পুব বরাবর এগোলে কলিন ফোর্বস, শহর থেকে খানিকটা দূরে এসে ঘোড়া ঘুরিয়ে নদীর সমান্তরালে চলে যাওয়া রাস্তা ধরে চললো, একটানা কয়েক মাইল এভাবে গেছে পথটা। নদী যেখানে বাঁক নিয়েছে ঠিক তার আগে একটা শাখা পথ বেরিয়ে একেবেঁকে চলে গেছে উত্তরের পাহাড়সারির দিকে, ওটা ধরে ওয়ারেন স্মিথ আর গ্রেবার র‍্যাঞ্চে যাওয়া যায়।

রাত, তবু সামনে প্রায় আধ মাইল পর্যন্ত পরিষ্কার দৃষ্টি চলে, বিপদ এলে আগেই টের পাওয়া যাবে। এত রাতে শহরমুখী কারু সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ, তারপরও সতর্ক থাকা ভালো। জেফরি আরচারের কাছে ভালো শিক্ষা পাওয়া গেছে : অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস বড় খারাপ জিনিস।

শেরিফকে মারধোর করে অস্বস্তি বোধ করছে কলিন। কিন্তু কি করা, উপায় ছিলো না। আরচার লোকটা নিপাট ভদ্রলোক, সাহসী। অন্য কারো বেলায় যা স্বাভাবিক ছিলো; ওয়ারেনের পক্ষাবলম্বন, করেনি সে, নিজের স্বাধীনতা বজায় রেখেছে, আইনকে তার স্বাভাবিক ধারায় চলতে দিয়েছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করতে যায়নি। অবশ্য আজকের অঘটনের পর ওর সম্পর্কে অবিশ্বাস্য কোনো অভিযোগও যদি সে বিশ্বাস করে বসে অবাক হবে না কলিন। নিজেই শেরিফকে ওয়ারেনের দিকে ঠেলে দেয়ার ব্যবস্থা করে এসেছে।

পাইপে তামাক ভরার জন্যে ঘোড়া থামালো কলিন, পর মুহূর্তে আড়ষ্ট হয়ে গেল হঠাৎ, ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকালো। একাধিক ঘোড়ার ছুটন্ত খুরের শব্দ, এগিয়ে আসছে। ঝটপট রাস্তা ছেড়ে মাঠে নেমে এলো কলিন, এখানে ওখানে শুয়ে রস একপাল গরুর মাঝে ঢুকে পড়লো। আবার লাগাম টেনে দ্রুত স্যাডল থেকে নেমে হাটু গেড়ে বসে পড়লো, লাগামটা ধরা রইলো হাতে। রাস্তা থেকে একপাল গরুর মাঝে দাঁড়ানো জিন চাপানো ঘোড়াটা ওদের চোখে নাও পড়তে পারে, অশান্বিত মনে ভাবলে কলিন।

আরো কাছাকাছি এলো ঘোড়াগুলো। ধীরে সুস্থে এগোচ্ছে সওয়ারীরা, বুঝতে পারলো কলিন। দৃষ্টিসীমায় এলো অশ্বারোহীরা, দুজন, সহজ ওদের এগোনোর ভঙ্গি, f° তে কষ্ট হলো না ওর। বেলিনডা গ্রেবার এবং ডেভিড স্পেক্টর। ওর দিকে তাকালো না, চলে গেল আপন পথে।

উঠে দাড়ালো কলিন, আবার স্যাডল চাপলো, হঠাৎ কি ভেবে দ্রুত এগোলো ওই দু’জনের উদ্দেশে। রাতে শহরে মায়ের কাছে থাকবে বলেছিলো বেলিনড, সাপারের নিমন্ত্রণ করেছিলো ওকে, স্পষ্টতই ওকে হোটেলের বারান্দা থেকে সরিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে। কলিন ওর আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেয়ায় মত পাল্টে এখন র‍্যাঞ্চে ফিরে যাচ্ছে বোধ হয়। 

