হ্যারিই প্রথম জনি হিউবার্টকে দেখতে পেল। কয়েক মাইল দূরে থাকতেই সে একক আরোহীকে দেখতে পেয়েছে। ভেবেছিল ওটা হয়তো মাইক বা ড্যাশার হবে। আরোহীকে চিনতে পেরে টিলার ওপর থেকে ছুটে নামতে গিয়ে প্রায় পা ভাঙার জোগাড় করল। টেরি আর কিড লেকার বাঙ্কহাউসের সামনে অলস ভাবে সময় কাটাচ্ছে। রনির নির্দেশ অনুযায়ী আজ আর রেঞ্জে যায়নি কেউ।

       পাহারা ছেড়ে হ্যারিকে টিলা থেকে ছুটে নামতে দেখে বেন কেসি ঘর ছেড়ে বাইরে বিরিয়ে এল। ওর সাথে ডক্টর হ্যাডলে, শেলী আর লিসাও বাইরে বেরোল।

ব্যাপার কি হ্যারি? প্রশ্ন করল বেন।

হিউবার্ট হাঁপাচ্ছে হ্যারি। দু’মিনিটের মধ্যেই এখানে পৌঁছে যাবে।

হয়তো সে আপোষ করতে চায়, বলল বেন। তারপর রাইডারদের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে সে আবার বলল, যা বলার, আমি বলব।

বস, আপত্তি জানাল কিড, হয়তো সে আমার খোঁজে এসেছে। ওকে আমার হাতে ছেড়ে দাও।

না। বেন কেসির স্বরে কতৃত্বের ছাপ। আমি নিজেই এটা হ্যাণ্ড করব।

প্রচণ্ড রাগে জনির সারা শরীর জ্বলছে। ওর লোকজনের কি হয়েছে তার কিছুই সে জানে না। রাগের মার্থায় এখন সে কেয়ারও করে না। সূর্যের তাপে চোখের কিনারাগুলো লাল হয়ে উঠেছে। ধুলোর পাতলা পরতের নিচে মুখটা হিংস্র। রকিঙ কের লোকজনই যে তার র‍্যাঞ্চ থেকে খাবার, গোলা-বারুদ আর ঘোড়া সরিয়েছে, এতে তার মনে কোন সন্দেহ নেই। রাগে ফুসতে-ফুঁসতে রকিঙ কের রাঞ্চে এসে পৌঁছল হিউবার্ট।

আশা করেছিল র‍্যাঞ্চটা জনশূন্য থাকবে। কিংবা বড়জোর বেন আর তার বোন দুটো থাকতে পারে। ওরা তাকে বাধা দিতে সাহস পাবে না। কিন্তু দেখল উঠানে টেরি, হ্যারি, স্টি লেকার রয়েছে-বাঙ্কহাউসের দরজায় রজারকে দেখা যাচ্ছে। ওদের থেকে অল্প দূরেই রয়েছে দুটো মেয়ে, ডাক্তার আর বেন কেসি। কেসি ওর দিকে এক-পা এগিয়ে এল।

হাওডি, জনি? স্পষ্ট স্বরে বলল সে। ঘোড়া থেকে নামো। নিশ্চয়। সন্ধি করতে এসেছ তুমি?

ওর কথায় ষাঁড়ের সামনে লাল কাপড় নাড়ার মতই প্রতিক্রিয়া হলো। সন্ধি? তোমার হাড়ের সবক’টা সন্ধি আমি ছুটিয়ে দেব ইডিআ্যাট!

