পরদিন সকালে চারজন ঘোড়সওয়ারকে আসতে দেখা গেল সানশাইন শহরের দিকে। একজন লোক আর্মি অফিসারের মত নেতৃত্ব দিচ্ছে দলটির। ওর কাপড় চোপড়ের মানও অন্যান্যদের চেয়ে উন্নত। পরনে লম্বা কোট। মাথায় বিবরের চামড়ার হ্যাট। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুটো জরিপ করছে সবকিছু। তার নিষ্ঠুরতা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে মুখে।
বার্নার্ডই প্রথম দেখতে পেল দলটাকে। স্যালুনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট কুঁকছিল সে। বাঁ দিকে চোখ পড়তেই সোজা হল। দলটা কয়েক শ গজ দূরে থাকতেই ও ঘুরে ঢুকে গেল স্যালুনে। দ্রুত। অন্যরা নাস্তা সারতে ব্যস্ত তখন। ওদের টেবিলের কাছে গিয়ে চেঁচিয়ে বলল সে, হিগিন্স, মিস্টার হিগিন্স আসছেন। অন্যরাও আছে সঙ্গে।
মৃদু হেসে বলল উইলসন, এত উত্তেজিত হচ্ছ কেন? চুপ করে বস।
বার্নার্ড একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, আমাদের বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করা উচিত না?
হাসল উইলসন, কোনও দরকার নেই। মাংসের টুকরো চিবোতে চিবোতে বলল রজার, কত দূরে ওরা?
কাছেই, বলল বার্নার্ড, এই এল বলে।
প্লেটে কাঁটা চামচ নামিয়ে রাখল রজার। আমরা কদ্দিন ধরে বসে আছি? উইলসনকে প্রশ্ন করল সে।
চুলে আঙুল চালিয়ে বলল উইলসন, মাসখানেক তো হবেই।
অথচ মনে হচ্ছে বছর পেরিয়ে গেছে, বলল রজার।
উইলসন সায় দিয়ে বলল, ঠিকই বলেছ।
তবে শিকারী শালাকে প্রত্যেকদিন ধোলাই দিতে পারলে বোধহয় এতটা একঘেয়ে লাগত না, ঠোঁট চেটে বলল রজার।
এখন আর একঘেয়ে লাগবে না। আমাদের কাজ বোধহয় দু’একদিনের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে, বার্নার্ড বলল।
ঘোড়সওয়াররা এসে থামল স্যালুনের সামনে। লোক তিনটি নেমে পড়ল ঘোড়া থেকে। রুক্ষ, মারকুটে চেহারা। এবার স্যাডল থেকে নেমে লাগামটা ফেলে দিল হিগিন্স। কেউ না কেউ ঘোড়াটার দায়িত্ব নেবে, ভাবটা এমন। সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠে এল সে। কাপড় থেকে তুষার ঝাড়ার প্রয়োজন বোধ করল না। দুজা খুলে ঘরে পা রাখল। ওকে দেখে টেবিলে বসা লোকগুলো উঠে দাঁড়াল। বিড়বিড় করতে লাগল রজার। বিরক্ত।
গা থেকে কোটটা খুলে ফেলল হিগিন্স। ছুঁড়ে ফেলল কাছের একটা চেয়ারে। ভালই আছ দেখছি, সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল সে। চুরুট ধরাল। তারপর গ্রিফিথের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদেরকে ড্রিংক দাও।
ইয়েস, স্যার।
আমার প্রাইভেট স্টক থেকে দিয়ো।
ইয়েস, স্যার।
অন্য লোক তিনটি ঘরে ঢুকল এসময়। হ্যাণ্ডশেক করল ওদের পাঁচজনের সাথে। বোতল এসে গেল।
আমি অনেকদূর থেকে এসেছি। এখন আর কোন কাজের কথা নয়। এস, সাফল্য কামনা করে টোস্ট করি আমরা, গেলাসটা তুলে বলল হিগিন্স।
ক্যাথি তখন টেকনের জন্যে নাস্তার ব্যবস্থা করছে। এসময় ছুটে এল মেরী। হাঁপাতে হাঁপাতে ঝলল, ক্যাথি, হিগিন্স এসেছে।
এখানে?
না, বলল মেরী। দলবল নিয়ে স্যালুনে ঢুকেছে।
ঠিক আছে, যাও তুমি, শান্ত কণ্ঠে কথাগুলো বললেও ভেতরে ভেতরে উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠল ক্যাথি।
টেকনের ঘরে গিয়ে বিছানার পাশে বসল সে। ওকে দেখে উঠে বসল টেকন। দেখেই বোঝা গেল অনেকখানি সুস্থ হয়ে উঠেছে এখন।
তোমাকে অমন দেখাচ্ছে কেন? ক্যাথিকে প্রশ্ন করল টেকন।
একটা খারাপ খবর আছে। হিগিন্স এসে পড়েছে। তোমাকে চলে যেতে হবে, মুখ কালো করে বলল ক্যাথি।
ঠিক আছে, যাব, বিছানা থেকে নামতে লাগল টেকন।
এখন নয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা কর।
কেন?
কেন? তখন পালাতে সুবিধে। তবে মনে করো না তোমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছি আমি। তোমার ভালর জন্যেই বলছি। হিগিন্স না ফিরলে আরও দিন দুয়েক থাকতে পারতে। এখন আর সেটা সম্ভব নয়।
তোমার এখান থেকে আজই চলে যাব আমি। কিন্তু এশহর ছেড়ে যাচ্ছি না, টেকন বলল।
‘কেন?’
কাজ আছে।
কিসের কাজ? কোনও কাজ নেই। এখান থেকে পালানোই তোমার কাজ। মখের পেশীগুলো শক্ত হল ক্যাথির।
রজারের কথা ভুলে গেছ?
ওহ্ হো! রজার, হতাশ ভঙ্গিতে ওর দিকে চাইল ক্যাথি। কিন্তু নয়জনের বিরুদ্ধে একা কিছুই করতে পারবে না তুমি। রজারের কথা ভুলে যাও।
না।
বোকামি করো না।
উপায় নেই।
খানিকক্ষণ একে অপরকে দেখল ওরা নিঃশব্দে। কি করতে চাও তুমি? নীরবতা ভাঙল ক্যাথি।
‘বার্নে বা অন্য কোথাও গিয়ে লুকিয়ে থাকব আমি। রজারকে বাগে পাওয়ার জন্যে।’
আসলে মরার সাধ হয়েছে তোমার।
‘আমার মনে হয় মরার নয়, মারার।’
উঠে পড়ল ক্যাথি। পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে যাব আমি আজ সন্ধ্যায়, বলল টেকন।
দরকার নেই। কালকের দিনটা থেকে চলে যেয়ো, ক্যাথি বলল। আপত্তি করল না টেকন।
বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে দরজায় দাঁড়াল ক্যাথি। তারপর ওর দিকে ফিরে বলল, খুন যদি করতেই হয় কাউকে, তবে হিগিন্সকে নয় কেন?
