২১.
বিসিআই এজেন্ট জাবেদ আলী জোগাড় করেছে লক্কড়-ঝক্কড়, পুরনো এক বোট। তবে ইঞ্জিন একদম নতুন। মানুষ পাচারে ওই বোট ব্যবহার করে গ্রিক ক্যাপ্টেন।
রাতের ঘুটঘুটে আঁধারে বোটে চেপে ভোরের আগেই সাইপ্রাসে পৌঁছে গেল রানা, লাবনী ও বেলা।
পরদিন সকালে পরিচিত এক সারেঙকে ঘুষ দিয়ে দুপুরে ফেরিতে উঠল রানারা। রাত আটটায় পোর্ট সাইদের বাইরে থামল ফেরি। নামিয়ে দেয়া হলো ওদেরকে।
আগেই ভাড়া করে রাখা জেলে-নৌকা তীরে পৌঁছে দিল ওদেরকে। লাবনী ও বেলাকে ছোট এক রেস্টুরেন্টে বসিয়ে উধাও হলো রানা। আধঘণ্টা পর ফিরল রেলগাড়ির টিকেট নিয়ে।
রেলস্টেশন থেকে মেইল ট্রেন ছাড়ল রাত দশটায়। কিন্তু ওটার গতিবেগ ঘণ্টায় পঁয়ত্রিশ মাইল। অবশ্য চারটের পর থেকে বাড়ল গতি।
এরই ভেতর কায়রোয় বাংলাদেশ দূতাবাসের সেকেণ্ড অফিসার মিতালি গাঙ্গুলির সঙ্গে কয়েকবার কথা হয়েছে রানার। জানা গেছে, গত দুদিন সীমান্তের কাছে ও কিংস ভ্যালির আকাশে ছিল কয়েকটি ড্রোন। সেগুলোর মালিক কাদির ওসাইরিসের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি। রানাকে পরামর্শ দিয়েছে মিতালি, উচিত হবে না কোনও গ্রামের মাঝ দিয়ে যাওয়া। হয়তো ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে ওদের ছবি। তথ্য দিলে পাবে মোটা অঙ্কের পুরস্কার।
এদিকে বিসিআই এজেন্ট জাবেদ আলীর সঙ্গে ফোন আলাপে রানা জেনেছে, মোনাকো থেকে কোথায় যেন ডুব দিয়েছে কাদির ওসাইরিস, নাদির মাকালানি এবং কিলিয়ান ভগলার।
আজ ভোরের পর দক্ষিণে সোহাগ শহরের কাছে আরও গতি কমাল ট্রেন। শামুকের মত চলছে বুঝে নেমে পড়ল রানারা।
মোনাকো ত্যাগের পর পেরিয়ে গেছে দুটো দিন।
প্রাচীন এক ল্যাণ্ড রোভার জিপগাড়ি পেয়ে সেটাই খুশি মনে ভাড়া করেছে রানা। তারপর থেকে মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে এগিয়ে চলেছে মরুময় প্রান্তরে।
কারও কারও ধারণা কায়রোর তাপমাত্রা মাত্রাতিরিক্ত, কিন্তু তাঁরা কাঁদতেন তিন শ মাইল দক্ষিণের অ্যাবাইদোসে এলে। পাশেই সাহারা মরুভূমি। ভোরের পর কিছুক্ষণ বাইরে রয়ে গেলে মনে হবে ফুটন্ত তেল ঢালা হচ্ছে গায়ে। এক শ ডিগ্রি ফারেনহাইটেরও বেশি তাপ। কখনও ঝিরঝিরে হাওয়া এলে মনে হচ্ছে ওটা আসছে স্রেফ স্বর্গ থেকে। উড়ন্ত বালি লেগে চটচট করছে ঘর্মাক্ত শরীর। ভোরের পর এরই মাঝে দুই বোতল পানি শেষ করেছে লাবনী।
কাঠফাটা রোদে বরাবরের মতই নির্লিপ্ত রানা। তবে গা থেকে খুলেছে জ্যাকেট। মাথায় পাতলা ক্যাপ। কিছুক্ষণ পর বলল, গরম আরও বাড়তে পারে।
এরচেয়ে বড় নরক কোত্থাও নেই, মন্তব্য করল বেলা, প্রাচীন দালান সবসময় এমন বাজে জায়গায় থাকে কেন?
একটু পর ছোট এক গ্রাম পেছনে ফেলে অ্যাবাইদোসে ঢুকল ওরা। বিস্তৃত জায়গায় পাথরের বড় মন্দির ও রাজকীয় দালানের ধ্বংসস্তূপ। কিছুক্ষণ পর থামল জিপ ওসেইরেন-এর সামনে। আগে থেকে না জানলে কেউ বুঝবে না এটা কোনও সমাধিস্থল।
টুরিস্ট বলতে দুচারজন। খাঁ-খাঁ করছে চারপাশ।
টুরিস্টদের জন্যে নোটিসে লেখা: দয়া করে কিছু ভাঙবেন না।
দূরে কয়েকজন পুলিশ। কারও প্রতি আগ্রহ নেই তাদের।
আমরা কী খুঁজব, বলো তো? বেলাকে বলল লাবনী। তুমি হচ্ছ আমাদের এক্সপার্ট!
নিজেকে এক্সপার্ট বলব না, খুশি হয়ে হাসল বেলা।
এবার কী?
পেছনের প্রায় আস্ত এক দালান দেখাল বেলা। ওটা টেম্পল অভ সেটি। বা স্যাথোেস। বাবার জন্যে তৈরি করেন র্যামেসেস দ্বিতীয়। খ্রিস্টপূর্ব তেরো শ সাল আগে তৈরি। অবিশ্বাস্য আর্কিটেকচার। মিশরের অন্য কোনও মন্দির এমন নয়। ঢোকার পর সামনে একের পর এক হল পাবেন না। এটা একেবারে অন্য কিছু।
কোন দিক দিয়ে? জানতে চাইল লাবনী।
ওসেইরেনের দিকে তাকাল বেলা। ধরুন, একই সময়ে তৈরি হয়েছে ওসেইরেন আর টেম্পল অভ সেটি। সব বইয়ে তা-ই লিখেছে। কিন্তু তা হয় কীভাবে? আপনি তো আর আপনার মন্দিরের অর্ধেক কাজ শেষ করে আধখাপচা রেখে আরেকটা তৈরি করবেন না! তা-ও আবার একই সময়ে একই জায়গায়! এমন তো আর নয় যে জায়গার অভাব ছিল। একটু দূরেই তৈরি করতে পারত টেম্পল অভ সেটি। দিগন্ত পর্যন্ত মরুভূমি দেখিয়ে দিল বেলা। জমির অভাব নেই।
তোমার থিয়োরি কী? জানতে চাইল রানা।
অনেকের মত আমারও মনে হয়, যিশুর জন্মের তেরো শ বছর আগে তৈরি হয়নি ওসেইরেন। আরও পুরনো। ডুবে গিয়েছিল বালির নিচে। পরে র্যামেসেস যখন দেখলেন ওটা, অর্ধেক মন্দির তৈরি করেই থেমে গেলেন। চাইলেন না ওসেইরেন ভেঙে ফেলতে। তখন ওসেইরেনের বাঁক ঘুরে তৈরি করা হলো টেম্পল অভ সেটি।
ওসেইরেনকে রেখে দিলেন কেন? জানতে চাইল রানা।
কারণ, ওটা দেখতে ওসাইরিসের সমাধির মত, জবাবটা দিল লাবনী, আসলটা হারিয়ে গিয়েছিল বহু কাল আগেই। র্যামেসেস বুঝেছিলেন, আসলটা না পেলেও এটার মূল্য কম নয়।
আমাদের ধারণা ঠিক হলে, ওটার ভেতর কোথাও আছে ওসাইরিসের চোখ, বলল বেলা।
ওই চোখ চেয়ে আছে পিরামিডের দিকে? চলো, ভেতরে যাওয়া যাক। পাথুরে শক্ত বালি মাড়িয়ে এগোল রানা।
একমিনিট পেরোবার আগেই ওসেইরেন-এ পা রাখ ওরা। খনন করে বের করা হয়েছে জায়গাটা। মনে হয় মং এক কূপ। বড় সিঁড়ির ধাপসদৃশ দেয়াল নেমেছে নিচে কারুকাজ করা সেটির মন্দিরের মত নয়- রুক্ষ, প্রকা একখণ্ড ফ্যাকাসে গ্ল্যানেট যেন। কামরাগুলো মোটামুটি নব্ব ফুট, মেঝেতে জমে আছে সবজেটে পানি।
পানির উচ্চতা বড়জোর এক ইঞ্চি, ভরসা দিল বেলা।
কপাল ভাল বর্ষার সময় আসিনি, মেঝেতে পা রাখল লাবনী।
উত্তর-পশ্চিমে অন্ধকারমত এক করিডোর দেখে ওদিবে চলল রানা। ওদিকটা দেখব।
উত্তর এন্ট্রান্স ওদিকে, বলল বেলা। আরেকবার দেখ গাইড-বুকের ডায়াগ্রাম।
করিডোরে ঢুকে ভুরু কুঁচকে দূরে তাকাল রানা। ধ নেমে আটকে গেছে ওদিকটা? কামরার শেষ প্রান্তে দেয়ালের কাছে থামল। ওই চোখ থাকবে পিরামিডের দিকে। ওট পশ্চিমে। সেক্ষেত্রে ওই চোখ আছে ভেতরের পুব দেয়ালে।
ঠিক! খুশি হয়ে উঠল লাবনী।
পিঠ থেকে ব্যাকপ্যাক নামিয়ে ফ্ল্যাশলাইট বের করে নিন রানা। পানি ছলকে এগোল ওরা পুবের দেয়ালের দিকে।
খানিকটা হাঁটতেই পানি থেকে উঠে এল মেঝে।
সামনে শুকনো মেঝের ছোট এক ঘর। চোখ পিটপিৗ করে অন্ধকারে দৃষ্টি সইয়ে নিতে চাইল ওরা। একটু পর বুঝল, বাইরের কামরার মতই এদিকের দেয়ালও মসৃণ কোথাও কোনও কারুকাজ নেই।
কিছু দেখছেন? জানতে চাইল বেলা।
না, বিরক্ত হয়ে গেছে লাবনী।
দেয়ালে আলো ফেলে চারপাশ দেখছে রানা। একটু পর দেয়াল বাদ দিয়ে আলো তাক করল বিমের দিকে।
হ্যাঁ, পেয়ে গেছি! বলে উঠল বেলা। ওই যে!
আরও ভালভাবে দেখতে ঠিক দিকে আলো ফেলল রানা।
ওই তো, পাথরের চোখ! বলা লাবনী। ওসাইরিসের!
পাথরের বিমের গায়ে খোদাই করা, ফুলে আছে চোখ।
আমিই আবিষ্কার করেছি! খুশি হয়ে বলল বেলা।
কপালের জোরে, বলল লাবনী। ভাল আর্কিওলজিস্ট হতে চাইলে শিখতে হবে কীভাবে মেথোডিক্যালি কাজ করতে হয়। ভুলে যেয়ো না, নিয়ম মানেনি বলে হাস্যকর, ফালতু লোক হয়ে গেছে ম্যান মেটয। আশপাশের কিছুই যেন চোখ না এড়িয়ে যায়।
মাথায় রাখব, ওর হিরোইনের বকা শুনে ঢোক গিলল বেলা। খারাপ হয়ে গেছে মন।
সেটা টের পেয়ে বলল লাবনী, যা করা উচিত, করবে ধীরেসুস্থে, তা হলেই দেখবে কোনও ভুল হবে না।
কিন্তু মানুষ ভুল না করলে নতুন কিছু সহজে শেখে না, তাই না, বেলা? বলল রানা।
আপনিও ভুল করেন? অবাক হয়ে ওকে দেখল বেলা।
সবাই করে, জোর দিয়ে বলল রানা। শুধু লাবনী করে না!
চোখ পাকিয়ে ওকে দেখল লাবনী, ঠোঁটে মৃদু হাসি।
আবারও খুশি হয়ে উঠেছে বেলা। বলল, আপনাদের যা দারুণ মানাবে না বিয়ে হলে! সত্যিই…
এসব কথা এখন বাদ, লজ্জা পেয়ে বলল লাবনী। তারপর নিচুগলায় বলল, ঠিকই বলেছ, বেলা। হয়তো মানাত। কিন্তু তা হবে না। আমরা দুজনই অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছিঃ অতি-ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের চেয়ে সহজ বন্ধুত্ব অনেক, অনেক শক্ত বাঁধন। আমরা আসলে বন্ধু চিরকাল। বন্ধুই থাকতে চাই। বেলার মাথায় হালকা টোকা দিল লাবনী, ঢুকল কিছু?
হাঁ করে চেয়ে রইল বেলা। এই দুটি মানুষের প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা ফুটে উঠল ওর দু-চোখে। ধীরে ধীরে মাথা ঝাঁকাল ও।
বিমে ফুলে থাকা চোখ ওসাইরিয়ান টেম্পলের লোগোর মতই। দেখা যাক কী আছে ওসাইরিসের চোখে, কম্পাস বের করল রানা। দু শ পঁচিশ ডিগ্রি। মানচিত্র নিয়ে মেঝেতে বিছিয়ে নিল। তা হলে, আমরা যাব ক্যানিয়নের মাঝ দিয়ে।
রুপালি গভীর খাদ, মন্তব্য করল লাবনী।
মানচিত্র আরও সতর্ক চোখে দেখল রানা। ওদিকে মরুভূমিতে কয়েকটা ক্যানিয়ন। যোডিয়াক কী দেখিয়েছে?
মাথা নাড়ল লাবনী। বোঝার উপায় নেই। শুধু জানা গেছে, ওসাইরিসের চোখ চেয়ে আছে রুপালি গভীর খাদের দিকে। পথ শেষে বোধহয় কাজে আসবে যোডিয়াকের অন্য হায়ারোগ্লিফিক্স।
আমাদের এখন চাই এমন এক ক্যানিয়ন, যেটার মুখ থাকবে মরুভূমির মেঝের চেয়ে নিচে, বলল রানা। একসময় ওখানে ছিল খাল বা নদী। ওপর থেকে নেমে এসেছে। নইলে তৈরি হতো না ওই ক্যানিয়ন। এই যে… মানচিত্রের নির্দিষ্ট জায়গায় তর্জনী রাখল রানা। ক্যানিয়ন গিয়ে উঠেছে চওড়া, খোলা মরুভূমিতে। ওদিকেই চেয়ে আছে ওসাইরিসের চোখ। মানচিত্রে টোকা দিল। তার মানে, পশ্চিমে সাত মাইল মত গেলে… এই যে এখানে পিরামিড।
ঝুঁকে দেখছে লাবনী ও বেলা।
কিন্তু মানচিত্রের বুকে কোনও পিরামিড নেই।
সমতল মরুভূমি।
ওটা হয়তো ঠিক ক্যানিয়ন নয়? আনমনে বলল লাবনী।
দেখা যাক, বলল রানা, এখান থেকে পনেরো মাইল গেলে এমন এক এলাকা পাব, যেখানে সহজেই ঢুকতে পারব মরুভূমিতে। সতর্ক থাকলে দুর্ঘটনা হওয়ার কথা নয়।
পরস্পরের দিকে তাকাল হতাশ বেলা ও লাবনী। জানে, ওদিকের বিরান এলাকায় কোনও পিরামিড নেই।
অত মন খারাপ কেন? নরম সুরে বলল রানা। প্রথমে ক্যানিয়ন খুঁজব। তারপর যাব ঠিক জায়গায়। দেখবে পেয়ে যাবে ওসাইরিসের পিরামিড।
থাকা তো উচিত, সবই তো মিলে যাচ্ছে, বিড়বিড় করল বেলা। আর ওটা পেলেই আমিও আপনাদের মতই হয়ে যাব বিখ্যাত!
তা হলে দেরি কীসের, চলল। মৃদু হাসল রানা।
উৎসাহের সঙ্গে বলল বেলা, চলুন, মাত্র পনেরো মাইল ঘুরতে হবে, তারপর এখান থেকে সাত মাইলের ভেতর পাব ওই পিরামিড!
ওসেইরেন থেকে বেরোবে বলে পা বাড়াল রানা।
ওর পিছু নিল লাবনী ও বেলা।
.
খর রোদে শুষ্ক, বিরান মরুভূমি ধরে নাচতে নাচতে চলেছে তুবড়ে যাওয়া ল্যাণ্ড রোভার ডিফেণ্ডার। বহুকাল আগেই নষ্ট হয়েছে এয়ার-কণ্ডিশন। জানালা সব খোলা, তবু এমনই গরম, মনে হচ্ছে চুল্লির মধ্যে বসিয়ে দেয়া হয়েছে রানা, লাবনী ও বেলাকে। মাঝে মাঝে পানির বোতলে চুমুক দিচ্ছে ওরা। লাবনী ও বেলা ঠিক করেছে, পারতপক্ষে আঙুলও নাড়বে না।
সিটে দুজনের মাঝে বসেছে: বেলা, চোখ সরাসরি সামনে। একটু পর পর দেখছে ড্যাশবোর্ডে রাখা জিপিএস ইউনিটের ডায়াল। জায়গামত পৌঁছে গেছি না?
আরও এক মাইল বাকি, বলল রানা।
দাউদাউ আগুনের হল্কার মত লাফিয়ে উঠছে সামনের বাতাস। এক দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্ত পর্যন্ত কী যেন অবয়ব নিচ্ছে।
উঁচু শৈলশিরা। লক্ষ বছর ধরে তাকে ভেদ করে গেছে নীল নদ।
তেমনই এক খাদের দিকে চেয়ে আছে রানা। ওখানে কালচে ছায়া। মনে হচ্ছে ওটাই আমাদের ওই ক্যানিয়ন।
হতে পারে, সায় দিল লাবনী।
কিছুক্ষণ পর ক্যানিয়নের মুখে থামল ল্যাণ্ড রোভার। ক্যাপ পরে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল ওরা।
খাদে ঢুকে চমকে গিয়ে বলল বেলা, খেয়াল করুন।
সূর্যের হলদে আলোয় ক্যানিয়নের দেয়ালে চকচক করছে সাদা কী যেন!