স্থির দাঁড়িয়ে আছে বেন। চেহারাটা সংযত, গম্ভীর। কেসি আগে কখনও এমন পরিস্থিতির মোকাবিলা করেনি। ঠোঁট চাটল টেরি। সে এখানকার সবথেকে পুরানো কর্মচারী। মনে মনে সে জানে বস্ এটা সামলাতে পারবে না। এগিয়ে গিয়ে মাঝখানে দাঁড়িয়ে ফাইটটা নিজের কাঁধে তুলে নিতে তার খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু তাতে কেসির তীক্ষ্ণ অহঙ্কার বোধ ক্ষুণ্ণ হবে-এটা সে মোটেও পছন্দ করবে না। র‍্যাঞ্চের সবাই একই কথা ভাবছে জেনে সে ফিসফিস করে বলল, এগিও না। এটা ওর ফাইট।

বেন শান্ত স্বরে বলল, হিউবার্ট, বোকামি কোরো না। আমরা আগেও বলেছি আমাদের দুজনের পাশাপাশি থাকার মত যথেষ্ট রেঞ্জ এখানে রয়েছে। কেবল তুমি বুজের ওপারে থাকলেই আমাদের মধ্যে কোন ঝগড়া-বিবাদ হবে না। বাবা মারা গেছে বলেই ভেব না তোমরা আমাদের ওপর চড়াও হতে পারবে।

শান্তিপূর্ণ অবস্থায় বাস করা ছাড়া তোমার আর কোন পথ নেই। তোমার লোকজন এখন হেঁটে মরুভূমি পার হচ্ছে। খাবার আর পানির অভাবে ওদের এখন খুব খারাপ অবস্থা। তোমার র‍্যাঞ্চে কোন ঘোড়া নেই–অন্য স্টেশনগুলোতেও নেই। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আমরা কর্ন প্যাচে গিয়ে সব জ্বালিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে আসব।

এটাই আমার শেষ কথা। তুমি এখনই শান্তিচুক্তি করে পাহাড়ের ওপাশে থাকতে পারো, নইলে আমরা গিয়ে থ্রী এইচ পুড়িয়ে দেব। তারপর তোমার রাইডারদের পায়ে হেঁটেই দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য। করব–সাথে তোমাকেও!

এত দ্রুত ঘোড়ার পিঠ থেকে নামল হিউবার্ট যে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। বেনের মুখোমুখি হলো সে। তার আগে তোমাকে আমি জাহান্নামে পাঠিয়ে ছাড়ব! গর্জে উঠল জনি।

আমি দুঃখিত, হিউবার্ট। বেন এখনও শান্ত। তুমি যদি ওই পথই বেছে নিতে চাও, তবে তাই হোক।

কোন যুক্তিই হিউবার্ট মানবে না। জীবনে কখনও সে পরাজয় স্বীকার করেনি। ওর চোখে এখন খুনের নেশা। পিস্তল বের করার জন্যে ঝট করে হাত নামাল সে।

টেরির কাছে দৃশ্যটা কচ্ছপ-গতিতে এগোচ্ছে। মানস চোখে বেনের নিশ্চিত মৃত্যু দেখতে পাচ্ছে সে। দেখল, জনির হাতে পিস্তল উঠে এল–ঠিক ফাস্ট ড্র বলা যায় না, তবে কেসির থেকে অনেক দ্রুত। বেনও পিস্তল বের করেছে। একটা তীক্ষ্ণ গুলির আওয়াজ শুনতে পেল টেরি। আশ্চর্য! যুবক র‍্যাঞ্চার এখনও দাড়িয়ে!

ধীরে পিস্তল উঁচিয়ে লক্ষ্য স্থির করছে বেন। টারগেট প্র্যাকটিসের ভঙ্গিতে কাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। হিউবার্ট আবার গুলি করল, এবং আবার। এবার বেন কেসি গুলি করল।

জনির হাঁটু ধীরে ভাঁজ হয়ে মাটি ছুঁলো। তারপর মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ল সে। উপস্থিত সবাই বুঝছে লোকটা মারা গেছে। ফেকাসে মুখে ধীরে পিস্তল নামাল কেসি।

টেরি, নিচু স্বরে বলল সে, তোমরা সবাই মিলে ওর লাশটা আপাতত গুদামে নিয়ে রাখো। ওদের আউটফিটের কেউ যদি আজ রাতের মধ্যে ওর দেহটা দাবি না করে, আমরা সকালে ওকে কবর দেব। ডাক্তারের দিকে ফিরল সে। হ্যাডলে, তোমার ব্যাগটা বের করো। মনে হচ্ছে আমি গুলি খেয়েছি।