ওর ঘোড়ার খুরের শব্দে একসঙ্গে ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকালো বেলিনডা আর স্পেক্টর, ঘোড়া থামালে সাথে সাথে। চোখের পলকে হোলসটারের দিকে হাত বাড়ালো স্পেক্টর। তাকে কি যেন বললো বেলিনডা, হাত সরিয়ে আনলো সে। রাশ টেনে ঘোড়া থামিয়ে মাথা থেকে টুপি নামিয়ে অভিবাদন করলো কলিন। চোখ। কুচকে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে বেলিনডা, মনে হলো ওর, কিন্তু ঠিক বুঝতে পারলো না। টুপির কিনারার নিচে এক রকম অদৃশ্য ওর চোখজোড়া।

তুমি কোত্থেকে এলে? সোজাসাপ্টা জানতে চাইলে বেলিনা।

রাস্তার ওপাশে ছিলাম।

ওত পেতে? বেলিনডার কণ্ঠে অভিযোগ, বুঝেও না বোঝার ভান করলে। কলিন।

না, তোমাদের ঘোড়ার আওয়াজ পেয়ে সরে গিয়েছিলাম, প্রথমে চিনে উঠতে পারিনি কিনা।

এতক্ষণে, বললে বেলিনডা, ইচ্ছে করলে বেসিন ছেড়ে অনেক দূরে চলে যেতে পারতে, অথচ যাওনি, কেন?

কারণ বেসিনেই থাকছি আমি,বললে কলিন, আর কোনো প্রশ্ন?

হঠাৎ সামনে ঝুঁকে এলো বেলিনডা। আচ্ছা, বলতে পারো, আজ আরেকটা খুন করে কি লাভ হলো? তুমি না থাকলে কি ঘটতো এটা? এভাবে একের পর এক খুন করে কোন ফায়দা লুঠতে চাও? এ কেমন মানুষ হয়েছে। তুমি?

বেলিনডার কথায় ক্ষুব্ধ হলো কলিন, কিন্তু রাগ প্রকাশ করলো না।

আমার অপরাধটা কোথায়, বেলিনডা? ইচ্ছে করে কাউকে হত্যা করেছি আমি? আমি এখানকার লোক নই? আর সবার মতো বেসিনে বসবাস করার অধিকার নেই আমার? আমি কেন ডেভিড স্পেক্টরের মতো নিশ্চিন্তে ওয়াগোনারের রাস্তায় হাঁটতে পারবে। না?

এটা কোনো যুক্তি হলো না।

হলো না? ওয়াগোনারের আজকের ব্যাপারটার কথাই ধরো, দোষটা কি আমার ছিলো?

লোকে বলাবলি করছে পুরোনো বিরোধ জিইয়ে রাখাই তোমার বেসিনে আসার উদ্দেশ্য।

তার প্রয়োজনও হতে পারে—

কেন?

অনেক কারণেই—

ঠিক আছে, ঝাঁঝের সঙ্গে বললো বেলিনডা, ধরে নিলাম প্রয়োজন হলো, তারপরও, মানুষ হত্যাকে কি তোমার খুব ভালো কাজ বলে মনে হয়?

চাক কনারসকে শখে মেরেছি ভাবছো নাকি?

জানি না। হ্যাঁ অথবা না, দুটোই হতে পারে, কিন্তু আসল কথা লোকটা মারা গেছে। তুমি যতক্ষণ এখানে আছে। খুনোখুনি চল বেই, ঠেকানো যাবে না।

সেজন্যে লেজ তুলে পালাতে হবে আমায়।

হ্যাঁ।

ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবে দেখছে না তুমি, বেলিনডা। আসলে মনে মনে চাইলেই সব অন্যায় অসুন্দর ভেসে যায় না, ন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে লড়াই করতে হয়, তোমাকে তোমার বিশ্বা সের পক্ষে দাঁড়াতে হবে: আচ্ছা, তুমি আরনেস্ট হলকে চিনতে? আমাদের র‍্যাঞ্চে ছিলো?

        হ্যাঁ। সে তো কাজ ছেড়ে চলে গেছে।

না মারা গেছে ও। প্রীংগারভিলে যাবার পথে হত্যা করা হয়েছে ওকে। ওর সঙ্গে আমাদের আরো সাতজন লোক প্রাণ দিয়েছে। নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে ওদের।

আমি-আমি-এ-কথা তো জানতাম না। কিন্তু তার সাথে ওয়ারেনের কি

ক্লাইভ কাসলারকে জিজ্ঞেস করে দেখো।

ক্লাইভ?

