৩১.
আর্মি কমাণ্ডের রোল কলের মত নয় ন্যাশ ময়নিহানের তলব। তবে ব্যাপারটা প্রায় তেমনই। র্যাঞ্চের ওপরতলায় বিশাল লাউঞ্জে জড় হয়েছে সবাই। প্রত্যেকে দক্ষ খুনি।
চুপচাপ বসে থেকে কাউকে খুন করার সুযোগ পেলে বেশি খুশি হবে।
উপস্থিত হয়েছে ন্যাশ ময়নিহান, রিক বেণ্ডার, র্যাঞ্চের কাজে নিয়োজিত খুনে কর্মচারীরা এবং পাঁচ আততায়ী। শেষের এই পাঁচজন জড় হওয়ায় পরিবেশে বিরাজ করছে চাপা উত্তেজনা ও বিপদের স্ফুলিঙ্গ। যে-কোনও সময়ে ওরা সাধারণ কথায় খুন করবে একে অপরকে। প্রত্যেকের ধারণা, নিজের মাঠে সেই সেরা। নেই দল বেঁধে কাজের অভিজ্ঞতা। নিজেদের এলাকায় আছে অধীনস্থ খুনির দল। এ দলের প্রধান করা হয়নি, তাই অপমান বোধ করছে প্রত্যেকে। তাতে কিছু যায় আসে না ময়নিহানের। কাজে লাগাবে এদের মাঝের দ্বন্দ্ব। পাঁচজনই চাইবে অন্যের চেয়ে ভাল কাজ দেখিয়ে বুঝিয়ে দিতে সেই আসলে সেরা।
সবাই দাঁড়িয়ে থাকলেও ময়নিহান বসেছে উইং-ব্যাড় চেয়ারে। হাতে জ্বলন্ত সিগার। পরনে স্যুটের বদলে সাধারণ পোশাক। উইণ্ডচিটার জ্যাকেট ও ক্যানভাস প্যান্ট। লেস দেয়া বুট। যে-কোনও দিকে সরতে পারবে বিদ্যুতের গতিতে। তা ছাড়া, ডিযাইনার স্যুট ত্যাগ করায় চারপাশের পরিবেশের মতই ধূসর ক্যামোফ্লেজুড় হয়েছে সে। মাথায় ধূসর বেসবল ক্যাপ। উরুর হোলস্টারে ঝুলছে বিখ্যাত সেমি অটোমেটিক বেরেটা পিএক্স ফোর স্টর্ম পিস্তল। ম্যাগাযিনে সতেরোটা গুলি। বাইরের খুনিরা কেউ জানে না, ময়নিহানের ডান কবজির কাছে পাউচে ঘুমাচ্ছে ওর প্রিয় ক্ষুর।
চুপচাপ বসে একে একে প্রত্যেককে দেখল ময়নিহান। এদের একজন ড্যাগেট ওয়াইল্ড। আকারে বেশ বড়সড়। পেশিবহুল শরীর। বিশেষ করে দেখার মত পুরুষ্টু বাইসেপ। হাসি চাপল ময়নিহান। রিক বেণ্ডারের তুলনায় নিতান্তই শিশু ড্যাগেট ওয়াইল্ড। বারকয়েক দানবের দিকে তাকিয়ে দেখেছে লোকটা, চোখে ঈর্ষা ও হেরে যাওয়ার কষ্ট।
এবার সময় হয়েছে সব বিভেদ ভুলে যাওয়ার, বলল ময়নিহান। মাসুদ রানাকে বলেছি আগামীকাল রাতের মধ্যে নিনা ভেঞ্চাকে এনে দিতে হবে। এর ফলে জুড়ি মেয়েটাকে উদ্ধার করতে মরিয়া হয়ে উঠবে সে। হামলা করবে এ র্যাঞ্চে। কিন্তু হাত মিলিয়ে কাজ না করলে, ধরে নিতে পারো প্রত্যেকে মারা পড়বে তোমরা।
আমাদের সঙ্গে পারবে না, বলল ধূসর চুলের এক লোক। কোমরের খাপে ছোরা। অন্যদের বেলায় কপাল ভাল ছিল ওর।
ঘরে সবচেয়ে বয়স্ক লোক এই হ্যাঙ্ক পার্কার। বয়স পেরিয়ে গেছে পঞ্চাশ। অবশ্য শরীরটা এখনও ত্রিশ বছরের যুবকের মতই। বিড়ালের মত ক্ষিপ্র। সবুজ চোখে হিংস্রতা।
ভারী ভুরুর এক যুবক কড়া চোখে দেখল তাকে। আর যাকে পারুক না-পারুক, আমাকে হারাতে পারবে না।
তার নাম ওয়াল্টার হেইন্স। কথার উচ্চারণ থেকে বোঝ যায় এসেছে আয়ারল্যাণ্ডের উত্তর এলাকা থেকে। হ্যাঙ্ক পার্কারের দিকে মাথা ইশারা করল সে। তবে ওই বুড়োর ব্যাপারে আমি ততটা শিয়য়ার নই।
কঠোর চেহারার লোক হেইন্স। শরীরে কটা ক্ষতচিহ্ন। তার বাবা ছিল আইআরএ-র খুনি। নিজেই খুন হয়েছিল এসএএস-এর সৈনিকের হাতে। আমেরিকার নিওয়ার্ক শহরে ত্রাসের রাজ্য গড়েছে তার ছেলে। প্রচণ্ড হিংসা করে পাশের শহর জার্সি সিটির হ্যাঙ্ক পার্কারকে।
টিটকারির হাসি হাসল হ্যাঙ্ক। এ বুড়ো এখনও অনেক কিছু শেখাতে পারবে তোমাকে, বাছা।
চেষ্টা করেই দেখো! বলল হেইন্স।
তোমরা মাথা ঠাণ্ডা রাখো, সতর্ক করার সুরে বলল চার্লস গ্রেড। মিস্টার ময়নিহান ঠিকই বলেছেন। আমাদের উচিত নয় ওই লোককে আণ্ডারএস্টিমেট করা। মারা গেছে ছয়জন প্রশিক্ষিত সৈনিক। প্রত্যেকের কাছে ছিল আগ্নেয়াস্ত্র। এ ঝামেলা উত্রাতে হলে আমাদের থাকতে হবে একাট্টা।
সমস্যাটা কী তোমার, টেক্স? জানতে চাইল হেইন্স, আত্মবিশ্বাস নেই? আগে ভাবিনি মাত্র একজনের ভয়ে এভাবে পুতিয়ে যাবে তুমি। শুনেছি বছরখানেক আগে খালি হাতে খতম করেছ তিন ইউএস মার্শালকে। তা হলে সেসব আসলে মিথ্যা গুজব?
টেক্সাসের লোক চার্লস গ্রেড। ডালাসে নয়, তার ঘাঁটি উত্তরদিকের শহর অস্টিনে। দীর্ঘদেহী, চওড়া হাড়, মাথা ভরা এলোমেলো খড়ের স্তূপের মত কালো চুল। ওপরের পাটিতে দুটো দাঁত নেই তার। সুযোগ পেলেই ওই ফাঁক দিয়ে বের করে জিভ। অনেকে মনে করে আনমনে কী যেন ভাবছে লোকটা। কিন্তু মৃত্যুর পর আর সুযোগ থাকে না ভুল শুধরে নেয়ার।
হেইন্সের দিকে চেয়ে হাসল গ্রেড। ওরা তিনজন ছিল না, দোস্ত। ছিল চারজন। তা ছাড়া, যাকে বাঁচাতে চেষ্টা করেছিল, তাকেও নিকেশ করেছি।
টিটকারির হাসি হাসল হেইন্স। ঘুরে দেখল ড্যাগেট ওয়াইল্ডকে। তোমার কী হাল, ভয় লাগছে, ফ্রেঞ্চম্যান?
কাউকেই ভয় পাই না, বলল ড্যাগেট। তবে চট করে তার চোখ চলে গেল রিক বেণ্ডারের ওপর।
এই খুনির দলে খুব বেমানান পঞ্চম মানুষটি। সে এক যুবতী। নাম মারি কিটন। বারবার প্রমাণ করেছে, যে-কোনও মানুষকে মুহূর্তে খুন করতে পারে সে। কয়েক বছর আগে ছিল ডিইএর এজেন্ট। কিন্তু আইনের উল্টো পথের মানুষদের সঙ্গে জোরালো সম্পর্ক প্রমাণ হওয়ায় চলে গেছে চাকরি। হালকা শরীরের মেয়ে সে। কোমল নয় মুখটা। প্রয়োজনে প্রচণ্ড ব্যথা দিতে জানে যে-কোনও পুরুষকে। নরম সুরে বলল মারি কিটন, তোমার বোধহয় শেখা উচিত ঠিক কখন মুখ বন্ধ রাখতে হয়।
তোমার কাছ থেকে শিখতে হবে, নাকি, মাগী? মারির উদ্দেশে তুড়ি বাজাল হেইন্স। তোমার তো উচিতই হয়নি এখানে আসা। ময়নিহানের দিকে তাকাল সে। জানতে একসঙ্গে কাজ করব, সেক্ষেত্রে এই বাঁজা মেয়েলোকটাকে এসবে ডাকলে কেন?
ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল মারি। হাত চলে গেছে উরুর পাশে হোলস্টারের কাছে।
পারলে অস্ত্রটা বের কর, মাগী, ঠিক জায়গা দিয়ে ওটা ভরে দেব, অন্যদের দিকে চেয়ে হাসল হেইন্স। কিন্তু ওর ফালতু কথা শুনে হাসছে না কেউ। আরও রেগে গেল যুবক। যা, মর, শালারা! আমি একাই দেখিয়ে দেব কীভাবে শেষ করতে হয় লোকটাকে! আমার সামনে পড়বি না কোনও শালা! মারি কিটনের দিকে ঘুরল সে। বিশেষ করে তুই, মাগী, ঘেয়ো কুত্তী!
এত রাগ কীসের, হেইন্স? জানতে চাইল মারি। পাত্তা দিইনি বলে? আগেই তো জানি, বিছানায় এক মিনিটেই খেলা খতম হয় তোমার!
মর, মাগী!
হাসছে অন্য খুনিরা। রাগে লাল হয়ে গেল হেইন্সের দুই গাল। চুপ হয়ে গেছে চরম অপমানে। ড্যাগেট ওয়াইল্ডের মত করেই বুকে বাধল দুই হাত। কড়া চোখে দেখছে মারি কিটন ও হ্যাঙ্ক পার্কারকে। বুঝতে পারছে না, ওই দুজনের ভেতর কাকে বেশি ঘৃণা করে।
যেহেতু, শেষ হয়েছে সবার শুভেচ্ছা বিনিময়, এবার আসা যাক কাজের কথায়, বলল ময়নিহান। তোমাদের বসদের নানান ধরনের উপকার করেছি বলেই তাঁরা তোমাদেরকে পাঠিয়ে দিয়েছেন এখানে। যার যার সিণ্ডিকেটের ফ থেকে এসেছ তোমরা। আমাকে বলা হয়েছে, তোমরা তাদের টপ টেরর। খোঁজ নিয়েও জেনেছি, সত্যিই তোমরা সেরা। কিন্তু, জেন্টলমেন ও লেডি, বিনা পয়সায় কাজ করিয়ে নেব না। বড় অঙ্কের টাকা পাবে মাসুদ রানাকে খুন করতে পারলে। কাজটা কঠিন। তাই তোমাদের মধ্যে চাই সুশৃঙ্খল জোট, নইলে এক এক করে খুন হবে তোমরা। একবার রিক বেণ্ডারকে দেখে নিয়ে আবার শুরু করল ময়নিহান, জানতেও চাই না কে শেষ করল লোকটাকে। প্রথম এবং শেষ কথা, খতম করতে হবে মাসুদ রানাকে। কিন্তু মনে রাখবে, একটা কাজ কখনও করবে না। এক এক করে সবার ওপর চোখ বুলিয়ে নিল সে। বেশিক্ষণ দেখল হেইন্সকে। তোমরা কেউ খুন করবে না মহিলাদেরকে।
আমি তো ভেবেছি ওই নিনা ভেঞ্চুরাকে খুন করতে চান, বস্, বলল চার্লস গ্রেড।
তা ঠিক, তবে মেরে ফেলার আগে ওর পেট থেকে বের করব অনেক জরুরি তথ্য। ওর কাছে আছে আমার বিরুদ্ধে অকাট্য প্রমাণ। তা ফেরত পেতে হবে। আগেই মরে গেলে বিপদ হবে।
আপনি মনে করেন ওই মেয়েকে আপনার হাতে তুলে দেবে মাসুদ রানা? আস্তে করে মাথা নাড়ল মারি। জুডি মেয়েটার জন্যে যেভাবে লড়ছে, তা থেকে বুঝতে পারছি, কোনও মেয়েকে আপনার কাছে পৌঁছে দেবে না সে।
নিনা ভেঞ্চুরা ওর অচেনা। দাম নেই ওর কাছে। কিন্তু জুড়ি অন্য কিছু।
ওরা তো দুই বোন, তাই না?
ড্যাগেট ওয়াইল্ডের দিকে তাকাল ন্যাশ ময়নিহান। প্রথমবারের মত মুখ খুলেছে লোকটা। এতক্ষণ একটু পর পর দেখছিল বেণ্ডারের বাইসেপ। বুক থেকে হাতের বাঁধন খুলল সে। ওই লোক প্রেমিকার জন্যে প্রেমিকার বোনকে কারও হাতে তুলে দেবে না। সেক্ষেত্রে ইজ্জত থাকবে না তার। আপনার কী ধারণা?
আমি কি একটা প্রশ্ন করতে পারি?
চার্লস গ্রেডের দিকে তাকাল ময়নিহান। দুই দাঁতের ফাঁক দিয়ে জিভ বের করেছে লোকটা। তৈরি করল ছোট একটা বুদ্বুদ। হাত বোলাল কাকের বাসার মত চুলে।
কী জানতে চাও?
নিনা ভেঞ্চুরা জীবিত থাকবে তাই যদি অত চান, তা হলে যে-লোক চেষ্টা করছে তাকে আপনার কাছে পৌঁছে দিতে, সেই লোককে খুন করতে চাইছেন কেন?
কারণ, সে অনেক বিপজ্জনক। বাঁচতে দেয়া যাবে না। সত্যি নিনা ভেঞ্চুরাকে আমার হাতে তুলে দিলে, পরে আবারও চেষ্টা করবে তাকে সরিয়ে নিতে।
অথচ, একটু আগেই বলেছেন, চেনেও না সে ওই মেয়েকে, বলল মারি। তা হলে তার জন্যে এত বড় ঝুঁকি নেবে কেন?
কারণ জুডি অনুরোধ করবে।
তা হলে মেয়েটাকে মেরে ফেললেই ল্যাঠা চুকে যায়, বলল ওয়াল্টার হেইন্স, ভয়ঙ্করভাবে খুন করা যায় কুত্তীটাকে। তাতে বুঝিয়ে দেয়া যাবে, ওর বড়বোনকে তোমার হাতে তুলে না দিলে কষ্ট দিয়ে তাকে মারবে তুমি। জুডি কুত্তীটাকে আমার হাতে ছেড়ে দাও, বুঝে যাবে কত কষ্ট হয় মরতে।
রাগী চোখে হেইন্সকে দেখল মহিলা খুনি মারি কিটন। তুমি সত্যিই নোংরা, হেইন্স। নারীবিদ্বেষী। তবে বলে লাভ নেই, সব যাবে তোমার মাথার ওপর দিয়ে।
আমি মেয়েদের পছন্দ করি, বলল হেইন্স। কিন্তু মুখ চালালে তাদের মুখ চিরকালের জন্যে বুজে দিই।
একটা কথা জানো, হেইন্স, বলল মারি, বেশিরভাগ পুরুষ তোমার মত হলে এত দিনে লেসবিয়ান হয়ে যেতাম।
তাই? আমি তো ভাবতাম তুমি ও-ই মালই।
যথেষ্ট হয়েছে, উঠে দাঁড়িয়ে দাঁতের মাঝে সিগার জল ময়নিহান। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, নিজেরা তোমরা বিবাদে মত্ত হলে কাজটা অনেক সহজ হবে মাসুদ রানার।
তা হলে এ মেয়েলোকটাকে বিদায় করো, কড়া সুরে বলল হেইন্স। ঘুরে তাকাল হ্যাঙ্ক পার্কারের দিকে। আর এই বুড়ো হাবড়াটাকেও গুলি করে মারা উচিত। বিপদের সময় আমাদেরকে ধীর করে দেবে এ।
আমার মাথায় একটা ভাল আইডিয়া এসেছে।
ন্যাশ ময়নিহানের দিকে ঘুরতে শুরু করেছে ওয়াল্টার হেইন্স। কিন্তু ঝট করে তার গলার কাছে ডানহাত নাড়ল ময়নিহান। আঙুলের মাঝে দেখা দিল রুপালি ঝিলিক। যেন স্পর্শ করা হয়েছে হেইন্সের ত্বক। কিন্তু বিস্ফারিত হলো যুবকের চোখ। একইসময়ে ফাঁক হয়ে গেল গলা। ওই ফাটল দিয়ে গলগল করে বেরোল রক্ত। ভিজে গেল বুক-পেট। ক্ষুরের আরেক টানে আরও ফাঁক হলো গলা। আর্টারির রক্ত গায়ে লাগবে বলে দুপা পিছিয়ে গেল ময়নিহান।
ওয়াল্টার হেইন্স বুঝে গেছে, মরছে সে। দুহাতে চেপে ধরল গলা। কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই। মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে সাহায্য চাইতে গেল অন্যদের কাছে, কিন্তু ধারালো ক্ষুর কেটে দিয়েছে ল্যারিংস। কণ্ঠ থেকে বেরোল বিদঘুটে গড়গড়ার আওয়াজ। ধমনি থেকে আবারও ছিটকে বেরোল রক্ত। থেমে যাচ্ছে হৃৎপিণ্ড। উপুড় হয়ে ধুপ করে মেঝেতে পড়ল যুবক।
সবার চোখ দেখে নিল ময়নিহান। যথেষ্ট সহ্য করেছি ওই বেয়াড়া গাধাটার অভদ্রতা। তোমাদের কেউ যদি ভাবো ওই সুরে আমার সঙ্গে কথা বলবে, তো চেষ্টা করে দেখতে পারো।
কাঁধ ঝাঁকাল চার্লস গ্রেড। তৃপ্তি নিয়ে হেইন্সের লাশের দিকে চেয়ে রইল মারি। শুধু বিব্রত ড্যাগেট ওয়াইল্ড। তবে তা আইরিশ ম্যানের দুঃখে নয়। মৃদু হাসছে হ্যাঙ্ক পার্কার। সে বলল, সহজ লোক নয় ওই মাসুদ রানা। বাঁচার উপায় থাকত না হেইন্সের। ওর বত্সকে জানিয়ে দেব, বীরের মত লড়তে গিয়ে মরেছে সে।
ধন্যবাদ, শীতল হাসল ন্যাশ ময়নিহান। খুশি হলাম, পার্কার। তবে কারও নির্দেশ মানতে আপত্তি থাকলে, তোমরা দেরি না করে এখনই সেটা জানিয়ে দাও।
তিন খুনিকে মনে হলো খুশি। চিন্তিত ড্যাগেট ওয়াইল্ড, আবারও দুহাত বেঁধে ফেলল বুকে।
কোনও সমস্যা, ওয়াইল্ড? এখনও ময়নিহানের হাতে ক্ষুর।
না, বস, সমস্যা নেই। হেইন্স একটা উটকো ঝামেলা ছিল। উল্টোপাল্টা করে বিপদে ফেলত অন্যদেরকে।
কথা ঠিক, ওয়াইল্ডের পেছন থেকে জানাল গম্ভীর রিক বেণ্ডার। মুখ খুলেছে প্রথমবারের মত। ওই কথা দিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছে, বুঝল না কেউ।
সতর্ক চোখে ওকে দেখল ময়নিহান। তোমরা শিয়োর তো, এখন থেকে পরস্পরের সঙ্গে মিলেমিশে চলতে পারবে? আপত্তি তুলল না কেউ। গুড। তো কাজের কথায় আসা যাক। উবু হয়ে হেইন্সের প্যান্টে রক্তাক্ত ক্ষুরের ফলা মুছল সে। কবজির ভেতরের দিকে চলে গেল অস্ত্রটা। মিটিঙের সময় নীরবে টপ টেররদের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকল ময়নিহানের পেশাদার কয়েকজন খুনি। নিজের কথা শেষ হলে দলের দুজনকে ইশারা করল ক্ষুরধার। লাশটার ব্যবস্থা করো।
ওটার কী করবেন, বস? জানতে চাইল মারি কিটন। দেখছে মেঝে থেকে লাশটা তুলে নিয়েছে দুই লোক।
অন্যদের যা করি, ওরও তাই করব, বলল ময়নিহান। কসাইখানায় গরুর মাংসের মত কুচি করে ক্যান করা হবে।
.
৩২.
যে-কারও জন্যে এক সপ্তাহ মানব-জগৎ থেকে হারিয়ে যাওয়া কঠিন নয়। কারও সঙ্গে যোগাযোগ না করলেই হলো। এড়িয়ে যেতে হবে সব কাগজপত্র ও ইলেকট্রনিক সূত্র। তাতে ধরে নেয়া যায়, যে-কেউ থাকবে মানব রেইডারের নাগালের নিচে। ঝামেলা এড়াতে ঠিক তা-ই করেছে নিনা ভেঞ্চুরা।
গত সাত দিন ছিল মস্তবড় এক ক্রু শিপের সাধারণ অচেনা যাত্রী হয়ে। জাহাজ ওকে নিয়ে গেছে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে। ঘুরে দেখেছে পুয়ের্তো রিকো, সেন্ট থমাস ও সেন্ট মার্টেন। হোটেলে না উঠে রাত কাটিয়ে দিয়েছে জাহাজে নিজের কেবিনে। যেখানে নামতে গেলে দেখাতে হবে পাসপোর্ট বা বোর্ডিং কার্ড, সেসব জায়গায় জাহাজ থেকে নামেইনি সে। মায়ামিতে জাহাজে ওঠার সময় একবার তোলা হয়েছে ক্রেডিট কার্ডের ছবি, কিন্তু এরপর জাহাজে উঠে ব্যাংকিং সিস্টেমের সাহায্য না নিয়ে সবসময় দরকারি জিনিস কিনেছে ও নগদ টাকায়। আর যে তিন দ্বীপে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেছে, সেই হিসাবের রেকর্ড নতুন করে অ্যাকাউন্টে তুলতে লাগবে অন্তত কয়েকটা দিন। ক্রুজ শিপের বুকিং দিয়েছে ক্যাশ টাকায়। হাতে সময় আছে এমন দক্ষ কেউ চেষ্টা করলে টুর অপারেটরের সাহায্য নিয়ে খুঁজে বের করতে পারত ওকে। কিন্তু সেই চিন্তা মাথায় ঢোকেনি ন্যাশ ময়নিহানের।
রানাও ব্যস্ততার কারণে ওসব নিয়ে ভাবেনি।
ডালাসের ফোর্ট ওঅর্থ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে রানা যেতেই টার্মিনাল সি-র লাউঞ্জে বেরিয়ে এল মহিলা। সহজেই তাকে চিনল রানা। জুডির ফোনের ছবিতে যেমন ছিল, সে চুলের স্টাইল পাল্টে ফেলেছে নিনা ভেঞ্চুরা। ছোট চুলে এখন কালো ডাই। প্রায়-গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোদে ত্বক তামাটে। চোখে বড় সানগ্লাস। একটু ভারী গড়ন আর সামান্য খাটো হলেও জুডির সঙ্গে তার চেহারায় ঢের মিল। বড়বোন নয়, অনেকে ভাববে যমজ।
হাই, নিনা, বলল রানা। এলেন, তাই খুশি হয়েছি।
যা বললেন, এরপর না এসে উপায় আছে, বলুন?
নিনা অত্যন্ত নার্ভাস, বুঝে গেল রানা। স্বাভাবিক। এক সপ্তাহের বেশি হলো প্রাণের ভয়ে লুকিয়ে আছে মহিলা। আর ওর নিজের বক্তব্য ছাড়া এমন কোনও প্রমাণ নেই যে ও আসলে ভয়ঙ্কর খুনি নয়।
সানগ্লাসের ওদিক থেকে রানাকে দেখছে নিনা ভেঞ্চা। একবার আমার ভাইকে গাড়িতে করে আমাদের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। পরে ওর কাছে আপনার অনেক সুনাম শুনেছি। ছবিও দেখেছি। তাই মনে আছে চেহারা।
চলুন, যাওয়া যাক, বলল রানা।
নিনার হাতে ছোট ব্যাগ। ওটা হাতে রানার পাশে পার্কিংলটের দিকে চলল মেয়েটা।
ব্ল্যাকমেইলার বলে কথা, তাই ভদ্রতা করে তার ব্যাগ বইতে গেল না রানা। টার্মিনাল থেকে বেরিয়ে উইণ্ডস্টারের পাশে পৌঁছুল ওরা। দুবন্ধুর কাছ থেকে গাড়িটা ধার নিয়েছে রানা। ওদিকে কেবিনে বসে প্ল্যান নিখুঁত কি না, তা নিয়ে গবেষণা করছে জন ও বাড।
নিনা গাড়িতে উঠতেই উত্তরদিকের সড়ক ধরে পাইলট পয়েন্ট লক্ষ্য করে চলল রানা। কিছুক্ষণ পেরোল, কথা হলো না ওদের মাঝে। ছোটবোন খুন হবে, তাই ভীত এবং চিন্তিত নিনা। চুপ করে আছে।
প্রথমে নীরবতা ভাঙল রানা, ন্যাশ ময়নিহানের বিরুদ্ধে কী ধরনের প্রমাণ আছে আপনার কাছে?
