তাতে চেলা করা কাঠ ভরতে শুরু করল ও! শেষে খচ্চরদুটোকে ওয়াগনে জুড়ল।
গ্রুলায় চাপল রোজালিনা।
হেনরী ক্রুশারকে মোটেও খারাপ মনে হয়নি আমার, অনেকক্ষণ পর নীরবতা ভাঙল জেমস। শিক্ষিত, সুদর্শন এবং প্রচুর টাকার মালিক। ওকে বিয়ে না করে বোধহয় ভুল করছ তুমি। সারা শহরের লোকজন তোমাদের জুটিটাকে সেরা মনে করে।
আমি তোমার কাছে পরামর্শ চেয়েছি? ঠাণ্ডা সুরে বলল মেয়েটা।
না, ম্যাম। আমি দুঃখিত।
একবার ভেবে দেখেছ কার জন্যে সুপারিশ করছ? দুদিন আগে ওর নাক ভেঙে দিয়েছ, আর আজ…তুমি সত্যি মজার লোক, মি. অ্যালেন! শত্রু সম্পর্কে একজন পুরুষকে সুপারিশ করতে এই প্রথম দেখলাম।
ওর পেটে প্রচুর হুইস্কি ছিল তখন, মাথার ঠিক ছিল না
আবারও! তুমি ওর কে হও, বাপু? এবার হেসে উঠল রোজালিনা। যদ্র শুনেছি তোমাদের প্রথম দেখায় সে তোমাকে বাজে ভবঘুরে বলে অপমান করেছিল।
তবু লপারের চেয়ে ভাল লোক সে। তোমার ব্যাপারে ওর আবেগটা খাঁটি।
সেটা আমি বুঝব। দয়া করে চুপ করো।
পৌঁছে গেছে ওরা। মার্ক প্রাইস আর ওর মা-কে পোর্চে দেখা গেল। ছুটে এল ছেলেটা। আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি, সাহসী কণ্ঠে প্রস্তাব দিল জেমসকে।
না। তোমার হাত ছিলে যাবে, নামার সময় বলল জেমস, আড়চোখে তাকাল মিসেস প্রাইসের গম্ভীর মুখের দিকে। অস্বাভাবিক রকমের শীতল মনে হচ্ছে মহিলাকে। অথচ বরাবর কাজ শেষে ফিরে এলে উষ্ণ অভ্যর্থনা পায় ও।
পারব আমি! চাপা জেদ প্রকাশ পেল মার্কের কণ্ঠে, এগোল ওয়াগনের দিকে।
ফের লরা প্রাইসের দিকে তাকাল জেমস। মহিলার চোখে সম্মতি দেখে শ্রাগ করল। খচ্চরগুলোকে ছাড়িয়ে করালে নিয়ে গেল ও। ফিরে এসে কাঠ নামানো শুরু করল।
বাড়ির রান্নাঘরে তখন মহিলা দুজন।
তোমার ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না, রোজ, চাপা স্বরে বলল মিসেস প্রাইস। ওর কাছে গেলে কেন?
এমনিতেই। কৌতূহল হচ্ছিল।
ওর মত একজন সম্পর্কে কৌতূহলী হওয়া কি ঠিক হবে? শেষে হয়তো আগ্রহী হয়ে উঠবে তুমি, সুযোগটা সে-ও ছাড়বে না। ভুল করার আগেই ভেবে দেখা উচিত।
মজার ব্যাপার কি জানো, ও ক্রুশার সম্পর্কে সুপারিশ করছিল।
ক্ষীণ হাসল লরা প্রাইস। হতে পারে এটা ওর অতি চালাকি, নয়তো সত্যি তাই বিশ্বাস করে সে। বোঝার উপায় নেই কোটা ঠিক। লোকটার থই পাওয়া কঠিন।
দেখা যাচ্ছে তুমিও ওর সম্পর্কে কৌতূহলী, ম্যাম।
স্বীকার করছি। সে এমন একজন লোক চারপাশের মানুষ যার অস্তিত্বটুকু সবসময়ই অনুভব করবে। কঠিন একজন মানুষ, দেখলেই বোঝা যায় কিন্তু কচিবোধ আছে। পারিবারিক পরিবেশে একটু আড়ষ্ট, অথচ নিশ্চিন্তে নির্ভর করা যায়। নিক পরিশ্রমী, কিন্তু দেখো ও যা কখনও করতে পারেনি এ কদিনে তাই করে ফেলেছে অ্যালেন। একেবারে বদলে দিয়েছে সবকিছু। আর মার্ক তো ওকে ছাড়া কিছু বোঝেই না, বাপের চেয়ে ওর কথায় গুরুত্ব দেয় বেশি।
হেসে ফেলল রোজালিনা। আমার চেয়ে তোমাকেই বেশি আগ্রহী মনে হচ্ছে, ওকে বোঝার চেষ্টা করছ তুমি!
