শিকার করতে আমার খুব ভাল লাগে। নরম হয়ে এলাম অনেকটা। কুত্তাটার ভাবনা আপাতত দূর করে দিলাম মন থেকে।
উঠে গিয়ে গরু দোয়ালাম। বালতিতে করে এনে দিলাম আম্মাকে। দুধের ব্যাপারে আমার দায়িত্ব শেষ, যা করার এখন আম্মাই করবে। রাইফেলটা বের করে নিয়ে চলে এলাম জাম্পারের কাছে। একটা দড়ির এক মাথা ওর গলায় বেঁধে বাকিটুকু দিয়ে ফাঁস বানিয়ে নাকে এঁটে দিলাম, দড়ির অন্য মাথাটা ব্যবহার করব লাগামের মত। আরেকটা দড়ি পেঁচিয়ে রাখলাম ওর পিঠে। হরিণ পাওয়া গেলে বেঁধে আনার জন্যে।
জাম্পারের পিঠে জিন পরানোর প্রয়োজন বোধ করলাম না। লাফিয়ে উঠে বসলাম। এগোলাম বার্ডসং ক্রীকের ধার দিয়ে। শুয়োরের পিঠের মত দেখতে একটা শৈলশিরা ধরে এগোতে এগোতে ভাবলাম, ইস্, একটা ঘোড়া থাকত যদি আমার! বুড়ো খচ্চরের পিঠে চড়ার চেয়ে ঘোড়ায় চড়া অনেক আরামের।
চওড়া একটা ঢালের কাছে চলে এলাম। ঘাসবনের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে জন্মে আছে ওকগাছ। ঘাস এখানে এত উঁচু, জাম্পারের পেট ছুঁয়ে যায়। সল্ট লিকের সিকি মাইল দূরে এসে থামলাম। খচ্চরটাকে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে পায়ে হেঁটে এগোলাম।
ওকে সঙ্গে নিলে ঝামেলা করবে, তাই নিলাম না। সারাক্ষণ লেজ নেড়ে মাছি তাড়াবে, অকারণেই পা ঠুকবে মাটিতে, তাতে ঘাবড়ে গিয়ে সরে যেতে পারে হরিণ। বন্দুকের গুলির শব্দকে সাংঘাতিক ভয় পায় সে। শুনলেই ভড়কে গিয়ে দড়ি ছিড়ে পালাতে চাইবে। গলায় ফাঁসি লেগে দম আটকে মরারও পরোয়া করবে না। কিংবা ধপ করে মাটিতে পড়ে গিয়ে এমন ভঙ্গি শুরু করবেযেন গুলিটা তার গায়েই লেগেছে।
সুন্দর একটা সকাল, শিকারের জন্যে উপযুক্ত। উজ্জ্বল রোদে ঝলমল করছে লম্বা সবুজ ঘাস, বনের পাতা। হাওয়া খুব কম। পাতা নড়ে না। দেখে বোঝার উপায় নেই কোন দিক থেকে বইছে। একটা আঙুল চুষে ভিজিয়ে ওপর দিকে তুলে ধরলাম। যেদিক থেকে হাওয়া বইছে আঙুলের সেদিকটায় ঠাণ্ডা লাগবে। বোঝা গেল আমার দিক থেকে সল্ট লিকের দিকে বয়ে যাচ্ছে বাতাস। আমার গায়ের গন্ধ পেয়ে যাবে হরিণ। আর এগোবেই না।
লিকটাকে এক পাশে রেখে হাঁটতে শুরু করলাম। দূর দিয়ে ঘুরে চলে এলাম এমন এক জায়গায় যেখানে লিকের দিক থেকে আমার দিকে বইছে বাতাস। হরিণ আর আমার গন্ধ পাবে না। অনেক বেশি ঝুপড়ি একটা ওকের ডাল থেকে ঝুলে রয়েছে বুনো আঙুরের ঝাড়। গাছের গায়ে পিঠ দিয়ে তার ভেতরে লুকিয়ে বসলাম। রাইফেলটা রাখলাম দু-হাঁটুর ওপর। স্থির হয়ে রইলাম গাছটার মতই।
ওভাবে বসতে আব্বাই আমাকে শিখিয়েছে। সেই ছোটবেলা থেকেই প্র্যাকটিস করতে করতে ওস্তাদ হয়ে গেছি এ ব্যাপারে। আব্বা বলে, তোর আকৃতিটা হরিণের চোখে পড়বে না, পড়বে নড়াচড়া। যদি গন্ধ না পায়, নড়াচড়া না দেখে, তোর দিকে তাকিয়ে থেকেও বুঝতে পারবে না তুই ওখানে আছিস।
সুতরাং ওভাবেই বসে রইলাম। চোখ ঘুরছে লিকের চারপাশের খোলা জায়গায়।