‘ওর সঙ্গে আমার শক্রতা নেই,’ গম্ভীরমুখে বলল টেকন।
মৃদু হাসল ক্যাথি। আমি মেরীকে দিয়ে খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। বেরিয়ে গেল সে।
ক্যাথি চলে গেলে বিছানা থেকে নামল টেকন। হাত-পা ছড়িয়ে, ঝুঁকে অল্পক্ষণ হালকা ব্যায়াম করে নিল। প্রথমে কষ্ট হল বটে তবে দাঁত চেপে সহ্য করল সে। আবার বশে আনতে হবে শরীরটাকে। হাত দুটো তুলে মুঠো পাকাল। খুলল। অনেকটা সুস্থ বোধ করছে এখন। পরে নিল বুটজোড়া।
বিছানার কিনারে এসে বসল সে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে তুলে নিল বিশাল। রাইফেলটা। প্রায় ছ’ফুট লম্বা অস্ত্রটা। শটগানের মত পেছন দিকটা ভেঙে গুলি ভরতে হয়। ওটা বিছানায় রেখে ঘরের কোণ থেকে চামড়ার তৈরি বেশ বড়সড় একটা থলি নিয়ে এল। ওটা থেকে বার করল প্রমাণ সাইজের একটা গুলি। গুলিটা ভরে রাইফেলটা নামিয়ে রাখল বিছানায়। থলিটা থেকে বার করল কার্তুজ তৈরির বিভিন্ন মাল-মশলা। পিতলের খোসা, বুলেটের চোখা মাথা, গান পাউডার। গুলি বানাতে বসল সে। একটা করে কার্তুজ বানাচ্ছে আর যত্ন করে সাজিয়ে রাখছে বিছানায়।
স্যালুনে হুইস্কির বোতল খালি হয়ে এসেছে প্রায়। গেলাসে লম্বা এক চুমুক দিল হিগিন্স। পরিতৃপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বারের দিকে তাকিয়ে বলল, গ্রিফিথ, ছেলেটাকে নিয়ে তুমি একটু বাইরে যাও। কিছু লাগলে আমরা নিয়ে নেব।
ইয়েস, স্যার। অ্যাপ্রন খুলে কোট পড়ে নিল গ্রিফিথ। তারপর পিকোকে ডেকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। ওরা বেরিয়ে গেলে বার্নার্ডকে দরজায় পাঠাল হিগিন্স। আড়ি পাতেনি কেউ নিশ্চিত হওয়ার জন্যে। চলে গেছে, টেবিলে ফিরে এসে বলল বার্নার্ড।
পকেট থেকে একটা ম্যাপ বার করল হিগিন্স। খুলে ছড়িয়ে দিল টেবিলে। রেল লাইন দুটো আর মাইল ত্রিশেক দূরে রয়েছে। প্রতিদিন চার মাইল করে দূরত্ব কমে আসছে। আশা করা যায় সপ্তাখানেকের মধ্যেই মিলে যাবে
ম্যাপের বিশেষ একটা জায়গা দেখাল সে। এখানে।
উইলসন দেখে বলল, প্রোমন্টরি পয়েন্ট, ইউট। শহর নাকি?
না, ওটা রেলরোড কোম্পানির দেয়া নাম। যাই হোক, উদ্বোধনী অনুষ্ঠান কবে হবে এখনও ঠিক হয়নি।
বার্নার্ড জিজ্ঞেস করল, সোনার পেরেক দিয়ে নাকি জোড়া দেয়া হবে লাইন দুটো?
হ্যাঁ, বলল হিগিন্স। আমি যেটা বলছিলাম, উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নির্ভর করছে ওয়াশিংটন আর রেলকর্তাদের ওপর। কিন্তু সেজন্যে তো আর বসে থাকা যায় না। দিন কয়েকের মধ্যেই চলে যাব আমরা এখান থেকে। প্রোমন্টরি পয়েন্টের কাছাকাছি ক্যাম্প করব কোথাও।
ইতস্তত করে বলল উইলসন, পালানোর কোন ব্যবস্থা করা হয়েছে, মিস্টার হিগিন্স? আগে থেকে জানা থাকলে ভাল হয়।
মাথা নাড়ল হিগিন্স। ভাল পয়েন্ট। চুরুট ধরাল।
দক্ষিণে প্রতি দশ মাইল অন্তর ঘোড়া বদলানোর সুযোগ থাকবে। প্রত্যেকের জন্যে রেডি থাকবে চারটে করে ঘোড়া। ওরা অনুসরণ করলেও ধরতে যাতে না পারে সেজন্যে। সবার দিকে চেয়ে ধোয়া ছাড়ল সে। পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ করলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা নেই। অত লোকের ভিড়ে কেউ বুঝতে পারবে না। কোত্থেকে গুলি এসেছে। ধাঁধায় পড়ে যাবে গার্ড আর, সৈন্যরা। কোন খুঁত রাখা হয়নি পরিকল্পনায়।
লোকটা গুরুত্বপূর্ণ। মৌমাছির চাকে ঢিল পড়ার অবস্থা হবে, বলল উইলসন।
তা ঠিক। তবে চিন্তার কিছু নেই, দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হবে তোমাদের। আরও চিন্তা-ভাবনা আছে আমার। সময়মত জানতে পারবে, হিগিন্স বলল।
থ্যাঙ্ক ইউ, উইলসন বলল।
এবার কাজের কথায় আসি, বলল হিগিন্স। আরেকটা মোড়ানো কাগজ মেলে ধরল সে টেবিলের ওপর। গেলাস এবং বোতল দিয়ে চাপা দিল কোনাগুলো। এটা খসড়া যদিও, তবে এর মধ্যেই ডিটেইলস আছে। এখানে আঙুল দিয়ে দুটো লাইন দেখাল সে। পুব-পশ্চিম দুটো রেল পথই দেখানো হয়েছে। আর এখানে
একটা ক্রস চিহ্ন দেখিয়ে বলল, মিলবে ও দুটো। পুরো এলাকাটাই রুক্ষ, পাথুরে। এখানটাতে- তর্জনী রাখল সে বিশেষ একটি জায়গায়, একটা টিলা আছে। টার্গেটে আঘাত করার জন্যে চমৎকার জায়গা। সবকিছু পরিষ্কার দেখা যায়। এই টিলার ওপর থেকেই গুলি করবে রজার।
ওদের দিকে চেয়ে মৃদু হাসল হিগিন্স। হাসিটা সংক্রমিত হল অন্যদের মাঝেও। রজারের দিকে চাইল ওরা। গর্বে বুক ফুলে উঠল রজারের।
আবার শুরু করল হিন্সি, তিনশো বায়ান্ন গজের দূরত্ব। বারবার মাপা হয়েছে। মিস করার প্রশ্নই ওঠে না, কি বল, রজার?
মাথাটা পেছনে হেলিয়ে বলল রজার, আমার ৪০৫ রাইফেল দিয়ে চারশ গজ দূরের যে কাউকে হিট করতে পারব আমি। শরীরের যে-কোনও জায়গায়।
ওর পিঠ চাপড়ে দিল উইলসন।
মাথা ঝাঁকাল হিগিন্স। সন্তুষ্ট। ম্যাপটাতে হাত বুলিয়ে বলল, অনেক সময় নিখুঁত প্ল্যানও ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। সেজন্যে উইলসন আর চ্যান্সি টিলায় থাকবে, রজারের সাথে। রজারের কিছু হয়ে গেলে রাইফেল তুলে নিয়ে গুলি করবে উইলসন। ওরা গুলি চালালে চ্যান্সি উইলসনকে প্রটেকশন দেবে। তবে এত কিছুর দরকার আসলে পড়বে না। যা জেনেছি, সিকিউরিটি নিয়ে তেমন মাথা ঘামাচ্ছে না ওরা।
সবার দিকে চাইল সে, ধীরে ধীরে বলল, রজার যদি মিস করে…’
বাধা দিল রজার। কর্কশ গলায় বলে উঠল, রজার মিস করবে না। খামোকা সময় নষ্ট করছেন আপনি।
ভাল, মন্তব্য করল হিগিন্স। তবু সাবধানের মার তো নেই। ঘোড়াগুলোর দেখাশোনা করবে বার্নার্ড। স্যাণ্ডার্স আর টাইগার ছদ্মবেশে রেলকর্মীদের সঙ্গে মিশে যাবে। সোনার পেরেক ঠোকার সময় কাছেপিঠেই থাকবে তোমরা। রজারের গুলিতে টার্গেট যদি গুরুতর আহত না হয় তবে গুলি চালাতে থাকবে টাইগার। পিস্তল দিয়ে স্যাণ্ডার্স প্রটেকশন দেবে তোমাকে। আর তোমাদের জন্যে ঘোড়া নিয়ে তৈরি থাকবে বার্নার্ড। কার্টার আর এলভিস ফেডারেল টুপারের পোশাকে থাকবে। তোমাদের কাজও টাইগার আর স্যাণ্ডার্সের মত। তবে বাড়তি সুবিধে পাবে তোমরা। গভর্নমেন্টের ইস্যু করা কারবাইন ব্যবহার করতে পারবে। বুঝেছ সবাই?