চেনো না?

চিনি! আমি-কলিন, ঠিক কি বলতে চাইছো?

মাথা নাড়লো কলিন। ক্লাইভকেই জিজ্ঞেস করে।

যদি দেখা হয়—

থেমে গেল বেলিনডা, হঠাৎ ভয়ের ছায়া পড়লে চেহারায়, যেন বুঝে গেছে ভয়ঙ্কর কোনো কথা শুনতে হবে।

বেলিনডা, বললো কলিন, আগামীকাল রাতে তোমাদের ওখানে সাপার খেতে যাবো বলেছিলাম, তা বোধ হয় পয়ারবো না। অন্য একদিন আসলে হয় না?

মাথা দোলালো বেলিনডা, কিন্তু ও কি বলতে চায় বুঝতে পারছে কিনা ধরতে পারলো না কলিন।

বলো তো, কলিন, জানতে চাইলে বেলিনডা, তোমার আসল ইচ্ছেটা কি?

এই একটা কথাই জানতে চাইছে সবাই, বললো কলিন, আমার জবাবও একটাই। জানি না। ও হ্যাঁ, তোমার ঘোড়াটা লিভারি আস্তাবলে আছে।

হুয়ান এরপর ওয়াগোনারে গেলে ছাড়িয়ে নেবে, বললে ডেভিড স্পেক্টর। অসলারকে বলে রেখেছি হুয়ান গেলে যেন ঘোড়াটা ওকে দিয়ে দেয়। কালই ওয়াগোনারে যেতে পারে সে। তোমার ঘোড়াটা কোথায় ছেড়ে দিয়ে এসেছে জিজ্ঞেস করে জেনে রাখবে।

কথা বলার আগে এতক্ষণ কান খাড়া করে ওদের কথা শুনছিলো ডেভিড স্পেক্টর, কাসলারের প্রসঙ্গ উঠতেই বিড়বিড় করে কি যেন বলেছে সে, লক্ষ্য করেছে কলিন, কাসলারকে বোধ হয় পছন্দ করে স্পেক্টর, ভাবলো ও।

তোমাকে সাহায্য করতে পারলে খুশি হতাম, বললে বেলিনডা, কোনো সমস্যাই সমাধানের অতীত নয়, এই ব্যাপারটার সুরাহা করার কাজে কোনোভাবে যদি তোমাকে সাহায্য করতে পারতাম।

সুযোগ আসতেও পারে, বললো কলিন। যাক গে, একদিন তোমার বাড়ি আসবো আমি, বেলিনদাঁ, তখন কথা হবে।

সামনে ঝুঁকে বেলিন্ডার হাতে মৃদু চাপ দিলে কলিন, তারপর ডেভিড স্পেক্টরের উদ্দেশে হাত নেড়ে ঘোড়া ঘুরিয়ে ছুটলো।

কিছুক্ষণ পশ্চিমে এগিয়ে রাস্তা ছেড়ে একটা অনুচ্চ টিলার আড়ালে এসে ঘোড়া থামালো ও, আবার পাইপ বের করে তামাক ভরা শুরু করলো। বেলিনডার প্রতি প্রসন্ন কলিন, সন্তুষ্ট বুড়ো ডেভিড স্পেক্টরের প্রতি। ডেভিড স্পেক্টরের মনটা আসলে, ভাবলো ও, কোমল, সেটা আড়াল করতেই চেহারা অমন রুক্ষ করে রাখে। বেলিনডাও নরম মনের মেয়ে, হানাহানি রক্তপাত চায় না। তবে সম্ভবত এবার নতুন করে ভাবতে শিখবে ও।

কিন্তু হঠাৎ মনে পড়লো কথাটা। হেলার বেলিনডার প্রতি কাসলারের দুর্বলতার কথা বলেছিলো। কতখানি দুর্বল সে? ভাবলে কলিন, বেলিনডাই বা কোন চোখে দেখে তাকে? ধেৎ, বেলিনডার মতো মেয়ে খুনেডাকাত কাসলারকে কিছুতেই ভালো বাসতে পারে না!