পাথরের ছড়াছড়ি ওখানে, ওগুলোর মাঝে মাঝে কালো দাগ। দাগগুলোতে রয়েছে লবণ। আব্বার কাছে শুনেছি, কোটি কোটি বছর আগে ওই লবণ পাথরে মিশেছে। এত আগের কথা কি করে জানল সে, সেটা আমার ধারণার বাইরে, তবে লবণ যে আছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। শুয়োর, হরিণ এবং বুনো ও পোষ সমস্ত জানোয়ার আসে ওখানে লবণ চাটতে। সল্ট লিক নামটাও সেজন্যেই হয়েছে।
এই লবণ মানুষেও খেতে পারে। তবে নেহায়েত ঠেকায় না পড়লে কেউ খায় না। আমার জন্মের আগে আব্বা-আম্মাও নাকি একবার ঠেকায় পড়েছিল। লবণ ফুরিয়ে গিয়েছিল। আম্মা তো ভেবে অস্থির। লবণ ছাড়া কিছু খাওয়া যায় না। আব্বা শেষে ওই পাথর বাড়ি নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে ভেঙে পানিতে গরম করে লবণ বের করেছিল। সেই লবণ গোলা পানি দিয়ে মাংস নোনা করেছিল, ময়দায় মেখে রুটি তৈরি করেছিল।
বুনো জানোয়ারেরা লবণ চাটতে আসে সাধারণত সকালের শুরুতে আর শেষ বিকেলে, তখনই হরিণ শিকারের উপযুক্ত সময়। ভালুক, চিতাবাঘ আর বনবিড়ালের মত মাংসখেকো শিকারী প্রাণীরাও জানে এটা, তাই এই সময় ওরাও আসে শিকার ধরতে। হরিণ মারতে এসে এখানে দুবার দুটো বনবিড়াল মেরেছি আমি, আরেকবার মেরেছি একটা নেকড়ে। আব্বা, মেরেছে একটা চিতাবাঘ। একটা খচ্চরের বাচ্চাকে মেরে ফেলেছিল ওটা।
ভালুক আর চিতাবাঘ শিকারের ইচ্ছে আছে আমার। সুযোগ পেলে আজকেও ছাড়ব না। কিন্তু এল একদল হ্যাভেলিনা শুয়োর। ওগুলোকে গুলি করার বিপদ আমার ভাল করেই জানা। কোনটাকে জখম করলেই হয়, দল বেঁধে এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে শিকারীর ওপর, জ্যান্ত ছিড়ে খেয়ে ফেলবে। ছোট জানোয়ার ওরা, দাঁতও পোষা শুয়োরের চেয়ে খুব একটা বড় নয়, কিন্তু রাগ খুব বেশি। একবার কাউকে তাড়া করলে তাকে শেষ না করে আর স্বস্তি নেই।
একবার হ্যাভেলিনা শুয়োরের পালে গুলি চালিয়েছিল জেড সিম্পসনের ছেলে রোজাল। তেড়ে এল শুয়োরের দল। আর কোন উপায় না দেখে একটা মেসকিট গাছে উঠে পড়ল সে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাকে আটকে রাখল শুয়োরেরা। যে গাছটায় উঠেছিল সে সেটা ছোট গাছ। দুটো শুয়োর সারাক্ষণ লাফিয়ে লাফিয়ে ধরার চেষ্টা করল তাকে, বাকিগুলো দাঁত দিয়ে কামড়ে গাছটাকে কেটে মাটিতে ফেলার চেষ্টা করল। পারেনি অবশ্য। সেই থেকে হ্যাভেলিনাকে গুলি করা তো দূরের কথা, দেখলেই পাঁচশো হাত দূর দিয়ে সরে যায় রোজাল।
শুয়োরগুলো চলে গেল। কয়েকটা ববহোয়াইট কোয়েল এসে নামল, পাথরগুলোর আশেপাশে ঠুকরে ঠুকরে পোকা খেতে লাগল। তারপর এল তিনটে গরু, সঙ্গে একটা বাছুর, আর একটা ষাঁড়। এসেই পাথর চাটতে আরম্ভ করল। কিছুক্ষণ ওগুলোকে দেখে চোখ তুললাম ওপর দিকে। আমি যে গাছে ঠেস দিয়ে বসেছি সেটার ডালেই খেলা জুড়েছে দুটো কাঠবেড়ালি।