জেনে কী করবেন? অস্বস্তি বোধ করে সিটে সরে বসল নিনা।
রানার মনে হলো, চলন্ত গাড়ি থেকে নেমে পড়বে মেয়েটা। আপনার কাছে কিছু তথ্য বা প্রমাণ আছে, যেগুলোর জন্যে ক্ষতি হতে পারে ময়নিহানের ব্যবসার। ব্যাপারটা কি এর চেয়েও বেশি কিছু?
জবাব দিল না নিনা। ভাবছে কী যেন। একটু পর উল্টো প্রশ্ন করল, আপনি কি জুডির প্রেমিক?
না, জানাল রানা। ভাবছে, প্রেমিকা না হলেও জুডির জন্যে অদ্ভুত এক আকর্ষণ জন্মেছে ওর মনে।
ভেবেছিলাম আপনি আর ও…
জুডি অনুরোধ করায় আপনাকে খুঁজতে শুরু করি।
ভয়েসমেইল খোলার পর পেলাম ওর মেসেজ। তাতে মনে হয়েছিল… আপনি… ইয়ে…
প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলল রানা, ভাল করেছেন যোগাযোগ করে, নিনা। এখন আমাদের কাছ থেকে সাহায্য খুব দরকার জুডির।
সানগ্লাসের নিচে আঙুল নিল নিনা। রানার মনে হলো মেয়েটা মুছে ফেলল অশ্রু। রাস্তার দিকে মনোযোগ দিল ও। এগোতে হচ্ছে প্রচুর গাড়ির মাঝ দিয়ে। নাম নর্থ স্টেমন্স ফ্রিওয়ে হলেও ভীষণ জ্যাম। কাছেই লিউইসভিল লেক। সামনেই সেতু। পথের পাশে সাইনবোর্ডে লেখা: হিকোরি ক্রিক ও কোরিথ টার্ন অফ। সামনেই ডেণ্টন।
কোথায় নিয়ে চলেছেন? জানতে চাইল নিনা।
পাইলট পয়েন্টে একটা কেবিনে যাব। ওখানে অপেক্ষা করছে আরও দুজন।
কারা তারা?
নাম জন হার্বার্ট ও বাড হিগিন্স। হয়তো নাম শুনেছেন আপনার ভাইয়ের কাছে।
জর্ন হার্বার্ট? ওই যে, যার মা ছিলেন জাপানি?
ঠিকই ধরেছেন।
আমাকে খোঁজার জন্যে তাদেরকে ভাড়া করেছে জুডি?
না। জুডিকে উদ্ধার করতে ওদের সাহায্য নিচ্ছি আমি।
আপনারা মাত্র তিনজন, হতাশ সুরে বলল নিনা, আপনি কি জানেন, একটা ফোন দিলেই অন্তত বিশজন খুনিকে জড় করতে পারবে ন্যাশ ময়নিহান?
তাদের অনেকে ঝরে গেছে, বলল রানা। খুলে জানাল লিটল ফোর্কে যাওয়ার পর কী হয়েছে।
শুনতে শুনতে ফ্যাকাসে হয়ে গেল নিনা। রানা থামার পর বলল, আপনি নিক বেণ্ডারকে খুন করেছেন?
নইলে আমাকে খুন করত।
আর রিক বোর?
পালিয়ে গিয়েছিল।
দুহাতে মুখ ঢাকল নিনা। ফুঁপিয়ে উঠল কবার। একটু পর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ওরা দানব। আপনি হয়তো জানেনও না কী করেছে ফ্র্যাঙ্ক ম্যালভির। সে ছিল লিটল ফোর্কের…
শেরিফ এবং আপনার প্রেমিক, কথাটা শেষ করল রানা।
সানগ্লাস মাথার ওপর তুলে ওকে দেখল নিনা। লালচে হয়েছে দুচোখ।হ্যাঁ। সে আমার প্রেমিক ছিল। কিন্তু ওকে পিটিয়ে মেরেছে বেণ্ডাররা। ম্যালভির কান ছিঁড়ে নিয়েছিল নিক।
এ ধরনের লোকের সঙ্গে মিশলে যে-কোনও সময়ে আসে বিপদ, শুকনো গলায় বলল রানা। ময়নিহানকে ব্ল্যাকমেইলের চেষ্টা করা উচিত হয়নি ফ্র্যাঙ্ক ম্যালভির।
বিড়বিড় করে কী যেন বলল নিনা। মাথা থেকে সানগ্লাস নিয়ে বন্ধ করল দুই উঁটি। ওটা রেখে দিল পার্সে।
রানা দেখল, ব্যাগে মেয়েলি কিছু জিনিস ও ডিজিটাল ভিডিয়ো ক্যামেরা। জানতে চাইল, ওরা যখন খুন করছে ম্যালভিকে, সে সময়ে ওখানে ছিলেন আপনি?
হ্যাঁ। ক্যামেরাটা স্পর্শ করল নিনা। লুকিয়ে ছিলাম জঙ্গলে। ফ্র্যাঙ্কের সঙ্গে কথা হয়েছিল, ভিডিয়ো করব পুরো মিটিং। ওটাকে কাজে লাগাব ময়নিহানের বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে।
তবে কি ধরে নেব ময়নিহানকে ব্ল্যাকমেইল করছিল না ম্যালভি?
অবশ্যই না। ময়নিহান বা জাজ হোন্ডের বিরুদ্ধে জোগাড় করছিল প্রমাণ। কথা অনুযায়ী টাকা নেবে সে, তারপর সব প্রমাণ তুলে দেবে স্টেট পুলিশের হাতে। ফ্র্যাঙ্ক জানত, এ ছাড়া উপায়ও নেই। সেজন্যে ওই লোকগুলোর মতই ভান করেছে, ও-ও ভয়ঙ্কর দুর্নীতিপরায়ণ।
আগেই কেন যোগাযোগ করেনি স্টেট পুলিশের সঙ্গে? কী দরকার ছিল আপনাকে দিয়ে ভিডিয়ো রেকর্ড করার?
আমাকে অন্তর থেকে ভালবাসত ফ্র্যাঙ্ক। বুঝছিল না, দলের কাকে বিশ্বাস করবে, আর কাকে নয়। অনেকেই জড়িয়ে যায় ময়নিহানের জালে। স্টেট পুলিশের সঙ্গে কথা বললে, ময়নিহানের কাছে সব ফাঁস করে দেয়া হবে না, এমন নিশ্চয়তা ছিল না। তারপর বেণ্ডারদের সঙ্গে যখন হাজির হলো ম্যাকলাস্কি, ফ্র্যাঙ্ক বুঝল ওর ধারণাই ঠিক।
অস্টিন ম্যাকলাস্কি বলেছে, ম্যালভি খুন হওয়ার পর আপনি নিজেই ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করেন। সরাসরি মহিলার চোখে তাকাল রানা। আপনার দাবি ছিল দুই মিলিয়ন ডলারের।
ওর কথা বিশ্বাস করলেন? মাথা নাড়ল নিনা।
বিশ্বাস না করার কারণ পাইনি, বলল রানা। চেপে গেল তখন লোকটার পেট থেকে তথ্য জোগাড় করছিল ও।
অসম্ভব মিথ্যুক তোক সে, মুখ ঘুরিয়ে নিল নিনা।
রানা বুঝল, ম্যাকলাস্কি একমাত্র মিথ্যুক নয়। সহজ সুরে বলল ও, সে মিথ্যুক কি না তা আর জানার উপায় নেই। তবে আপনি যেটা করেছেন, তা বেআইনী, নিনা। অবশ্য, ময়নিহান বা অন্যরা যা করছে, সে তুলনায় আপনার অপরাধ অনেক কম। খারাপ লাগছে যে আপনার লোভের জন্যে আজ জীবনের শেষপ্রান্তে পৌঁছে গেছে জুডি।
আমি কাউকে ব্ল্যাকমেইল করিনি, শুধু চেয়েছি আমার প্রাপ্য টাকা। ময়নিহানের কাছে টাকা পাই আমি।
কয়েক হাজার ডলার, বলল রানা।
সেটা বড় কথা নয়। রেস্টুরেন্টের জন্যে কাজ করেছি, অথচ আমার টাকা আটকে দিল সে। চাইনি এমনি এমনি তাকে ছেড়ে দিতে।
তার মানে, কয়েক হাজার ডলার আদায় করতে গিয়ে নিজের বোনকে ফেললেন মৃত্যুর মুখে। কাজটা কী ভাল করেছেন?
আমি জানতাম না যে এসবে জড়িয়ে যাবে জুডি।
সেটা বড় কথা নয়, নিনার একটু আগের কথাটাই ব্যবহার করল রানা। মস্তবড় বিপদে আছে জুডি।
দুহাতে মুখ ঢাকল নিনা। থরথর করে কাঁপছে আঙুল।
রানা ভাবছে, বিপজ্জনক লোকের কাছ থেকে মেয়েটা নিজের প্রাপ্য আদায় করতে গেছে, তা বিপজ্জনক; কিন্তু এর চেয়েও ঢের বড় অন্যায় আছে। সেটা নিরীহ মানুষের কাছ থেকে জোর করে ঘুষ আদায় করা। বাংলাদেশে সেটা চলছে পূর্ণমাত্রায়। আবারও নিনার দিকে মনোযোগ দিল রানা। নিনা, দেখিয়ে দিয়েছি আমার হাতের সব তাস। আপনি জানেন, আমি কে এবং কী করি। জুডিকে ছুটিয়ে নিতে ডেকেছি দুজন বন্ধুকে। তবুও আপনার বিশ্বাস না এলে আমার আর কিছু করার নেই। নিনাও বুঝে গেছে, হয়তো প্রাণে বাঁচবে না জুডি। ভাল করবেন খুলে বললে, ন্যাশ ময়নিহানের বিরুদ্ধে কী ধরনের প্রমাণ আছে আপনার হাতে।
মাথা দোলাল নিনা। ডান চোখের কোণে টিপটিপ করে লাফ দিচ্ছে একটা নার্ভ। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। লিটল ফোর্কের ওই রেস্টুরেন্টের জন্যে তৈরি করি পাবলিসিটি ক্যাম্পেনের একটা ওয়েবসাইট।
ভিলাজ-ও-সঁও।
হ্যাঁ। মালিকপক্ষ চেয়েছিল নতুন করে সাজিয়ে নেবে রেস্টুরেন্ট। প্রচুর খরচ করেছিল আধুনিক আসবাবপত্রের জন্যে। চমক দিতে চেয়েছিল লিটল ফোর্কের নাগরিকদের। দেখার মত হয়ে ওঠে ওই রেস্টুরেন্ট।
এ কথায় রানার মনে পড়ল, এখন কী অবস্থা ওই বাড়িটার।
যখন শুনলাম ওটা বিক্রি করেছে মালিকপক্ষ, খুব অবাক হলাম। অথচ, কদিন আগেও খুব হৈ-চৈ করছিল তারা। এদিকে তৈরি হয়েছে আমার পাবলিসিটি ক্যাম্পেন প্রোগ্রাম। আর তখনই আমার পায়ের তলা থেকে সরিয়ে নেয়া হলো পাপোশ।
ওই রেস্টুরেন্ট কিনে নিল ন্যাশ ময়নিহান, বলল রানা, জানিয়ে দিল কাজের জন্যে কিছু দেবে না।
হ্যাঁ, মাথা দোলাল নিনা। এর কোনও ব্যাখ্যা দিল না কেউ। হঠাৎ করেই শহর ছেড়ে চলে গেছে মালিকপক্ষের সবাই। হাজির হলো ন্যাশ ময়নিহান। জানি, ব্যবসার সময় কখনও কখনও এমন হয়। তবুও কেমন যেন সন্দেহ হলো। বলে দেয়া হলো, যেন সরিয়ে নিই রেস্টুরেন্ট অফিস থেকে আমার ইকুইপমেন্ট। বলতে লজ্জা লাগছে, আর কারও কাছে স্বীকার করব না, তবে নিজের মালপত্রের সঙ্গে তাদের কমপিউটারের কিছু কাগজপত্র সরিয়ে ফেললাম। জানলাম, জোর খাঁটিয়ে রেস্টুরেন্ট দখল করেছে ময়নিহান। সেজন্যে আগের মালিকপক্ষকে দিয়েছে মাত্র বিশ হাজার ডলার। অথচ ওই সম্পত্তির দাম অন্তত দুই থেকে তিন লাখ ডলার।
এরপর গেলেন শেরিফের কাছে। ফ্র্যাঙ্ক ম্যালভিও জেনে গেল অন্যায়ভাবে ওই সম্পত্তি দখল করেছে ন্যাশ ময়নিহান। আগ্রহী হয়ে উঠল সে।
আগেই টের পেয়েছিল, গোলমাল আছে। আমাকে জানাল, আগে থেকেই জাজ হোল্ডের বিপক্ষে তদন্ত করছে ও। ওই লোক অনেক দিন ধরেই আদালতকে কাজে লাগিয়ে জমি-জিরাত কম দামে বিক্রি করছিল ময়নিহানের কাছে। ফ্র্যাঙ্ক আরও জানাল, ওর চাই আরও শক্ত প্রমাণ। এমন কিছু, যেটার জন্যে ফসবে জাজ হোল্ড আর ন্যাশ ময়নিহান।
ডেণ্টন শহরের ভিড় ভরা রাস্তায় পৌঁছে গাড়ি চালনায় মন দিল রানা। সরে গেল উত্তরদিকে এক শাখা রাস্তায়। চলেছে রে রবার্ট লেক লক্ষ্য করে। চুপ হয়ে গেছে নিনা ভেঞ্চুরা। তবে রানার মনে হলো না, সব কথা বলেছে সে। ওসব কথায় রয়েছে বড় কিছু ফাঁক।
জাজ হোল্ড আমাকে বলেছিল, চাপের মুখে ফ্র্যাঙ্ক ম্যালভির কথা মত তাকে পুরো টাকা দিয়েছিল ময়নিহান, বলল রানা। তবুও আরও বেশি চেয়ে বসল সে।
নড়েচড়ে বসল নিনা। চোখে অপরাধী দৃষ্টি। তা যদি করেও থাকে, সেটা আমি জানি না।
মিথ্যা না বলাই ভাল, নিনা। ফ্র্যাঙ্ক ম্যালভি শেরিফ হলেও চেয়েছিল হঠাৎ বড়লোক হতে। আর আপনার মনে হলো: ভালই তো, প্রতিশোধ নেয়া যাবে ন্যাশ ময়নিহানের ওপর।
অস্বীকার করছি না। মনে হয়েছিল উপযুক্ত শাস্তি হওয়া উচিত তার। তাতে ফিরে পাব প্রাপ্য টাকা। শায়েস্তা করতে চেয়েছি তাকে। …কিন্তু আপনি ভুল ভাবছেন, সত্যিই সব টাকা তুলে দিতাম স্টেট পুলিশের হাতে।
নিজের টাকা সরিয়ে নেয়ার পর?
তা ভাবিনি। কঠোর হলো নিনার চোখ। নিয়ম মেনেই আদায় করতাম টাকা। সেজন্যে পাঠাই উকিলের নোটিস। ভেবেছি, জাজ হোল্ড আর ময়নিহান মামলায় ফেঁসে গেলে আমার জন্যে সহজ হবে টাকা পাওয়া।
কাজেই আপনারা চাপ দিলেন ময়নিহানকে, যাতে সে গোপনে দেখা করে ফ্র্যাঙ্ক ম্যালভির সঙ্গে? টার্নপাইক পেরিয়ে উত্তরদিকের রাস্তায় পড়ল রানা। কেন ভাবলেন যে জঙ্গলে দেখা হলে তা আপনাদের জন্যে সুবিধাজনক হবে?
প্রস্তুতির সময় ছিল না। নিজে নার্ভাস ছিল ময়নিহান। এমন জায়গায় টাকা নিতে হবে, যেখানে ছবি তুলে প্রমাণ রাখতে পারব। তাই গ্রেট ওয়েলস ওঅটারফলের কাছের জঙ্গল বেছে নিলাম আমরা। ভাল করেই চিনতাম আশপাশের সব জায়গা, যেখানে লুকিয়ে পড়তে পারব। আগেই ভিডিয়ো ক্যামেরা নিয়ে ওখানে চলে যাই আমি।
কিন্তু ঠিক সময়ে এল না ন্যাশ ময়নিহান, বলল রানা। বদলে এল ম্যাকলাস্কি আর দুই বেণ্ডার। তারা খুন করল ফ্র্যাঙ্ক ম্যালভিকে।
না, একটু ভুল বললেন। ময়নিহান ওখানে ছিল।
তাই কী?
হ্যাঁ, অন্যরা না জানলেও, আমি ওকে দেখেছি। উপভোগ করছিল খুনের প্রতিটি মুহূর্ত।
তার ভিডিয়ো তোলেন আপনি?
হ্যাঁ।
এখনও আছে ওই ভিডিয়ো?
পার্সের ক্যামেরা স্পর্শ করল নিনা। এখানেই আছে।
কপি করেছেন?
অবশ্যই।
মাথা দোলাল রানা। ম্যাকলাস্কি বলেছিল আপনি খুন হতে দেখেননি।
অসম্ভব মিথ্যুক লোক, বলল নিনা। ভিডিয়ো দেখাতে পারব কীভাবে ফ্র্যাঙ্ককে খুন করছে তারা। ভাল করেই জানে, প্রমাণ আছে আমার কাছে। তাই খুন করতে জঙ্গলে। খুঁজছিল আমাকে। লুকিয়ে ছিলাম পুরো একদিন একরাত। তারপর বহু কষ্ট করে পালিয়ে যেতে পারলাম। সরাসরি রানার চোখে তাকাল নিনা। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, কী কারণে নিজেকে বাঁচাতে এত মরিয়া ন্যাশ ময়নিহান?
বুঝলাম, বলল রানা, কিন্তু সেক্ষেত্রে কেন গল্প ফাঁদল অস্টিন ম্যাকলাস্কি? আপনি ব্ল্যাকমেইল করতে চেয়েছেন ওদেরকে?
যাতে পিছু নেয়া বাদ দেয়, তাই হুমকি দিই। স্টেট পুলিশের হাতে প্রমাণ তুলে দিলেও প্রাণে বাঁচতাম না। পেছনে খুনি লেলিয়ে দিত ময়নিহান। তখন মনে হলো তার কাছ থেকে অনেক টাকা চাইলে চমকে যাবে সে। তাতে অন্যদিকে সরাবে মনোযোগ।
উল্টো আরও জটিল করলেন সব। ভাল করতেন জুডিকে জানালে। পুলিশ অফিসার। ভাল করেই বুঝত কী করা উচিত।
দেরিতে বুঝেছি, ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল নিনা।
ওর জন্যে খারাপই লাগল রানার। বলল, বড় কয়েকটা ভুল করেছেন। ভুল আমিও করেছি। এরপর থেকে প্রতিটা পা ফেলতে হবে সতর্ক হয়ে।
আমরা কি প্রমাণ নিয়ে পুলিশের কাছে যাব?
আপাতত না। তাতে খুন হবে জুডি।
তা হলে কী করব আমরা?
শেষ করব ঝামেলা। পথের ধারে গাড়ি থামাল রানা। হাওয়ার জোর ঝাপটা দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে পেছনের গাড়ি। গম্ভীর রানা বলল, জুডিকে উদ্ধার করতে কি আপনি তৈরি? হয়তো নিতে হবে মস্তবড় ঝুঁকি।
যা বলবেন, তাই করব। বোনের জন্যে জান দিতেও দ্বিধা করব না।
গুড, বলল রানা, তা হলে নিন মানসিক প্রস্তুতি।
.
৩৩.
বসো, নরম সুরেই বলল জ্যাকসন।
বাথরুমে যেতে হবে। উসখুস করল জুডি।
আবারও? একটু আগে না গেলে?
অনেক পানি খেয়েছি, তাই না গেলেই নয়।
বিরক্ত হলো জ্যাকসন। চলে এসেছে লোগানের পালা। একটু পর যেয়ো।
খোঁচা দিল জুডি, ভয় পাচ্ছেন? আপনাকে তো সাহসী মানুষ বলেই ভাবতাম?
ওকে ধর্ষণ করতে চেয়েছে লোগান টার্সন। অনুমতিও দিয়েছে ময়নিহান। ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ওর ব্লাউস আর ব্রা খুলে স্তন মন্থন করেছে জানোয়ারটা। লোভে বেরিয়ে গিয়েছিল জিভ। তবে খোলেনি ওর জিন্সের প্যান্ট। কুকুরটা ময়নিহানের জরুরি কাজ নিয়ে ঘর থেকে চলে যাওয়ায় হাঁফ ছেড়েছে জুডি।
জ্যাকসন ভাড়াটে মস্তান হলেও টার্সনের মত লোভী এবং অভদ্র নয়। সাহায্য করেছে ব্লাউস পরতে। লম্বায় সে সোয়া ছয় ফুট। ধূসর রঙের চুল খাটো করে ছাঁটা। গালে অসংখ্য লাল ফুটকি। গোল কাঁচের চশমার ওদিকে বড় দুটো নীল চোখ। অনামিকায় সোনার আঙটি। বিবাহিত তোক। তাকে এদের মাঝে দেখে অবাকই হয়েছে জুডি। তার বাচ্চা আছে কি না, কে জানে! হয়তো আছে। সেজন্যেই এখনও আছে বিবেক।
ভয় পাচ্ছি না, বলল জ্যাকসন। চেয়ারে বসো।
প্রস্রাব করতেই হবে। নইলে এখানেই… মেঝে দেখাল জুডি।
কাজটা করলে তোমাকেই পরিষ্কার করতে হবে।
তার চেয়ে ভাল হতো না বাথরুমে যেতে দিলে?
