চওড়ায় অন্তত ত্রিশ গজ হবে রিও ফ্রিয়ো। দু’পাড়ে উইলোর শাখা হেলে পড়েছে পানির ওপর, জোরাল বাতাস ঘূর্ণি তুলছে পানিতে। সূর্য এখন ঠিক মাথার ওপর, মেঘের পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে নীল আকাশ! ঘোলাটে মেঘের দল ছুটছে অবিরাম, নিচের জমিনে পড়া ছুটন্ত ছায়াগুলোকে ধরার নিরন্তর চেষ্টায় আছে যেন।

উইলো সারির কাছে এসে ঘোড়া থামাল বেন স্লেজেল, স্যাডল ছেড়ে নদীর বাঁক ধরে এগোল। কার্ল ব্রেনেলকে যে জায়গায় অ্যাম্বুশ করা হয়েছিল, জায়গাটার বর্ণনা দিয়েছে টেকোস ফারমিন বুঝিয়ে দিয়েছে কিভাবে পৌঁছতে হবে।

রিও ফ্রিয়োর ওপারে লেযি-এনের জমি, ঢালের আকারে উঠে গেছে পাহাড়ের ওপর। পাহাড় না বলে বিশাল, মাটির ঢিবিই বলা উচিত। ঘন ঝোঁপ আর বোন্ডার ছাড়াও কিছু গুল্ম জাতীয় গাছ আছে। ওখান থেকেই গুলি করা হয়েছে কার্ল ব্রেনেলকে।

উপত্যকা ধরে ওপরে-নিচে তীক্ষ্ণ নজর চালাল বেন। ডাবল-বি র‍্যাঞ্চ হাউস থেকে এ জায়গাটা বহু দূরে, রিও ফ্রিয়োর বাঁকের ঠিক মুখে। ডাবল-বির জমি হলেও তিন দিকেই লেযি-এন রেঞ্জ। নদীর এপাড়ের জমি অপেক্ষাকৃত নিচু, আর ওপাশে গাট-হক জমি ঢালের আকারে পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে মিশেছে। ন্যাড়া মাথার কিছু পাহাড় আছে পেছনে, তারপরই বেসিনের সবচেয়ে উর্বর তৃণভূমি-অবারিত, সমৃদ্ধ এই জমির মালিক, স্বভাবতই টম নোলান।

জায়গাটার অবস্থান এমনই যে রিও ফ্রিয়োর ওপাড়ে ঝোঁপের আড়াল থেকে ডাবল-বির তৃণভূমিতে নজর রাখতে পারবে যে কেউ। অন্তত কয়েক মাইল জায়গা দৃষ্টিসীমায় থাকবে তার। জায়গা আর সময় নির্বাচন ঠিক থাকলে এখানে বসেই যে কাউকে খুন করে সরে পড়া সম্ভব। লুকিয়ে থাকার মত যথেষ্ট আড়াল আছে, আছে পালানোর উপযুক্ত পথ।

কে করেছে কাজটা? লেযি-এন? সন্দেহটা প্রথমে ওদের ওপরই গিয়ে পড়ে, কারণ আড়াই দশক ধরে দুটো বাথানের শক্রতার নিষ্পত্তি হয়নি এখনও। অস্বীকার করার উপায় নেই কার্ল ব্রেনেল না থাকলে লেযি-এনই সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে। পেছন থেকে কিংবা অ্যাম্বুশ করে খুন করার লোক যথেষ্ট আছে লেযি-এন করিডায়, ভাল বেতন দেয়া হয় এদের, এবং লেযি-এনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মত লোক বেসিনে কমই আছে।

নিদারুণ কৌতূহল বোধ করছে বেন। বিপদের আশঙ্কা বা সম্ভাবনার চেয়ে তীব্র হয়ে উঠেছে ওর কৌতূহল, এতটাই যে পরোয়া না করে ফোর্ড ধরে রিও ফ্রিয়োর ওপাড়ে উঠে এল। চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি চালাল বেন, মনে হলো না কেউ দেখছে ওকে।

বিপজ্জনক “গাট-ক” জমিতে আবারও পা রাখল ও। পানিতে নামার আগে বুট জোড়া খুলে নিয়েছিল, পাড়ের নরম মাটি এড়িয়ে অপেক্ষাকৃত শক্ত মাটিতে উঠে আসার পর বুট পরে নিল।

