ওদের চোখে ধুলো দিয়ে জুলিয়াস পালিয়ে গেছে, এই খবর নিয়ে ভগ্নদূত হয়ে মেডকের সামনে এসে দাঁড়াল নকার। জানাল, কেবল দু’জনের পক্ষে জুলিয়াসকে পাহারা দিয়ে আটকে রাখা কোনক্রমেই সম্ভব ছিল না।
তাহলে দোষটা সম্পূর্ণ তোমার, এডের দিকে ফিরে মন্তব্য করল মেউক।
আমি আবার কি করলাম? নিরীহ ভাল মানুষের মত প্রশ্ন করল এড।
জুলিয়াসকে আমরা এখানে হাতের মুঠোয় পেয়েছিলাম। তুমিই ছেড়ে দিয়েছ।
কাঁধ ঝাঁকাল এড। এখনও বলি ঠিকই করেছি আমি। জুলিয়াসকে এখানে হত্যা করলে খুব খারাপ দেখাত। কিন্তু এ নিয়ে তুমি এত চিন্তা করছ কেন বুঝি না। রুখে দাঁড়াবার মত শক্তি এখন আর ওর নেই, তাছাড়া সেবাস্টিন দত্ত তো ত্যাজ্যই করেছেন ওকে।
ঘরের মধ্যে উত্তেজিত ভাবে পায়চারি করছে মেডক। সে জানে এড যা বলছে কথাগুলো খুব সত্যি। কিন্তু জুলিয়াস আপাতত ওর কোন ক্ষতি করতে না। পারলেও পরবর্তীতে অনেক ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে। পার্কে জুলিয়াস বেশ জনপ্রিয়-ডেনভারের ব্যাপারে মিথ্যা অপবাদ দিয়েও সেটা ক্ষুণ্ণ করতে পারেনি মেডক।
কাল সকালেই শহরে যাচ্ছ তুমি, নকার, হঠাৎ পায়চারি থামিয়ে বলে উঠল মেডক। শেরিফকে বলেছি তোমাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছি আমি। তুমিও সবাইকে জানাবে এখানে আর কাজ করছ না তুমি।
তারপর?
ওকে খতম করাই হবে তোমার কাজ। সম্ভবত নডি কোলম্যানের ওখানেই আবার ফিরে গেছে জুলিয়াস। কিন্তু সে যাই হোক, শিগগিরই একদিন শহরে আসতেই হবে ওকে।
আমার টাকার কি হবে?
কাজ শেষ হলেই টাকা পাবে তুমি। যাও এখন আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও। তুমি না; এড-তোমার সাথে কথা আছে আমার।
সবাই বেরিয়ে যেতেই দরজায় খিল এটে তাতে হেলান দিয়ে দাঁড়াল এড। দুশ্চিন্তার বিন্দুমাত্র ছায়া নেই ওর মুখে। অবশ্য কেউই ওকে বিব্রত হতে কোনদিন দেখেনি।
তোমাদের খবর কি? প্রশ্ন করল মেডক।
ভাল।
চোখ ছোট করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেডক চেয়ে রইল এডের দিকে। আজ সকালেই পেপিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কবে বিয়ে করছ তোমরা-জবাব না দিয়ে আমতা আমতা করল সে।
দিন এখনও ঠিক করিনি।
তবে ঠিক করে নাও, আদেশ করল মেডক।
এডের গলায় একটু ঝাঁঝ প্রকাশ পেল। আমাকে গরু-ছাগলের মত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবার চেষ্টা কোরো না। সেটা পছন্দ করি না আমি। পেপিকে বিয়ে করব, ওর সম্পত্তিও নেব, কিন্তু কাজটা আমি নিজের মত করেই শেষ করতে চাই।
যাই করো, জলদি করো। যাও, তুমিও দূর হও এবার।
দাঁত বের করে অবজ্ঞার হাসি হেসে এড জবাব দিল, সানন্দেই যাচ্ছি।
এড বেরিয়ে যেতেই আবার পায়চারি শুরু করল মেডক। এডকে নিয়ে চিন্তায় পড়েছে সে। জুলিয়াস আর এড দুজনে একই সাথে রকিং এইচে পৌঁছেছিল-কথাটা ভোলেনি মেডক। সেদিন রাতেও এই ওকে ছেড়ে দিয়েছিল। অবশ্য একটা যুক্তিসঙ্গত কারণই দেখিয়েছে সে, তবু ব্যাপারটা মেডকের পছন্দ হয়নি। নজর রাখতে হবে লোকটার ওপর।
সেবাস্টিন দত্তের কামরায় ঢুকে দরজা বন্ধ করে বাতি জ্বালাল মেডক।
সেবাস্টিন চোখ বুজে পড়ে আছেন বিছানায়।
এই যে বুড়া মিয়া, ওঠো, কথা আছে, বলল মেডক।
সেবাস্টিন দত্তের কোন পরিবর্তন দেখা গেল না। চোখ বুজেই শুয়ে রইলেন তিনি।
বিছানার ওপর ঝুঁকে পড়ে ঠেলা দিল মেডক। কই শুনছ? ওঠো।
চোখ মেললেন সেবাস্টিন। আবার জ্বালাতে এসেছ তুমি?