পাইপটা পরিষ্কার করতে হবে, তেতো লাগছে তামাকের ধোঁয়া, কেমন একটা দুর্গন্ধ!

পাইপ থেকে ছাই ঝাড়লো কলিন। বার কয়েক থুতু ফেললো। তারপর আবার রাস্তার দিকে এগোলো। বেলিনডার প্রশ্নের উত্তরে সত্যি কথা বলেনি ও। হ্যারলড ওর সঙ্গীদের নিয়ে ফিরে আসার আগে একটা কাজ করতে যাচ্ছে কলিন। ঝুঁকিবহুল কাজ, কিন্তু পুরো সপ্তাহটা টিকে থাকাও তো অনিশ্চিত!

রাস্তায় এসে উত্তরে বাঁক নিলো, কলিন। বেলিনডা আর ডেভিড স্পেক্টর যেদিকে গেছে সেদিকে এগোলো। বেলিনডারা বড়জোর মিনিট বিশেকের পথ এগিয়ে আছে, তাই তাড়াহুড়ো করলো না কলিন, ওদের অতিক্রম করতে চায় না। রাস্তাটা যেখানে বীর ক্রীক অতিক্রম করেছে সেখানে পৌঁছে পানিতে নেমে গেল কলিন, অগভীর ক্রীকের বালুময় তলদেশ ধরে এগোলো। লিনডা ওয়া রেনের কথা ভাবছে মনে মনে, ক্যানসাস সিটির জাঁকজমক আর কোলাহল থেকে বঞ্চিত মেয়েটা, পাঁচশো ডলার পেলে আবার ফিরে যাবার কথা বলেছিলো, ওয়ারেনের কবল থেকে বাঁচতে চায় সে।

হেলারকে ধন্যবাদ। পাঁচশো ডলার পাওয়া গেছে তার কল্যাণে। 

বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো কলিনের ঠোঁটে। লিনডাকে ক্যানসাস। সিটিতে যেতে সাহায্য করে ওয়ারেনের আঁতে ঘা দেবে ও।

জিম হ্যাগারটি, সিনডিকেটের প্রেসিডেন্ট, একবার প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলো : লড়াইয়ের কৌশল মাত্র একটা, যতক্ষণ সম্ভব লড়াই থেকে দূরে থাকবে, কিন্তু লড়াই যদি করতেই হয়, হাতের কাছে যা পাবে, যত তুচ্ছ হোক, অশোভন হোক, তাই দিয়ে আঘাত করবে প্রতিপক্ষকে, প্রথম সুযোগেই তাকে দিশেহারা করে দিতে হবে, সামলে ওঠার সুযোগ যেন না পায়, পরাস্ত না হওয়া পর্যন্ত ক্রমাগত আঘাত হেনে যাও; লড়াই মানেই লড়াই, এখানে ভদ্রতার স্থান নেই, প্রয়োজনে হীন কৌশল গ্রহণেও পিছপা হবে না, লড়াই শেষ হওয়ার পর ভদ্রতা দেখানোর প্রচুর সুযোগ মিলবে।

জিম হ্যাগারটির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ নেই। লড়াই মানেই নোংরামি। তুমি যদি প্রতিপক্ষকে টলাতে না পারো, সে তোমাকে ছাড়বে না, পরাজয় মেনে নিতে হবে তোমাকে। এই মুহূর্তে নিরস্ত্র অবস্থা ওর, তারপরও ওয়ারেনকে বেসামাল করে দেয়ার একটা চেষ্টা চালানো যায়!

স্প্রীংগারভিল ট্রেইলে ফোর্বস র‍্যাঞ্চ রাইডারদের পরিণতি ওর জানা, হেলারের কাছে খবরটা পেয়ে চমকে উঠবে ওয়ারেন। বেলিনডা আরনেস্ট হল সম্পর্কে ক্লাইভ কাসলারকে প্রশ্ন করলে আরেকটা ধাক্কা খাবে ওরা; তারপর ও যদি ক্যানসাস সিটিতে যেতে লিনড ওয়ারেনকে সাহায্য করে, প্রচণ্ড আঘাত লাগবে ওয়ারেনের মর্যাদায়। সন্দেহ নেই তাল হারিয়ে ফেলবে সে।

