খবর আনতে আবার বেরিয়ে গিয়েছিল রবার্ট অ্যালেন। কিছুক্ষণ পরই ফিরে এল সে, জানাল তালিকায় নাম আছে এমন বাইশজন পুরুষ আর পাঁচজন নারী শহর ছেড়ে চলে গেছে। তবে জমজমাট ব্যবসা ছেড়ে এক চুল নড়েনি জ্যাক চেম্বারল্যান্ড।

ওরা তোমার জন্যে অপেক্ষায় আছে, ড্যান, বলল কার্টিস। এটা যে একটা ফাঁদ নিশ্চিত জানি আমি। তোমার হয়ে বরং আমিই যাই। রাইফেল ভাল চালাই আমি, তাছাড়া আমাকে আশা করছে না ওরা।

মাথা নাড়ল লসনু। তা হয় না, টিম। ধন্যবাদ তোমাকে। এ আমার কাজ, আমিই করব।

প্রায় আধ-ঘণ্টা লাগল তৈরি হতে। সারা শরীরে ব্যথা, আড়ষ্ট পেশী আর সন্ধিগুলো নড়তে চাইছে না। একটু নড়াচড়া করলেই হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছে লসন। হাতের আঙুলগুলো নাড়াচাড়া করল ও, আড়ষ্ট রয়ে গেছে এখনও। সামনে

অনেক দায়িত্ব পড়ে রয়েছে-এ ভবনাই খানিকটা সুস্থ করে তুলল ওকে।

এক ফাঁকে জো হারপার এসে জানাল লুকিয়ে আবার শহরে ঢুকেছে বেনি ডবিন আর শেইন থমসন। চেম্বারল্যান্ডের বারে গিয়ে ঢুকেছে। শুনেই খেপে গেল লসন।

বাড়তি কার্তুজ আর শটগান নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ও। পোর্চে বেরিয়ে আসতে দেখল দূরে জেনারেল স্টোরের পাশের গলিতে সেঁধিয়ে গেল একজন, লঅফিসের ওপর নজর রাখছিল নিশ্চয়ই। ব্যাপারটা গ্রাহ্য করল না লসন। হাঁটতে হাঁটতে ডিক ফেল্টনের অফিসের সামনে এসে দাঁড়াল ও, সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলল কিছুক্ষণ। শেষে শহরের একমাত্র রেস্তোরাঁ বু লেগুন-এ ঢুকে পড়ল। জানালার পাশে একটা টেবিল দখল করে কফির ফরমাশ দিল,জেরেমি টাউনের দীর্ঘ মূল রাস্তা আর বেশ কিছু বাড়ি চোখে পড়ছে এখান থেকে। টিম কার্টিসকে দেখতে পেল ও, জ্যাক চেম্বারল্যান্ডের সেলুন থেকে বেরিয়ে আসছে। রাস্তায় কিছুক্ষণ পায়চারি করল সে, তারপর আবারও ঢুকে পড়ল সেলুনে।

স্মিত হাসল লসন। তাড়া নেই ওর, অপেক্ষা করুক থমসনরা। কফিটা বেশ ভাল, উপভোগ করছে ও। নিজেকে ক্রমশ সুস্থ মনে হচ্ছে।

থমসন, ডবিন এবং রক্স, তিনজন ভয়ঙ্কর লোক, লুকিয়ে অপেক্ষা করছে ওর জন্যে। জ্যাক চেম্বারল্যান্ডও ভয়ঙ্কর, তবে লসন জানে জয়ের ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে পিস্তলে হাত দেয় না সে। কোরি মার্টিন আছে যখন, তখন এলি থমাসও থাকবে। তবে কিনকেড আর ওর চেলা জেস হার্কার নাও থাকতে পারে। হয়তো পুরোটাই জানে তারা, কিন্তু এটা যেহেতু ওদের ব্যাপার নয় সেহেতু দূরে থাকবে ওরা।

আরেক কাপ কফির অর্ডার দিল লসন।

সেলুনের সামনে আরেকজনকে দেখা যাচ্ছে এখন। লোকটাকে চিনতে পারল লসন-মাইক অ্যান্ডারস। নির্দিষ্ট কোন পেশা নেই তার। কখনও ছিচকে চোর, কখনও রাসলার, আবার জুয়ার টেবিলে ধান্ধাবাজ হিসেবেও দেখা গেছে তাকে। লসন বুঝতে পারল ওর ওপর নজর রাখার জন্যে পাঠানো হয়েছে লোকটাকে।

এদিক-ওদিক তাকাল অ্যান্ডারস, হোটেলের দিকে এগিয়ে আসছে। সতর্ক, মাপা দৃষ্টি চোখে। লসনকে হোটেলের ভেতরে দেখে থমকে দাঁড়াল মুহূর্তের জন্যে, তারপর এমন ভাব করল যেন দৈখতেই পায়নি। নিতান্ত খামখেয়ালিপনার সঙ্গে ভেতরে ঢুকল সে, লসনের তিন-চার টেবিল দূরে বসল। কফি আর পাইয়ের ফরমাশ দিল চড়া গলায়।

মিনিট পাঁচ পরেই ঢুকল হ্যান্স কোবার্ন। হাসি হাসি মুখ সোনা ব্যবসায়ীর। লসনের উল্টোদিকের চেয়ারে বসল সে, তবে আড়চোখে দেখে নিয়েছে মাইক অ্যান্ডারসকে।

কফিটা চমৎকার। দারুণ লাগছে, হালকা সুরে বলল লসন। শহরের দায়িত্ব নেওয়ার পর এই প্রথম স্বস্তি বোধ করছি আমি। খানিকটা ঝুঁকে এসে নিচু কণ্ঠে যোগ করল, ভান করল যেন কাউকে শুনতে দিতে চায় না। এবার নিশ্চিন্তে আক্রমণ করতে পারব। রাস্তার ওপাশে আমাদের ছেলেরা তৈরি আছে তো?

বুঝে নিল সোনা ব্যবসায়ী। হ্যাঁ। তৈরি সবাই।

বেশ, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল! যাকগে, সোনা কেমন তুলছ তোমরা?