ঢিবির মত উঁচু পাহাড়ের দিকে দ্রুত এগোল ও, ছোট্ট একটা চাতাল আছে। বিশ ফুট ওপরে। ওটার কাছে পৌঁছে হাঁটু গেড়ে বসল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জরিপ করল জায়গাটা। গাছের ফাঁক দিয়ে লেযি-এন তৃণভূমির বড়সড় একটা অংশ চোখে পড়ছে। ডাবল-বির দিকে তাকাতে রীতিমত বিস্মিত হলো। যতটা ভেবেছিল তারচেয়ে অনেক বেশি জায়গা চোখে পড়ে এখান থেকে, পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ওপাড়ের সবকিছু রিও ফ্রিয়ের পাড় বরাবর দক্ষিণে প্রায় এক মাইল এবং উত্তরে আধ-মাইলের মত নদীর দু’ধার, এমনকি বহু দূরে ডাবল-বি র‍্যাঞ্চ হাউসও চোখে পড়ছে।

একটা সিগারেট রোল করল ও। ভাবছে ঠিক কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছিল খুনীকে, মাত্র একটা শটে ওর সারা জীবনে দেখা সবচেয়ে ভাল মানুষটাকে খুন করেছে লোকটা।

ফর্টি-ফোর ক্যালিবারের গুলিতে মারা গেছে কার্ল ব্রেনেল। খুব চলতি ক্যালিবার, এবং কার্তুজগুলো পিস্তল বা রাইফেল দুটোতেই ব্যবহার করা যায়। নিবিষ্ট মনে আশপাশের মাটি আর ঘাস পর্যবেক্ষণ করল বেন, ক্ষীণ আশা করছে কোন চিহ্ন খুঁজে পাবে যার মাধ্যমে খুনীর পরিচয় পেতে পারে।

ডজন খানেক সিগারেটের গোড়া পড়ে আছে মাটিতে, কিছু নুয়ে পড়া ঘাস…ব্যস, আর কিছু না। চাঁদের অস্পষ্ট আলোয় গুলি করতে হয়েছে লোকটাকে, রিও ফ্রিয়ের ওপাড়ে ট্রেইলের ওপর চোখ রেখে আনমনে ভাবল বেন, এবং অন্তত তিনশো ফুট দূর থেকে। মাত্র এক গুলিতে কাজ সেরে ফেলেছে খুনী–নিখুঁত নিশানায়!

বেনের সন্দেহ, যতটা বলেছে তারচেয়ে বেশি জানে টেকোস ফারমিন। কে জানে কি কারণে সত্য চেপে গেছে সে! কিন্তু মুখ না খোলার জন্যে দোষ দেয়া যায় না তাকে, কারণ এখানে বেশিরভাগ লোকই মুখ বুজে থাকতে পছন্দ করে, কিংবা বাধ্য হয়। বেয়াড়া যে কোন মুখ মাত্র একটা গুলিতে চিরতরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

আচমকা মেরুদণ্ডে শিরশিরে একটা অনুভূতি হলো ওর। বিপদ! তৎক্ষণাৎ নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হলো-লেযি-এনের জমিতে আছে এখন, বিপদ এলে ওখান থেকেই আসবে। ঝটিতি ঘুরে তাকাল ও, গাছের ফাঁক-ফোকর দিয়ে দেখল পাহাড়ী উপত্যকা ধরে দ্রুত এগিয়ে আসছে তিন রাইডার। নির্ঘাত লেযি এন ক্রু। কিন্তু কিভাবে ওর খবর পেল ওরা?

ফিরতি পথে এগোল ও, ঘুরতে যেতে আচমকা কিছু একটায় বেধে গেল ডেনিম জ্যাকেট। বাম হাতে সেটা চেপে ধরে টান দিল ও, দেখল ধুলো মাখা একটা স্পার-জ্যাংলার-সাধারণত টেক্সাস জাতীয় স্পারের সঙ্গে এ ধরনের ধাতব টুকরো ব্যবহার করা হয়। দ্রুত জ্যাকেটের পকেটে জিনিসটা চালান করে দিয়ে ফিরতি পথে ছুটতে শুরু করল ও।