আরে বিপদ! চেয়ার ছেড়ে হলওয়ের দরজা খুলল জ্যাকসন। হোলস্টার থেকে নিল পিস্তল। নল দিয়ে ইশারা করল জুডিকে। বাথরুমে যাবে। কিন্তু দেরি করবে না, ঠিক আছে? আর সঙ্গে যাব আমিও।
মাথা দোলাল জুডি। চলল বাথরুমের দিকে। পেছনেই পিস্তল হাতে জ্যাকসন। ময়নিহান র্যাঞ্চে বন্দি হওয়ার পর থেকে চলছে এ নিয়ম। জুডি বাথরুমে গেলে চোখ রাখছে কেউ না কেউ। ওর গোপনাঙ্গ দেখার লোভে বেশিরভাগ সময় যাচ্ছে টার্সন। তবে জুডি আবিষ্কার করেছে, উপায় আছে পালিয়ে যাওয়ার। বাথরুমে একটা জিনিস খেয়াল করেনি জেলাররা। ওটা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে, ও। হয়তো প্রতিশোধ নিতে পারবে ওর অপমানের।
খুলে দেবেন হাতকড়া? দুহাতই ব্যবহার করতে হবে। জিন্সের প্যান্টের বোতাম দেখাল জুডি। চোখ গেল টয়লেট সিটের ওপর। অথবা আমার হয়ে করতে পারেন কাজটা।
জুডির হ্যাণ্ডকাফ খুলে বাথরুমের দরজার হ্যাণ্ডেলে ঝুলিয়ে দিল জ্যাকসন। দেখাল টয়লেটের বাউল। ঠিক আছে। কাজ ঝটপট শেষ করো।
অবশ হয়েছে আঙুল, কবজি নেড়ে রক্ত চলাচল ঠিক করতে চাইল জুডি। বন্ধ করতে গেল দরজা।
কিন্তু পা বাড়িয়ে দরজা বন্ধ হওয়া ঠেকাল জ্যাকসন। না, দরজা খোলা থাকবে।
ঠিক আছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে টয়লেটের দিকে ফিরল জুডি। খুলতে শুরু করেছে জিন্সের প্যান্টের বোতাম।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলল জ্যাকসন। আধখোলা রেখেছে দরজা। গলা চড়াল: আমরা সবাই লোগানের মত পশু নই। ভেতরে কী করবে দেখতেও চাই না। কোনও চালাকি না করলেই হলো।
আপনি লোগানের মত নন, তা জানি, ভেতর থেকে বলল জুডি। অনেক ধন্যবাদ, জ্যাকসন।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজার দিকে পিঠ দিল লোকটা।
কবাটের ফাঁক দিয়ে জুডি দেখল, হোলস্টারে পিস্তল রেখেছে জ্যাকসন। মনে মনে হাসল ও। এবার সুযোগ করে পালিয়ে যেতে হবে। আগে মনে আশা ছিল, উদ্ধার করবে রানা। কিন্তু পরে বুঝেছে, তা হওয়ার নয়। নিজেরই কিছু করতে হবে। হলিউডের মেকাপ করা নায়িকাদের মত চুপ করে বসে থাকবে আর নায়ক এসে উদ্ধার করবে, তা হবে না। ভুললে চলবে না, ও এনওয়াইপিডির পুলিশ অফিসার। সুতরাং নামতে হবে কাজে।
টয়লেটের সিটে বসল জুডি। পরের কাজ কঠিন। এটা ভাবতে গিয়েই রক্তে ছড়াল অ্যাড্রেনালিনের স্রোত। তৈরি হয়ে নিচ্ছে লড়তে বা পালিয়ে যেতে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক বোঝাতে রোল থেকে নিল টিশ্য। কয়েক সেকেণ্ড পর করল ফ্লাশ। পরে নিল প্যান্ট। যে জিনিস দেখে মুক্তির কথা ভেবেছে, ওটা তুলে নিল কমোডের পেছন থেকে। একবার কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল জ্যাকসন। তাকে পাত্তা না দিয়ে সিঙ্কে হাত ধুতে লাগল জুডি। ভারী তোয়ালে দিয়ে শুকিয়ে নিল হাত। জিনিসটা ঠিক জায়গায় না ঝুলিয়ে চলল বাইরে জ্যাকসনের দিকে। মনোযোগ আকর্ষণ করতে গিয়ে বলল, সত্যি ধন্যবাদ, জ্যাকসন। হাসছে জুডি। খুব চাপ ছিল।
ঠিক আছে, এবার ফিরতে হবে ঘরে।
আচ্ছা, হাত থেকে তোয়ালে ফেলল জুডি। আমার কাজ শেষ।
জুডিকে নিয়ে ঘরে ফিরবে জ্যাকসন। দরজার হ্যাণ্ডেল থেকে নিতে গেল হাতকড়া। হাঁ করল কী যেন বলতে। কিন্তু তখনই পোকামাকড় মারার অ্যারোসলের ক্যান ওপরে তুলল। জুডি। এতক্ষণ ওটা ছিল তোয়ালের আড়ালে। দেরি না করেই ক্যাপ খুলে জ্যাকসনের চোখে-মুখে অ্যারোসল স্প্রে করল জুডি।
ইনসেকটিসাইড খুন করবে না লোকটাকে। কিন্তু চোখে ঢুকতেই জীবনটা নরক হলো তার। মুখে বিশ্রী স্বাদ। ভীষণ জ্বলছে চোখ। যেন মুখে ছুঁড়ে দিয়েছে সালফিউরিক অ্যাসিড। সরল টলতে টলতে। দুহাতে ঢেকে ফেলেছে চোখ। স্প্রের ধক খানিকটা ঠেকিয়ে দিয়েছে চশমা, তবুও আপাতত সে অন্ধ। আরও কবার জ্যাকসনের চোখে-মুখে স্প্রে করল জুডি। পরের কাজ আরও কঠিন।
খালি পায়ে লোকটার উরুসন্ধিতে লাথি মারল জুডি। নিজেই ফুঁপিয়ে উঠল পায়ের ব্যথায়। কিন্তু জ্যাকসনের মনে হলো আগে কখনও এত ব্যথা পায়নি সে। গুঙিয়ে উঠে দুই হাতে গোপনাঙ্গ ও অণ্ডকোষ চেপে ধরল সে। হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে মেঝেতে। হ্যাণ্ডেল থেকে হ্যাণ্ডকাফ নিয়েই ঝট করে ওদিকে ঘুরল জুডি। শেকলের নয়, এ হ্যাণ্ডকাফের মাঝে রয়েছে লোহার পুরু ডাণ্ডা। জ্যাকসনের মাথার ওপর গায়ের জোরে ওটা নামাল জুডি। মাথা বাঁচাতে হাত তুলল জ্যাকসন। হোলস্টারের পিস্তলে থাবা দিল অন্যহাত। দ্বিতীয়বারের মত তার মাথায় হ্যাণ্ডকাফের বাড়ি দিল জুডি। খুলির চামড়া ও মাংস কেটে দরদর করে নামল রক্ত।
জুডির দিকে ঘুরতে চাইছে জ্যাকসন। কিন্তু পেছনে গিয়ে হাতটা ধরে ফেলল জুডি। পরক্ষণে কবজিতে পরিয়ে দিল হাতকড়ার একটা কাফ। লোহার পুরু ডাণ্ডার কারণে ইচ্ছে হলে শক্তিশালী যে কাউকে দিতে পারবে প্রচণ্ড ব্যথা। হ্যাণ্ডকাফ মুচড়ে দিয়ে জ্যাকসনের হাত পেছনে নিল জুডি। বেকায়দাভাবে কবজি আটকা পড়েছে লোকটার। ঘাড় ধরে জোরে নিচে ঠেলে দিতেই বাধ্য হয়ে শুল সে। এ সুযোগে তার পিঠে হাঁটু রেখে অন্যহাতও হ্যাণ্ডকাফে আটকে নিতে চাইল জুডি। বাধা দেয়ার চেষ্টা করছে জ্যাকসন, কিন্তু আটকা পড়া হাতটা মুচড়ে দেয়ায় গুঙিয়ে উঠল ব্যথায়। পরক্ষণে তার মুক্ত হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল জুডি।
হোলস্টার থেকে প্রায় খসে পড়েছে পিস্তল। খপ করে ওটা নিল জুডি। উপুড় হয়ে পড়ে আছে জ্যাকসন, লড়তে পারে, বা দিতে পারে চিৎকার।
মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিল জুডি। গায়ের জোরে পিস্তলের বাঁট দিয়ে বাড়ি দিল শত্রুর ঘাড়ে। গাল বকে উঠল জ্যাকসন, কিন্তু আবারও তার ঘাড়ে বাঁট নামাল জুডি। বিড়বিড় করছে, অজ্ঞান হও… অজ্ঞান হও… আরে, বাপু…।
রিক বেণ্ডারের মাথার পাশে বাড়ি দিয়ে ওই পাহাড়টাকে অজ্ঞান করেছে রানা, নিজ চোখে দেখেছে জুডি। তা হলে এই বেয়াক্কেলেটা এমন করছে কেন? একের পর এক বাড়ি দিতে হবে? কিন্তু খুলি ভেঙে মগজে গেঁথে গেলে? কিন্তু উপায়ই বা কী? চিন্তা বাদ দিয়ে পিস্তলের নলের জোরালো আরেক বাড়ি দিল জ্যাকসনের চাদি বরাবর। ফুঁপিয়ে উঠে ঘুমিয়ে পড়ল লোকটা, নিচ্ছে হালকা শ্বাস।
উঠে দাঁড়াল জুডি, হাঁফিয়ে গেছে ভয়ে। ঘরে ঢুকে দেখল কোথাও নেই ওর বুটজুতো। হয়তো আনা হয়নি লিটল ফোর্ক থেকে। খালি পায়ে পালিয়ে যাওয়া কঠিন। তবে এসব ভেবে এখন দমে যাওয়া অনুচিত। হলওয়ের দরজায় পৌঁছে জ্যাকসনের গ্লক সতেরো পরখ করল জুডি। ও যেটা ব্যবহার করত, তার চেয়ে এই পিস্তল বড়।
দক্ষ হাতে খুলল ম্যাগাযিন। ওটা গুলিতে ভরা। নতুন করে পিস্তলে ম্যাগাযিন ভরে টেনে নিল স্লাইড। ফায়ারিং চেম্বারে পৌঁছে গেছে বুলেট। ট্রেনিঙে বলা হয়েছে, অফ করে রাখবে না সেফটি ক্যাচ। কিন্তু রানাকে দেখেছে উল্টো কাজ করতে। নইলে যে মুহূর্তের ভগ্নাংশ সময় লাগবে, তাতে খুন হতে পারে কেউ।
রানার কথা মনে পড়তেই থেমে গেল জুডি।
মরেই কি গেল মানুষটা?
আর কখনও দেখা হবে না?
চিন্তাটা জোর করে মন থেকে দূর করল জুডি।
না, নিশ্চয়ই বেঁচে আছে রানা!
খারাপ ভাবনা মনে আসতে দেবে না ও।
কক্ষণো না!
রানার প্রতি ওর অনুভূতি নিজ স্বার্থে ব্যবহার করতে চেয়েছে ন্যাশ ময়নিহান। ডাহা মিথ্যা বলেছে ও। জানিয়ে দিয়েছে, ওদের মাঝে ব্যক্তিগত কোনও সম্পর্ক নেই।
আসলেই তো নেই!
অন্তত রানার তরফ থেকে।
কিন্তু মানুষটার ব্যাপারে বুকে হাত রেখে এ কথা বলতে পারবে ও?
সত্যের খুব কাছে পৌঁছে গিয়েছিল ময়নিহান।
হ্যাঁ, জুডি ভালবেসে ফেলেছে রানাকে।
খোঁজখবর নিয়ে জেনেছে, নিজ জীবনে কখনও কোনও মেয়েকে জড়াবে না রানা। চিরকালের মুক্ত-বিহঙ্গ।
তখনই ঠিক করেছে জুডি, সুযোগ এলেও রানাকে বাঁধতে চাইবে না ও।
না হয় হলো ওরা ভাল বন্ধু?
তাই বা কম কী ওর জন্যে?
সত্যিকারের দেবতা না দেখলেও রানাকে দেখেছে– স্বর্গের দূত কি ওর চেয়েও নির্লোভ?
মনে হয় না!
নিজেকে কড়া ধমক দিল জুডি: এটা সময় হলো তোর এসব ভাবার?
বেরোতে হবে এই দুর্গ থেকে!
পাথরের মত শক্ত করতে হবে মন। সতর্ক করবে না কাউকে। সুয়োগ দেবে না কোনও। গুলি করবে খুন করতে। নইলে খুন হবে নিজে।
জুডি ভাবল, হ্যাঁ, এখন তুই ভুলে যা রানার কথা!
হলওয়ের ওদিকের দরজা খুলল ও। বামে কটা দরজা, ডানে সরু হল। ওদিকে ডাবল ডোর কোনও লাউঞ্জ এরিয়ার। কান পাতল জুডি, সকালে ওখানে শুনেছে অস্পষ্ট কথা। কিন্তু এখন কোনও আওয়াজ নেই ওই ঘরে। পায়ের নিচে পালিশ করা কাঠের তক্তার মেঝে। হল-এ বেরিয়ে বড় করে দম নিল জুডি। বাগিয়ে ধরেছে গ্লক। চলল লাউঞ্জ লক্ষ্য করে।
প্রথমে যখন আনা হলো, বাঁধা ছিল হাত-পা-চোখ। দেখা হয়নি কিছুই, আটকে রেখেছিল বেডরুমে। সর্বক্ষণ পাহারায় ছিল এক লোক। বোঝার উপায় ছিল না বাড়িটা কেমন বা আছে কজন লোক। পরে বুঝেছে, ও আছে বিশাল বাড়ির দোতলায়। সম্ভবত এটা টেক্সাসের দক্ষিণে কোনও র্যাঞ্চ হাউস।
লাউঞ্জে পা রেখে জুডি দেখল, প্রকাণ্ড ফ্রেঞ্চ ডোরের ওদিকে বারান্দা। দূর দিগন্তে গেছে প্ৰেয়ারি। কড়া রোদ ও শুকনো হাওয়ায় হলদে প্রায়-পোড়া ঘাস। জানা নেই সময়, তবে বোঝা যাচ্ছে এখন বিকেল। একটু পর আকাশ ও দিগন্ত ছেয়ে ফেলবে ধূসর রঙ।
কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে চাইল জুডি। চোখ খুঁজছে বেরোবার পথ। বোধহয় হলওয়ের দূরে সিঁড়ি। কিন্তু ওদিকে গেলে যখন-তখন ধরা পড়বে ময়নিহানের লোকের হাতে। পিস্তল আছে মানেই এমন নয়, ওটা দিয়ে ঠেকাতে পারবে সবাইকে। একদল খুনির বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবে না ও। দিবাস্বপ্ন দেখছে না জুডি।
লাউঞ্জে ঢুকে উঁচু এক উইং-ব্যাকড় চেয়ার পাশ কাটল ও। পায়ের নিচে মৃদু আপত্তি তুলল মেঝের কাঠের তক্তা। থমকে গেল জুডি। মেঝেতে কালচে দাগ। দ্বিতীয়বার দেখতেই বুঝল, মেঝেতে পড়েছে অনেক রক্ত। এখানে খুন হয়েছে কেউ। বাতাসে এখনও রক্তের আঁশটে গন্ধ।
গলা শুকিয়ে গেল জুডির।
তা হলে কি খুন হয়েছে রানা বা নিনা?
হয়তো ওদেরকে ধরে এনেছিল ময়নিহান?
খুন করেছে এখানে।
মনে দুশ্চিন্তা আসতেই চোখ বুজল জুডি।
রক্ত যদি রানা বা নিনারই হবে, তো বাঁচিয়ে রেখেছে কেন ওকে ন্যাশ ময়নিহান? বা ওকে তুলে দিচ্ছে না কেন লোগান টার্সন বা লোভী কারও হাতে?
এতক্ষণে খুন হওয়ার কথা ওর।
না, এ রক্ত রানা বা নিনার নয়।
কালচে দাগ এড়িয়ে দরজার দিকে চলল জুডি। পেছনে শুনল মৃদু আওয়াজ। হলওয়ে ধরে হেঁটে আসছে কেউ।
বোধহয় লোগান টার্সন!
চলেছে জুডির বন্দিশালার দিকে।
সেক্ষেত্রে সময় নেই হাতে। এ বাড়ি ছেড়ে প্রথম সুযোগে পালাতে হবে জুডিকে। প্রতিটি মুহূর্ত খুব জরুরি।
জুডি একবার ভাবল, লুকিয়ে পড়বে দরজার পাশে, তারপর লোগান পাশ কাটালেই গুলি করে মারবে তাকে।
ওকে কম অপমান করেনি লোভী জানোয়ারটা!
মরাই উচিত পাগলা কুকুরটার!
কিন্তু গুলি করলে সেই আওয়াজে ছুটে আসবে অন্যরা।
মাথা নাড়ল জুডি। এত ঝুঁকি না নিয়ে উচিত বারান্দায় চলে যাওয়া। হয়তো ওদিকে আছে কোনও পথ। তা না পেলেও ওখানে গেলে বুঝবে চারপাশ কেমন। হয়তো পেয়ে যাবে লুকিয়ে পড়ার মত জায়গা।
ডাবল ডোরের কবাট খুলে বারান্দায় পা রাখল জুডি। পুরো বাড়িটাকে ঘিরেছে এই বারান্দা। বামে সরে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ঘরে উঁকি দিল ও।
কেউ ঢোকেনি ঘরে। দূরের দরজার ওপাশে বন্দিশালার দিকে হাঁটছে কেউ। জুডি ধারণা করল, ওই লোক লোগান টার্সন না হয়েই যায় না। কসেকেণ্ড পর করিডোরে দেখল প্যারামিলিটারি পোশাক পরনে কেউ, মাথায় কাউবয় হ্যাট।
হ্যাঁ, সে লোগান টার্সনই!
এক এক করে ক্ষণ গুনতে লাগল জুডি।
দুমিনিট পেরোবার আগেই শুনল টার্সনের চিৎকার ও গালি। দেরি না করে বারান্দার দূরের বাঁক লক্ষ্য করে দৌড় দিল জুডি। উড়ে চলেছে রকেট বেগে। কোণ ঘুরে দেখল, একপাশে নিচে যাওয়ার সরু সিঁড়ি। প্রথমতলায় রেলিং দিয়ে ঘেরা আরেকটা বারান্দা। ওর ভয় লাগছে, যে-কোনও সময়ে ছুটে আসবে টান। ঝড়ের বেগে সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করেও কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে চাইল জুডি। একতলায় নেমে বসে পড়ল সিঁড়ির একপাশে। বামে একটু দূরে কটা আউটবিল্ডিং। পেছনে টিনের বিশাল ছাউনি। ওখান থেকে আসছে বাজে দুর্গন্ধ।
কয়েক ঘণ্টা আগে টান ছিঁড়ে দিয়েছে জুডির ব্লাউস। দেখা যাচ্ছে বুকের বড় অংশ। এখন ছুটতে হবে খালি পায়ে। ভয় লাগছে ওর। খালি পায়ে বালিতে হাঁটা এক কথা, আর পাথুরে জমিতে দৌড়ানো অন্য কথা। প্রতিটি পদক্ষেপ দেবে ব্যথা। কিন্তু এসব ভেবে লাভ নেই। রেলিং টপকে তিন ফুট নিচে উঠানে নামল জুডি। থমকে গেল ওখানে। কান পাতল। দূর থেকে এল টার্সনের চিৎকার। তারপর এল ছুটন্ত পায়ের আওয়াজ।
ঘুরেই ছাউনির দিকে ছুটল জুডি। চাইছে ধারালো পাথরের খোঁচা এড়াতে। কিন্তু প্রথম আউট বিল্ডিঙের কাছে যেতে না যেতেই ফুলে গেল পায়ের পাতা। কপাল ভাল রক্তপাত হচ্ছে না।
যন্ত্রণা থাকুক, নিজেকে বলল জুডি। দৌড়াতে থাক!
কানের পাশ দিয়ে গিয়ে ছাউনির দেয়ালে বিঁধল বুলেট। ভয়ে আত্মা খাঁচা-ছাড়া হয়েছে জুডির। তবে ঘুরেই বাড়ির দিকে তাক করল পিস্তল। ওপরের বারান্দায় লোগান টার্সন। তাক করছে পিস্তল। টিপে দিল ট্রিগার। হাতে লাফিয়ে উঠল অস্ত্রটা। একপাশে সরে পাল্টা গুলি করল জুডি। ঝটকা দিয়ে পিছিয়ে গেল টার্সন, তবে গুলি লাগেনি গায়ে।
ওই যে! চিৎকার করল সে। ছাউনির দিকে যাচ্ছে!
প্রাণের ভয়ে ছুট দিল জুডি। যেভাবে হোক শত্রুদের সঙ্গে বাড়াতে হবে ব্যবধান। তৃতীয় গুলিতে ওকে গেঁথে ফেলতে পারে টার্সন। চলেছে বাড়িটার পাশ দিয়ে। বাঁক ঘুরে ওদিকে মাঝারি কাঠের বেড়া দেখে ওদিকে ঝাঁপ দিল জুডি। মাটিতে পড়ল বেকায়দাভাবে চিত হয়ে। চারপাশে ভেসে উঠল একরাশ ধুলো। ব্যথায় মুখ কুঁচকে ফেলল ও। তিন সেকেণ্ড পর তাকাল ফেলে আসা পথে। শুকিয়ে গেল গলা। বাড়ি থেকে ছুটে আসছে কজন লোক। ধুলোর মেঘের কারণে কাউকে চিনল না জুডি।
উঠে পর পর তিনবার গুলি পাঠাল লোকগুলোর দিকে। হাতে ভীষণ ঝাঁকি দিয়েছে অস্ত্রটা। বুঝে গেল, ওপর দিয়ে গেছে ওর গুলি। কেউ আহত না হলেও ছত্রভঙ্গ হয়েছে। তারা। স্বাভাবিক অবস্থায় জুডি নিয়ন্ত্রণ করত শ্বাস, তারপর অস্ত্র তাক করে গুলি করত কুকুরগুলোর দিকে। তাতে মাটিতে পড়ত দুতিনজন। কিন্তু কাজ করছে না ওর মগজ। ঘুরেই দৌড় দিল। পেছনে আবার গর্জে উঠল পিস্তল। ওর বাম কানের পাশ দিয়ে গেল বুলেট। ছাউনির দরজা পেরোতে গিয়ে ভেতরে ছায়ার মাঝে দেখল বিশাল সব মেশিন। ভাবল ওখানে কাভার নেবে কি না। না, উচিত হবে না। পেছনের ওরা এসে কোণঠাসা করবে ওকে। সংখ্যায় বেশি, প্রত্যেকের কাছে পিস্তল। শেষপর্যন্ত বাধ্য হয়ে আত্মসমর্পণ করতে হবে।
দৌড় বন্ধ করো, জুডি। ওই গলা চিনতে পারল জুডি। নির্দেশ দিলেও কণ্ঠে রয়েছে রসিকতার ছাপ।
নরকে যাও, ময়নিহান! দৌড় না থামিয়ে পাল্টা চেঁচাল জুডি। সামনেই আরেকটা বেড়া। আগেরটার চেয়ে দক্ষতার সঙ্গে টপকে গেল ও। কিন্তু মাটিতে পা দিতেই ডান পায়ের নিচে খচ্ করে বিঁধল কী যেন। নরম মাংস কেটে বেরোচ্ছে রক্ত। ব্যথায় মুখ বিকৃত করলেও দৌড়ে চলল জুডি।
সামনেই গরু রাখার গোয়ালঘর ও টিনের বিশাল ছাউনি। বামে বাঁক নিয়ে ছাউনি লক্ষ্য করে ছুটল জুডি। আপাতত ওকে দেখবে না পেছনের কেউ। ছাউনির বাইরে পেল পরিত্যক্ত বড় এক ট্রাক ও পুরনো শেভ্রোলে গাড়ি।পুড়ছে টেক্সাসের রোদের আগুনে। ট্রাকের ক্যাব দখল করেছে মোরগ ও মুরগির পাল। ট্রাক বা গাড়ি এতই প্রাচীন, ওসব নিয়ে পালাতে পারবে না জুডি। আড়াল নিল ট্রাকের। চোখ রাখল ছাউনির কোণে। কসেকেণ্ড পর দেখল ছুটে আসছে কেউ। তাকে লক্ষ্য করে গুলি পাঠাল ও। দেখে নিল কাঁধের ওপর দিয়ে। এখান থেকে সরতে হবে, নইলে ঘিরে ফেলবে তারা। তাতে খুন হবে বা ধরা পড়বে ও।
বাড়িটার কোনা লক্ষ্য করে গুলি পাঠাল জুডি। শত্রুপক্ষ পিছিয়ে যেতেই কাভার থেকে বেরিয়ে দিল ছুট। চলেছে ছাউনির জানালার দিকে। তিন সেকেণ্ড পর চৌকাঠে হাত রেখে টেনে তুলল নিজেকে। লাফ দিয়ে নামল ছাউনির ভেতর। নাক কুঁচকে গেল পোড়া ধাতু ও এভিয়েশন ফিউয়েলের কটু গন্ধে। ম্লান আলোয় দেখল, বিধ্বস্ত এক এয়ারক্রাফট ও দুটো ভাঙাচোরা গাড়ি। চুরমার হয়েছে বড়জোর দুএক দিন আগে। এখনও ইঞ্জিন থেকে টপটপ করে পড়ছে মোবিল ও অকটেন।
কীভাবে এ তাণ্ডব হলো জানে না, তবে জুডি বুঝে গেল ওকে উদ্ধার করতেই হামলা করেছিল রানা। বুকে সাহস ফিরল ওর। কিন্তু পরক্ষণে ভাবল, বাঁচব কী করে? কোথায় মানুষটা? ঠিক আছে তো? যতই আশা করুক, আপাতত সাহায্য পাবে না রানার কাছ থেকে।
ছাউনির সদর দরজা বন্ধ। জুডি গেল দূরের জানালার কাছে। ওটা বন্ধ হলেও ভোলা যাকে ছিটকিনি। জানালা খুলে লাফ দিয়ে ওদিকে নামল ও। কিন্তু পা পড়েছে কাদায়। নাকে এল কাঁচা গোবরের গন্ধ। ডুবে গেছে গোড়ালি। সরতে গিয়ে সড়াৎ করে পিছলে গেল। আরেকটু হলে হাত থেকে পড়ত পিস্তল। সামলে নিল নিজেকে। গোবরের মাঝ দিয়ে চলল বাড়িটার সামনে। ময়নিহান এবং তার লোক আসবে ওদিক দিয়েই।
কোনও মেশিন চালু হওয়ায় দালানে শুরু হলো ধাতব আওয়াজ। কড়াৎ শব্দ তুলল আগ্নেয়াস্ত্র, জুডিকে পাশ কাটিয়ে ছাউনির দেয়ালে, বিঁধল বুলেট। ওর মনে হলো, ইচ্ছে করেই গুলি করছে মাথার ওপর দিয়ে। চাইছে ওকে জীবিত ধরতে। তাতে বাড়তি সুবিধা পাবে ও। ঘুরেই খুঁজল টার্গেট। বাড়িটার কোণে কে যেন! দেরি হলো না গুলি পাঠাতে। বুলেট বিঁধল লোকটার বাম বুকে। ছিটকে পিছিয়ে চিত হয়ে মাটিতে পড়ল সে। জুডি খুশি হতো ওর গুলিতে ময়নিহান মরলে। কিন্তু কাকে গুলি করেছে বোঝার উপায় নেই। প্রত্যেকের পরনে একই কালো ড্রেস।
এ-ই শেষ সুযোগ, ধমক দিল ময়নিহান, পালাতে চেষ্টা করলে গুলি করা হবে।
পাত্তা না দিয়ে হালকা পায়ে আরেকটা বেড়া টপকে গেল জুডি, ছুটল ছাউনির কোনা ঘুরে। কিন্তু তখনই মুখোমুখি ধাক্কা লাগল একজনের সঙ্গে। এইমাত্র একটা দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে সে।
তাল সামলে তার দিকে তাকাল জুডি। ভেবেছে গুলি করবে শত্রুপক্ষ, কিন্তু তা নয়। এ ন্যাশ ময়নিহানের কেউ নয়, মাঝারি আকৃতির এক মহিলা। পরনে সাদা ব্লাউস, ব্লেযার ও জিন্সের প্যান্ট। দেখলে মনে হয় মহিলা পুলিশ। কিন্তু তার সাদা ব্লাউস ভরা রক্তের ছিট-ছিট দাগ। দুহাত চট চট করছে রক্তে। জুডির জানার কথা নয়, ওয়াল্টার হেইন্সের লাশ টুকরো করার দায়িত্ব যেচে ময়নিহানের কাছ থেকে নিয়েছে মারি কিটন। নিজ কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে, এমনসময় বুঝল কাছেই হাজির হয়েছে কেউ। জুডিনা জানলেও ময়নিহানের লোকদের ভেতর ভয়ঙ্করতম খুনি মারি কিটন।
দুজনই একইসময়ে বুঝল, ওরা আছে বিপদে। ট্রিগারে চাপ বাড়াল জুডি। কিন্তু বিদ্যুদ্বেগে নড়ল মারি। ঝট করে সরে গেছে বামে, পরক্ষণে লাথি মারল জুডির কবজির ওপর। দূর দেয়ালে বিঁধল গুলি। থাবা দিয়ে পিস্তল কেড়ে নিল মারি। পাথরের মত শক্ত বামহাতে চড় মারল জুডির গালে। চোখের সামনে কালো চাদর দেখছে ও। পেছাতে গিয়ে হুড়মুড় করে পড়ল মাটিতে। এক সেকেণ্ড পর পিস্তলটা ঘুরিয়ে ওর দুই চোখের মাঝে তাক করল মারি কিটন।
ও, তুই সেই বেশ্যা, যাকে ফেরত চাইছে মাসুদ রানা? টিটকারির হাসি হাসল মারি। কিন্তু দুঃখের কথা, মরে গেলে তোকে দিয়ে ওর কোনও কাজ হবে না।
এত বিপদেও স্বস্তি পেল জুডি। রানা বেঁচে আছে।
ট্রিগারে চাপ দিচ্ছে মারি কিটন।
মারি, থামো, জুডির পেছন থেকে নির্দেশ দিল ন্যাশ ময়নিহান।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে গ্লক নামিয়ে নিল মহিলা।
ঘাড় ফিরিয়ে ময়নিহানের দিকে তাকাল জুডি।
লোকটার কানে মোবাইল ফোন। কথা বলছে কার সঙ্গে যেন। ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি। কসেকেণ্ড পর বলল, ওকে, রানা, দেখা হবে একঘণ্টা পর।
.
