বোকামি করে ফেললাম। ষাঁড়টাকে বাড়ির এত কাছে না মারলেও চলত। মাংস পচা গন্ধ ছড়াবে। বিষাক্ত করে তুলবে পরিবেশ। ঝর্নাটাও কাছেই। ওটার পানিতেও বিষ ছড়াতে পারে। খাওয়ার পানিই পাব না তাহলে।
সরিয়ে ফেলা দরকার, আম্মা বলল। তারপর পোড়াতে হবে।
পোড়াবে? অবাক হয়ে বললাম, দরকার কি? ফেলে রাখলেই হবে। একদিনেই শেষ করে দেবে শকুন আর শেয়ালের দল।
তাতে রোগ ছড়াবে।
আম্মা গিয়ে জাম্পারকে লাগাম পরাতে শুরু করল। আমাকে দড়ি এনে দিল লিজ। মোটা করে ষাঁড়টার দুই শিঙে দড়ি বাঁধলাম। জাম্পারকে টানতে টানতে নিয়ে এল আম্মা। মরা গরু আর রক্ত দেখে অস্থির হয়ে ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাস ছাড়তে শুরু করল ওটা। লাফিয়ে সরে যেতে চাইল। রোগের গন্ধ মনে হয় সে-ও পেয়েছে। ওকে চুপ থাকার জন্যে গালাগাল করলাম।
তাতেও যখন হলো না, ডাল ভেঙে নিলাম পেটানোর জন্যে। মারের ভয়ে বাধ্য হয়ে শান্ত হলো সে। ওর গলায় বাধা দড়ির সঙ্গে ষাঁড়ের শিঙের দড়ি বাঁধল আম্মা।
এতবড় একটা ষাঁড়, অনেক ভারি। টেনে সরানো জাস্পরের সাধ্যের বাইরে। টানতে টানতে বাঁকা হয়ে গেল। ফুলে উঠল ঘাড়ের পেশী। প্রাণপণ চেষ্টায় বড় জোর হাতখানেক সরাতে পারল মরা গরুটাকে, তারপরই হাল ছেড়ে দিল।
জাম্পারটা ভীষণ পাজি, কিছুতেই কাজ করতে চায় না, খালি ফাঁকি দেয়ার তালে থাকে, কাজে গোলমাল করে দেয়, সবই ঠিক। কিন্তু একটা কাজে সে সত্যিই ওস্তাদ। সেটা হলো বোঝা টানা। কিন্তু তার মত ভারবাহীও সরাতে পারল না ষাঁড়টাকে। আসলেই এটা তার ক্ষমতার বাইরে।
অন্য কৌশলে টানানোর চেষ্টা করলাম। লাভ হলো না। একটা দড়ি ছিড়ে বেরিয়ে গেল আমার কানের পাশ দিয়ে। চাবুকের মত শপাং করে উঠল। আরেকটু হলেই লাগত আমার কানে। কানটা খোয়াতে হত তাহলে।
নাহ্, সরানো যাবে না এভাবে। আম্মার দিকে তাকালাম।
মাথা নেড়ে আম্মা বলল, আর কিছু করার নেই। এখানেই পোড়াতে হবে। মুশকিল হবে এখন কাঠ আনা নিয়ে।
এত বড় একটা ষাঁড় পোড়ানো সহজ কথা নয়। অনেক কাঠ দরকার। শুকনো কাঠ পাওয়া যায় কাছাকাছি এমন কোন ব্যবস্থা নেই। মরা বা শুকনো গাছটাছ যা ছিল অনেক আগেই সেগুলো শেষ করে ফেলেছি আমরা। আমি সুস্থ থাকলে অতটা অসুবিধে হত না। গিয়ে কেটে নিয়ে আসতে পারতাম। উপায় না দেখে শেষে আম্মা আর লিজই বনে গেল জাম্পারকে নিয়ে। শুকনো ডালপালা জোগাড় করে আনল। সেগুলো মরা গরুটার ওপর সাজিয়ে দিয়ে আগুন ধরাতে ওদেরকে সাহায্য করলাম আমি।
দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। অনেক উঁচুতে উঠে গেল আগুনের শিখা। প্রচণ্ড তাপ, পোড়া চামড়া আর মাংসের অসহ্য তীব্র গন্ধ যেন ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিতে চাইল আমাদের।
ভাবলাম, আগুন যা হয়েছে তাতে চোঙ্গোর মত তিনটে ষাঁড়কে পুড়িয়ে ফেলা সম্ভব। কিন্তু ঘণ্টা দুয়েক যেতেই ভুল ভাঙল আমার। নিভে এল আগুন। অবাক হয়ে দেখি অর্ধেকটাও পুড়ে শেষ হয়নি। আবার কাঠ আনতে বনে যেতে হলো আম্মা আর লিজকে।
দুই দিন দুই রাত লাগল বঁড়টাকে পুড়িয়ে ছাই করতে। সারা দিন ধরে এই কাজই করলাম আমরা। আম্মা আর লিজ গিয়ে কাঠ আনে, আমি সেগুলো আগুনে ফেলি। চর্বিপোড়া গন্ধে টেকা দায়। রাতে হয় আরেক যন্ত্রণা। পোড়া মাংসের গন্ধে এসে হাজির হয় নেকড়ের দল। নিজেরা নিজেরা ঝগড়া করে, মারামারি করে, চিৎকারে কান ঝালাপালা করে। আগুনের ভয়ে কাছে আসতে পারে না। তবে মাংসের লোভও ছাড়তে পারে না। বসেই থাকে। আর চেঁচামেচি করে জ্বালিয়ে মারে আমাদের। ওগুলোর অত্যাচারে ঘুমাতে পারি না আমরা।
রাতভর জেগে পাহারা দেয় ওল্ড ইয়েলার। খোঁড়াতে খোঁড়াতে একবার যায় আগুনের কাছে, আবার ফিরে আসে ঘরের কাছে। চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করে। দূরে সরে থাকার হুমকি দেয় নেকড়েগুলোকে।
দুই রাতই জেগে রইলাম আমি। দেখলাম নেকড়ের চোখ, অন্ধকারে জ্বলে জ্বলন্ত কয়লার মত। মাঝে মাঝে কানে আসে বেচারি চিত্রার যন্ত্রণা কাতর ডাক। এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে সে। বাড সারসির চাচার কথা মনে করে গায়ে কাঁটা দেয় আমার। শিউরে শিউরে উঠি।
কেবলই আব্বার কথা মনে হয়। আর পারি না। তাকে এখন ভীষণ প্রয়োজন আমাদের।
ষাঁড়টাকে পোড়ানো শেষ হলে আম্মা বলল, এবার চিত্রাটারও একই গতি করা দরকার। বলল বটে, কিন্তু তার মুখ দেখেই বুঝতে পারলাম একথা বলতে কতটা কষ্ট হচ্ছে তার। এত ভাল একটা দুধেল গাই খোয়ানোর কথা, সত্যিই, ভাবা যায় না।
আমার মতই আম্মাও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এতটা উদ্বিগ্ন হতে আর কখনও দেখিনি তাকে। কোন সন্দেহ নেই, আমারই মত ঘাবড়ে গেছে। দুটো গরুকে যখন জলাতঙ্কে ধরেছে। বাকিগুলোকেও ধরতে পারে।
বললাম, বাঁচবে তো না এমনিতেও, শুধু শুধু কষ্ট পাচ্ছে। তবে বাড়ির কাছে আর না। বনে নিয়ে যাব। কাঠ আছে এমন জায়গায়।
তোর পায়ের অবস্থা কেমন?