ভালই।

বিভিন্ন বিষয়ে কিছুক্ষণ কথা বলল ওরা। কার্ল ব্রেনেট এসেছে, এক ফাঁকে জানাল কোবার্ন। বিশালদেহী আরও এক লোক এসেছে শহরে, মুখে লম্বা একটা দাগ ওর। বলল তোমার কাছে এসেছে। পাহাড়ের একটা বাথানে নাকি থাকে ওরা।

এবার সত্যিই স্বস্তি বোধ করল লসন। ভুল হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই, এ নিশ্চয়ই ম্যাট হিগিন্স। ওদের ফোরম্যান। পিস্তলে দারুণ চালু, বিশ্বস্ত এবং লড়াকু লোক। নিশ্চয়ই বাবা পাঠিয়েছে ওকে, আনমনে ভাবল লসন।

কফি শেষ করে উঠে পড়ল অ্যান্ডারস। কি এক তাড়ায় পেয়েছে যেন তাকে, দ্রুত বেরিয়ে গেল।

হোটেলের পেছন দরজা দিয়ে বেরোল লসন। দ্রুত পায়ে এগোচ্ছে। খোলা জায়গায় আবর্জনা আর উচ্ছিষ্ট পড়ে আছে। বিভিন্ন দালানের পেছন দিক দিয়ে ও যখন জ্যাক চেম্বারল্যান্ডের সেলুন ব্লু মাইন্টেন-এর পেছন দরজায় পৌঁছল সবে তখন সামনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকেছে মাইক অ্যান্ডারস।

ও তো বসে বসে আয়েশ করে কফি খাচ্ছে, অ্যান্ডারসের কন্ঠ শুনতে পেল লসন। তবে ওর বোধহয় একটা পরিকল্পনা আছে। শুনলাম কার্ল ব্রেনেট আর মাট হিগিন্স এসেছে শহরে।

মানে? খেঁকিয়ে উঠল চেম্বারলান্ড।

কয়েকজন নাকি সশস্ত্র অবস্থায় অপেক্ষা করছে তার ওপাশে। কার্ল ব্রেনটকে তো চেনাই, ভারতের বিখ্যাত গানফাইটার। আর হিগিন্সের কথা আগেও শুনেছি আমি, বহু দিন ধরে লাপাত্তা ছিল। এতদিন বোধহয় পাহাড়ে লুকিয়ে ছিল।

ম্যাট হিগিন্স? সন্দিহান সুরে বলল ডধিন। একমর আউট-ল ছিল হারামজাদা। এখন বোধহয় পাহাড়ের ওপাশে যে বাথানটা আছে, ওখানে কাজ করে। ঝামেলা, জ্যাক, হিগিন্স কঠিন লোক। অরিগনে একবার…

লসন কি পরিকল্পনা করেছে বুঝতে পেরেছ? জিজ্ঞেস করল রক্স, প্রায় উপেক্ষা করল ডবিনকে, হিগিন্সের দুঃসাহসিকতার ফিরিস্তি দেয়ার সুযোগ দিল না।

জানালার পাশ থেকে উঁকি দিল লসন। দুজনকে দেখা যাচ্ছে। এদেরকে আত্মসমর্পণ করতে বলে লাভ নেই, মরে গেলেও তা করবে না কেউ। সুতরাং লড়াই ছাড়া বিকল্প নেই। ঝটিকা আক্রমণ করতে হবে, নইলে এতগুলো দক্ষ লোকের বিরুদ্ধে টিকতে পারবে না ও।

অ্যান্ডারস উত্তর দেয়ার আগেই সবাইকে চমকে দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল লসন। দরজা খোলার শব্দে মুখ তুলে তাকাল সবাই।

স্মিত হাসি লসনের ঠোঁটে। আমার পরিকল্পনা হচ্ছে… বলেই বেনি ডবিনের উদ্দেশে প্রথম গুলিটা করল ও, কারণ ভবিন গুলি খেয়ে পড়লে থমসনের ওপর পড়বে, তাতে লক্ষ্য স্থির করতে অসুবিধে হবে বিশালদেহী গানম্যানের। ডবিনের পেট বরাবর গুলি করল ও, শটগানের দ্বিতীয় গুলিতে ফেলে দিল কার্ট রক্সকে।

পরমুহূর্তে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল লসন, যাতে টার্গেট হিসেবে অন্যদের কাছে নিজে ছোট হয়ে যায়। আঙুলগুলো আড়ষ্ট হয়ে আছে এখনও, তবু সহজেই হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করে ফেলল। থমসনের প্রথম গুলি এক চুলের জন্যে মিস করেছে ওকে, ধীরে সুস্থে এবার বিশালদেহীর পেট বরাবর একটা গুলি পাঠিয়ে দিল লসন।

মেঝেয় শুয়ে পড়েছে অ্যান্ডারস। আমার কাছে পিস্তল নেই! সমানে চেঁচাচ্ছে সে। কথাটা বিশ্বাস করল লসন, কারণ বিশ্বাস করতে ভাল লাগছে ওর, তাহলে অন্তত একজনকে নিয়ে ভাবতে হবে না। জ্যাক চেম্বারল্যান্ডের উদ্দেশে গুলি করল ও এবার, কিন্তু অবচেতন মন যেন সতর্ক করে দিয়েছে সেলুন-মালিককে; শেষ মুহূর্তে বিপদ বুঝতে পেরে বারের পেছনে বসে পড়েছে সে।

মুহূর্তের মধ্যে হোলস্টারে পিস্তল ভরে রেখে শটগানে নতুন কার্তুজ লোড করল লসন। বহুবার এ কাজ করেছে ও, সেজন্যে সময় লাগল কম। শটগানে গুলি ভরে উঠে দাঁড়াল এবার, চারপাশে শ্যেনদৃষ্টি চালাল।

কোন সুযোগই পায়নি বেনি ডবিন। কিন্তু রক্স আরেকটু হলে ফেলে দিয়েছিল ওকে। প্রায় একইসঙ্গে গুলি করেছে ওরা, তবে লসন খানিকটা আগে করেছে বলেই রক্ষা পেল। বাহুতে একটা জোরাল টান অনুভব করল ও, দেখল হাঁটু ভেঙে মেঝেয় পড়ে যাচ্ছে কাট রক্স। ব্যথায় কুঁকড়ে গেছে মুখ, কিন্তু তারপরও পিস্তল তোলার চেষ্টা করছে। মারা যায়নি থমসনও। চোখের পলকে একপাশে সরে গেল সে, হাতে উদ্যত পিস্তল।

চুলচেরা হিসেব করার উপায় নেই, কিংবা নিশানা করারও সময় নেই এখন। চোখের পলকে গুলি করল লসন। সামান্য নড়ে যাওয়ায় বুকে না লেগে থমসনের গলায় লাগল গোলা। মুহূর্তে একটা গর্ত হয়ে গেল, চোখে অবিশ্বাস নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল বিশালদেহী, তারপর দড়াম করে আছড়ে পড়ল কাঠের মেঝেয়।

এবার কার্ট রক্সের দিকে মনোযোগ দিল লসন। সুযোগ একটা সে ইতোমধ্যে পেয়েছে বটে, কিন্তু তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে মিস করেছে। কপালে ত্রিনয়নের সৃষ্টি হতে হাঁটু ভেঙে মেঝেয় পড়ে গেল সে। আর উঠল না।