৩৪.
কল কেটে মোবাইল ফোন পকেটে রাখল রানা। তিক্ত হয়ে গেছে মন। ওর পাশে উইণ্ডস্টার গাড়ির পেছন সিটে বসে আছে নিনা ভেঞ্চুরা। সামনের সিটে জন হার্বার্ট। ড্রাইভ করছে বাড হিগিন্স। জুডির মোবাইল ফোন ট্রেস করে কেবিনে হামলা করতে পারে ময়নিহানের খুনেরা, তাই পাইলট পয়েন্টের রাস্তায় ঘুরছে ওরা।
আমাদের উচিত এফবিআই-এর সাহায্য নেয়া, তৃতীয়বারের মত বলল নিনা।
আগেও মানা করেছে রানা। এবারও যুক্তি দিয়ে বোঝাল, কেন আইনী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করা অনুচিত হবে।
আপনার জন্যে মানুষ খুন করেছি, নিনা, বলল রানা। এখন পুলিশ বা এফবিআইকে জড়ালে বাকি জীবন থাকব জেলে।
মরে যাওয়ার চেয়ে জেলে থাকা ভাল, নাক ফুলিয়ে বলল নিনা ভেঞ্চুরা।
সেটা সবার জন্যে নয়, বলল রানা। জুডিকে ছুটিয়ে আনার একটা পরিকল্পনা করেছে ও। কাজটা কঠিন। তবে তাতে সম্ভাবনা আছে সফল হওয়ার। সেজন্যে মৃত্যুও হতে পারে নিনার। তার কারণেই আজ এত বড় বিপদে পড়েছে। জুডি, তাই ওর উচিত ছোটবোনকে বাঁচাতে ঝুঁকি নেয়া। রওনা হ ময়নিহান র্যাঞ্চের দিকে, বাডকে বলল রানা।
পুব লিবার্টি স্ট্রিট ধরে শহর থেকে বেরিয়ে এল ওরা। উত্তরদিকের হাইওয়েতে উঠে চলল গ্রেসন কাউন্টির দিকে। তবে একটু পর ধরল সরু এক শাখা রাস্তা। চলেছে ময়নিহান র্যাঞ্চের দিকে। আবারও শুরু হলো প্রত্যন্ত এলাকা। একটা-দুটো কাঠের বাড়ি, আশপাশে ছোট-বড় ঘাসজমি, এখানে-ওখানে নানান গাছ ও ঝোপঝাড়। আরও কিছুক্ষণ যাওয়ার পর পৌঁছে গেল ওরা অ্যাম্বুশ করা সেই এলাকায়। শহরে জনাকীর্ণ জায়গায় জিম্মি বদল হলে ভাল হতো, কিন্তু সেক্ষেত্রে হয়তো শুরু হতো দুপক্ষের গোলাগুলি। এসব ভেবেই রানা ওর প্ল্যানে রেখেছে এই প্রেয়ারি। যা হবে, কোনও সাক্ষী থাকবে না তার।
ঘনিয়ে আসছে সন্ধ্যা, এমনসময় প্রথমবারের মত থামল ওরা। আশপাশে বাড়িঘর নেই। মাঠে চরছে এক পাল লংহর্ন গরু ও ষড়।
গাড়ি থেকে নেমে কোমর সমান উঁচু ঘাসের মাঠে হারিয়ে গেল জন ও বাড। গাড়ি নিয়ে রওনা হলো রানা। পেছনের সিটে চোখ বুজে ফ্যাকাসে মুখে বসে আছে নিনা ভেঞ্চুরা। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
সব ঠিক থাকলে আগামী একঘণ্টার ভেতর ফেরত পাব জুডিকে, আশ্বস্ত করতে চাইল রানা।
যদি সব ঠিক না থাকে? গলা কেঁপে গেল মেয়েটার।
সেক্ষেত্রে মারা পড়ব আমরা। তবে সে সম্ভাবনা কম। যা করতে বলেছি, সেটা করলে ঝুঁকি অনেকটাই কমবে।
আমাকে দেখেই যদি খুন করে ময়নিহান?
মৃদু হাসল রানা। তা হলে ওকে খুন করব আমি।
সেটা তো খুব আনন্দের কথা, বিড়বিড় করল নিনা।
তবে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন আপনাকে গুলি করবে না। আগে চাইবে ক্যামেরার রেকর্ড করা দৃশ্য মুছে দিতে। গুলি না করার আরেকটা কারণ, আপনার বা আমার কাছে রয়ে যেতে পারে ভিডিয়োর কপি। আগে নিশ্চিত হতে হবে তাকে।
অত্যন্ত বিপজ্জনক লোক। খুশি হয় খুনোখুনি হলে। কে জানে, হয়তো মজা পেতেই খুন করবে। তারপর দেখতে চাইবে আপনি কী করেন।
সেক্ষেত্রে নিজেও বাঁচবে না সে।
আপনি খুব আত্মবিশ্বাসী মানুষ, বলল নিনা। জানলেন কী করে আপনি তাকে মেরে ফেলার আগেই আপনাকে সে খুন করবে না?
এটা নিশ্চিত হতে পারবে না কেউই, বলল রানা। তবে আগেও এমন পরিস্থিতিতে পড়েছি। ন্যাশ ময়নিহান শহুরে মস্তান। নিরীহ কিছু মানুষকে খুন করেছে বলে ভাবছে যা খুশি করতে পারবে। তার ধারণা ভুল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
মনে হলো না রানার কথা শুনে স্বস্তি পেল নিনা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমার বড়ভাইও পুলিশ ছিল। পরে যোগ দেয় আপনার ডিটেকটিভ এজেন্সিতে। কিন্তু করুণভাবে মরতে হয়েছে ওকে। আমরাও হয়তো বাঁচব না।
হয়তো, বলল রানা। কেউ জানে না পরের সেকেণ্ডে বেঁচে থাকবে কি না। রিয়ার ভিউ মিররে তাকাল ও।
চোখ বিস্ফারিত করে ওকে দেখছে নিনা। বুঝে গেছে, কী বলা হয়েছে ওকে।
গাড়িতে নামল নীরবতা।
একমাইল যাওয়ার পর চওড়া এক গেটের সামনে থামল রানা। আগেরবার এপর্যন্ত আসতে পারেনি। রাস্তার দুপাশে সারি সারি গাছ। গেটের ওদিকে নেই কোনও নড়াচড়া। ঘনিয়ে আসছে সন্ধ্যার অন্ধকার। দীর্ঘ হয়েছে প্ৰেয়ারিতে ছায়া। গেট পেরোলে দূর দিগন্তের ওদিকে কোথাও ময়নিহানের র্যাঞ্চ হাউস।
নিনার দিকে ঘুরে তাকাল রানা।
মেয়েটার চোখে পানি। নিচু গলায় বলল, কখনও ভাবতেও পারিনি এমন বিপদে পড়বে জুডি।
মনে সাহস রাখুন, নিনার হাতে মৃদু চাপড় দিল রানা। দেখবেন, বড় কোনও বিপদ হবে না।
জুডিকে ফিরে পেলেই আর কিছু চাই না।
ঘুরে গেটের ওদিকে তাকাল রানা। আরেকবার চেক করল ওয়ালথার। মনে মনে তৈরি লড়াইয়ের জন্যে। মনে রাখবেন, যা যা বলেছি, ঠিক তাই করবেন।
তর্ক করল না নিনা। ঠিক আছে।
উইণ্ডস্টার সামনে বাড়াল রানা। গেটের ওদিকে ন্যাশ ময়নিহানের জমি। সিকি মাইল যাওয়ার পর গাড়ি রাখল ও। নেমে পড়ে খুলে দিল পেছনের দরজা। নিনাকে সাহায্য করল বেরিয়ে আসতে। দুজনই ওরা জানে, ঘনিয়ে আসছে ভয়ঙ্কর বিপদ।
সামনে থেকে এল ইঞ্জিনের আওয়াজ।
এবার চাই ভাল অভিনয়। খপ করে নিনার জ্যাকেটের কলার চেপে ধরল রানা। হিঁচড়ে নিয়ে চলল মেয়েটাকে। থামল গাড়ির সামনে। ঘাড় ধরে নিনাকে বসিয়ে দিল মাটিতে। হাঁটু গেড়ে এদিক-ওদিক দেখছে মেয়েটা। ওর পেছনে দাঁড়িয়ে মাথার দিকে ওয়ালথার তাক করল রানা। ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে নিনা। কনভয় তৈরি করে আসছে তিনটে গাড়ি। থেমে গেল এক শ গজ দূরে। হুড়মুড় করে গাড়ি থেকে নামল বেশ কজন। তাদের ভেতর পাহাড়ের মত বিশাল এক লোককে দেখল রানা। মালিকের কাছে ফিরেছে তা হলে রিক বেণ্ডার।
বাড কমপিউটারে ছবি দেখালেও আগে সামনা-সামনি ন্যাশ ময়নিহানকে দেখেনি রানা। রিক সহ তারা পাঁচজন। থামল কনভয়ের প্রথম গাড়ির সামনে। প্রত্যেকের পরনে কালো মিলিটারি গিয়ার। তাদের মাঝে হালকা-পাতলা এক মেয়েকেও দেখল রানা। ভেবেছিল জুডি। কিন্তু এক সেকেণ্ড পর বুঝল ভুল ভেবেছে,। ওই মহিলা জুডির মত লম্বা নয়। নড়াচড়ার ভঙ্গি ছোবল মারতে উদ্যত কেউটের মত। অন্য তিনজনের হাতে অস্ত্র। পঞ্চমজনের দুইহাত পেটের ওপর। যেন প্রার্থনা করছে। রানা ধারণা করল, ওই লোকই ন্যাশ ময়নিহান।
নিনা ভেঞ্চুরাকে এনেছি, ময়নিহান, গলা ছাড়ল রানা, জুডিকে দেখাও। নইলে এক গুলিতে ফুটো করব এর মগজ।
দূর থেকে পাল্টা চেঁচাল লোকটা, রানা? ভাবছ, ধরে নেব যে নিনা ভেঞ্চুরাকে গুলি করবে তুমি?
এই কুত্তীর জন্যেই এত ঝামেলা। কাজেই বিশ্বাস করো বা না করো, এ মরে গেলে আমার কিছুই যায় আসে না!
কপা সামনে বাড়ল ন্যাশ ময়নিহান। দুপাশে একটু ছড়িয়ে গেল অন্যরা। দুপাশ থেকে রানার দিকে রাইফেল তাক করেছে দুই লোক।
আমার পরনে কেভলার জ্যাকেট, বলল রানা, তোমার লোক একটা গুলি করলে সঙ্গে সঙ্গে নিনা ভেঞ্চুরাকে শেষ করে দেব।
দলের সবাইকে অস্ত্র নামাতে হাতের ইশারা করল ন্যাশ ময়নিহান।
জুডি কোথায়? ওকে দেখাও!
দ্বিতীয় গাড়ির পাশে গেল রিক বেণ্ডার। দরজা খুলে বের করে আনল কাউকে। মরা আলোয় রানা দেখল, রিকের হাত থেকে ঝটকা দিয়ে ছুটতে চাইছে কেউ।
হ্যাঁ, জুডি।
ওকে কাঁধে তুলে নিল দানব। ব্যবহার করছে বর্ম হিসেবে। ফিরে এসে থামল ময়নিহানের পাশে। কাঁধের ওপর দিয়ে রানার দিকে তাকাল জুডি। এতটা দূরে হলেও রানা দেখল, বিস্ফারিত হয়েছে বেচারির দুচোখ। পাগল হয়ে উঠল রিকের কাঁধ থেকে নামার জন্যে। ছটফট করছে গলা কাটা মুরগির মত। মুখের ভেতর রুমাল, কিন্তু গলা থেকে বেরোল গোঙানি। গালি দিয়ে ভূত বিদায় করছে। রানার। স্বাভাবিক, ওর বোনের মাথায় পিস্তল ধরেছে বাঙালি যুবক!
শুয়োরের পালে ফিরেছ, তাই না, বেণ্ডার? জোর গলায় বলল রানা। অবাক হইনি!
ন্যাশ ময়নিহানের দিকে তাকাল রিক বেণ্ডার। জবাবে কিছু বলল না টপ টেরর। রানাকে বামহাতের মধ্যমা দেখাল দানব।
জিম্মি কীভাবে বদল করতে চাও, রানা? জানতে চাইল ময়নিহান।
জুডিকে পাঠাবে আমার দিকে। ও যখন মাঝপথে পৌঁছে যাবে, আমি ছেড়ে দেব নিনাকে।
না। একইসময়ে রওনা হবে দুজন।
ঠিক আছে। জুডি এগোতে থাকুক।
ওই ক্যামেরা কোথায়?
জ্যাকেটের পকেট থেকে ক্যামেরা নিয়ে দেখাল রানা। এই যে তোমার জিনিস। কথাটা শেষ করেই, ডানদিকের ঘাসভরা মাঠে ক্যামেরা চুড়ল ও। এখনই ক্রিটিকাল মুহূর্ত। এবার যে-কোনও সময়ে গুলি করবে শত্রুপক্ষ। কিন্তু রানা ভাবছে সে সম্ভাবনা কম। কারণ, আগে ময়নিহানের বুঝতে হবে, ওই ক্যামেরায় ভিডিয়োটা আছে কি না। হতে পারে, ওটা নকল জিনিস। অন্য কোথাও আছে আসল ক্যামেরা ও ভিডিয়ো।
ধরে নিচ্ছি, ভিডিয়োর কপি করেছ, বলল ময়নিহান। পরে হয়তো ওটা ব্যবহার করবে আমার বিরুদ্ধে?
জবাবে বলল রানা, ওই ক্যামেরা বা ভিডিয়ো নিয়ে মাথাব্যথা নেই আমার! এই কুত্তীটাকে নিয়ে কী করবে, বা কোথায় লুকাবে প্রমাণ, সেসব তোমার ব্যাপার! দেরি না করে পাঠাও জুডিকে। আমরা সরে যাওয়ার পর নিনার কী হলো, সেটা নিয়ে ভাবতেও যাব না।
নীরবে কিছুক্ষণ কী যেন চিন্তা করল ময়নিহান। তারপর মুখ তুলে তাকাল রানার দিকে। ঠোঁটে ফুটে উঠল হাঙুরে হাসি। মৃদু মাথা দোলাল রিক বেণ্ডারের উদ্দেশে। কাঁধ থেকে জুডিকে নামাল দানব। একটু ঝুঁকে কী যেন বলল মেয়েটার কানে। রানার সাধ্য নেই যে অত দূর থেকে শুনবে। ঘুরে ওর দিকে তাকাল জুডি। চোখে গনগনে আগুন ও হতাশা। আরও কী যেন ওর মুখে। চেয়ে আছে রানার চোখে।
হ্যাঁচকা টানে নিনাকে দাঁড় করাল রানা। এখনও মাথায় ঠেকিয়ে রেখেছে ওয়ালথারের নল।
পেরোতে লাগল ভীষণ অস্বস্তিকর ক্ষণ।
আধমিনিট পর জুডিকে সামনে ঠেলল ময়নিহান। একই কাজ করল রানা। এক পা এক পা করে পরস্পরের দিকে চলেছে জুডি ও নিনা।
নিনার মেরুদণ্ড লক্ষ্য করে ওয়ালথার তাক করে রেখেছে রানা। আসল ক্যামেরা পাবে কি না জানে না, তবে চুপ করে আছে ময়নিহান। আরও কপি আছে কি না সে ব্যাপারেও মন্তব্য করল না। রানা জানে, আপাতত ও নিজে আছে অপেক্ষাকৃত ভাল অবস্থানে। নিনা মরলে ময়নিহানের মহা বিপদ। হয়তো কোথাও রয়ে গেছে ভিডিয়োর কপি।
রানার উদ্যত পিস্তল দেখে জুডির পিঠে নিজেদের রাইফেলের নল তাক করল ময়নিহানের লোক। কামানের মত ডের্ট ঈগল তাক করেছে রিক বেণ্ডার। ওটা দিয়েই ফেলে দিয়েছিল কপ্টার। দেহের পাশে হাত মুঠো করে দাঁড়িয়ে আছে টপ টেরর। মুখে স্থির হাসি। দেখছে। পরস্পরের দিকে হেঁটে চলেছে দুই বোন।
মনে রাখবেন কী করতে হবে, নিচু গলায় নিনাকে বলল রানা। জবাবে দুই কাধ আড়ষ্ট করল নিনা। ফুঁপিয়ে উঠল ভয়ে। এখন অভিনয় করছে না।
কাছাকাছি পৌঁছে গেছে দুই বোন। জুডির চেহারা দেখছে রানা। প্রচণ্ড রেগেছে মেয়েটা। সেইসঙ্গে চোখে ভয়। নিশ্চয়ই একই হাল নিনার। পরস্পরের দিকে তাকাল তারা।
জুডি, হাঁটতে থাকো, মনে মনে বলল রানা। নইলে মুখ থুবড়ে পড়বে আমার প্ল্যান!
নিনার ওপর থেকে চোখ সরিয়ে রানার দিকে তাকাল জুডি। কঠোর চেহারা করে দাঁড়িয়ে আছে রানা। এ ছাড়া উপায়ও নেই ওর। ধোঁকাটা ধরা পড়লে প্রাণে বাঁচবে না ওরা কেউ।
হাঁটার গতি বাড়াল জুডি ও নিনা। কমে এল দুজনের ব্যবধান। মুখে রুমাল, তবুও কথা বলতে চাইল জুডি।
পরস্পরকে জড়িয়ে না ধরলে বাঁচি, ভাবল রানা।
সোজা হেঁটে যাও, জুডি, তাড়া দিল ময়নিহান, কোনও কথা নয়। পাশ কাটিয়ে যাবে তোমরা।
ময়নিহানের কথা শুনেছ, নিনা, ধমকের সুরে বলল রানা। বোনকে বাঁচাতে হলে ওর কথা শোনো। রানার দিকে তাকাল জুডি। ফুলে গেছে নাক। এমনই ছিল ওর বড়ভাইয়ের নাকটাও। দূর থেকে শুনতে পেল রানা, মুখে রুমাল থাকলেও গোঁ-গোঁ আওয়াজ তুলে কিছু বলতে চাইছে জুডি।
দুই বোনের মাঝে এখন দশ ফুট ব্যবধান।
বোনের দিকে সরে যেতে লাগল জুডি।
তাতে ঘন-ঘন মাথা নাড়ল নিনা। বুঝিয়ে দিতে চাইছে, উচিত হবে না কাছে আসা।
পাঁচ ফুটের ভেতর পৌঁছে যেতেই পরস্পরের চোখে তাকাল ওরা।
আর তিন ফুট…
দুই…
এক…
চিৎকার করে সতর্ক করতে চাইল রানা, কিন্তু সেটা করলে চমকে গিয়ে গুলি পাঠাবে ময়নিহানের লোক। ওর মনে হলো, পেরোচ্ছে জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘ মুহূর্ত।
পরের সেকেণ্ডে সরেই জুডিকে জড়িয়ে ধরল নিনা। ধুপ করে পড়ল মাটিতে। ওখানে থামল না নিনা, জুডিকে নিয়ে গড়িয়ে গিয়ে পড়ল অগভীর নালায়। একইসময়ে সামনে বেড়ে দ্রুত ট্রিগার টিপতে লাগল রানা।
পুরো দেড় সেকেণ্ড পর ময়নিহানের লোক বুঝল, তাদের উচিত পাল্টা গুলি করা।
ঘুরেই রাইফেল কাঁধে তুলল দুইজন। কিন্তু এঁকেবেঁকে দৌড় দিয়েছে রানা। গুলি পাঠাল শত্রুদের উদ্দেশে। এত দূর থেকে পিস্তলের বুলেট লাগলে বলতে হবে নেহায়েত কপালের জোরে লেগেছে। অবশ্য, ভয় পেয়ে ছিটকে সরল লোকগুলো। রানার আশপাশ দিয়ে গেল গুলি। এখনও রানার থেকে ত্রিশ গজ দূরে জুডি ও নিনা। নালার ভেতর দিয়ে এগোচ্ছে উইণ্ডস্টার গাড়ির দিকে। আধ সেকেণ্ড পর ওদিকে অস্ত্র তাক করল ময়নিহানের খুনিরা।
খবরদার! নিনা ভেঞ্চুরাকে খুন করবে না! ময়নিহানের চিৎকার শুনল রানা।
নতুন এই তথ্য পেয়ে থমকে গেছে সবাই।
নিজে তাদের দিকে গুলি পাঠাল রানা। ওর দুটো গুলি বিঁধল ময়নিহানের পেছনের গাড়িতে। দুই লাফে ওই গাড়ির আড়ালে সরল টপ টেরর। তাকে খুন করার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি রানার জন্যে জুডি ও নিনাকে সরিয়ে নেয়া। রাস্তা থেকে নেমে পড়ল ও। শুকনো মৌসুমে খটখট করছে নালা। ঝড়ের বৈগে সামনে বেড়ে খুনিদের উদ্দেশে গুলি করছে রানা।
ছড়িয়ে পড়েছে ময়নিহানের ভাড়াটে খুনিরা।
হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে অ্যাসল্ট রাইফেল কাঁধে তুলল লম্বা এক লোক। সাইটে পেয়ে গেছে রানাকে।
কিন্তু তখনই চুরমার হলো লোকটার মাথা। চারদিকে ছিটিয়ে গেল মগজ, খুলির টুকরো ও রুক্ত। উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ল লাশ। আধ সেকেণ্ড পর প্রেয়ারি থেকে এল এম টোয়েন্টিফোর স্নাইপার রাইফেলের গর্জন।
ঠিক জায়গায় পযিশন নিয়েছে জন ও বাড, ভাবল রানা। গলা উঁচিয়ে বলল, জুডি, নিনা, জলদি এসো!