কেন, আমাকে দেখতে ইচ্ছা করে না? মরলেই তো পারো, সবারই হাড় জুড়ায়!
তোমাকে না মেরে মরব না আমি।
খ্যাকখাক করে হেসে উঠল মেডক। সেবাস্টিন দত্তের মৃত্যু ঘটলে এই ধরনের আনন্দটা হারাবে সে। সুখবর আছে, তোমার মেয়ে আমার এক কর্মচারীকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে।
আমার ছেলে কোথায়?
মেস ঘরে পোকার খেলে টাকা হারছে।
অন্য ছেলের কথা জিজ্ঞেস করছি।
আর ছেলে কই তোমার? জুলিয়াসের কথা জিজ্ঞেস করছ? বেচারা মারা গেছে।
মাথা নাড়লেন সেবাস্টিন দত্ত। না, সে মারা গেলে ফলাও করে সেই খবরটা তুমি আমাকে আগেই শোনাতে।
একটু চটে উঠল মেডক। তোমার আর বেশিদিন নেই, জিন্দা লাশ তুমি। পেপি আর এডের বিয়েটা হয়ে গেলেই সাজানো দুর্ঘটনায় মারা পড়বে জারভিস। তারপর তোমার পালা।
চোখ বুজলেন সেবাস্টিন দত্ত।
কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বাতি নিভিয়ে দিল মেডক আরও কয়টা দিন টিকে থাকো, বুড়া মিয়া। তোমার জন্যে এক টুকরো বিয়ের কেক পাঠিয়ে দেব আমি।
হাসতে হাসতেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল পাষণ্ড মেডক।
পরের পাঁচটা দিন একা একাই লোলাদের র্যাঞ্চে কাটাল জুলিয়াস। খরগোস শিকার করে টাটকা মাংস খেয়েছে, সিমেরন পাহাড়ে ঘুরে ফিরে সময় কাটিয়েছে। সে। বাড়িটার ধারে কাছেই গোটা সাতেক বিষাক্ত র্যাটল স্নেক মেরেছে। এর মধ্যে আর কেউ র্যাঞ্চের ত্রিসীমানাতেও আসেনি। ওর মুখের ফোলা ভাবটা চলে গেছে। পাজরের ব্যথাটাও নেই বললেই চলে, হাতের অবস্থাও অনেক ভাল এখন।
ছয় দিনের দিন দক্ষিণ দিক দিয়ে ঘুরে বিকেল বেলা নডি কোলম্যানের খামারে পৌঁছল জুলিয়াস। নডি বাড়িতে ছিল না-মারিয়া আর বাচ্চারা জুলিয়াসকে পেয়ে খুব খুশি।
আমরা তোমার জন্যে দুশ্চিন্তায় ছিলাম, বলল মারিয়া। অবশ্য বিশ্বাসযোগ্য মানুষের কাছে খবর পেয়েছি তুমি নিরাপদেই আছ। এখানে আসার পথে কাউকে দেখলে?
কই, না তো?
তাহলে হয়তো সে চলে গেছে।
কে?