দৌড়াদৌড়ি, লাফালাফি করছে ওরা, কিচির মিচির করছে। রোদ লেগে লেগে ঝিক করে উঠছে ওগুলোর রোমশ ফোলানো লেজ। একটা কাঠবেড়ালি লাফ দিয়ে গিয়ে পড়ল দূরের ডালে, ওখানে বসে ফিরে তাকিয়ে কিচকিচ করতে লাগল। যেন চ্যালেঞ্জ করছে তার সঙ্গীকে, দাও তো দেখি আমার মত লাফ! লাফ দিল তার সঙ্গী। ঠিকই পার হয়ে গেল। আবার লাফ দিল প্রথমটা। এবার আরও দূরের একটা ডালে। ফিরে বসে তাকাল সঙ্গীর দিকে, অর্থাৎ এবার দেখি কেমন পারো? ঠিকই পার হলো দ্বিতীয়টা। এরকম করতে করতে অনেক দূরের একটা ডালে যেতে গিয়ে থাবা ফসকাল প্রথমটার, পাতা খামচে ধরে আটকে থাকার চেষ্টা করল, পারল না, পড়ে গেল মাটিতে। তাই দেখে দ্বিতীয়টার কি উল্লাস। নাচতে শুরু করল। সেই সঙ্গে কিরকির কিরকির করে এক ধরনের বিচিত্র শব্দ। অট্টহাসি হেসে বলতে চাইছে, খুব তো বাহাদুরি করেছিলে, এখন!
আমিও হেসে উঠলাম। এবং ভুলটা করলাম।
কি করে আমার অলক্ষ্যে এত কাছে চলে এসেছে হরিণটা বলতে পারব না। যেন মাটি ফুঁড়ে উদয় হয়েছে। আমার গাছটার দিকেই তাকিয়ে আছে। ফোঁস ফোঁস করছে, বাতাস শুঁকছে, একটা পা ঠুকছে মাটিতে।
এখনও আমার গন্ধ পায়নি। সম্ভবত দেখেওনি। নড়লাম না। জোরেই হেসে ফেলেছিলাম, কানে গেছে হরিণটার, সন্দেহ করে বসেছে।
রাইফেল কাঁধে তুলতে ভরসা পেলাম না। নড়াচড়াটা ঠিক চোখে পড়ে যাবে তার, ছুটে পালাবে। আব্বা থাকলে অবশ্য অন্য কথা ছিল, তার নিশানা খুব ভাল, ছুটন্ত হরিণকেও ফেলে দিতে পারে, আমার অতটা আত্মবিশ্বাস নেই। তার চেয়ে চুপ করেই থাকি, দেখা যাক কি হয়। এক সময় না এক সময় চোখ ফেরাবেই সে, সেই সুযোগে তুলে নেব।
বসে আছি তো আছিই, চোখ আর ফেরায় না হরিণটা। একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে। শেষে আস্তে আস্তে এগোতে শুরু করল আমার দিকে।
কি করব বুঝতে পারছি না। অস্বস্তি লাগছে। দূর থেকে আমাকে চিনতে না পারলেও কাছে এসে ঠিকই চিনে ফেলবে। চোখের পলকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটতে শুরু করবে তখন, এত দ্রুত, গুলি করার সুযোগই হয়তো দেবে না।
উত্তেজনায় বুকের মধ্যে যেন হাতুড়ি পিটছে আমার। টানটান হয়ে গেছে সমস্ত পেশী। আর দেরি করা যায় না। এমনিতেও যাবে ওটা, ওমনিতেও, চুপ করে বসে থাকার চেয়ে বরং একটা সুযোগ নিয়েই দেখা যাক। একটানে রাইফেল তুলে নিলাম কাঁধে।
যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই করল হরিণটা, ঘুরেই দৌড়। নলের মাছির সামনে বাদামী একটা ঝিলিক দেখলাম শুধু। সই করার আর সময় পেলাম না। টিপে দিলাম ট্রিগার।
কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গেল আমার সামনেটা। তার ভেতর দিয়ে কিছুই চোখে পড়ল না। তাড়াতাড়ি রাইফেলে আরেকটা গুলি ভরেই লাফিয়ে উঠে দৌড় দিলাম ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে। অন্য পাশে বেরিয়ে যা দেখলাম তাতে দমে গেল মনটা।
ঝোপঝাড় ভেঙে লেজ তুলে ছুটে পালাচ্ছে ভীত গরুগুলো। ঘোৎ-ঘোৎ করছে। যেন ভূতে তাড়া করেছে ওগুলোকে। ওগুলোর পাশেই ছুটছে আমার হরিণটা। পিঠ বাঁকা। ছোট সাদা লেজটা লেপটে আছে গায়ের সঙ্গে।
বুঝতে পারলাম, গুলি লেগেছে, তবে মারাত্মক কিনা বোঝা গেল না।