দৌড় থামিয়ে ময়নিহানের আরেক খুনির দিকে গুলি পাঠাল রানা। পেশিবহুল সে, কিন্তু পেশি ঠেকাতে পারল না প্রচণ্ড গতির বুলেট। এক পা পিছিয়ে চিত হয়ে মাটিতে পড়ল লোকটা। গড়ান দিয়ে এড়িয়ে গেল রানার পরের গুলি। উঠে বসে অ্যাসল্ট রাইফেলের নল তাক করেই টিপে দিল ট্রিগার। আগেই মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে রানা। ওর মাথার ওপর দিয়ে গেল একরাশ বুলেট। প্রাণের ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল জুডি ও নিনা। উড়ন্ত ধুলোর মাঝ দিয়ে ওদিকে তাকাল রানা। আবারও নালায় শুয়ে পড়েছে মেয়েরা।
জলদি ওঠো! নির্দেশ দিল রানা, থাকবে কাছাকাছি। ময়নিহান চায় নিনা বেঁচে থাকুক। গুলি করবে না কেউ।
কিন্তু ওর নিজের কপাল অতটা ভাল নয়। এক পশলী গুলি পাঠাল পেশিবহুল লোকটা। রানার চারপাশে বিধছে বুলেট। ছিটকে উঠছে ছেঁড়া ঘাস। মুখে ঠাস্ করে লাগল মাটির চাপড়া। চোখ বাঁচাতে পাতা বুজে ফেলল রানা। কিন্তু পরের সেকেণ্ডে শুনল প্ৰেয়ারিতে বজ্রপাতের মত আওয়াজ। গর্জে উঠেছে ইপার রাইফেল। থেমে গেল এম সিক্সটিন অ্যাসল্ট রাইফেল। মাথা তুলে রানা দেখল, উপুড় হয়ে পড়ে আছে শক্তপোক্ত লোকটা, বুলেটের আঘাতে প্রায় উড়ে গেছে। তার ঘাড়।
সরে যেতে হবে এখান থেকে, বুঝে গেছে রানা। একটা একটা করে গুলি পাঠাচ্ছে রিক বেণ্ডার। আওয়াজটা কামানের গোলাবর্ষণের মত। পাশে টাশ-টাশ শব্দ তুলছে ময়নিহানের পিস্তল। গাড়ির ওদিক থেকে গুলি করছে দুজন। কিন্তু গাড়ি ভেদ করে জন ও বাডের উইনচেস্টারের গুলি ঢুকতেই লাফিয়ে অন্য কাভার খুঁজল ময়নিহান ও রিক।
প্রাথমিক শক কেটে যেতেই পুলিশ ট্রেনিং মনে পড়েছে জুডির। বড়বোনকে টেনে তুলে দৌড়ে এল রানার দিকে। ওদেরকে কাভার দিতে শত্রুপক্ষের দিকে গুলি পাঠাল রানা। ময়নিহানের গাড়ির কাছে রয়ে গেছে এক লোক। বেতের মত সরু। নানান দিকে সরে এড়াতে চাইছে গুলি। পাল্টা গুলি পাঠাল সে।
রানা সরে যাওয়ার আগেই একটা বুলেট ভেদ করল ট্রেপেইযিয়াস মাংসপেশি। ওর মনে হলো, খেয়েছে গর্দভের লাথি। কপাল ভাল, ও ডানহাতি। অসুবিধে হবে না গুলি পাঠাতে। কিন্তু ঘাড়ের কাছটায়, যেন দাউদাউ আগুন ধরে গেছে।
গাড়িতে উঠে মাথা নিচু রাখবে! জুডিকে বলল রানা। বড়বোনকে টেনে আনছে মেয়েটা। একটু আগের সেই ভাব আর নেই জুডির চোখে। সেখানে কৃতজ্ঞতা ও দুশ্চিন্তা। দেখছে, রানার জ্যাকেটের কলারকে পাশ কাটিয়ে কুলকুল করে নামছে রক্ত। তাড়া দিল রানা, আমি ঠিক আছি, গিয়ে গাড়িতে ওঠো!
একটা অস্ত্র দাও, বলল জুডি। পাশে লড়তে পারব।
তার চেয়ে চট করে নিনাকে তোলো গাড়িতে।
চিকন লোকটা আর যুবতী হাঁটু গেড়ে বসেছে মাটিতে। হাতের অস্ত্র সরাসরি তাক করেছে রানার বুকে। কিন্তু তাদের লাইন অভ ফায়ারে চলে এল জুডি ও নিনা। নিনার গায়ে লাগবে, সেই ভয়ে গুলি করতে পারছে না রানাকে। নির্দিষ্ট অ্যাংগেল বজায় রেখে পেছাতে শুরু করেছে রানা। শত্রুপক্ষের দুজনকে ওয়ালথারের সাইটে রেখেছে, তবে পাঠাচ্ছে না গুলি। আশপাশে দেখল না ময়নিহান বা রিক বেণ্ডারকে। জন বা বাড গুলি শুরু করতেই কাভার নিয়েছে তারা।
খেলা খতম, ময়নিহান! নীরবতা ভাঙল রানা। ভুলে যাও আমাদের কথা। থাকল ক্যামেরা। ভেবো না ক্ষতি করব। নিনাকেও আর দরকার নেই তোমার।
বোগাস কথা বলেছে, রানা নিজেই জানে। খেলা খতম নয়। ওদেরকে খুন করতে প্রাণপণ চেষ্টা করবে ন্যাশ ময়নিহান।
তবে আপাতত আর চাইবে না খুন করতে।
উইণ্ডস্টারের পেছনের সিটে উঠল নিনা ও জুডি। এক সেকেণ্ড পর ড্রাইভিং সিটে চাপল রানা। অ্যাক্সেলারেটরে চাপ দিয়ে চরকির মত ঘুরিয়ে নিল গাড়ি। রওনা হলো গেটের দিকে। রিয়ার ভিউ মিররে দেখল, ময়নিহানের গাড়িবহরের সামনে থেমেছে চারজন। কেউ অস্ত্র তুলল না ওদের গাড়ির দিকে।
দূর থেকে এল অমানুষিক গর্জন। রানার মনে হলো, ওটা ছেড়েছে রিক বেণ্ডার। আনমনে ভাবল: হ্যাঁ, শেষ হইয়াও হইল না শেষ!
তীরের বেগে ময়নিহান র্যাঞ্চের গেট পেছনে ফেলল গাড়ি। আগে প্রথমবার যেখানে থেমেছে, দুমিনিটে পৌঁছে গেল ওখানে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল রানা, তারপর দীর্ঘ ঘাসের মাঠ থেকে বেরিয়ে রাস্তার ধারে পৌঁছে গেল জন ও বাড। এখানেই ওদেরকে নামিয়ে দিয়ে গেছে রানা। দুই বন্ধুর হাতে রাইফেল। বাড উঠে পড়ল গাড়ির সামনের প্যাসেঞ্জার সিটে। পেছনের সিটে নিনা ও জুডির পাশে বসল জন। পেছনের সিটের ওদিকে লাগেজ কম্পার্টমেন্টে রাখল বাডের আনা এম টোয়েন্টিফোর স্নাইপার রাইফেল। কম্বল দিয়ে ঢেকে দিল। কাজটা শেষ হতেই গাড়ির তুমুল গতি তুলল রানা। ফিরে চলৈছে লেকের পাশের কেবিন লক্ষ্য করে।
হায় হায়, রানা, তোর তো গুলি লেগেছে! রানাকে বলল বাড। গাড়ি রাখ। আমি ড্রাইভ করছি।
কিছুই হয়নি… দাঁতে দাঁত চেপে বলল রানা। বলেছে ডাহা মিথ্যা। ব্যথা প্রচণ্ড। চোখের কোণে আসছে কালো সব ছায়া।
রাখ তো, রানা! ওর কানের কাছে ধমক দিল জন।
আগে সরি ময়নিহানের র্যাঞ্চ থেকে। ওরা পিছু নিতে পারে।
তুই রওনা হওয়ার পর গাড়িতে উঠেছিল, কিন্তু তারপর ফিরে গেছে র্যাঞ্চে, বলল জন, যাতে তাড়াতাড়ি যায়, সেজন্যে গোটা দশেক গুলি পাঠিয়ে দিয়েছি আমরা। তবে কারও গায়ে লেগেছে বলে মনে হয় না।
ঘুরে পেছনে তাকাল জুডি। ফাঁকা পড়ে আছে রাস্তা। অবশ্য, এর মানে এই নয়, পিছু নিয়ে আসছে না কেউ। রানা, জন ও বাডের আকস্মিক হামলায় হতভম্ব হয়েছে ময়নিহান। বিশেষ করে কাজে এসেছে এম টোয়েন্টিফোর স্নাইপার রাইফেল। কিন্তু যখন বুঝবে আশপাশে নেই স্নাইপার, লোকটা চাইবে পিছু নিতে। দেরি হবে না দলবল নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করতে। তা ছাড়া, পাগল হয়ে উঠবে রিক বেণ্ডার। এরই ভেতর বুঝে গেছে, বোকা বনেছে সে। প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে ধাওয়া করে ছুটে আসবে।
প্রথম সুযোগেই ওদেরকে ফেলে দেয়া উচিত ছিল, বলল জন।
উদ্দেশ্য ছিল আমাদের ভিন্ন, বলল রানা।
তা ঠিক। জুডি ও নিনাকে দেখছে জন।
সরি, শারীরিক ও মানসিক কষ্ট দিয়ে ফেললাম, জুডি ও নিনাকে বলল রানা। কিন্তু এ ছাড়া আর উপায় ছিল না।
যা হওয়ার হয়েছে, বড় কথা আমরা বেঁচে আছি, বলল নিনা। তাকাল ছোটবোনের দিকে।
মৃদু মাথা দোলাল জুডি। ওকে জড়িয়ে ধরল নিনা।
অবশ্য, পাঁচ সেকেণ্ড পর বড়বোনের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল জুডি। সাবধানে স্পর্শ করল রানার ঘাড়ের ক্ষত। নরম ও উষ্ণ আঙুল লাগতেই শিউরে উঠল ক্লান্ত রানা। পরক্ষণে শুনল জুডির ভেজা কণ্ঠ: মাসুদ রানা, আবারও যদি দেখি এমন ঝুঁকি নিয়েছ, খোদার কসম, আমি নিজেই গুলি করে মারব তোমাকে! ফুঁপিয়ে উঠে কান্না চাপল ও।
চুপ করে আছে রানা। গত কদিনের প্রচণ্ড পরিশ্রম, ঘুমের অভাব আর আহত ঘাড়ের ব্যথায় আস্তে করে বুজে গেল ওর চোখ। জোর করে খুলল পাতা।
কিছুক্ষণ হলো ওকে লক্ষ করছে বাড। নিচু গলায় বলল, এবার গাড়িটা রাখ, রানা। নইলে ময়নিহান যা পারেনি, তুই পারবি। ঝড়ের বেগে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে পাঠিয়ে দিবি আমাদের সবাইকে স্বর্গের মেইন গেটে!
লজ্জা পেয়ে রাস্তার পাশে গাড়ি থামাল রানা। নেমে পড়ল ড্রাইভিং সিট থেকে। ড্রাইভারের সিটে উঠল বাড। প্যাসেঞ্জার সিটে চাপল জন, হাতে শটগান। জুডি পেছনের সিট থেকে নামতেই মাঝের সিটে ঠাই হলো রানার।
আবারও রওনা হলো গাড়ি।
জুডি ও নিনার মাঝে সমাসীন হয়েছে রানা। দুপাশে যেন আরামদায়ক দুই গদি। ঝিমাতে শুরু করল ও। টের পেল, সাবধানে খোলা হচ্ছে ওর জ্যাকেট ও শার্ট।
সুন্দরী রাগলে নাকটা এত ফোলে কেন, ভাবতে গিয়ে আনমনে হাসল রানা। পরক্ষণে ঘুমিয়ে পড়ল জুডির কাঁধে মাথা রেখে।
.
কতক্ষণ অচেতন থেকেছে, জানে না রানা। হঠাৎ করেই জেগে উঠল। চোখের পাতা সামান্য খুলে আবছা আলোয় দেখল এদিক-ওদিক। আছে লেকের তীরের সেই কেবিনে। প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় ওকে খাইয়ে দেয়া হয়েছে ব্যথার ওষুধ। ঝিমঝিম করছে মাথা। শরীরের বামদিক অবশমত। ডানহাতে বামকাধ স্পর্শ করল। দক্ষতার সঙ্গে ক্ষতের ওপর ব্যাণ্ডেজ বেঁধেছে কেউ। যাতে অন্ধকারে ওকে থাকতে না হয়, তাই জ্বেলে দেয়া হয়েছে বাথরুমের বাতি। বাইরে কয়েকজনের গলার মৃদু আওয়াজ।
রানার পরনে শুধু জাঙ্গিয়া। বিছানায় উঠে বসে চারপাশ দেখল ও। পাশের চেয়ার থেকে জিন্সের প্যান্ট নিয়ে নেমে পড়ল খাট থেকে। ভীষণ টলে উঠল একবার। তাল সামলে সাবধানে পরল প্যান্ট। ভদ্রস্থ হওয়ার পর ধীর পায়ে গিয়ে খুলল কেবিনের দরজা। বাইরে লেকের তীরে বসে আলাপ করছে জন, বাড, জুডি ও নিনা। দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে ঘুরে তাকাল ওরা। চারজনের মধ্যে জ্বলছে ধিকিধিকি আগুন। ডিনারে বসেছে ওরা। বার্গারের ঘ্রাণ নাকে আসতেই বমি এল রানার। কয়েকবার ঢোক গিলে সামলে নিল নিজেকে।
নিনার আনা পোশাক পরেছে জুডি। দুবোনের চেহারায় এতই মিল, রানার কয়েক সেকেণ্ড লাগল ওদেরকে আলাদা করতে। চট করে উঠে ওর দিকে এগিয়ে এল জুডি। ওকে দেখছে জন, বাড ও নিনা। তারপর আবারও মজে গেল আলাপে।
রানার সামনে পৌঁছে নরম সুরে বলল জুডি, তোমার চাই অনেক ঘুম।
প্রায় সেরে গেছি, বলল রানা।
ক্ষত পরিষ্কার করে ব্যাণ্ডেজ করা হয়েছে। তবে বিশ্রাম নিতে হবে। চলো, শুয়ে পড়বে। আলতো হাতে রানাকে কেবিনের দিকে ঠেলল জুডি।
অনেক কাজ পড়ে আছে, তা ছাড়া…
হ্যাঁ, আছে, তবে সেসব পরে করলেও হবে।
রানা খেয়াল করল, ফুলে আছে জুডির চোখের পাতা। কেঁদেছে অনেক। সুস্থ কাঁধ জড়িয়ে ধরে ওকে কেবিনের দিকে নিয়ে চলল মেয়েটা। আপত্তি করে লাভ হবে না বুঝে সুবোধ বালকের মত হাঁটছে রানা। কেবিনে ঢুকে বিছানার পাশে থামল ও।
শুয়ে পড়ো, নরম সুরে বলল জুডি। চোখে টলমল করছে অশ্রু। প্রথমে ভেবেছি আমার জন্যে নিনার ক্ষতি করবে তুমি। তখন তোমার প্রতি মনে এসেছিল ভীষণ বিরূপ ভাব। …তারপর…।
অমন না করলে…
পরে বুঝেছি। জীবনের ঝুঁকি নিয়েছ নিনা আর আমার জন্যে। ভাবতেও পারিনি কেউ এত নিঃস্বার্থভাবে… চুপ হয়ে গেল জুডি। একটু পর বলল, তোমার ওপর রাগ করেছি বলে এখন ঘৃণা করতে ইচ্ছে হচ্ছে নিজেকে।
প্রাণপণে ঘৃণা করো, কিন্তু সুন্দর নাকটা ওভাবে ফুলিয়ো না তো, বাপু, ভাবল রানা। মুখে বলল, এখন তো আর ঘৃণা নেই?
একটু আছে।
আমার এবারের অপরাধ?
আমাকে দিয়ে ঘৃণা করিয়েছ, সেজন্যে তোমাকে ঘৃণা করি। গম্ভীর চেহারা করেও নিজের বোকামি বুঝে ফিক করে হেসে ফেলল জুডি।
আমার উচিত হয়নি মোটেলে তোমাকে রেখে চলে যাওয়া, বলল রানা।
ঠিক। উচিত ছিল আমার খুব কাছে থাকা। তুমি ঠিকই জানতে কী চেয়েছি তোমার কাছে।
বোধহয় জানতাম, খুকখুক করে কাশল রানা। তবে তখন জরুরি কাজে…।
খাটে বসে পড়ে রানার কোমর জড়িয়ে ধরে টানল জুডি।
বাথরুমের হলদে আলোয় ওকে স্বর্গের অপ্সরা মনে হলো রানার। বসল ওর পাশে।
তবে তখন মোটেল থেকে তুমি চলে না গেলে, পরে কখনও হয়তো এত ভালভাবে চিনতাম না, অস্পষ্ট স্বরে বলল জুডি। এবার মাথাটা ঠেকাও বালিশে, আমি মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।
বহু দূরে হুতাশ নিয়ে সঙ্গিনীকে ডাকছে পাহাড়ি সিংহ। ঘুম আসতে দেরি হলো না রানার। পাশে বসে আকাশ পাতাল ভাবছে জুডি। বুকটা হু-হু করছে কেন জানি।
.
৩৫.
একটু আগে র্যাঞ্চ হাউসের লিভিংরুমে ফিরেছে ন্যাশ ময়নিহান। বসে আছে উইং-ব্যান্ড চেয়ারে। চুপ করে ভাবছে এবার কী করবে। হাতে নিনার ভিডিয়ো ক্যামেরা। ছোট্ট স্ক্রিনে দেখছে ফ্র্যাঙ্ক ম্যালভিকে পিটিয়ে খুন করছে রিক বেণ্ডার ও নিক বেণ্ডার। শেরিফের বুকে অস্ত্র তাক করে তাকে খুন হতে দেখছে অস্টিন ম্যাকলাস্কি। দুই বেণ্ডারের বিরুদ্ধে লড়ার সাধ্য নেই ম্যালভির। এক পর্যায়ে তার কান ছিঁড়ে নিল নিক। এমনি সময়ে শোনা গেল নিনা ভেঞ্চার ফুঁপিয়ে ওঠার শব্দ। চুপ থাকতে পারেনি মেয়েটা। জঙ্গলের দিকে ঘুরল ক্যামেরা। দেখা গেল নীরব এক লোক। মনোযোগ দিয়ে দেখছে হত্যাকাণ্ড। যুম করা হলো ছবি।
মুখের ভাল দিকটা তোলেনি, আপত্তির সুরে বলল ময়নিহান। তবু পরিষ্কার চেনা যাচ্ছে তাকে। হাত নেড়ে নিনার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে সবার। এ ছবি দেখলে যে কেউ বুঝবে ময়নিহান ওখানে ছিল খুনের সময়। কোনওভাবেই মাফ পাবে না আদালত থেকে।
এবার দুলে উঠল ক্যামেরা, অস্পষ্ট হয়ে গেল ছবি। ভীষণ ভয়ে পালাতে শুরু করেছে নিনা ভেঞ্চুরা। শোনা গেল দৌড়ে যাওয়ার সময় রীতিমত ফোঁপাচ্ছে মেয়েটা। ধুপধাপ আওয়াজ তুলছে ওর বুটজুতো।
এ ধরনের ছবি চিরকালের জন্যে জেলখানায় পুরবে ময়নিহানকে। মাসুদ রানা যা-ই বলুক, নিশ্চয়ই কপি আছে এ ভিডিয়োর। অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে জুডি ব্ল্যাকউড, নিনা ভেঞ্চুরা আর মাসুদ রানাকে খতম করা। কোনওমতেই বাঁচতে দেয়া যাবে না ওই দুই বোনকে। তবে মাসুদ রানার বিষয়টি অন্যরকম। অন্য সিণ্ডিকেটের টপ টেররদের সামনে ওকে বোকা বানিয়ে অপমান করেছে লোকটা। কাজেই ভয়ঙ্কর কষ্ট দিয়ে খুন করতে হবে তাকে।
মারি কিটনের অনুরোধ শুনে ওয়াল্টার হেইন্সের মৃতদেহ টুকরো করতে দিয়েছে ময়নিহান। তবে মাসুদ রানাকে ধরে এনে কসাইখানায় খুন করবে সে নিজ হাতে। হেইন্সের মত নয়, জীবিত অবস্থায় ওই লোকটাকে কেটে নামাবে সে।
অফ করে দিল ময়নিহান ক্যামেরা। ঘরের দূরে চুপ করে বসে আছে রিক বেণ্ডার। ডুবে আছে আপন চিন্তায়। তাকে ক্যামেরা দেখাল ময়নিহান। এই ফিল্মের জন্যে আমার চেয়ে অনেক বড় বিপদে আছ তুমি। হয়তো বোঝোনি বিপদের মাত্রা। অবাক লাগছে ভাবতে যে এটা উদ্ধার করতে পুরো মনোযোগ দাওনি তোমরা।
মেয়েলোকটা বা তার ছবি নিয়ে মাথা ঘামাইনি, বলল রিক। ভেবেছি, কী করবে বেটি? ইন্টারনেটে পোস্ট দেবে? যোম্বি সিনেমা আর মানুষের কাঁচা মাংস খাওয়ার অন্তত হাজার খানেক মুভি দেখেছি ইউটিউবে। কেউ সিরিয়াসলি নেয় না এসব। একবার দেখেই ভুলে যাবে সবাই।
আইনী যে-কোনও সংস্থার হাতে যখন তুলে দেবে, তারা কিন্তু সিরিয়াসলিই নেবে। বিশেষ করে যখন জানা যাবে যে অফিসে আর ফেরেনি শেরিফ।
আমরা না ওদিক সামলে নিয়েছি? বলল রিক, প্রমাণ করা যাবে, জাজ হোন্ডের টাকা লুঠ করে প্রেমিকাকে নিয়ে পালিয়ে গেছে লোকটা।
ওই গল্প তৈরি করেছিল অস্টিন ম্যাকলাস্কি। শেরিফ অফিসের একটা কেবিনেট সরিয়ে ওটা রাখা হয় জাজের অফিসে। আবার তার একটা কেবিনেট নেয়া হয় শেরিফের অফিসে। এসব করা হয়েছিল প্রমাণ করার জন্যে। দেখিয়ে দেয়া হতো, জাজ হোল্ডের অফিসের কেবিনেটে পাওয়া গেছে ম্যালভির আঙুলের ছাপ।
এসব বলে চাপা দিত ম্যালভির কেস। কিন্তু এখন ভিডিয়োটা থাকার কারণে, যে-কেউ বুঝবে পিটিয়ে খুন করা হয়েছে লোকটাকে। আর সেসময় ওখানে ছিল ময়নিহান। মস্তবড় বিপদে জড়িয়ে যাবে সে। তার কাছে এখন আছে অরিজিনাল ভিডিয়ো। ওটার কপি রেখে খুব লাভ হবে না। রিক ঠিকই বলেছে, আজকাল বেসিক কমপিউটার প্রোগ্রাম জানে এমন যে-কোনও নবিশ তৈরি করতে পারবে এমন বিশ্বাসযোগ্য ভিডিয়ো। অনায়াসেই ময়নিহানের উকিলরা প্রমাণ করবে এ ধরনের ভিডিয়ো মিথ্যা।
ভিডিয়ো সংক্রান্ত চিন্তা মন থেকে দূর করল ময়নিহান। ঠিক করেছে, পরে ভেবে দেখবে কীভাবে নিশ্চিহ্ন করা যায় প্রমাণ। রিক, এখনও মাসুদ রানাকে খুন করতে চাও?
ওকে মারতে পারলে আর কিছুই চাই না, বলল রিক।
আমিও চাই মরুক লোকটা, বলল ময়নিহান। তবে এটাও চাই, আমরা দুজন যেন তাকে খুন করতে গিয়ে প্রতিযোগিতা না করি।
সোজা হয়ে বসল রিক। কাঁচকোচ আওয়াজ তুলল চেয়ার। আমরা আবার কবে শত্রু হলাম, বস্?
যখন তুমি ফেলে দিলে আমার হেলিকপ্টার, আয়েস করে বসল ময়নিহান। হাত রেখেছে পেটের ওপর।
আপনি তা হলে জানেন, বস্? বিস্মিত রিক।
বিধ্বস্ত হওয়ার আগে কল করেছিল পাইলট, বলল ময়নিহান, বলেছিল প্রকাণ্ড এক লোক ম্যাগনাম দিয়ে গুলি করছে তার দিকে। বলো তো, রিক, কার কথা মনে পড়বে তোমার?
আপনার লোককে খুন করেছি জেনেও আমাকে বললেন ফিরতে?
হ্যাঁ, বললাম, রিক। বুঝতে পেরেছি কেন করেছ ওই কাজ। তুমি চাও নিজ হাতে মাসুদ রানাকে খুন করতে। অন্যরা যদি পথে বাধা হয়, সরিয়ে দেবে তাদেরকে।
উঠে দাঁড়াল রিক। ওর ছায়া পড়ল ঘরের মাঝে। প্রায় ছাত ছুঁই-ছুঁই করছে মাথা। আমি শুধু ওই মস্তানদের শেষ করিনি, আরও কয়েকজনকে মেরেছি।
ম্যাকলাস্কি আর হোল্ড? আমারও তাই ধারণা। ঘাড় মটকে গিয়েছিল ম্যাকলাস্কির। আর হোল্ড পড়ে তিনতলার জানালা থেকে। মনে হয়নি ওগুলো মাসুদ রানার স্টাইলের সঙ্গে মেলে।
তো? এবার কী করতে চান, বস?