নকার। গত দুইদিন সে আশপাশের এলাকা চষে ফেলেছে। দূর থেকে নডি ওকে কয়েকবার দেখেছে, কিন্তু কাছে ভেড়েনি।
কয়েক মিনিট পরেই নডি ফিরে এল। কি, আবার কাজে লাগার জন্যে তৈরি তো?
না, আরও কয়েকটা দিন যাক, জবাব দিল জুলিয়াস।
আমি জানতাম তুমি ওই কথাই বলবে।
রাতের খাবার তৈরি হতে আরও আধঘণ্টা দেরি আছে জেনে নডি আর জুলিয়াস ঘোড়া দেখাশোনার কাজ সারতে আস্তাবলে ঢুকল।
কাল সকালে আমাকে একটা ঘোড়া ধার দিতে হবে, বলল জুলিয়াস। লোলার ঘোড়ায় চড়ে আমার শহরে যাওয়াটা ঠিক হবে না।
তোমার যেটা পছন্দ বেছে নিয়ে, কিন্তু আমার মতে তোমার আদৌ শহরে যাওয়া ঠিক হবে না।
কেন?
শুনলাম নকারকে রকিং এইচ থেকে বের করে দিয়েছে মেডক। এখানেও তোমাকে খুঁজতে এসেছিল সে। এখনও শহরেই আছে লোকটা।
চিন্তিত ভাবে মাথা নাড়ল জুলিয়াস। বলল, নডি, ওর সাথে মোকাবিলা করার কোন ইচ্ছা নেই আমার। কিন্তু তাই বলে সারা জীবন ওর ভয়ে আমাকে লুকিয়ে চুরিয়ে চলতে হবে, এরও কোন মানে হয় না। আমার মত আমি চলব, যদি ওর সাথে দেখা হয়ে যায়, হবে।
শুনেছি লোকটা খুব ক্ষিপ্র।
সব বন্দুকবাজই নিজেকে সেরা ওস্তাদ বলে মনে করে। সে যাক, লোলার সাথে দেখা হয়েছে তোমার?
হয়েছে, ভালই আছে সে!
রকিং এইচের খবর কি?
সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেবাস্টিন দত্ত এখনও স্রেফ মনের জোরেই টিকে আছেন। পেপি আর এডের বিয়ের একটা খবর শোনা যাচ্ছে-কেউই ব্যাপারটা পছন্দ করছে না।
জারভিসের কি সমাচার?
আগের মতই।
চমকে দেয়ার মত নতুন কিছুই ঘটেনি। বাড়ির ভিতরে যেতে যেতে জুলিয়াস বলল, আগামীকাল খুব ভোরে রওনা হব আমি-সকালে ঝামেলার সম্ভাবনা কম থাকবে।
আগামীকাল আমারও শহরে যাওয়া দরকার, বলল নড়ি।
হেসে মাথা নেড়ে জুলিয়াস জবাব দিল, না, তোমার কালকে শহরে যাবার কোন দরকার নেই। মারিয়াকেও আমি তাই জানার। গতবার আমার জন্যে ফাঁদ পাতা হয়েছিল, কালকে আমি শহরে যাব একথা কেউ জানে না। সত্যিই যদি আমার সাহায্যের দরকার হয় তাহলে আমি নিজেই বলব।
পরদিন ভোর না হতেই রওনা হয়ে সকাল ন’টায় জুলিয়াস পৌঁছে গেল ক্রেস্টলাইনে। সোজা রেস্টুরেন্টের সামনে ঘোড়া বেঁধে রেখে ভিতরে ঢুকল সে। দরজার সাথে লাগানো ছোট্ট ঘণ্টিটা ‘টিং’ করে বেজে উঠল। সকালের নাস্তা এরমধ্যেই সবাই সেরে নিয়েছে-কোন লোক নেই রেস্টুরেন্টে।
ঘণ্টির শব্দে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল লোলা। জুলিয়াসকে দেখেই থমকে দাঁড়াল সে-গাল দুটো সামান্য আরক্ত হলো তার।
সুপ্রভাত, লোলা, হাসিমুখে বলল জুলিয়াস।
মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল লোলা। ওর দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, সুপ্রভাত, জুলিয়াস। কফি না নাস্তা?