রুপা! পাথরের গায়ে চিকচিক করছে। খুশি হয়ে উঠল লাবনী।
ভাল করে দেখবে বলে চোখ থেকে সানগ্লাস নামাল বেলা। মিশরে রুপা নেই বললেই চলে। তাই প্রাচীন যুগে ওটাকে সোনার চেয়েও বেশি দাম দেয়া হতো।
সরু ক্যানিয়নের মেঝে ধীরে ধীরে উঠেছে, ওদিকে চেয়ে আছে রানা। এদিক দিয়ে এগোতে পারবে জিপ নিয়ে।
যেতে পারবে? জিজ্ঞেস করল লাবনী।
আশা তো করি পারব, বলল রানা।
আবারও জিপের পাশে ফিরল ওরা।
ল্যাণ্ড রোভার নিয়ে ক্যানিয়নের মাঝ দিয়ে সাবধানে এগোল রানা। দুপাশে দেয়াল, সরাসরি ওপর থেকে পড়ছে না রোদ। কিছুক্ষণ পর খাড়া হয়ে উঠল সরু পথ। একটু পর পর বাঁক। কখনও এতই সংকীর্ণ, আটকে যেতে চাইছে গাড়ির নাক। খুব সতর্ক হয়ে এগোচ্ছে ওরা।
এক জায়গায় ক্যানিয়নের দেয়ালে মস্তবড় এক গর্ত দেখল ওরা। ওখানে জিপ থামাল রানা। এই যে আমাদের রুপার খনি।
টিলার গা কেটে ভেতরে হারিয়ে গেছে সুড়ঙ্গ।
পুরো খনি খুঁজে হয়তো পাবে এক কাপ সমান রুপা, বলল লাবনী, যযাডিয়াকে লিখেছে, মার্কারির পথ ধরে এগোতে হবে। আমরা ভেবেছি বুধগ্রহ। তবে যাই লিখুক, এদিকে কিন্তু কোনও পিরামিড নেই।
আছে, দেখতে পাচ্ছেন না, জোর দিয়ে বলল বেলা।
তুমি দেখিয়ে দিয়ো, জিপ নিয়ে আবারও এগোল রানা।
একটু পর আরও খাড়া হলো পথ। ওরা চলেছে গভীর এক নালার ভেতর দিয়ে। অনেক ওপরে এক চিলতে নীল আকাশ। কিছুক্ষণ খাড়াই পথে চলে ক্যানিয়ন থেকে বেরিয়ে এল জিপ। সামনে ধু-ধু মরুভূমি।
কম্পাস ও জিপিএস দেখল রানা। যোডিয়াক দেখিয়ে দিয়েছে ওদিকে যেতে হবে। বেলা, আমার রুকস্যাকে বিনকিউলার আছে। ওটা দেবে?
কয়েক সেকেণ্ড পর রানার হাতে বিনকিউলার দিল বেলা। আপনি কোনও পিরামিড দেখছেন?
না। শুধু বালির প্রান্তর। বিনকিউলার দিয়ে দূরে তাকাল রানা।
কত দূরে ওই পিরামিড? লাবনীর দিকে তাকাল বেলা।
এক আতুর, সিক্স পয়েন্ট এইট-ফাইভ মাইল।
দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্ত দেখা শেষ রানার। নতুন কোঅর্ডিনেট দিল জিপিএস-এ। দূরে চোখা কিছুই নেই।
একটু দূরেই থাকার কথা পিরামিড। হতাশ হয়ে পড়েছে বেলা।
রানা গাড়ি নিয়ে রওনা হতেই একটু পর পর জিপিএস দেখতে লাগল লাবনী।
চার মাইল পেরোল ওরা।
বাকি রইল তিন মাইল।
তারপর দু মাইল।
শেষে এক মাইল।
আশপাশে দেখার মত আছে শুধু আকাশ আর হলদেটে বালির ঢিবি ও প্রান্তর।
মুখ গোমড়া করে বসে আছে বেলা।
আর মাত্র এক মাইল দূরে থাকবে পিরামিড।
কিন্তু দেখা গেল না কিছুই।
হতভম্ব দৃষ্টিতে এদিক ওদিক দেখছে লাবনী।
আর আধ মাইল দূরেই ওদের গন্তব্য।
আশপাশে বালির ঢিবির ঢেউ তোলা মরুভূমি ছাড়া কিছুই নেই।
বিপ আওয়াজ তুলল জিপিএস।
ল্যাণ্ড রোভার থামাল রানা। ব্যস, আমরা পৌঁছে গেছি।
দরজা খুলে নেমে পড়ল বেলা। কাঁদো-কাঁদো হয়ে গেছে চেহারা।
চারপাশে ধু-ধু মরুভূমি ছাড়া কিছুই নেই!
আমরা সব সূত্র পেয়েছি! অনুসরণ করেছি রুপালি ক্যানিয়ন! তা হলে পিরামিড নেই কেন?
বেলার কাঁধে হাত রেখে নীরবে সান্ত্বনা দিল লাবনী।
ল্যাণ্ড রোভারের ছাতে উঠল রানা। ভরসা দেয়ার জন্যে বলল, হয়তো বালির নিচে চাপা পড়েছে পিরামিড?
বালির নিচে? মাথা নাড়ল লাবনী। সম্ভব না। ওটা হবে প্রকাণ্ড। এতই বড়, দশ মাইল দূর থেকেও দেখা যাবে।
এত হতাশ হয়ো না, বেলা, বলল রানা। আমরা তো এখনও চারপাশ ভালভাবে দেখিইনি।
আর দেখেই বা কী হবে? কেঁদে ফেলল বেলা। আপনাদের কষ্ট দিয়েছি! সবার সময় নষ্ট করেছি! মেরে ফেলতে চেয়েছে একদল লোক। অথচ, সব বৃথা! হায়, ঈশ্বর, আমি দুঃখিত!
কাঁদছ কেন, বেলা? মন খারাপ কোরো না। বেলাকে জড়িয়ে ধরল লাবনী।
ডক্টর ম্যান মেটয ঠিকই বলেছিলেন! আমি আস্ত একটা অপদার্থ! কোনও মূল্য নেই! সোনার হরিণের পেছনে ছুটতে গিয়ে নষ্ট করেছি সবার সময়! দরদর করে বেলার গাল বেয়ে পড়ছে অশ্রু।
মন খারাপ করে না, বেলা, ওর বাহুতে হাত রাখল লাবনী। একদিন দেখবে মস্তবড় আর্কিওলজিস্ট হবে। আর তখন…
কখনোই কিছু হতে পারব না, মাথা নাড়ল বেলা। জীবনেও কোনও কাজ করিনি। বাবা-মার টাকা আছে বলে সবাই দাম দিত। ওই পয়সা আমার না। জীবনে একবার চাইলাম দুনিয়ার কাছে নিজেকে প্রমাণ করব, দেখিয়ে দেব আমিও কিছু করতে পারি! কিন্তু ব্যর্থ হলাম হাস্যকরভাবে!
জিপের ছাত থেকে বলল রানা, তুমি না থাকলে আমরা কিছুই জানতাম না। যোডিয়াক চুরি করে যা খুশি করত কাদির ওসাইরিস। অত ভেঙে পোড়ো না, পিরামিড না থাকার নিশ্চয়ই কোনও ব্যাখ্যা আছে। সেটা জানলেই পাব ওটা।
পাব না কিছুই, বিড়বিড় করল বেলা। দুঃখে থরথর করে কাঁপছে নিচের ঠোঁট।
জিপের ছাত থেকে নেমে পড়েছে রানা। চলো, চারপাশ ঘুরে দেখি। কিছু পেয়েও তো যেতে পারি?
ওকে চেনে লাবনী, তাই ওর মনে হলো কিছু ভাবছে রানা। নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, কী যেন পেয়েছ, তাই না?
হুঁ। তবে ওটা পিরামিড নয়। উত্তর-পশ্চিম দিক দেখাল রানা। ওই যে ওদিকে।
বালি ও পাথর ছাড়া চারপাশে কিছুই নেই, তবুও রানার দেখিয়ে দেয়া জায়গার দিকে তাকাল লাবনী। কী?
ওর চোখে বিনকিউলার দিল রানা। ওই যে পাথরগুলো। একটা এল শেপের।
হ্যাঁ। তো?
ওগুলো সাধারণ পাথর নয়।
বিনকিউলারের জন্যে অনেক কাছে চলে এল ওদিকের দৃশ্য। কাঠের কুটিরের ঢালু ছাতের মত উঁচু হয়ে আছে প্রকাণ্ড দুই পাথর, ঠেস দিয়েছে পরস্পরের ওপর। নিচে বালি ভেদ করে উঠে এসেছে ত্রিকোণ এক ছোট চূড়া।
সাধারণ পাথর নয়!
মসৃণ!
পাথরের ব্লক!
যেসব ব্লক দিয়ে তৈরি ওসেইরেন, ঠিক তেমন!
কোনও দালান! প্রায় ফিসফিস করল লাবনী।
অথবা তার ধ্বংসাবশেষ, বলল রানা।
লাবনী ও রানাকে অবাক চোখে দেখছে বেলা। বুঝতে চাইছে, ওরা নিষ্ঠুর কৌতুক করছে কি না। কয়েক সেকেণ্ড পর বুঝল, ঠাট্টা করছে না কেউ। একমিনিট! আপনারা তা হলে কিছু পেয়েছেন? সেটা কী?
বেলার হাতে বিনকিউলার দিল লাবনী। ভাল করে দেখো পাথরগুলো।
চোখ মুছে বিনকিউলার নাকের ওপর তুলল বেলা। তিন সেকেণ্ড পর বলল, আমরা তা হলে বসে আছি কেন?! চলুন!
হ্যাঁ, চলো, হাসল রানা। সবাই গাড়িতে চেপে বসতেই রওনা হয়ে গেল ও।
পাঁচ মিনিট পর কুটিরের ঢালু ছাতের মত আকৃতির দুই পাথরের সামনে থামল ল্যাণ্ড রোভার।
নেমে পড়ল ওরা।
দালানটা বর্গাকৃতির। একেক দিক দৈর্ঘ্যে বারো ফুট।
এটা মার্কার, নিজের থিয়োরি জানাল লাবনী। নিশানা রাখতে তৈরি করেছিল।…কিন্তু এটা কীসের নিশানা?
বিশাল পাথরের ব্লক দেখছে বেলা। হয়তো এটা দেখে বুঝে নিত কোন দিকে যেতে হবে?
মাথা নাড়ল লাবনী। যোডিয়াক অনুযায়ী, রুপালি গভীর খাদ পেরোবার পর এক আতুর উত্তর-পশ্চিমে গেলে পাওয়া যাবে পিরামিড।
যদি নিচে থাকে ওটা? বলল রানা।
মাথা নাড়ল লাবনী। ছোট পিরামিড তৈরি করতেও যে পরিমাণের বালি সরাতে হবে, তা প্রায় অসম্ভব কাজ।
তো আমরা পিরামিড দেখছি না কেন? জানতে চাইল বেলা।
পকেট থেকে যোডিয়াকের ছবি নিল লাবনী। এটাতেই কোনও সূত্র আছে। রানা, দেখো তো উত্তরদিক কোটা?
কমপাস দেখল রানা।
কাঁটা দেখে দিক নির্দেশনা খুঁজছে লাবনী। মাথার ওপরে তুলল ছবি। উত্তর দিকে তাক করলাম।
ছবি নিচে নামাও, বলল রানা। এই দালান রাখা হয়েছে দিক নির্দেশনার জন্যে, ঠিক?
হ্যাঁ, তা ঠিক।
যোডিয়াকে উল্টো হয়ে আছে পিরামিড।
হ্যাঁ, তো?
তার মানে, ওটা একটা উল্টো পিরামিড, বলল রানা। আর তুমি দাঁড়িয়ে আছ ওটার মাথার ওপর।
ষষ্ঠতম র্যামেসেসের সমাধিতে যেসব ছবি, সব আয়নার প্রতিবিম্বের মত করে আঁকা, বলল বেলা। যমপুরী দেখিয়ে দিয়েছে, যেন মাটির ওপরের দৃশ্য। আরেকটা কথা, স্ফিংসের ভেতরের যোডিয়াক যদি খাফ্রের আগের আমলের হয়, অন্যসব পিরামিডের চেয়ে বহু আগে তৈরি হয়েছে ওসাইরিসের পিরামিড। তখন হয়তো মাটির ওপর রাখত না ওই জিনিস?
অন্যান্য পিরামিডের উল্টো ওটা, মাটির নিচে তৈরি। শ্বাস আটকে ফেলল লাবনী। পরেরগুলো যারা তৈরি করেছে, তাদের হয়তো সাহসই ছিল না ওসাইরিসের নকল করার। অথবা, অত কষ্ট করতেই যায়নি?
গাঁয়ের যোগীর ভাত নেই, বিড়বিড় করল রানা। বসে পড়ল বালির ওপর। এক মুঠো বালি তুলে সরিয়ে রাখল। ওর তৈরি গর্ত দেখাল। এমনই গর্ত খুঁড়ে তৈরি করেছে। পরামিড। প্রতি স্তরের কাজ শেষ হলে পাথরের ব্লক গেঁথে উঠে এসেছে। ফলে গ্রেট পিরামিডের মত অত খাটুনি দিতে হয়নি। ওপরে তুলতে হয়নি পাথরের ব্লক, সাহায্য করেছে। মাধ্যাকর্ষণ।
তুমি তা হলে বলছ, আমরা আছি পিরামিডের ওপর? যেন মেনে নিতে পারছে না লাবনী।
আমার কথা ঠিক কি না, তা জানতে হলে গায়ে খাটতে হবে, ল্যাণ্ড রোভারের পাশে গেল রানা। ফিরল তিনটে কোদাল নিয়ে। ত্রিকোণ পাথরের পাশের বালি দেখাল। কাজে নেমে পড়ো।
কোথায় খুঁড়ব? জানতে চাইল বেলা।
এই ঘরের ঠিক মাঝখানে, একটা কোদাল বেলার হাতে ধরিয়ে নিল রানা। এটা ঠিকই মার্কার। আবার প্রবেশপথও।
চুপচাপ কাজে নামল ওরা। সূর্যের কড়া আলোয় একটু পর শুকিয়ে গেল সবার গলা। পানি খেয়ে নিল। গর্ত তৈরি করছে, আবার ঝরঝর করে গর্তে পড়ছে বালি। পঁচিশ মিনিট পর রানার কোদালের ফলায় লেগে ঠং আওয়াজ তুলল কী যেন।
নতুন উদ্যমে কাজ করছে রানা।
কিছুক্ষণ বালি সরাবার পর বেরোল চ্যাপ্টা একটা স্ল্যাব।
আমার মনে হয় দালানের মেঝে, বলল বেলা।
মাথা নাড়ল লাবনী। বোধহয় অন্যকিছু। এসো, ওটার ওপর থেকে বালি সরিয়ে ফেলি।
পাশেই সেই ত্রিকোণ পাথর। আরও পাঁচ মিনিট কাজ করার পর বালিমুক্ত হলো ছয় ফুট বাই তিন ফুট পাথরের স্ল্যাব। বালি মেখে ভূত হয়ে গেছে ওরা।
চার কোনা এন্ট্রান্সের ঢাকনি? বলল লাবনী।
স্ল্যাবের মাঝের জায়গা থেকে বালি সরিয়ে ফেলেছে বেলা। ফিক করে হেসে ফেলল। এটা দেখেছেন?
পাথরের ওপরে খোদাই করা একটা সিম্বল।
ওসাইরিসের ফোলা চোখ!
ড্যাব-ড্যাব করে রানাকে দেখছে লাবনী।
তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ না এবার দুই টনি পাথরের চাপড়া সরাব? আপত্তির সুরে জানতে চাইল রানা।
ওর দিকে চেয়ে আছে বেলাও।
ও, দলে তা হলে তোমরাই ভারী? গর্ত ছেড়ে উঠে ল্যাণ্ড রোভারের কাছে গেল রানা। এবার ফিরল ক্রোবার হাতে। স্ল্যাবের কিনারা দেখল। একটা দিকে তো মেরে ঢোকাল ক্রোবার। হাতলে চাপ দিল দুই হাতে। তাতে সামান্য নড়ল স্ল্যাব। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে রানা বলল, যত ভারী ভেবেছি, অতটা নয়! বড়জোর হার্নিয়া হবে! লাবনী, গাড়িতে ধাতব স্পাইক পাবে! নিয়ে এসো!
স্পাইক নিয়ে এল লাবনী। এক এক করে স্ল্যাবের নিচে স্পাইক ভরল রানা, তারপর চাড় দিল ক্রোবার দিয়ে। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর সামান্য সরল স্ল্যাব। কিনারা দিয়ে দেখা গেল নিচে কুচকুচে কালো আঁধার।
গিয়ে ল্যাণ্ড রোভার গাড়িটা খুব কাছে নিয়ে এল রানা। ওটার উইঞ্চ ব্যবহার করল স্ল্যাব ওপরে তুলতে। একপাশ থেকে ঠেলল স্ল্যাব। কয়েক সেকেণ্ড পর জোরালো খটাং আওয়াজে কাছের দেয়ালের গায়ে গিয়ে পড়ল পাথরের চাইয়ের একপাশ। ওটা যেখানে ছিল, সেই বালিজমির মাঝে এখন গোল এক গর্ত।
হাত থেকে বালি ঝরাতে শুরু করে বলল রানা, সহজ কাজ।
খুব বেশি সহজ, বলল বেলা, অন্যান্য পিরামিডের দরজা সবসময় লুকিয়ে রাখা হত।
একই কথা ভাবছে লাবনী। মাথা দুলিয়ে বলল, হয়তো ভেবেছে এখানে আসবে না কেউ, অথবা আসবে শুধু যাদের আসার কথা। তাই কোনও বাধা তৈরি করেনি।
ভাবছ, ভেতরে ফাঁদ পেতে রেখেছে? জানতে চাইল রানা।
মাথা দোলাল লাবনী। তা-ই তো মনে হয়।
তাই সহজেই পেয়ে গেছি পিরামিড? বলল বেলা।
ভেতরে নামলে সবই বুঝব, বলল লাবনী।
তার আগে কাজ আছে, বলল রানা। অপেক্ষা করো। দূরে রেখে আসি গাড়ি।
মরুভূমির ভেতর কোথায় রাখবে? জানতে চাইল লাবনী।
আসার সময় একটা নালা দেখেছি, বলল রানা। গাড়ি রাখলে চট করে কেউ খুঁজে পাবে না।
খুঁজবে কেন কেউ? জানতে চাইল বেলা।
কারণ কাদির ওসাইরিস বলে একজন আছে, আমাদেরকে খুঁজছে, বলল রানা, গত কয়েক দিন ধরেই চোখ রাখছে কিংস্ ভ্যালিতে। এদিকে খুঁজবে না, এমন ভাবার কারণ নেই।
কথাটা শুনে চোখ-মুখ শুকিয়ে গেল বেলার। ওদিকে অবশ্য নালাটা দেখেছি।
গাড়ি রেখে আসছি। দালান থেকে বেরিয়ে গেল রানা। দরকারি ইকুইপমেন্ট নামিয়ে ল্যাণ্ড রোভার নিয়ে রওনা হলো। সিকি মাইল গিয়ে গাড়ি নামিয়ে দিল অগভীর নালায়। পনেরো মিনিট পর ফিরল পাথরের দালানে।
ওর জন্যেই অপেক্ষা করছে লাবনী ও বেলা। প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্ট ভাগ করে নিল ওরা। দড়ি বাঁধল স্ল্যাবে, তারপর একে একে নেমে পড়ল আঁধার গর্তে।
ছয় হাজার বছর পর আবারও মানুষের পা পড়ছে ওসাইরিসের পিরামিডের ভেতর।
.