ভাল লাগল না এটা। মাংসের জন্যে শিকার করতে খারাপ লাগে না আমার। আব্বা বলে, খাওয়ার জন্যে একজন আরেকজনকে মারতেই পারে, সেটা আলাদা কথা, কিন্তু জখম করে ছেড়ে দেয়াটা বড় খারাপ। বিশেষ করে হরিণের মত সুন্দর একটা প্রাণীকে। এভাবে জখম হয়ে পালিয়ে যাবে ওটা, তারপর অসহ্য যন্ত্রণা পেয়ে ধুকে ধুকে মরবে, ভাবতেই খারাপ লাগল।
আবার রাইফেল তুললাম। কিন্তু গরুগুলোর জন্যে গুলি করতে পারলাম না। মিস হয়ে হরিণের গায়ে না লেগে শেষে গরুর গায়েই লেগে যেতে পারে।
হঠাৎ অদ্ভুত এক কাণ্ড করল হরিণটা। সোজা ছুটে গেল একটা গাছের দিকে। যেন কানা হয়ে গেছে। গাছের গায়ে বাড়ি লাগল মাথা। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। ডুবে গেল ঘাসের মধ্যে। অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে শুধু চোখে পড়ল তার সাদা পেটটা।
অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু উঠল না ওটা। কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে দিলাম দৌড়। চিবুক সমান উঁচু ঘাসের মধ্যে দিয়ে ছোটাও কঠিন। গতি বাড়ানো যায় না।
অবশেষে পৌঁছলাম এসে জায়গাটায়। দম ফুরিয়ে গেছে। জোরে জোরে শ্বাস টানতে টানতে দেখলাম, মরে পড়ে আছে হরিণটা। গুলিটা লেগেছে পেটের একপাশে, হৃৎপিণ্ডের কাছাকাছি।
কি যেন একটা ঘটে গেল নিজের ভেতর। এক লাফে যেন অনেক বড় হয়ে গেলাম। অনেক ক্ষমতাবান আর শক্তিশালী মনে হতে লাগল নিজেকে। তারমানে নিশানা আমার ভালই, গুলি করতে জানি। অহেতুক একটা জানোয়ারের কষ্টের কারণ হইনি। পরিবারের জন্যে মাংস জোগাড় করতে এসেছি, ছুটন্ত হরিণকে গুলি করে ফেলে দিয়েছি, ঠিক আব্বা যা করে। আর কি চাই?
ফিরে চললাম বাড়িতে। পেট চিরে নাড়িভূঁড়িগুলো খুলে ফেলে দিয়ে হরিণটাকে বেঁধে নিয়েছি আমার পেছনে, জাম্পারের পিঠে। গর্বে ফুলে আধহাত উঁচু হয়ে গেছে বুক। শিকারির গর্ব। বার বার একটা কথাই মনে হচ্ছে, আমি সফল, পরিবারের জন্যে খাবার নিয়ে যেতে পারছি। একটা মাত্র গুলিতে অত কঠিন নিশানাকে ফেলে দিতে পেরে নিজেকে অনেক বড় শিকারি মনে হচ্ছে। অনেক বড় হয়ে গেছি যেন। কুকুরটার ব্যাপারে আরলিসকে এখন সিদ্ধান্ত দিতে পারি। তবে রাখতে না দেয়ার কথাটা আর ভাবলাম না। রাখতে চাইছে, রাখুকগে। ছোটদের এসব ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে বড়দের মাথা না ঘামানোই ভাল। কুকুরটা যে চোর, সেটা ভেবেও আর বিরক্ত হলাম না। আরলিসকে খুশি করার জন্যেই ওটাকেও খাওয়াব, কারণ, মাংস জোগাড় করাটা এখন আমার জন্যে কোন ব্যাপার না।
ভাবতে ভাবতে চলেছি। যতই ভাবছি, ততই উদার হয়ে যাচ্ছে মন। বার্ডসং ক্রীক পেরিয়ে গাছপালার নিচ দিয়ে এগোলাম ঘরের দিকে।
হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেল আমার সমস্ত উদারতা। ডোবার মধ্যে আবার দেখলাম আরলিসকে। সে একা নয়, এবার তার সঙ্গে নেমেছে বিশাল কুকুরটাও। চোর, নোংরা, কুৎসিত জানোয়ারটাকে খাওয়ার পানি নষ্ট করতে দেখে আগুন ধরে গেল মাথার মধ্যে।
আরলিস! চিৎকার করে উঠলাম। জলদি পানি থেকে তোল কুত্তাটাকে!