আমাদের হওয়ার কথা শত্রু। কিন্তু আগেই তোমাকে বলেছি, চাই না আমাদের ভেতর শত্রুতা থাকুক।
কর্কশ হাসল রিক। বস্, আপনার খুনিরা জানেও না, তাদেরকে কলের পুতুলের মত ব্যবহার করছেন আপনি। কিন্তু আমি অত গাধা নই। এক এক করে মরছে তারা। বলুন তো, ঠিক কখন আমাকে দুনিয়া থেকে বিদায় করবেন?
আমার প্ল্যানটা তেমন নয়, বলল ময়নিহান, তবে একটা কথা, আমি হাতের মুঠোয় চাই রানাকে। সবার সামনে আমাকে অপমান করেছে লোকটা।
আপনি বলছেন অপমানের কথা? আর ওই হারামজাদা কুত্তার বাচ্চা খুন করেছে আমার আপন ছোটভাইকে!
আমি নিজ হাতে খুন করতে চাই ওকে।
মাথা নাড়ল রিক। না, বস, ও আমার।
অলস বেড়ালের মত আয়েস করে চেয়ার ছাড়ল ন্যাশ ময়নিহান। আড়ষ্ট হয়ে গেছে রিক। তার উদ্দেশে হাত নাড়ল টপ টেরর। ভয় পেয়ো না, রিক। আমার হাতেই খুন। হবে রানা। তবে তুমি চাইলে তোমাকেও রাখতে পারি পাশে। দুজন মিলে খুন করব ওকে। তবে সব প্রশংসা দিতে হবে আমাকে।
অন্য কেউ এ প্রস্তাব দিলে, বস, তার কলজেটা উপড়ে নিতাম; তবে আপনার কথা আলাদা। ঠোঁট বেঁকে গেল রিকের। গভীরভাবে ভাবছে টপ টেররের প্রস্তাব। জীবনের সেরা চুক্তি বলেই মনে হচ্ছে তার এটাকে। হাসতে হাসতে প্রতিশোধ নেবে, অথচ খুনের দায় চাপবে না ঘাড়ে। আপনার যুক্তি তত ভাল বলেই মনে হচ্ছে, বস।
কেউ যেন জানতে না পারে আসল সত্যি, রিক।
কাউকে বলতে যাব কোন আক্কেলে?
অর্থাৎ, মেরে ফেলতে হবে অন্যদেরকে।
হ্যাঙ্ক পার্কার আর মারি কিটন? আপনি বললে এখনই গিয়ে খতম করে দিয়ে আসি।
ভুল ভাবছ। বলেছি রানার সঙ্গীদের কথা। প্রেয়ারিতে হাজির হয়েছিল স্নাইপার রাইফেল নিয়ে। যেদিক থেকে গুলি খেয়ে মরেছে ড্যাগেট, ওয়াইল্ড আর চার্লস্ গ্রেড, তাতে বুঝতে পেরেছি, তারা ছিল কমপক্ষে দুজন। জুডি ব্ল্যাকউড আর নিনা ভেঞ্চরাকেও ছেড়ে দেয়া যাবে না কিছুতেই।
প্রথম সুযোগে খুন করব ওদের সবাইকে।
কিন্তু বাঁচিয়ে রাখবে মাসুদ রানাকে।
ঠিক আছে, মেঝের দিকে তাকাল রিক। আর আপনার অন্য লোকগুলোকে, বস? ওদেরকে মেরে ফেলব?
এক সেকেণ্ডের জন্যে কী যেন ভাবল ময়নিহান, তারপর বলল, যা করতে বলে দেব, তার বাইরে যাবে না ওরা।
ঠিক আছে, বস্।
রিকের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল ন্যাশ ময়নিহান।
সন্দেহ নিয়ে তাকে দেখল দানব।
অত ভয় কীসের, রিক? চুক্তি না হয়ে গেছে?
হ্যাঁ, হয়েছে, বলল রিক, তবে খুঁজে বের করতে চাইছি কোথায় রেখেছেন আপনার নরকের ওই ক্ষুর।
মুচকি হাসল ময়নিহান। এজন্যেই তোমাকে ভালবাসি, রিক। আগে কখনও বলেছি, তুমি আমার দলের সেরা?
জী, বস্, আগেও বলেছেন।
নতুন অংশীদারী চুক্তি, হাত মেলাল ন্যাশ ময়নিহান ও রিক বেণ্ডার।
.
৩৬.
কুয়াশা মাখা মাঝরাত।
রওনা হয়েছে রানা, জন, বাড, জুডি ও নিনা। থমথম করছে নীরব পাইলট পয়েন্টের রাস্তা। উইণ্ডস্টারের সামনের দুসিটে বাড ও জন। পেছনের সিটে জুডি ও নিনার মাঝে রানা। চিন্তায় ডুবে গেছে মেয়েদুটো। রানার কাঁধে মাথা রেখেছে জুডি। ওর চুল থেকে রানা পাচ্ছে কী-এক ফুলের মিষ্টি সুবাস। মনে পড়ছে কয়েক ঘণ্টা আগের কথা। ভালবাসার কোনও দাবি বা বিয়ের কথা তোলেনি জুডি। বরং নিজেই বলেছে, আর কখনও দেখা না হলেও সন্তুষ্ট থাকবে শুধু বন্ধু হিসেবে রানাকে পেলে। তাতে বিরাট হাঁফ ছেড়ে স্বাভাবিক হতে পেরেছে রানা।
ডিএফডাব্লিউ এয়ারপোর্টের দিকে চলেছে ওরা। ঠিক হয়েছে বিমান যোগে টাম্পা শহরে যাবে জুডি ও নিনা। ওদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উড়ে আসছে গিল্টি মিয়া ও হারাধন কই। ঠিক হয়েছে, উপযুক্ত লোক পাওয়ার আগ পর্যন্ত নতুন শাখায় জন হার্বার্টের সহযোগী হিসেবে ওখানে থাকবে ওরা দুজন।
হারাধন কই গিল্টি মিয়ার ফুপাত ভাই। বয়স বড়জোর বাইশ। গিল্টি মিয়াও জানে না ওর আসল নাম। পাঁচ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে মেলা দেখতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল। একমাত্র ছেলে, প্রায় পাগল হয়ে যায় ওর বাপ-মা। কিন্তু দুদুটো নদী সাঁতরে পার হয়ে, পনেরো মাইল পায়ে হেঁটে ভোররাতে বাড়ি ফিরল সে। ওর দাদা তখনই ঘোষণা দিল: এখন থেকে ওর নাম হারাধন কই।
দুঘণ্টা পর জুডি ও নিনাকে নিয়ে ফ্লোরিডার দিকে রওনা হবে গিল্টি মিয়া আর হারাধন কই। রানা, জন ও বাড ফিরবে ময়নিহান র্যাঞ্চে। ওরা শত্রুর আস্তানায় হামলা করবে শুনে ভীষণ রেগে গিয়েছিল জুডি। মাথা নেড়ে বলেছে, রানা আহত ও ক্লান্ত। খুন হবে যখন-তখন, কাজেই কোনওভাবেই ওকে ছেড়ে যাবে না জুডি। কিন্তু নতুন করে তর্ক শুরু করার আগেই ওর মুখ বুজিয়ে দিয়েছে রানা চুমু দিয়ে। পুরো এক মিনিট পর ঠোঁট সরিয়ে বলেছে, কাজটা শেষ করতে হবে, জুডি। নইলে বাকি জীবন আমরা সবাই থাকব বিপদে। যে-কোনও সময়ে আসবে মৃত্যু। তুমি নিশ্চয়ই নিরন্তর হুমকি মাথায় নিয়ে বাকি জীবন চাও না?
কেঁদে ফেলেছে জুডি। ভয় লাগছে, আর কখনও দেখব না তোমাকে।
সতর্ক থাকব, কথা দিয়েছে রানা।
ওর আহত কাধ স্পর্শ করে বিড়বিড় করেছে জুডি, অনেক বেশি ঝুঁকি নাও। দুই ইঞ্চি নিচ দিয়ে বুলেট গেলে খুন হতে।
তখন নিজের দিকে খেয়াল ছিল না। তা ছাড়া, এবার কাউকে সরিয়ে আনতে হবে না, স্রেফ দুনিয়া থেকে বিদায় করব একদল হিংস্র জানোয়ারকে।
বড় বড় চোখে রানাকে দেখেছে জুডি। ওর বুকে জেগে উঠেছে পুলিশ অফিসারের বিবেক।
ওরা অশুভ মানুষ, জুডি, যুক্তি দিয়েছে রানা।
তা জানি।
ওদেরকে থামাতে হবে, নইলে বাঁচতে দেবে না আমাদের মত আরও অনেককে। এফবিআই-এর কাছে ভিডিয়োর কপি দিলেও ওদের নাগালের বাইরে থাকবে ময়নিহান। নিজ হাতে আমাদেরকে খুন করতে না পারলে ভাড়া করবে খুনি। বা কাজে লাগাবে কোনও সিণ্ডিকেটকে।
ভাবছ আপত্তি তুলব? রানাকে অবাক করে বলেছে। জুডি, না, আপত্তি বা তর্ক করব না। র্যাঞ্চ থেকে বেরোবার সময় ভেবেছি, ওখানে এমন কেউ নেই যে তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। ওরা মারা গেলে থাকছে না ছেঁড়া কোনও সুতো।
জুডির চোখে অবাক হয়ে চেয়েছে রানা। কসেকেণ্ড পর বলেছে, জানতাম না তোমার মধ্যে বাস করে দুঃসাহসী এক মেয়ে!
তোমার মত সাহসী নই, তবে যুক্তি বুঝতে অসুবিধা হয় না, মৃদু হেসেছে জুডি। তা ছাড়া, তোমার সঙ্গে থেকে এই কদিনেই হয়ে উঠেছি দুর্ধর্ষ।
অবশ্য সামান্য ভুল ভাবছ, বলেছে রানা, লিটল ফোর্কে আমাদেরকে চেনে অস্টিন ম্যাকলাস্কি আর জাজ হোল্ড।
ওরা দুজন মারা গেছে, জানাল জুডি।
অবাক চোখে ওকে দেখেছে রানা।
কান পেতে শুনেছি ময়নিহানের কথা। তার ধারণা ওই দুই খুন তুমিই করেছ। তবে আমার তা মনে হয় না।
ম্যাকলাস্কি যখন মোটেল রেইড করল, বুঝলাম আমার নাম তাদের অজানা, বলল রানা, একই কথা খাটে বেণ্ডারদের স্যাঙাৎদের বিষয়ে। তবে ভেবেছি তোমার কাছ থেকে নামটা জেনে থাকতে পারে পুলিশ ফোর্স।
রানার মন পড়েছে জুডি। কমুহূর্ত পর বলল, আমাকে ময়নিহানের হাতে তুলে দেয়ার পর ম্যাকলাস্কি জানতে পেরেছে আমার নাম। ফোনে শেরিফ অফিসে যোগাযোগ করার সময় নিজের নাম জানাইনি। মহিলা পুলিশকে শুধু বলেছি, নিনা ভেঞ্চুরার ব্যাপারে কথা বলতে চাই শেরিফের সঙ্গে।
নিনাকে চিনবে স্থানীয় মস্তানরা, ন্যাশ ময়নিহানের সঙ্গে গোলমালে জড়িয়ে গিয়েছিল ও।
কিন্তু মুখ খুলতে গেলেই প্রমাণ হবে লিটল ফোর্কে কী করছিল তারা, মাথা নাড়ল জুডি। কাজেই মুখ বন্ধ রাখবে সবাই।
কথা ঠিক, সায় দিল রানা। তা ছাড়া, তারা জানে না এ শহরে এসেছিল নিনা। এ থেকে আরেকটা বিষয় বেরিয়ে আসে। পরবর্তী সময়ে বিপদ এড়াতে চাইলে মুখোমুখি হতে হবে ময়নিহান আর ওর দলের।
রানার যুক্তি খণ্ডন করতে গেল না জুডি। শুধু বলল, খেয়াল রেখো, লড়তে গিয়ে যেন খুন হয়ে না যাও।
মরতে কে চায়? ঠিক আছে, সতর্ক থাকব, বলল রানা।
এরপর এ বিষয়ে দ্বিতীয়বার কথা হয়নি রানা বা জুডির।
গাড়িতে পাশাপাশি বসে আছে ওরা। একটু পর পৌঁছে গেল এয়ারপোর্টে। লাউঞ্জে ওদের সঙ্গে দেখা করল গিল্টি মিয়া ও হারাধন কই। বসে পড়ে রানার পা ছুঁয়ে সালাম করল বাঙালি তরুণ। উঠে দাঁড়িয়ে লাজুক চোখে দেখল জুডি আর নিনাকে। গিল্টি মিয়া দুপায়ের স্যাণ্ডেল বুটের মত করে ঠুকে স্যালিউট করল রানাকে। অনেক বকা দিয়েও ওর ভক্তির আতিশয্য থামাতে পারেনি রানা। শেষে বুঝেছে: ছোট্ট সাইজের মানুষটা ওকে শুধু ভক্তিই করে না, অন্তর থেকে ভালবাসে। এ-ভালবাসার কোনও তুলনা হয় না।
কী ধরনের বিপদ, আগেই ফোনে গিল্টি মিয়াকে বলেছে রানা। মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে হাজির হয়েছে বত্তিশ বচোর কয়েদ খাটা প্রাক্তন পাকা চোর। তবু ওকে সরিয়ে নিয়ে আরেক দফা ব্রিফ করল রানা।
সব মাতায় আচে, স্যর, কোনো চিন্তে করবেন না, বলল গিল্টি মিয়া, কেউ বেগড়বাই করলেই ঠক্কাস করে দোব। তাছাড়া, হারাধোন আচে না। ওর গায়ে ষাড়ের জোর। সেদিন ভোরে আমায় কাঁদে তুলে একমাইল দৌড়ে গেল। এটু হাঁপাল না! বোজেন অবস্তা, স্যর! ওকে। আপিসের বাইরে দাঁড় করিয়ে দোব… তাহালে
কিন্তু কেউ এসে গুলি বা ছোরা চালালে? জানতে চাইল চিন্তিত রানা।
তা কখখোনও হবে নি, স্যর। আরও পাকা হয়েছি না? এলেই ঠক্কা। বারোটা বাজিয়ে দোব।
বাজার করবে কে? মেয়েদের একা রেখে তুমি তো কোথাও যেতে পারবে না।
ও-বাড়ি থেকে বেরোবই না। বাজার-সদাই করবে হারাধোন। তবে, স্যর, ইয়ে… ও ব্যাটা আমার চেয়েও এক কাটি সরেস হয়ে উটেছে। সেদিন বড়সড় একটা নোট গাপ করে দিলে। পেলাম না তো পেলামই না। বুজলাম ওস্তাদ মারা সাগরেত হয়ে উটেছে, স্যর। এমন করবে বুজলে, আগেই চড়িয়ে ওর বত্তিশ পাটি দাঁত ফেলে দিতুম। আবার হেসে জিজ্ঞেস করে: কিচু খুজচেন, দাদা? বলতে ইচ্চে হলো, ওরে, স্লা, তোর মতন বেয়াদপ… শ্রদ্ধেয় স্যরের সামনে গাল বকে ফেলে দাঁতে জিভ কাটল গিল্টি মিয়া।
গম্ভীর চেহারায় বলল রানা, ঠিক আছে, চলো।
আবার ওরা ফিরল অন্যদের পাশে।
এবার উঠতে হবে বিমানে, জুডিকে জানাল রানা।
মিষ্টি হেসে বিদায় নিল জুডি।
দুই বোনের দুপাশে চলল গিল্টি মিয়া ও হারাধন কই।
একটু পর পেরিয়ে গেল ওরা ডিপারচার গেট।
ঠিক আছিস? রানার গম্ভীর মুখ দেখে নরম সুরে বলল জন। শরীর খারাপ লাগছে?
না, ঠিক আছি, বলল রানা। ঘাড়ের চামড়া ও সামান্য পেশি চেঁছে নিয়ে গেছে বুলেট। ইতিমধ্যেই কমেছে ব্যথা। লড়তে সমস্যা হবে না।
জুডির জন্যে মন খারাপ? জানতে চাইল বাড।
দূর! ভালমত পরিচয়ই হলো না! মাথা নাড়ল রানা। মাত্র কদিনের পরিচয় ওর জুডির সঙ্গে, অথচ অদ্ভুত এক আকর্ষণ বোধ করছে মেয়েটির প্রতি। অন্যদিকে মন সরাল ও, চল, যাওয়া যাক।
পাঁচ মিনিট পর পার্কিংলটে গাড়ির পাশে থামল ওরা। ভাল করেই জানে, সব ঝামেলা শেষ করতে চাইলে ময়নিহান র্যাঞ্চে গিয়ে লড়তে হবে। কোনও নিশ্চয়তা নেই যে বেঁচে ফিরবে ওরা।
আশা করি ময়নিহান যাবে মাটির নিচে, আর আমরা থাকব ওপরে, যেন রানার চিন্তা মুখে প্রকাশ করল জন।
উইণ্ডস্টারের ড্রাইভিং সিটে বসল বাড। পাশের সিটে জন। পেছন সিটে রানা। ঠিক করেছে ঘুমিয়ে নেবে একটু। সঞ্চয় করতে হবে শক্তি। সামনে হয়তো পড়ে আছে দীর্ঘ লড়াই। জুডির উদ্বিগ্ন, মিষ্টি মুখটা মন থেকে সরিয়ে দিল ও।
গাড়ি নিয়ে রওনা হয়ে গেল দুর্ধর্ষ, বেপরোয়া তিন বন্ধু।
.
৩৭.
মারি, জরুরি একটা কাজ দিতে চাই তোমাকে, বলল ন্যাশ ময়নিহান।
কিচেনে দাঁড়িয়ে গ্রিন টি-র কাপে চুমুক দিচ্ছে মহিলা। পাশের টেবিলে মোবাইল ফোন। ঘরে ঢুকে ওটা দেখেছে ময়নিহান। মনে হয়েছে, মালিকপক্ষের কাছে রিপোর্ট দিচ্ছিল মারি কিটন। ঘাড় ফিরিয়ে ময়নিহানের দিকে তাকাল ও, যেন মরা মাছের চোখ। কেমন যেন গা শির শির করে।
আপনি আগেই একটা কাজ দিয়েছেন, বলল মারি। খুন করতে হবে মাসুদ রানাকে।
তারও আগে আরেকটা জরুরি কাজ আছে।
পা ছড়িয়ে চেয়ারে বসল মারি। মেয়েলি ভাব নেই তার আচরণে। প্যান্টের পকেটে ডানহাতের বুড়ো আঙুল ভরে তাকাল ভুরু কুঁচকে। মাসুদ রানাকে খুনের চেয়েও জরুরি কী কাজ থাকতে পারে, বস?
আমি চাই প্রথম সুযোগেই নিনা ভেঞ্চুরাকে খুন করবে তুমি। ও এখন আমাদের জন্যে ভয়ানক বিপজ্জনক।
ও তো আছে রানার সঙ্গে। মাসুদ রানাকে খুন করার সময়েই শেষ করে দেব।
কাজটা অত সহজ হবে না, বলল ময়নিহান। অন্য কোনও কৌশলে নিনাকে সরিয়ে দেবে রানা।
ধীর হাতে মোবাইল ফোন তুলে বুক পকেটে রাখল মারি কিটন। অস্ত্র বোধহয় হাতব্যাগে। বাড়তি পোশাকও র্যাঞ্চে আনেনি। মুহূর্তে রওনা হতে পারবে যে-কোনও দিকে। তো, বলুন কী করতে হবে?
অল্প কথায় সারবে ঠিক করেছে ময়নিহান। একটু আগে রিক বেণ্ডারের সঙ্গে আলাপে জেনেছে জরুরি তথ্য। ফ্লোরিডার টাম্পা শহর থেকে লিটল ফোর্ক শহরে এসেছিল নিনার ছোটবোন জুডি। এ কথা মাথায় রেখে টাম্পায় পরিচিত কজন ক্রাইম বসের সঙ্গে কথা বলেছে ময়নিহান।
জানা গেছে, সহজ লোক নয় মাসুদ রানা। নামকরা এক প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সির চিফ। শুধু তা-ই নয়, সম্ভবত বাংলাদেশ আর্মি ইন্টেলিজেন্সের কমাণ্ডো ছিল। আরও পরিচয় আছে: মেক্সিকো, উরুগুয়ে, পেরু এবং আরও অনেক দেশে শখের আর্কিওলজিস্ট হিসেবে কাজ করেছে নানান অভিযানে। দুহাতে লাখ লাখ ডলার সাহায্য করে দুস্থ মানুষকে। কবার হারিয়ে যাওয়া মানুষকে খুঁজে বের করেছে জঙ্গল-পাহাড়-মরুভূমি-সাগর ছুঁড়ে। অনেকে বলে: লোকটা সত্যিকারের দুঃসাহসী এক বেপরোয়া বাঙালি অভিযাত্রী।
কিছুদিন হলো টাম্পা শহরে খুলেছে ওর ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির শাখা। এরই মাঝে অপরাধী সমাজের চক্ষুশূল হয়েছে উঠেছে তার দুই সহযোগী। ওই শাখা অফিসের চিফের নাম জন হার্বার্ট। প্রাক্তন যোদ্ধা। রানার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আপাতত কোথায় যেন গেছে সে। বুঝতে দেরি হয়নি ময়নিহানের, ওই লোকই স্নাইপারদের একজন। এ-ও আন্দাজ করেছে, এসবের শেষ না দেখে টেক্সাস ছেড়ে নড়বে না তারা।
আরেক ঝামেলা হচ্ছে ওই দুই মেয়ে। তাদেরকে দূরে কোথাও সরিয়ে দেবে মাসুদ রানা। তারপর ঠিকই ফিরবে শো-ডাউন করতে। এ ছাড়া উপায়ও নেই তার। নইলে তাড়া খেয়ে বেড়াবে আমৃত্যু। ময়নিহানের ধারণা, রানা পাঠিয়ে দেবে মেয়েদুটোকে টাম্পা শহরে। লুকিয়ে রাখবে কোথাও।
কয়েক ঘণ্টা আগে ডিএফডাব্লিউ এয়ারপোর্ট থেকে বিমানে উঠেছে দুই মেয়ে। ব্যবহার করেছে নকল নাম। কিন্তু আমার লোকের বর্ণনা থেকে বুঝতে পেরেছি, ওরাই। পাহারা দিয়ে নিয়ে গেছে দুজন বাদামি চামড়ার লোক।
তো রানা বা তার রহস্যজনক বন্ধু নয়? জানতে চাইল মারি। অন্য কেউ নিয়ে গেছে ওদেরকে?
যাত্রীর লিস্ট দেখেছে আমার লোক। ওই দুই লোক এসেছিল ফ্লোরিডার টাম্পা শহর থেকে। ফিরেছে পরের ফ্লাইটে। আইআরএস ডেটাবেস থেকে জেনেছি, লোকদুটো বাংলাদেশি। চাকরি করে রানা এজেন্সিতে। টেবিলের ওপর দিয়ে মারির দিকে একটা কাগজ ঠেলল ময়নিহান। এই যে ঠিকানা। মাত্র কিছুদিন হলো ভোলা হয়েছে ওই অফিস। …পারবে তো কাজটা শেষ করতে?
দুটো লোক আর দুটো মেয়ে? ভাববেন না। সময় লাগবে না ঝামেলা শেষ করতে। কাগজটা পকেটে রাখল মারি কিটন। কিন্তু আমাকে কেন কাজটা দিলেন, বস্? পাঠাতে পারতেন হ্যাঙ্ক পার্কার আর ওই পর্বতটাকে।
কারণ, মনে হয়েছে এ কাজের জন্যে তুমি সেরা।
মৃদু হাসল মারি। ক্ষণিকের জন্যে মনে হয়েছিল, আপনি চান আমাকে সরিয়ে দিতে। যাতে বিপদ না হয় আমার। …আপনি তো লড়বেন মাসুদ রানার বিরুদ্ধে?
হ্যাঁ, শেষ করব ওকে, বলল ময়নিহান। কয়েক মুহূর্ত পর মাথা নাড়ল। ভাল করেই জানি, অন্যদের চেয়ে দুর্বল নও তুমি। খুশি হবে জুডি ব্ল্যাকউডকে বাগে পেলে। খুন করতে যাচ্ছিলে, কিন্তু আমি বাধা দিই। এখন আর তা করব না।
আমাকে গুলি করতে চেয়েছিল কুত্তীটা, বলল মারি। কেউ আমার বিরুদ্ধে কিছু করলে কোনদিন ভুলি না। কাজেই মরতে হবে তাকে।
তো কখন নামছ কাজে?
মাথা দোলাল মারি কিটন। দেরি হবে না দুই কুত্তীকে শেষ করতে।
কাজ শেষ হলে পাবে মোটা অঙ্কের বোনাস, লোভের টোপ ফেলল ময়নিহান। টেবিলের ওপর দিয়ে ঠেলল আরেকটা কাগজ। এটা বিমানের রির্ভেশনের নম্বর। টিকেট পাবে বিমান টিকেটের কাউন্টারে।
কীভাবে যাব এয়ারপোর্টে?