২২.
ম্যান হোল সদৃশ গর্ত দিয়ে নেমে এসেছে রানা, লাবনী ও বেলা। এন্ট্রান্স চেম্বারের ছাত আট ফুট উঁচু। ওপর থেকে ঝিরঝির করে পড়ছে মিহি বালি। পরিষ্কার ঘর, তবে বদ্ধ জায়গার বাতাস যেমন হয়, তেমনই গুমোেট। নির্মাতারা সমাধি বন্ধ করে চলে যাওয়ার পর পেরিয়ে গেছে হাজার হাজার বছর।
ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় চারপাশ দেখল বেলা।
এই পাতাল ঘর ওপরের বারো ফুট বর্গাকৃতির ঘরের চেয়ে অনেক বড়। কাছের দেয়ালের সামনে থামল ওরা।
হায়ারোগ্লিফিক্স! বিড়বিড় করল বেলা। অবাক কাণ্ড তো!
কীসের অবাক কাণ্ড? পাশ থেকে বলল লাবনী, পড়তে পারছ?
মোটামুটি। একটু অদ্ভুত। অনেক পুরো অক্ষর।
দেখতে দারুণ, সাদা দেয়ালে ফ্ল্যাশলাইটের আলো ফেলল লাবনী। রঙিন হায়ারোগ্লিফ দেখলে মনে হয় আঁকা হয়েছে গতকাল। অক্ষরের মাঝে মাঝে ইজিপ্টের পুরাণের দেবতার ছবি।
রানাও দেখছে দেয়াল। অক্ষরের মাঝে জগৎ-স্রষ্টা সূর্য দেবতা রা ও উদোম দেহের আকাশ-দেবী নাট। কিন্তু পরিচিত এক দেবতা নেই। ওসাইরিস নেই, বলল রানা।
ওসাইরিস ছাড়া অসম্পূর্ণ প্রাচীন মিশরের ধর্ম।
হোরাস, বলল বেলা, সেট, আইসিস বা আনুবিসও নেই। শেষেরজন তো সমাধি-দেবতা। তাকে অন্তত দেখব ভেবেছিলাম।
এরা ওসাইরিসের সমসাময়িক, বা তার ছেলেমেয়ে, বলল লাবনী। হয়তো তখনও দেবতা হয়নি। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, এই পিরামিড পুরনো রাজ বংশের চেয়েও আগের। খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার বছর আগে ওসব দেবতাকে পূজা দেয়া হতো।
তা হলে আমরা ঠিকই ধরেছি! হাসল বেলা।
চেম্বারের আরেকদিকে একটা প্যাসেজের মুখে গিয়ে থেমেছে রানা। কারুকাজ করা দুই পিলারের ওদিকে দরজা। নেমে গেছে সিঁড়ির তিনটে ধাপ। তারপর বেশ খাড়া প্যাসেজ।
এখনই নেমো না, বলল লাবনী, আগে ভালভাবে দেখা হোক এ ঘর। জরুরি তথ্য পেতে পারি।
অক্ষর পড়ছে বেলা। প্রেতলোকে কী ধরনের বিচার বা পরীক্ষার ভেতর পড়তে হবে, সেসব লিখেছে।
জানার মত কিছু পাবে? জিজ্ঞেস করল রানা।
জানি না, বলল বেলা। এটা ইজিপশিয়ান বুক অভ দ্য ডেড-এর আগের ভার্শান।
ঘুমাতে যাওয়ার আগে পড়তে হয়, তাই না? শুকনো হাসল লাবনী। স্টিফেনকিংমুন!
খিলখিল করে হাসল বেলা। আবার মন দিল দেয়ালের অক্ষরে। এসব আসলে প্রার্থনা। একেকটা আরিত পেরোবার সময় লাগবে। আরিত মানে একেকটা স্তর। এখানে লিখেছে: যদি পাপ না করো, বিচার ছাড়া পৌঁছবে ওসাইরিসের কাছে। তবে এসব লেখা হয়েছে অন্যভাবে।
অন্যভাবে মানে কী? জানতে চাইল লাবনী।
মনে মনে কয়েকটা লাইন পড়ল বেলা। এই যে, এখানে লিখেছে: তুমি প্রবেশ করবে ওসাইরিসের বাড়ির প্রথমতলায়। এটা কম্পিত মহিলার আস্তানা। মৃতজগতের প্রহরী সে। আরও লিখেছে, এই মহিলা ধ্বংসের মালকিন। পুরনো বুক অভ দ্য ডেড-এ আরও লেখা: কেউ অন্যায় না করলে ধ্বংস না করে আরও নিচের প্রেতলোকে যেতে দেবে। এখানে লিখেছে: ওই মহিলা ধাতব।
আর কিছু জানতে চাইল রানা।
মাথা নাড়ল বেলা। প্রার্থনা না বলে এটাকে সতর্কবাণী বলতে পারেন। কোথাও লেখেনি কীভাবে পেরোতে হবে ওই আরিত।
রানার দিকে তাকাল লাবনী। ভয় লাগছে।
এগোলেই বুবি ট্র্যাপে? মাথা দোলাল রানা। কম্পিত মহিলার বিষয়ে আর কিছুই নেই, বেলা?
হায়ারোগ্লিফিক্স পড়ছে বেলা। কমিনিট পর বলল, এরপর পাবেন আগুনের হ্রদ। পাপীকে গিলে নেবে ওই আগুন। আরও কী যেন লিখেছে, বুঝছি না। এরপর ঝড় বৃষ্টির মহিলার স্তর। তাকে পার করলে প্রচণ্ড শক্তিশালী মহিলার স্তর। অন্যায়ভাবে ঢুকলে যে কাউকে পিষে ফেলবে। তারপর আছে প্রচণ্ড আওয়াজের দেবী…
প্রাচীন অক্ষর দেখছে বেলা। একটু পর বলল, বিকট আওয়াজের দেবী ছেড়ে দিলে গিয়ে পড়ব রক্ত-মাংস ছিটকে দেয়া ভয়ঙ্কর যন্ত্রের পরীক্ষায়। ওটা পেরোলেও রক্ষা নেই, ওসাইরিসের কাছে যাওয়ার আগে সামনে পড়বে মাথা-কাটা যন্ত্র। এসবই লেখা আছে বুক অভ ডেড-এ। কিন্তু এখানে লিখেছে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে।
মিথ্যা লেখেনি, বলল লাবনী, প্রেয়ার অভ দ্য ডেড এসেছে এ বর্ণনা থেকেই। ওসাইরিসের সমাধি রক্ষায় যেসব বুবি ট্র্যাপ ব্যবহার করেছে, সে-কথাই উঠে এসেছে প্রাচীন ধর্মে।
রক্ত-মাংস ছিটকে দেয়া ভয়ঙ্কর যন্ত্রের পরীক্ষায় পাশ করতে হলে শুধু প্রার্থনায় কাজ হবে না। ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় নিচে যাওয়া প্যাসেজ দেখল রানা।
কাজে লাগবে এমন আর কিছুই লেখেনি? হতাশ হয়েছে লাবনী।
না, মাথা নাড়ল বেলা, একই কথা বারবার লেখা। ভয়ঙ্কর দেবতা ওসাইরিস! অভিশাপের পর অভিশাপ দিয়েছে! যারা অপবিত্র করবে সমাধি, রক্ষা নেই তাদের। হাজারোভাবে বারবার খুন করবে! ইত্যাদি ইত্যাদি!
এখনই মরতে রাজি নই, বিড়বিড় করল লাবনী। গিয়ে থামল রানার পাশে। পিলারের কাছে একাধিক কারুকাজ করা মিশরীয় দেবতা। দেয়ালে লেখা: নিয়ম না মেনে আরিত পেরোতে গেলেই নির্ঘাৎ মৃত্যু। রানা, ঝুঁকি নেয়া উচিত?
কাঁধ ঝাঁকাল রানা। কেউ আসেনি এত বছরে। তাতে হয়তো নষ্ট হয়নি ফাঁদ। আবার, হয়তো নষ্ট হয়েছে। ফাঁদ এখন কী অবস্থায় আছে, তা না জেনে বলা মুশকিল।
তুমি তো দেখছি পিচ্ছিল আমেরিকান কূটনীতিকদের মত দু-মুখে কথা বলছ, বিরক্ত হলো লাবনী। তাকাল বেলার দিকে। তোমার কী মনে হয়, বেলা?
কেউ কিছু জিজ্ঞেস করছে বলে খুব অবাক হলো বেলা। আমি? আমি কী বলব! আপনারা যা বলবেন, সেটাই মেনে নেব।
জীবনটা তো তোমার, বলল রানা।
চুপ করে কী যেন ভেবে নিয়ে বলল বেলা, বহু দূরে চলে এসেছি। আপনাদের কারণে এখনও আস্ত আছি। তাই মনে হচ্ছে, সঙ্গে গেলে কোনও ক্ষতি হবে না। চলুন, যাওয়া যাক!
সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা রাখল বেলা। কিন্তু কাঁধ ধরে ওকে থামাল রানা। তুমি আসবে আমাদের পর। পিছু নেবে, ঠিক আছে?
হুঁ।
উল্টো পিরামিডে দুবার নব্বই ডিগ্রি বাঁক নিয়ে কারুকাজ করা দুটো পিলারের মাঝ দিয়ে গেছে ঢালু প্যাসেজ। সামনেই প্রথম আরিত বা স্তর।
প্রথম স্তর, নার্ভাস সুরে বলল বেলা।
আঁধারে ফ্ল্যাশলাইটের আলো পাঠাল রানা। কী যেন দেখে বলল, বিশাল। বোধহয় অনেক গভীর।
কৃপ? জানতে চাইল লাবনী।
হ্যাঁ, একটু সামনেই। গহ্বরের কিনারায় থামল রানা। কূপের ছাত তিরিশ ফুট ওপরে। নিচে আলো পাঠিয়ে বোঝ গেল না গভীরতা। কূপের ওদিকে গেছে অক্সিডাইড় তামার প্রকাণ্ড দুই পাইপ। ওপাশের দেয়ালে আঁকা দানবীয় এক মহিলা। কূপের ওপর পাথরের সরু এক কলাম বা সেতু।
অনিরাপদ, নিচু স্বরে বলল লাবনী। ওই সেতু চওড়ায় বড়জোর এক ফুট। বেকায়দাভাবে ঢালু।
সেতুর ওদিকে পুরু, কারুকাজ করা কোনও মেশিনের ওপর পড়ল রানার ফ্ল্যাশলাইটের আলো। দেখল, পাথরের বিশাল দাঁতওয়ালা দুটো চাকা। তাতে চিকচিক করছে ধাতব কী যেন।
পাথরের বড় সিলিণ্ডারের সঙ্গে চেইন লাগানো, রানা বলল, পুলিও আছে।
পৌঁছে গেছি কম্পিত মহিলার আস্তানায়, বলল লাবনী।
চেইনে ওজন চাপলেই ঘুরবে পাথরের চাকা, অমনি সেতুতে ওঠা যে কাউকে চ্যাপ্টা করবে দুই পাইপ, আন্দাজ করল রানা।
থরথর করে কাঁপবে সেতু? বিড়বিড় করল বেলা। কিন্তু মেশিনটা চালু হবে কী দিয়ে?
আমরাই চালু করব, তিক্ত হাসল লাবনী। সেতুর মধ্যে ট্রিগার করার মত কিছু আছে। ওজন চাপলেই কাপবে সব।
তা হলে আমরা পেরোব কী করে?
ব্যাগ থেকে দড়ি বের করেছে রানা। চেইন ওজন নিলে বেশিক্ষণ দুলবে না পাথরের সেতু। নিজেকে ঠিকভাবে বেঁধে নেব সেতুর সঙ্গে, এরপর সাবধানে পেরোব।
কথা শুনে আঁৎকে উঠেছে লাবনী। বলল কী! তোমাকে নিয়ে খসে পড়লে?
পড়বে বলে মনে হয় না, বলল রানা। এ ছাড়া উপায়ও নেই। নইলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে এপারে।
রানার বাহু চেপে ধরেছে লাবনী। খুব ভাল করে সেতুতে দড়ি বাঁধবে, ঠিক আছে?
নির্ঘাত। কাজে নেমে পড়ল রানা। দুবার সেতুর সঙ্গে দড়ি পেঁচিয়ে গিঁঠ দিল। অন্যপ্রান্ত বাঁধল কোমরে। পাথরের কলামে আস্তে করে পা রেখে বিড়বিড় করল, রওনা হলাম।
তাতে কিছুই হলো না।
ঢালু হলেও নড়ছে না সেতু।
হাঁটু গেড়ে বসল রানা, এগোল সাবধানে।
হতবাক হয়ে ওকে দেখছে লাবনী।
সেতুর মাঝে পৌঁছুল রানা, তারপর পেরিয়ে গেল চারভাগের তিনভাগ।
হঠাৎ নড়ে উঠল সেতু। ঠং-ঠং আওয়াজ তুলল চেইন।
দুহাতে সেতু জড়িয়ে ধরল রানা। অবশ্য, তিন সেকেণ্ড পর থামল চেইনের আওয়াজ। থমথম করছে চারপাশ।
কী হলো, রানা? ফ্যাকাসে মুখে জিজ্ঞেস করল লাবনী।
মুখ তুলে সামনে দেখল রানা। জানি না, তবে আর নড়ছে না! পেরিয়ে গেল শেষ কয়েক ফুট। দড়ি থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তাকাল চারপাশে। একটু দূরে দেয়ালে বড় এক ফাটল। ওখান থেকে পড়ে দাঁতওয়ালা চাকার মাঝে আটকে গেছে একটা পাথরখণ্ড। এজন্যেই ঘুরতে পারেনি চাকা। চেইনও দোলাতে পারেনি সেতু।
পাথরের ওই টুকরো হঠাৎ করে খুলে আসবে না, সেটা নিশ্চিত করল রানা। এবার ভর দিলেও বিন্দুমাত্র নড়ল না সেতু। একজন একজন করে এসো। তাড়াহুড়ো করবে না।
প্রথমে সেতু পেরোল লাবনী, তারপর বেলা।
ভূমিকম্পে নষ্ট হয়েছে যন্ত্র? আনমনে বলল লাবনী। দেখছে পাশের ফাটল। বা হয়তো তৈরির সময়ে ত্রুটি ছিল।
ঢালু আরেকটা পথ দেখাল রানা। দুপাশে কারুকাজ করা পিলার। পরের আরিত কোটা যেন?
আগুনের লেক, বলল বেলা। বা বলতে পারেন, জীবন্ত খেয়ে ফেলা আগুন!
তার মানে আগুন থাকবে, বলল রানা। বদ্ধ জায়গায় ওই জিনিস ভয়ঙ্কর।
কপাল ভাল হলে পরের ফাঁদও নষ্ট থাকবে। পাথরের মেকানিযম দেখছে লাবনী।
ভাগ্যের ওপর এত ভরসা কোরো না। সামনের প্যাসেজ ধরে এগোতে লাগল রানা।
প্যাসেজ বেশ ঢালু। হাঁটা কঠিন।
দুবার নব্বই ডিগ্রি বাঁক নিল প্যাসেজ।
ঘুরে ঘুরে নিচে চলেছে, বুঝে গেল ওরা।
রানা ভাবছে, ওপরের তামার পাইপ নিচের চেম্বারে যুক্ত কি না। একটু যেতেই পড়ল কারুকাজ করা দুটো পিলার। ওগুলোই বুঝিয়ে দিল, সামনে আরেকটা স্তর বা ঘর।
নাক কুঁচকে গেছে রানার। গন্ধ পাচ্ছ? পিলার পেরিয়ে থামল ও। আলো ফেলল সামনের ঘরে।
কামরা ত্রিশ ফুট দৈর্ঘ্যের। ওপাশে বড় দরজা। তিরিশ ফুট উঁচু ছাত। ওখান থেকে ঢালু হয়ে পনেরো ফুট নেমেছে এক দেয়াল। ছাতে অসংখ্য বৃত্তাকার ফোকর। সেগুলোর ভেতর একটা বড়। চিমনির মত। ছোটসব গর্তের দিকে সন্দেহ নিয়ে তাকাল রানা। মন বলছে, সামনে মস্তবড় বিপদ!
ঘরে জিনিসপত্র বলতে তেমন কিছুই নেই। ওদিকের দেয়ালে গ্ৰেহাউণ্ডের মত দেখতে এক দেবতার ছবি প্রবেশপথের কাছে তামার হেলমেটের মত বড় কয়েকট গ্লোব। সরাসরি সামনে ধুলোভরা মেঝেতে গর্ত। ওট চারকোনা, তিন ফুট চওড়া। কোনও ধরনের তরলে ভরা এমনই আরেক গর্ত দূরের দরজার সামনে। রানারা যে প্যাসেজে দাঁড়িয়ে আছে, তার চেয়ে নিচু ঘরের ধুলোভর মেঝে। একটু ওপরে ছোট দুই চৌবাচ্চার কিনারা।
ওই ছবির মধ্যে কী যেন খুব অস্বাভাবিক, বলল লাবনী। কিন্তু আগুন কোথায়?