রনি আর শর্টি সেভেন পাইনস শহরে পৌঁছল। আঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। ওরা দুজনেই ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত। লিভারি আস্তাবলে ঘোড়া রেখে রাস্তা ধরে ওরা এগোল। হার্ট ওদের অনেক পিছনে-মুখটা কঠোর।

কী একটা দেশ! তেতো স্বরে বলল শর্টি। হয় রোদে পুড়ে যাচ্ছে, নয়তো বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে!

হোক বৃষ্টি! জবাব দিল রনি। খাবার তো এত রাতে কোথাও পাওয়া যাবে না, আমার কেবল একটা বিছানা আর কম্বল হলেই চলবে।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে হ্যাট আর প্লাসটিকের বর্ষাতি থেকে পানি ঝেড়ে সেলুনের হোটেলে ঢুকল ওরা। লবিতে টিমটিম করে একটা বাতি জ্বলছে। সাড়া পেয়ে ঘুমে কাতর কেরানি তার দরজা খুলে গলা বাড়াল। স্থিরদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, সাত নম্বর। নিজেই র‍্যাক থেকে চাবিটা নিয়ে নাও। আমি শুয়ে পড়ছি!

দরজা টেনে দিলেও বিছানায় গেল না সে। এক মিনিট চিন্তা করে তাড়াতাড়ি প্যান্ট পরে নিল। তারপর তাড়াতাড়ি আ্যাডামের কামরার দিকে এগোল।

একঘণ্টা আগে বিছানায় গেলেও ঘুমায়নি অ্যাডাম। অনেক কিছুই ঘটছে, কিন্তু কোন খবর সে পাচ্ছে না। দরজার ওপর মৃদু টোকার শব্দ ওর কানে এল। বালিশের তলা থেকে পিস্তলটা বের করে কান পেতে রইল। আবার টোকা পড়ল। কে? নিচু স্বরে প্রশ্ন করল সে।

আমি-জেরেমি! তোমার জন্যে খবর আছে!

বিছানা ছেড়ে নেমে দরজা খুলে দিল অ্যাডাম। জেরেমি ঢুকতেই আবার বন্ধ করল।

ভাবলাম তোমার জানা দরকার। রনি ড্যাশার এখন শহরে! ওর সাথে শর্টি মাইকও এসেছে। মাত্র কয়েক মিনিট আগেই পৌঁছেছে। ওদের আমি সাত নম্বর কামরাটা দিয়েছি।

ড্যাশার? কিছু বলল সে? কোন খবর?

একটা কথাও না। দুজনেই ক্লান্ত, কিন্তু ওদের গায়ে একটা আঁচড়ও লাগেনি।

ঠিক আছে, ঘুমোতে যাও। কাল সকালে একটু ঘুরেফিরে খবর নেয়ার চেষ্টা কোরো কি ঘটছে।

ভোরবেলা থেকেই খবর আসতে শুরু করল। জনি হিউবার্ট মারা গেছে। এবং সে মারা পড়েছে বেন কেসির হাতে! তিনটে গুলি করেছিল হিউবার্ট। বেন, মাত্র একটা!

হিউবার্টের রাইডাররা ফাঁদে পড়ে পায়ে হেঁটে অ্যালকেলি বেসিন পার হচ্ছে। ওদের সব ঘোড়া তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ঘণ্টাখানেক পর আরও দু’জন লোক শহরে পৌঁছল।

হ্যানকিনস আর ড্রেনান দল ছেড়ে ভিন্ন পথ ধরেছিল। অল্পক্ষণ পরেই ওদের কপাল ফিরে গেল। থ্রী এইচের কিছু ঘোড়া দেখতে পেল ওরা। একটা ছোট শাখা ক্যানিয়নে ঘোড়াগুলো ঘাস খাচ্ছিল। সুখকর পরিবেশে দলের সাথে ওদের বিচ্ছেদ হয়নি বলে ঘোড়া নিয়ে দলের কাছে ফিরে যাওয়ার কোন প্রয়োজন বোধ করেনি ওরা। ঘোড়ার খালি পিঠে উঠে সোজা সেভেন পাইনসের দিকে রওনা হয়েছে!