সে এখানে থাকতে আসেনি, রোজ, এটুকু নিশ্চিত বুঝেছি আমি। হঠাৎ করে কিছু না বলে হয়তো চলে যাবে। এখানে কেন এসেছে বা পড়ে আছে তা-ই আমাকে বেশি ভাবাচ্ছে।
কিন্তু তোমাদের কাজ ঠিকই সামলাচ্ছে।
সেটা ঠিক, ট্রে-তে কফির মগ নামিয়ে রাখল লরা প্রাইস, একটা থালায় কিছু বিস্কুট সাজাল এরপর। আমিও ওর সাথে একমত, ক্রুশারের সাথেই তোমাকে ভাল মানাবে।
একই উত্তর তাহলে তোমাকেও দিতে হয়-ওটা আমার ব্যাপার।
অফিস রূমে চলল, ট্রে হাতে নিয়ে এগোল মহিলা। অনুসরণ করল রোজালিনা। টেবিলে ট্রে নামিয়ে রেখে পোর্চে চলে গেল লরা প্রাইস, গলা চড়িয়ে অ্যালেনকে ডাকল।
করালের ভেতর থেকে সাড়া দিল সে, খচ্চরগুলোর পরিচর্যা করছে বোধহয়। মার্কসহ একটু পর দরজায় দেখা গেল তাকে। নিক কোথায়, ম্যাম? একটা চেয়ার টেনে বসে জানতে চাইল জেমস।
নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইদানীং সেলুনে যাওয়াটা নিয়মিত হয়ে পড়েছে ওর। দুপুরের পর ওকে দিয়ে আর একটা কাজও করানো যায় না। আমার ভয় হয় কবে স্যাভেজের পাল্লায় পড়ে ও। উদ্বেগ প্রকাশ পেল মহিলার কণ্ঠে।
কফি শেষ করে বেরিয়ে গেল জেমস। শেডের দিক থেকে হাতুড়ি পেটানোর শব্দ ভেসে এল একটু পর। উঠে দাঁড়াল রোজালিনা, বিদায় নিল লরা প্রাইসের কাছ থেকে। বেরিয়ে এসে এগোল শেডের দিকে। দূর থেকে দেখতে পেল কিছু একটার ওপর হাতুড়ি পেটাচ্ছে জেমস অ্যালেন। ওর পাশে মগ্ন হয়ে তা দেখছে মার্ক।
কাছে গিয়ে দেখল লম্বা একটা কাঠ কেটে-হেঁটে কি যেন করছে ওরা, পুরোমাত্রায় মনোযোগী মার্ক। রোজালিনা ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সেটাও টের পায়নি।
তোমাকে এগিয়ে দেয়া উচিত, হাতের কাজ থামিয়ে উঠে দাঁড়াল জেমস, মার্কের দিকে ফিরল। কাজটা আমরা পরে শেষ করব, মার্ক।
বাধ্য ছেলের মত মাথা ঝাঁকাল সে যদিও কিছুটা অসন্তুষ্ট দেখাচ্ছে।
একাই যেতে পারব, মাত্র তো কয়েক গজ পথ।
আমি কিন্তু বলিনি যে একা যেতে পারবে না তুমি।
ক্ষণিকের জন্যে তাকিয়ে থাকল রোজালিনা, তারপর মৃদু হাসল। একজন সঙ্গী হলে অবশ্য মন্দ হয় না। তোমার ওপর বোধহয় নির্ভর করা যায়।
হাতুড়ি, করাত রেখে প্যান্টের পেছনে হাত মুছল জেমস, বেরিয়ে এসে অপেক্ষায় থাকল মেয়েটির জন্যে। মার্ককে আদর করে শেড ছেড়ে বেরিয়ে এল রোজালিনা।
এগোল ওরা।
মি. অ্যালেন?
ফিরে তাকাল সে।
এখানে আসার আগে ছিলে কোথায়?
আমি আসলে ভবঘুরে মানুষ, তবে বেশিরভাগ সময় অ্যাবিলিনে ছিলাম।
সে তো অনেক দূর। ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছ?
আসাটা হঠাৎ হয়ে গেছে।
তুমি কেন এসেছ এখানে, বলবে?
প্রশ্নটা থমকে দিল জেমসকে। এ ধরনের প্রশ্ন সরাসরি করে না কেউ, কোন মহিলা তো নয়ই। হঠাৎ চলে এসেছি।
মিথ্যুক!
অবাক হয়ে রোজালিনার দিকে তাকিয়ে থাকল জেমস। মেয়েটাকে আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে। ও মিথ্যে বলেছে কি করে এত নিশ্চিত হয় মেক্সিকান গোলাপ?
আমার যখন দশ কি এগারো বছর বয়েস, এ শহরে এসেছিলাম আমরা। তারপর অনেক মানুষ দেখেছি, বিচিত্র একেকজন। বেশিরভাগই ভবঘুরে নয়তো ফেরারী। কিছুটা হলেও তাদেরকে চিনতে শিখেছি। আমি জানি তুমি ফেরারী বা ভবঘুরে নও। তোমার মধ্যে গোছানো একটা ভাব আছে যা ওদের মধ্যে থাকে না। এখানকার কেউকেটাদের কাউকে পরোয়া করছ না, অথচ ফেরারী হলে ওদের সমঝে চলার কথা তোমার। এ থেকে একটা জিনিসই বোঝা যায়-নির্দিষ্ট একটা উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছ তুমি এবং হয়তো স্যাভেজরাই তোমার লক্ষ্য।
তুমি আমাকে বিস্মিত করছ, ম্যাম।
এটা খুব সহজ ব্যাপার যদি একটু খোজ-খবর রাখা যায়।
এত খবর জানলে কি করে?
প্রাইসদের কাছ থেকে। তুমি আসার পর ওখানে দুদিন গিয়েছি আমি, আর মার্কের সাথে তো রোজই দেখা হয়। ওদের বাড়িটা বদলে দিয়েছ তুমি। লরা তোমার ওপর খুব সন্তুষ্ট। আর মার্কের কাছে তো তুমি ওর আদর্শ পুরুষ, ও স্বপ্ন দেখছে তোমার মত হবে…।
চুপ করে থাকল জেমস, রোজালিনার কথাগুলো ভাবছে।
একটা উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছ তুমি, তাই না? ঘুরিয়ে ফের একই প্রশ্ন করল রোজালিনা।