টাইগার গলা খাকারি দিয়ে বলল, বুঝেছি। কিন্তু ভিড়ের মধ্য থেকে গুলি করে পালাবে কিভাবে?
একটা কথা বুঝছ না কেন, আমাদের মত প্ল্যান-পরিকল্পনা করেনি ওরা। প্রথম গুলিটা হলেই ওরা হতভম্ব হয়ে যাবে। উল্টো-পাল্টা গুলি ছুঁড়তে থাকবে। ফলে কাজ সেরে পালাতে অসুবিধে হবে না। আর ঘোড়া তো তৈরি থাকবেই। ওদের নাগালের বাইরে চলে যেতে সময় লাগবে না।
সেরকম হলেই ভাল, উইলসন বলল।
এ ব্যাপারে বাকি আলোচনা ক্যাম্পে সেরে নেব, বলল হিগিন্স। মুড়িয়ে রাখল ম্যাপ, খসড়া।
বড় করে শ্বাস টেনে বলল, এবার এদিককার খবর বল। কোনও ঝামেলা হয়নি তো?
তেমন কিছু না। একটা লোক এসেছিল কেবল। ও…বার্নার্ড কথা শেষ করার আগেই গর্জে উঠল রজার। চুপ করে গেল বার্নার্ড।
কে? কে এসেছিল? প্রশ্ন করল হিগিন্স।
এই এক ভবঘুরে শিকারী। চলে গেছে, দ্রুত সামাল দেয়ার চেষ্টা করল উইলসন।
কিছু বুঝতে পারেনি তো? তীক্ষ্ণ চোখে ওর দিকে চাইল হিগিন্স।
না, না। কোন প্রশ্নই ওঠে না, মৃদু হেসে রজারকে একবার দেখে নিল উইলসন।
গুড। বাইরে কাউকে বুঝতে দেয়া চলবে না। চেয়ারে নিচু হয়ে বসল সে। ছড়িয়ে দিল পা। মৃদু গলায় প্রশ্ন করল, পুবের পরিবারটা কেমন আছে? পালানোর চেষ্টা টেষ্টা করেনি তো?
সামান্য হেসে বলল উইলসন, না। ঘোড়া পাবে কোথায়? আর এই শীতে যাবেই বা কি করে?
তা ঠিক। বার্নার্ড, আরেকটা বোতল নিয়ে এস গে, খুশি হয়ে বলল হিগিন্স।
শেষ বিকেল। বিছানায় বসে কার্তুজ বানিয়েই চলেছে টেকন। শ’খানেক হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। প্লেটে খাবার নিয়ে এসময় ঘরে ঢুকল ক্যাথি। গরুর মাংস নিয়ে এসেছে। বিছানায় প্লেটটা নামিয়ে রাখল সে।
রজারের জন্যে এতসব আয়োজন? প্রশ্ন করল ও।
না, কাজ করতে করতেই জবাব দিল টেকন। তাহলে এত গুলি তৈরি করছ কেন?
সময় কাটাচ্ছি। কোনও কাজ তো নেই।
জানালায় গিয়ে দাঁড়াল ক্যাথি। বাইরের দিকে চেয়ে বলল, ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই আঁধার হয়ে যাবে।
টেকন জবাব দিল না। কার্তুজ বানিয়েই চলেছে। ওর কাছে এসে বলল ক্যাথি, মেরীকে বলেছি একটা ব্যাগে খাবার দিয়ে দেবে।
কেন?
কারণ আঁধার হলেই এশহর ছেড়ে চলে যাচ্ছ তুমি। তোমার ঘোড়াসহ।
সেটা সম্ভব নয়, ক্যাথি, শান্তকণ্ঠে, বলল টেকন।
কেন নয়? হিসিয়ে উঠল ক্যাথি। ওদের সঙ্গে পারবে না তুমি। আমি বলছি, তুমি চলে যাবে।
ওরা কারা? ঘটছেটা কি এখানে? আমাকে বলতে চাও না কেন তুমি? নরম গলায় প্রশ্নগুলো করল টেকন।
আগেই বলেছি আমি জানি না কিছু। শুধু এটুকু জানি রজার ওদের কাছে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় লোক। ওর কিছু হলে বাঁচবে না তুমি।
আমার কিছু করার নেই, ক্যাথি।
আছে। পালাও! ধরা পড়লে চোখের পলক পড়ার আগেই খুন হয়ে যাবে।
আমার প্রশ্নগুলোর জবাব কিন্তু পাইনি এখনও।
জবাব একটাই। ধরা পড়লে কেউ বাঁচাতে পারবে না তোমাকে। ওরা নয়জন, তুমি একা।
আচ্ছা, হিগিন্স কে? এখানে কি করছে?