রাইডাররা যখন পাহাড়ের চূড়ায় উঠে এল, ততক্ষণে বাকস্কিনের স্যাডলে চেপে বসেছে বেন। ছুটে আসায় হাঁপাচ্ছে কিছুটা, দম নিচ্ছে ধীরে ধীরে। হঠাৎ অসঙ্গতিটা চোখে পড়ল ওর, রাইডারদের একজন উধাও হয়ে গেছে, দু’জনকে দেখতে পাচ্ছে এখন। ঢাল বেয়ে নেমে এল তারা, নদীর কাছাকাছি হলো। ঠিক উল্টোদিকে বাকস্কিনের স্যাডলে স্থির হয়ে বসে আছে বেন, নীরবে দেখছে লোকগুলোকে। স্ক্যাবার্ডে রাখা উইনচেস্টারের ওপর ফেলে রেখেছে একটা হাত।

আবারও তুমি, স্লেজেল? পরিচিত একটা কণ্ঠ জানতে চাইল ত্যক্ত কণ্ঠে।

হ্যাঁ, হারলো, স্মিত হেসে বলল ও।

মনে হয় তোমাকে একটু আগে এপাড়ে দেখেছি?

হয়তো, প্রতিবেশী হিসেবে ওপাড়ে যেতেও পারি আমি, তাই না?

নেহাত গুরুত্বহীন জিজ্ঞাসা, অন্তত জ্যাক হারলোর আচরণে তাই প্রমাণ হলো। দস্তানা পরা ডান হাত বাতাসে নাড়ল সে, যেন প্রতিবেশী হিসেবে বেনের অধিকার বাতিল করে দিচ্ছে। নীল চোখ স্থির হলো ওর মুখে, গম্ভীর স্বরে জানতে চাইল: এখানে এসেছ কেন, স্লেজেল?

হারিয়ে যাওয়া একটা মেয়েকে খুঁজছি, অ্যামিগো!

উরুতে সপাটে চাপড় মারল হারলো, বেনের কৌতুকে আহত হয়েছে বোধহয়। কাজ শুরু করে দিয়েছ তাহলে?

স্যাডলে নিশ্চল বসে আছে অন্য লোকটা, নিচু ব্রিমের হ্যাটের তলা দিয়ে নিরীখ করছে বেনকে। পোড়-খাওয়া দৃঢ় চেহারা, ইস্পাত-ধূসর চোখ জোড়ায় সতর্ক দৃষ্টি দেখলেই বোঝা যায়, বহু পথ চলার আর বহু মানুষের সাথে মেশার অভিজ্ঞতা আছে তার।

রীজের ঢাল ধরে সতর্ক দুষ্টি চালাল বেন। তৃতীয় লোকটা কোথায়? হয়তো ঝোঁপের আড়ালে শুয়ে থেকে রাইফেলে নিশানা করছে ওকে।

ব্যস্ত আছ নাকি, স্লেজেল? জানতে চাইল হারলো।

জরুরী কিছু নয়। কেন?

বুড়ো কথা বলতে চায় তোমার সঙ্গে। কি চায় সে?

শ্ৰাগ, করল টেক্সান, দু’হাত ছড়িয়ে দিল। আমাকে কিছু বলেনি। বস্ নিজেই বলবে তোমাকে।

বাকস্কিন ঘুরিয়ে নিল বেন। প্রায় ছয় বছর হলো টম নোলানকে দেখেনি, এবং বুড়ো কয়োটটাকে দেখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই ওর, স্রেফ খানিকটা কৌতূহল অনুভব করছে।

সত্যিই আসছ? খানিকটা বিস্মিত কণ্ঠে জানতে চাইল হারলো।

আঙুল চালিয়ে হ্যাটের কিনারা ওপরে তুলে দিল বেন, স্যাডল হর্নে কনুই রেখে ঝুঁকে এল কিছুটা। যেতেও পারি। আগে শোনা যাক তোমাদের সঙ্গে ছিল এতক্ষণ, ওই লোকটা কোথায় গেছে?

সবকটা দাঁত বের করে হাসল হারো। ঘুরে স্যাডল ক্যান্টারে একটা হাত রাখল, মুক্ত হাত আগু-পিছু করল অবহেলার ভঙ্গিতে। মিনিট কয়েকের মধ্যে দেখা গেল তৃতীয় লোকটাকে, রীজের চূড়ায় উঠে এসেছে এখন, হারলোর উদ্দেশে হাত নেড়ে কিনারা ধরে উত্তরে এগোল।

লোকটা দৃষ্টির আড়ালে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল বেন, তারপর রিও ফ্রিয়ো পেরিয়ে লেযি-এনের জমিতে পা রাখল। কৌতূহলী দৃষ্টিতে হারলোর সঙ্গীর দিকে তাকাল।