মুখে ফোস্কা পড়েছে পায়ের অবস্থা কাহিল। এই অবস্থায় এদের একটাই ইচ্ছে, থ্রী এইচ থেকে দুরে থাকতে চায় ওরা।

রনি ড্যাশার দ্বিতীয় কাপ কফি নিয়ে বসেছে, এই সময়ে হ্যানকিনস আর ড্রিনান প্রায় টলতে টলতে মলির রেস্টুরেন্টে ঢুকল। ঠাণ্ডা নীল চোখে ওদের যাচাই করে দেখল সে।

এখানকার কফি ভালে। কিন্তু তোমরা নাস্তা চাও, নাকি ঝামেলা?

হ্যানকিনস ক্ষুব্ধ চোখে চেয়ে থাকল। ড্রিনান মুখ খুলল। নাস্তা আর গোসলের পর দেশ ছেড়ে চলে যেতে চাই। তুমি কি বলল, রনি?

শর্টির হাত দুটো পিস্তলের ব্যাটের কাছে। অপেক্ষা করছে। তুমি ওর সাথে একমত? হ্যানকিনসকে প্রশ্ন করল রনি।

বেজার মুখে মাথা ঝাঁকাল হ্যানকিনস। ওই দিনই পরের দিকে শহর ছেড়ে চলে গেল ওরা। সপ্তাহ শেষ হওয়ার আগেই কর্ন প্যাঁচ পুড়িয়ে দেয়া হলো। জনি হিউবার্টকে ওর ভাইয়ের পাশেই কবর দেয়া হলো। রেঞ্জটা এখন শান্ত। কেন ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে।

থ্রী টি এল-এর মরিসন যে রনির পথ চেয়ে আছে, এটা সে জানে। তবু যে কেন ও এখানেই থাকছে, তা সে নিজেও জানে না। রেড শহরে ফিরে গেছে। অ্যাডামের পাশেই ওকে সর্বক্ষণ দেখা যায়। কেউ ডাকি স্মিথকে ইউনিয়নভিলে দেখেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। কিন্তু সে যে শহর ছেড়ে কোথায় উধাও হয়েছে তা কেউ জানে না।

গত দশ দিন যাবৎ একটা অদ্ভুত অনুভূতি রনির মনে অস্বস্তি জাগাচ্ছে। র‍্যাঞ্চের বারান্দায় বসে সবদিক বিচার করে সে এর কারণটা বুঝল। জেরিকে সে পড়তে দেখেছে বটে, কিন্তু নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবে না লোকটা মরেছে। সমার্স বেঁচে থাকতে এই এলাকায় শান্তি কখনও ফিরে আসবে না। সুতরাং যা-ই ঘটুক না কেন, হাইডআউটে গিয়ে তাকে নিজেই দেখে আসতে হবে।

অল্পক্ষণ আগেই হাইডআউটে পৌঁছেছে ড্যাশার। রকস্লাইড-যেপথে রনি কানিয়নে ঢুকেছিল সেটা আগের মতই আছে। কিন্তু করাতের দাঁতের মত পাহাড়গুলো আর আগের জায়গায় নেই, লক্ষ করল সে। ক্যানিয়নের দুটো অংশেই প্রাণের কোন সাড়া নেই। চারদিক নিঝুম। ক্যানিয়নের তলায় পাথর পড়ে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি করেছে। পাথরের দালানটার কেবল দুটো দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে। দুটোতেই ফাটল ধরেছে। বাকিটা পুরোই ধ্বংস হয়েছে। জেরি জীবিত থাকলেও সে ক্যানিয়নে নেই। করালে একটা ঘোড়াও নেই। দালানের পাথরের স্কৃপের ভিতর রনি কোন লাশ খুঁজে পেল না–তবে রক্তের দাগ ওখানে রয়েছে। তারপর করালের কাছে একটা কবর দেখতে পেল।