কিছু না বলে ক্ষীণ হাসল জেমস। মূল রাস্তায় চলে এসেছে ওরা। ধুলোমাখা রাস্তা ধরে এগোচ্ছে। কৌতূহলী লোকের দৃষ্টি উপচে পড়ছে ওদের ওপর। কারণটা একেবারে সহজ-ওর মত ঠিকানাবিহীন কাউকে রোজালিনা বার্থেজের সাথে আশা করে না এরা। রোজালিনা মেক্সিকান হলেও এমন এক মেয়ে, যাকে সত্যিকার ভদ্রমহিলা মনে হয়-বনেদী আচরণ আর অতুলনীয় সৌন্দর্য ওকে আর দশটি সাধারণ মেয়ে থেকে আলাদা করেছে, এবং পুরুষের কাছে যে কোন অর্থেই কাক্ষিত। এ মেয়ের পাশে কেভিন লপার বা হেনরী ক্রুশারকেই ভাল মানাবে, ওর আর স্যাভেজ বা নেবরের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
এড়িয়ে যাচ্ছ তুমি, অভিযোগ করল মেয়েটা।
মাথা নাড়ল জেমস, গম্ভীর দেখাচ্ছে ওকে। ওপাশে কামারের দোকানের সামনে দেখতে পেয়েছে রেনে নেবরকে। পোর্চের খুটির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আয়েশ করে, শীর্ণ দেহটাকে দেখাচ্ছে আরেকটা খুঁটির মত। মরা জানোয়ারের মত অভিব্যক্তিহীন চোখজোড়া স্থির হয়ে আছে জেমসের ওপর। পকেট থেকে দুমড়ানো একটা সিগার বের করে ঠোঁটে ঝোলাল। নোংরা মলিন বেল্টের চামড়ায় কাঠি ঘষে আগুন জ্বালাল, সেটা এত জোরে যে বিশ গজ দূর থেকে তা শুনতে পেল জেমস। একমুখ ধোয়া ছাড়ল সে, পায়ের ভর বদল করল। তারপর চোখ ফেরাল রোজালিনার দিকে। আঙুল তুলে হ্যাটের কিনারা ছুঁয়ে নড করল, কিন্তু লোকটার দৃষ্টিতে নগ্ন লোভ দেখতে পেল জেমস। অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছে চোখদুটোকে। না তাকিয়েও বুঝতে পারল অস্বস্তি বোধ করছে মেয়েটা, উধাও হয়ে গেছে সারাক্ষণের সপ্রতিভ ভাবটুক।
দ্রুত চলা শুরু করল রোজালিনা, জেমসকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। কয়েক পা এগিয়ে থেমে পাশ ফিরতে দেখল পোর্চ থেকে নেমে এসেছে ডেপুটি, ওদের দিকেই আসছে। রক্ত সরে গেল ওর মুখ থেকে, জেমস পাশে আসতে অজান্তেই তার শার্ট খামচে ধরল, তারপর তাল মেলাল জেমসের সাথে। মি. অ্যালেন, কথা যোগাচ্ছে না ওর মুখে। ও আসছে…আমাদের পিছু নিয়েছে। চাপা স্বরে বললেও ওর কণ্ঠে ভয় ঠিকই প্রকাশ পেল।
এগোও, ম্যাম, পাত্তা দিয়ো না। নেবর যদি টের পায় তুমি ভয় পাচ্ছ, আরও আগ্রাসী হয়ে উঠবে ও।
দ্রুত এগোতে চাইছে রোজালিনা, কিন্তু ধীরে একই গতিতে এগোেল জেমস।
ত্রিশ গজ এগিয়ে ক্যাফের পোর্চে উঠে আসতে ধৈর্য হারিয়ে ফেলল মেয়েটা। প্রায় ছুটে ঢুকে পড়ল ভেতরে, ফিরেও এল সাথে সাথে। দরজায় দাঁড়িয়ে এক নজর দেখল রেনে নেবরকে। তারপর অস্থির দৃষ্টি স্থির হলো জেমসের ওপর। ভেতরে এসো, মি. অ্যালেন, অনুরোধ ঝরে পড়ল ওর কণ্ঠে। কফি খেয়ে যাবে।
ঘামছে রোজালিনা, ভয়টা কাটেনি। কারণটা ঠিক ধরতে পারছে না জেমস। আনমনে মাথা ঝাঁকাল, পোর্চে উঠে এল। মেয়েটার ভয়ার্ত দৃষ্টি বলে দিচ্ছে এদিকেই আসছে ডেপুটি। জেমস সামনে আসতে সরে গিয়ে জায়গা দিল রোজালিনা, ঘুরে দুই সারি চেয়ার-টেবিলের মাঝখান দিয়ে দ্রুত এগোল। রান্নাঘরের দরজায় দেখা গেল মিসেস বার্থেজকে। মেয়ের মুখ, জেমসের ওপর, সবশেষে দরজা পথে বাইরে চলে গেল তার দৃষ্টি। প্রথমে উদ্বিগ্ন দেখাল তাকে, তারপর দৃঢ় সঙ্কল্পবদ্ধ হয়ে গেল মুখ, কঠিন হয়ে উঠেছে চাহনি। একটা টেবিলে হাতের ট্রে নামিয়ে রেখে দরজার দিকে এগোল মহিলা।
ওকে আসতে দাও, ম্যাম, চেয়ার টেনে বসার সময় মৃদু স্বরে বলল জেমস। দেখা যাক কি বলার আছে ওর।
থেমে জেমসকে দেখল মহিলা, কি যেন বলতে চেয়েও সংবরণ করে নিল। তারপর মাথা ঝাঁকাল, টেবিলে রাখা ট্রে-র দিকে এগোল। দুটো টেবিলে তিনজন খদ্দের আছে, তাদের মনোযোগ বাইরে পোর্চে উঠে আসা রেনে নেবরের ওপর।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল সে, নিপ্রাণ চোখ তুলে সারা কাফের ওপর নজর বুলাল। হ্যাট খুলে মাথা নুইয়ে নড করল মারিয়া বার্থেজকে।
কফি খাবে নাকি, মার্শাল? উদার কণ্ঠে আহ্বান করল জেমস। বসে পড়ো তাহলে।
ঘুরে তাকাল ডেপুটি, স্থির দৃষ্টিতে দেখল ওকে। মুখ ভাবলেশহীন, ভেতরে কি ভাবনা চলছে বোঝার উপায় নেই। জেমসের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে সবার ওপর ঘুরে গেল তার দৃষ্টি, স্থির হলো ওপরে ওঠার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা রোজালিনার ওপর। ক্ষীণ হাসল সে, কিন্তু আন্তরিক না হওয়ায় সেটা বিদঘুটে দেখাল।
নিশ্চিন্তে বসে পড়ো, সোৎসাহে বলল জেমস। আমিই বিল দেব।
দৃঢ় পায়ে এগিয়ে এল দো-আঁশলা। সামনে এসে উল্টোদিকের চেয়ারে বসল, জেমসের ওপর থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও দৃষ্টি সরায়নি। আমার সাথে তামাশা কোরো না, অ্যালেন, শীতল হিংস্র কণ্ঠে বলল সে। আমি হেনরী ক্রুশার নই!