এ ঘরে বুবি ট্র্যাপ আছে, বুঝতে পারছে রানা। চারপাশ দেখছে সতর্ক চোখে।
হয়তো নিভে গেছে আগুন? দাঁত খিঁচিয়ে রাখা দেবতা দেখতে এক পা সামনে বাড়ল বেলা।
এগোবে না, মানা করল রানা। ঝুঁকে সামনের চৌবাচ্চায় তর্জনী চুবিয়ে নাকের কাছে ধরল। পানি। আলো ফেলে দেখল, চৌবাচ্চার তিনদিক দিয়ে ঘেরা দেয়াল। বড়জোর চার ফুট গভীর। এর সঙ্গে যোগাযোগ আছে ঘরের শেষমাথার চৌবাচ্চার।
সুড়ঙ্গ? বলল লাবনী। অদ্ভুত। হেঁটে গেলেই তো হয়।
কাজটা সহজ নয়, বলল রানা, অন্য কোনও বিপদ হবে।
ওটা কী? ঘরে আলো ফেলল লাবনী।
ছাতের অসংখ্য গর্ত থেকে মেঝেতে নেমেছে টানটান সব কালো সলতে।
সলতে থেকেই বোধহয় আসবে মহাবিপদ, বলল রানা। আলো ফেলল ঘরের মেঝেতে। না সরিয়ে এগোতে পারব। না।
অভাব নেই সলতের, নানানদিকে আলো ফেলে দেখছে লাবনী। কী যেন মনে পড়তে চাইছে। বলো তো, এই ঘরে কী নেই?
কী? প্রতিধ্বনি তুলল বেলা। এক পা সামনে বাড়ল।
মেঝের স্ল্যাবের মাঝে কোনও ফাঁক নেই, বলল রানা। বড় পাথরের মেঝেতে ওই জিনিস থাকে। দূরের দেয়ালে আলো ফেলল। আগের ঘরে সবচেয়ে বড় ব্লক ছয় বাই দশ ফুটের ছিল। কিন্তু এই মেঝে কমপক্ষে ত্রিশ ফুট দৈর্ঘ্যের।
তা হলে কি ধরে নেব এ মেঝে তৈরি মাত্র একটা পাথর থেকে? জানতে চাইল বেলা। আরেক পা বেড়ে পা রাখল সামনের মেঝেতে। টুপ করে ডুবে গেল গোড়ালি। আরেহ! হুমড়ি খেয়ে পড়তে শুরু করে আঁৎকে উঠল বেলা।
এক সেকেণ্ড আগেও যা ভেবেছে, সেই মেঝে আসলে তেলতেলে কোনও পদার্থের চৌকো পুকুর।
রানা পেছন থেকে টেনে না নিলে তরলের গভীর চৌবাচ্চায় তলিয়ে যেত বেলা। ভারসাম্য ফিরে পেয়ে বলল, এটা কী হলো? অবাক হয়ে গেছে।
তেল, বলল রানা, ওপরে ছড়িয়ে আছে বালি। মনে হচ্ছে মেঝে।
ছাতের গর্ত দেখছে লাবনী। সলতে ছিড়লেই দপ্ করে জ্বলে উঠবে ওপরের কিছু। পরক্ষণে শুরু হবে আগুন।
জুতোর সোল মেঝেতে ঘষল বেলা। এই ফাঁদ পেরোব কীভাবে?
ডুব সাঁতার কেটে, পানির ঘোট চৌবাচ্চা দেখাল রানা। ঘর ভরা আগুন থাকলেও পানির নিচে তা থাকবে না।
কাজটা এত সহজ? সন্দেহের চোখে নকল মেঝে দেখছে লাবনী।
তামার গ্লোবের ওপর ফ্ল্যাশলাইটের আলো ফেলল রানা। এসব পরেই আগুন থেকে বাঁচতে হবে।
জিনিসটা কী? জানতে চাইল বেলা।
একটা গ্লোব হাতে নিল রানা। ভেতরে ধরার হ্যাণ্ডেল। মাথায় গ্লোব পরল। শিরস্ত্রাণের মত কাঁধ পর্যন্ত নেমেছে। ভারী জিনিসটা। ডাইভিং হেলমেট। ভোতা শোনাল ওর কণ্ঠ।
রানার গ্লোবের চাঁদিতে টোকা দিল লাবনী। ভেতরে বেশিক্ষণ অক্সিজেন থাকবে না।
একবার সুড়ঙ্গে নামলে এটাই একমাত্র ভরসা, বলল রানা। চৌবাচ্চা ভরা পানি দেখল। মনে হয় না সুড়ঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক আছে ছাতের গর্তের। আগুন এড়িয়ে সুড়ঙ্গ পেরিয়ে উঠতে হবে দুই চৌবাচ্চার মাধ্যমে। ব্যস, জানে বেঁচে গেলে!
নিজেও গ্লোব পরখ করছে বেলা। যা পাতলা, আগুনের তাপে চট করে গরম হয়ে উঠবে।
তবুও ওটাই বাঁচার একমাত্র উপায়, বলল লাবনী, তুমি নিশ্চয়ই কই-ভাজা হতে চাও না?
না, জীবনেও না! বারকয়েক মাথা নাড়ল বেলা। আমি বিশ্বসুন্দরী হতে চাই।
সহজে সাঁতরে ওপারে যাবে, তা হবে না, বিশ্বসুন্দরী, বলল রানা। বড় বিপদ লুকিয়ে রেখেছে ওসাইরিসের লোক। প্রথমে যাব আমি।
না, আমি যাব, জোর দিয়ে বলল লাবনী।
ডাহা মিথ্যা বলল রানা, পানির নিচে বাধা থাকলে আমাকে সতর্ক করবে এমন কাউকে চাই।
কিন্তু…।
কোনও কিন্তু নেই, মানা করে দিল রানা। এক পা নামিয়ে দিল চৌবাচ্চার পানিতে।
ঢোক গিলল লাবনী। ভেবে দেখেছ, ওই পানি আছে হাজার হাজার বছর ধরে? ভাবলে কেমন শিউরে ওঠে না গা?
শিউরে উঠছি না, তবে পানি গিলতে রাজি নই, বলল রানা। একবার প্রাচীন হেলমেট ওপরে তুলে আবার বসিয়ে নিল মাথায়। দুহাতে ধরেছে ভেতরের হ্যাণ্ডেল। পরক্ষণে ডুব দিল। বেড়ে গেছে চৌবাচ্চার গভীরতা, তবে নাকের ফুটোর নিচেই থাকল পানি। অবাক হয়ে রানা বুঝল, ভেতরের বাতাসের কারণে ভেসে উঠতে চাইছে হেলমেট। সুড়ঙ্গের মাঝ দিয়ে এগোল ও। ছাতে ঘষা খেল হেলমেটের ওপরের দিক।
কী যেন লাগল বুকে, তারপর সরেও গেল।
সুড়ঙ্গের ভেতর ছিঁড়ে গেছে একটা সলতে।
চমকে গেছে লাবনী আর বেলা। ছাতের কাছ থেকে এসেছে ঘষ্টে যাওয়ার আওয়াজ।
কীসের শব্দ? লাবনীর দিকে তাকাল বেলা।
বড় লাইটার জ্বেলে নেয়ার মত আওয়াজ। এবার চিৎকার করে বলল লাবনী, রানা! জ্বলে উঠবে আগুন! আতঙ্ক নিয়ে ছাতের দিকে তাকাল। খর-খর আওয়াজ তুলছে। প্রাচীন পাথর ও ধাতু। যে-কোনও সময়ে ঝলসে উঠবে আগুনের ফুলকি…
ছোট গর্ত থেকে এল আগুনের লালচে ঝিলিক।
সরসর করে নেমে এল ধোয়া-তোলা সাপের মত সরু কিছু ফিতা। পড়ছে ঘরের নানানদিকে। মাত্র কয়েকটা ফিতায় জ্বলছে আগুন। কিন্তু নকল মেঝেতে পড়তেই পুরো ঘর জুড়ে দপ করে জ্বলে উঠল লেলিহান আগুন!
অগ্নি লেকের কথা লেখা ছিল হায়ারোগ্লিফে।
এখন সেই নরকেই আছে রানা।
সুড়ঙ্গ পেরিয়ে ঘরের নিমজ্জিত মেঝে ধরে হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে শুরু করেছে রানা। শুনছিল নিজের শ্বাসের শব্দ। চারপাশে ঘুটঘুটে আঁধার। কিন্তু হঠাৎ করেই আলোকিত হলো সব। গোটা পুলে জ্বলে উঠেছে কমলা আগুন। প্রচণ্ড তাপে টগবগ করে ফুটছে তেল। বড় দ্রুত গরম হয়ে উঠছে তেলের নিচে পানি, সেইসঙ্গে হেলমেটের হাতল।
ভুলটা এখন বুঝতে পারছে রানা। চট করে এগোতে পারবে না পানির কারণে। উঠেও আসতে পারবে না। ওপরে দাউদাউ আগুন। পানির নিচে ভয়ঙ্কর এক স্লো-মোশন দুঃস্বপ্নে আটকা পড়েছে ও।
কিন্তু এটা দুঃস্বপ্ন নয় যে জেগে উঠলেই রক্ষা পাবে।
গ্লোবের ওপরে গনগনে আগুন দেখে গলা শুকিয়ে গেছে রানার। চৌবাচ্চায় নামার সময় ছলকে লেগেছে তেল, এখন মশালের মত জ্বলছে প্রাচীন হেলমেটের ওপরের অংশ।
রানা! ফিরে এসো! সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ো!
আগুনের কড়-কড় আওয়াজের ওপর দিয়ে আবছাভাবে লাবনীর কণ্ঠ শুনল রানা। বুঝে গেছে, আবার ফেরার মত বাতাস হেলমেটে নেই। এই কামরা বড়জোর তিরিশ ফুট দৈর্ঘ্যের। এগিয়ে চলল রানা। বেশিক্ষণ লাগবে না ওদিকের দরজার কাছে পৌঁছে যেতে।
হামাগুড়ি দিয়ে সামনে বাড়ছে রানা। নাকে পানি লাগছে বলে মাঝে মাঝে আটকে আসছে শ্বাস। হেলমেটের নিচের অংশ দিয়ে ফ্লোর দেখছে। হায়ারোগ্লিফিক্স। সেগুলোর ভেতর রয়েছে ওসাইরিসের ফোলা একটা চোখ।
ওর ধারণা, বিশেষ কারণেই মেঝেতে রাখা হয়েছে ওটা। হয়তো বোঝাতে চাইছে কিছু। কিন্তু অক্সিজেন কমে আসছে। বলে অন্যদিকে মনোযোগ দেয়ার সময় ওর হাতে নেই।
আগুনের তাপে ক্রমেই আরও উষ্ণ হচ্ছে হেলমেটের হাতল। একটু পর সরিয়ে নিতে হবে হাত। সেক্ষেত্রে ভেসে উঠবে গ্লোব। বাতাসের অভাবে ভেসে উঠলেই গনগনে আগুনে পুড়ে মরবে ও!
ঠং! করে কী যেন লাগল হেলমেটের সঙ্গে।
আরেকটু হলে হ্যাণ্ডেল থেকে হাত সরিয়ে নিত রানা, ভয় পেয়ে খামচে ধরল ওটা। এক সেকেণ্ড পর বুঝল, সামনের পথ বন্ধ। মেঝে থেকে উঠেছে পাথরের চওড়া স্ল্যাব। যা ভেবেছে, তা-ই, আগুনের মাঝ দিয়ে সহজে যাবার পথ রাখেনি পিরামিডের নির্মাতারা!
পানির নিচে কাঁকড়ার মত বামে সরল রানা। হাঁটু বাড়িয়ে বুঝতে চাইল পাথরের দেয়াল কোথায় শেষ। ডানহাতে হ্যাণ্ডেল ধরে বামহাতে হাতড়াল পাথরের বুকে। বামে এগোল আরও একটু। এদিকে কোথাও বাধা নেই। কোথায় চলেছে বোঝারও উপায় নেই। স্বাভাবিক রাখতে চাইল শ্বাস। মনে পড়েছে, হেলমেটে আছে সীমিত অক্সিজেন।
ভীষণ রাগ হলো প্রাচীন মিশরীয়গুলোর ওপর। ইহ! গোলকধাঁধা তৈরি করেছে শালারা! শেষমাথা যদি বন্ধ থাকে?
নিশ্চয়ই কোথাও পথ আছে?
নির্মাতা যদি সত্যিই চাইত ওসাইরিসের সমাধিতে ঢুকতে দেবে না কাউকে, সেক্ষেত্রে বুজে দিত সব সুড়ঙ্গ। একদল পুরোহিত দেবতা করেছিল ওই রাজাকে। তাকে অনুসরণের জন্যে উদ্বুদ্ধ করত সবাইকে। এদিকে কোনও পথ থাকতেই হবে!
খুঁজে বের করতে হবে ওই পথ!
হাতে সময় নেই!
হেলমেটের ভেতর ফুরিয়ে আসছে অক্সিজেন।
মেঝের ওই হায়ারোগ্লিফিক্স…
দম আটকে পানির নিচে মুখ নিল রানা। ওপরের নারকীয় আগুনের লালচে আলোয় অদ্ভুত দেখাল মেঝে।
একটা হায়ারোগ্লিফিক্স চেনে রানা। সামনে বাড়তেই আবারও দেখল ওসাইরিসের কয়েকটা চোখ। কুচকুচে কালো মণি যেন সরাসরি দেখছে ওকে।
কিন্তু একটা অন্যরকম।
ওই মণি চেয়ে আছে বামে। পাশেই পাথরের ব্লক।
বামহাত বাড়িয়ে অন্ধের মত এগোল রানা। পুড়তে শুরু করেছে হাতল ধরা ডানহাতের আঙুল। সাবধানে আঙুল নাড়ল রানা। কিন্তু আগুনের তাপ থেকে রক্ষা নেই। একটু পর ছেড়ে দিতে হবে হেলমেট। আগুনে পুড়বে ওর মাথা।
মৃত্যু সেক্ষেত্রে নিশ্চিত!
বামহাতে মেঝে ঘষে এগোল রানা। হাত বাড়িয়ে দেয়ার দুসেকেণ্ড পর টের পেল, সামনেই একটা বাঁক!
বাঁকের কোনা চেপে ধরল বামহাতে। নিজেকে টেনে নিল ওদিকে। সামনের মেঝেতে ওসাইরিসের আরেকটা চোখ। এবার মণি চেয়ে আছে কামরার দূরে। ওটার দৃষ্টিকে অনুসরণ করে এগোল রানা। কয়েক ফুট যাওয়ার পর পেল আরেকটা চোখ। এবার ওটা দেখাল ডানদিকে।
বেড়ে গেছে আগুনভরা কামরার তাপমাত্রা। ছাতের চিমনি দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে তেল-পোড়া ধোঁয়া। দুহাতে মুখ ঢেকে আগুনের দিকে চেয়ে আছে লাবনী, পাশেই বেলা। জ্বলন্ত তেলের পুলের মাঝে চোখে পড়ছে রানার হেলমেট। এদিক ওদিক যাচ্ছে উদ্ভ্রান্ত রানা। বাঁচার উপায় নেই। ফুরিয়ে আসছে অক্সিজেন। গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে হলো লাবনীর। ওর চোখের সামনে পুড়ে মরবে ওর ভালবাসার মানুষটা, কিন্তু কিছুই করতে পারবে না!
ওদিকে ওসাইরিসের চোখ দেখে এগিয়ে চলেছে রানা। অক্সিজেন কমে গেছে বলে ঘুরছে মাথা। আটকে আসছে দম। ওপরের আগুনের তাপ অতিরিক্ত উষ্ণ করে তুলছে। পানি।
সামনে আরেকটা চোখ দেখে আবার এগোল রানা।
পুড়ে যাচ্ছে হাতল ধরা আঙুল!
গন্তব্য আর কত দূরে?
প্রতিবার দম নিলে ভীষণ জ্বলছে বুক। যে-কোনও সময়ে জ্ঞান হারাবে রানা।
ওই যে আরেকটা চোখ!
ডানদিকে চেয়ে আছে!
গ্লোব ধরা হাত থরথর করে কাঁপছে ওর। হেলমেট থেকে বেরিয়ে গেল একটা বুদ্বুদ। সে জায়গা দখল করল পানি।
পরের চোখ সরাসরি চেয়ে আছে সামনে।
ওদিকে ছায়ামত কিছু।
আরেকটা সুড়ঙ্গ!
হেলমেট নিয়ে পানির নিচে ডুব দিল রানা। প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকল সুড়ঙ্গে। পাথরের ছাতে গুঁতো দিল তামার হেলমেট। আওয়াজ হলো ঘণ্টির মত।
মাত্র কয়েক পা যেতে হবে… নিজেকে মনে করিয়ে দিচ্ছে রানা। আর মাত্র…।
সুড়ঙ্গ ফুরাতেই উঠতে গেল রানা। পুড়ছে হাত, আঙুল থেকে খসে গেল হেলমেটের হাতল। ঠাস্ করে পানির ভেতর পড়ল তামার গ্লোব। গরম পানি লাগল মুখে। খক-খক করে কেশে উঠে রানা টের পেল, পাতলা রাবারের মত হয়ে গেছে পা। কাত হয়ে পড়ে গেল পানিভরা চৌবাচ্চার ভেতর। জ্ঞান হারাতে শুরু করে মনে মনে চিৎকার করল রানাঃ না, আমি হারব না!
কয়েক সেকেণ্ড পর ধড়মড় করে উঠে পানি থেকে তুলল মুখ। শক্ত হাতে ধরল চৌবাচ্চার ওপরের কিনারা। ভু করে ফুসফুস থেকে বেরোল কার্বন-ডাই-অক্সাইড। গরম বাতাসে ভরে নিল বুক।
মাসুদ ভাই উঠেছেন! চিৎকার করে উঠল বেলা।
ওহ্, ধন্যবাদ! বিড়বিড় করে কাকে যেন বলল লাবনী। গলার কাছে চেপে ধরে রেখেছে আটলান্টিসের লকেট। চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, রানা! তুমি ঠিক আছ তো?
আগুনের কড়-কড় শব্দের ওপর দিয়ে বলল রানা, খুবই ভাল আছি। কিন্তু জীবনেও আর কোনও পিরামিডে ঢুকব না!