ব্যস? বলার আর কিছু খুঁজে পেলে না? কৃত্রিম আহত সুরে বলে উঠল জুলিয়াস। তোমাকে এখন জড়িয়ে ধরে চুমু খেলে কি করবে?
প্রতিবাদ স্পষ্ট হয়ে উঠল লোলার চোখে। কিন্তু হাসতে হাসতেই বলল, ভাল হবে না বলছি! আমি চিৎকার করলে ফুটন্ত পানির প্যান হাতে মা বেরিয়ে আসবেন রান্নাঘর থেকে। একবার ঘটেছিল তাই। যাক, তোমার জন্যে একটা খবর আছে।
কি খবর?
পেপি তোমাকে দেখা করতে বলেছে। অ্যাডালামের গুহা চেনো?
গুহাটা রকিং এইচের উত্তর-পশ্চিমে জঙ্গলের ভিতরে লুকানো একটা জায়গা। ছেলেবেলায় ওখানে অনেক খেলেছে ওরা। গা ঢাকা দিয়ে ওখানে পৌঁছতে কোন অসুবিধা হবে না তার। লোলার দিকে চেয়েই সম্মতি জানাল সে।
আজ থেকে শুরু করে তোমার সাথে দেখা করার জন্যে ওখানে প্রত্যেকদিন একবার করে যাবে পেপি। আমি বলেছিলাম দু’একদিনের মধ্যেই তোমার সাথে আমার দেখা হবে।
ধন্যবাদ, লোলা।
এডের সম্পর্কে ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ওকে ভালবাসে পেপি।
মুখ বিকৃত করলেও জুলিয়াস জানে লোলার কথাই ঠিক। কিন্তু এতে ওর করার কিছুই নেই।
আরও একটা খবর আছে তোমার। খবরটা তোমাকে দিতে মন না চাইলেও দিচ্ছি, জিনা তোমাকে দেখা করতে বলেছে।
জুলিয়াসের বুকের ভিতরটা লাফিয়ে উঠল। জিনা কি জন্যে দেখা করতে বলেছে? গতবার যা কথা হয়েছে তাতে তো সব শেষ হয়ে যাবার কথা! নাকি মেয়েটা নতুন করে কিছু ভেবেছে?
কফি না নাস্তা? সাদামাঠা গলায় জিজ্ঞেস করল লোলা।
লোলার দিকে মুখ তুলে চাইল জুলিয়াস। আগের সেই অন্তরঙ্গ ভাবটা আর। নেই ওর মুখে। এর কারণটাও জুলিয়াসের, অজানা নয়। জিনার পাঠানো খবরে ওর বিচলিত হয়ে ওঠা লক্ষ করেছে লোলা। নিজের অনুভূতি গোপন রাখতে পারেনি জুলিয়ার্স। হঠাৎ নিজের ওপরই রাগ হলো তার, বলল, লোলা, তুমি…
কফি দেব, না নাস্তা? বাধা দিয়ে উঠল লোলা।
নাস্তা, আর শোনো…
কিন্তু বলার মত আর কিছুই খুঁজে পেল না জুলিয়াস। লোলাদের পাহাড় ঘেরা র্যাঞ্চে একা একা সে কেবল লোলার কথাই ভেবেছে। আবার ওকে দেখার জন্যে তার মনটা উদগ্রীব হয়ে ছিল। ভেবেছিল জিনাকে মন থেকে পুরোপুরি মুছে ফেলেছে। কিন্তু তবে এই দোটানা কেন? মন স্বীকার করতে না চাইলেও সে বুঝতে পারছে এখনও তার বুক জুড়ে বসে আছে জিনা।
তোমার নাস্তা নিয়ে আসি, ত্রস্ত পায়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল লোলা। অস্বস্তিভরে একটু নড়েচড়ে বসল জুলিয়াস। কেউ একজন ভিতরে ঢুকল। ঘণ্টির শব্দে মুখ তুলে ডিগবিকে দেখে মুখ বাকাল জুলিয়ান। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেছে তার-শেরিফের এই অসময়ে আসার কি দরকার ছিল? অনেক কথাই লোলাকে বলার ছিল, কিন্তু এখন আর কিছুই বলা যাবে না।
জুলিয়াসের টেবিলে এসে চেয়ার টেনে বসতে বসতে সে বলল, সুপ্রভাত, জুলিয়াস। কোথায় ছিলে তুমি?