আমাকে আসতে দেখেনি ওরা। চিৎকার শুনে ভীষণ চমকে গেল দুজনেই। লাফাতে লাফাতে পানি থেকে কুকুরটা উঠল একদিক দিয়ে, আরলিস আরেক দিক দিয়ে। গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে আরলিস। আর সেটা দেখেই এমন খাউ-খাউ জুড়ে দিল কুকুরটা, যেন আমি একটা প্যানথার, খেয়ে ফেলতে এসেছি ওদেরকে।
লাফ দিয়ে নামলাম খচ্চরের পিঠ থেকে। চিৎকার করতে করতে কুকুরটা এগিয়ে আসতে লাগল আমার দিকে, ভাবসাব ভাল না, কামড়েও দিতে পারে। তাড়াতাড়ি নিচু হয়ে কয়েকটা পাথর তুলে নিলাম।
আরেকটু এগিয়ে এল ওটা। বড় একটা পাথর ছুঁড়লাম ওটাকে সই করে। থ্যাপ করে গিয়ে লাগল দুচোখের মাঝখানে। বিকট এক চিৎকার দিয়ে পড়ে গেল ওটা। কাঁপতে লাগল থরথর করে। বার দুই কুঁই কুঁই করে এক গড়ান দিয়ে সোজা হয়ে আবার উঠে দাঁড়াল। বিন্দুমাত্র সময় না দিয়ে আরেকটা পাথর ছুঁড়লাম। লাগল পাজরে। যথেষ্ট শিক্ষা হয়ে গেল। কেঁউউ কেঁউউ করতে করতে লেজের গোড়াটা দাবিয়ে ছুটে পালাল বাড়ির দিকে।
আমিই পাথর ছোঁড়ায় একমাত্র ওস্তাদ নই। আরলিসের বয়েস কম, মাত্র পাঁচ, কিন্তু তাতে কি? ট্রেনিং দিয়ে দিয়ে এই বয়েসেই ওকেও আমারই মত ওস্তাদ করে তুলেছি। ওই মুহূর্তে আফসোস হতে লাগল, কেন শেখালাম! আরেকটু হলেই আমার বা কানটা ছিড়ে নিয়ে যাচ্ছিল ওর একটা পাথর। কুকুরটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, পাথরটা কানে লেগে বেরিয়ে যেতেই চরকির মতো পাক খেয়ে ঘুরলাম। ঝট করে মাথা নামিয়ে ফেললাম, নইলে দ্বিতীয় ঢিলটা লাগত আমার বাঁ চোখে।
ধমক দিয়ে বললাম, আরলিস, ভাল চাস তো ওসব বন্ধ কর!