                                 লারামি
                                          ১৮৮১
                                  বুট পরেই মরেছে সে

একটা কবর! জেরি সমার্স বেঁচে আছে! দ্রুত দ্বিতীয় আস্তানাটার দিকে এগোল রনি। তাড়াহুড়ো করে ওটা ছেড়ে চলে যাওয়ার সব চিহ্নই রয়েছে ওখানে। টপারের দিকে এক নজর চেয়ে দেখল ঘোড়াটা কান খাড়া করে বুনো চোখে এদিকওদিক দেখছে। রনিও একবার চারপাশে দেখল। হঠাৎ জমিটা একটু কেঁপে উঠল।

ছুটে এসে এক লাফে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসল সে। পুরোদমে প্রবেশ পথের দিকে ছুটল টপারকে নিয়ে। ঘোড়ার পায়ের নিচে মাটিটা যেন ককাচ্ছে। পাথরের সাথে পাথর প্রচণ্ড চাপের সাথে ঘষা খাওয়ার আতঙ্ক-জাগানো শব্দ তুলে দক্ষিণের পাহাড়গুলো আরও-আরও উঁচু হয়ে আকাশের দিকে উঠছে। বেরোবার ফাঁকটা এখন আরও সরু হয়েছে। ঘোড়াটাকে নিয়ে লাফিয়ে ফাঁক গলে বেরিয়ে এল রনি। ভূমিকম্পের জের এখানেও সুস্পষ্ট। লম্বা সরু ফাটলগুলো মরুভূমির মধ্যে যতদূর দেখা যায় এগিয়ে গেছে। র‍্যাঞ্চে ফেরার পথ ধরল রনি।

জেরি সমার্স বেঁচে আছে। তাই যদি হয়, কোথায় আছে সে? কর্ন প্যাচে আগুন ধরিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। থ্রী এইচে যোগ দিয়ে থাকতে পারে সে। কিন্তু তার সম্ভাবনা কম। জেরি সমার্স হচ্ছে লীডার-অন্যের আদেশ মেনে চলা ওর ধাতে সইবে না।

মরুভূমিতে জেরি ট্র্যাক খোজা অর্থহীন। জেরির মত আউটলকে ট্র্যাক করতে হলে মাথা খাটিয়ে করতে হবে। ইউনিয়নভিলে সে যাবে, কারণ ওখানে সে পরিচিত। রনির বিশ্বাস, জেরি চাইবে ওর শত্রুরা সে মারা গেছে মনে করে নিশ্চিন্ত থাকুক।

রাত হয়ে আসছে। এতক্ষণে রনি অনুভব করল সে ক্লান্ত। টপার যেভাবে চলছে, তাতে বুঝতে পারছে ঘোড়াটাও তাই। বাটির মত একটা বড় গর্তে কিছু কটনউড গাছ দেখে ওদিকেই এগোল রনি। ওখানে পানি থাকার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। ওর ধারণা ভুল নয়। চুয়ে পড়া পানিতে মাঝখানে একটা ছোট্ট পুকুর মত হয়েছে। একপাশে ম্যানজানিটার ঘন ঝোঁপ। উপড়ে পড়া একটা বিশাল গাছের পাশে ক্যাম্প করল। ছোট্ট একটা আগুন জ্বেলে কফি চাপাল সে।

কফি ঢালছে, এই সময়ে পাথরের ওপর ঘোড়ার খুরের ক্লিক্লিক শব্দ ওর কানে এল। কাপটা নামিয়ে রেখে গাছের গুড়ির মোটা দিকটার আড়ালে চলে গেল–হাতে রাইফেল। অনেকক্ষণ সব চুপচাপ। গরম কফি ভরা কাপটার দিকে সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল রনি। আসার আর সময় পেল না লোকটা!