সুপ্রভাত, শেরিফ, বিরক্ত সুরে জবাব দিল জুলিয়াস। বিশ্রাম করছিলাম।
আমার প্রশ্নের জবাব হলো না ওটা। সে যাক, রকিং এ ইচে চড়াও হয়ে হাঙ্গামা বাধিয়েছিলে কেন? তোমার বাবা যে খুব অসুস্থ, এতটুকু বোধও কি তোমার নেই?
শেরিফে সাথে তর্ক করার ইচ্ছা জুলিয়াসের নেই। তাছাড়া ডিগবি ওকে দেখতে পারে না, জুলিয়াস যাই বলুক বিশ্বাস করবে না সে। এড়িয়ে যাবার জন্যে সে বলল, যা ঘটে গেছে সেজন্যে আমি খুব দুঃখিত, এখন ওসব কথা তুলে আর কি লাভ?
তা ঠিক। আমি তো সব শুনে তোমাকে জেলেই ভরব ঠিক করেছিলাম, কিন্তু মেডকের মন নরম, সে-ই বাধা দিল।
মেডকের মন নরম! ভাবতেই হাসি পাচেছ-তবু কোন মন্তব্য করল না জুলিয়াস। লোলা জুলিয়াসের নাস্তা দিয়ে গেল।
শোনো, জুলিয়াস, তোমার রকিং এইচে যাওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করছি আমি। ওখানে গিয়ে আর গোলামাল পাকিয়ো না, বুঝেছ?
নিশ্চয়ই, সহজভাবেই জবাব দিল জুলিয়াস।
আর একটা কথা, পার্কে যেন কোন অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে এজন্যে মেডক খুব সহযোগিতা করছে। নকার আর তোমার ঝগড়ার পরিণাম খারাপ দাঁড়াতে পারে ভেবে নকারকে বরখাস্ত করেছে। পার্ক থেকেই চলে যাবার নির্দেশ দিয়েছে ওকে। আশা করছি দু’একদিনের মধ্যে চলে যাবে লোকটা, তবে এখনও শহরেই আছে সে।
নকারের সাথে আমার কোন বিরোধ নেই।
সে অন্যরকম বলে। প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে হন্যে হয়ে রয়েছে। ওকে সাবধান করে দিয়েছি যে পার্কে কোন বন্দুকবাজি আমি সহ্য করব না। এরপরেও যদি তোমরা গোলাগুলি করো, তবে তোমাদের মধ্যে যে বেঁচে থাকবে তাকেই জেলে পুরব আমি।
আমার তরফ থেকে ঝামেলা হবে না, জবাব দিল জুলিয়াস।
নকার তাহলে শহরেই আছে। সাবধান থাকতে হবে ওকে। শহরে যতক্ষণ থাকবে বিপদের সম্ভাবনাও ততই বাড়বে। আর একটা ব্যাপার সেই সাথে টের পেল জুলিয়াস, যতটা মনে করেছিল তারচেয়েও অনেক বেশি ধূর্ত মেডক। নকারকে বরখাস্ত করায় এখন যাই ঘটুক ওর আর কোন দায়িত্ব থাকছে না। সবাই ওকে সম্পূর্ণ নির্দোষ ভাববে।
উঠে দাঁড়িয়ে ভারী গলায় ডিগবি বলল, তোমার ওপর নজর রাখব আমি, জুলিয়াস। সুতরাং সাবধান।
আমাকে সাবধান করতে হবে না, নকারের ওপর নজর রেখো, হেসে জবাব দিল জুলিয়াস।
কফি নিয়ে এল লোলা। টেবিলের ওপর জুলিয়াসের কফি নামিয়ে রেখে সে বলল, দেখি তোমার হাত?