তিন পা এগিয়ে কোরি মার্টিনের হাতের নাগাল থেকে পিস্তলটা লাথি মেরে সরিয়ে দিল লসন। শটগানের নল চেপে ধরল তার গলায়। এক মুহূর্ত পরস্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল ওরা। ট্রিগারে সামান্য চাপ পড়লেই শেষ হয়ে যাবে মার্টিন। কিন্তু আত্মসমর্পণের কোন চিহ্নই নেই লোকটার মুখে। অপেক্ষা করছ। কেন, লসন? চেঁচিয়ে উঠল সে। গুলি করো! মৃত্যু পাওনা হয়েছে আমার।

না, মাটিনের ভাঙা ডান হাতের দিকে ইঙ্গিত করল লসন। গানম্যান হিসেবে কোন দিন আর দাঁড়াতে পারবে না তুমি। এ শহর থেকে চলে যাও, মার্টিন, অন্য কোথাও গিয়ে ভাল মানুষ হওয়ার চেষ্টা করো। তবে নামটা বদলে নিয়ো আর এমন ভাব কোরো যেন পিস্তলের নামই শোনোনি কোন দিন।

জ্যাক চেম্বারল্যান্ডের দিকে ফিরল ও এবার, যদিও পুরো সময়টাই চোখের কোণ দিয়ে লক্ষ্য রেখেছে তার দিকে। কাউন্টারে দুহাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে সে, চোখে-মুখে আতঙ্ক। বোঝাতে চাইছে লড়াইয়ে ছিল না, এবং এ লড়াইয়ের কিছুই জানে না।

দুপা এগিয়ে সেলুন মালিকের মুখোমুখি হলো লসন। চলে যাওয়ার একটা সুযোগ দিয়েছিলাম তোমাকে, জ্যাক। সুযোগটা নাওনি তুমি।

বোকামি হয়ে গেছে, ড্যান।

সত্যিই বোকা তুমি! শটগান তুলল লসন, তারপর সজোরে বঁটটা নামিয়ে আনল জ্যাক চেম্বারল্যান্ডের মুখে।

তাল হারিয়ে পিছিয়ে গেল বার-মালিক টলছে মৃদু মৃদু, মুখের একপাশ থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করেছে।

আঙুল তুলে দরজাটা দেখাল লসন। রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে, জ্যাক। জলদি কেটে পড়ো। আমার মত বদলে যাওয়ার আগেই চলে যাও শহর ছেড়ে।

আমার মালপত্র…জিনিসপত্র গোছাতে হবে।

গতকাল তোমাকে সেই সুযোগ দিতাম। কিন্তু আজ দেব না। জলদি!

সামান্য দ্বিধা করল সেলুন-মালিক, কিন্তু লসনের চোখের দিকে তাকাতে সমস্ত সংশয় মুহূর্তে দূর হয়ে গেল। দরজা দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে গেল সে। মাথা নিচু করে হাঁটছে, কিন্তু মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তলে তলে অসন্তোষ আর প্রতিহিংসায় জ্বলছে।

ওকে এভাবে চলে যেতে দিলে? দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে টিম কার্টিস।

হ্যাঁ, যদি এবার শিক্ষা হয়।

ততক্ষণে মোটামুটি ভিড় জমে গেছে। সেই ভিড়ের সুযোগে সটকে পড়ছিল মাইক অ্যান্ডারস। তাকে থামাল লসন। ভুল পথে পা বাড়িয়েছ তুমি, মাইক। এ পথ তোমার নয়। আরেকটু হলে মারা পড়তে আজ।

হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হচ্ছে।

বারের ওপর থেকে চাবির গোছা তুলে নিয়ে তার দিকে ছুঁড়ে দিল লসন। একটা কাজ দিচ্ছি তোমাকে। থমসন, রক্স আর ডবিনকে কবর দেবে, ফলক লাগাবে কিন্তু। সবার কবরেই ফলক থাকা উচিত। ফিরে এসে লকার খুলবে, যা পাবে সবই তোমার। তারপর কেটে পড়বে এখান থেকে, ভুলেও এদিকে এসো না আর।

ইতস্তত করছে সে। পয়সা নেব?

নেবে। জ্যাকের অধিকাংশ টাকাই চুরির। ওই টাকা দিয়ে নতুন পোশাক কিনবে আর দ্র ভাবে বাঁচার চেষ্টা করবে।

ক্লান্ত বোধ করছে লসন। লাশ তিনটে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে মাইক অ্যান্ডারস। ইতোমধ্যে একজন সহকারী জুটে গেছে ওর। ভিড় কমে যাচ্ছে।

শটগান আর পিস্তল রিলোড করে সেলুন থেকে বেরিয়ে এল লসন। অনুভব করছে আবার অসাড় হয়ে যাচ্ছে আঙুলগুলো, বিশ্রাম চাইছে শরীর, কিন্তু সচেতন একটা স্পৃহা কাজ করছে এখনও। কিনকেড…জেসি ওয়েন…এলি থমাসের মত ডজন খানেক হিংস্র মানুষ রয়ে গেছে এখনও।

সে কি খুন করতে ভালবাসে?

কফিতে চুমুক দিতে দিতে ভাবছে ড্যানি লসন। ভালবাসে কি?

না।

অ্যান্ডারস আর চেম্বারল্যান্ডকেও মেরে ফেলতে পারত। অ্যান্ডারস ছেলেটা হয়তো তত খারাপ নয়, সঙ্গ দোষে বখে গেছে। ভাল হওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে এখনও। সেজন্যেই ছেড়ে দিয়েছে তাকে। কিন্তু চেম্বারল্যান্ডকে ছাড়ল কেন?.সে তো চোর আর খুনী। পশ্চিমে নতুন আসা বহু লোকের সর্বনাশ করেছে, এ ধরনের শহরে সবসময়ই দেখা যায় তাকে। আর আছে সীমান্তে অবৈধ ব্যবসা। তাহলে কেন চেম্বারল্যান্ডকে খুন করল না?