একটা উপায় ওর মাথায় খেলল। খুব সতর্কতার সাথে কাপের হাতলটার সাথে রাইফেলের মাথায় বসানো নিশানা করার কাঁটায় বাধিয়ে ধীরে নিজের দিকে টেনে নিয়ে এল। কপাল ভাল, কাপ থেকে চলকে খুব কমই পড়ল। তৃপ্তির সাথে কফি শেষ করল রনি। আসুক ওরা, এখন সে তৈরি।

আবার একটা ক্লিক শোনা গেল–আরও কাছে। লোকটা যে-ই হোক, খুব সাবধানে এগোচ্ছে। নিচু হয়ে আকাশের দিকে চাইল সে–কোন তারা আড়াল হয় কিনা খেয়াল করছে। কিন্তু তা হলো না। মৃদু কথাবার্তার আওয়াজ রনির কানে এল। মাথা কাত করে কান পেতে শোনার চেষ্টা করল। যখন বুঝতে পারল, হেসে গুঁড়ি ঘুরে ঘাসের ভিতর দিয়ে বুকে হেঁটে এগোল। যখন আকাশের পটভূমিতে ওদের চওড়া হ্যাটগুলো দেখতে পেল; সে উঁচুস্বরে বলে উঠল, তোমরা যদি ক্যাম্পের দিকে এগোলে নিজেদের আগে থেকেই ঘোষণা করো, তাহলে এভাবে ধরা পড়তে হবে না।

বাধ্য ছেলের মত ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল শর্টি আর হ্যারি। হ্যারি বলল, ভাবলাম তোমার হয়তো সঙ্গ ভাল লাগবে। তাছাড়া এদিকে যখন এলামই মনে করলাম তোমাকে কিছু খবরও দিয়ে যাই।

কি খবর? ডক হ্যাডলে আর মিস শেলী শীঘ্রি বিয়ে করতে যাচ্ছে।

পুরানো খবর। আমি আগেই শুনেছি, বলল রনি।

আরও কিছু ঘটনা ঘটেছে থ্রী এইচে। বলডি আর সিলভারের মধ্যে কিছু গরম কথা কাটাকাটি চলছিল, এই সময়ে ওই কয়েটি ট্রয়, বলডিকে পিছন থেকে গুলি করে বসেছে। ডক হ্যাডলের ধারণা বলডি হয়তো বেঁচেও যেতে পারে–কিন্তু এর কোন নিশ্চয়তা নেই।

ওই আউটফিটটা নিজেদের মধ্যেই মারপিট করে–অন্যের সাথে মিলেমিশে চলবে কিভাবে? মন্তব্য করল রনি। এসো, ক্যাম্পে চলো-কফি তৈরি।

কফিতে চুমুক দিয়ে লারামির কবর খুঁজে পাওয়ার কথা জানাল রনি। আরও বলল, তার বিশ্বাস জেরি সমার্স বেঁচে আছে।

সেটা আমরা শুনেছি। ফিনলে হার্ট ওর ঘোড়ার ছাপ দেখতে পেয়েছে। সাথে আরও একজন আছে–সম্ভবত বেইলি। ওদের কিছুদূর অনুসরণ করার পর হার্ট ট্র্যাক হারিয়ে ফেলেছে।

ওরা কোন দিকে যেতে পারে বলে মনে করছ? হ্যারি জানতে চাইল।

বলা যায় না। হয়তো স্টার সিটির সেই মাইনে।

এখন কি করবে? প্রশ্ন করল শর্টি। তুমি কি জেরির পিছু নেবে?

সম্ভবত। একটা সিগারেট রোল করল রনি। তবে হতে পারে ওর যথেষ্ট হয়েছে। লোকটা দেশ ছেড়ে চলেও যেতে পারে। চলে গেলে ওকে আর ধাওয়া করব না। আর থ্রী এইচের বেলায়, আশা করি ওরা আর ঝামেলা করবে না। এড়াতে পারলে বেন হাঙ্গামা চায় না। আমারও একই মত।

শর্টিকে একটু মনমরা দেখাচ্ছে। ইশ! একটা ভাল ফাইটের চান্স মিস হয়ে গেল!