হাত দুটো লোলার সামনে তুলে ধরে জুলিয়াস বলল, তুমি ও নিয়ে দুশ্চিন্তা কোরো না-আমার হাত প্রায় ভাল হয়ে গেছে।
নকারের সাথে যদি…
কোন চিন্তা কোরো না তুমি।
হঠাৎ উল্টোদিকের আসনে বসে পড়ল লোলা। কিন্তু আমার দুশ্চিন্তা যাচ্ছে কই? এখনই তুমি বাইরে রাস্তায় পা দেবে-কি ঘটবে কিছু ঠিক আছে? তোমাকে এভাবে বিপদের মধ্যে যেতে দিতে মন সরছে না।
আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আমার ওপর রাগই করেছ।
মাথা নাড়ল লোলা। রাগ করিনি-একটু দুঃখ পেয়েছিলাম। হয়তো আমিই বেশি আশা করেছি, কিন্তু এখন সে-প্রসঙ্গ থাক।
সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছে ওকে। বারবার কেবল দরজার দিকে চাইছে লোলা। টেবিলের ওপর রাখা ওর ছোট ছোট হাত দুটোর ওপর নিজের হাত রেখে আদর করে মৃদু চাপ দিল জুলিয়াস। সুস্থির হও, লোলা। মানুষকে ঝুঁকি নিতেই হয়। গুহায় আমাদের পূর্বপুরুষ যারা বাস করত, তারা ঝুঁকি নিয়ে বাইরে না বেরুলে। এখনও আমাদের আগের মত বর্বরই থাকতে হত।
হাসতে চেষ্টা করল লোলা। আমাদের ওই রকম একটা গুহা থাকলেই ভাল হত। আগে ভাবতাম আমার অনেক সাহস, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি আসলে আমি একটা ভীতুর ডিম।
তুমি কোন চিন্তা কেরো না, সান্তনা দিল জুলিয়াস সামনেই আমার ঘোড়া বাঁধা রয়েছে। ঘোড়ায় চেপে এক মিনিটের মধ্যেই শহর ছেড়ে চলে যাব। তবে, আবারও ফিরব আমি।
তুমি ফিরে আসো, এটাই চাই।
লোলার হাতে মৃদু চাপড় দিয়ে উঠে দাঁড়াল জুলিয়াস। দরজার সামনে গিয়ে একটু থেমে খাপে ভরা পিস্তলটা পরীক্ষা করে দেখল ওটা ঠিকমত সহজে বেরোয় কিনা। জুলিয়াস জানে লোলা লক্ষ করছে তাকে, কিন্তু উপায় নেই। যদিও শহর ছেড়ে যাবার আগে নকারের সাথে দেখা হবার সম্ভাবনা নেই, তবু সাবধান থাকা ভাল।
লোলাকে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে এল জুলিয়াস। রাস্তার অন্য মাথায় তার অফিসের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে ডিগবি নোবল। অ্যালেন কারভার বারের বারান্দা পরিষ্কার করছে। ব্যাঙ্কের সামনে দাঁড়িয়ে তিনজন লোক কথা। বলছে। ঘোড়ার রাশটা খুলে লাগাম ঢিলে করতে করতেই পিছন থেকে নকারের চড়া কর্কশ স্বর শুনতে পেল জুলিয়াস। রেস্টুরেন্টের কোনায় দাঁড়িয়ে আছে নকার!
ঘুরে দাড়াও, জুলিয়াস দত্ত!