আসলে খুন করতে অপছন্দ করে সে। কিন্তু ওর গুলিতে যারা মারা গেছে, তাদের জন্যে কি কখনও দুঃখ বোধ করেছে কিংবা অনুশোচনা হয়েছে? হ্যাঁ, অ্যান্ডারসের মত মাথা গরম অবুঝ ছেলেরা খুন হলে দুঃখ পায় লসন, মনে হয় শুধু পরিস্থিতির শিকার হয়ে মারা গেল এরা। কিন্তু বিগ থমসন, বেনি ডবিন কিংবা কার্ট রক্সের মত লোকের জন্যে বিন্দুমাত্র দুঃখ নেই ওর। এরা বয়স্ক, অভিজ্ঞ, জেনে-শুনেই ঝামেলা পাকায়। মানুষের সর্বনাশ করে আনন্দ পায় ওরা। একমাত্র মরে গেলেই এদের গুণ্ডামি শেষ হয়।

ভাল লাগে না, মনে মনে স্বগতোক্তি করল লসন, ভাল লাগে না এসব! কিন্তু দায়িত্ব বা কর্তব্য থেকে এক চুল সরে আসার উপায় নেই। কে কি ভাবল, কিংবা কি বলল তাতে কিছুই আসে-যায় না ওর। পরিস্থিতির বিচারে কি করা উচিত, নিশ্চিত জানে লসন, এবং তাই করবে। এক চুল টলাতে পারবে না কেউ।

আর হয়তো দুতিনটে দিন, ভাবল সে, তারপরই সবকিছুর নিষ্পত্তি হবে। প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে ওর। তখন কি করবে? পাহাড়ের কোলে নয়ন জুড়ানো একটা বাথান ভেসে উঠল ওর মানসপটে, আলো-ছায়ায় ঘেরা এক উপত্যকা…গভীর প্রশান্তি নিয়ে একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে ও, পাশেই অপূর্ব সুন্দরী এক নারী…। মনে মনে একচোট হাসল লসন। অদ্ভুত ধারণাটা ইদানীং শাখা গজাচ্ছে মনের গভীরে, অথচ কদিন আগেও এ ধরনের চিন্তা আসেনি মাথায়।

ঝেঁটিয়ে চিন্তাটা তাড়িয়ে দিল লসন। কল্পনার ফানুস ওড়ানোর সময় নয় এটা, সামনে কঠিন সময়। কিনকেড আর জেসি ওয়েন রয়ে গেছে এখনও। সহজ পাত্র নয় এরা।

জেসি ওয়েনের ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না লসন। আসলে কি চাইছে লোকটা? জেরেমি টাউনে পড়ে আছে কেন? সরাসরি কিছু করেনি সে, স্রেফ পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে যেন। তালিকায় রাখা যায়নি তাকে, কারণ এখানে আসার পর এমন কিছুই করেনি যে ওকে দোষারোপ করা যাবে। বরং কিছু কিছু মানুষের উপকারই করেছে সে। অথচ লসন নিশ্চিত জানে লাভের আশা ছাড়া এক দণ্ড এখানে থাকার কথা নয় লোকটার। কার্ল ব্রেনেটকে হয়তো সে-ই ভাড়া করেছে। একবার ব্যর্থ হয়ে হাল ছেড়ে দেয়ার কথা নয় তার, কে জানে হয়তো আরেকটা সোনার চালানের অপেক্ষায় আছে!

কি ব্যাপার, মার্শাল, শুধু কফি খেলেই চলবে? পরিচিত কণ্ঠে সংবিৎ ফিরে পেল লসন। কাউন্টির সবচেয়ে গরম শহর জেরেমি টাউন, অথচ এখানকার মার্শাল দেখছি দিব্যি কফি গিলে খুনে-বদমাশদের তাড়াচ্ছে!

চোখ তুলে তাকাল লসন। কার্ল ব্রেনেট।

স্মিত হাসছে ব্রেনেট, এগিয়ে এসে টেবিলের সামনে দাঁড়াল। লসন ইঙ্গিত করতে উল্টোদিকের একটা চেয়ার দখল করল। মনে হচ্ছে হুট করে এখানে চলে এসে ভুল করিনি, নিজ থেকেই মুখ খুলল সে। আর কিছু না হোক তোমার কাজকর্ম দেখে মজা তো পেয়েছি। আহ্, যেভাবে পেটালে থমসনকে! সাহস আছে তোমার, ড্যান, চেম্বারল্যান্ডের সেলুনে যেভাবে হানা দিলে…

এখানে এসেছ কেন? মগে কফি ঢালার সময় বাধা দিয়ে জানতে চাইল লসন।

থমকে গেল ব্রেনেট, ধীরে ধীরে গম্ভীর হয়ে গেল মুখটা। চাকুরি গেছে আমার, লিয়ন সিটিতে আমার কাজ-কারবার পছন্দ হয়নি বস্‌দের। হাতে কাজ না থাকায় ভাবলাম এখানে এলে হয়তো একটা পেয়ে যাব।

ওরা নিজেরা নেমে পড়লেই পারে!

মৃদু হাসল ব্রেনেট। শুনেছি বেশ কিছু মারদাঙ্গা লোক জোগাড় করেছে কিনকেড। জেসি ওয়েন যোগ দিয়েছে ওর সঙ্গে। ওর চেলা এলি থমাসকে চেনো তো? এগারোটা খুন করেছে ও। ওদের মতে আমি কম হিংস্র, তাই চায় না আমাকে। থমাসের মত লোক দরকার ওদের।

ব্রেনেটকে কফি পরিবেশন করল লসন। তোমার আসল উদ্দেশ্যটা কি, বলো তো?

কাজ খুঁজছি।

শহরের বাইরে, বাথানের কাজ করবে?

ইচ্ছে আছে, কিন্তু এ মুহূর্তে জেরেমি টাউন ছাড়ছি না, কফিতে চুমুক দিয়ে চিন্তিত স্বরে বলল ব্রেনেট, মনে মনে লসনের প্রস্তাবটা বিবেচনা করছে। তাহলে সব মজা মিস হয়ে যাবে। পরে না হয় প্রস্তাবটা ভেবে দেখব।

সিগারেট রোল করে ব্রেনেটকে অফার করল লসন, তারপর স্থির দৃষ্টিতে নিরীখ করল গানম্যানকে। যে উদ্দেশ্য নিয়েই এসে থাকো, কার্ল, আমার পথে যেন তোমাকে দেখতে না পাই। ভাল মানুষ হিসেবে যদি থাকতে চাও, আপত্তি নেই আমার, কিন্তু…

আরে, খেপে যাচ্ছ কেন! ঝামেলা করতে এখানে আসিনি আমি। বরং পারলে তোমাকে সাহায্য করতে চাই।

কেন?

খানিক দ্বিধা করল ব্রেনেট, আনমনে সিগারেট ফুকছে। দৃষ্টি লেগে আছে ওপাশের দেয়ালে। আমার মত মানুষদের ন্যায়-অন্যায় বোধ কম, ড্যান। আগপাছ ভেবে কাজ করিনি কখনও, যখন যা মনে ধরেছে তাই করেছি। কিন্তু ইদানীং মনে হচ্ছে সত্যিই বোধহয় ধার কমে গেছে আমার। একটা বয়স হলে সবাই বোধহয় শ্লথ হয়ে পড়ে। পিস্তলের কথা বোঝাচ্ছি। আচ্ছা, ড্যান, কখনও কি ভেবেছ কিভাবে মারা যাবে তুমি?