আবার একই প্রশ্ন? লোকের কাজ করে দেয় হিগিন্স। প্রচুর টাকার বিনিময়ে। পুরো শহরটাই কিছুদিনের জন্যে কিনে নিয়েছে সে। ভাড়া করেছে সেরা বন্দুকবাজদের। কাজেই বুঝতেই পারছ কি বিশাল কাজের দায়িত্ব নিয়েছে। হিগিন্স।
কাল চলে যাব আমি।
বিছানায় বসল ক্যাথি। টেকনের পাশে। দুহাতে তুলে ধরল ওর মুখ। দেখ, তোমাকে চিনি না আমি। কিন্তু কেন যেন দুর্বল হয়ে পড়েছি তোমার প্রতি। আমি কিছুতেই চাই না ওদের হাতে প্রাণ দাও তুমি। ওর কপালে চুমু খেল ক্যাথি।
কাল চলে যাব আমি, আবার বলল টেকন।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল ক্যাথি। মেরী আজ এঘরে শোবে। তুমি খাবারের ব্যাগ নিয়ে চলে যাও।
ক্যাথি চলে গেলে পর খাবারের প্লেট নিয়ে বসল টেকন। খেতে শুরু করল। বিছানার পাশে রাখা হুইস্কির বোতলটার ছিপি খুলল। লম্বা এক টান দিয়ে চেয়ে রইল দেয়ালের দিকে। ভাবছে। যুক্তি দিয়ে বুঝছে ওর চলে যাওয়া উচিৎ এ শহর ছেড়ে। কিন্তু রজারের একটা হিল্লে না করে যাবে না সে। আর অন্য লোকগুলো। কি করছে এখানে। সেটাও জানা দরকার। যদিও এসব নিয়ে তার মাথা না ঘামালেও চলে, তবু। কিন্তু রজারের ব্যাপারটা কিছুতেই ভুলতে পারছে না সে। তবে ওকে বাগে পেতে হলে ভাগ্যের সহায়তা লাগবে। আর সুযোগও পাওয়া চাই। এক রকম শিকার আর কি। এতে অভ্যস্ত সে।
রাত হয়ে গেছে অনেক। চুপ করে চেয়ারে বসে রয়েছে টেকন। বিছানায় অঘোরে ঘুমোচ্ছে মেরী। এঘরে ঘুমোতে প্রবল অস্বস্তি বোধ করছিল সে। পরে ক্যাথির ধমকে বাধ্য হয়েছে। টেকনও অবশ্য অভয় দিয়েছে।
টেকনের সব জিনিসপত্র বেঁধে-হেঁদে দিয়ে গেছে ক্যাথি।
রিভলভারটা কোলে নিয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই এখন টেকনের। রজারকে কিভাবে মুঠোয় পেতে পারে সে ব্যাপারে ভেবেছে অনেক। উপায় মেলেনি।
বাইরের দেয়ালে হঠাৎ থপ করে হালকা একটা শব্দ হল। চমকে উঠল টেকন। পিস্তলটা হাতে নিয়ে দেয়াল ঘেঁসে দাঁড়াল সে। জানালার কাঁচে দুবার টোকা পড়ল। খানিকবাদে আবার, পাল্লা দুটো খুলে গেল জানালার। ধীরে ধীরে খোলা জানালা দিয়ে এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস এসে কাঁপিয়ে দিল টেকনকে। নড়ে উঠল মেরীও। কুঁকড়ে গেল খানিকটা। আগন্তুক তার মাথাটা ঢোকাল ঘরে। তারপর জানালা গলে নামিয়ে দিল পুরো শরীরটাই। পিকো। পিস্তলটা হোলস্টারে রেখেই ওর কাছে পৌঁছে গেল টেকন। কাধ ধরে এক টানে নিয়ে এল ঘরের মাঝখানে। মুখে হাতচাপা দিয়ে শুইয়ে ফেলল মেঝেতে। টু শব্দটি করতে পারল পিকো।
প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে ছোঁকরা। মুখ নামিয়ে জোরাল ফিসফিসে গলায় জিজ্ঞেস করল টেকন, এখানে কি করছ? ও তোমার প্রেমিকা? ঘুমন্ত মেরীর দিকে মাথা ঝাঁকাল সে।
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল পিকো। ভয় কাটেনি।
আমি এখানে আছি জানতে? মাথা নাড়ল সে।
হাত সরিয়ে নিচ্ছি। চিৎকার করবে না।
আবার মাথা কঁকাল পিকো। রাজি। ওর মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিল টেকন। খুব ভয় পেয়েছিলাম… স্বাভাবিক গলায় বলে উঠল পিকো।
কথাটা শেষ করতে পারল না সে। টেকনের হাত আবার চাপা দিল মুখ। আস্তে, ফিসফিস করে বলল সে।
এখানে বসে আছ তুমি! আমি তো ভেবেছিলাম মরেই গেছ, ফিসফিসিয়ে বলল পিকো।
কম কথা বল, ধারালো গলায় বলল টেকন। চেয়ারে ফিরে গেল সে। উঠে। দাঁড়াল পিকো। ওর দিকে চেয়ে টেকন বলল, তুমি তো সমস্যায় ফেলে দিলে। তোমাকে নিয়ে এখন কি করি?
হুইস্কি খাওয়াও, আঁধারে ঝিকিয়ে উঠল ওর দাঁত। হাসছে।
হুইস্কির বোতলটা তুলে নিল টেকন। ছিপি খুলে এগিয়ে দিল পিকোর দিকে। প্রায় ছুটে এসে বোতলটা ছিনিয়ে নিল সে। ঢকঢক করে গিলে ফেলল বেশ খানিকটা।
টেকন ওর হাত থেকে কেড়ে নিল বোতলটা। চুপ করে বসে থাক, একটা চেয়ার দেখিয়ে বলল সে। ভেবে দেখি তোমার কি ব্যবস্থা করা যায়।
টেকন আর পিকো বসে রইল সারা রাত। মাঝে সাঝে হুইস্কি টানল দুজনে। কথা হল খুব কম। নানা রকম পরিকল্পনা করল টেকন। বাতিল করে দিল সবগুলোই। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করতেই পিকোকে বলল টেকন, তোমাকে ছোট্ট একটা কাজ করতে হবে, পিকো।
কি কাজ, সিনর?
রজারকে কেমন লাগে তোমার?
রজার! ভয়ের ছায়া ঘনাল পিকোর মুখে। না না, আমি রজারের কোনও ব্যাপারে নেই।
আরে, অত ভয় পাচ্ছ কেন? একটা খবর শুধু পৌঁছে দেবে ওকে, সাহস দেয়ার চেষ্টা করল টেকন।
কি খবর? ভয়ে ভয়ে জানতে চাইল পিকো।
পরে বলব, টেকন বলল। হঠাৎই উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বাইরে চল। কোনও শব্দ যাতে না হয়। খুব সাবধান। রাইফেলটা তুলে নিল সে। অন্য জিনিসগুলো দেখিয়ে পিকোকে বলল, নিয়ে চল।
দরজা খুলে বেরিয়ে এল ওরা। সন্তর্পণে। পা টিপে টিপে নেমে গেল নিচে। অন্ধকার লিভিং রূমটায় এল দুজনে। তারপর সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল বাইরে। দুজনে এল বাড়ির পেছন দিককার বার্নটাতে। পায়ের নিচে চূর্ণ হচ্ছে। জমে থাকা শক্ত তুষার। প্রায় নিঃশব্দে। আঁধার কাটতে আরও ঘণ্টা আধেক লাগবে। পিকো অনুসরণ করছে টেকনকে। ভীত, সন্ত্রস্ত।
বার্নে পৌঁছল দুজনে। আঁধারে চোখ সইয়ে নেয়ার জন্যে এক মুহূর্ত দাড়াল। ওরা। বেশ কয়েকটা স্টল রয়েছে ওখানে। গোটা দুয়েক খুঁজতেই নিজের ঘোড়াটা পেয়ে গেল, টেকন। ওকে চিনতে পেরে চারদিকে তাকাল ঘোড়াটা। তারপর মৃদু ডাক ছাড়ল। ঘোড়াটার পাশে গিয়ে ওর গলাটা ঘষে আদর করল টেকন। নরম গলায় পিকোকে, বলল, আমার স্যাডলটা খুঁজে বার কর।
ঘোড়াটা এখানে এল কিভাবে? প্রশ্ন করল পিকো।
স্যাডলটা কোথায়? কর্কশ গলায় পাল্টা জিজ্ঞেস করল টেকন।
আঁধারের মধ্যেই ঘোড়ায় স্যাডল এবং লাগাম পরানো হল। পিকো জিসিনপত্রগুলো বেঁধে দিয়ে রাইফেলটা রাখল বুটে।
চলে যাচ্ছ এখনই? পিকো জিজ্ঞেস করল।
না, টেকন বলল। এখন যাচ্ছি না। এদিকে এস, হুইস্কির বোতল হাতে পিকোকে নিয়ে দরজার কাছে গেল সে। দরজাটা সামান্য ফাঁক করে একটা বস্তার ওপর বসে পড়ল। উল্টো দিকে বসতে ইশারা করল পিকোকে।
পিকোর দিকে তাকিয়ে বলল টেকন, ভোর হয়ে গেলে রজারকে গিয়ে ডেকে তুলবে তুমি। খবরটা পৌঁছে দেবে।
সবেগে মাথা নাড়ল পিকো। ভীত কণ্ঠে বলল, তা পারব না, সিনর। ঘুম থেকে জাগালে রজার আমাকে মেরে ফেলবে।
চিন্তা কোরো না, টেকন বুঝিয়ে বলল তাকে। মিস্টার হিগিন্স এর মেসেজ পৌঁছে দেবে তুমি। ও চটবে না।
ঢোক গিলল পিকো। স্পষ্ট দেখতে পেল টেকন।
ওরে বাবা, মিস্টার হিগিন্সকে আরও বেশি ভয় পাই আমি।
হিগিন্স জানবে না ব্যাপারটা, বলল টেকন। আর আমার কথামত কাজ করলে রজারকেও আর কোনদিন ভয় পাবে না তুমি।
কিভাবে?