সুড়ঙ্গ থেকে বেরোবার পর কী হয়েছে? জানতে চাইল বেলা।
পানির তলা দিয়ে এলে মেঝেতে দেখবে ওসাইরিসের চোখ, বলল রানা, চোখে চোখে রাখবে ওসব চোখ। কোনও কোনওটা নির্দিষ্ট দিকে তাক করা। অনুসরণ করলে পৌঁছুবে এ পারে। এবার হেলমেট পরে নেমে পড়ো চৌবাচ্চায়। বেশি খরচ করবে না অক্সিজেন।
ভীষণ শুকনো মুখে চৌবাচ্চায় নামল লাবনী। তলিয়ে গেল পানির নিচে। ওপরে থাকল গ্লোবের একাংশ। বেঁটে সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে এগোল হামাগুড়ি দিয়ে। পিছু নিল বেলা।
ঘরের ওদিকে রানা জানে, লেক পেরোবার কাজটা সহজ নয়। শেষদিকে হেলমেটের হাতল এতই গরম হবে, মন বলবে শেষ পর্যন্ত পুড়েই মরছি।
অপেক্ষায় থাকল রানা।
অবশ্য ওর মত করে অসহায়ভাবে এগোতে হচ্ছে না লাবনী বা বেলাকে। মাত্র তিন মিনিটে পৌঁছে গেল দ্বিতীয় চৌবাচ্চার ভেতর। প্রথমে লাবনীকে টেনে তুলল রানা, তারপর এল বেলা। ভুস করে ভেসে উঠল ও।
নাক-মুখ কুঁচকে ফেলেছে লাবনী। ওরে, বাবা! পুড়ে গেছে আঙুল!
আমার তো আঙুলই নেই! হাতে ফুঁ দিচ্ছে বেলা। উঠে এল চৌবাচ্চা থেকে।
ফুরিয়ে এসেছে জ্বলন্ত লেকের তেল। চারপাশে ধোঁয়া। কমে আসছে আগুনের তেজ।
কী হারামি দেখো, কীসব ফাঁদ পেতে রেখেছে! রেগে গিয়ে বলল লাবনী।
ওয়াটারপ্রুফ ফ্ল্যাশলাইট নতুন করে জেলে নিয়ে বলল রানা, আমি অন্য কথা ভাবছি।
সেটা কী? সমস্বরে জানতে চাইল লাবনী ও বেলা।
পেরোতে হবে আরও পাঁচটা আরিত!
বাপরে! খুশিতে ভুষি হয়ে গেলাম, বিড়বিড় করল লাবনী। কড়া চোখে দেখল বেলাকে। যেন সব দোষ ওর। পরের স্তর কোনটা?
ঝড়-বৃষ্টির মহিলার এলাকা, ঢাক গিলল বেলা।
বাহ্, খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে, বাঁকা সুরে বলল লাবনী।
তা হলে চলে নাচতে নাচতেই, দলবল নিয়ে পরের ঢালু প্যাসেজ ধরে এগোেল রানা।
.
২৩.
প্যাঁচ খেয়ে পিরামিডের আরও গভীরে গেছে সুড়ঙ্গ। দেয়ালে দেয়ালে কুৎসিত অলঙ্কারের মত দেবতাদের ভয়ঙ্কর সব চিত্র। অন্তর কাঁপিয়ে দেয়া লেখা দেয়ালে। মূল বক্তব্য: বিনা অনুমতিতে অনুপ্রবেশ করলে রক্ষা নেই কারও!
অলৌকিক বা আধিভৌতিক বিপদের ভয় রানার নেই, তবে ভাবছে ভয়ানক বিপজ্জনক সব বুবি ট্র্যাপের কথা। আজ তক যত প্রাচীন রহস্যময় দালানে ঢুকেছে, ওগুলোর ভেতর সম্পদ রক্ষা করতে ছিল বিস্মিত করার মত মারাত্মক সব ফাঁদ।
দেবতা-রাজা ওসাইরিসের পিরামিড প্রকাণ্ড এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভবন। কাজেই স্বাভাবিকভাবেই সেই আমলের রাজ বংশ রক্ষা করতে চেয়েছে এটাকে। ফাঁদও সেজন্যেই।
ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় সামনে কারুকাজ করা পিলার দেখল রানা। ওদিকেই আরেকটা আরিত। কিন্তু কয়েক পা যাওয়ার পর বুঝল, সামনে কোনও ঘর নেই। বেশ খাড়াভাবে নেমেছে প্যাসেজ। এটাই একটা আরিত।
লাবনী, বেলা, আমরা যে আগুনের ঘর থেকে নেমে এসেছি, তার ঠিক নিচে এই প্যাসেজ, বলল রানা।
যেসব বাঁক ঘুরে এসেছে, সেগুলো মনে মনে খতিয়ে দেখল লাবনী। রানার কথাই ঠিক। প্যাসেজের ছাতের ওপরে আছে পানিভরা ওই ঘরের মেঝে। বিপদ হবে ভাবছ?
পরের ফাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে ঝড়-বৃষ্টির, আর আমাদের মাথার ওপরেই টনকে টন পানি।
ঠিক! ছাতের দিকে ফ্ল্যাশলাইটের আলো তাক করল লাবনী। প্যাসেজের দুপাশের দেয়ালে নানান ছবি, কিন্তু ছাতে তা নেই। মনে হলো নিরেট পাথরের ব্লক দিয়ে তৈরি ছাত। কোনও গর্ত দেখছি না।
সতর্ক চোখে চারপাশ দেখছে রানা। ছাত ঠিক আছে, কিন্তু সামনে পিলারের ওদিকে প্যাসেজের মেঝের দুপাশে গভীর নালা। চওড়া হবে চার ইঞ্চি। হয়তো ওখানে গেলেই শুরু হবে বিপদ।
আমার তো মনে হচ্ছে সাধারণ নালা, বলল বেলা।
ওপরের প্যাসেজে কিন্তু ছিল না, বলল লাবনী।
পিলারের ওদিকটা দেখছে রানা।
নতুন করে ভিজতে হবে? মাথা নাড়ল লাবনী। খুন হব ভারী জলপ্রপাত নেমে এলে?
আপনার কথা যেন কানে না যায় দেবতাদের! নার্ভাস হয়ে দুদিকের দেয়ালের দেবতাদেরকে দেখছে বেলা।
নিচে যেতে হলে এই প্যাসেজ ধরেই যেতে হবে, বলল রানা। আগে হোক বা পরে, ঘটবে খারাপ কিছু। কী করবে ঠিক করো তোমরা।
বহু কষ্টে এ পর্যন্ত এসেছি, এখন পিছিয়ে যাব না, মৃদু হেসে বলল লাবনী। তা ছাড়া, নষ্ট ছিল প্রথম ফাঁদ। পরেরটা পেরোতেও খুব কষ্ট হয়নি। এখনই বা হাল ছাড়ব কেন?
এখনও লাল হয়ে আছে আঙুল, বলল বেলা, তবে আছি লাবনী আপার সঙ্গে। মরলে তো একবারই মরব।
উচ্চ মম শির, বিড়বিড় করল রানা। বেলাকে বলল, ভাবছ মাথা নিচু করবে না কারও কাছে?
মনে আছে শেষ ফাঁদের নাম মাথা-কাটা যন্ত্র? ঢাক গিলল বেলা।
প্রয়োজনে মাথা নিচু করে নেবে, বলল গম্ভীর রানা। চলো, যাওয়া যাক। ঢালু প্যাসেজে আলো ফেলল ও। খুব ধীরে হাঁটবে, ঠিক আছে?
মাসুদ ভাই, আপনি এগিয়ে যান, আমরা আছি আপনার পেছনে, মিছিলের স্লোগানের মত করে বলল বেলা।
শামুকের গতি তুলে পিলার পেরোল রানা। বারবার দেখছে মেঝে ও ছাত। তবে পাঁচ ফুট যেতেই থেমে গেল। আলো ফেলেছে ছাতের একাংশে। ছাতের ব্লক ক্রমেই আরও বড় হচ্ছে।
ছাতের ব্লকের সরু সব ফাটল থেকে মাঝে মাঝে পড়ছে মিহি বালি!
চোখ বিস্ফারিত করল লাবনী। চুন-সুরকি খুলে আসছে!
দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরেছে বেলা। মাথার ওপর দানবীয় সব পাথরের ব্লক, ভাল লাগছে না আমার!
সাবধানে এগোও, পাকা চোরের মত এক পা এক পা করে চলেছে রানা। মাঝে মাঝে দেখছে এবড়োখেবড়ো ছাত। আবার দেখছে মেঝে। ভয়ে শুকিয়ে গেছে গলা। কয়েক পা গিয়ে বলল, মনে হচ্ছে, ঝড়-বৃষ্টির ভদ্রমহিলা যে-কোনও সময়ে হিসি করে দেবে!
সেক্ষেত্রে ভদ্রমহিলা বলা যায় না, বলল লাবনী, মানুষের মাথায় এসব কী?
ওপরেই… আরেক পা এগোল রানা। চমকে গেছে। ওর পায়ের নিচে একটু ডেবে গেছে একটা স্ল্যাব!
রানার মতই পাথরের মূর্তি হয়েছে লাবনী ও বেলা।
দুপাশের দেয়ালের ওদিক থেকে এল ঘড়ির মত মৃদু ক্লিক-ক্লিক আওয়াজ। চাপ পড়ে গেছে ট্রিগারে…
ফাপা আওয়াজ হলো: ক্লং! কাঠের ওপর পড়েছে ভারী ধাতু। শোনা গেল জলোচ্ছাসের মত শোঁ-শোঁ আওয়াজ।
শত শত টন পানি নেমে আসছে নিচে!
জলদি! রানা আর কিছু বলার আগেই ছাতের ফাটল বেয়ে ঝরঝর করে নামল ভারী বর্ষণ। বাড়ছে পতনের গতি।
তিরিশ ফুট দৈর্ঘ্যের ছাতের ফাটলের পানি ছিটকে ফেলবে ঢালু প্যাসেজে?
অবাক কাণ্ড! বলল লাবনী। আমাদের ক্ষতি হবে না।
এই পানি আসল ফাঁদ নয়, পেছনের প্যাসেজের ছাত দেখছে রানা। ওটা বিপদ! ফাটল ধরেছে ছাতে। হুড়মুড় করে নামছে জলোস। হয়তো ওটার সঙ্গে নেমে আসবে পাথরের ভারী সব ব্লক! লেজ তুলে পালাও!
আপনার মত আমার লেজ নেই! ঝেড়ে দৌড় দিল বেলা। বিড়বিড় করে যিশুর কাছে প্রার্থনা করছে: বাঁচাও তো, বাপু, পুরো দশটা মোটা মোমবাতি দেব তোমার চার্চে! খেয়াল রেখো, আমি মরলে কিন্তু পাবে না কিছুই!
ছাতে সাধারণ চুন-সুরকির বদলে ব্যবহার করা হয়েছে মিহি বালি ও গুঁড়ো লাইমস্টোন। তাতে যত্ন করে বসিয়ে দেয়া হয়েছে পাথরের ব্লক! ঠিকঠাক বসে ছিল এত হাজার বছর। কিন্তু ট্রিগারে চাপ পড়তেই নেমে আসতে শুরু করেছে বিপুল পানি। স্রোতে ভেসে যাচ্ছে লাইমস্টোন ও বালি। নড়ছে ভারী পাথরের ব্লক। ঠং-ঠাং শব্দে লাগছে পরস্পরের সঙ্গে। যে-কোনও সময়ে টুকরো টুকরো হয়ে নেমে আসবে ভাঙা ছাত।
কিন্তু তার চেয়েও বড় বিপদ, ঢালু প্যাসেজে বিপুল পানি তৈরি করেছে জোরালো স্রোত। ছাতের মতই হিসাব কষে মেঝেতেও বসিয়ে দেয়া হয়েছিল স্ল্যাব। পানির স্রোত এখন খেয়ে ফেলছে ওগুলোর মাঝের প্লাস্টার!
নিচের গভীর গহ্বরে ধুপ-ধাপ শব্দে পড়ল প্যাসেজের শুরুর কিছু স্ল্যাব!
ওরে, বাবা, মরে গেলাম! চড়ুই পাখির মত লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটছে বেলা।
জানের ভয়ে তিন সেকেণ্ডে ওর পেছনে পৌঁছে গেল রানা ও লাবনী। পাশাপাশি ছুটছে রকেটের বেগে। পেছন থেকে আসছে স্রোত।
ভারী জলধারা খসিয়ে ফেলছে পেছনের মেঝে!
দৌড়াতে দৌড়াতে রানা টের পেল, দেয়ালের পাশে রয়ে যাচ্ছে পেছনের নালা। কিন্তু এতই সরু, ওটা ধরে দৌড়াতে পারবে না ওরা!
আমার সামনে দৌড়াও! গলা ফাটাল রানা। তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভারী ও। প্যাসেজের পাথরের স্ল্যাব নিয়ে ওর পতন হলে সঙ্গে যাবে লাবনী আর বেলাও।
আর পারব না! পিছিয়ে পড়ছে লাবনী। তোমরা যাও!
বহু নিচের গহ্বরে গুড়ম! আওয়াজে পড়ল প্যাসেজের কিছু স্ল্যাব! যে-কোনও সময়ে ছাত থেকে পড়বে প্রকাণ্ড সব পাথরের ব্লক! নিচের মেঝেতে বইছে বানের মত ছয় ফুটি উঁচু শ্রোত! খলখল আওয়াজে তেড়ে যাচ্ছে রানাদের দিকে!
ঘুরেই লাবনীকে কাঁধে তুলে আবারও সামনের প্যাসেজে ছুটল রানা। খসে পড়ল পেছনের মেঝের স্ল্যাব। প্রাণপণে দৌড়ে চলেছে রানা। কিন্তু লাবনীকে সহ ওকে ভাসিয়ে নিল জোরালো পানির স্রোত। ছিটকে পড়ল সামনের মেঝেতে।
স্রোতের নিচে লাবনীকে নিয়ে গড়িয়ে চলেছে রানা। ওর তিন ইঞ্চি পেছনের পাথরের স্ল্যাব গিয়ে পড়ল গভীর গহ্বরে। লাবনীকে নিয়ে শেষ একটা গড়ান দিল রানা।
এবার পালা ওদের পতনের!
কিন্তু পেছনে গভীর গর্তে পড়ল প্যাসেজের মেঝের শেষ স্ল্যাব। বহু নিচ থেকে এল ভারী পাথর আছড়ে পড়ার জোর আওয়াজ। পরক্ষণে বিকট আরেক আওয়াজে ধসে গেল পুরো ছাত।
পাশেই কারুকাজ করা পিলার দেখল রানা।
ওরা বোধহয় আছে নতুন আরেক প্রস্থ প্যাসেজের মুখে!
কাছেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে কেউ, ঘুরে তাকাল রানা। চুনের মত ফর্সা হয়েছে বেলার মুখ। তবে অকৃত্রিম আনন্দের হাসি হেসে ফেলল রানা ও লাবনীকে দেখে। বন্যার পানিতে ভেজা মেঝে থেকে তুলে নিল ওর ফ্ল্যাশলাইট।
পেছনের প্যাসেজে তাকাল রানা। এখন আর ছাত নেই, মেঝেও নেই। ওটা এখন আর কোনও প্যাসেজই নয়!
উঠে বসল লাবনী, হাতে রয়ে গেছে জ্বলন্ত ফ্ল্যাশলাইট! কাঁধের ঝুলি থেকে আরেকটা নিয়ে এগিয়ে দিল রানার দিকে।
ফ্ল্যাশলাইটটা নিয়ে বাতি জ্বালল রানা।
ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে ওরা। চুপ করে বসে থাকল ভেজা পাথরের মেঝেতে। একটু দূরেই বড় এক পাথরের বোল্ডারে আঁকা ভয়ঙ্কর চেহারার শক্তিশালী এক ডাকাতনী। বড় বড় পা দিয়ে চ্যাপ্টা করছে পিঁপড়ে!
বুঝতে দেরি হলো না ওদের, এটা কোনও প্যাসেজ নয়। বড় কোনও ঘর। নতুন আরিত!
একটু দূরে ব্যারেলের মত মস্তবড় ধাতব দুই ফাটল ধরা রোলার। টুপ-টুপ করে ও-দুটো থেকে পড়ছে বানের পানির ফোঁটা। লেংচে লেংচে এখনও ঘুরছে রোলার।
ভূমিকম্পের জন্যে সম্ভবত নষ্ট হয়েছে ওসাইরিসের সমাধির কয়েকটা ফাঁদ। সময়ের আগেই ধসে গেছে প্যাসেজের মেঝে। যথেষ্ট স্রোত ওদেরকে আছড়ে ফেলতে পারেনি রোলারের ওপর, নইলে কিমা হয়ে যেত ওরা।
কেউ চোরের মত ঢুকলে পিষ্ট করবে শক্তিশালী মহিলা, বলল বেলা, কিন্তু আমরা ঢুকেছি আইনগতভাবেই। কিছুই করতে পারবে না পুরনো ওই দুই রোলার।
এত বড় পা-ওয়ালা কাউকে ভদ্রমহিলা বলতে পারব, বলল লাবনী।
ক্লান্তি ও ভারী ব্যাগের ওজনে পিঠ ভেঙে আসছে রানার। কাঁধে চোট পেয়েছে মেঝেতে গড়াবার সময়। শুকনো গলায় জানতে চাইল, তোমরা পরের আরিতের জন্যে রেডি তো?
বেলাকে দেখে নিয়ে বলল লাবনী, হ্যাঁ। কপাল ভাল। একইসময়ে পেরিয়ে গেছি দুটো ফাঁদ!
আরও তিনটে আছে, ঢোক গিলল বেলা।
পেছনে ফেলে এসেছি চারটে, সামনে কম, বলল রানা, তা হলে চলল, খুঁজতে যাই পরের আরিত।
উঠে রওনা হলো ওরা।
ঘর পেরোতেই সামনে পড়ল আবারও ঢালু প্যাসেজ।
হাঁটতে হাঁটতে বলল বেলা, নিচে কোথাও আছে বিকট শব্দের দেবী!
.
উল্টো পিরামিডের ওপরের ঘরে বাতাসে ওড়া বালি ছাড়া নড়ছে না কিছুই। মরুভূমির চারপাশ থমথমে নীরব। কিন্তু একটু পর উত্তর-পুর্ব থেকে এল হালকা একটা আওয়াজ।
বাড়তে লাগল ওই শব্দ।
দিগন্তে দেখা দিল ধূসর কিছু। তাপ বেশি বলে ঝলমল করছে দূরে মরীচিকা। পাক খেয়ে উড়ছে ধুলোর মেঘ। তবে বালিঝড় নয়। সে তুলনায় অনেক ছোট। সরাসরি আসছে পাথরের প্রাচীন কুটিরের দিকেই!