ভাল। হাঁটাহাঁটি শুরু করা উচিত। নইলে খিচ ধরাটা ছাড়বে না।
খোলা জায়গায় ফেলবি, সাবধান করে দিল আম্মা। শুকিয়ে খড়খড়ে হয়ে আছে ঘাস। আগুনের ছোঁয়া পেলেই দপ করে জ্বলে উঠবে। দাবানল লেগে যাবে।
গরুটার আসার অপেক্ষায় রইলাম। এল ওটা। বাড়ির পাশ দিয়ে ঘুরে গিয়ে বনের দিকে এগোতেই বেশ কিছুটা দূরত্ব রেখে বন্দুক হাতে তার পিছু নিলাম।
তাকানো যায় না বেচারির দিকে। রোগে একেবারে শেষ করে দিয়েছে। হাড় কখানা শুধু আছে, তার ওপর চামড়াটা জড়ানো। জীবন্ত একটা কঙ্কালই বলা চলে। অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে রয়েছে। দুনিয়ার কোন দিকেই খেয়াল নেই। আপনাআপনি পা পড়ছে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে। কিছুদূর গিয়ে গিয়েই মাটিতে পড়ে যায়। মনে করি, এই বুঝি তার শেষ পড়া, আর উঠতে পারবে না। কিন্তু ঠিকই পারে। গোঙানিও চলতে থাকে আবার।
সুবিধে মত একটা জায়গার ওপর দিয়ে এগোলেই গুলি করব। কিন্তু গেল না। তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ারও সাহস হলো না। বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে। এখন আর ওকে দিয়ে কিছুই করানো যাবে না। করাতে গেলে উল্টোপাল্টা কিছু করে বসতে পারে। বিপদে ফেলে দিতে পারে ষড়টার মতো।
মাইলখানেক আসার পর একটা শুকনো নালার দিকে এগোল সে। গুলি করার জন্যে উপযুক্ত জায়গা। বাড়ি থেকে অবশ্য বেশ কিছুটা দূরে, পোড়াতে আসতে অসুবিধে হবে, কিন্তু আশেপাশে শুকনো ডালপালা পাওয়া যাবে প্রচুর। শুকনো ঘাসে আগুন ধরে গিয়ে দাবানল ছড়ানোরও ভয় নেই।
তাড়াহুড়ো করে ওর সামনে চলে এলাম। লুকিয়ে পড়লাম একটা ঝোপে। না লুকালেও বোধহয় চলত। কোন দিকেই খেয়াল নেই। একেবারে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেও হয়তো দেখতে পেত না।
এক গুলিতেই ফেলে দিলাম।
এইটুকু পথ হেঁটেই হাত-পা কাঁপতে শুরু করল আমার। দরদর করে ঘাম বেরোচ্ছে। বড় বেশি কাহিল হয়ে পড়েছি। কবে যে আবার ঠিকমত চলার শক্তি পাব কে জানে!
আমার দিকে এক নজর তাকিয়েই সোজা বিছানায় চলে যাওয়ার হুকুম দিল আম্মা। তুই শুয়ে থাক। পোড়ানোর কাজটা আমরাই সারতে পারব। পায়ে এখন বেশি চাপ দেয়া ঠিক না। আবার ফুলবে।
তর্ক করলাম না। করার অবস্থাও নেই। কোথায় চিত্রাকে ফেলে এসেছি আম্মাকে কললাম।
দলবল নিয়ে রওনা হয়ে গেল আম্মা। জাম্পারের পিঠে চেপে গেল লিজ। আম্মা গেল হেঁটে। আগুন জ্বালানোর জন্যে এক কড়াই জ্বলন্ত কয়লা নিয়ে গেছে। আরলিসকে রেখে গেছে বাড়িতে।