তুমি বলছ ওটা তাহলে তামাশা ছিল? হেসে বলল জেমস।
তো কি! ওকে উস্কে দিয়েছ তুমি। হেনরী ক্রুশার জীবনে কখনও মারামারি করেনি অথচ তাকে বাধ্য করেছ। সবার সামনে ওকে হেনস্তা করার চেষ্টা করেছ।
জেমসের হাসি বিস্তৃত হলো। তুমি বোধহয় ঘুমাচ্ছিলে তখন-স্যাভেজ যখন। ঘরভর্তি লোকের সামনে প্রমাণ করল যে মারামারির খায়েশ তোমাদের ব্যাংকারেরই হয়েছিল? নাকি স্যাভেজের সাথে একমত নও তুমি? আমার ভয় হচ্ছে একটু পরে হয়তো বলবে আমিই ক্রুশারকে অত হুইস্কি গিলিয়েছি।
টেবিলে থাবা মারল নেবর। চালিয়াতি ছাড়ো, অ্যালেন! তোমার তামাশা উপভোগ করতে আসিনি আমি।
এখন রাত নয়, তোমার হাতেও পিস্তল নেই। ভাবলাম বোধহয় তাই করতে এসেছ।
টাফ লোক, না? রেনে নেবরের ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি, জেমসের সূক্ষ্ম ভৎসনায় আমল দিল না। মেয়েছেলের সামনে এমন সবাই দেখাতে পারে। পিস্তল হাতে সামনে দাঁড়ালে তো পেচ্ছাব করে দেবে।
হয়তো, নেবর, চাপা স্বরে বলল জেমস, ঝুঁকে এসেছে। কে জানে হয়তো তুমিই তা করবে। আমার তো ধারণা বুকের চেয়ে কারও পিঠই তোমার পছন্দ।
ডেপুটির মুখ যেন পাথরে গড়া, ভাবান্তর হলো না। আমি তোমাকে খুন করব, অ্যালেন, খোদার কসম! ফিসফিস করে ঘোষণা করল।
দয়া করে দিনের বেলায় এসো।
তোমার মত বহু লোক দেখেছি, অ্যালেন। ওদের জন্যে আফসোস হয়। নিজের ওপর খুব বেশি ভরসা কোরো না, টেরই পাবে না কখন বুটহিলে ঠাই পেলে!
ধন্যবাদ। কফি নিয়ে এল মারিয়া বার্থেজ, মগ দুটো নামিয়ে রেখে দ্রুত কেটে পড়ল।
মার্শাল, কফিতে চুমুক দেয়ার সময় আলাপী সুরে বলল জেমস। দয়া করে। এদের কাছ থেকে দূরে সরে থেকো। ভুলেও এদের ক্ষতি করার চিন্তা কোরো না। তাহলে তোমাকে ছাড়ব না আমি। তোমার ওই তারাটা আমাকে আটকাতে পারবে না, ওসব টিনের টুকরোকে আমি পরোয়া করি না।
নিপ্রাণ চোখজোড়া সজীব দেখাল-কৌতুক আর অবজ্ঞা সেখানে। যদি করি? উস্কানি নেবরের গলায়।
চব্বিশ ঘণ্টা পেরোনোর আগেই খুন করব তোমাকে।
আরিব্বাপস! তুমি আইনের লোককে হুমকি দিচ্ছ, অ্যালেন! তো?
শোনো, অ্যালেন। ও তো একটা মেক্সিকান মেয়ে মাত্র। যে কেউ চাইলেই ওকে পেতে পারে। দেখছ না লপার, ক্রশার, স্যাভেজ সবাই ওকে পেতে চায়। তুমিও ব্যতিক্রম নও। তাহলে আমার দোষটা কোথায়?
মেয়েটা যদি চায় তো ওকে পাবে তুমি।
একটা মেক্স মেয়ের আবার চাওয়ার দাম কি!
আছে, নেবর। এবার অন্তত অনুমতি নিয়েই তোমাকে কোন মেয়ে…ওর কাছে যেতে হবে।
এবার? সন্দিগ্ধ দেখাল ডেপুটিকে।
বোঝা যাচ্ছে পুরানো পাপী তুমি, ব্যাখ্যা দিল জেমস। এবং এ ব্যাপারে ওস্তাদ লোক। দুএকটা দড়ি নিয়ে কখনও কেউ কি তোমার পিছু নেয়নি?
কি বলতে চাও? উত্তেজিত দেখাল নেবরকে। চোখ ছোট করে তাকিয়ে আছে।
তেমন কিছু না, কফিতে চুমুক দিল জেমস, অমায়িক হাসল। বলছিলাম তোমার যা স্বভাব দুএকজন মেয়ের বাবা কিংবা মহিলার স্বামী হয়তো খুঁজে বেড়াচ্ছে তোমাকে, নাগালে পেলে ঝুলিয়ে দেবে কোন একটা গাছে। আছে নাকি কেউ?
ডেপুটির চোখে সন্দেহ, বোঝার চেষ্টা করছে কথাগুলোর পেছনে আলাদা কোন অর্থ আছে কি-না। মনে হচ্ছে আরও কিছু জানো তুমি, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল, কিন্তু হতাশ হতে হলো তাকে। মিটিমিটি হাসছু জেমস, আগ্রহভরে তাকিয়ে আছে। খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসছ তুমি, অ্যালেন! ঠাণ্ডা সুরে বলল সে, খরখরে শোনাল গলা। আমিও তাই চাই। মনে হচ্ছে হেলাফেলা করার মত লোক নও তুমি। রিক তো পাত্তা দেয়নি, এখন সারাক্ষণ তোমার কথাই ভাবছে।
ওকে বললা পুরোপুরি সেরে ওঠার আগে যেন আমার সামনে না আসে। সেদিন রাতের ব্যাপারটা মোটেও ভুলে যাইনি।
কফিতে চুমুক দিল ডেপুটি, আড়চোখে একবার তাকাল কোণের টেবিলে বসে থাকা লোক দুজনের দিকে। তারপর ঝুঁকে এল ওর দিকে। আমার ধারণা, জেমস অ্যালেন, তোমার এ নামটা ভুয়া। অন্য কোথাও দেখেছি তোমাকে, এটা নিশ্চিত…রসো, মনে পড়ে যাবে। আচ্ছা, লিভারি সিটিতে ছিলে তুমি, কিংবা অরিগনে?
তোমার লাইনে আমাকে খুঁজে পাবে না।
বড় বেশি তড়পাচ্ছ, অ্যালেন। স্যাভেজ সুস্থ হয়ে নিক, তারপর টাইট দেব তোমাকে।
কিন্তু এদের কাছ থেকে দূরে থেকো। ওরা মেক্সিকান হতে পারে; কিন্তু ওদের অসম্মান শহরের লোকেরা মুখ বুজে সহ্য করবে না। লপার বা ক্রুশারও করবে না।
হাহ, মেক্সদের জন্যে খুব দরদ দেখাচ্ছ! ওরা তোমার কে?
কেউ না, নেবর, ডেপুটির চোখে চোখ রাখল জেমস। কিন্তু ওরা তোমাকেআমাকে একসূত্রে গেঁথে দিয়েছে। ওদের সাথে বেচাল করলেই তোমাকে চেপে ধরার একটা সুযোগ পেয়ে যাব আমি। সুতরাং বুঝতেই পারছ ওরা হচ্ছে তোমার জন্যে টোপ। যদি মনে করো হজম করতে পারবে তো গিলতে পারো, নয়তো এখুনি সে-আশা উগরে ফেলল। সবাই আপসে সবকিছু পায় না, জোর করে চড়া মূল্যের বিনিময়ে ওকে পাওয়া তোমার জন্যে বোকামি হবে।
হুমকি দিচ্ছ?