উড়ন্ত বালির মাঝে পাক খেয়ে উঠছে ধূসর-কালো কিছু। বাড়ছে ইঞ্জিনের চাপা আওয়াজ। সঁই-সাঁই করে ঘুরছে প্রচণ্ড বেগে প্রপেলার ব্লেড।
তবে ওটা কোনও এয়ারক্রাফ্ট নয়।
প্রকাণ্ড হোভারক্রাফট যুবর-ক্লাস অ্যাসল্ট ভেহিকেলের ব্রিজের জানালায় দাঁড়িয়ে আছে নাদির মাকালানি। ওর বাহন সহজেই বহন করতে পারে ট্যাঙ্ক ও অন্যান্য ভেহিকেল। চলতে পারে পৃথিবীর প্রায় সব কঠিন জমিতে। গ্রিক নেভি চারটে যুবর কিনলে তাদেরকে অনুকরণ করেছে মিশরীয় কর্তৃপক্ষ। ভূমধ্য এলাকার শত্রুদের ভয় দেখাতেই রাশানদের কাছ থেকে কেনা হয়েছে প্রকাণ্ড দুই যুবর।
অফিশিয়াল সার্ভিসে যাওয়ার আগে এখনও ট্রায়ালে আছে ওগুলো। এখান থেকে ষাট মাইল দূরে নির্জন এলাকায় হচ্ছে ট্রায়াল। তবে, ব্রিজের দ্বিতীয় লোকটা এদিকের মরুভূমিতে নিয়ে এসেছে এই যুবরটাকে।
দারুণ জিনিস, জেনারেল খালিদ আসিরকে বলল নাদির মাকালানি। কাজ শেষ হলে হয়তো এই জিনিস ধার দেবে আমাদের কোনও মন্দিরের জন্যে! তবে জানি না, পার্ক করব কোথায়।
যেখানে খুশি রাখবে, দোস্ত! হাসল জেনারেল আসির। কেউ আপত্তি তুললেও চিন্তা নেই, এটার সঙ্গে আছে রকেট লঞ্চার আর গ্যাটলিং গান। নিচে ফোর ডেকের টারেট দেখাল সে। কারও দিকে ছয় ব্যারেলের কামান তাক করলে চট করে বুজে ফেলে মুখ।
মৃত্যুভয় সব সময়েই কাজে আসে, তাই না? পরস্পরের দিকে চেয়ে মুচকি হাসল নাদির মাকালানি ও জেনারেল খালিদ আসির। আর কয় মাইল, দোস্ত?
বড়জোর এক মাইল, স্যর, বলল পাইলট।
গুড। ব্রিজের পেছনের ওয়েপন্স রুমে ঢুকল নাদির। উঁচু গলায় বলল, সামনেই কোঅর্ডিনেট।
এই ঘরে আছে কয়েকজন যুবর ক্রু, কাদির ওসাইরিস, কিলিয়ান ভগলার, ডক্টর লুকমান বাবাফেমি এবং নাদিরের দলের নতুন এক সদস্য।
ডক্টর মেটয, আপনি শিয়োর তো ঠিক জায়গা খুঁজে পেয়েছেন? আর্কিওলজিস্টের কাছে জানতে চাইল কাদির ওসাইরিস।
এর চেয়ে বেশি শিয়োর কখনও হইনি, তাকে সন্দেহ করা হচ্ছে বলে বিরক্ত ম্যান মেটয। যোডিয়াকের উল্টো পিরামিড, নীল নদ, রুপার ক্যানিয়ন আর ওসেইরেনের অবস্থান, সবই বলে দিয়েছে। নিজের ল্যাপটপ দেখাল সে। ওটায় এক উইণ্ডোতে মরুভূমির স্যাটেলাইট ইমেজ, দূরত্বের লাইনের মার্কিং ও ডিরেকশন, অন্য উইণ্ডোতে আইএইচএর বিশাল ইজিপশিয়ান ডেটাবেস ও ওসেইরেনের ওসাইরিসের চোখের ইমেজ। হয় ওখানে থাকবে ওই পিরামিড, নয়তো কখনও কোথাও পাওয়া যাবে না খুঁজে।
পাওয়া গেলেই আপনার ভাল, হুমকির সুরে বলল নাদির মাকালানি।
বিরক্তি আরও বাড়ল ম্যান মেটয-এর। গম্ভীর কণ্ঠে বলল, পয়সা নিলে নিজ কাজ ঠিকভাবেই করি। কাজেই দয়া করে হুমকি দিতে আসবেন না। কাদির ওসাইরিসের দিকে তাকাল সে। অবাক কাণ্ড, আজ থেকে মাত্র দুসপ্তাহ আগেও আমাকে কিনতে চাইলে, এককথায় উড়িয়ে দিতাম আপনার প্রস্তাব। …কিন্তু আজ? স্ফিংসের ওই দুর্ঘটনার পর আমিও চাই আমার প্রাপ্য বুঝে নিতে। চাপা রাগে বিকৃত হলো তার মুখ। দুনিয়ার সব দৈনিক পত্রিকায় ছাপার কথা ছিল আমার ছবি, কিন্তু তার বদলে ওখানে থাকল ডক্টর লাবনী আলম। আমাকে হাস্যকর বাঁদর বানিয়ে ছেড়েছে সে। এখন যথেষ্ট টাকা পেলে একটু কমবে আমার ক্ষতি।
ওয়েপন্স অফিসার ডাকতেই ঘরে ঢুকল খালিদ আসির। মনিটরে কী যেন দেখাল ওয়েপন্স অফিসার।
ভুরু উঁচু করল কাদির ওসাইরিস। ডক্টর মেট্য, আপনি লাবনী আলমের কথা তুললেন বলে একটু অবাকই লাগছে।
অবাক লাগছে কেন?
কারণ, আমার ভুল না হলে আবারও আপনাকে হারিয়ে দিয়েছে সে। আকাশের ড্রোন থেকে যুবরে আসছে ইমেজ। সিকি মাইল দূরে এক নালায় পড়ে আছে পুরনো এক তুবড়ে যাওয়া ল্যাণ্ড রোভার ডিফেণ্ডার।
ওদিকে হোভারক্রাফটের টার্গেটিং সিস্টেম দেখাচ্ছে পাথুরে দালানে কয়েকটা কোদাল। লোহার তৈরি যে-কোনও জিনিসের ওপর লক হয় ওয়েপেনারি কমপিউটারের কার্সার।
ও, আগেই পৌঁছে গেছে বেটি? মনিটরে চোখ রেখে রাগে লাল হলো ডক্টর মেটয।
তাকে দেখে বাকা হাসছে ভগলার।
প্রতিযোগী হলেও এখন কাজ করছে আমাদের জন্যেই, বলল কাদির, আশপাশে কেউ নেই। তার মানে, পিরামিডে ঢোকার পথ খুঁজে বের করেছে সে। কষ্ট করে একগাদা বুলডোর বা ডিগার আনতে হবে না!
ব্রিজে গিয়ে দাঁড়াল কাদির ওসাইরিস। পিছু নিয়ে ওই ঘরে ঢুকল নাদির মাকালানি ও ভগলার। সামনে বিছিয়ে আছে ফ্যাকাসে হলদে মরুভূমি। একটু দূরেই পাথরের কুটিরের মত দালান। পাঁচ শ টন হোভারক্রাফটের বেগ কমাল পাইলট। স্টার্নের ওপরে হ্রাস পেল ঘুরন্ত তিন বিশাল প্রপেলারের গতি।
আপনার লোক সম্পূর্ণ বিশ্বস্ত? খালিদ আসিরের কাছে জানতে চাইল কাদির ওসাইরিস। একবার সরকারের কানে এ বিষয়ে কিছু পৌঁছুলে…
খালিদের হয়ে তোমাকে কথা দিচ্ছি, দৃঢ়কণ্ঠে বলল নাদির। আগেও আমার জীবন বাঁচিয়েছে ও।
আর আমার লোকের হয়ে শপথ করছি, বলল জেনারেল আসির। মাত্র কয়েকজনকে এনেছি। নিজে বেছে নিয়েছি তাদেরকে। বাঁকা হাসল সে। যথেষ্ট টাকা পাচ্ছে, কাজেই আপনার সবই গোপন রাখবে ওরা।
গুড। প্রাচীন কুটিরের দিকে ফিরল কাদির। শেষ কফুট এগিয়ে থামল যুবর। প্রকাণ্ড রাবারের কুশন চেপে বসল বালির ওপর। ভুস্ করে চারপাশে ছিটে গেল একরাশ বালি। বেশ, চলুন, ওসাইরিস আর ডক্টর লাবনী আলমকে খুঁজে বের করি।
.
২৪.
বাপরে! গহ্বরে আলো তাক করে ওপরে ঘুটঘুটে কালো ছাড়া আর কিছুই দেখছে না লাবনী। এত উঁচু!
জানো, আছি কোথায়? দূরের দেয়ালে দুটো পাইপ দেখছে রানা। ওপরের সেতুর যন্ত্রপাতি কাজ করলে এতক্ষণে এই মেঝেতে থাকত আমাদের ফাটা লাশ। অন্তত দু শ ফুট ওপরে ওই সেতু।
মনের খাতায় পুরো পিরামিড এঁকে নেয়ার চেষ্টা করল লাবনী। সর্বনাশ! তা হলে তো এটা গ্রেট পিরামিডের সমান! বা আরও বড়!
ওই কারণেই পরে আর কোনও রাজা খুফুর পিরামিডের মত বড় কিছু তৈরি করতে চায়নি, চিন্তিত স্বরে বলল বেলা। কিন্তু ওই পিরামিড যদি ওসাইরিসেরটার সমানও হয়, অন্যরা হয়তো সাহসই পায়নি ওসাইরিসকে ছোট করার।
পাইপে মনোযোগ দিয়েছে রানা।
ওগুলো সংযুক্ত। একটা বেশ সরু। তবে গোড়ার কাছে মোটা, গিয়ে মিশেছে অনুভূমিক এক টে। ওপরে আঁকা মস্ত হাঁ করা এক মহিলার মুখ
চার্চের অর্গানের মত, বলল রানা, বাতাস কোনওভাবে ভেতরে পাঠালে শুরু হয় জোরালো আওয়াজ।
খুলে বলো কীভাবে কী হয়, বলল লাবনী।
অন্য টিউবে কিছু পড়লে তখন ওটা কাজ করে পিস্টনের মত। পাইপের কাছেই একটা প্যাসেজ। ধাতব গেট আছে। আপাতত বন্ধ। আমার ধারণা, ওই গেট খুললেই চালু হবে ফাঁদ। এই ঘর জুড়ে আরম্ভ হবে প্রচণ্ড আওয়াজ।
তো কী করা উচিত? চিন্তিত চেহারায় রানাকে দেখল লাবনী।
গেটের দিকে চলল রানা।
সাবধান, রানা! সতর্ক করল লাবনী।
গেট খুলছি না। তবে চাই ট্রিগার করতে যন্ত্রটা।
কিন্তু গেট না খুললে… শুরু করেছিল বেলা…
কিন্তু রানার পায়ের নিচে চাপ খেয়ে ডেবে গেল এক স্ল্যাব।
সর্বনাশ, ফ্যাকাসে চেহারায় রানাকে দেখল লাবনী।
জলদি অন্য প্যাসেজে ঢোকো! ফিরতি পথে পা বাড়াল রানা। ওর দেখাদেখি লাবনী ও বেলা।
কিন্তু প্রথম প্যাসেজের মুখে সড়াৎ করে নেমে এল দ্বিতীয় গেট। দেখতে জেলের শিকের তৈরি দরজার মত। ভয় পেয়ে এক পা পিছিয়ে গেছে বেলা। শুরু হয়েছে গভীর ও বিষণ্ণ এক চাপা আওয়াজ। খুব দ্রুত বাড়তে লাগল ওটা।
একটু দূরে যেন চালু হয়েছে জেট ইঞ্জিন।
স্লট থেকে বেরোল দমকা হাওয়া। দীর্ঘ পাইপে বাড়ি খেয়ে বাড়ছে আওয়াজ। যেন থরথর করে কাঁপছে গোটা ঘর। মেঝে থেকে লাফিয়ে উঠছে ধুলোবালি। দেয়াল থেকে খসে পড়ছে রঙ ও প্লাস্টার।
মানসিক ও শারীরিক কষ্টে পড়েছে রানা, লাবনী ও বেলা। ফুঁপিয়ে উঠল লাবনী, হায়, আল্লা! আর সহ্য করতে পারছি না! কেমন যেন করছে ওর বুক। সেই সঙ্গে বমি-বমি ভাব। বুম! বুম! শব্দে কাঁপছে সারাশরীর। দুহাতে গেটের নিচের শিক ধরে প্রাণপণে ওপরে তুলতে চাইল। কিন্তু উঠল না ভারী গেট।
ওদিকের গেটের সামনে পৌঁছে গেছে রানা। ওর পক্ষেও সম্ভব হলো না শিকের দরজা তোলা। পাইপের দিকে ঘুরে তাকাল। চিৎকার করে বলল, স্লটে কিছু গুঁজে দিতে হবে!
বজ্রপাতের মত বিকট শব্দের মাঝে রানার কথা প্রায় শুনতেই পায়নি লাবনী। অবশ্য, বুঝেছে কী করতে হবে। ব্যাকপ্যাক নামিয়ে মেঝেতে ফেলল ভেতরের সব। বেছে নিল নাইলনের দীর্ঘ দড়ি। ওটা দিয়ে তৈরি করছে বল। একই কাজ করল বেলা। ওদিকে পাইপের সামনে পৌঁছেছে রানা। প্রচণ্ড অস্বস্তিতে কুঁচকে গেছে চেহারা। নিজের ব্যাগ থেকে জ্যাকেট নিয়ে বল তৈরি করে খুঁজে দিল সুটে। বাতাস বেরোবার পথ আটকে যাওয়ায় আরও তীক্ষ্ণ হয়ে সামান্য পাল্টে গেল আওয়াজের তীব্রতা।
থরথর করে কাঁপছে পাথুরে মেঝে। টলতে টলতে রানার কাছে পৌঁছুল লাবনী ও বেলা। ওদের বাড়িয়ে দেয়া নাইলনের বল নিয়ে স্লটে ঠাসল রানা।
হাত থেকে ফ্ল্যাশলাইট ফেলে দুহাতে কান চেপে ধরল লাবনী। অন্যরাও আছে মস্ত বিপদে। কান চেপে ধরলেও রক্ষা নেই। বুকে ঢুকে যেন সব ছিঁড়ে ফেলছে ভয়ঙ্কর আওয়াজ।
কাঁপছে পিরামিড। ওপরের বিশাল গহ্বর থেকে ঝরঝর করে ঝরছে চুন-সুরকি। নিচের মেঝেতে ঠুস্-ঠাস-ধুম শব্দে পড়ছে ছোট-বড় পাথর! প্যাসেজের দেয়ালে তৈরি হচ্ছে ফাটল। এই বিকট আওয়াজ না থামলে মস্তবড় ক্ষতি হবে ওসাইরিসের পিরামিডের।
দড়ির বল ও জ্যাকেটের গোলা স্লটে আরও ঠেসে দিল রানা, কানের ব্যথায় খিঁচিয়ে গেছে মুখ। ওপরের দিকে বন্ধ করা পাইপ অর্গ্যান। বাতাস শুধু বেরোচ্ছে স্লটের মাধ্যমে। এখন কোনওভাবে তীব্র বাতাস ঠেকাতে পারলে…
একটু একটু কমছে কম্পনের মারাত্মক রণন। রানা বুঝে গেছে, প্রাণে বাঁচতে হলে দড়ির বল ও জ্যাকেটের গোলা আরও ঠেসে রাখতে হবে। বাতাস ফুরালে থামবে বিপজ্জনক মেশিনের গর্জন।
তিরতির করে কাঁপছে পাইপ। ভয়ঙ্কর চাপ তৈরি করছে ভেতরের বাতাস। অর্গ্যানের মুখে জেহ্যামারের মত প্রচণ্ড বাড়ি দিল কমপ্রেসড় বাতাস। স্লট থেকে ছিটকে বেরোল গুঁজে রাখা কাপড় ও দড়ি। ওগুলোর ধাক্কা খেয়ে পেছনের মেঝেতে পড়ে চিতপাত হলো রানা। প্রকাণ্ড দানবের বিশ্রী কাশির মত বিকটভাবে খুক করে উঠল অর্গ্যান। এত ভয়ানক ভারী শব্দ আগে জীবনেও শোনেনি রানা। ওকে কোলে নিয়ে হরিকম্প করছে মেঝে। নতুন উদ্যমে চলল ভীষণ গম্ভীর হুঙ্কার। দেয়াল থেকে পড়ছে প্লাস্টার, ফেটে যাচ্ছে মেঝে।
লাবনী ও বেলাকে মেঝেতে কুঁকড়ে থাকতে দেখল রানা। নিজে ধড়মড় করে উঠে কুড়িয়ে নিল ফ্ল্যাশলাইট। হামাগুড়ি দিয়ে এগোল। পাইপের নিচের অংশে ফেলল আলো। সুট আটকে কাজ হয়নি, কিন্তু নিশ্চয়ই কোনও উপায় আছে এই ইস্রাফিলের শিঙা বন্ধ করার!
কানের কনকনে ব্যথা সহ্য করেও বিড়বিড় করল রানা, তুমি হয়েছ মিউযিক ইন্সট্রুমেন্টের কারিগর? পরক্ষণে ভাবতে লাগল, কীভাবে তৈরি করা যায় অর্গ্যান।
দুই পাইপের একটায় আছে পিস্টন। ওটা পড়তে শুরু করলে চাপ খেয়ে নিচে ছুটবে বাতাস। কিন্তু বেরোবার পথ সংকীর্ণ, তাই পিস্টনের পতনের গতি কমিয়ে দেবে বাতাস। ওদিকে অর্গ্যান পাইপের নিচে বালিঘড়ি আকৃতির চিমটা আরও কমিয়ে দেবে বাতাস বেরোবার পথ।
তৈরির নিয়মটা মনে পড়তেই রানা বুঝল, কী করতে হবে ওকে। হামাগুড়ি দিয়ে গেল ব্যাগের কাছে। বের করে নিল হাতুড়ি। আবার ফিরল তীব্র অথচ ভারী আওয়াজের অর্গ্যানের কাছে। জানে, চিৎকার করলেও নিজের কানেই পৌঁছাবে না তা।
একদিকের দেয়ালে চড়চড় করে ধরল ফাটল। ঝরঝর করে ঝরল চুন-সুরকি ও পাথরের চল্টা।
পরক্ষণে অর্গানের পাইপে হাতুড়ি নামাল রানা।
ধাতুর জিনিসটায় তৈরি হলো সামান্য ফাটল।
স্লট থেকে এল করুণ এক তীক্ষ্ণ, প্রলম্বিত আর্তনাদ।
আবারও পাইপে হাতুড়ি নামাল রানা।
আবারও!