একেবারে শেষ মুহূর্তে উঠে দাঁড়াল ইয়েলার। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। যাবে কি যাবে না এই নিয়ে দ্বিধা। তবে থাকতে পারল না। পা সুড়সুড় করছে যাওয়ার জন্যে। মিনিটখানেক পর খোঁড়াতে খোঁড়াতে রওনা হয়ে গেল ওদের পেছনে। খুব রোগা হয়ে গেছে। হাঁটার সময় একটা পা উঁচু করে রাখে, প্রায় ফেলতেই পারে না মাটিতে। তবে তিন পায়ে ভর করেও যেতে পারবে। আমার মত এত সহজে কাহিল হবে বলেও মনে হলো না। তাই ফিরে আসতে ডাকলাম না। যাক।
ওকে যেতে দিয়ে এক হিসেবে ভালই করেছি। নইলে সারা জীবন পস্তাতে হত। ওই মুহূর্তে বুঝতে পারিনি সেটা। মানুষ যদি তার ভবিষ্যটা জানতে পারত, তাহলে অনেক মারাত্মক অঘটন থেকে বেঁচে যেত। কি ঘটবে তখন জানলে কি আর কাউকে বেরোতে দিই। কিছুতেই দিতাম না।
শুয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম বলতে পারব না। একটানা ঘুমালাম সূর্য ডোবা পর্যন্ত। হঠাৎ চমকে জেগে উঠলাম। মনে পড়ল আরলিসের কথা। সর্বনাশ! একা একা কি করছে ও খোদাই জানে! গাল দিলাম নিজেকে। এভাবে কাণ্ডজ্ঞানহীনের মত ঘুমিয়ে পড়া উচিত হয়নি।
তবে ভালই আছে আরলিস। কুকুরের বাচ্চাটার সঙ্গে খেলছে। দারুণ একটা সঙ্গী জটে গেছে তার। একটুকরো দড়ি হাতে নিয়ে ওটাকে দেখিয়ে দৌড়াচ্ছে। দড়ির একটা প্রান্ত গড়াচ্ছে মাটিতে। সেটাকে লক্ষ্য করে ছুটছে বাচ্চাটা। কাছাকাছি হলেই ধরার জন্যে লাফ দিয়ে গিয়ে পড়ছে। কখনও ধরতে পারছে, কখনও পারছে না। যখন পারছে তখনও রাখতে পারছে না। হ্যাচকা টান মারছে আরলিস। ডিগবাজি খেয়ে পড়ছে ওটা। দড়িটা ছুটে যাচ্ছে দাঁত থেকে। আমার তো ভয়ই হলো, দাঁত না খসে আসে। এলেও অবশ্য কোন ক্ষতি নেই। ওগুলো দুধের দাঁত। এমনিতেও পড়ে গিয়ে নতুন দাঁত গজাবে। মুহূর্তের জন্যেও দমছে না বাচ্চাটা। নতুন উদ্যমে আবার উঠে তাড়া করছে দড়ির মাথাকে।
আম্মা আর লিজ এখনও ফেরেনি। দেরি অবশ্য হওয়ারই কথা। কাঠকুটো জোগাড় করে সেগুলো দিয়ে গরুটাকে ঢেকে আগুন ধরানোটা সহজ কাজ নয়। তাছাড়া ওরা মেয়েমানুষ। এসব কাজ পুরুষের জন্যে যতটা সহজ, ওদের জন্যে নয়। বাড়ি থেকেও বেশ অনেকটা দূরে। আসতে সময় লাগে। আশা করলাম কাজ শেষ করে অন্ধকারের আগেই ফিরে আসতে পারবে।
একটা বালতি নিয়ে ঝর্নায় চললাম পানি আনতে। আব্বার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছি। দুই দিন আগে আম্মা বলেছে তার আসার সময় হয়ে গেছে। যে কোন দিন চলে আসতে পারে। কিন্তু আমার আর তর সইছে না। ঘোড়ার জন্যে নয়, ভয় পাচ্ছি জলাতঙ্ককে। আব্বা থাকলে অনেকটা ভরসা পেতাম। রোগটা এখনও মহামারী আকারে শুরু হয়নি। গোয়ালের বাকি গরুগুলোকেও যদি ধরে, দিশেহারা হয়ে যাব। কি করব তখন জানি না।
<