ডড কিনলে, সঙ্গীর দিকে খানিকটা মাথা ঝুঁকিয়ে জানাল হারলো।

নড করল বেন।

চোখ তুলে ওর দিকে তাকাল কিনলে। পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, মৃদু স্বরে বলল সে; মার্জিত উচ্চারণ, কণ্ঠে বিদ্বেষ বা অতিরিক্ত আগ্রহ কোনটাই নেই। পরিষ্কার কাপড় পরনে, দামী না হলেও ভদ্রস্থ এবং পরিচ্ছন্ন। সাধারণ লেযি-এন রাইডার বা ভ্যাকুয়েরোদের চেয়ে সহজে আলাদা করা যাচ্ছে তাকে–মাসিক একশো ডলারে পোষা ভ্যাকুয়েরো নয়।

নীরবে লেযি-এন ব্ল্যাঞ্চ হাউসের দিকে এগোল ওরা।

র‍্যাঞ্চ হাউসটা তৈরি করার সময় সৌন্দর্য এবং নিরাপত্তা দুটো দিকই বিবেচনা করা হয়েছে। দোতলা বিল্ডিং–অ্যাডোবি দালান, টালির ছাদ। আঙিনায়, ফ্লাওয়ার বেড আর একটা পুকুর কাটা হয়েছে। পুকুরে কিছু হাঁস সাঁতার কাটছে। অসংখ্য কটনউড এবং উইলোর ঝাড় ছায়া আর প্রশান্তি বিলাচ্ছে র‍্যাঞ্চ হাউসের চারপাশে। ঠিক পেছনে পাহাড়ের নিরেট শরীর। শিকাগোয় দেখা যায়, এমন একটা উইন্ডমিল রয়েছে এক পাশে, লাগোয়া ট্যাঙ্কে পানি পাম্প করছে।

মূল দালানকে ঘিরে রাখা অ্যাডোবি দেয়ালের প্রশস্ত গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকল তিন অশ্বারোহী। র‍্যাঞ্চ হাউসটা দেখে মাথা নাড়ল বেন স্লেজেল। বহু বছর আগেও যেমন দেখেছে, অপূর্ব সুন্দর একটা বাড়ি। শান্তি, নীরবতা আর আন্তরিকতার এক স্বর্গ। বাস্তবের সঙ্গে ওর কল্পনার অমিল লক্ষ করে ক্ষীণ হাসল বেন, বেসিনের সমস্ত অশান্তি যে এখান থেকে শুরু হয়েছিল তা ক’জন জানে? অথচ এমন একটা বাড়ির স্বপ্ন দেখবে যে কেউ।

দারুণ, তাই না? প্রসন্ন সুরে জানতে চাইল হারলো।

নড করল ও। অন্য কোথাও এত সুন্দর বাড়ি দেখিনি আমি।

থুথু ফেলল সে। আমি প্রায়ই ভাবি এত সুরক্ষিত করে বাড়ি তৈরি করার কারণটা কি?

টেক্সানের দিকে তাকাল বেন। মানুষটাকে কিছুটা হলেও ভিন্ন রকম মনে হচ্ছে এ মুহূর্তে। মার্সেনারির মতই কঠিন, দৃঢ়চেতা; কিন্তু একইসঙ্গে একজন, খুনীর সহজাত প্রবৃত্তিও লুকিয়ে আছে জ্যাক হারলোর মধ্যে।

কিছু মানুষ ঘোড়া পছন্দ করে, কেউ কেউ লিকার বা মেয়েদের পছন্দ করে, খানিকটা তিক্ত স্বরে বলল বেন। টম নোলানের ক্ষেত্রে এর কোনটাই খাটে না, শুধু ক্ষমতা আর সমৃদ্ধিই পছন্দ তার।

কোনটারই অভাব নেই ওর।

কিন্তু সবকিছুরই শেষ আছে, দার্শনিক সুরে খেই ধরল বেন। একটা সময় আসে যখন সবাইকেই হাল ছেড়ে দিতে হয়, কিংবা বিদায় নিতে হয়।

ঝট করে বেনের দিকে ফিরল ডড কিনলে। কেন? শান্ত স্বরে জানতে চাইল সে।

এটাই রীতি, এভাবেই চলে আসছে পৃথিবী।

সন্দেহ আছে আমার!