এবার বড় ফাটল ধরল পাইপে।
বড় ঢেকুর তোলার শব্দে ভু-ভু করে বেরোচ্ছে। বাতাস। দ্রুত কমতে লাগল গম্ভীর আওয়াজ।
ঝনঝন করছে মাথা, মেঝেতে বসে পড়ল রানা। এখনও চলছে জেট ইঞ্জিনের আওয়াজ। কিন্তু অন্যরকম আওয়াজও পেল।
খটাং-খটাং-খটাং!
বাড়ছে ওই শব্দ। আসছে ওর দিকেই!
ভয় পেয়ে একপাশে ডাইভ দিল রানা। পরক্ষণে যেখানে ছিল, সেজায়গার ওপর দিয়ে উড়ে গেল পাইপের ভাঙাচোরা, ধারালো অসংখ্য টুকরো। পাইপে আছে খুব ভারী, তীব্রগতি কিছু, ওটা ধুম করে মেঝেতে পড়ে তৈরি করল ছোটখাটো এক শুকনো পুকুর।
পিস্টন!
বাতাস বেরিয়ে যেতেই ওটাকে ঠেকাবার কিছুই ছিল না। তুমুল বেগে নেমে এসেছে মাধ্যাকর্ষণের টানে।
তবে ওই মহা পতনের পাঁচ সেকেণ্ড পর আপত্তিকর ছোট তিনটে পুট-পুট-ফ্যাড়াৎ শব্দে চিরকালের জন্যে চুপ মেরে গেল দেবতা-রাজা ওসাইরিসের প্রলয়ঙ্করী অর্গান!
মেঝেতে উঠে বসল রানা। ফুট পাঁচেক দূরে লাবনী ও বেলা। ওর দিকেই চেয়ে আছে। চোখে কেমন এক লজ্জা।
সবার আগে মুখ খুলল লাবনী, কানে কিছু শুনছ, রানা বা বেলা?
কান ঝনঝন করছে, কিন্তু শুনছি, বলল বেলা।
উঠে বসেছে ওরা দুজন।
রানা? আবারও বলল লাবনী।
হু। ফ্ল্যাশলাইট কুড়িয়ে নিল রানা। তোমরা সুস্থ?
নীরবে মাথা দোলাল লাবনী ও বেলা।
উঠে ওদিকের গেটের সামনে গেল রানা। চেষ্টা করল শিকের গরাদে ওপরে তুলতে।
ভারী!
তবে এবার উঠছে।
গেট রেখে আবার ফিরল রানা।
নীরবে যে যার ব্যাগে ভরল দরকারি জিনিসপত্র। ব্যাগ পিঠে ঝুলিয়ে ফিরল গেটের সামনে।
রানা গেট ওপরে তুলতে ওদিকে চলে গেল লাবনী ও বেলা। ওরা দুজন মিলে তুলে রাখল গেট। এ সুযোগে ওদের পাশে পৌঁছে গেল রানা। ওরা গেট ছেড়ে দিতেই জোরালো ঠং! শব্দে মেঝেতে পড়ল ওটা।
পেছনের ধ্বংসস্তূপ দেখল রানা। পাঁচটা গেছে, এখনও বাকি দুটো ফাঁদ।
পরের দুটোর নাম বেশি ভয়ঙ্কর, দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়ল বেলা। ওপরের দেয়ালে লেখা: বিকট আওয়াজের দেবী ছেড়ে দিলে গিয়ে পড়বে রক্ত-মাংস ছিটকে দেয়া ভয়ঙ্কর যন্ত্রের পরীক্ষায়। ওটা পেরোলেও রক্ষা নেই, ওসাইরিসের কাছে যাওয়ার আগে সামনে পড়বে মাথা-কাটা যন্ত্র।
ওগুলোও পেরোব, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই বলল লাবনী। মনে মনে বলল, মরতেও ভয় পাই না। পাশে রানা আছে
ওই দুই যন্ত্র পেরোলেই পাব ওসাইরিসের দেখা, বলল বেলা।
রানার সঙ্গে পরের প্যাসেজে পা বাড়াল ওরা।
.
ওসাইরিসের পিরামিডে রানারা যে স্তরে আছে, তা থেকে কমপক্ষে দু শ ফুট ওপরে কম্পিত মহিলার কক্ষে নেমেছে কাদির ওসাইরিস। বিশাল অর্গানের পাইপের তৈরি ভয়ঙ্কর শব্দে বাতাসে ভাসছে মিহি ধুলো।
বুঝতে পারছি কোথা থেকে আসছে ওই আওয়াজ, মস্তবড় কূপে ফ্ল্যাশলাইটের আলো পাঠাল কাদির ওসাইরিস। তার পিছু নিয়ে গহ্বরের কিনারায় থামল দলের অন্যরা। কারও কারও পরনে মিলিটারির পোশাক, ওয়েবিঙে নানা ইকুইপমেন্ট ও অস্ত্র-গোলাবারুদ। কিন্তু সৈনিক নয় তারা। অবশ্য, কৌতূহল মেটাতে কাদির ওসাইরিসের সঙ্গে এসেছে জেনারেল আসির। তার দলের লোক বাইরে অপেক্ষা করছে হোভারক্রাফটে। পিরামিডে যে দল নেমেছে, তারা ওসাইরিয়ান টেম্পলের সদস্য। নাদির মাকালানির ব্যক্তিগত সিকিউরিটি ফোর্স।
বহু নিচের আঁধার দেখল নাদির। কোনও ফাঁদ। ওটা ট্রিগার করেছে রানা, ডক্টর আলম বা ওই মেয়ে। অশুভ হাসল সে। আমার মন দুভাগে ভাগ করা, বুঝলে, বড়ভাই? দারুণ হতো না, ওরা ফাঁদে পড়ে মরল, আর নিরাপদে ওই জায়গা পেরিয়ে গেলাম আমরা? আবার মন চাইছে, বেঁচে থাকুক ওরা। যাতে নিজ হাতে ওদেরকে খুন করতে পারি।
বড় কথা, ওরা যেন এখান থেকে বেরোতে না পারে, বলল কাদির ওসাইরিস। ঘুরে দেখল ডক্টর ম্যান মেট্যকে। এই ঘর দেখে কী বুঝছেন?
এই ঘরের হায়ারোগ্লিফিক্স অনুযায়ী, প্রতিটি আরিতে আছে বুবি ট্র্যাপ। দাঁতওয়ালা বড় এক চাকা দেখাল মেট। আমার ভুল না হলে ওটাই বোধহয় কম্পিত মহিলা। ওরা পেরোবার সময় চালু হয়ে গিয়েছিল ওটা। তবে মরেনি ওরা।
তার মানে নিচেও পড়েনি? দুঃখের সুরে জানতে চাইল ডক্টর লুকমান বাবাফেমি।
আওয়াজ শুনছেন? ওটা প্রচণ্ড আওয়াজের দেবীর হুঙ্কার! তার মানে পঞ্চম স্তর। অন্তত ওই পর্যন্ত পৌঁছে গেছে তারা।
অর্থাৎ, ওই পর্যন্ত বিপদ হবে না আমাদের, বলল কাদির ওসাইরিস। পা রাখল সেতুর ওপর।
আপনি ঠিক জানেন, বিপদ হবে না তো? কাঁপা গলায় বলল বাবাফেমি।
আরেক পা এগোল কাদির। নড়ল না সেতু। নষ্ট করা হয়েছে ফাঁদ, বা বিকল ছিল।
সামনে বাড়ো, কাদির, বলল নাদির মাকালানি। তার ভাই সেতু পেরিয়ে যেতেই অন্যদেরকে পার হতে ইশারা করল। সামনে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা পড়লে ভয়ের কিছু নেই। দরকারি সব ইকুইপমেন্ট সঙ্গে নিয়েছি আমরা।
খড়খড় আওয়াজ তুলল দাঁতওয়ালা দুই চাকা। একটু সরে গেল পাথরের একটা টুকরো। খেয়াল করল না কেউ।
সামনে কারুকাজ করা পিলার দেখেই রানা বুঝল, ওরা পৌঁছে গেছে ষষ্ঠ আরিতে। লাবনী-বেলা, আমরা এখন আছি রক্ত মাংস ছিটকে দেয়া ভয়ঙ্কর যন্ত্রের সামনে। সতর্ক হয়ে পেছনে আসবে।
প্যাসেজে আলো ফেলল রানা ও লাবনী। এই প্যাসেজ সমতল। দুপাশের দেয়ালে ভয়ঙ্কর অশুভ চেহারার সর প্রাচীন দেবতা, যেন প্রতিযোগিতা করছে নিজেদের ভেতর কে বেশি ভয় দেখাতে পারে। বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে, একবার ভুল হলে উপায় নেই বাঁচার। তবে নতুন অন্যকিছুও আছে। প্যাসেজে।
ওটাও খুব অশুভ।
দেয়ালের নানান উচ্চতায় অনুভূমিক সব সুট। ওপরের দিকে এবং নিচে জং-ধরা লালচে লোহার পাত।
কাছের স্লটে আলো ফেলল রানা। ভেতরে দীর্ঘ ধাতব কিছু। একমাথায় কবজা, আরেকদিক ক্ষুরের ফলার মত ধারালো। এসব গর্তে আছে নানান অস্ত্র। প্যাসেজ ধরে হাঁটলেই স্লট থেকে ছিটকে বেরিয়ে গাঁথবে শরীরে।
জং-ধরা, বলল বেলা। হয়তো কাজ করবে না।
ঝুঁকি নিতে চাও? কড়া চোখে বেলাকে দেখল লাবনী। এসব সুট দৈর্ঘ্যে প্যাসেজের সমান। এদিক ওদিক সরে বাঁচার উপায় নেই। পার হব কীভাবে? রানার দিকে তাকাল
ব্যাকপ্যাক নামিয়ে ওটা থেকে এক খণ্ড কাঠের টুকরো নিল রানা। হাত বাড়িয়ে ওটা দিয়ে টোকা দিল মেঝেতে। রানা আহত হবে ভেবে ভয়ে নাক-মুখ কুঁচকে ফেলেছে লাবনী। এই বুঝি হাতে বিঁধল ধারালো কিছু!
কিন্তু কিছুই ঘটল না।
প্যাসেজের মুখে থেমে আবারও কাঠের টুকরো ঠুকল রানা। না, ট্রিগার আছে আরও দূরে। উঠে দাঁড়াল ও।
তার মানে মাঝে গেলেই, তখন… ঢোক গিলল বেলা।
প্যাসেজের শেষমাথা চল্লিশ ফুট দূরে। তাতেই শেষ। হয়নি প্যাসেজ। বাঁক ঘুরে চলে গেছে আরেক দিকে।
এসব অস্ত্র ট্রিগার না করে প্যাসেজ পেরোবার উপায় আছে? বলল লাবনী।
কাঠের টুকরো হাতে বলল রানা, দেখা যাক উপায় আছে কি না। প্যাসেজে কয়েক ফুট দূরের মেঝেতে কাঠের টুকরো ছুঁড়ল ও। আগের জায়গায় রয়ে গেল সব ফলা। আশা করি, অন্তত ওই পর্যন্ত আমরা নিরাপদ। কপা সামনে বাড়ল রানা।
আন্দাজে কিছু কোরো না, ভয়ে কাঁপছে আমার বুক, নালিশের সুরে বলল লাবনী।
এবার ব্যাকপ্যাক থেকে ভারী এক হাতুড়ি নিল রানা।
এবার কী? বলল লাবনী। একটু করে এগোবে আর কিছু না কিছু সামনে ফেলবে? কিন্তু বুঝবে কী করে, কোটা আসলে ট্রিগার? তারপর হঠাৎ করে… হাত দিয়ে গলা কেটে ফেলার ভঙ্গি করল ও।
তো তুমিই বলো কী করা উচিত? ভুরু নাচাল রানা। কথা বলে প্যাসেজ পেরোতে পারবে না।
আমরা হেঁটে যাব না, হঠাৎ করে বলল বেলা। মন দিয়ে দেখছে হায়ারোগ্লিফিক্স। দৌড়াতে হবে মুরগি-চোর শেয়ালের মত! লিখেছে, প্যাসেজ ধরে হেঁটে গেলে মরবে ভয়ঙ্কর কষ্ট পেয়ে। শেষ লাইনে লেখা: দৌড়াও ওসাইরিসের সঙ্গে দেখা করতে!।
সূত্র দিয়েছে? অবাক সুরে বলল লাবনী, আগের কোনও আরিতে তো এমন কিছু ছিল না!
মাত্র ক লাইন, মোটা কালিতে লেখা অক্ষর দেখাল বেলা। নামার সময় সব দেখতে দেখতে এসেছি। কিন্তু হয়তো চোখ এড়িয়ে গেছে দরকারি হায়ারোগ্লিফিক্স। সূত্র ছিল। এবারেরটা তো পরিষ্কার দেখছি চোখের সামনে।
তো প্রাণপণে দৌড়াতে হবে, আবারও প্যাসেজে আলো ফেলল রানা। ঝুঁকি আছে। অবশ্য, এ ছাড়া উপায়ও নেই। ওদিকে বাঁক নেয়ার পর কী আছে, তা জানো, বেলা?
সম্ভবত ওদিকে আছে মাথা-কাটা যন্ত্র, শিউরে উঠল বেলা। কচু করে কেটে নেবে আপনার কল্লাটা, তারপর…
আমার মাথা নিয়ে এত ভাবতে হবে না, বিরস সুরে বলল রানা। ব্যাকপ্যাকে রেখে দিল ভারী হাতুড়ি। তা হলে হরিণের মত দৌড়াব আমরা, ঠিক আছে?
হ্যাঁ, সায় দিল বেলা।
হু, বলল বিমর্ষ লাবনী, আর মরে গেলে পরজগতে গিয়ে লাথি মেরে ফাটিয়ে দেব বেলার নরম পাছা।
অলিম্পিকের দৌড়বিদের ভঙ্গিতে তৈরি হয়ে গেল রানা। বেলা? লাবনী? রেডি?
মাথা দোলাল লাবনী ও বেলা।
ঠিক আছে, ওয়ান, টু… থ্রি!
প্যাসেজে পাশাপাশি উড়ে চলল ওরা।
নড়ল না বা সামনে বাড়ল না একটা ফলাও।
প্যাসেজের দূরে গিয়ে পড়ল রানার হাতের ফ্ল্যাশলাইটের আলো। ওদের জুতোর নিচে মেঝে থেকে উঠছে ঠ-ঠপ ফাপা আওয়াজ।
দশ ফুট পেরিয়ে গেল ওরা।
বিশ।
প্রতিধ্বনি তুলছে পদধ্বনি।
পেরোল ওরা ত্রিশ ফুট।
ঝড়ের বেগে এগিয়ে আসছে বাঁক…
লাবনীর পায়ের নিচে কড়মড় করে উঠল ধুলোভরা একটা ব্লক। আত্মা কেঁপে গেল ওর। দৌড়ে চলেছে। দেয়ালের সুট থেকে এল না কোনও অস্ত্র।
তবে পেছনে হলো বিদঘুটে এক আওয়াজ।
কাঁচকোঁচ শব্দে ঘুরছে কোনও মেশিন।
খট-খট করে পড়ল ধাতুর ওপর ধাতু।
চলছে বোধহয় কাউন্ট ডাউন!
আরও জোরে! বাঁকের খুব কাছে পৌঁছে গেছে রানা। প্রায় একইসময়ে বাঁক ঘুরল ওরা। থমকে গিয়ে ঘুরে পেছনে তাকাল রানা।
তীরধনুকের ছিলা টেনে ছেড়ে দেয়ার আওয়াজ হলো: সক্ল্যাং!
প্যাসেজের শুরুর স্লট থেকে ছিটকে বেরোল জং-ভরা ধারালো বর্শার সব ফলা। সামনে বেড়ে ঝুলে গেল কয়েকটা তলোয়ার। বর্শাগুলো ঠং-ঠং করে লাগল ওদিকের দেয়ালে।
হাজারো বছরে কমেছে দক্ষ কারিগরের তৈরি মরণ ফাঁদের কার্যকারিতা, ভাবছে রানা। তবুও প্যাসেজে কেউ থাকলে খুন হতো!
কিন্তু কে বলেছে নষ্ট হয়েছে ফাঁদের কার্যকারিতা?
লাবনী-বেলা! শুকনো গলায় তাড়া দিল রানা। নিজে ছুট দিয়েছে সামনের প্যাসেজ ধরে। পেছনে এল মেয়েদুটো। প্যাসেজের এদিকেও আছে ওই একই মারাত্মক সুট!
কানের কাছে ঠং-ঠং শুনল ওরা। ভেবেছিল বাঁক নিলেই আগের প্যাসেজ শেষ। তা নয়! খেয়াল করেনি সামনে নতুন আরিতের কারুকাজ করা পিলার নেই।
তীরের মত ছুটে প্যাসেজে আরেকবার বাঁক ঘুরেই রানা বুঝল, নতুন এ প্যাসেজেই আছে মাথা-কাটা যন্ত্র!
তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলোয় পড়েছে ওরা!
প্যাসেজে আরিতের কারুকাজ করা পিলার। একটু দূরে দুদেয়ালে চকচকে কী যেন!
গলার উচ্চতায় মুখোমুখি দুটো সুট!
রানা বুঝে গেল, দেয়ালের ওই দুই অংশে বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে ওদের গর্দান নেয়ার!
পেছনের প্যাসেজের ধারালো বর্শা ও তলোয়ারের খপ্পর থেকে বাঁচতে প্রাণপণে ছুটতে ছুটতে, পেরিয়ে গেছে নতুন আরিতের পিলার!
নিজেদেরকে রক্ষা করতে মহা দুষ্ট জিনের মত লাবনী ও বেলার কাঁধে চাপল রানা। মেঝে থেকে তুলে নিয়েছে পা। ভারী ওজন চেপে বসতেই হুমড়ি খেল বেলা। একইসময়ে লাবনীকে নিয়ে মেঝেতে পড়ল রানা। একটু দূরেই সপ্ত আরিত শেষ। ওদের ওপর দিয়ে সাঁই করে গেল ঘুরন্ত দুই ধারালো ধাতব ডিস্ক। বারবার খটাং-খটাং আওয়াজে লাগছে চারপাশের দেয়ালে। যে-কোনও সময়ে কেটে বসবে ওদের শরীরে।
মুখ গুঁজে পড়ে থাকল ওরা। আরও বেশ কবার ওদের ওপর দিয়ে গেল দুই ডিস্ক, তারপর সামনের দেয়ালে লেগে পড়ল প্যাসেজের পাশে। এখনও ঘুরছে বনবন করে।
শয়তান মিশরীয় পিশাচ! ভয়ে কেঁদে ফেলেছে লাবনী। খুনি… ইবলিশ… হারামজাদা…
গালির স্টক শেষ হওয়ার আগে নিজের কাছে কিছু রাখো, উপদেশ দিল রানা। মেঝে ছেড়ে উঠে গেল পেছনের এক স্লটের সামনে। ভেবেছিল সহজে পাবে না তলোয়ার, কিন্তু টান দেয়ায় বেরিয়ে এল স্লট থেকে। হাজার হাজার বছরের জং-ধরা কবজা খতম করে দিয়েছে মেকানিযম। বেরোবার সময় কোনও সমস্যা হবে না।
জিতে গেছি! দৌড়ে আসায় এখনও হাঁফাচ্ছে বেলা। এটাই শেষ বুবি ট্র্যাপ! রানার দিকে তাকাল অনিশ্চিত চোখে। ঠিক বলছি তো?
