জায়গাটা ভাল করে পর্যবেক্ষণ করে এসে রাশ টেনে ঘোড়াটাকে থামাল লী। গতরাতে যে পাহাড়ের ভিতর দিয়ে ওরা এপাশে পৌঁছেছে, সেটা বিশাল দেয়ালের মতই দাঁড়িয়ে আছে ওদের পিছনে। অবিচ্ছিন্ন ভাবে মাথা উঁচু করে একটানা উত্তরে এগিয়ে গেছে ওটা। পুবের এবড়োখেবড়ো জমির ওপর বুটি-বুটি সীডারের ঝোঁপ দেখা যাচ্ছে। দক্ষিণে যেখানে সীডারের ঝোঁপ শেষ হয়েছে, ঠিক সেখান থেকেই শুরু হয়েছে বালুর ঢিবির সারি।
তোমার কী মনে হয়? লোকটা ক্লিফ ঘেঁষে উত্তর দিকে গিয়ে পাহাড় পেরিয়ে ফিরে যায়নি তো? প্রশ্ন করল বার্ট।
পাহাড় ফুড়ে যাবার উপায় ওর জানা থাকলে অবশ্য অন্য কথা, বলল লী। তবে যে পথ দিয়ে আমরা এসেছি সেদিক দিয়ে যে সে যায়নি, আমি শিওর। ভোর হতেই আমি ওদিকটা দেখে এসেছি। ওর ফেরার কোন চিহ্ন নেই ওখানে।
ইউজিন এখনও কম্বল ছেড়ে ওঠেনি। গতরাতে ভাল ঘুম হয়নি তার-চোখ বুজলেই কেবল জেনেফারের চিন্তিত মুখটা বারবার ভেসে উঠেছে মনের পর্দায়।
এলাকাটা একেবারে শুকনো, বিজন। আজ সকাল থেকে আকাশে একটা শকুন ছাড়া আর কোন প্রাণের সাড়া ওদের নজরে পড়েনি। শকুনটা মাথার উপর একটা চক্কর দিয়ে হয়তো তার সম্ভাব্য ডিনার হিসাবেই চিহ্নিত করে গেল ওদের।
আজ সকালে বিভ্রান্ত বোধ করছে ওরা। যাকে তাড়া করে এতদূর এসেছে। তার ট্রেইল এখানে হারিয়ে গেছে। এখন লী আর গিবনের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা। করছে সবাই।
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে গিবন তার মত প্রকাশ করল। একটা ভাগ্যের জুয়া খেলতে হবে আমাদের, লী। লোকটা রেড-ইন্ডিয়ানদের মতই চতুর আর সাবধানী। ও যদি দক্ষিণে গিয়ে থাকে তবে আর ওর চিহ্ন খুঁজে পাব না আমরা। ওই বালুর টিবিগুলো বাতাসে সর্বক্ষণ সরে সরে যাচ্ছে। ওখানে ঘোড়ার পায়ের ছাপ বাতাসে খুব অল্প সময়েই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
জুয়ার কথা কী বলছ?
ও যে কোনদিকে গেছে সেটা আন্দাজ করে নিয়ে ছুটে এগিয়ে গিয়ে ওর পথ রোধ করে দাঁড়াতে হবে।
আর আমাদের আন্দাজ ভুল হলে?
তা হলে উপায় নেই-ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যেতে হবে।
মনস্থির করে ফেলল লী। আমরা সোজা ফাদার্স ফেরির দিকে যাব। ওখানে যদি শিগগিরই ওর দেখা না পাই, তা হলে ভাটির দিকে অন্য ফেরিতে ওকে খুঁজতে যাব।
লী পথ দেখিয়ে দেখিয়ে আগে আগে চলল। পথে জেকবের কোন চিহ্ন ওদের চোখে পড়ল না।
পরদিন ফেরিঘাটে পৌঁছেও জেকবের কোন পাত্তা মিলল না।
ওকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না, বলল ক্লাইভ। ব্যাটা আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে ভেগেছে।
অসম্ভব! বলল লী, ওকে যেমন করে তোক রতেই হবে-পালাতে দেয়া চলবে না।
সে যা-ই হোক এখন ঝটপট অন্য ফেরিতে পৌঁছে কিছু খেয়ে না নিলে উপোস করেই আমাদের মরতে হবে, মন্তব্য করল গিবন।
আমিও এ-ব্যাপারে একমত, কথাটা সমর্থন করে একসাথে বলে উঠল ইউজিন আর ক্লাইভ।
দক্ষিণে রওনা হলো ওরা। নদী থেকে বেশ একটু দূর দিয়েই এগোবে ওরা। তাতে নদীর বাঁকে বাঁকে ঘোরা পথে না চলে সোজা পথে এগোতে পারবে। গিবন। মুখ ফিরিয়ে চেয়ে দেখল কিছুটা দূরেই দেখা যাচ্ছে প্রকাণ্ড নাভাজো পাহাড় মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে। ওই পাহাড়ের মাথা থেকে প্রায় গোটা দেশটাই দেখা যায়, বলল সে।
.