যা ইচ্ছে ভাবতে পারো। আমার কথার নড়চড় হবে না।
তোমার কথার নিকুচি করি! চড়া গলায় বলে উঠল নেবর, ধৈর্য হারিয়েছে। তোমাকে দেখে নেব, অ্যালেন। ওই মেয়েটাকেও ছাড়ব না!
ধীরে বন্ধু, কফিটা শেষ করো। একটা সিগার টেনে মাথা ঠাণ্ডা করো। প্রস্তাবটা আমি মন্দ দেইনি। তাতে তোমার পিঠ বাঁচবে।
উঠে দাঁড়াল ডেপুটি, বুক টান টান। মুখে স্বাভাবিক হাসি দেখা গেল এবার। যেভাবে আর যে জন্যেই এখানে এসে থাকো, অ্যালেন, বাতেই হচ্ছে তোমার কপাল মন্দ। আমাদের ইচ্ছে ছাড়া লিয়ন সিটি থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে না। এখানে আইন বলতে স্যাভেজ আর আমাকেই বোঝায়, সুতরাং তোমারই উচিত আমাদের সমঝে চলা। জানো তো এ শহরে কোন কোট বা জাজ নেই? বিচারের কাজটাও তাই আমরা করি। একবার বাগে পেলে কেউ তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে না। মনে রেখো তোমার মত লোক লিয়ন সিটিতে কেবল ঢুকতেই পারে, বেরিয়ে যেতে পারে না।
দেখা যাবে, নেবর।
ববের সেলুনে বসবে লপার। ইচ্ছে হলে আসতে পারো। উত্তরের অপেক্ষা করে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করল সে। বেরিয়ে যাওয়ার সময় সশব্দে বন্ধ করল দরজাটা।
জেমসের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল রোজালিনা বার্থেজ। শুকনো মুখ, অস্থির ভয়ার্ত দৃষ্টি ওর গভীর কালো চোখে। আমি ভেবেছিলাম তোমরা হয়তো ডুয়েল লড়বে…যা ভয়ঙ্কর লোক! স্যাভেজকেও এতটা ভয় লাগে না আমার।
কয়োটের মত নীচ, সুযোগসন্ধানী ওরা দুজনেই। কিন্তু কেভিন লপারকেও তোমার ভয় করা উচিত, ম্যাম।
কেন?
স্যাভেজ বা নেবরের চেয়ে ভিন্ন কিছু নয় সে, কেবল ভদ্রলোকের একটা মুখোশ ওকে আলাদা করে রেখেছে।
একটা চেয়ারে বসে পড়ল রোজালিনা। চোখে কৌতূহল। মনে হচ্ছে আগে থেকে চেনো ওদের?
কিছুটা।
তারমানে…হয়তো ওদের খোঁজেই এসেছ! ফিসফিস করে বলছে মেয়েটা, উত্তেজনায় উজ্জ্বল দেখাচ্ছে সুন্দর মুখ। হ্যাঁ, ঠিক এটাই হবে। লরা প্রাইসও এরকম সন্দেহ করছিল। তুমি কে, মি. অ্যালেন?
ওটাই আমার পরিচয়, ম্যাম।
কিন্তু লুকিয়ে রাখার মত অনেক কিছু আছে তোমার, স্পষ্ট বুঝতে পারছি। অস্বীকার কোরো না। কোনটা ভান আর কোনটা আসল এটুকু বোঝার বয়স আমার হয়েছে।
মানতে পারলাম না। তুমি হেনরী ক্রুশারের আবেগটা ধরতে পারোনি।
কে বলল পারিনি? নইলে তাকে না করতাম?
সিগারেট রোল করছিল জেমস, চুপ করে থাকল। চোখ তুলে দেখল অপেক্ষা করছে মেয়েটা, দৃষ্টিতে অফুরন্ত আগ্রহ। তোমার না জানাই ভাল, ম্যাম, সিগারেট ধরানোর সময় বলল ও। আমি দুঃখিত।
অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল রোজালিনা, ঠিক বুঝতে পারছে না কেন এ লোকটির ওপর বিন্দুমাত্র প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। সচরাচর দেখে এসেছে ওকে খুশি করার জন্যে মুখিয়ে থাকে পুরুষরা, কিছু জানতে চাইলে বাড়তি দুএকটা কথা বলবেই। অথচ ওর সৌন্দর্য বা আন্তরিক উপস্থিতি তাকে মোটেই স্পর্শ করছে না।
তুমি মেক্সিকানদের ঘৃণা করো?
না, ম্যাম, মোটেই তা নয়।
তাহলে কোন মেয়েকে ভালবাসো, তাই না?
হেসে ফেলল জেমস। রোজালিনার আরক্ত এবং বিব্রত মুখের দিকে তাকাল, খানিকটা অসহায়ও দেখাচ্ছে মেয়েটাকে, কারণটা জানে ও। সহজ একটা হিসাব করেছে মেয়েটি, ওকে প্রভাবিত করতে না পারার কারণ হিসেবে আরেকটি মেয়েকে দায়ী করেছে। আনমনে মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে দাড়াল জেমস। পকেট থেকে খুচরো পয়সা বের করে রাখল টেবিলে। এগোতেই সামনে দেখতে পেল মিসেস বার্থেজকে। দুজনের মধ্যে কি ঘটেছে নীরবে বোঝার প্রয়াস পেল মহিলা। কিন্তু তাকে সময় দিল না জেমস, নড করে দ্রুত ক্যাফে থেকে বেরিয়ে গেল।
বাইরে এসে পোর্চে দাড়াল ও। সন্ধ্যার অন্ধকার জাকিয়ে বসেনি এখনও। বাড়িগুলোয় আলো জ্বলতে শুরু করেছে, রাস্তায় লোকজন কম। কাছের সেলুন থেকে হৈ-হল্লা আর নিচু লয়ের তাল ভেসে আসছে।
রেনে নেবরকে খানিকটা নাড়া দিয়েছে সে, এবার চিন্তায় পড়ে যাবে ওরা। জেমসের অতীত নিয়ে খোচানো শুরু করবে। শুরুটা মন্দ নয়, ভাবছে জেমস, আরেকটা ধাক্কা দেবে একটু পর। প্রতিক্রিয়াটা কেমন হবে আগে থেকে বোঝার উপায় নেই। হয়তো নেবরের মতই মুখিয়ে উঠবে কেভিন লপার, সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে। কিংবা পাগলা কুত্তা হয়ে যাবে। জেমস ওটাই চায়। নিজেদের সীমানা ছেড়ে বেরিয়ে আসুক ওরা, তাহলে ওরই সুবিধে।
রাতের খাওয়া সেরে নেয়া যাক, তাছাড়া মার্কের খেলনাটাও শেষ করতে হবে। তারপর কেভিন লপারের সাথে খোশগল্প করা যাবে, সিদ্ধান্ত নিল ও। বুটের তলায় আধ-খাওয়া সিগারেট পিষে পোর্চ থেকে নেমে এল। ফুটপাথ ধরে এগোল। গলি, বাড়িগুলোর কোণায় তীক্ষ্ণ নজর রাখছে, কে বলতে পারে এর যে কোন একটা জায়গায় ওর জন্যে অপেক্ষা করে নেই কেউ?