আমার গাড়িটা নেবে, মারির দিকে চাবি বাড়িয়ে দিল ময়নিহান। এখানে আমার কাজ শেষ হলে এয়ারপোর্টের পার্কিংলট থেকে সংগ্রহ করে নেব ওটা।
হয়তো আগেই শেষ হবে আমার কাজ, বলল মারি। সেক্ষেত্রে ওটা নিয়ে নিজেই ফিরব।
কাঁধ ঝাঁকাল ন্যাশ ময়নিহান। ভাবছে, চট করে ফিরতে পারবে না মারি। এদিকে আগামী কঘণ্টার ভেতরই হামলা করবে মাসুদ রানা।
.
৩৮.
রাত তিনটা বা চারটায় সবচেয়ে অসচেতন থাকে মানুষ। তাই ওই সময়ে পৃথিবীর বুকে খুন হয় সবচেয়ে বেশি। বেশিরভাগ মানুষই থাকে ঘুমের কোলে। এ সুযোগে অপ্রস্তুত অপরাধীদের ধরতে রেইড দেয় পুলিশবাহিনী। টেরোরিস্ট ধরতেও মিশনে বেছে নেয়া হয় ওই রাত তিনটে থেকে চারটা। রানার উচিত ন্যাশ ময়নিহানের র্যাঞ্চে সেই সময়ে হামলা করা। কিন্তু তাতে রয়েছে একটা সমস্যা। ময়নিহান ভাল করেই জানে, কোন্ সময়ে হামলা করবে রানা। তার দলে আছে কয়েকজন খুনি। সতর্ক থাকবে তারা। এসব ভেবেই রানা ঠিক করেছে, অপেক্ষায় রাখবে না টপ টেররকে।
রানা যেমন চিনেছে ময়নিহানকে, ওই লোককে চিনতে বাকি নেই জন ও বাডেরও। টপ টেররের কাছে সবই হাসির বিষয়। খুন করা যেন মজার ভিডিয়ো গেম। সবসময় মরলে মরবে অন্যরা। তার কিছুই হবে না। প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করবে সে।
পাকা শয়তান বলতে পারিস, বলল জন। ওর ধারণা, পুরো দুনিয়া ঘুরছে ওকে ঘিরে।
আবার কেবিনে ফিরেছে রানা, বাড ও জন। নতুন করে ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বেলেছে বাড। কিছুক্ষণ পর লেকের বুকে পড়বে সূর্যের প্রথম রশ্মি। রাতে বার্গারের তেলতেলে গন্ধে বমি এলেও এখন খিদেয় রানার মনে হচ্ছে খেতে পারবে গোটা দশেক।
বাবুর্চির কাজ করছে বাড, কাঁটাচামচ দিয়ে গেঁথে রানার দিকে বাড়িয়ে দিল আরেকটা মস্ত বার্গার। লোকটা হয়তো ভাবছে সে দুনিয়ার সেরা খুনি, তার তুলনা নেই।
হয়তো সত্যিই তা-ই, কে জানে! বলল জন।
জানে না আমরা কারা, বা কী আমাদের ব্যাকগ্রাউণ্ড, বার্গারে কামড় বসাল রানা।
মাথা নাড়ল জন। আগের কথা বললি। এতক্ষণে তোর ব্যাপারে সব তথ্য জোগাড় করে ফেলেছে।
কাঁধ ঝাঁকাতে গিয়ে চামড়ায় টান পড়তেই গাল কুঁচকে ফেলল রানা। কঠোর চোখে দেখল বার্গারটাকে। দোষ যেন ওটার। তবে আরেক কামড় দিয়ে বুঝল, দারুণ স্বাদের। মাংস চিবুনোর পর ঢোক গিলে বলল, হয়তো যথেষ্ট রিসোর্স নেই। দেড় দিন জুডির ফোন ছিল আমার কাছে। ট্রেস করতে পারেনি। কঠিন হবে তার জন্যে আমার ব্যাকগ্রাউণ্ড জানা।
শত্রুর ব্যাপারে প্রথম শর্তটা ভুলে গেলি? বলল জন।
ভুলিনি, বলল রানা। ছোট করছি না কাউকে। তবে বুঝলাম না, কেন মুখোমুখি হতে চাইছে। তাতে কী পাবে সে?
হাতের বার্গার ওর দিকে তাক করল জন। ভুলে গেলি, ক্ষতি করেছিস তার? অর্ধেক তোক মেরে সাফ করলি, ভেঙে চুরমার করলি রেস্টুরেন্ট। তোর জন্যে বন্ধ হয়েছে কেন্টাকির বড় ব্যবসা। থেকে নামিয়ে দিয়েছিস তাকে বটম টেররে- তোকে ছাড়তে চাইবে কেন?
রিক বেণ্ডারকে বুঝতে পারি, বলল রানা। আমার হাতে মরেছে ওর ছোটভাই। তাই চাইছে খুন করতে। কিন্তু ন্যাশ ময়নিহানকে ঠিক স্বাভাবিক লোক মনে হচ্ছে না।
সে কেমন তা নিয়ে ভাবছি না, বলল জন, শুধু জানি সে আমাদের শত্রু। পথ থেকে সরিয়ে দিলে নিশ্চিন্তে ফিরতে পারব ফ্লোরিডায়। তখন আর এদের কেউ আসবে না খুন করতে।
চুপচাপ বার্গার চিবুতে লাগল রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর দিগন্তের ওদিক থেকে উঁকি দিল সোনালি রোদ। বার্গার শেষ করে কফি নিল রানা। ভাবছে, সামনে দীর্ঘ দিন। ওরা ফিরবে ময়নিহান র্যাঞ্চে। স্নাইপার রাইফেল পাবে না। নেবে এমন অস্ত্র, যেগুলো ডেটাবেস থেকে ট্রেস করতে পারবে না এফবিআই বা পুলিশ ফোর্স। আশা করা যায়, জন ও বাড উইনচেস্টার দিয়ে যেসব গুলি করেছে, সেগুলো টার্গেটে লেগে হারিয়ে গেছে প্রেয়ারিতে। সামনের লড়াইয়ে আড়াল করা যাবে না ওদের গুলি।
রাইফেলের কেস নিয়ে বেরিয়ে গেল বাড। বাইরে গর্জে উঠল গাড়ির ইঞ্জিন। পুরো নব্বই মিনিট পর ফোর্ট ওঅর্থ জয়েন্ট রিযার্ভ বেস থেকে ফিরল ও। সার্জেন্টের হাতে তুলে দিয়ে এসেছে অস্ত্রগুলো।
কেবিনে ওদের আঙুলের ছাপ ও রানার রক্তের ফোঁটা মুছল ওরা। পরে আইনী সংস্থা হয়তো ধরে নেবে কেবিন ভাড়া নিয়েছিল কজন মৎস্যশিকারী।
যে যার অস্ত্র পরীক্ষা করল ওরা। রানা নিয়েছে ওয়ালথার পি.পি.কে. আর একটা কে-বার নাইফ। জনের পছন্দ গ্লক সতেরো, মসবার্গ কমব্যাট শটগান আর আট ইঞ্চি ব্লেডের শ্রেড নাইফ। বাডের কাছে রাশান সেমি অটোমেটিক পিস্তল আর উরুর সঙ্গে বাঁধা কমাণ্ডো নাইফ। গাঢ় রঙের শার্টের ওপর ওরা পরল কালো জ্যাকেট, জিন্সের প্যান্ট, পায়ে বুট। আমেরিকার সবচেয়ে বাজে বারের ডোরম্যান/বাউন্সার বলে মনে হচ্ছে জনকে, তবে বরাবরের মতই চুল পরিপাটি করা নিপাট ভদ্রলোক সেজেছে বাড।
শেষবারের মত পাইলট পয়েন্ট ছাড়ার আগে একটা কাজ করবে রানা। সবাইকে নিয়ে রানা এজেন্সিতে উঠেছে গিল্টি মিয়া, তবুও লেকের তীরে গিয়ে জুডিকে ফোন দিল ও।
হাই, রানা, ওদিক থেকে এল মিষ্টি কণ্ঠ। তবে গলায় ক্লান্তি। কাঁধের কী অবস্থা?
প্রায় সেরে গেছে।
ডাহা মিথ্যুক!
গিল্টি মিয়া কোথায়?
বাইরের ঘরে টেবিলের ওদিকে। ভেতরের ঘরে আমরা দুই বোন।
ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম? সরি!
না, তা নয়, তাড়াতাড়ি করে বলল জুডি। খুব খুশি হয়েছি ফোন করেছ বলে।
নিনাকে বোলো, রুক্ষ আচরণ করেছি, সেজন্যে আমি দুঃখিত।
ও জানে কেন এমন করতে হয়েছে।
একটু পর রওনা হচ্ছি, বলল রানা, কল করেছি তা জানাতে।
আমি গুডবাই দেব না।
কেন?
পরে যাতে দেখা হয় আবার।
চিন্তা কোরো না, বলল রানা। আশা করি আজই কেটে যাবে সব বিপদ। অন্তত ময়নিহান আর আসবে না তোমাদের বিরক্ত করতে।
ফিসফিস করে বলল জুডি, ভাল থেকো।
কল কেটে দিয়ে পকেটে রাখল রানা মোবাইল ফোন। স্পর্শ করল ওয়ালথারের বাট। চলে এল কেবিনের কাছে। উইণ্ডস্টার গাড়ির সামনে ওর জন্যে অপেক্ষা করছে জন ও বাড।
তুই রেডি তো, রানা? জিজ্ঞেস করল জন।
জবাবে রানা বলল, চল, রওনা হওয়া যাক।
ন্যাশ ময়নিহানের র্যাঞ্চে বাড়তি ঝুঁকি যেন নিতে না হয় বন্ধুদের, সেজন্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক কাজটা নিয়েছে রানা। আপত্তি তুলেছিল দুই বন্ধু, কিন্তু পাত্তা দেয়নি ও।
একটু পর গাড়ি নিয়ে রওনা হলো ওরা। বরাবরের মতই কমপিউটার দিয়ে জাদু দেখাল বাড। মোবাইল ব্রডব্যাণ্ড কানেক্টর ব্যবহার করে স্ক্রিনে আনল ময়নিহান র্যাঞ্চ হাউস ও আশপাশের এরিয়াল ইমেজ। গুগল ব্যবহার করলে আজকাল আর শত্রু এলাকায় রেকি করতে হয় না কাউকে। পরিষ্কার দেখা গেল ওই এলাকার প্রতিটা বাড়ি। এরপর জাদুর চেয়েও বেশি কিছু করল বাড। গ্রেসন কাউন্টি ডেটাবেস থেকে সংগ্রহ করল ময়নিহানের র্যাঞ্চ হাউস ও অন্যান্য বাড়িটা স্কেটিক্স। কীভাবে ওগুলো তৈরি করা হয়েছে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল ওরা।
র্যাঞ্চ হাউস প্রকাণ্ড। বেযমেন্ট ও অ্যাটিকসহ পুরো চারতলা। কলোনিয়াল ম্যানশনের ওপরতলায় আছে লিভিং কোয়ার্টার। নিচতলায় কিচেন, ডাইনিং ও গুদাম। একটু দূরেই বিশাল কয়েকটা বাড়ি। শেষের বাড়িটা খোয়াড়, আয়তক্ষেত্রাকার। চারপাশে মাইলের পর মাইল খোলা ঘাসজমি।
গোপনে কাছে যাওয়া অসম্ভব, বলল জন। ভাল হতো এম টোয়েন্টিফোর থাকলে। গুলি করতে পারতাম দূর থেকে।
ইউটা মরুভূমিতে সিআইএর একটা টেরোরিস্ট ট্রেনিং সেল-এর খুব কাছে ক্রল করে পৌঁছেছিল রানা ও জন হার্বার্ট। তা করতে হয়েছিল জাতিসংঘের অ্যান্টি টেরোরিস্ট টিমের হয়ে। ফিরেছিল জরুরি তথ্য নিয়ে। পরে বাগদাদ শহরে কিছুদিনের জন্যে ঠেকিয়ে দেয় ওরা অসামরিক জনসাধারণের ওপর মার্কিনীদের অন্যায়, নির্বিচার, অনৈতিক বোমাবর্ষণ। সেই জন বলছে, কঠিন হবে র্যাঞ্চ হাউসে হামলা করা।
ওদের কাছে এফএলআইআর টেকনোলজি না থাকলে বড় ঘাসের কারণে যেতে পারব অনেক কাছে, বলল বাড।
ওই টেকনোলজি ব্যবহার করে আর্মি। খুঁজে বের করে কোথায় আছে অ্যাম্বুশ। ইনফ্রা-রেড ডিটেক্টর জানিয়ে দেয় ডিজিটাল থারমাল ইমেজ। ক্যামোফ্লেজ পরা সৈনিকও দেখা যাবে আয়নার মত, এমন কী খরগোশ বা ইঁদুরও রক্ষা পায় ওটার চোখ থেকে।
রানার মনে হয়নি এফএলআইআর টেকনোলজি হাতে পাবে ময়নিহান। অপরাধী সঙ্ঘের লোকদের সঙ্গে তার ওঠবস, জোগাড় করেছে এম সিক্সটিন অ্যাসল্ট রাইফেল, কিন্তু তার মানে এই নয় যে পেয়ে গেছে আর্মির গোপন সব ইকুইপমেন্ট।
দৃষ্টি সরিয়ে দিলে, চট করে বুঝবে না ঢুকেছিস তাদের এলাকায়, বলল রানা, আমি মনোযোগ আকর্ষণ করব। ন্যাশ ময়নিহান চায় প্রতিশোধ নিতে, কাজেই তার দলের চোখ থাকবে আমার ওপর। সেই সুযোগে র্যাঞ্চ হাউসের পেছনের দালানে পৌঁছে যাবি তোরা।
আমাদের জন্যেও তৈরি থাকবে, বলল জন, গত কালকের অ্যাম্বুশের কথা ভুলবে না। ঘাসের ভেতর ছিল দুজন স্নাইপার। গুলির অ্যাংগেল দেখে বুঝে গেছে।
জানবে না আমি একা, না তোরাও আছিস, বলল রানা, আমি হামলা করলে বাধ্য হয়ে আমার দিকেই বেশি সময় দেবে। হয়তো খেয়াল থাকবে না তোদের কথা।
আসলে কী করতে চাস তুই? জানতে চাইল জন। সংক্ষেপে ওর প্ল্যান জানাল রানা।
সব শুনে মাথা নাড়ল জন ও বাড।
পাগল নাকি? আপত্তি তুলল জন। যে-কেউ বলবে, খুন হবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিস তুই!
রানা ভাবছে ও রুস্টার কাবার্ন, বলল বাড। ঘোড়ার রাশ দাঁতে কামড়ে ছুটবে জন ওয়েইনের মত, দুই হাতে দুই সিক্সগান!
জন ওয়েইনের ভক্ত দুই বন্ধুর পাল্লায় পড়ে সিনেমাটা দেখেছে রানা। ডায়ালোগ পাল্টে নিয়ে মনে মনে বলল, ফিল ইয়োর হ্যাণ্ড, ময়নিহান; ইউ সান অভ আ বিচ!
.
৩৯.
মাসুদ রানার জন্যে কয়েকটা জায়গায় অপেক্ষা করতে পারত ন্যাশ ময়নিহান। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে মিডওয়েস্টের কয়েকটা বড় অফিসবাড়ি। অথবা থাকতে পারত ডালাসের অফিসে। জানালা দিয়ে দেখা যাবে রিইউনিয়ন টাওয়ার। সামান্য দূরে টেক্সাস স্কুল বুক ডিপোযিটরি। ওখান থেকেই জন এফ. কেনেডিকে গুলি করেছিল খুনি লি হার্ভে অসওঅল্ড। আগে স্টেডিয়াম থেকে আসত দর্শকের চিৎকার। পরে সব খেলা সরিয়ে নেয়া হয়েছে ডালাস স্টার আমেরিকান এয়ারলাইন্স সেন্টারে।
আরও কিছু জায়গায় থাকতে পারত ময়নিহান। কিন্তু সবচেয়ে নির্জন বলে র্যাঞ্চটাকেই বেছে নিয়েছে সে। গত চব্বিশ ঘণ্টায় দুবার গোলাগুলি হলেও এখানে আসেনি পুলিশের কেউ। তৃতীয়বারও সম্ভাবনা নেই আসার। ময়নিহান চাইছে না লড়াইয়ের সময় তৃতীয় আর কেউ এসে হাজির হোক।
আসবে রানা, ভাল করেই জানে অধীর ময়নিহান। কয়েক ঘণ্টা আগেই তৈরি হয়েছে তার কজন ভাড়াটে খুনি। ঠেকিয়ে রাখবে রানাকে। এদিকে বাড়ির দোতলায় রানার জন্যে থাকবে রিক বেণ্ডার। রানাকে খুন করার অনুমতি তাকে দিয়েছে স্বয়ং ময়নিহান, নইলে আগেই গুলি শুরু করত দানব। ওর বুকে জ্বলছে প্রতিশোধের আগুন। ময়নিহান চায়নি রানা খুন হওয়ার আগে নিভে যাক ওই অঙ্গার। তার চেয়েও বড় কথা, রানাকে নিজ হাতে খুন করার লোভে হ্যাঙ্ক পার্কার ও অন্যদেরকে মেরে ফেলতে পারে উন্মাদটা।
নিজের কাছে প্রশ্ন রেখেছে ময়নিহান: কেন রিককে বাঁচিয়ে রেখেছে সে? জানে, তাকে পছন্দ করে এটা ডাহা মিথ্যা। বাস্তব কথা হচ্ছে, অন্যদের মতই রিকও ওর হাতের সুতোয় ঝুলানো হিংস্র এক পুতুল। কিন্তু এখন নিখুঁত নয় এ পুতুল। ভ্রাতৃমৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে দলের ছয়জনকে খুন করেছে সে। রানাকে শেষ করার পথে ময়নিহান বাধা হয়ে উঠলে ওকেও খুন করবে দানব। অন্তত চেষ্টা করবে।
রিক বলেছে, রানা-হত্যার সব প্রশংসা দেবে ন্যাশ ময়নিহানকে। কিন্তু একফোঁটাও বিশ্বাস করে না সে দানবটাকে। লোকটা শপথ নিয়েছে: ছোটভাইয়ের খুনের বদলা নেবে নিজ হাতে। হাতজোড় করে মাফ চাইলেও রক্ষা নেই রানার। কিন্তু বেণ্ডারের হাতে রানা মরলে চলবে না ময়নিহানের।
হ্যাঁ, সঠিক সময়ে সে শেষ করে দেবে রিক বেণ্ডারকে।
তবে এখন নয়!
খুঁতওয়ালা পুতুলেরও দরকার আছে। ভোতা হাতুড়িও কাজে লাগে তক্তায় পেরেক গাঁথতে। রানা মরলে ওরই পথে যাবে রিক। তখন নরকে গিয়ে ট্যাড়া ভাইকে ফাঁক হয়ে যাওয়া গলা দেখিয়ে বিস্তারিতভাবে বলবে: ক্ষুরধারন্যাশ ময়নিহান সত্যিই দল-নেতা।
সড়াৎ করে ক্ষুর বের করল ময়নিহান। ডেস্ক থেকে নিল একটা কাগজ। ওটা দুআঙুলে টিপে ধরে ওপর থেকে নিচে নামাল ক্ষুরের ধারালো ফলা। কেটে দুটুকরো হয়ে টেবিলে পড়ল কাগজ।
ইস্পাতের পাতে দেখল নিজ চোখ। আনমনে জিজ্ঞেস করল, কতটা ভাল লাগবে রানার গলা নামিয়ে দিতে? …অনেক! অনেক!
.
শুয়ে থাকা দিগন্ত ছেড়ে আকাশে উঠছে সোনালি সূর্য। উইণ্ডস্টার গাড়ি নিয়ে ময়নিহান র্যাঞ্চের গেট পেরিয়ে গেল রানা.। এই গাড়ি গত চব্বিশ ঘণ্টায় বেশ কবার কাজে এলেও এবার বিদায় দিতে হবে এটাকে। জন যে কোম্পানি থেকে ভাড়া নিয়েছে, প্রাণে বাঁচলে পরে সেখানে ক্ষতিপূরণ পাঠিয়ে দেবে রানা।
দেখল ফিউয়েল মিটার। ফুরিয়ে এসেছে তেল। হয়তো উচিত ছিল ট্যাঙ্কে খানিকটা বাড়তি অকটেন রাখা। ওখান থেকে বের করে দুটো ক্যানে তেল ভরে পেছনের সিটে রেখেছে রানা। এখন ভয়ই লাগছে, গন্তব্যে পৌঁছুবার আগেই না বন্ধ হয় ইঞ্জিন! অবশ্য, ভুল হওয়ার কথা নয়। সামনে মাত্র একমাইল দূরেই র্যাঞ্চ হাউস।
অ্যাক্সেলারেটর প্যাডেলে চাপ দিল রানা। দ্রুতগতি এখন ওর বন্ধু। হামলা করবে ময়নিহান র্যাঞ্চে। লড়াই না জিতে ফেরার পথ নেই।
রানার মনে দুশ্চিন্তা এসেছিল, র্যাঞ্চে হয়তো রয়ে গেছে নিরীহ কেউ। পরে বুঝেছে, ময়নিহানের পশুর দল ছাড়া কোনও মানুষ থাকবে না ওখানে। ভাল করেই জানে, আবারও হামলা করবে রানা। কাজেই ওর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে এমন কাউকে আশপাশে রাখবে না সে। এ কথা ভেবেই নিজের প্ল্যান গুছিয়ে নিয়েছে রানা। ভাবছে, ও কামিকাযি পাইলটের মত। তবে ওর থাকবে ইজেক্টর সিট।
সগর্জনে ঝড়ের বেগে চলেছে উইণ্ডস্টার। আরও বাড়ছে গতি। যেখান থেকে জুডি ও নিনাকে সরিয়ে নিয়েছিল রানা, সে জায়গাটা পিছিয়ে গেল বিদ্যুদ্বেগে। জমির একটা ভাঁজ পেরোল গাড়ি। প্রথমবারের মত দেখা গেল দূরে বিশাল র্যাঞ্চ হাউস। আধুনিক নয়। ন্যাশ ময়নিহান নিজেও হয়তো এ যুগের জন্যে উপযুক্ত নয়। উচিত ছিল কয়েক শ বছর আগে জন্ম নেয়া। হয়তো হতো জলদস্যুদের নামকরা খুনে নেতা। কয়েক সেকেণ্ড পর প্রথম আধুনিকতা চোখে পড়ল রানার। রাস্তার পাশের নালা থেকে উঠল এক লোক। মুখে তুলল রেডিয়ো। তার উল্টোদিকের মাঠের কিনারায় আরেক লোক। সরাসরি রানার গাড়ির দিকে এম সিক্সটিন অ্যাসল্ট রাইফেল তাক করল সে। চোখে চশমা। আগে কখনও তাকে দেখেনি রানা। তবে জুডির কাছে শুনেছে, তার নাম রডনি জ্যাকসন। একে অজ্ঞান করে পালাতে চেয়েছিল জুডি। সবার মধ্যে সে নাকি কিছুটা বিবেকবান।
ভুল ভেবেছ, জুডি, এ রাইফেল তাক করছে অচেনা মানুষকে খুন করতে, মনে মনে বলল রানা। আরও বাড়াল ইঞ্জিনের গতি। পরমুহূর্তে এক পশলা গুলি লাগল গাড়ির সামনের দিকে। ছিঁড়েখুঁড়ে গেল ধাতব দেহ। নানাদিকে লাফ দিল কমলা স্ফুলিঙ্গ। কান ফাটানো আওয়াজ তুলছে রাইফেল। সিটে প্রায় শুয়ে পড়েছে রানা। বামহাতে হ্যাণ্ডেল টান দিয়ে খুলল দরজা। ওর জ্যাকেটে জোর টান দিল বুলেট, নাকের ডগা দিয়ে তাপের হলকা ছুটে চলে গেল।
দরজা খুলে বাইরে ঝাঁপ দিল রানা। কয়েক গড়ান দিয়ে উঠেই ওয়ালথারের গুলি পাঠাল রেডিয়োওয়ালার দিকে। ওর প্রথম গুলিতে ফুটো হয়েছে লোকটার গলা। পিছিয়ে গেল সে, হাত থেকে পড়ে গেছে রেডিয়ো। চিত হয়ে পড়ল মাঠের ভেতর।
চশমাওয়ালা গুলি শুরুর পর পেরিয়ে গেছে পাঁচ সেকেণ্ড। লাফিয়ে দূরে পড়েছে রানা, দেখেনি লোকটা। মনোযোগ গাড়ির ওপর। খালি করছে ম্যাগাযিন। বুলেটের আঘাতে ফুটো হচ্ছে উইণ্ডস্টারের পাতলা খোলস।
তাকে আরও গুলি করতে দিল রানা। ওর কাজেই সহায়তা করছে সে।
দুসেকেণ্ড পর চশমাওয়ালার গুলি বিঁধল ঠিক জায়গায়। বিস্ফোরিত হলো গাড়ির পেছন সিটে রাখা ক্যানিস্টার। উইণ্ডস্টারের পেট থেকে ছিটকে উঠল আগুনের নীল ফুটবল। মাঠের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল ভাঙা ধাতব খণ্ড। দাউদাউ করে জ্বলে উঠল শুকনো ঘাস। অকটেন নিভে যেতেই ভকভক করে বেরোল কালো ধোয়া। ইঞ্জিন বন্ধ হলেও জ্বলন্ত চাকায় ভর করে সোজা র্যাঞ্চ হাউস লক্ষ্য করে ছুটছে গাড়ি।
রডনি জ্যাকসনের দিকে পিস্তল তাক করল রানা। আগুনভরা গাড়ি দেখছে লোকটা। বুঝতে পারেনি কী ভুল করে বসেছে। বিজয়ের ছাপ পড়ল মুখে, কিন্তু দুসেকেণ্ড পর চোখে ফুটল অবিশ্বাস। নীল শিখা নিয়ে কাঠের বাড়ির দিকে চলেছে গাড়ি।
হায়, ঈশ্বর!