নাভাজো পাহাড়ের চূড়ায় শুয়ে দূরবীন চোখে লাগিয়ে একে একে ছয়জনকে দেখল জেকব। অন্য ফেরির উদ্দেশে রওনা হলো ওরা! সন্দেহ নেই ওখানে ওরা খাবার আর অন্যান্য সরঞ্জাম সংগ্রহ করবে। কিন্তু নিজের খামারের ক্ষতি করে কতদিন বাইরে কাটাতে পারবে ওরা?
ওদের উপর নজর রেখে আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই। বোঝাই যাচ্ছে, তার ট্রেইল হারিয়ে ফেলেছে ওরা। ডালিয়াকে সে যে ক’দিন সময় দিয়ে এসেছিল তা পেরিয়ে গেছে। এখান থেকে তিরিশ মাইল দূরে রয়েছে ডালিয়া। একা একা মেয়েটা কী করছে কে জানে? এই এলাকার কিছুই চেনে না সে, তবু তার কথামত একা একাই সে পথে বেরিয়ে পড়েছে কি?
খাড়া ঢাল বেয়ে নেমে ‘ওয়ার গড’ ঝর্ণায় নিজের বোতলে পানি ভরে ঘোড়াটাকে পানি খাইয়ে নিল জেকব। পাহাড় থেকে কিছুটা নেমে মালভূমি ধরে দক্ষিণ-পুবে এগোল সে। প্রথম বারো মাইল নির্বিঘ্নেই কাটল। পিউটে পাহাড়ে বিকেলের সূর্য যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।
পুরোনো একটা ইন্ডিয়ান ট্রেইল ধরে এসেছে জেকব।
ঘোড়াটা অবসন্ন হয়ে পড়েছে, সে নিজেও খুব ক্লান্ত-তবু এগিয়েই চলল। খুরের চিহ্ন লুকাবার জন্য সোজা রাস্তায় না গিয়ে এবার বন্ধুর পাথুরে পথ বেছে নিল সে। আকাশে চাঁদ উঠতে উঠতে টল মাউনটেন-এর ধারে পৌঁছে গেল জেকব।
ষোলো দিনের দিন ঘোড়ায় চড়ে দু’টো ক্যানিয়নের সন্ধিস্থলে এসে দাঁড়াল ডালিয়া। অন্ধকারে ঘোড়ার পিঠে বসেই ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে সে। তার মাথার উপর একটা বাদুড় চক্কর দিচ্ছে। ঘোড়ার খুরের আওয়াজ শোনার জন্য উত্তর্ণ হয়ে আছে সে।
মনের গভীরে তার স্থির বিশ্বাস জেকব আসবেই। কখনোই সে ধোকা দেবে তাকে। প্রথমে একটু সন্দেহ ছিল-অন্ধকার নেমে আসার পর সেটা দূর হয়ে গেছে-আর ভয় করছে না তার। এখন সে স্থির নিশ্চিত, যদি জেকব না ফেরে, তার মানে হয়তো নিকোলাস তাকে খুঁজে পেয়েছে। অথবা আর কিছু ঘটেছে।
নিকোলাস যে ওদের পিছু নেবেই এতে কোন সন্দেহ নেই তার। লোকটার শিরায় শিরায় রয়েছে হিংসা আর জিদ। সে আসবে। আর এলে লোক-লস্কর নিয়েই আসবে।
শেষ পর্যন্ত আজও নিরাশ হয়ে ফিরতে হলো তাকে। জিন নামিয়ে ঘোড়াকে খেতে দিল ডালিয়া।
কয়েক ঘণ্টা পরে হঠাৎ ঘুম ভেঙে জেগে উঠল সে। তার ঘোড়াটাই শব্দ করে ডেকে উঠেছে। তাড়াতাড়ি জেকবের দেওয়া রাইফেলটা হাতে তুলে নিল ডালিয়া। কিছুক্ষণ কান খাড়া করে থেকে খুরের শব্দ শুনতে পেল সে। রাইফেলটা উত্তেজিত ভাবে আঁকড়ে ধরে অপেক্ষা করছে ও। ঠোঁট শুকিয়ে আসছে-বুকের ভিতরটা টিপ ঢিপ করছে।
হঠাৎ লোকটার গলা কানে এল। ঘোড়ার পিঠ চাপড়ে দিয়ে সে বলছে, শাবাশ বেটা, বাড়ি পৌঁছে গেছি আমরা।
আনন্দের আতিশয্যে কাঁপতে কাঁপতে হাঁটু মুড়ে মাটিতে বসে পড়ল ডালিয়া।
<