কানেই তুলল না সে। ভয়ে আর রাগে অন্ধ হয়ে গেছে। আরেকটা বিশাল পাথর তুলে নিল। ছুঁড়ে মারার শক্তি থাকলে ওটা দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিত আমার।
চোদ্দ বছর বয়েসে নয় বছরের ছোট ভাইয়ের সঙ্গে পাথর ছোড়াছুঁড়ির যুদ্ধ শোভা পাবে না তোমার। অন্যায়টা তার হয়ে থাকলেও নয়। কিছুতেই বলে বোঝাতে পারবে না একথা বড়দের। তারা তোমাকেই ধিক্কার দেবে, ছি-ছি করবে। বলবে, অত বড় হয়ে ওই অবোধ দুধের শিশুর সঙ্গে লাগতে তোমার লজ্জা করল না? বোঝানো যাবে না, অবোধটি মোটেও অবোধ নয়, আস্ত বিচ্ছু।
সুতরাং এ ক্ষেত্রে যে কাজটা করণীয়, তা-ই করলাম। ইয়েলারটার মতই দৌড় দিলাম বাড়ির দিকে। ওটা কেঁউ কেউ করতে করতে গেছে, আমি ডাকতে ডাকতে গেলাম আম্মাকে।
তেড়ে এল আরলিস। উলঙ্গ শরীর, হাতে পাথর। ওটা দিয়ে আমার মাথা ফাটিয়ে দেয়ার ইচ্ছেটা ত্যাগ করতে পারছে না কিছুতেই। লক্ষ্য ভেদ করার জন্যে মরিয়া হয়ে আমার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করছে।
দৌড়ে অবশ্যই আমার সঙ্গে পারার কথা নয় তার, পারল না। অনেক পেছনে ফেলে দিলাম তাকে। ইতিমধ্যে বেরিয়ে এল আম্মা। স্কার্টের ঝুল উড়িয়ে দৌড়ে এল আমাদের দিকে। এই, কি হয়েছে রে! কি হয়েছে!
চেঁচিয়ে বললাম, আরলিসকে ধরো! বলেই আম্মার পাশ দিয়ে একদৌড়ে বেরিয়ে গেলাম।
ধরে ফেলল আম্মা। কিন্তু আরলিস তখন যেন পাগল হয়ে গেছে। হাত ছাড়ানোর জন্যে টানাটানি করতে লাগল। মনে হচ্ছে আম্মাকেই মেরে বসবে।
যা ঘটবে আশা করেছিলাম, ঠিক তা-ই ঘটল। খাওয়ার পানিতে কুত্তা নিয়ে নামার অপরাধে আরলিসকে ভালমত ধোলাই দিল আম্মা। তারপর আমাকে বকতে লাগল ওর সঙ্গে অত মুরুব্বিয়ানা ফলাতে যাওয়ায়। আর যে কুকুরটা, যার শয়তানীর জন্যে এত কিছু ঘটে গেল, সেটাকে কিছুই বলা হলো না, দিব্যি রেহাই পেয়ে গেল।
বার বার মনে হতে লাগল, আমার প্রতি মোটেও সুবিচার করা হয়নি। এই যদি হয় অবস্থা, পরিবারের দায়িত্ব নেব কিভাবে? আমার কথাই যদি না শোনে, কি ভাবছি না বোঝে, ওদেরকে চালাব কি করে?
ফিরে গিয়ে জাম্পারকে টেনে নিয়ে এলাম উঠানে। বাড়ির পাশের ওক গাছটায় হরিণটাকে ঝুলিয়ে চামড়া ছিলতে শুরু করলাম। কত আশা করে এসেছিলাম, হরিণটাকে মারার জন্যে অনেক বাহবা পাব, আমার অনেক প্রশংসা করবে আম্মা। অথচ কি হয়ে গেল? আমাকে পাত্তাই দিল না। ছোট ভাইয়ের সঙ্গে লাগতে যাওয়ার জন্যে বকাঝকা করল, যদিও পুরো দোষটাই তার। আমাকে আরলিসের চেয়ে একটুও আলাদা করে ভাবছে না, বড় মনে করছে না।
চামড়া ছিলে মাংস কাটতে শুরু করলাম। কেবলই ভাবছি একটু আগের ঘটনাটার কথা। যতই ভাবলাম, ততই রাগ বাড়তে লাগল কুকুরটার ওপর।
ডগ রানে ঝুলিয়ে দিলাম বড় বড় কাটা টুকরোগুলো। এখান থেকেই শুয়োরের মাংস চুরি করে খেয়েছিল শয়তান কুত্তাটা। ইচ্ছে করেই ঝোলালাম ওখানে। দুটো কারণে। জায়গাটা খুব ঠাণ্ডা, মাংস ভাল থাকে। আরেকটা কারণ, দেখতে চাই আবারও চুরি করে কিনা সে। তাহলে ওটাকে তাড়ানোর একটা ভাল ছুতো পেয়ে যাব। এইবার চুরি করলে আর রাখবে না ওকে আম্মা, আরলিস যতই কান্নাকাটি করুক।
কিন্তু আমার ফাঁদে পা দিল না ওল্ড ইয়েলার। আমার ছুঁড়ে দেয়া হাড় চুষতে লাগল বসে বসে। ফিরেও তাকাল না ডগ রানের দিকে। ওখানে যে রসাল মাংস ঝোলানো আছে, তার গন্ধই যেন পায়নি।
<