প্রশ্নটা থমকে দিল লসনকে, স্থির দৃষ্টিতে গানম্যানের দিকে তাকিয়ে থাকল। ও উত্তর দেয়ার আগেই খেই ধরল ব্রেনেট।

ভাবোনি, তাই না? কিন্তু আমি জানি, পিস্তলবাজ পিস্তলের গুলিতেই মরে। হাজারটা উদাহরণ দেয়া যাবে। এটাই পশ্চিমের রীতি, চাইলেও এড়াতে পারব না আমরা। কিন্তু ইদানীং আমার মনে হচ্ছে অন্তত চেষ্টা তো করতে পারি। ভাবছি সবকিছু ছেড়ে দিয়ে সাধারণ একটা জীবন বেছে নেব কিনা।

বেশ তো।

জীবনের সমস্ত সঞ্চয় নিয়ে এসেছি আমি। ভাবছি একটা স্টোর খুলব। জেফরি হ্যালার্ডের কাছ থেকে অনুমতিও পেয়েছি।

অনুমতি ছাড়াই শুরু করতে পারো। এমন কোন নিয়ম করেনি হ্যালার্ড। ইচ্ছেমত ব্যবসা শুরু করতে পারে যে কেউ, কেবল ঝামেলা না করলেই হলো।

কিন্তু আমি ভাবছি আরও কদিন পরে শুরু করব। ঝামেলাটা শেষ হোক, শহরটা শান্ত হলে… কথাটা শেষ করল না সে, লসনের মত সেও যেন এই শহরে টিকে থাকার সম্ভাবনা সম্পর্কে সন্দিহান। তবে আশান্বিত নিশ্চয়ই, নইলে এখানে থিতু হওয়ার চিন্তা করত না।

জানালা দিয়ে বাইরের রাস্তায় চোখ বুলাল লসন, সন্ধে হয়ে এসেছে প্রায়। শহরের পশ্চিমে পাহাড়ের পেছনে ডুব দিচ্ছে সূর্য, পাহাড়ের বিপরীতে উজ্জ্বল আভা তৈরি হয়েছে দিগন্তে। আরেকটা ঘটনামুখর রাতের শুরু, আনমনে ভাবল ও, কে জানে কাল সূর্যোদয় দেখার সৌভাগ্য হবে না কার!

উঠে দাঁড়িয়ে মাথায় হ্যাট চাপাল ব্রেনেট। ব্লু লেগুনের ধারে-কাছে পাবে আমাকে, ড্যান। দরকার পড়লে জানাতে দ্বিধা কোরো না। আমার পক্ষে যতটা সম্ভব…কেন.এখানে এসেছি, তোমার প্রশ্নের আরেকটা উত্তর আছে কিন্তু। সবারই অহঙ্কার থাকে, সেটা শেষ হয়ে গেলে তার অস্তিত্বই থাকে না। কিনকেড আমাকে ঘুণাক্ষরেও জানায়নি কাগজ বলতে আসলে কিছু নিরীহ মানুষের ক্লেইমের দলিল হাত করতে হবে। স্টেজে গার্ড হিসেবে তুমি থাকছ, সেটাও বলেনি। বোঝ তাহলে অবস্থা, স্রেফ আমাকে খুন হওয়ার জন্যে পাঠিয়েছিল ও! ভাগ্যিস পিস্তলে হাত দেইনি, নইলে নাচেজের মতই অবস্থা হত আমার মজুরি তো দেয়ইনি, উল্টো ভীতু বলে গালাগাল: করেছে আমাকে, থেমে জানালা দিয়ে শহরের দিকে তাকাল গানম্যান, প্রতিজ্ঞায় দৃঢ় হয়ে গেছে চোয়াল দুটো। সুযোগ পেলে সেই অপমানের শোধ আমি নেব!

আনমনে নড করল লসন। হঠাৎ করেই সিদ্ধান্তটা নিল। প্রয়োজনে পাশে পাবে একে, নিশ্চিত জানে ও, মিথ্যে বড়াই করেনি কার্ল বেনেট। এখনই তার সাহায্য নিতে অসুবিধে কি?

আমার ডেপুটি হবে নাকি, কার্ল? আচমকা শুধাল ও।

চলে যেতে উদ্যত হয়েছিল, ব্রেনেট, ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল। স্পষ্ট অবিশ্বাস তার চোখে, তারপর মুহূর্তে উজ্জ্বল হয়ে গেল মুখ। কাজটা অবশ্য আগেও করেছি, কিন্তু ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি তোমার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাব, ড্যান। তুমি আমাকে যোগ্যতার চেয়ে বেশি সম্মান দিচ্ছ! শহরের লোকেরা আপত্তি করতে পারে, আমার কুখ্যাতি সম্পর্কে কম-বেশি জানে সবাই।

করবে না, কারণ আমার ইচ্ছেমত এই শহর চলবে—এই চুক্তি করেই কাজটা নিয়েছি। যাকে ইচ্ছে ডেপুটি বানাতে পারি। তাছাড়া কিনকেডকে এক হাত নেওয়ার সুযোগটা হারানো কি ঠিক হবে?

স্মিত হেসে হাত বাড়িয়ে দিল ব্রেনেট। এখন মনে হচ্ছে জেরেমি টাউনে এসে মোটেও ভুল করিনি।

আরেকপ্রস্থ কফি পান করল ওরা, তারপর শহরের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করল কিছুক্ষণ। ঠিক করল টহল দিতে বেরোবে, বিপদে পড়লে কিভাবে অন্যকে জানাবে সেটা ঠিক করে নিল।

ব্যাজ ছাড়াই বেরিয়ে গেল ব্রেনেট। তার ঠিক পরপরই বেরোল লসন। বিভিন্ন জায়গায় থামল, সতর্ক চোখে লক্ষ্য করছে সবকিছু। হাঁটতে হাঁটতে সরু গলি ধরে শহরের একেবারে শেষে চলে এল, সামনেই বিশাল একটা বাড়ি। বাতি জ্বলছে না কোন কামরায়। কিন্তু আবছা অন্ধকারে মূল দরজায় একটা মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেল লসন।

সিগারেট টানছে, মেয়েটা। উল্টোদিকের বাড়ি থেকে ছিটকে আসা আলোয় মেয়েটির পরনের সিল্কের পোশাক ঝিলিক মারছে।

মেয়েটিকে চেনে লসন। থামল ও। হ্যালো, জেনি। কেমন আছ?

হ্যালো, ড্যান। ভাল। তুমি?

ভাল। তোমার পুরুষ মানুষটা কি আশপাশে আছে?