সাপার সেরে মার্কের জন্যে খেলনা তৈরি করল জেমস। রবার্ট হার্ডিংয়ের সেলুনের উদ্দেশে যখন রওনা দিল ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে প্রাইসরা, অন্তত বাতি নিভিয়ে দিয়েছে। গলি ধরে নির্বিঘ্নে চলে এল ও।
সেলুনটা জমজমাট। একটা টেবিলে বসে গল্প করছিল কেভিন লপার আর লেসলি উইলিয়ামস। ওকে দেখে দূর থেকে হাত নাড়ল স্টোর মালিক, ক্ষীণ হাসল। বারের কাছে এসে হুইস্কির ফরমাশ দিল জেমস, ববের উইশের জবাবে মৃদু নড করল। বারকিপার মগভর্তি হুইস্কি দিয়ে যেতে চুমুক দিল, এই ফাঁকে সবার ওপর নজর দেয়ার কাজ সেরে ফেলেছে। বেশিরভাগ লোকই পাঞ্চার নয়তো ভবঘুরে। আগামী সপ্তাহে শুরু হতে যাওয়া রাউন্ড আপ আর খরা নিয়ে আলাপ করছে। শীত নিয়েও ভাবছে কয়েকজন। সল্ট লেক আর রকি পর্বতমালার কারণে এখানে শীতটা বেশিই পড়ে।
ওরা তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিল, জানাল বব।
তাহলে কি এখন আর করছে না?
তা নয়। তবে ভাবছিল তুমি বোধহয় না-ও আসতে পারো। মি. লপার বলছিল ডেপুটির মাধ্যমে খবর পাঠানোয় তুমি হয়তো অন্য কিছু ভেবেছ।
অন্য কিছু কি?
হয়তো ভয় পেয়েছ।
ও তাই বলেছে নাকি?
ঠিক এরকম কিছু না বললেও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এটাই বোঝাতে চেয়েছে।
হুইস্কি শেষ করল জেমস, গম্ভীর দেখাচ্ছে ওকে। চিন্তা-ভাবনাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে মনে মনে, নিশ্চিত জানে কেভিন লপারই হবে আসল প্রতিদ্বন্দ্বী। ববের কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে পোকার চিপস নিয়ে উদ্দিষ্ট টেবিলের দিকে এগোল। সামনে এসে দাঁড়াতে হাসল স্টোর মালিক, লেসলিকে ভাবলেশহীন দেখাচ্ছে।
আমি ভাবছিলাম ডেপুটি হওয়ার মত খেলার প্রস্তাবটাও তোমার মনে ধরেনি, হালকা সুরে বলল লপার। সিগার কেস বের করে সিগার ধরিয়ে তাকাল বারের দিকে। এক প্যাকেট নতুন তাস দাও, বব।
চেয়ার টেনে বসল জেমস। খেয়াল করল সেলুনভর্তি লোকজন কৌতূহলী হয়ে উঠেছে, উৎসাহী কয়েকজন কাছে এসে দাড়িয়েছে। বারকিপারের দেয়া নতুন তাস শাফল করল লেসলি উইলিয়ামস, কার্ড বেঁটে দেয়ার পর খেলা শুরু হলো। ঘণ্টাখানেক হিসেব করে খেলল সবাই, পরস্পরের খেলার ধরন বোঝার চেষ্টা করছে।
প্রথম থেকে আগ্রাসী ভূমিকা নিয়েছে জেমস। মাঝারি মানের কার্ড নিয়ে প্রচুর টাকা খেলল। ও চাইছে লপার যেন কিছুটা হলেও ভুল ধারণা পায়। খেলার আয়ু যত বাড়ল ওদের চারপাশে ভিড় বাড়তে থাকল। কেউই চুরি করছে না, নিশ্চিত জানে জেমস। লেসলি হারছে, ওর বেশিরভাগ টাকা এখন জেমসের ভাগে পড়েছে। পরের ঘণ্টায় অবস্থার পরিবর্তন হলো খানিকটা, লপারের কাছে ভাল তাস পড়তে শুরু করল।
জুয়াড়ী ভাবলেশহীন, হতাশা আর বিরক্তি চেপে রেখেছে। লপারকে উৎফুল্ল দেখাচ্ছে, উজ্জ্বল তার চোখজোড়া। একটার পর একটা সিগার ফুকে চলেছে, হাতের পাশে টেবিলের ওপর সিগার কেসটা। একনজর ওটা দেখল জেমস, নতুন তাস না নিয়ে দান বাড়াল। পরপর দুটো তাস নিল লপার। কিন্তু শেষপর্যন্ত খেসারৎ দিতে হলো তাকে, অল্পের জন্যে হেরে গেল লেসলির কাছে। সারাক্ষণ যা হেরেছে ওই একদানে তুলে ফেলল জুয়াড়ী।
খেলাটা উপভোগ করছে জেমস। কেভিন পার ধূর্ত ও কুশলী, তবু ফাঁদে ফেলা যাবে তাকে। লেসলি ছোটখাট একটা ধাপ্পা দিয়ে কাজটা সহজ করে দিয়েছে। পরের দানে জিতল ও, লেসলিকে একরকম বাধ্য করে টিকিয়ে রাখল অনেকক্ষণ পর্যন্ত। দুজনের হাতে বাজে তাস, লপার বসে গেছে। পরে দেখা গেল তার তাসই ওদের দুজনের চেয়ে ভাল ছিল।
এরার গম্ভীর দেখাল, কেভিন লপারকে, নড়েচড়ে বসেছে। উদাস দৃষ্টিতে তাকাল বাইরের দিকে। ঠোঁটে নতুন সিগার। একটু আগের সতর্ক ভাবটুকু উধাও হয়ে গেছে। চোখে চাপা রাগ, সেটা চেপে রাখার চেষ্টা করেও পারছে না। মনে মনে ক্ষীণ হাসল জেমস, খেলাটার মজাই এখানে প্রতিপক্ষকে বুঝতে পারলে সহজে টেক্কা দেয়া সম্ভব। হার জিনিসটা সবারই অপছন্দ, লপারও তার ব্যতিক্রম নয়।