রজারকে খুন করব আমি। এখনই।
খুন? মিস্টার রজারকে?
হ্যাঁ। খবরটা পৌঁছে দিচ্ছ?
জানি না, নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারল না পিকো।
কাজটা করে দিলে যত ইচ্ছে হুইস্কি খেতে পারবে, লোভ দেখাল টেকন। যত ইচেছ?
দু আঙুল তুলল টেকন। দুবোতল, মিস্টার রজারকে ডেকে তুলে বলবে মিস্টার হিগিন্স দেখা করতে চান। পারবে না?
ভয় করছে, ঘোষণা দিল পিকো।
ভয়ের কি আছে? কেউ জানতে পারবে না কিছু, মরা মানুষ কি কথা বলতে পারে? রজার মরবে আমার হাতে, বলেছি না?
আর রজার যদি তোমাকে খুন করে তখন কি হবে?
ফালতু চিন্তা ছাড়, দৃঢ়তার সঙ্গে বলল টেকন।
দিনের আলো ফুটে উঠল। দরজাটা আরও খানিক ফাঁক করল টেকন। এস, পিকোকে বলল সে। উঠে দাঁড়াল পিকো। প্রবল অনিচ্ছায়।
হুইস্কি দেবে তো?
অবশ্যই, বলল টেকন। পকেটে হাত ঢুকিয়ে তিনটে সিলভার ডলার বার করে আনল সে। দু’বোতলের দাম আছে এখানে। সময়মত পেয়ে যাবে তুমি।
কাঁধে হাত দিয়ে পিকোকে বাইরে নিয়ে এল টেকন। রজারকে ডেকে তুলে বলবে মিস্টার হিগিন্স তাকে দেখা করতে বলেছেন। ক্যাথিদের বাসায়। বলবে, তিনি বলেছেন সাথে রাইফেল আনতে। শীঘ্রি। আর কেউ যেন জানতে না পারে। বুঝেছ?
ভয় করছে।
হুইস্কির বোতলটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিল টেকন। খানিক বাদে ফিরিয়ে নিল। দেরি করো না, সবাই জেগে যাবে একটু পরেই। জলদি যাও, বলল সে।
রওনা দিল পিকো। খানিকক্ষণ সেদিকে চেয়ে থেকে ভেতরে ঢুকে পড়ল টেকন। দেখে নিল ঘোড়াটা রেডি রয়েছে কিনা। তারপর পাশের দরজা দিয়ে বার্ন হাউস থেকে বেরিয়ে এল। চলে গেল ক্যাথিদের বাসার পেছন দিকটাতে। এমন একটা জায়গা বেছে নিল যেখান থেকে দেখা যায় বাঙ্ক-হাউসটা।
রিভলভারে ছ’নম্বর গুলিটা ভরল সে। সাধারণত পাঁচটার বেশি রাখে না। ফ্রী রয়েছে কি না অস্ত্রটা, দেখে নিল বার কয়েক।
রিভলভার হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছে টেকন, বাঙ্কহাউস থেকে বেশ অনেকক্ষণ পর বেরিয়ে এল পিকো। বার্নের দিকে চেয়ে দ্রুত ঢুকে পড়ল স্যালুনে। পেছনের দরজা দিয়ে। মুহূর্ত পরেই বেরোল রজার। হাতে গানবেল্ট। হাঁটা ধরল সে। থামল একবার। বেধে নিল গানবেল্টটা। ওকে লক্ষ্য করছে টেকন।
ক্যাথিদের বাড়ি থেকে রজার যখন গজ বিশেক দূরে তখন আচমকা বেরিয়ে এল টেকন। পিস্তলটা রয়েছে হাতে। নিচু করে ঝুলিয়ে রেখেছে। রজার! তীক্ষ্ণ ডাকটী ভোরের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে খানখান করে দিল। চরকির মত ঘুরল রজার।
রাজ্যের বিস্ময় ফুটে উঠল মুখে। তুমি…তুমি!
পিস্তলটা ডান পায়ের আড়ালে নিয়ে গেল টেকন। চিনতে পেরেছ? আমি সেই শিকারী, বলল সে। ভুল করেছিলে; রজার। মস্তবড় ভুল, বরফ শীতল গলায় কথা কটা উচ্চারণ করল সে।
রজারের বিস্ময় যেন কাটেনি এখনও। তবে মুহূর্তের মধ্যেই সামলে নিল নিজেকে। ধীরে ধীরে সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল কুৎসিত হাসি। ভাল, খুব ভাল, বলল সে। ঠোঁট চাটল। তীব্র শীতে শুকনো হয়ে গেছে ঠোঁটজোড়া। তোমাকে আবার পাব ভাবিনি কখনও। আমার হাতে দ্বিতীয়বার মরতে যাচ্ছ তুমি। সোজা টেকনের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল রজার।
সতর্ক দৃষ্টিতে ওকে লক্ষ্য করছে টেকন। মেপে নিচ্ছে দূরত্বের ব্যবধান। আর কয়েক পা এগোলেই মরবে রজার।
কথা বলতে বলতে এগোচ্ছে রজার। কার সাথে লাগতে এসেছ জান না তুমি, মিস্টার। আজ উইলসন নেই যে বাঁচাবে তোমায়।
গজ দশেক দূরে থাকতে আচমকা থমকে দাঁড়াল রজার। ড্র’ বলেই পিস্তলের জন্যে ছোবল মারল তার হাত। পিস্তল রজারের হাতে আসার আগেই আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায়, বিদ্যুৎ গতিতে হাত উঠে এল টেকনের। রজার পিস্তল বার করল যদিও তবে ততক্ষণে ফুটো হয়ে গেছে তার বুক। গুলি করতে লাগল সে। বৃথাই। ওগুলো আঘাত হানল তুষারে। দু’পা পিছিয়ে গিয়ে দড়াম করে পড়ে গেল সে। কেঁপে উঠল একবার। তারপর স্থির হয়ে গেল চিরদিনের মত।
টেকন ধীরে ধীরে হেঁটে এল মৃত রজারের কাছে। ইতিমধ্যেই রক্তে লাল হয়ে গেছে সাদা তুষার। রিভলভারের চেম্বার খুলল সে। কার্তুজের খোলটা লাফিয়ে। পড়ল রজারের বুকে। গড়িয়ে পড়ে গেল। আর বিন্দুমাত্র কালক্ষেপণ না করে বার্নের দিকে হাঁটা ধরল টেকন। গুলির শব্দে লোকগুলো নিশ্চয় বেরিয়ে আসবে, ভাবল সে। তবে তাড়াহুড়োর কিছু নেই। ওরা তৈরি হয়ে বেরিয়ে আসার আগেই ঘোড়ায় চেপে নাগালের বাইরে চলে যাবে ও।
বার্নের দিকে ফেরার পথে ক্যাথির কথা মনে হল ওর। ওদেরকে এখান থেকে নিয়ে যেতে পারলে খুশি হত সে। কিন্তু উপায় নেই এ মুহূর্তে। পরে অবশ্যই চেষ্টা করে দেখবে।