মুহূর্তের জন্যে দ্বিধা করল মেয়েটা, কালো চোখে সংশয় ফুটে উঠেছে। না, তালিকায় নাম ছিল ওর। তোমার জন্যেই ওকে চলে যেতে হয়েছে।

দুঃখিত, জেনি। কিন্তু তুমি তো জানোই ওর স্বভাব-চরিত্র কেমন।

জানি আমি! তিক্ত স্বরে বলল জেনিফার লয়েড।

তাহলে ওকে ছেড়ে দিচ্ছ না কেন? হয়তো ওর জন্যেই একদিন বড় কোন সমস্যায় পড়ে যাবে তুমি।

জানি, হয়তো তাই হবে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিগারেটে শেষ টান দিল জেনি, তারপর পায়ের কাছে ফেলে জুতোর তলায় পিষল। কিন্তু ওকে ভালবাসি আমি। ভালবাসা ব্যাপারটা কি তুমি বোঝ, ড্যান?

চুপ করে থাকল লসন, কিছুটা হলেও বিব্রত বোধ করছে। সত্যিই কি কোন ধারণা আছে ওর এ ব্যাপারে? চিন্তাটা তখনই থামিয়ে দিল লসন, একসময় বলল: হয়তো বুঝি, জেনি। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে, ভাল যখন বাসোই তাহলে ওকে ভাল করার চেষ্টা করছ না কেন?

চেষ্টা করছি, ড্যান।

তুমি খুব ভাল মেয়ে, জেনি। চারটে শহরে তোমাকে দেখেছি।

পাঁচটা। লিডভিলেও ছিলাম আমি।

ঠিক আছে, পাঁচটা। …এবং সব জায়গায় তুমি খুব শান্তিপ্রিয় ছিলে, অন্যের মঙ্গল চেয়েছ সবসময়। মনে আছে, ব্রনসনভিলে যখন কলেরা লেগেছিল, আক্রান্তদের ফেলে চলে গিয়েছিল সবাই? তুমি কিন্তু রয়ে গিয়েছিলে।

এছাড়া আর কি করতে পারতাম আমি।

রাইফেল হাত বদল করল লসন। কিন্তু সবাই তোমার মত উচিত কাজটা করেনি। …ঠিক আছে, জেনি। আপাতত বিদায়। পরে দেখা হবে আবার।।

বড় রাস্তায় ফিরে এল লসন। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থেকে সতর্ক দৃষ্টি চালাল পুরো শহরে। আজ রাতে একেবারেই শান্ত হয়ে আছে জেরেমি টাউন। সেলুন আর জুয়ার আড্ডাগুলো প্রায় ফাঁকা। কাল সকাল থেকে আবার ব্যস্ত হয়ে উঠবে শহরটা…কিন্তু তখন সে নাও থাকতে পারে…কার্ল ব্রেনেটই সব ঝুট-ঝামেলা সামাল দিতে পারবে।

আর মাত্র একটা কাজ বাকি আছে। কিনকেড আর জেসি ওয়েনকে থামাতে হবে।

ঘোড়ার তীক্ষ্ণ চিঁহি শব্দে সংবিৎ ফিরে পেল লসন, সমস্ত চিন্তা মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল। পাশ ফিরতেই গলি ধরে ছুটে আসতে দেখল একটা বাকবোৰ্ডকে, প্রাণপণে ছুটছে ঘোড়াগুলো। পঞ্চাশ গজ পেছনে গাঢ় কিছু কাঠামো দেখতে পেল লসন, চোখ কুঁচকে তাকাল ও, অন্তত বিশজন ঘোড়সওয়ার। বাকবোর্ডটাকে তাড়া করছে এরা। গলি ধরে সরাসরি বড় রাস্তার দিকে ছুটে আসছে বাকবোর্ড, বাঁক পেরোনোর সময় এক দিকে হেলে পড়ল, সজোরে ধাক্কা খেল কোনার বাড়ির দেয়ালে। হুড়মুড় করে কাত হয়ে পড়ে গেল ওটা, রাস্তায় ছিটকে পড়ল এক যাত্রী।

একজন? না…দুজন যাত্রী। উঠে বসার চেষ্টা করছে পড়ে যাওয়া লোকটা। তাকে চিনতে পারল লসন-হ্যান্স কোবার্ন।

অন্যজন…মেরী কোবার্ন। কোন্ নরকে গিয়েছিল ওরা?

দুপায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে সোনা ব্যবসায়ী। পরমুহূর্তে লসনকে দেখতে পেল, অস্ফুট স্বরে চেঁচিয়ে উঠল: ওহ, ড্যান! এখানে আছ তুমি!

ততক্ষণে এসে পড়েছে পেছনের দলটা। সবার সামনে স্যামুয়েল কিনকেড। মোটা পাকানো একটা দড়ি ঘোরাচ্ছে সে। কোবার্ন উঠে বসার চেষ্টা করতে দড়ির ফাঁস দিয়ে আটকে ফেলল তাকে। হ্যাচকা টানে সোনা ব্যবসায়ীকে ফেলে দিল রাস্তায়। এ অবস্থায় টেনে নিয়ে যাবে।

স্যামুয়েল কিনকেড, থামো তুমি! চিল্কার করল লসন।

নরকে যাও তুমি, লসন! গর্জে উঠল কিনকেড, চলে এসেছে বড় রাস্তায়, পিছু পিছু এগিয়ে আসছে অন্যরা।

বুনো জন্তুর মত ঝাপিয়ে পড়ল লসন, বুঝতে পারছে আসলে সোনা ব্যবসায়ী নয়, ও-ই তাদের টার্গেট। হয়তো এই উসিলায় জড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলতে চাইছে—ব্রেনেট, হিগিন্স কাউকেই ছাড়বে না। কিন্তু সবার আগে ওকে শেষ করতে চাইছে।

অন্ধকার থেকে গুলি ছুঁড়ল লসন। ঘোড়ার স্যাডল থেকে ছিটকে পড়ল একজন। ইতোমধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছে হ্যান্স কোবার্ন, কিন্তু হোলস্টার থেকে পড়ে গেছে ওর পিস্তল।

হ্যান্স! চেঁচাল সন।

ঝটিতি ওর দিকে ফিরল সে। তখনই নিজের বাড়তি পিস্তলটা ছুঁড়ে দিল লসন। শূন্যে সেটা লুফে নিল সোনা ব্যবসায়ী, এবং হাতের মুঠিতে আসা মাত্র গুলি করতে শুরু করল। স্যাডলশূন্য হলো এক ঘোড়সওয়ার। একই সময়ে গুলি করেছে লসন, কিন্তু স্যাডলের একপাশে হেলে পড়েছে স্যামুয়েল কিনকেড, গুলিটা তাকে স্পর্শ করল না।

কিনকেডের গুণ্ডাবাহিনী চলে এসেছে মূল রাস্তায়, সমানে গুলি ছুঁড়ছে। মুহূর্মুহু গুলির শব্দ আর গানপাউডারের কটু গন্ধে ভারী হয়ে গেল বাতাস। গুলির পাশাপাশি দড়ির ফাঁসও ব্যবহার করছে ওরা।