স্টার সিটিতে খুব উন্নত মানের আকর পাওয়া গিয়েছিল। ওটা দু’বছর টিকেছিল, তারপর ফুরিয়ে গেল। মাইনাররা করার কিছু না পেয়ে কেউ কেউ ইউনিয়নভিলে, আর অন্য লোকজন বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ল। ছাপড়াগুলো রয়েই গেল।

ফেকাসে মুখে, আধমরা অবস্থায় জেরিকে নিয়ে স্টার সিটিতে পৌঁছল বেইলি। সবথেকে ভাল অবস্থায় যেটা আছে, সেই ছাপরাতেই আশ্রয় নিল ওরা। গুলির জখমের সেবায় বেইলির বিস্তর অভিজ্ঞতা আছে। কানের পাশে মাথার চামড়া হাড় পর্যন্ত চিরে গেছে। খুলিতেও একটা প্রচণ্ড আঘাত লেগেছে। কিন্তু পাথর পড়ে দেহের জখমগুলোই বেশি মারাত্মক হয়েছে, কারণ পুরো দেহ টেবিলের তলায় ঢুকাতে পারেনি সে। যখন আহত জেরিকে মোটামুটি নিরাপদে ছেড়ে যাওয়া সম্ভব, তখন ডাকির সাথে যোগাযোগ করে ওকে স্টার সিটিতে নিয়ে এল।

পুরো সাতদিন যমের সাগ্নে লড়ল জেরি। বেইলি আর ডক বেনটন ওকে সাহায্য করল। ইউনিয়নভিল শহর থেকে ডাক্তারকে চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে এসেছে ডাকি স্মিথ। প্রাক্তন আর্মি স্যারন বেনটন এখন মদে ডুবে থাকলেও ডাক্তারি ভুলে যায়নি। শেষ পর্যন্ত ওকে যখন ইউনিয়নভিলের সেলুনে ফিরিয়ে দিয়ে আসা হলো, জেরি তখন দ্রুত সেরে উঠছে। সুস্থ হচ্ছে বটে, কিন্তু যত সারছে ততই মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠছে ওর। শেষে এটা আরও বাড়ল।

মেঝের ওপর পায়চারি করে বেড়াচ্ছে জেরি। সরু, ফেকাসে মুখ। চাপা একটা রাগে ফুসছে। বেইলি উদ্বিগ্ন চোখে ওকে লক্ষ করছে-ধীর প্রকৃতির ডাকিও আশঙ্কিত। ড্যাশারের কাছে হেরে যাওয়াই কি এর কারণ? নাকি এটা মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পাওয়ার ফল–বোঝা যাচ্ছে না। তবে এটা ঠিক যে এখন ওর আসল রূপ বেরিয়ে এসেছে। সহজ হাসির আচ্ছাদনটা অদৃশ্য হয়েছে, কেবল রয়েছে একটা খুনী-ভাল কিছুই আর ওর মধ্যে অবশিষ্ট নেই।

আমার মতে, প্রস্তাব দিল ডাক বেইলি, আমাদের আপাতত এখান থেকে সরে যাওয়াই ভাল। ড্যাশার যতদিন আছে, এখানে কারও কিছু করার উপায় নেই। পরে অ্যাডামকে আমরা দেখে নেব।

যাওয়ার কথা ভুলে যাও! ঝট করে বেইলির দিকে ফিরল জেরি। ওর চেহারাটা ভীষণ হয়ে উঠেছে। ড্যাশার আর অ্যাডাম না মরা পর্যন্ত আমরা এদেশ ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না! ওই সোনাও আমি চাই, কিন্তু তারচেয়ে বেশি চাই রনিকে!