প্রতিটি মানুষেরই নিজস্ব উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য আছে।

তোমার লক্ষ্য কি, স্লেজেল? জানতে চাইল কিনলে। নিশ্চিত নই আমি।

নিশ্চিত হলে কি করবে, নোলানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাবে আবার?

নিজের উদ্দেশ্য পূরণ করতে গিয়ে কাউকে খুন করার ইচ্ছে নেই আমার।

স্মিত হাসল কিনলে, প্রায় বিদ্রুপের মত দেখাচ্ছে হাসিটা। কিন্তু যদূর শুনেছি, খুন-খারাবি নতুন কিছু নয় তোমার কাছে।

ছয় বছর আগে সিরেনোর ওই ফাইটের কথা বোঝাতে চাইছ?

হ্যাঁ। তাছাড়া আরও কিছু ঘটনা আছে।

শীতল একটা অনুভূতি হলো বেনের। কিসের কথা বলছ?

ওর চোখে চোখ রাখল ডড কিনলে, স্থির নিষ্কম্প দৃষ্টি। কিভাবে ভাবলে মাঝখানের ছয়টা বছর আড়াল করতে পারবে?

ধীরে ধীরে সিগারেট রোল করল বেন, উত্তর দেয়ার আগে খানিক ভাবল মনে মনে। জানতাম না ইতিহাস তৈরি করেছি আমি, কিনলে, ব্যাখ্যা দেয়ার সুরে। বলল ও, যদিও জানে সেটা মোটেই জরুরী নয়। পশ্চিম বড় অদ্ভুত জায়গা, বাঁচার তাগিদেই বেপরোয়া হয় লোকেরা।

ক্ষীণ হাসি দেখা গেল লোকটার মুখে, বেনের ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হয়েছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। আমাকে আর দরকার নেই তোমার, হারলো, অন্তত আজকে, লেযি-এন রাইডারের উদ্দেশে বলল সে, তারপর বেনের দিকে ফিরল। হাস্টা লা ভিস্টা, স্লেজেল।

নড করল বেন। তামাক আর কাগজ হারলোর হাতে ধরিয়ে দিয়ে সিগারেট ধরাল। লোকটা কে? পিঙ্কারটনের গোয়েন্দা?

স্টক ডিটেকটিভ।

ভাড়াটে খুনী, তাই তো বলতে চাইছ, হারলো?

যীশুর দোহাই, ব্যাপারটাকে সহজ ভাবে নাও, স্লেজেল!

হেসে আলতো স্পার দাবাল বেন, গেট দিয়ে ঢুকে পড়ল ওর বাকস্কিন। আমি কি একাই যাব? ঘাড়ের ওপর দিয়ে পেছন ফিরে জানতে চাইল ও।

একাই যেতে হবে তোমার। বুড়ো নোলানের সঙ্গে দেখা করতে গেলে আমার প্রায়ই মনে হয় সঙ্গে এক টুপ সৈন্য না থাকলে ঠিক নিশ্চিন্ত হওয়ার উপায় নেই।

খুব বেশি বাড়িয়ে বলেনি লোকটা, বিশাল বাড়ির সামনের হিচিং রেইলে ঘোড়ার লাগাম বাঁধার সময় ভাবল বেন। হ্যাট দিয়ে কাপড় থেকে ধুলো ঝেড়ে ছায়া ঘেরা বারান্দায় উঠে এল ও, মূল দরজায় পেতলের নকার ধরে নাড়া দিল দু’বার। ভারী মেহগনি কাঠের পাল্লায় খোদাই করে বসানো হয়েছে নকারটা, গরুর মাথার মত হুবহু আকৃতির। শিং দুটো আঙ্কার কাজ করছে, ওগুলো ধরে নাড়া দিতে হয়। মিনিট পূর্ণ হওয়ার আগেই সরে গেল পাল্লা দুটো, বয়স্ক এক মেক্সিকান এসে দাঁড়াল সামনে।

মি. নোলানের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। আমার নাম বেন স্লেজেল।

নড করল লোকটা। এসো, সেনর।

প্রশস্ত সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে এল ওরা। দুটো দরজা পেরিয়ে তৃতীয়টার দরজায় মৃদু করাঘাত করল মেক্সিকান।