পরের দুই দানে স্টোর মালিকের সঞ্চয় ফুরিয়ে গেল। বিতৃষ্ণার সাথে বারকিপকে ডাকল সে। দুহাজারের চিপস্ দিয়ে যাও বব। রসিদ লিখে দিচ্ছি। আর একটা বোতল।
সাদা একটা কাগজে রসিদ লিখে দিল সে। পরের দান শুরু হতে হুইস্কির গ্লাস তুলে নিল।
মুখ দেখে জেমস টের পেল ভাল তাস পেয়েছে লপার, দান বাড়াচ্ছে। প্রমাদ গুণল ও, একটা কার্ড নিয়ে দেখল। ফাকা একটা জায়গা পূরণ হয়েছে, আরেকটা দরকার। ওদিকে নিশ্চিন্তে খেলে যাচ্ছে স্টোর মালিক। একটা তাস তুলে দেখল, অসন্তুষ্ট মনে হলো তাকে।
লপারের পেছনে দাঁড়িয়েছিল এক কাউবয়, প্রচুর টেনেছে। ওর চোখ লপারের তাসের ওপর পড়তে লোকটার চোখে নিজের বিপদসঙ্কেত দেখতে পেল জেমস। আরেক দান খেলে শো করল। সেরা তাস পেয়েছে লপার। জেতা টাকা তাকে সন্তুষ্ট করতে পারল না। রাগ ফুটে উঠল চোখে।
নতুন করে তাস দেয়া হলো। পর্যাপ্ত টাকা নেই বলে ভাল তাস নিয়েও বসে গেল লেসলি উইলিয়ামস। একবারই বাড়তি একটা তাস নিয়েছে জেমস। দেখে টেবিলের ওপর ফেলে রাখল সেটা। মাঝে মাঝে লপারের দৃষ্টি চলে যাচ্ছে ওটার দিকে। লোভ আর জেদ পেয়ে বসেছে লোকটাকে। টাকার অঙ্ক দ্বিগুণ করল সে। ভ্রুক্ষেপ করল না জেমস, নিজের পালার সময় নিশ্চিন্তে চিপস দিয়ে গেল।
চিন্তিত দেখাচ্ছে লপারকে। সিগার কেসে হাত বাড়াল, খালি হয়ে গেছে ওটা। বব? ডাকল সে।
আমার কাছ থেকে নিতে পারো, পকেট থেকে একই রকমের একটা সিগার কেস বের করে এগিয়ে ধরল জেমস। যদি না তোমার আপত্তি থাকে।
কেভিন লপারের চোখ আটকে থাকল ওটার ওপর, শিখিল শরীর শক্ত হয়ে গেল। অজান্তে কেঁপে উঠল মুখের একটা পেশী। চোখাচোখি হতে তার চোখে একাধারে ভয় আর বিস্ময় দেখতে পেল জেমস। খানিক বাদে চোখ সরিয়ে নিল সে। হঠাৎ করে সতর্ক হয়ে গেছে স্টোর মালিক। হেলান দিল চেয়ারে, তারপর ফের দেখল জেমসকে। হাসল। ধন্যবাদ, ওতে চলবে না। এরচেয়ে কড়া জিনিস চাই।
একটু পর দেখা গেল চিপসের স্তুপ জমে গেছে টেবিলে। বসে থেকে দেখছে লেসলি, কৌতূহল শেষপর্যন্ত কে জেতে।
টাকা বাড়াচ্ছে লপার, জেদ তার পিছু নিয়েছে।
সর্বনাশ করার সময় এটাই, সিদ্ধান্ত নিল জেমস। জানে এ মুহূর্তে লপারের মনোযোগ খেলার চেয়ে ওর সিগার কেসের দিকেই বেশি, তাকে ভাবাচ্ছে ওটা। হয়তো ভাবছে কি করে জেমসের কাছে এল। ওর জন্যে মোক্ষম সুযোগ। সিগার ধরিয়ে দানের টাকা বাড়াল ও।
শেষ চিপসটাও বোর্ডে ফেলল লপার। দৃঢ় সঙ্কল্পবদ্ধ দেখাচ্ছে চোয়াল, উল্লাসে ফেটে পড়ার অপেক্ষায় আছে। আমার কাছে আর নেই, চাপা সুরে বলল সে। তুমি আপত্তি না করলে আমরা সরাসরি শো-তে যেতে পারি। না চাইলে আরও খেলে যাব, স্টোর থেকে নাহয় টাকা আনিয়ে নেয়া যাবে। মনে হচ্ছে এ দানটা আমিই…
যথেষ্ট হয়েছে ভেবে সায় জানাল জেমস।
কার্ড দেখাতে বিস্ময়ে ঝুলে পড়ল লপারের কাঁধ, দৃষ্টিতে অবিশ্বাস। নিজেকে দ্রুত সামলে নিল, ক্লিষ্ট হাসি দেখা গেল মুখে। স্বীকার করতেই হবে ধুরন্ধর লোক তুমি, অ্যালেন। আমাকে খেলতে বাধ্য করেছ। …আজকের মত যথেষ্ট হয়েছে। আমার সব টাকা তো তুমিই জিতলে।
সেলুন খালি হতে শুরু করেছে, লোকজনের মধ্যে গুঞ্জন। জেমস ভাবছে লপারের আজ রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে ও। ব্যাপারটা কিভাবে নেবে সে আঁচ করা যাচ্ছে না।
উঠে দাঁড়াল লেসলি উলিয়ামস, শ্রাগ করে কিছু না বলে কেটে পড়ল। বারকিপারের কাছ থেকে একটা বোতল নিয়ে, ১ ওপাশের দরজায় গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল, নীরবে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় হলো জেমসের সাথে। সন্তুষ্ট দেখাচ্ছে। তাকে।
ওটা কোথায় পেলে, অ্যালেন? কণ্ঠের শীতল ভাব গোপন করতে ব্যর্থ হলো লপার। তোমার নিজের নয় বোধহয়?