ও বার্নহাউস থেকে কদম কয়েক দূরে থাকতেই আচমকা চিৎকার শুনতে পেল, থাম। স্যালুনের পেছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে একটা লোক। অ্যাকশনে যাওয়ার জন্যে দ্রুত ঘুরে দাঁড়াল টেকন। চেঁচিয়ে উঠল লোকটা, খবরদার! নড়লেই গুলি করব। মাথার ওপর হাত তুলে দাড়াও। লোকটার হাতে রাইফেল।
লোকটার কথা মতই কাজ করল সে।
মিস্টার হিগিন্স! ওর দিক থেকে চোখ না সরিয়েই চেঁচাল লোকটা। মিস্টার হিগিন্স! টেকনের দিকে চেয়ে বলল, তুমি কে? কি করছ এখানে? আবার ডাকল হিগিন্সকে।
ওর ডাক শুনে বাঙ্কহাউস থেকে বেরিয়ে এল সকলে। কেউ বুট পরছে। কেউ মুক্তপুরুষ, বাঁধছে গানবেল্ট। তুষারের ওপর দিয়ে দৌড়ে আসতে লাগল ওরা। সবার আগে উইলসন। রজারের মৃতদেহের কাছে এসে থমকে দাড়াল সকলে। হাঁটু গেড়ে বসে নাড়ি টিপে পরীক্ষা করল উইলসন। মারা গেছে রজার, জানাল সকলকে।
এসময় স্যালুনের দরজা খুলে বেরিয়ে এল হিগিন্স। পরনে সুট। কিন্তু টাই নেই। টেকনের দিকে এগোল সে। কুঁচকে রয়েছে ভূ। ডাকাডাকি করায় বিরক্ত হয়েছে।
বার্নার্ড সকলের আগে পৌঁছল টেকনের কাছে। মুখ হাঁ হয়ে গেল তার। তুমি..তুমি বেঁচে আছ? প্রায় চেঁচিয়ে উঠল সে।
হিগিন্স ঠোঁটে চুরুট গুঁজে কড়া চোখে চাইল টেকনের দিকে। তার দিকে দৌড়ে এল উইলসন। এ কে? তীক্ষ্ণ গলায় জানতে চাইল হিগিন্স।
উইলসন জবাব দেয়ার আগেই বলে উঠল বার্নার্ড, রজার একে মেরে শহর থেকে বের করে দিয়েছিল। ও ফিরে এসে রজারকে মেরে ফেলেছে।
হিগিন্স চাইল ওর দিকে। কি বললে?
ও রজারকে খুন করেছে, মিস্টার হিগিন্স। লাশ পড়ে রয়েছে ওদিকে, শান্ত কণ্ঠে বলল বার্নার্ড।
হিগিন্স অবিশ্বাসের দৃষ্টি বোলাল টেকনের ওপর। এই লোক রজারকে মেরে ফেলেছে? ডেরেক রজারকে?
ততক্ষণে সবাই ঘিরে ফেলেছে টেকনকে। রাইফেলধারী লোকটিও রয়েছে সেখানে। উইলসন বলল, বার্নার্ড ঠিকই বলেছে, মিস্টার হিগিন্স। রজার মারা গেছে। পড়ে রয়েছে ওদিকে। এগিয়ে এসে টেকনের বেল্ট থেকে রিভলভারটা তুলে নিল উইলসন।
ওদের কথা যেন বিশ্বাস হল না হিগিন্সের। নিজের চোখে দেখার জন্যে গেল সে। ফিরে এসে চিৎকার করে বলল, তোমরা বুঝতে পারছ কতবড় সর্বনাশ হয়ে গেছে? এতগুলো লোক থাকতে এটা কি করে সম্ভব হল?
মিস্টার হিগিন্স, ও যে ফিরে এসেছে বুঝতে পারিনি আমরা, ভয়ে ভয়ে বলল বার্নার্ড।
ইতিমধ্যে ক্যাথি, তার মা আর মেরী বেরিয়ে এসেছে বারান্দায়। টেকনকে পাথরের মূর্তির মত দাড়িয়ে থাকতে দেখল ওরা। এখনও হাত দুটো ভোলা রয়েছে মাথার ওপর।
লোকটা কথা শোনেনি। টেকনের ভবিষ্যৎ কল্পনা করে বুকের মধ্যে ব্যথা অনুভব করল ক্যাথি। চোখ ফেটে কান্না আসতে চাইছে। ঠোঁট চেপে ভেতরে চলে এল সে। পেছন পেছন এলেন মা। ওই লোক এখানে ছিল হিগিন্স জানতে পারলে যে কি হবে…’ খুব ধীরে ধীরে বললেন তিনি। ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ক্যাথি। কথা বলতে ভাল লাগছে না তার।
হিগিন্স চুরুটটা ছুঁড়ে ফেলল তুষারে। দাঁতে দাঁত পিষে বলল, এ কে? কিভাবে
এল? কি চায় এখানে?
বার্নার্ড বলল, এর কথাই বলতে চাইছিলাম গতকাল। ক’দিন আগে রজার
একে মেরে তাড়িয়েছিল এখান থেকে। আমরা ভেবেছি মারা গেছে ও। আজ ওকে দেখে আশ্চর্য লাগছে।
রাইফেলধারী লোকটি হিগিন্সকে বলল, আপনি চাইলে ওর ব্যবস্থা করতে পারি আমি। টেকনকে উদ্দেশ্য করে বলল সে।
জবাব দিল না হিগিন্স। কড়া চোখে চাইল টেকনের দিকে। আমি জানতে চাই ও এখানে এল কিভাবে? রজারকে মারল কিভাবে? সবার দিকে চাইল এবার সে। উইলসন তোমার কিছু বলার আছে?
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল উইলসন।
বার্নার্ড? তুমি কিছু বলবে?
পুরো ঘটনাটা হিগিন্সকে খুলে বলল বার্নার্ড। কিছুই বাদ দিল না। এ শহরে টেকনের আসা থেকে শুরু করে রজারের হাতে মার খেয়ে অর্ধ সচেতন অবস্থায় চলে যাওয়াতক সবই বলল। শেষে যোগ করল, তবে ও কোথায় লুকিয়ে ছিল একদিন সেটাই ভাবছি। অনেক সুস্থ মনে হচ্ছে ওকে। বিশ্রাম যে পেয়েছে বোঝাই যাচ্ছে।
শহরের প্রত্যেকটা বাড়িই খুঁজে দেখেছি আমরা। হারামজাদা ছিল কোথায়? বলল আরেকজন।
সবার কথা চুপ করে শুনল হিগিন্স। নতুন চুরুট ধরাল একটা। তারমানে এই লোক একদিন এখানেই ছিল? আমাদের সব পরিকল্পনার কথা জেনে ফেলেছে! কপালের একটা শিরা লাফাচ্ছে দপদপ করে। লম্বা করে শ্বাস টানল সে। আমি জানতে চাই এ কদিন ও কোথায় ছিল। গর্দভের দল, ব্যাপারটার সাথে কতগুলো টাকা জড়িত জান তোমরা? সবার দিকে একে একে চাইল সে, সব ক’টা মাথা নিচু। হিগিন্স ঝট করে ঘুরে টেকনের মুখোমুখি হল, এ শহরটা আমার। এখানকার লোকজনও। তুমি কে, এখানে মরতে এসেছ কেন?