এসো! ভেতর থেকে গম্ভীর একটা কণ্ঠ ভেসে এল।

দরজা মেলে এক পাশে সরে দাঁড়াল ভূত্য। হেঁটে বিশাল কামরায় ঢুকল বেন। টম নোলানের অফিসরূম এটা। পাখিদের এয়ারি রূমের মত উঁচু জায়গায় নির্মিত, এখান থেকেই নিজের সাম্রাজ্য পরিচালনা করে লেযি-এন বস। বিশাল কামরাটা সাজানো-গোছানো, ছবির মত সুন্দর। সারা ঘরে উষ্ণতা বিতরণ করছে ফায়ারপ্লেস। চুনকাম করা দেয়ালে নাভাজো কম্বল, অ্যাপাচী বর্শা, গদা, পেতলের তৈরি স্প্যানিশ স্পার সমেত জুতো, মাজল-লোডিং বন্দুক, বাফেলো গান, বুলেটের খোলস…এমনি সব অ্যান্টিক, শিল্পকর্ম বা পুরা-নিদর্শনে ভরা। বিশাল রোল-টপ ডেস্কের পেছনে সাদা-চুলো লোকটি বসে আছে, পেছনের জানালায় লেযি-এন তৃণভূমির একটা অংশ দেখা যাচ্ছে।

তোমাকে দেখে টাফ লোক মনে হচ্ছে, বেন, গম্ভীর স্বরে নীরবতা ভাঙল টম নোলান।

ক্ষীণ হাসল বেন। কিন্তু তোমার চেয়ে টাফ নই, মি. নোলান।

হাসতে যাচ্ছিল লেযি-এন মালিক, বেনের মন্তব্যে হাসিটা মিলিয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে। স্ফটিকের মত স্বচ্ছ নীল চোখে নির্বিকার চাহনি। জীবিত অবস্থায় কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে মানুষটা। অহংকার তো থাকবেই, বেন যেন নিজের অজান্তে তাতে খানিকটা চোট দিয়ে ফেলেছে। নিমেষে চেপে বসল টম নোলানের চোয়ালের পেশী, কঠিন মাপা দৃষ্টিতে নিরীখ করল ওকে।

বরাবরের মত, এবারও বিস্ময় বোধ করল বেন–অ্যাগনেসের বাবা টম নোলানের মত নিষ্ঠুর মানুষ, হিসেবটা কোন দিনই মেলাতে পারেনি, এবারও ব্যর্থ হলো।

একটা চেয়ার ইঙ্গিত করল লেযি-এন মালিক। বোসো, বেন। কি দেব তোমাকে?

রাই?

দুটো গ্লাসে হুইস্কি ঢালল নোলান, একবারের জন্যেও চোখ তুলে তাকাল না। ভোমার সম্পর্কে ইদানীং অনেক খবর আসছে আমার কানে, খানিকটা হেসে মন্তব্য করল সে।

কোন কিছুই দেখছি তোমার অগোচরে থাকে না, মি. নোলান।

চারপাশে কি হচ্ছে, উপস্থিত না থাকলেও খবর রাখতে হয়, বেন, নইলে এত বড় একটা বাথান চালানো সম্ভব হত না।

মানছি। হয়তো আমার বাবার মৃত্যু সম্পর্কেও কিছু খবর দিতে পারবে তুমি।

তীক্ষ দৃষ্টিতে ওকে দেখল টম নোলান। নীরবে গ্লাসে চুমুক দিল ওরা, কেউই নীরবতা ভাঙছে না। বিশাল দেয়াল-ঘড়ির টিকটিক শব্দ কানে বাজছে। এজন্যেই ফিরে এসেছ?

এক হিসেবে তাই বলা যায়।

উত্তরাধিকার বুঝে নেওয়ার জন্যে আসোনি?

হয়তো। আমার ধারণা সেটা তুমিও ভাল করে জানো।

কিংবা…অ্যাগনেসের কারণেই ফিরে এসেছ তুমি।

না। তবে ও চাইলে অনেক আগেই ফিরে আসতাম।

কিন্তু ও তোমার ভাইয়ের বউ এখন, বেন।

ঘড়িটা টিকটিক করেই যাচ্ছে।

গ্লাসের অর্ধেকটা পান করেছে নোলান। বাকি পানীয়ের দিকে তাকিয়ে থাকল শূন্য দৃষ্টিতে, নির্বিকার মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই ঠিক কি ভাবছে। আনমনে হাতের গ্লাস নাড়ল সে, গ্লাসের ভেতরে পানীয়তে ঘূর্ণন উঠল। হয়তো তোমাকে বিশ্বাস করা উচিত, করতে পারলেই ভাল লাগত আমার।

কিন্তু এটাই সত্যি।

তাহলে কার্ল ব্রেনেলের খুনীর পরিচয় জানতে এসেছ তুমি?