আবার যখন ঘোড়া থামালে কলিন, মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। বেসিনে আসার পর প্রথম রাত কাটানোর জায়গাটিতে, ওয়ারেন র্যাঞ্চের কাছে, ক্ৰীকের ধারে গাছপালার আড়ালে এসে পড়েছে ও। স্যাডল থেকে নেমে ঘোড়া বাধলো কলিন। তারপর রাঞ্চের দালানগুলোর দিকে তাকালো। আলো নেই কোথাও। সবাই ঘুমাচ্ছে বোধ হয়। ঘুমাক যত ইচ্ছে। একাকী এই মুহূর্তে হামলে পড়ার পরিকল্পনা নেই ওর, অতটা নির্বোধ ও নয়।

স্যাডলের পেছন থেকে প্রথমে বিছানা নামালে কলিন, তার–পর খসালো স্যাডলটা। মাটিতে চাদর বিছিয়ে শুয়ে পড়লো। পাতার ফাঁকে তারা দেখা যাচ্ছে, জ্বলজ্বল করছে। পাহাড়ের ওপাশে আর্তনাদ করে উঠলো একটা কয়োটে, জবাব দিলো আরেকটা। ঝিরঝির বাতাস বইছে। চোখ বুজলে কলিন, কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নেয়া যাক। রাতে কেউ বিরক্ত করবে না আশা করা যায়। সকালেও কারো এখানে আসার সম্ভাবনা নেই। কেন আসবে? ওয়ারেন রাঞ্চের নাকের ডগায় ক্যামপ করেছে ফোর্বস, ভাবতেও পারবে না ওরা।

পাশ ফিরে শুলো কলিন, সকালের কথা ভাবছে। সূর্য ওঠার পর ওয়ারেনের রাইডাররা বেরিয়ে পড়বে, শহরের দিকে যাবে একদল, দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে কেউ। এবং ওর খোঁজে যাবে একটা দল। এই সুযোগে হয়তো লিনডার সঙ্গে দেখা করতে পারবে ও। নইলে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে সুযোগের সন্ধানে। তার আগেই ওদের চোখে ধরা পড়ে গেলে কেটে পড়বে।

আবার চিত হয়ে শুলে কলিন, একটু পরেই তলিয়ে গেল ঘুমে। ভোর হওয়ার আগেই ঘুম ভাঙলো, উঠে পড়লো ও। হ্যারলডের মেয়ের কাছ থেকে পাওয়া সেই বাকস থেকে ঠাণ্ডা খাবার দিয়ে নাশতা সারলো। তারপর দ্রুত পালানোর সুবিধের কথা ভেবে ঘোড়ার পিঠে স্যাডল চাপিয়ে রাখলো।

এবার অপেক্ষার পালা।

ওয়ারেন র‍্যাঞ্চ জেগে উঠলো ধীরে ধীরে। উঠোন থেকে সমবেত কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। বাংক হাউস, র্যাঞ্চ হাউস আর কোরালে যাওয়া আসা করছে রাইডাররা। খাবারের ঘণ্টা বাজার বেশ আগেই ঘোড়ার পিঠে জিন চাপালো কয়েকজন। বাকিরা নাশতা শেষ হওয়ামাত্র ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হলো। কয়েক মুহূর্ত পর ওয়ারেনের নেতৃত্বে এগারোজনের একটা দল শহরের পথ ধরলো। বিলও আছে ওই দলে, ঢ্যাঙা কাঠামো দেখে লুইস প্যাটেনকে চিনতে পারলো কলিন। কিন্তু ওদের প্রতি তেমন আমল দিলে না ও।

এখনো দুটো জিন চাপানো ঘোড়া দেখা যাচ্ছে কোরালে। তার মানে কমপক্ষে দু’জন রাইডার রয়ে গেছে, বেশিও হতে পার। এরাও হয়তো একটু পর বেরিয়ে যাবে। দেখা যাক।