এবার বুঝেছ, বিড়বিড় করল রানা। পরক্ষণে টিপল ট্রিগার। জ্যাকসনের হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে পিঠ ফুটো করে বেরিয়ে গেল গুলি।
কালো, কটুগন্ধী ধোঁয়ার পেছনে ছুটল রানা। চলেছে বাড়ি লক্ষ্য করে। রাস্তার গর্তে এখানে-ওখানে জ্বলছে অকটেন। আঁধার হয়েছে চারপাশ। স্বস্তি বোধ করছে রানা। কাউকে দেখছে না, বাড়ি থেকেও ওকে দেখবে না কেউ।
ফুটো হওয়া জ্বলন্ত চাকায় ভর করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছে গাড়ি, কমে গেছে গতি। লিটল ফোর্কের রেস্টুরেন্টের মত বাড়ি ভেঙে ঢুকবে না এই গাড়ি। তবুও ধপাক আওয়াজে লাগল বাড়ির বামদিকে। রানার মনে হলো, মুহূর্তের জন্যে দুলে উঠেছে বিশাল ম্যানসন। পরক্ষণে কালো ধোঁয়ায় আড়াল হলো সব। রানা দৌড়ে চলেছে তীরের বেগে। কসেকেণ্ড পর দেখল, শুকনো কাঠের বাড়ির গা চাটছে ধোঁয়া ও লকলকে কমলা আগুন। কাজে লেগেছে ওর চলন্ত আগুনে বোমা।
ছুটতে ছুটতে চোখের কোণে নড়াচড়া দেখল রানা। ঘাসের মাঝ দিয়ে ছুটে আসছে এক লোক। কাঁধে তুলল রাইফেল। গুলিও করল, কিন্তু লক্ষ্যভেদের সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। রানার মাথার ওপর দিয়ে গেল বুলেট। এক সেকেণ্ড পর বাড়কে দেখল রানা। লোকটার পাজরে ঢুকল ওর কমাণ্ডো নাইফ। নিচ দিয়ে ঢুকে ডগা পৌঁছে গেল হৃৎপিণ্ডে। মুহূর্তে খুন হয়েছে লোকটা। লাশটা মাঠে পড়ার আগেই হাত থেকে রাইফেল কেড়ে নিল বাড। নিচু হয়ে দৌড়ে আবারও উধাও হলো কোথায় যেন।
মারা গেছে শত্রুপক্ষের তিনজন। আর কজন আছে, জানা নেই। দৌড়ে চলেছে রানা। এখনও বড় কোনও বিপদ হয়নি। জ্বলন্ত উইণ্ডস্টার গাড়িটা পাশ কাটিয়ে উদ্যত ওয়ালথার হাতে সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠল রানা।
ওপরতলায় পদশব্দ। লাথি মেরে দরজা খুলেই ভেতরে ঢুকল বিসিআই এজেন্ট। ঝট করে সরে গেল কবাটের একপাশে। কাভার করেছে কিচেন। মাথার ওপরে মেঝেতে দৌড়ে যাচ্ছে কে যেন। কী যেন বলল চিৎকার করে। দূরে গুলির আওয়াজ। বাড়ির পাশে শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে লড়ছে জন বা বাড।
রানার বামে কাঠের দেয়াল চাটছে কমলা আগুন। একটু পর আগুনে পুড়বে বাড়ির এদিকটা। লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়বে পুরো বাড়িতে। তার আগেই পালিয়ে যেতে পারে ন্যাশ ময়নিহান। তার খোঁজে চলল রানা। ওদিকের দরজা পেরোবার আগে দেখল প্যাসেজওয়ে।
কেউ নেই।
টার্গেট খুঁজছে রানা।
মাথার ওপর ছুটন্ত পদশব্দ। বাড়িতে আগুন ধরতেই সিঁড়ি লক্ষ্য করে ছুটছে কেউ। প্যাসেজওয়ের একপাশে সরু সিঁড়ি গেছে দোতলায়। উঠতে হবে ওপরে, কিন্তু সিঁড়ির আগে দুপাশে ঘরের দরজা। কবাটের ওদিকে থাকতে পারে কেউ। বাইরে জন ও বাডের তুমুল গুলি। কড়কড়-পড়পড় আওয়াজে পুড়ছে কাঠ। বাইরে উইণ্ডস্টারে হলো ভোতা বিস্ফোরণ। বোধহয় ওটা দ্বিতীয় ক্যানিস্টার। আশপাশে নেই ময়নিহান বা রিক বেণ্ডার। মুহূর্তের জন্য রানার মনে হলো, বিপদ বুঝে পালিয়ে গেছে লোকদুটো। পরক্ষণে বুঝল: তা হওয়ার নয়। তারা অপেক্ষা করবে ওকে খুন করতে।
ডানের দরজা খুলে সবকিছুর ওপর দিয়ে পিস্তলের নল ঘুরিয়ে আনল রানা।
কেউ নেই।
আছে শুধু কটা ওয়াশিং মেশিন।
বামের দরজা খুলল রানা।
খালি।
আবার মনোযোগ দিল সিঁড়ির নিচের দিকে। ওপরে কে যেন দৌড়ে যাচ্ছে বাড়ির পেছন লক্ষ্য করে। ধাওয়া করতে হবে। তবে আগে নিশ্চিত হতে হবে কেউ নেই পেছনে।
ওয়ালথার তাক করে পরের দরজা খুলল রানা। কিন্তু তখনই ওর পিস্তল ধরা কবজিতে প্রচণ্ড জোরে ঠাস্ করে নামল কী যেন! ব্যথায় বিকৃত হয়ে গেল ওর মুখ। প্রায় অবশ হয়েছে হাত। প্রাণপণে ধরে রাখল ওয়ালথার। ঝন্টু করে ওপরে তুলল বামহাত। মুখ লক্ষ্য করে ঘুষি আসতেই কনুই তুলে ঠেকিয়ে দিল হাতটা। তখনই বুকে লাগল হাঁটুর প্রচণ্ড গুতো। হুড়মুড় করে পড়তে গিয়েও টলমল করে বেরোল প্যাসেজওয়েতে। প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে পিঠ ঠেকল দেয়ালে। পরক্ষণে বামহাতে ওয়ালথার নিল ও। গুলি করল লোকটাকে লক্ষ্য করে। ছুটে আসতে গিয়েও ঝটকা খেয়ে থামল সে। পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে ঘোড়ার মত পিছন পায়ের লাথি দিয়েছে .৩৮ গুলি। রানা আবছাভাবে দেখল, লোকটার পরনে কেভলার ভেস্ট। আবারও সামনে বাড়ল আততায়ী, এবার তারও হাতে উঠে এসেছে পিস্তল।
ঝট করে আরেকদিকে সরল রানা। মাথার পাশে কাঠের দেয়ালে গর্ত তৈরি করল বুলেট। বুকে পিস্তল তাক করলে এতক্ষণে লাশ হতো ও। নিজে ভুল করতে চাইল না রানা, ওয়ালথার তুলেই গুলি করল লোকটার কপাল লক্ষ্য করে। ছিটকে ওদিকের দেয়ালে বাড়ি খেয়ে ওখান থেকে মেঝেতে পড়ল লাশ। বয়স হবে অন্তত পঞ্চাশ। রানার মনে পড়ল, জুডিকে সরিয়ে নেয়ার সময় এর গুলিতেই আহত হয়েছিল ও।
আগুনে কড়মড় আওয়াজে ফাটছে দেয়াল ও মেঝে। প্যাসেজ ভরে উঠছে ধোঁয়ায়। ক্রমেই বাড়ছে তাপ।
সিঁড়ির দিকে তাকাল রানা। উঠতে হবে ওপরে। হাতে সময় নেই। সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতেই ওপরতলা থেকে এল চিৎকার: পার্কার! পার্কার? শেষ করতে পেরেছ?
না, পারেনি, মনে মনে বলল রানা। ওপরের লোকটার গলা ময়নিহান বা রিক বেণ্ডারের নয়।
বাড়ির পেছন থেকে এল গুলির আওয়াজ।
জন ও বাড দুজনই দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। পাগল করে দিয়েছে ময়নিহানের ভাড়াটে খুনিদেরকে। বন্ধুদের সঙ্গে যোগ দেবে রানা, তবে আগে রয়ে গেছে একটা কাজ। ময়নিহানের এক লোকের আছে যৌন বিকৃতি, চরম অপমান করেছে জুডিকে। লোগান টার্সন নামের ওই লোককে শেষ করবে রানা। মুখে হাত চেপে আমেরিকান সুরে বলল, কে? টান?
হ্যাঁ, জবাব দিল সে। কুত্তার বাচ্চা শেষ?
হ্যাঁ, খতম, নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে রানা।
.
৪০.
প্রতিশোধের উপযুক্ত সময় এসেছে রিক বেণ্ডারের। পাত্তা না দিলেও চলে ন্যাশ ময়নিহানকে। র্যাঞ্চ হাউসে পৌঁছে গেছে মাসুদ রানা। এবার মরবে এতে ভুল নেই। কিন্তু কল্পনায় যে লড়াই চেয়েছে রিক, হয়তো তেমনটা হবে না। মুখোমুখি লড়বে না বাদামি লোকটা। জ্বলন্ত বাড়ির মধ্যে কীভাবে মরবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
ধোঁয়ায় শ্বাস আটকে? শুয়োরের মত পুড়ে রোস্ট হয়ে? নাকি খুন হবে বদমাসটা কারও গুলিতে?
সেক্ষেত্রে সারাজীবনেও আফসোস যাবে না রিকের।
দেরি না করে খুঁজে বের করতে হবে মাসুদ রানাকে। এতে বাধা দিলে গুলি করে ময়নিহানের মাথা উড়িয়ে দেবে রিক। কিন্তু নিজে যে সে গুলি করে রানাকে মারতে পারবে, তার নিশ্চয়তা নেই। অথচ, মগজে সর্বক্ষণ গর্জন ছাড়ছে নিক। বলে চলেছে: বড়ভাই হয়েও মিথ্যা বলেছ! তোমার না কথা ছিল মাথা ছিঁড়ে নেবে মাসুদ রানার!
যখন জীবিত ছিল, বেশি কথা বলত নিক। এখনও তাই করছে রিকের মগজের ভেতর। সর্বক্ষণ বিরক্ত করত বলে কতুবার তাকে খুন করতে চেয়েছে রিক! তবুও এখন কেন জানি, নিক মরে গেছে বলেই হয়তো, খুব কষ্ট লাগে বুকে।
হ্যাঁ, ছোটভাইকে খুশি করতে সবই করবে রিক। বিড়বিড় করল, চুপ, নিক! বলেছি না নিজ হাতে খুন করব? আগে বেরোতে দাও এখান থেকে!
শোঁ-শোঁ গর্জন ছাড়ছে আগুনের হলকা।
মড়াৎ করে ভেঙে পড়ল বেডরুমের পেছন-দেয়াল।
মৃত ভাইয়ের কথা শুনতে পেয়ে অস্বস্তি বোধ করছে রিক। ও যা বলছে, মোটেও শুনছে না নিক। জোরে উচ্চারণ করেও লাভ হচ্ছে না। কিন্তু দেয়াল ধসে পড়ায় থেমেছে নিকের অনুযোগ। এবার এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে খাপ পেতে অপেক্ষা করবে রিক রানার জন্যে।
দোতলার বেডরুমে আছে সে। জেগে ছিল দুদিনের বেশি। তাই ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছিল শরীর। তাই একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছিল।
এখন বাজে কয়টা?
হয়তো ঘুমিয়েছে বড়জোর পাঁচ মিনিট।
আবার হতে পারে কয়েক ঘণ্টা।
একটা গাড়ি এসে গুঁতো দেয়ায় আগুন জ্বলে উঠেছে বাড়িতে। তখনই আচমকা জেগে উঠেছে রিক। ঘরে ঢুকেছে কয়েকটা গুলি। বাইরে থেকে গুলি করে সবাইকে বাড়ির আরেকদিকে পাঠাতে চাইছে কেউ। গুলির ভয়ে নয়, জীবন্ত পুড়ে মরার ভয়ে সরে যেতে হবে ওকে এখান থেকে।
গুলির শব্দ নিচতলায়। বাইরেও গোলাগুলি। বিছানা থেকে নেমে বেডরুমের দরজা খুলে খালি প্যাসেজে উঁকি দিল রিক। হাত কোমরের হোলস্টারে। ডের্ট ঈগল পিস্তল বের করে প্যাসেজে বেরিয়ে এল সে। সামনের এক ঘর থেকে ছিটকে বেরোল এক লোক। তাকে চিনল রিক। ওই শালার নাম লোগান টার্সন। তাকে বাঁচতে দেয়া যাবে না। আগে হোক বা পরে, রানা বা রিকের হাতে মরবে সে। আগেই পথের কাঁটা নিকেশ করা ভাল ভাবলেও পিস্তল তুলল না রিক। লোগান টার্সন যোগ্য লোক না হলেও কাজে আসবে।
লোগান? ডাকল রিক। চরকির মত ঘুরে পিস্তল তাক করল লোকটা। এক সেকেণ্ড পর বুঝল রিক বেণ্ডার তাদেরই লোক। অস্ত্র নামিয়ে ফেলল সে। ময়নিহান কোথায়?
বাড়ির পেছনে। চোখ বিস্ফারিত করে রিককে দেখছে লোগান। ক্রিমির পেটের মত ফ্যাকাসে হয়েছে মুখ। রিক খেয়াল করল, একটু কাঁপছে তার পিস্তল ধরা হাত।
রানা তো সামনে। পেছনে কী করছে ময়নিহান?
অন্যরা যা করছে! আগুনে পুড়ে মরার আগেই বেরোতে চাইছে বাড়ি ছেড়ে!
ক’পা সামনে বেড়ে লোগানের কলার চেপে ধরল রিক। কাজের জন্যে পয়সা দিচ্ছে তোমাকে, পালিয়ে যাওয়ার জন্যে নয়!
তা ঠিক, কিন্তু পয়সার লোভে উন্মাদটার হাতে জান দেব? পুরো বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে শালা!
নিজের কাজ করো, ধমকের সুরে বলল রিক। নইলে রানার হাতে নয়, খুন হবে ময়নিহান বা আমার হাতে। লোগানের ঘাড় ধরে সিঁড়ির দিকে ঠেলে নিয়ে চলল সে। সিঁড়ি পাহারা দেবে।
নিচের ল্যাণ্ডিঙে হ্যাঙ্ক পার্কার আছে।
ওকে খতম করবে রানা, বলল রিক। দ্বিধা নেই কণ্ঠে।
ভাবছ তাকে খুন করতে পারব আমি? আপত্তির সুরে বলল টার্সন।
না, চাইছি তুই মর, শালা, ভাবল রিক। রানাকে দেরি করিয়ে দিবি, আর সে সুযোগে বাড়ি থেকে বেরোব আমি। যে ঘর থেকে এসেছে, ওই দরজা দিয়ে আসছে এখন ঘন কালো ধোঁয়া। কঠোর চোখে লোগানকে দেখল রিক। অন্তত ঠেকাতে চেষ্টা করো, কাপুরুষ!
তুমি কী করবে?
বুকে আঙুল ঠুকল রিক। আমি? অন্য সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাব। খুন করব হারামজাদাটাকে।
সিঁড়ির মুখে লোগানকে রেখে করিডোর ধরে ঝেড়ে দৌড় দিল রিক। দূরে এক ঘরের দরজার ওদিকে বারান্দা। ওটা ধরে পুরো বাড়ি ঘুরে আসতে পারবে। ছুটতে ছুটতে শুনল লোগান টার্সনের প্রশ্ন: পার্কার! পার্কার? শেষ করতে পেরেছ?
থমকে দাঁড়াল রিক। পার্কার রানাকে খুন করতে পারলে নিজের হাড়ের মত শক্ত বুট চিবিয়ে খেতেও আপত্তি তুলবে না ও! নিচতলা থেকে জবাব দিয়েছে কেউ। কিন্তু আগুনের গর্জনে রিক বুঝল না কে সে। ওপরের প্যাসেজ ভরে উঠছে কুচকুচে কালো ধোঁয়ায়। ওদিকে লোগান। কাশছে খুকখুক করে।
আগের প্ল্যান অনুযায়ী শেষ ঘরের দিকে চলল রিক। হাঁক ছাড়ল, ময়নিহান! থামল ওই ঘরের কাছে পৌঁছে। দরজা সামান্য খোলা। অনুচিত হবে অনুমতি না নিয়ে ঘরে ঢোকা। চমকে গিয়ে গুলি করতে পারে ময়নিহান।
বস, আমি, রিক বেণ্ডার। ধীরে ধীরে কবাট ঠেলে সরাল রিক। গুলি এল না। ঘরে কেউ নেই। সাবধানে কবাটের পেছনদিক দেখল। বস্ শালা ওর ক্ষুর নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লে খুন হবে।
না, সে নেই কবাটের আড়ালে।
বারান্দায় যাওয়ার দরজা খোলা।
ঘর পেরিয়ে বাইরে উঁকি দিল রিক। বাড়ির পেছনে যাওয়ার জন্যে ছুটছে এক লোক, পরনে মিলিটারি ফ্যাটিগ। ওই একই জিনিস সবাইকে দিয়েছে ময়নিহান। তবে এর বেসবল ক্যাপের নিচে ধূসর খাটো চুল। ওই যে ময়নিহান!
বারান্দায় বেরিয়ে পিছু নিল রিক। কিন্তু তখনই পাশের বাড়ি থেকে শটগান তাক করল এক লোক। চুল কালো। ঠোঁটে হাসি। গুলি করার আগেই একলাফে সরে গেল রিক। পাশের দেয়ালে বাস্কেট বলের সমান একটা গর্ত তৈরি করল বাকশট।
পাল্টা গুলি পাঠাল রিক। হাঁতে কামানের মত লাফিয়ে উঠেছে ডেযার্ট ঈগল। কিন্তু আগেই সরে গেছে হারামি লোকটা।
বন্দুকওয়ালাটা আবার কে! জন হার্বার্ট সম্বন্ধে মারি কিটনের কাছে যা বলেছে ময়নিহান, তার কিছুই জানে না রিক।
বাড়ির পেছনে ঠা-ঠা শব্দে গর্জে উঠল এম সিক্সটিন। খুবলে গেল বারান্দার রেলিং। পরক্ষণে গুলির তাড়া খেয়ে আবারও বাঁক ঘুরে ছুটে এল ময়নিহান। দুহাতে ঢেকেছে মাথা। যেন এভাবে বাঁচাতে পারবে ওটাকে। পেছনের দেয়ালে বিঁধল একরাশ গুলি। নানাদিকে ছিটকে গেল কাঠের কুচি। দৌড়ে সরতে গিয়ে পিছলে মেঝেতে ধুপ করে পড়ল ময়নিহান। তার দিকে ছুটল রিক। একবার দেখে নিল কাঁধের ওপর দিয়ে। শটগানওয়ালা এলে মহাবিপদ। কাছে পৌঁছে বসের হাত ধরে টেনে তুলল সে।
আমরা যেমন প্ল্যান করেছি, ঠিক তেমনটা হচ্ছে না, কী বলেন, বস্?
বাড়ির দেয়ালে হেলান দিল ময়নিহান। বিস্ফারিত দুই চোখ। এই প্রথম তাকে দুশ্চিন্তায় পড়তে দেখছে রিক। সব সময়ের হাসিটা উধাও হয়েছে শালা বসের।
বাড়ির পেছনে কুচকুচে এক বদমাস, হাতে সাবমেশিন গান, বলল ময়নিহান, আরেকটু হলেই আমাকে দুটুকরো করে ফেলত।
বুড়ো আঙুল দিয়ে কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে দেখাল রিক। ওদিকে জাপানি একজন। সে-ও সুবিধার লোক না। বলুন তো, বস্, এখানে হচ্ছেটা কী?
ভুরু কুঁচকে ফেলল ময়নিহান। রানার কারণে শুরুতেই খতম হয়েছে তিন গানম্যান। একজনকে ভুল করে মেরে ফেলেছে আমাদেরই কেউ। অন্যজন মরেছে কেলে ব্যাটার হাতে। তা হলে আমরা বাকি থাকলাম কজন, রিক?
সিণ্ডিকেটের লোক বলতে লোগান টার্সন, বলল রিক। বুঝে গেছে, ওই লোকও বেশিক্ষণ নেই। ও বলল সিঁড়ির ল্যাণ্ডিঙে আছে পার্কার।
তা হলে আমরা চারজন, আর ওরা তিনজন। এখনও আমাদের জেতার সম্ভাবনাই বেশি।
আঙুলের কড়া গুনে বলল রিক, মারি কিটন কই?
অন্য কাজে পাঠিয়েছি, ময়নিহানের কন্ঠে আফসোস। মাথা থেকে বেসবল ক্যাপ খুলে ছুঁড়ে ফেলল মেঝেতে। বড় ধরনের ভুল হয়ে গেছে।
চোখ পিটপিট করল রিক। মারি গেছে কোথায়?
ওই দুই মেয়েকে শেষ করতে টাম্পা শহরে, বলল ময়নিহান। ঝট করে কুঁজো হয়ে বসে পড়ল। নিজেও একই কাজ করেছে রিক। বন্দুকের ছররা গুলিতে ঝাঁঝরা হলো মাথার একটু ওপরের দেয়াল।
মর, কুত্তার বাচ্চা! গলা ফাটাল রিক।
আটকা পড়েছি, বলল ময়নিহান, বেরোতে হবে এই ফাঁদ থেকে।
আমি খুন করব মাসুদ রানাকে, জেদ ভরা কণ্ঠে বলল রিক।
অন্যদের কী হবে?
ওরাও বাঁচবে না। মাথা সামান্য ওপরে তুলেও নামিয়ে নিল রিক। এইমাত্র দেয়ালে লাগল আরেক পশলা এম সিক্সটিনের গুলি। অতবড় শরীরটা নিয়ে মেঝেতে মিশে যেতে চাইল সে। কিন্তু ঠিকই বলেছেন, আগে বেরোতে হবে এই গাড়া থেকে।
পাশের বাড়িটার সঙ্গে এই বাড়ির ব্যবধান দেখল রিক। কাছের রুম থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে বেরোচ্ছে ঘন ধোঁয়া।
বেরোবার পথ তো দেখি না, বলল রিক। লড়াই করে বেরোতে হবে, নইলে মরব পুড়ে।
ওদের গুলিতে মরতে চাই না, বলল ময়নিহান।
এ ব্যাপারে আমিও একমত, বস, বলল রিক। ওদের চেয়ে ভাল যোদ্ধা আমরা।
ঠোঁট বাঁকা করে নকল হাসি হাসল ময়নিহান। টেনে নিল পিস্তলের স্লাইড। অস্ত্রটা চোয়ালের পাশে ধরল, যেন জেম্স্ বণ্ড মুভির নায়ক। রওনা হও, রিক। কাভার দেব।
ময়নিহানের দিকে তাকাল রিক। মনে পড়ল, এই হাঁদা শালার পা চেটেই পেট চালাত সে। এই শালাই লবস্টার থেকে মাংস খুঁটে খেত আর অপমান করত ওর লক্ষ্মী ছোটভাই নিককে। শীতের মধ্যে রাস্তায় থাকত বেচারা। হঠাৎ করেই রিক বুঝল, ময়নিহান, আসলে কী। বদ্ধউন্মাদ সাইকোপ্যাথ! কুত্তাটার ধারণা সে দুনিয়ার রাজা!
ময়নিহানের কথা ভুলে উঠে দাঁড়াল রিক। ভাবছে, শত্রু বলতে ওই তিনজন। গুলি করেও ওকে থামাতে পারবে না। লড়তে পারবে ময়নিহান আর সে। তবে বাড়িতে ঢুকে পড়েছে মাসুদ রানা। ময়নিহানের দিকে তাকাল রিক। ঠিক আছে, বস, ওই দুজনকে খতম করতে যাচ্ছি।
রেলিং টপকে কার্নিশে নেমে পাশের বাড়ি লক্ষ্য করে লাফ দিল রিক। উড়ে চলেছে দানব শূন্যে। বিশ ফুট নিচে শক্ত জমিন।
<