হ্যাঁ।

আমিও তাই ভেবেছি।

প্রসঙ্গটা ঠিকই তুলেছে বুড়ো। প্রশংসা না করে উপায় নেই। এক ধরনের নিষ্ঠুরতা বলা যায় এটাকে, কিন্তু একইসঙ্গে স্পষ্টবাদিতার নমুনাও, শল্য চিকিৎসকের কাঁচির মত–নিষ্ঠুর কিন্তু অত্যাবশ্যক এবং দারুণ কার্যকরী, এই হচ্ছে টম নোলান।

খুনটা আমি করিনি, বেন, ঘোষণা করল সে।

তোমার মতই বলতে হয়: বিশ্বাস করতে পারলে খুশি হতাম, মি. নোলান।

সুইভেল চেয়ার ঘুরিয়ে জানালার দিকে ফিরল টম নোলান, আয়েশ করে। হেলান দিল চেয়ারে। পেছন থেকে শুধু গ্লাস ধরা হাত আর এক মাথা চুল দেখতে পাচ্ছে বেন।

তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না, নিস্পৃহ স্বরে বলল সে। কিন্তু কার্ল ব্রেনেলকে খুন করিনি আমি, আসলে খুন করার যৌক্তিক কোন কারণও ছিল না।

হয়তো ব্যক্তিগত কোন কারণ নেই। নিজের পোশাকে কখনোই রক্ত লাগতে দাওনি তুমি। ঠিক বলিনি?

ঝট করে চেয়ার ঘুরিয়ে ওর মুখোমুখি হলো লেযি-এন মালিক, কঠিন চোখে চাপা অসন্তোষ ফুটে উঠেছে। স্বীকার করছি কার্লের প্রতি ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ছিল আমার, মনে-প্রাণে ঘৃণা করতাম ওকে। জনমের শত্রুতা বোধহয় একেই বলে।সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে ওর পেটে বুলেট ঢুকিয়ে দিতে পারলে শান্তি পেতাম আমি। কিন্তু ড্রাই–গালশ করা আমার ধাতে নেই, বেন।

বড়বড় কথা বলছ, তুমি, মি. নোলান। সারা নিউ মেক্সিকোর লোকেরা অন্যদের সম্পর্কে তোমার দৃষ্টিভঙ্গির কথা জানে, বছরকে বছর নিজের রেঞ্জে নিষ্ঠুর এক আতিথেয়তার নমুনা দেখিয়ে এসেছ তুমি। অপছন্দের লোকটাকে খুন করে গাট-হৃক জমিতে এনে ফেলে রাখো, তারপর দাবি করো ট্রেসপাস নয়তো রাসলিং করছিল সে। ব্যস, ঝামেলা খতম। কেউ তোমাকে জিজ্ঞেস করতে আসে না, সেই সাহসও নেই কারও। আরেকটু হলে গতরাতে এই আতিথেয়তার শিকার হয়ে গেছিলাম আমি।

এক চুমুকে গ্লাসের অবশিষ্ট পানীয় শেষ করে ফেলল টম নোলান। ক্ষীণ বিদ্রুপের হাসি ঝুলছে ঠোঁটের কোণে, চোখে কৌতুক ফুটে উঠল। নিজের পিঠ বাঁচাতে যথেষ্ট করেছ তুমি, বেন। কিন্তু স্টিভের ধারণা, ও সময়মত না পৌঁছালে হয়তো খুনোখুনি হয়ে যেত।

ঠিকই বলেছে ও।

ফ্রেড মোরিস তোমাকে ভুলে যায়নি, বেন, উপযুক্ত কারণও আছে।

ছয় বছর আগে সিরেনো কর্নারে বিল আর আমার মুখোমুখি হয়েছিল ও, ক্ষত-বিক্ষত মুখে হাত বুলাল বেন, র‍্যাঞ্চারের ভর্ৎসনায় আমল দিল না, বরং পাল্টা বিদ্রুপের স্বরে মনে করিয়ে দিল: খুন করার জন্যেই গুলি ছুঁড়েছিল ওরা। যা পাওয়া উচিত ছিল, তাই পেয়েছে সে।

নড করল টম নোলান। মজার ব্যাপার কি জানো, আসল সত্য কিন্তু চাপা, পড়ে গেছে। লড়াইয়ের সমস্ত কৃতিত্ব নিজের করে নিয়েছে বিল ব্রেনেল আর বেসিন ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছ তুমি।

তো?