আধ ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। একটা লোককে বাংক হাউসের দিকে যেতে দেখলো কলিন। কয়েক মিনিট পর কোরালের দিকে গেল আরেকজন, দুহাতে দুটো বাকেট, ঘোড়ার খাবার নিয়ে যাচ্ছে বোধ হয়। কোরালে ঢুকে ফীডিং-ট্রাফে বাকেট খালি করলো সে, তারপর বেরিয়ে এসে বাংক হাউসের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ডাকলো, ডেকস, অ্যাই ডেকস। জবাব পেলো কিনা বুঝতে পারলো না কলিন। কোণাকুণিভাবে আস্তাবলের দিকে পা বাড়ালো লোকটা।

আরো আধ ঘণ্টা কাটলো। এর মধ্যে খড় নিয়ে আগের লোক টাই আরো একবার কোরালে গেছে। একটা লোক, ঝোলানো কঁধি তার, পরনে অ্যাপ্রন, তার মানে বাবুর্চি, বাড়ির একপাশের একটা দরজা গলে বাইরে এলো, কাপড় শুকাতে দিয়ে আবার ঢুকে পড়লো ভেতরে।

নিভে যাওয়া পাইপে টান দিলো কলিন ফোর্বস, দাতের ফাঁকে চেপে ধরে রেখেছে ওটা।

বিরক্তির সঙ্গে জিন চাপানো ঘোড়া দুটোর দিকে তাকালে কলিন। ঘোড়ায় চেপে ওই দু’জনের বেরিয়ে যাবার কথা, অথচ কোনো আলামতই নেই, দেখে শুনে ওদের বাইরে যাবার ইচ্ছে আছে বলেও মনে হচ্ছে না। এখনো তিনজন লোক আছে র‍্যাঞ্চে, আরো বেশিও হতে পারে; বাবুচি, বাংক হাউসে একজন–ব্যাটা এখনো বেরোয়নি, করছেটা কি?–আরেকজন সকাল থেকে নানা কাজে ব্যস্ত, বার্নের পুব পাশে মুরগীকে খাবার দিচ্ছে এখন! মুরগীগুলোকে খাইয়ে তারপর বেরোবে? খোদাই জানেন!

হামাগুড়ি দিয়ে কয়েক গজ পিছিয়ে এলো কলিন, উঠে দাড়ালো, আড়মোড়া ভেঙে হাত পায়ের খিল ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। পিস্তল বের করে পরখ করলো ও। এভাবে চলতে থাকলে সারা সপ্তাহতেও লিনডার সঙ্গে দেখা করা যাবে না। র‍্যাঞ্চে মোট তিনজন আছে, আবার ভাবলো কলিন। বাংক হাউসে একজন–বিশ্রাম নিচ্ছে নয়তো কোনো কাজে ব্যস্ত, উঠোনে এটা ওটা করছে একজন; আর বাবুচি নিশ্চয়ই কিচেনে। তিনজন। বেশি হতে পারে। সম্ভাবনা কম।

উঠোনটা পরিষ্কার নজরে আসে এমন জায়গায় এসে দাড়ালো কলিন। মুরগীকে খাইয়ে এবার বানে যাচ্ছে লোকটা। আস্তাবলে ঢুকলো সে। সময় গুণে চললো কালন। পাঁচ মিনিট। দশ। আর বেরিয়ে এলো না লোকটা।

এখান থেকে র‍্যাঞ্চ হাউসের দুরত্ব বড়জোর পঞ্চাশ গজ। পঞ্চাশ কদম। অধি মিনিটেরও কম সময়ে এই দূরত্বটুকু পেরোনা যায়, তারপর আর ছ’সাত পা এগোলেই ওই দরজাটা, ওটা গলে মেস হল আর কিচেনে ঢুকে পড়া যাবে অনায়াসে। বাবুর্চি অসতর্ক অবস্থায় থাকবে, তাকে সামলানো সমস্যা হবে না।

সমস্যা একটাই, র‍্যাঞ্চ হাউসে পৌঁছুনোর আগেই বাংক হাউস বা বার্ন থেকে যদি ওদের কেউ বাইরে তাকায়! মাত্র আধ মিনিট সময় দরকার। নাও তাকাতে পারে। পরিস্থিতি মোটামুটি অনুকূল। লম্বা একটা দম নিলে কলিন, ফাঁকায় বেরিয়ে এলো, তারপর দ্রুত পদক্ষেপে র্যাঞ্চ হাউসের দিকে এগোলো। 