টেকন চুপ।
জবাব দাও। হিগিন্সের দিকে চেয়ে দাড়িয়ে রইল টেকন। কোথায় ছিলে তুমি? স্যালুনে? কোন বার্নে?
দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল টেকন। চাইল দূরের তুষার ঢাকা পাহাড়গুলোর দিকে। নিশ্চুপ।
দ্রুত এক পা আগে বাড়ল হিগিন্স। চড় কষাল টেকনের গালে। আমার সঙ্গে বেয়াদবি? রাইফেলধারীর দিকে ঘুরল সে। এই, রাইফেল কক কর।
তৎক্ষণাৎ আদেশ পালন করল লোকটি।
মিস্টার, টেকনকে বলল হিগিন্স, শেষবারের মত বলছি, আমার প্রশ্নের জবাব দাও। নইলে রজারের পাশে জায়গা হবে তোমার।
মুখ খুলল টেকন। শান্তকণ্ঠে বলল, সেই ভাল।
এক সেকেণ্ড দ্বিধা করল হিগিন্স। ক্লিনসন, রাইফেলধারীকে বলল সে, গুলি কর। রাইফেল তাক করল ক্লিনসন।
থাম, নীরবকণ্ঠের চিৎকারে চমকে উঠল সবাই। ক্যাথি। কখন যেন ফিরে এসেছিল বারান্দায়। এবার ছুটে এল ওদের দিকে। কাতরস্বরে বলল ও আমাদের বাসায় ছিল। আমি লুকিয়ে রেখেছিলাম।
আচমকা যেন থমকে গেল সবকিছু। হিগিন্সের হাতটা রাইফেলধারীকে নির্দেশ দেয়ার ভঙ্গিতে শূন্যেই রইল। নামাতে ভুলে গেল সে। কিছুক্ষণ চেয়ে রইল ক্যাথির দিকে। কেন জানতে পারি?
ও আহত ছিল। ঠাণ্ডায় মারা যাচ্ছিল। ওর জায়গায় একটা বেড়াল ছানা হলেও ঘরে নিয়ে যেতাম আমি। ও আপনাদের পরিকল্পনার কথা কিছুই জানে না, চিন্তা করবেন না।
আস্তে মাথা নাড়ল হিগিন্স। তোমার দয়ার শরীর, ম্যাম। কিন্তু আমার যে ক্ষতি হয়ে গেল তার কি হবে? শ্লেষের সঙ্গে বলল সে।
শুনুন, রাগ চেপে বলল ক্যাথি। ওকে আশ্রয় দেয়ার জন্যে ক্ষতি হয়নি। আপনার রজার ওর ওপর যে অত্যাচার করেছে তারই শাস্তি পেয়েছে সে। দোষ ওর নয়, রজারের।
রজারের দোষ? আমাদের ছেলেমানুষ পেয়েছ? যা হোক, বড় বেশি সাহস তোমার। তোমার ব্যাপারে পরে সিন্ধান্ত নেব আমরা। টেকনের দিকে ঘুরল হিগিন্স, শোন, মিস্টার, বিরাট ক্ষতি করেছ আমার। অপূরণীয় ক্ষতি। কাজেই তোমার বেঁচে থাকার কোনও অধিকার নেই। রাইফেলধারীর দিকে ফিরে বলল, ক্লিনসন, ওকে বার্নের পেছনে নিয়ে গিয়ে গুলি কর।
ওকে মের না, অনুনয় করল ক্যাথি। চুরুটটা মুখ থেকে বার করে ক্যাথির দিকে চেয়ে রইল হিগিন্স। ভাল। যা ভেবেছিলাম ব্যাপারটা দেখছি তার চেয়ে গভীর। তুমি ওর প্রাণ ভিক্ষা চাইছ?
ক্যাথি কিছু বলার আগেই মুখ খুলল উইলসন। গলা খাকরে বলল, মিস্টার হিগিন্স…’ মাথা থেকে হ্যাটটা খুলে নিয়ে সম্মান দেখাল সে। মিস্টার হিগিন্স। আমি বলছিলাম কি…এর সম্পর্কে আপনাকে কিছু জানানো দরকার। হয়ত আগ্রহ বোধ করতে পারেন আপনি।
জানাও, কৌতূহলী হল হিগিনস।
অস্বস্তি বোধ করতে লাগল উইলসন। চাইল এদিক ওদিক। কথাগুলো আড়ালে কোথাও বলা ভাল। এটুকু বলতে পারি লোকটা রেলরোড কোম্পানিতে ছিল।
তো?
লোকটা শিকারী। ওদের মাংস জোগান দিত। শাপশুটারদের রাইফেল আছে ওর।
বলে যাও।
আজকের দুর্ঘটনাটা দেখে মনে হল ওটা ফেয়ার ফাইট ছিল, খানিক ইতস্তত করল উইলসন। তারপর বলল, যে লোক রজারকে ফেয়ার ফাইটে…
কি বলতে চাইছ? জিজ্ঞেস করল হিগিন্স। ত্যাগ করল উইলসন। চলুন না, স্যালুনে গিয়ে বসি। বেলা তো অনেক হল। নাস্তার টেবিলে আমার আইডিয়ার কথাটা বলব আপনাকে। দেখুন, পছন্দ হয় কিনা। লোকটাকে তো ঘণ্টাখানেক পরেও মারা যাবে।
বেশ, চল, খানিক ভেবে বলল হিগিন্স। তারপর ক্লিনসনের দিকে ফিরে বলল, ভালমত সার্চ কর ওকে। অস্ত্র পেলে নিয়ে নেবে।
রুক্ষ হাতে টেকনকে সার্চ করল ক্লিনসন। রওনা দেয়ার মুহূর্তে ক্যাথির দিকে তাকাল হিগিন্স। তুমি আমাকে অবাক করেছ, মিস। এ ব্যাপারে পরে জবাবদিহি। করতে হবে তোমায়। হিগিন্স শান্তকণ্ঠে কথাগুলো বললেও তার গুরুত্ব বুঝতে অসুবিধে হল না ক্যাথির। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল সে।
টেকনের দিকে চেয়ে ক্যাথির দিকে আঙুল দেখাল, হিগিন্স। তুমি ওদের বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নাও। আমরা তোমার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি। তীক্ষ্ণ চোখে চারদিকে চাইল হিগিন্স। বার্নার্ড! ক্লিনসন! লোকটাকে ক্যাথিদের বাসায় নিয়ে যাও। দুদিকের দরজায় পাহারা দেবে দুজনে। পালাতে যাতে না পারে। যাও।
ইয়েস, স্যার! এগিয়ে এসে বলল বার্নার্ড। উইলসনের দিকে তাকিয়ে বলল হিগিন্স, চল, যাওয়া যাক।
ওরা হাঁটা দিতেই ক্লিনসন আর বার্নার্ড টেকনকে নিয়ে ক্যাথিদের বাড়ির দিকে এগোল। ওকে পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকিয়ে বলল ক্লিনসন, ভেতরে বসে থাক, মিস্টার। পালাতে চেষ্টা করো না।
ক্যাথির মায়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল টেকনের। পুরো ব্যাপারটাই দেখেছেন তিনি জানালায় দাড়িয়ে। কেমন যেন করছে বুকটা। অসম্ভব মায়া লাগছে লোকটার জন্যে। কোন কথা বলতে পারলেন না তিনি। চলে গেলেন ভেতরে।
দোতলায় মেরীর ঘরে এসে টেকন জানালার কাছে দাঁড়াল। ওপরে আসেনি ক্লিনসন আর বার্নার্ড। ক্লিনসনকে সামনের বারান্দায় বসে থাকতে দেখল সে। ধারণা করল বার্নার্ড রয়েছে বাড়ির পেছন দিকে।
মেরীকে বাইরে যেতে বলে ওর কাছে এসে দাঁড়াল ক্যাথি। টেকন চেয়ে রয়েছে রাস্তার ওপাশে, স্যালুনের দিকে। খানিকক্ষণ কথা বলল না কেউই। তারপর নীরবতা ভাঙল ক্যাথি, আমার কথা শুনলে না তুমি।
বাইরের দিকে চেয়েই রইল টেকন। খানিক বাদেই আসবে ওরা। তোমাকে গুলি করে মারবে।
মারুক। তাতে তোমার কি?