বস, আপত্তি তুলল ডাক, পুরো দেশটাই এখন আমাদের বিরুদ্ধে। এখানে থাকলে আমাদের জীবন্ত ফেরার কোন আশা নেই। বাড়িয়ে বলছি না। এখন আমরা সরে পড়তে পারব। ওরা জানে না তুমি বেঁচে আছ, কি মরেছ। কিন্তু বিশ্বাস করো, ওরা সন্দিগ্ধ হয়ে উঠতে শুরু করেছে।

ড্যাশার, বলে চলল সে, এলাকাটা চষে বেড়াচ্ছে তোমার খোঁজে। ফিনলে হার্টও তাই করছে। রিজের মাথায় বসে দূরবীন দিয়ে আমি দেখেছি তোমার ট্রেইল ধরেই সে এগোচ্ছিল, পরে হারিয়ে ফেলল। কিন্তু বারবার মুখ তুলে সে এই পাহাড়গুলোর দিকে তাকাচ্ছিল। মনে হলো এদিকটা ভাল করে খুঁজে দেখার ইচ্ছা ওর আছে। আমি তোমাকে বলছি জেরি, হার্ট ক্ষান্ত হওয়ার পাত্র নয়।

বিদ্বেষে জ্বলছে জেরির চোখ। কি ব্যাপার ডাক, ভয় পাচ্ছ? তোমার কাছ থেকে এটা আমি আশা করিনি!

দরজার দিকে এগিয়ে গেল সমার্স। ওখানে হঠাৎ ঘুরে নিচু স্বরে সে বলল, কেউ আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না। বুঝেছ? কেউ না!

বেরিয়ে গেল জেরি। ওর পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে। ফেকাসে মুখে ডাকি স্মিথের দিকে তাকাল ডাক। অনেক বদলে গেছে ও, মন্তব্য করল সে।

নীরস মুখে মাথা ঝাকলি ডাকি। এখানে থাকার কোন মানে হয় না, ডাক! কোন মানেই নেই! ওই হার্ট লোকটা ব্লাডহাউণ্ডের মত–একবার ট্রেইল ধরলে সহজে ছাড়বে না। লারামিকে মেরেছে সে। আর ড্যাশারের মোকাবিলা করার চেয়ে বাঘের আস্তানায় ঢুকে চান্স নেয়া অনেক ভাল। ভূমিকম্পটা না হলে জেরিকে আজ আর বেঁচে থাকতে হত না।

আমরা তাহলে কি করব? প্রশ্ন করল ডাক।

জবাব না দিয়ে স্মিথ বিড়ালের মত নিঃশব্দ পায়ে জানালার কাছে সরে গিয়ে বাইরে উঁকি দিল। তারপর বসল। কি করব? উঁচু গলায় বলল সে। আমি বসের সাথেই থাকব। আর কি করব? এখন, ড্যাশারকে কি করে শেষ করা যায় সেটাই ভাবতে হবে!

ডাক চট করে স্মিথের দিকে তাকাল, তারপর জানালার দিকে একবার চেয়ে নড় করল। হ্যাঁ, বলল সে, ওকে মারাই হবে আমাদের প্রথম কাজ। পরে অ্যাডামকে শেষ করে সোনা ছিনিয়ে নিতে হবে।

হঠাৎ কামরায় ঢুকল জেরি। চাপা রাগের সাথে প্রথমে বেইলি, পরে ডাকির দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকাল সে। জেরি যে দূরে সরে গিয়ে আবার নিঃশব্দে ওদের কথাবার্তা শোনার জন্যে ফিরে এসেছিল, এটা ওরা দুজনেই বুঝতে পারছে। পায়চারির সাথে বিড়বিড় করছে সমার্স।

থেমে স্থির দৃষ্টিতে বেইলি আর ডাকির দিকে তাকাল সে। চোখে অনিষ্টকর আর অশুভ ইঙ্গিত। কিন্তু তার পিছনে আরও কিছু রয়েছে-বেইলি ওটা প্রথমবারের মত দেখল, এবং চিনে শিউরে উঠল। জেরি সমার্স বদ্ধ-পাগল।

<

Super User