কারো চিৎকার বা পিস্তলের আওয়াজ পাওয়া গেল না। র‍্যাঞ্চ হাউসে পৌঁছে দেয়ালঘেষে এগোলে কলিন, দরজাটার কাছে এসে পড়লো। আধ খোলা দরজা, কবাটে ধাক্কা দিয়ে আরেকটু ফাঁক করলো ও, তারপর পা রাখলে খালি মেসহলে। রান্নাঘরে গুনগুন করে জনপ্রিয় গানের সুর ভাজছে কেউ একজন। লিনডা? রান্না ঘরের দরজায় এসে উঁকি দিলো কলিন, বাবুর্চি আলু কাটছে আর গান গাইছে। ওর কোমরে পিস্তল দেখলো না কলিন, আপনমনে কাজ করছে।

বাবুর্চিকে বিরক্ত না করে ভবনের মূল অংশের দিকে পা বাড়ালো কলিন। একটা নাতিপ্ৰশস্ত ডাইনিং রুম হয়ে পারলারে এলো ও, কেউ নেই, জানালায় পর্দা টানানো। লিনডা কোথায়? এখনো ঘুমে? লিনডার শোবার ঘর চেনা, সেদিকে এগোলে। কলিন। দরজা খুলে ভেতরে তাকালো।

বিছানাতেই পাওয়া গেল লিনডাকে, জেগেই আছে, উবু হয়ে শুয়ে পত্রিকা পড়ছে।

হ্যালো, লিনডা, আস্তে করে বললো কলিন। চমকে সোজা হয়ে বসলো লিনডা।

তুমি। ঢোক গিলে বললো সে।

হ্যাঁ। আবার এলাম।

ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে চৌকাঠের সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাড়ালে কলিন। দাড়ি কামিয়েছে সেই গতকাল সকালে, গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পরনে ধুলো মলিন পোশাক, কেমন দেখাচ্ছে খোদা মালুম। অবশ্য পুরুষের এ-চেহারা লিনডার অপরিচিত নয়। কাউবয়রা প্রতিদিন শেভ করে, এমন ঘটনা বিরল।

তোমাকে এখানে পেলে ঠিক খুন করে ফেলবে। ফাঁসফেসে গলায় বললো লিনডা। নিজেকে সামলে নিয়েছে সে ইতিমধ্যে, আঙুল দিয়ে একগোছা চুল প্যাচাচ্ছে। কি বললাম শুনেছো? জানতে চাইলো এবার।

নিশ্চয়ই, বললে কলিন, কিন্তু তার আগেই আমরা পালাচ্ছি।

আমরা? বিস্ফারিত চোখে তাকালো লিনডা।

কেন নয়? বললো কলিন, পাঁচশো ডলার জোগাড় করার কথা বলেছিলে না? টাকা নিয়েই তো এসেছি।

পকেট থেকে টাকার বানডিলটা বের করলো কলিন, ছুড়ে ফেললো বিছানায়।

হাত বাড়াতে গিয়েও থমকে গেল লিনডা, এক ঝটকায় সরিয়ে নিলো হাতটা। আমি–কোথায় পেলে এত টাকা?

ভয়ের কিছু নেই, বললো কলিন, চুরি করিনি। তোমার ইচ্ছে পূরণ হতে যাচ্ছে এবার, কি বলো? ক্যানসাস সিটিতে ফিরে যাওয়া এখন আর সমস্যা নয়।

ঝিম মেরে বসে রইলো লিনডা, আঙুলের বিয়ের আঙটিটা ঘোরাতে লাগলো আনমনে।

সেদিন আসলে কথার কথা বলেছিলাম, কিন্তু এখন হাত দুটো এক করে কোলের ওপর রাখলে লিন, এখন পালানো ছাড়া গতি নেই আমার। নইলে ওরা–

কি করবে, লিনডা?

থাক, এই প্রসঙ্গে কথা বলতে চাই না। কিভাবে যাবো, বলো?

র‍্যাঞ্চে এখন মোট কজন আছে?

বাবুর্চিকে ধরলে তিনজন।

তোমাকে আটকানোর চেষ্টা করবে ওরা?