কুড়িয়ে পেয়েছি।
নীরবে ওকে নিরীখ করল স্টোর মালিক, বোঝার চেষ্টা করছে কথাটার মধ্যে কতটুকু সত্যতা রয়েছে। একটু পর বিরক্তি দেখা গেল মুখে। দেখা যাচ্ছে আমারটার মত একটা সিগার কেস বয়ে বেড়াচ্ছ অথচ জানো না ওটা কার…
ওটা পাওয়ার পর আমি অবাকই হয়েছিলাম, হেসে তাকে থামিয়ে দিল জেমস। জিনিসটা দামী, স্বেচ্ছায় কারও ফেলে যাওয়ার কথা নয়।
শ্রাগ করল লপার। কোথায় পেলে? হালকা সুরে জানতে চাইলেও তার চোখ বলে দিচ্ছে ভেতরে ভেতরে কৌতূহলে ফেটে যাচ্ছে।
অ্যাবিলিন থেকে মাইল ত্রিশ উত্তরে একটা শহর আছে, জোনস সিটি। ওখানকার এক ক্যাম্পে। জেমস হলফ করে বলতে পারবে কেভিন লপারের মাথা খারাপ হওয়ার জো হয়েছে, এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি সে, কিন্তু অনেকটাই আঁচ করে ফেলেছে। আরও অন্তত কয়েকটা প্রশ্ন ভিড় করেছে তার মনে,কিন্তু জিজ্ঞেস করার সুযোগ নেই; তাহলে, নিজের ওপরই সন্দেহ নিশ্চিত করা হয়ে পড়ে।
টেবিলের কিনারে চওড়া থাবা ফেলে রেখেছে লপার, অন্য হাতে সিগার, শক্ত হয়ে চেপে বসেছে আঙুলগুলো। লোকটার কপালের পাশে একটা শিরা লাফাচ্ছে। দেখা পেলে তাকে ফেরত দেবে নাকি? ধীরে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে জানতে চাইল।
হতে পারে তাকে খুঁজেই পাব না, কিংবা কে বলতে পারে এটা নেয়ার ইচ্ছে তার হয়তো থাকবে না। উঠে দাঁড়িয়ে উইশ করল স্টোর মালিকের উদ্দেশে, সিগার কেস তুলে নিয়ে পকেটে ঢোকাল। ভাবছি তোমাকে দিয়ে যাব এটা, দুটোর একটা সেট হবে তোমার। একটা হারালেও অন্যটা দিয়ে কাজ চালিয়ে নিতে পারবে। নাম খোদাই করার ব্যাপারটাও বোধহয় সমস্যা করবে না, হেসে তার চোখে চোখ রাখল জেমস, গভীর উদ্দেশ্যপূর্ণ চাহনি। দুএকটা আঁক দিলেই তোমারটার মত হয়ে যাবে।
রাখ-ঢাকের কোন ঝামেলা রাখেনি জেমস, বুঝিয়ে দিয়েছে লপার সম্পর্কে কি ভাবছে ও। থমকে গিয়ে তাকিয়ে থাকল স্টোর মালিক, দৃষ্টিতে সন্দেহ আর আশঙ্কা। কাঁধ উচু করে হেলান দিল চেয়ারে, শিথিল হয়ে গেল শরীর। তুমি কেন ভাবছ ওটা নেব আমি?
টেবিলের সব চিপস্ দুহাতে তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করেও থেমে ফিরে তাকাল জেমস। দেখো, লপার, আমি হচ্ছি বাউণ্ডুলে টাইপের লোক। পকেট খালি রেখে নোংরা কাপড় পরে ওরকম দামী একটা জিনিস বয়ে বেড়ানো আমাকে মানায় না। তোমার বা হেনরী ক্রুশারের মত সম্মানিত কারও হাতেই ওটা মানায়। ক্রুশার তো ধূমপান করে না, তাই তুমিই আমার একমাত্র পছন্দ।
টেবিলে রাখা গ্লাস তুলে নিয়ে চুমুক দিল লপার, হাসল, কিন্তু সেটা চোখ স্পর্শ করল না। সতর্ক ভাবটা ফিরে এসেছে তার মধ্যে। হাত নাড়ল ওর উদ্দেশে। সাবধানে যেয়ো, বন্ধু। তোমার পকেটে এখন অনেক টাকা।
বারে এসে ববের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলল জেমস। পুরো টাকাই তার কাছে জমা রাখল ও, রসিদ লিখে দিল বারকিপ। বেরোনোর সময় দেখল এখনও বসে আছে স্টোর মালিক। ভাবছে কি যেন। বাইরে চলে এল ও। পুরো শহরটা ঘুমোচ্ছে। চাদের আলোয় চোখে পড়ছে সবকিছু। নিশ্চিন্তে উত্তরে এগোল।
কেভিন লপার আজ ঠিকমত ঘুমাতে পারবে না, তার বুকের ভেতর একটা কাটা ঢুকিয়ে দিয়ে এসেছে ও। নিশ্চিত হয়ে গেছে লোকটা। আসল খেলা শুরু হবে এবার। ওকে মেরে ফেলার মওকা খুঁজবে। খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসবে সব কজন।
রাখ-ঢাকের কোন ব্যাপার ওর কখনোই পছন্দ হয় না। সেলুনে ইচ্ছে হচ্ছিল লপারের মুখের ওপর বলে দেয় সত্যটা। কিন্তু তাতে মজাটা নষ্ট হয়ে যেত। প্রিয়জন হারানোর কষ্ট ওরা বুঝবে না, মরার আগে তাই দুশ্চিন্তা আর আশঙ্কায় কিছুটা হলেও ভুগুক। জেমস যতক্ষণ হাত গুটিয়ে বসে থাকবে ওদের আতঙ্ক ততই বাড়বে, একটাকে সরিয়ে দিতে পারলে তো কথাই নেই। ফাঁসির দড়ি হাতে ওদের জন্যে অপেক্ষা করার ইচ্ছে ওর নেই, প্রমাণ করতে হবে তাহলে। সেটা সম্ভব নয়। চারজনই তারা সত্যটা জানে, এটাই হচ্ছে বড় কথা।
<