কি বললে? বিশ্বাস করতে পারছে না যেন ক্যাথি।
ওর দিকে ফিরল টেকন। মারলে মারবে। তোমার তাতে কি?
ওর মুখের দিকে চেয়ে রইল ক্যাথি। হাঁ হয়ে গেছে মুখ। লোকটা বলে কি? হঠাৎ কাঁপতে লাগল তার শরীর। প্রচণ্ড ক্ষোভে। চুপ করে অপেক্ষা করল টেকন।
আমার কি! টেকনের দু’গালে দু’হাতে চড় কষাল ক্যাথি। পরপর। আমার কি? আবার বলল সে।
ওর দিকে চেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল টেকন।
জাহান্নামে যাও তুমি, বলে দূরে চলে গেল ক্যাথি। তারপর ভেঙে পড়ল বাঁধভাঙা কান্নায়।
এবার আর চুপ থাকতে পারল না টেকন। কাথি… চুপ কর তুমি।
টেকন ওর কাছে গিয়ে আলতো করে হাত রাখল কাঁধে। ঝাড়া দিয়ে হাতটা ফেলে দিল ক্যাথি। আমাকে মাফ করে দাও, অনুনয় ঝরে পড়ল টেকনের কণ্ঠে। তুমি আমার জন্যে যা করেছ…’ কথাটা শেষ করল না টেকন। সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব আমি।
সারাজীবন? ফুপিয়ে চলেছে ক্যাথি। তোমার জীবন আর কতক্ষণের? বড়জোর আধঘণ্টা। বেড়ে গেল ফোঁপানি।
ক্যাথির কাঁধ ধরে জোরে ঝাঁকি দিল টেকন। চিবুকটা তুলে ধরে বলল, মরার আগে আমি জেনে যেতে চাই কিসের প্ল্যান করেছে হিগিন্স।
টেকনের দিকে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল ক্যাথি, জেনে কি লাভ তোমার? তুমি কিছু করতে পারবে না।
পারি আর না পারি, জানতে চাই আমি। বল, ক্যাথি, তীক্ষ্ণ স্বরে বলল টেকন।
চুপ করে রইল ক্যাথি। ওরা প্রেসিডেন্টকে খুন করবে, কথাগুলো বহু কষ্টে উচ্চারণ করল সে।
টেকন যেন বুঝতেই পারল না কথাটা। কি করবে? খুন করবে? প্রেসিডেন্টকে? কোন প্রেসিডেন্টকে?
আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে খুন করবে ওরা।
পুরো ব্যাপারটা এখনও বুঝে উঠতে পারেনি টেকন। আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে? এখানে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
এখানে নয়। রেলরাস্তার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আসবেন প্রেসিডেন্ট। সেখানেই তাকে খুন করবে হিগিন্সের লোকজন।
এখানে কি করছে ওরা?
অপেক্ষা করছে। এটা ওদের ক্যাম্প। সময় হলেই চলে যাবে এখান থেকে।
কিন্তু কেন, ক্যাথি? প্রেসিডেন্টকে মেরে ওদের কি লাভ? শ্রাগ করল ক্যাথি। আমি কি জানি! শুধু জানি পশ্চিমের কয়েকটা রাজ্য আরও কিছুদিন পরে আমেরিকার সঙ্গে যুক্ত হতে চায়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট চাইছেন কাজটা এখনই সেরে ফেলতে। সে কারণেই তাকে মেরে ফেলার ব্যবস্থা হয়েছে। হিগিন্সকে ভাড়া করেছে তারা। টাকা-পয়সা দিচ্ছে পশ্চিমের কিছু বড়লোক। সবকিছু ঠিকমতই চলছিল। মাঝখান থেকে বাগড়া দিলে তুমি, কান্না থামিয়ে বলল ক্যাথি।
আমি? কিভাবে?
রজারকে মেরে ফেলেছ তুমি। ওদের টপগান। প্রেসিডেন্টকে ওরই গুলি করার কথা ছিল।
তুমি এতসব জানলে কিভাবে?
হিগিন্স বলেছে। মদ খেলে মাথার ঠিক থাকে না ওর। মনটা উদার হয়ে যায়।
একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল টেকন। মেঝের দিকে চেয়ে ভাবতে লাগল ক্যাথির কথাগুলো। ওর কাছে এসে কাঁধে হাত রাখল ক্যাথি। শান্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, কিছু খাবে? মাথা নাড়ল টেকন। অন্যমনস্ক।
দুজনেই নিশ্চুপ খানিকক্ষণ। তারপর মৃদু গলায় প্রশ্ন করল ক্যাথি, তুমি কে, টেকন? শুধুই শিকারী?
হ্যাঁ, শুধুই শিকারী।
তুমি কোথা থেকে এসেছ?
দক্ষিণ থেকে। বেশ অনেক বছর হয়ে গেল। তবে এখন আশেপাশের অঞ্চলেই থাকি।
যুদ্ধে গিয়েছিলে? সবাই গিয়েছিল। দক্ষিণের পক্ষে ছিলে?
হ্যাঁ।
তবে তো প্রেসিডেন্ট মরলে তোমার কিছু এসে যায় না।
টেকন খানিক চেয়ে থেকে বলল, হ্যাঁ, কিছু এসে যায় না। প্রেসিডেন্টকে রক্ষার দায়িত্ব তার সরকারের।
ওরা যদি তোমাকে রজারের জায়গায় কাজ করতে বলে? হঠাৎ প্রশ্ন করল ক্যাথি।
আমি করব না।
হতাশ কণ্ঠে বলল ক্যাথি, এর অর্থ জান? ওদের কথায় রাজি না হলে গুলি করে মারবে তোমায়।
এত সহজ নয়। আগেও অনেকে চেষ্টা করে দেখেছে, দৃঢ়তার সাথে কথাগুলো বলল টেকন।
তোমার মত পাগল আর দুটো দেখিনি। ওরা প্রস্তাব নিয়ে এলে ফিরিয়ে দিয়ো না। অন্তত আমার মুখ চেয়ে।
টেকন দ্রুত ক্যাথির মুখের দিকে চেয়ে বলল, হিগিন্সকে ভয় পাচ্ছ?
হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলল ক্যাথি। না, পাচ্ছি না। কথাগুলো কেন বললাম বুঝবে না তুমি।
ঠিক সে সময় বার্নার্ডের মাথা দেখা গেল দরজায়। মিস্টার হিগিন্স তোমাকে ডাকছেন। নেমে এস। কোনরকম চালাকির চেষ্টা করবে না।
উঠে পড়ল টেকন। দরজার কাছে গিয়ে থামল। ক্যাথির দিকে চেয়ে বলল, আমার জন্যে ভেব না।
কথা বলতে পারল না ক্যাথি। হঠাৎ ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল টেকনকে। ওর বুকে মুখ লুকিয়ে কেঁদে ফেলল আবার।
<