হ্যাঁ, করবে। কারণ আমার ঘর ছেড়ে বের হওয়া নিষেধ।

লিনডা হঠাৎ পালানোর জন্যে খেপে উঠেছে কেন বোঝার চেষ্টা করলো কলিন। কিন্তু এখন জিজ্ঞেস করার সময় নেই। দরজা খোলার অস্পষ্ট শব্দ পেয়েছে ও। চরকির মতো ঘুরলো কলিন। লম্বা, চওড়া কাঁধঅলা এক তরুণ, বাংক হাউসে ঢুকেছিলো যে, পারলারে পা রাখছে।

শোবার ঘরে ঢোকার আগে টুপি খুলে ফেললে লোকটা। মিসেস ওয়ারেন, তার কণ্ঠে উদ্বেগ, একটা কথা ছিলো।

চোখের আড়ালে যাবার ফুরসতই পেলো না কলিন। দাড়িয়ে রইলো লোকটা কখন ওকে দেখবে তার অপেক্ষায়। সতর্ক।

শোবার ঘরের দরজার দিকে ঘুরলে লোকটা, বিস্ময়ে বিস্ফারিত হলে তার চোখ, টুপি ফেলে পাগলের মতো পিস্তলের দিকে হাত বাড়ালো।

সে পিস্তল তুলে আনতেই ড্র করলো কলিন, টিপে দিলো ট্রিগার। ওর কাঁধের পাশ দিয়ে সই করে গিয়ে দেয়ালে বিধলে প্রতিপক্ষের বুলেট। ঝট করে হাঁটু ভেঙে বসে পড়লো কলিন, ফের গুলি করার জন্যে প্রস্তুত। কিন্তু দীর্ঘদেহী গানম্যান যেন বাতাসে ঝুলছে এখন, অনড়, ছাদের সঙ্গে অদৃশ্য সুতোয় যেন বেঁধে দিয়েছে কেউ। এক মুহূর্ত। পায়ের পাতার ওপরই আধপাক ঘুরলো সে, তারপর আচমকা যেন ছিড়ে গেল অদৃশ্য সুতো, দড়াম করে মেঝেতে আছড়ে পড়লো।

আর্তনাদ করে ছুটে এলো লিনডা। টমি। টমি! মৃত গান ম্যানের পাশে বসে পড়লো, কান্নার মতো শব্দ বেরিয়ে আসছে তার গলা চিরে।

রান্নাঘর থেকে রাইফেল বাগিয়ে ঝড়ের বেগে তেড়ে এলো বাবুচি ছোড়া। সাথে সাথে তাকে কাভার করলো কলি।

ফেলে দাও ওটা, রাইফেলের দিকে ইঙ্গিত করে বললো কলিন। এক চুল নড়বে না! মাথার ওপর তোল দুই হাত।

বারান্দায় পায়ের আওয়াজ। একটা ছায়া সরে গেল দরজা থেকে। ঝট করে তাকালে কলিন। কেউ নেই। অন্য লোকটা বোধ হয়, আন্দাজ করলো ও। দ্রুত দরজার দিকে পা বাড়ালো। কিন্তু দোরগোড়ায় পৌঁছুনোর আগেই ওয়াগোনারের দিক থেকে তীক্ষ্ণ চিৎকার ভেসে এলো। মানে পরিষ্কার। তৃতীয় লোকটা সাহায্যের আশায় দ্রুত কেটে পড়েছে। বাইরে তাকালো কলিন। অপস্রুয়মান একটা ঘোড়ার স্যাডলে ঝুঁকে থাকা সওয়ারীর কাঠামো দেখতে পেলো।

আবার বাবুর্চির দিকে চোখ ফেরালে কলিন ফোর্বস। মাথার ওপর হাত তুলেই দাড়িয়ে আছে, বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে কপালে, ভীত। লিনডার দিকে তাকালো কলিন। নিহত কাউহ্যানডের পাশেই বসা সে।

পেটের ভেতর পাক দিয়ে উঠলো কলিনের, মনে হলো বমি করে দেবে। দ্রুত কয়েক বার নিঃশ্বাস নিলো ও। একটু ভালো লাগলো তাতে। আবার একটা খুন করলো ও, হত্যা করতে বাধ্য হলো।

এখন আর ওর পক্ষে সরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না।

<

Super User