এবার চওড়া হাসি দেখা গেল র‍্যাঞ্চারের মুখে। তুমি নও, বরং বিলই দু’জনকে খুন করেছে এবং আহত করেছে ফ্রেডকে। এটাই হচ্ছে সিরেনোর ওই লড়াই সম্পর্কে অন্যদের ধারণা। কিন্তু সত্যটা তুমি যেমন জানো, আমিও জানি। আর জানে ফ্রেড মোরিস। ও ঠিকই জানে সেদিন কার গুলিতে বিকলাঙ্গ হয়েছে। বিলের পক্ষে দু’জনকে ধরাশায়ী করা কোন ভাবেই সম্ভব ছিল না, কারণ বেহেড মাতাল না হলেও নেশায় এতটাই বিপর্যস্ত ছিল যে ট্রিগার টানার মত মনের জোরও ছিল না ওর তখন।

বলে যাও।

স্বীকার করছি, তুমি চলে যাওয়ায় আমি কিন্তু খুশিই হয়েছিলাম। কিছু দিন নিশ্চিন্তে চলে গেছে, কারণ কার্ল বা বিল সেধে কখনও ঝামেলা করেনি। আসলে সিরোনোর ওই লড়াইয়ের পর পরস্পারের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থেকেছে দুই বাথানের ক্রুরা। দু’একটা মারামারির ঘটনা ঘটেছে অবশ্য, কিন্তু কোনটাই গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু তুমি ফিরে আসার পর বোধহয় পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। শোনো, বাছা, বিল ব্রেনেলকে অনায়াসে সামলাতে পারব আমি, ওর মত লোককে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব।

গ্লাস খালি করে উঠে দাঁড়াল বেন। ঝামেলা করতে ফিরে আসিনি আমি, মি. নোলান।

সত্যি কথা হচ্ছে: ফিরে এসেছ তুমি, এবং রিও ফ্রিয়োর দখল এখনও চাই আমার। একজন ব্রেনেলকে বিয়ে করেছে আমার মেয়ে। আমার একমাত্র মেয়ে! আমার কষ্টটা বুঝতে পারবে না, বেন। বুঝবে, কখনও যদি সন্তানের বাবা হও।

একটা কথাই বলার আছে তোমাকে: হয় চলে যাও, নইলে ঝামেলা পোহাও। জানি না বিলের কাছে কত পাওনা হয়েছ তুমি, কিন্তু এটা জানি ফুটো পয়সা দেওয়ারও সামর্থ্য নেই ওর। তোমাকে দশ হাজার ডলার দিতে রাজি আছি আমি, স্রেফ একটা শর্তে: বেসিন ছেড়ে চলে যাবে চিরদিনের জন্যে, কখনও ফিরে আসতে পারবে না।

কেন? ধীরে ধীরে প্রশ্নটা করল বেন।

দুটো গ্লাসে আবারও পানীয় ঢালল টম নোলান। তোমার মধ্যে যে জিনিস দেখেছি, স্লেজেল, স্বীকার করছি দুশ্চিন্তা হচ্ছে আমার। বিল ব্রেনেল বা অন্যদের অনায়াসে সামলাতে পারব, কিন্তু তুমি ওদের চেয়ে আলাদা কিসিমের। রিও ফ্রিয়ো ছেড়ে চলে যাও; সান। টাকাটা নিয়ে ছুটতে থাকো। এখানে যেমন নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছি আমি, ঠিক ততটাই নিশ্চিত জানি তুমি থেকে গেলে কিছু দিনের মধ্যে আমাদের যে কোন একজন খুন হয়ে যাবে।

গ্লাস তুলে পানীয়টা দেখল বেন। অন্তত কিছু দিন থাকছি আমি।

স্থির দৃষ্টিতে ওকে দেখল টম নোলান, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে গ্লাসটা তুলে ধরল। জানতাম এ কথাই বলবে। ঠিক আছে, হয়তো এটাই হওয়া উচিত ছিল–যেহেতু আমাদের দুজনের পরিণতি একই সূত্রে গাঁথা। নিজের পিঠের দিকে খেয়াল রেখো, স্লেজেল।

গ্রেসিয়াস, মি. নোলান। পরস্পরের গ্লাস ঠোকাঠুকি করল ওরা, তারপর পানীয় ঢেলে দিল গলায়।

<

Super User