পিস্তলের গুলি শেষ হতে রাইফেলের দিকে হাত বাড়াল লসন। কিন্তু পজিশনে আনার আগেই একটা ফাস কেড়ে নিল রাইফেলটা। আরেক ঘোড়সওয়ার পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়ার সময় প্রচণ্ড জোরে ল্যাসো দিয়ে আঘাত করল ওর মুখে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে অন্ধ হয়ে গেল লসন। ধুলো উড়ছে সর্বত্র। চোখ পিটপিট করে দৃষ্টি পরিষ্কার করার প্রয়াস পেল ও, এক হাতে অন্ধের মত পিস্তলে গুলি ভরছে। কিন্তু ল্যাসোর ফাস ছুটে এসে পিস্তলটা কেড়ে নিল এবার। এক ঘোড়সওয়ার লাথি মেরে ধূলিময় রাস্তায় ফেলে দিল ওকে। কয়েক গজ এগিয়ে ঘোড়া ঘুরিয়ে নিল সে, তারপর ছুটে এল ফিরতি পথে, যাওয়ার সময় মাড়িয়ে যাবে লসনকে।

এমন মজা পাইনি বহু দিন! খরখরে কণ্ঠে উল্লাস প্রকাশ করল স্যামুয়েল কিনকেড। দেখো দেখি, আজ শুধু সোনা ব্যবসায়ী নয়, জেরেমি টাউনের টাফ মার্শালকেও ঘায়েল করতে যাচ্ছি আমরা! মজাটা টের পাচ্ছ, লসন? তোমার খেল খতম, আজই শেষ হয়ে যাবে তুমি!

চোখ ফিরিয়ে লোকটাকে খুঁজল লসন, দেখা যাচ্ছে না কিনকেডকে। ছুটন্ত ঘোড়সওয়ারকে এড়াতে আন্দাজের ওপর একপাশে সরে গেল ও। বাড়ির দেয়ালের সঙ্গে মিশিয়ে দিল শরীর। সরার পথে ভাগ্যক্রমে পেয়ে গেল নিজের পিস্তল। দ্রুত হাতে সিলিন্ডারে বুলেট ঢোকাল ও, চোখ তুলে দেখল দালানের কোণ থেকে গর্জে উঠেছে একটা রাইফেল। ওর দিকে ছুটে আসা ঘোড়সওয়ার ছিটকে পড়ল স্যাডল থেকে। পড়ার পর আর উঠল না।

গুলিটা করেছে জেনি লয়েড।

পরমুহূর্তে আরেকজনকে রাস্তায় দেখতে পেল সসন। আইক জেসাপ! দুহাতের দুই পিস্তল সমানে আগুন ওগরাচ্ছে। একটু কাত হয়ে দাঁড়িয়ে গুলি ছুঁড়ছে সে, প্রত্যেকটা গুলি প্রায় নির্ভুল নিশানায় আঘাত হানছে।

উঠে দাঁড়াল লসন। কিন্তু বাম দিকটা খেয়াল করেনি ও, তাড়াহুড়োয় সুযোগ হয়নি, দড়ির ফাঁস আবারও মাটিতে ফেলে দিল ওকে। এলি থমাস। লসন দেখল হাসছে সে, হাতের শটগান ধরে রেখেছে ওর মুখ বরাবর। হাসা উচিত হয়নি লোকটার, দেরি না করে গুলি করা উচিত ছিল। ওই সময়টুকুই যথেষ্ট সনের জন্যে, এক লহমায় গুলি করল ও। একইসঙ্গে ঝাঁপ দিয়েছে একপাশে। চোখের সামনে গুঁড়িয়ে গেল এলি থমাসের মুখ, যেন রক্তমাখা একটা মুখোশ পরেছে। শেষ মুহূর্তে গর্জে উঠেছিল তার হাতের শটগান, লসনের পাশে মাটি কেঁপে উঠল। ধুলোয় ঢাকা পড়ল ওর মুখ।

দাঁড়াতে চেষ্টা করল ও, টের পেল সারা শরীর কাঁপছে। চোখ তুলে দেখল ওর দিকে তাকিয়ে আছে কিনকেডের আরেক শিষ্য মরগান কেইন। মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে তরুণের, চোখ বিস্ফারিত।

হাতের পিস্তল না তুলেই গর্জে উঠল লসন, পালাও, গাধা! মেরে ফেলব নইলে!

পিছু হটল কেইন, তারপর ঘুরে দৌড়াতে শুরু করল।

রাস্তার নিচু দিকে সরে গেছে স্যামুয়েল কিনকেডের দল, সেখান থেকে আবার ছুটে এসে আক্রমণ করার তোড়জোড় করছে। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না লসন, সারা শরীর ভেঙে পড়তে চাইছে। চোখের কোণে রক্ত, শর্ট ভিজে গেছে। একটা কাঁধ অবশ হয়ে গেছে, শক্তি পাচ্ছে না হাতে। জ্ঞি অদম্য মনোবল আর জেদই টিকিয়ে রেখেছে ওকে।

ওর ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে আছে জেনিফার লয়েড। একটু দূরে অবস্থান নিয়েছে ম্যাট হিগিন্স, নির্বিকার সুখে অপেক্ষায় আছে। তার পাশেই আইক জেসাপ আর ডিক ফেল্টন। হ্যালার্ড, জো হারপার, বিল লারকিন কিংবা জ্যাক ক্লেটনও চলে এসেছে, বাসা দৃষ্টিতে সবাইকে দেখতে পেল লসন।

এগিয়ে আসছে ঘোড়সওয়াররা। এদিকে নিশুপ দাঁড়িয়ে আছে ওরা, যেন কারও নির্দেশের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু কাজের সময় নির্দেশ দিতে হলো না, এমনকি কেউ তার ধারও ধারল না, কিনকেডের দল রেঞ্জের মধ্যে আসা মাত্র গুলি ছুঁড়তে শুরু করল সবাই। একের পর এক স্যাড থেকে খসে পড়ছে লাশ। পিস্তলের গর্জন, মানুষের বীভৎস আর্তনাদ আর ঘোড়ার আতঙ্কিত চিৎকারে মুখর হয়ে উঠল জায়গাটা।

আবার পড়ে গেল লসন। এদিকে পালিয়ে গেছে কিনকেডের দল, তবে অধিকাংশই পড়ে আছে লাশ হয়ে।

প্রাণপণ চেষ্টায় উঠে দাঁড়াল লসন। দ্বিগুণ ক্লান্তি লাগছে এখন। নিজেকে আচ্ছন্ন মনে হচ্ছে ওর, কোন কিছুরই পরোয়া করতে ইচ্ছে করছে না। অবচেতন মন বলছে কাছের বাড়ির জানালায় আছে কেউ, কিংবা বাড়িটার পাশের গলিতে…আবারও গুলি করবে লোকটা, ওর অসহায় অবস্থার সুযোগ নিচ্ছে…