ধীর গতিতে ঘুরে দাঁড়াল জুলিয়াস। ওর হাতটা কোমরে বাঁধা পিস্তলের বাঁটের কাছে নেমে এসেছে। মনেমনে তৈরি থাকলেও এটা ঠিক আশা করেনি। ও। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নকারের দিকে চেয়ে আছে জুলিয়াস। একটু ঝুঁকে মুখ কুঁচকে দাড়িয়ে আছে নকার। ওর ডান হাতটা পিস্তলের বাটের কাছাকাছি ঘুরছে।
এবার আর এড়িয়ে যাবার উপায় নেই তোমার, বলল নকার। তৈরি
কেন? শান্ত গলায় প্রশ্ন করল জুলিয়াস।
কেন তা তুমি ভাল করেই জানো, মরার জন্য তৈরি হও।
এমন কঠিন অবস্থায় মানুষের হাসি বেরুবার কথা নয়, তবু চেষ্টা করে একটু হাসল জুলিয়াস। অপেক্ষা করছে সে-নকারের স্নায়ুর জোর পরীক্ষা করার জন্যে ওকেই প্রথম পিস্তল বের করার সুযোগ দিতে চায় জুলিয়াস। গান-ফাইটে শক্ত নার্ভের দরকার। জুলিয়াস আশা করছে মনের জোর কম থাকলে হয়তো পিছিয়ে যাবে নকার। অহেতুক পিস্তল ব্যবহার করতে চায় না ও।
সতর্ক দৃষ্টিতে নকারকে লক্ষ করছে জুলিয়াস। একটু আগেও নকারের কপালটা শুকনো ছিল, এখন বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছে সেখানে। ওর চোখের ভাব পালটে গেছে-আগের আত্মবিশ্বাসের ছাপ আর সেখানে নেই।
জুলিয়াসের গলা দিয়ে একটা শব্দ বেরুল। নকারের কাছে ব্যঙ্গাত্মক হাসির মতই শোনাল শব্দটা। আর সহ্য করতে পারল না সে। বেসুরো গলায় চিৎকার করে বলল, এইবার, জুলিয়াস, গুলি করো!
এক ঝটকায় পিস্তল বের করে আনল নকার। জুলিয়াসের হাতেও বিদ্যুৎ খেলে গেল। নিজের গুলির শব্দের প্রায় সাথে সাথেই প্রতিধ্বনির মত নকারের গুলির আওয়াজ শুনতে পেল জুলিয়াস। ঊরুর উপরটা হঠাৎ চাবুকের আঘাতে যেন জ্বলে উঠল। আবার গুলি করল জুলিয়াস। কিন্তু তার দরকার ছিল না, নকার ততক্ষণে পিছন দিকে উল্টে পড়তে শুরু করেছে। হাত থেকে পিস্তল খসে পড়ল-ওর অসাড় দেহটা মাটিতে পড়ার আগে মাথাটা দালানের কোনায় ঠকে গেল। কাত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল সে।
এক মুহূর্ত নিশ্চল হয়ে দাড়িয়ে থেকে পিস্তল খাপে ভরল জুলিয়াস। অন্য হাতে মুখটা মুছল। ঘামে ভিজে গেল তালু। ওর হাত-পা দুটোও কেমন যেন। দুর্বল ঠেকছে। রেস্টুরেন্টের দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে এল লোলা। মুখটা ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, চোখ দুটো বিস্ফারিত, উৎকণ্ঠায় তার হাত দুটো বুকের কাছে ভাজ করা।
উপায় ছিল না, লোলা, ভারী গলায় বলে উঠল জুলিয়াস। চেষ্টা করেও…
কথাটা শেষ হলো না। আড়চোখে দূরে ডিগবি নোবলকে ওর দিকে ছুটে আসতে দেখল জুলিয়াস। শেরিফের হুমকির কথা ভোলেনি সে। যা ঘটেছে তাতে দেশের কোন আইনেই জুলিয়াসকে আটকানো অসম্ভব। কোন সন্দেহ নেই আত্মরক্ষার জন্যেই গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছে সে-কিন্তু শেরিফ ইচ্ছা করলে অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে হলেও তাকে আটকে রাখতে পারে। হাজতে আটকে থাকার কোন ইচ্ছে নেই ওর।
ঘোড়াটা ছাড়া পেয়ে লাগাম মাটিতে লুটিয়ে রাস্তার ওপর হাঁটছে। একটু এগিয়ে ঘোড়াটাকে ধরেই লাফিয়ে ওর পিঠে উঠে বসল জুলিয়াস। চিৎকার করতে করতে শেরিফ ছুটে এল।
এখন সময় নেই, ঘোড়া ছুটিয়ে দূরে সরে যেতে যেতে চিৎকার করে জানাল জুলিয়াস। পরে দেখা হবে!
দ্রুত বেরিয়ে গেল সে। কিছুদূর গিয়ে পিছন ফিরে দেখল এর মধ্যেই লোকজন জড়ো হতে আরম্ভ করেছে। লোলা হাত নেড়ে বিদায় জানাল ওকে। শেরিফও ওর দিকে চেয়ে হাত নাড়ছে, তবে তার হাত মুষ্ঠিবদ্ধ।
<