তীব্র ব্যথা অনুভব করছে ও বাহুতে, অসাড় হয়ে গেছে একটা পা। বুঝতে পারছে গুলি লেগেছে শরীরের একাধিক জায়গায়। ধীরে ধীরে পাশ ফিরল ও, বাড়িটার জানালায় দৃষ্টি চালাল। আবছা আলোয় অস্পষ্ট একটা মুখ দেখতে পেল। পিস্তল তুলতে চাইল ও, কিন্তু এক বিন্দু শক্তি নেই দেহে। ক্লান্তি, রাজ্যের অবসাদ শরীরে। হুড়মুড় করে রাস্তায় পড়ে গেল ও, এবার আর উঠতে পারল না। জ্ঞান হারানোর আগে টের পেল পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে কেউ, ঝাঁপসা দৃষ্টিতে আইক জেসাপের অস্পষ্ট অবয়ব দেখতে পেল ও।

দ্রুত, প্রায় নিঃশব্দে ত্রিশ গজ দূরত্ব পেরিয়ে গেল জেসাপ। গলি ধরে ঢুকে পড়ল বাড়িটায়। কোথায় যেতে হবে জানা আছে ওর।

খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল ও। করিডর ধরে চলে এল নির্দিষ্ট কামরায়। ভেজানো পাল্লা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল, নিঃশব্দে। অন্ধকার কামরাটা, কিন্তু মানুষের নিঃশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে জেসাপ।

মুহূর্তের জন্যে দ্বিধা করল ও, অন্ধকারে চোখ সয়ে আসতে জানালার পাশে দীর্ঘ একটা কাঠামো চোখে পড়ল।

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল লোকটা। হাত বাড়িয়ে জানালার পর্দা টেনে দিল সে, তারপর সরে এল কামরার ভেতরের দিকে।

আলোটা জ্বালো, ওয়েন, মৃদু, প্রায় নির্লিপ্ত স্বরে বলল জেসাপ।

থমকে দাঁড়াল লোকটা, হোলস্টারে ছোবল হেনেছিল সে, শেষ মুহূর্তে জেসাপের কণ্ঠ চিনতে পেরে নিজেকে নিবৃত্ত করে নিল। তুমি না রাস্তায় ছিলে? এখানে এলে কখন? আড়ষ্ট স্বরে জানতে চাইল জেসি ওয়েন।

আলোটা জ্বালো! আবারও বলল জেসাপ।

শ্রাগ করল ওয়েন। পকেট হাতড়ে দেয়াশলাই বের করে জ্বালাল সে, কোণের টেবিলে রাখা লণ্ঠন ধরাল। সতর্ক দৃষ্টিতে তার প্রতিটা নড়াচড়া খেয়াল করল জেসাপ, হোলস্টারের ওপর পড়ে আছে ওর একটা হাত।

তো? জুয়াড়ীর দিকে ফিরল ওয়েন, চোখে সতর্ক চাহনি।

তুমি একটা জঘন্য লোক, ওয়েন, কেউ কি বলেছে কথাটা? শুনেছি চালু পিস্তলবাজ হিসেবে বড়াই করতে পছন্দ করো, অথচ সামনাসামনি লড়ার মুরোদ নেই তোমার! তুমি আসলে কিনকেড বা থমসনের চেয়েও অধম?

পাথরের মত নির্লিপ্ত হয়ে গেছে ওয়েনের মুখ, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বন্ধুর দিকে।

বাইরের মানুষগুলোকে দেখেছ, ওয়েন? নিতান্ত নিরীহ মানুষ ওরা। কিন্তু মরবে জেনেও রুখে দাঁড়িয়েছে বেপরোয়া শত্রুর বিরুদ্ধে। ওরা একটা স্বপ্ন দেখছে—চাইছে এই শহরটা টিকে যাক। ড্যানি লসন ওদেরকে সেই স্বপ্ন দেখিয়েছে। অথচ তুমি তাকেই সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছ! লসনের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে যদি, না হয় তোমাকে সত্যিকার পুরুষ মানুষ বলা যেত, কিন্তু…

পথ ছাড়ো আমার! শীতল স্বরে বাধা দিল ওয়েন।

ওয়েনের চোখে চোখ রেখে ক্ষীণ হাসল জুয়াড়ী। আজকে একটা জুয়া খেলতে এসেছি আমি, ওয়েন, অন্যরকম জুয়া। এই কামরা থেকে হয় তুমি, নয়তো আমি বেরোব।

নিকুচি করি তোমার জুয়ার! ভেবেছ তোমাকে হারানোর ক্ষমতা নেই আমার? বড় বাড় বেড়েছে তোমার, জেসাপ, ভেবেছ সাধারণ মাইনারদের মত আমাকেও সামাল দিতে পারবে? বাঁকা হাসি ওয়েনের ঠোঁটের কোণে, তিরতির করে কাঁপছে কপালের পাশে একটা শিরা। হোলস্টারের ওপর লেপ্টে আছে দুই তালু। সিদ্ধান্ত টা নিয়েই ফেলেছে, নাচার সে-বন্ধুর লাশ টপকেই বেরিয়ে যেতে হবে।

যে কোন একজন! রাজি তুমি? হালকা চালে প্রশ্নটা করল জেসাপ, সিগার ধরিয়েছে এই মাত্র।

যেভাবে চাও তুমি! স্বীকার করছি তাসে তোমার হাত সত্যিই ভাল। এতটাই যে সবাই বলে তাস নাকি তোমার ইচ্ছেমত চলে। কিন্তু পিস্তল? পিস্তল কি কারও কথা শোনে বা ইচ্ছের কথা বোঝে, যখন সামনে এরচেয়েও সেয়ানে পিস্তলবাজ দাঁড়িয়ে থাকে?

আমারটা বোঝে।

তাহলে দেখাও! বিদ্যুৎ খেলে গেল ওয়েনের হাতে, চোখের নিমেষে মুঠিতে উঠে এল জোড়া পিস্তল।

মাত্র দুটো গুলির শব্দ হলো। এর ঠিক দুই মিনিট পর বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এল আইক জেসাপ।

পরদিন বুটহিলে কবর দেয়া হলো জেসি ওয়েনকে। তার কবরের ফলকে লেখা থাকল:

জেসি ওয়েন
(?–১৮৮১) পিস্তলে আইক জেসাপের দক্ষতা নিয়ে বাজি ধরেছিল সে।
বন্ধুর সন্দেহ নিরসন করতে খুব বেশি দেরি করেনি জেসাপ।

<

Super User