আমি কী জানি! হেসে বলল রানা, হায়ারোগ্লিফিক্স পড়েছ তুমি, আমি তো নই।
হায়ারোগ্লিফিক্স অনুযায়ী আর কোনও ফাঁদ নেই, বলল লাবনী। তবুও ভীষণ সতর্ক। দেখছে চারপাশ। উঠে দাঁড়াল।
তা হলে চলো, একটু দূরের বাঁক দেখাল রানা।
নতুন করে এগিয়ে চলল ওরা।
মোড় ঘুরে পেল নিচে যাওয়ার ঢালু প্যাসেজ। অবশ্য, মাত্র দশফুট যেতেই পড়ল আবারও কারুকাজ করা পিলার।
আরিতের পিলার নয় ওগুলো।
অন্য কিছু।
সোনার তৈরি! জটিল কারুকাজ করা!
ফ্ল্যাশলাইটের উজ্জ্বল আলোয় ঝিকঝিক করছে সোনা।
নিরেট সোনার পিলার, বলল লাবনী, আগে কখনও এ জিনিস দেখিনি!
হাঁ হয়ে গেছে বেলা। কসেকেণ্ড পর বলল, বলুন তো, কত টাকার গহনা বানানো যাবে?
চুপ! চোখ পাকিয়ে ধমক দিল লাবনী। গহনা? কীসের গহনা! এসব হচ্ছে দুনিয়ার সেরা দামি আর্টিফ্যাক্ট!
দুটো করে পিলারের মাঝে একটা করে মিশরীয় দেবতার মূর্তি। তা-ও সোনার তৈরি। ওপরের প্যাসেজে যেসর ভয়ঙ্কর চেহারার দেবতা দেখেছে ওরা, এরা তেমন নয়। একটু দূরেই উঁচু হেডড্রেস পরা দুই দীর্ঘদেহী মামি, কাপড়ে পেঁচিয়ে রাখা। দুহাতে কী যেন অস্ত্র, চিনল না ওরা। মুখে মুখোশ নেই, পুরনো তামার মতই সবজেটে ত্বক। দেহের এখানে ওখানে ঝুলছে সোনা ও রুপার পাতা।
এবং…
দুপাশের দুই মামির পেছনে অন্ধকার বড় এক চেম্বারে রাজসিংহাসনে বসে আছে সোনায় গড়া ওসাইরিস!
ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় ওরা দেখল, ঘরে ঝিকমিক করছে দেয়ালের তাকে তাকে থরে থরে উঁচু করে রাখা সাত রাজার ধন!
মস্তবড় ঘরের মাঝখানে রুপালি এক সারকোফাগাস!
হয়তো আছে আরও ফাঁদ, তাই সতর্কতার সঙ্গে এগোল ওরা। তবে নতুন কোনও বিপদ হলো না।
সত্যিই ওরা পৌঁছে গেছে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে।
বুজে যাওয়া কণ্ঠে বলল লাবনী, পেয়ে গেছি, এটাই ওসাইরিসের সমাধি!
.
২৫.
ফ্ল্যাশলাইটের উজ্জ্বল সাদা আলোয় ঝিকমিক করছে ওসাইরিসের সোনা-রুপার আর্টিফ্যাক্ট ও ধনদৌলত। সোনা ও রুপার মূর্তি যেমন আছে, তেমনি রয়েছে সাধারণ কাঠের চেয়ার। একপাশে বেশকিছু বাণ্ডিল করা খাড়া বর্শার ডগায় ভাসছে প্রমাণ সাইযের এক নৌকা। সামনে বসে আছে। ওসাইরিস, মুখে সোনা-রুপায় গড়া মুখোশ। এর কাছে কিছুই নয় তুতেনখামেনের সমাধি। তাতে অবাক হওয়ার কোনও কারণও নেই। সাড়ে তিন হাজার বছর আগে নতুন রাজ্যের অখ্যাত রাজা ছিল সে, সে-তুলনায় মিশরের প্রাচীন সভ্যতায় সাড়ে ছয় হাজার বছর আগে বহুগুণ শক্তিশালী ও বিখ্যাত দেবতা-রাজা ছিল ওসাইরিস।
কফিন দৈর্ঘ্যে পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি। সামনে গিয়ে থামল রানা, লাবনী ও বেলা। ঢাকনির ওপরে ওসাইরিসের রুপালি মুখ। সুর্মা চর্চিত শান্ত চোখ দেখছে ছাত।
এই কফিন যে তৈরি করেছে, তার কারুনৈপুণ্যের তুলনা নেই, নিচু গলায় বলল লাবনী, সবই নিখুঁত। চারপাশের আর্টিফ্যাক্ট দেখাল। ভাবিনি পুরনো সাম্রাজ্যের আগেও এত আধুনিক ছিল মিশরীয় শিল্প।
আটলান্টিসের সভ্যতার মত, বলল বেলা, আধুনিক, অথচ কেউ জানত ওটার কথা? তারপর ওই সভ্যতা আবিষ্কার করলেন আপনি!
রানা আর আমি মিলে আবঞ্চার করোছ, মৃত মনে পড়তে মৃদু হাসল লাবনী। আর এবারের এই আবিষ্কারের জন্যে আমাদের সঙ্গে সমান প্রশংসা পাবে তুমিও।
খুশিতে ঝলমল করে উঠল বেলার মুখ। সি গ্রেড পাওয়া ছাত্রী খুব খারাপ করেনি, তাই না?
কাছেই রঙিন কিছু রুক্ষ চেহারার কাঠের মূর্তি। তারা চাকর। মৃত্যুর পর রাজার যাবতীয় কাজ করে দেবে। চোখের জায়গায় লালচে পাথর।
সারকোফাগাসের একপ্রান্তে থামল রানা। ওসাইরিসকে তো পেলাম, এবার কী করতে চাও, লাবনী?
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আগে ফোটো তুলতাম, তারপর ক্যাটালগ করতাম। এরপর আসত সব পরীক্ষা করার পালা। কাঁধ ঝাঁকাল লাবনী। কিন্তু বিপদের ভয় আছে। বলেই প্রথমে চাই এই সমাধি নিরাপদ রাখতে। প্রথম সুযোগে যোগাযোগ করব এসসিএ-তে ডক্টর হামদির সঙ্গে। তিনিই স্থির করুন কী করা যায়।
দেখেছি, পাথরের পিরামিডের এত গভীরে ফোনের সিগনাল নেই, জানাল রানা।
ওসাইরিসের পাউরুটির কী হবে? জানতে চাইল বেলা।
খাবারের অবশিষ্ট খুঁজছে রানার চোখ। কাঠের ছোট এক গোল টেবিলে ধুলোর মত কী যেন। হয়তো পাউরুটিই ছিল একসময়। মনে হয় না ওখান থেকে পাওয়া যাবে ইস্ট। কফিনের নিচে দশ ইঞ্চি গভীর এক তাক চোখে পড়ল ওর। ভেতরে ক্যানোপিক জার। মামিফিকেশনের সময় মৃতদেহের দরকারি অর্গান রাখত। কাদির ওসাইরিস ভেবেছে, ইস্টের স্পোর পাবে ডাইজেস্টিভ সিস্টেমে।
লাবনীর পাশে আরেকটা জার দেখেছে বেলা। কফিনের মাথার দিকে পেল তৃতীয় জার। এখানেও একটা আছে। অন্যটা থাকবে পায়ের কাছের মেঝেতে। দেখে নিয়ে মাথা দোলাল রানা। বলে চলেছে বেলা: প্রতিটি জার কমপাসের পয়েন্ট অনুযায়ী রাখা। এদিকেরটা বাঁদরের মাথার মত। বেবুন। সে দেবতা হ্যাপি। অর্থাৎ, এটার ভেতরে আছে ওসাইরিসের ফুসফুস। জার তুলে নিতে গিয়ে বেলার মনে পড়ল, ভেতরে কী আছে। নাক-মুখ কুঁচকে ফেলল। উফ্, কী ভয়ঙ্কর!
এই জারে কী? জানতে চাইল লাবনী।
হ্যাপি থাকে উত্তরদিকে… কমপাস ডিরেকশন বুঝে নিল বেলা। তা হলে আপনার কাছেরটা শেয়ালের জার। ডুয়ামুটেফ দেবতা।
জারের ওপর আলো ফেলল লাবনী। ওটার মাথার ওপর লম্বা কানওয়ালা এক শেয়াল। হুম, ঠিক আছে।
ওটার ভেতরে আছে পেটের মালপত্র। উল্টোদিকে আছে এক বাজপাখি। কুয়েবেহূসেনুফ। অথবা কুয়েবেসুনেফ। স্বরবর্ণের অভাবে মিশরীয় ভাষার এই হাল। যাই হোক, ওটার ভেতর আছে ইনটেস্টাইন।
বাহু, বলল রানা। জার ভরা নাড়িভুড়ি।
ওসাইরিসের পায়ের দিকে দক্ষিণের জার মানুষ-দেবতা ইমসেটির। ওই জারের ভেতর আছে ওসাইরিসের যকৃৎ।
রানার দিকে তাকাল লাবনী। কাদির ওসাইরিস চাইছে এসব জার। এই অবস্থায় আমাদের কী করা উচিত?
পিরামিড থেকে বেরিয়েই ফোন দেব ডক্টর হামদির কাছে, বলল রানা।
উচিত হবে না, কক্ষের দরজা থেকে বলল কে যেন।
ঝট করে ঘুরে তাকাল রানা। চমকে গিয়ে লাফিয়ে উঠেছে বেলা। হাঁ হয়ে গেছে লাবনী।
ওসাইরিসের বড় এক মূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে আছে কাদির ওসাইরিস। পাশেই নাদির মাকালানি। হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। কাভার করছে রানাকে।
সামনে বাড়ল কাদির ওসাইরিস। কামরার ভেতরে ঢুকল বেশ কয়েকজন। তাদের ভেতর আছে কিলিয়ান ভগলার ও লুকমান বাবাফেমি। জ্বেলে নেয়া হলো শক্তিশালী বাতি। পরিষ্কার দেখা গেল চারপাশ।
যা ভেবেছি, তার চেয়েও দারুণ এই সমাধি, চারপাশ দেখতে দেখতে বলল কাদির ওসাইরিস, আর এসবই আমার। যেন নিজের ঘরেই ফিরেছি।
এসব কিছুই আপনার নয়, আপত্তির সুরে বলল লাবনী।
অস্ত্রের নল ঘুরিয়ে ওদেরকে কফিন থেকে সরে যেতে ইশারা করল নাদির মাকালানি। তোমাদের জন্যে দারুণ জিনিস রেখেছি। প্রত্যেককে দেব একটা করে। বুলেট।
তার দুই লোক সাবধানে সার্চ করল রানাকে। শোল্ডার হোলস্টার থেকে নিয়ে নিল ওয়ালথার পি.পি.কে।
রুপার কফিনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল কাদির ওসাইরিস। মামির পায়ের দিকের জার তুলল। এখানে আছে দেবতা রাজার দেহের সব অঙ্গ। বুঝলেন, ডক্টর আলম, ভুল বলি না আমি।
কী যেন বলতে গিয়েও থেমে গেল লাবনী।
এইমাত্র কামরায় ঢুকেছে এক লোক।
ফুঁসে উঠল লাবনী, ম্যান মেটয! তা হলে এদের হয়ে কাজ করছ?
শীতল চোখে ওকে দেখল মেট। প্রথম থেকেই আমার পেছনে লেগেছ, লাবনী আলম। এটা বদঅভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে তোমার। কিছু আবিষ্কার করতে গেলেই দেখা যাচ্ছে, আগেই হাজির হচ্ছ। তবে এবার টিভি দর্শকদের সামনে জোকার বানাতে পারবে না আমাকে।
আহা, ম্যান মেটয, আজও তুমি শিশু, কবে হবে সত্যিকারের ম্যান? টিটকারির সুরে বলল লাবনী। তোমার সর্বনাশ করে দিচ্ছে সবাই। মনে কত শখ, কিছু আবিষ্কার করবে, কিন্তু সবাই দুষ্টুমি করে তা করতে দিচ্ছে না। তাই শেষে মিশলে গিয়ে নকল এক ধর্মের একদল বদমাশের ভিড়ে!
রাগে মুখ বিকৃত করল নাদির মাকালানি। অস্ত্রের নল তাক করল লাবনীর বুকে।
অস্ত্রের মুখে কিছুই করতে পারবে না, তবুও ধমকের সুরে বলল রানা, খবরদার, মাকালানি!
মাথা নাড়ল কাদির ওসাইরিস। খুন চলবে না, নাদির। অপবিত্র করা যাবে না এ সমাধি। হাতের জার নামিয়ে রেখে কফিন চক্কর দিল সে। চারটে জার। লিভার, ইনটেস্টাইন, লাংস আর স্টমাক। অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে শেয়ালের মাথাওয়ালা জার তুলল কাদির। ডক্টর আলম, মিস্টার রানা, এই জারে আছে চিরকালীন জীবনের চাবি। আছে ওসাইরিসের জন্যে তৈরি পাউরুটির ইস্ট-এর স্পোর। আমার লাগবে মাত্র সামান্য স্যাম্পল, আর ব্যস, ওই গোপন জ্ঞান হবে আমার। নতুন করে তৈরি করব ওই ইস্ট। কারও অধিকার থাকবে না ওটার ওপর। শুনলে অবাক লাগে, কিন্তু সত্যিই পাউরুটি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করব আমি গোটা দুনিয়া।
জারের ভেতরে স্পোর থাকলে, তবে, বলল রানা। কে জানে, ওসাইরিস হয়তো মরার দিন পাউরুটি খায়নি। বা বেশি ভেজে ফেলেছিল পাউরুটিওয়ালা। পুড়ে গেছে ইস্ট।
তা যদি না পাই, তাও কম পাচ্ছি না, ঘরের চারপাশে চোখ বোলাল কাদির ওসাইরিস। আবার চোখ স্থির হলো রানার ওপর। তবে মনে করি না ইস্ট পাব না। সেজন্যে সঙ্গে এনেছি ডক্টর কার্ল ব্রনসনকে। দাড়িওয়ালা এক লোককে ইশারা করল। ওই লোককে চিনল লাবনী। সুইস ল্যাবোরেটরিতে ছিল। দুটো জার থেকে স্পোর পেতে পারি। দেখা যাক, আমি ঠিক, না ওরা। শেয়ালের মাথাওয়ালা জার ওপরে তুলল কাদির। এই জার ওয়েবেহসনুফের। এর ভেতরে কী আছে জানতে প্রাণ দিতেও আপত্তি নেই আমার। ডক্টর ব্রনসন, পরীক্ষা করে দেখুন। আগে কোটা দেখবেন? ইনটেস্টাইন না স্টমাক?
ইনটেস্টাইনের ভেতরের জিনিস এসেছে ডাইজেস্টিভ প্রসেসের ভেতর দিয়ে, বলল দাড়িওয়ালা ডক্টর। স্পোর যদি থাকে, তো সেটা থাকার সম্ভাবনা বেশি স্টমাকে। কাজেই আগে দেখতে চাই ইনটেস্টাইন।
তা হলে তাই দেখুন।
বাজপাখির জার হাতে নিল ডক্টর কার্ল ব্রনসন।
একমিনিট! গলা চড়ে গেল লাবনীর, ওই জার খুব দামি আর্টিফ্যাক্ট। খুলতে গিয়ে নষ্ট হতে পারে। করুণ চোখে তাকাল ম্যান মেটয-এর দিকে। মেট, তুমি তো জানো আর্টিফ্যাক্টের মূল্য। ফ্যাকাসে হলো আর্কিওলজিস্ট। চোখে দ্বিধা। অবশ্য মুখ খুলল না। কত টাকা দিচ্ছে যে এতবড় ক্ষতি মেনে নিচ্ছ?
ডক্টর মেটয ভাল করেই জানে কত পাবে, আর সেটা কম না দেখেই রাজি হয়েছে, বলল কাদির ওসাইরিস। ছোট এক গোল পোর্টেবল টেবিল পেতে ওটার ওপর বাজপাখির জার রাখল ডক্টর ব্রনসন। ব্রিফকেস থেকে বেরোল দরকারি ইকুইপমেন্ট। লাবনী আলম, তোমার লজ্জা হওয়া উচিত; বেঈমানি করেছ, নইলে আজ এ কক্ষে সম্মানের সঙ্গে আমার পাশে থাকতে। তার বদলে হয়েছ বন্দি। জানেও বাঁচবে না।
রানা, লাবনী ও বেলার দিকে সাবমেশিন গান তাক করে রেখেছে নাদির মাকালানি। পাশেই আরও দুই গার্ড। তাদের হাতেও এমপি-সেভেন। এতটা দূরে তারা, ঝাঁপিয়ে পড়ে অস্ত্র কেড়ে নিতে পারবে না রানা।
সবাই অপেক্ষায় আছে, জার নিয়ে কাজ করবে ডক্টর ব্রনসন। হাতের পাশেই একসারিতে কিছু রঙহীন তরলের বোতল, টেস্ট টিউব, পোর্টেবল মাইক্রোস্কোপ। খোদাই করা জারের মাথা দেখছে লোকটা। কয়েক সেকেণ্ড পর ধাতব চিমটে দিয়ে সরাতে চাইল সিলের কালো রজন। কাজটা শেষ হলে মুখ তুলে দেখল কাদির ওসাইরিসকে।
মাথা দোলাল ধর্মগুরু।
সাবধানে প্যাঁচ খুলছে ডক্টর ব্রনসন। মৃদু শব্দে ঘুরছে মাটির জারের ঢাকনি। সামান্য টিক্ আওয়াজ হলো। ভেঙে গেছে সিলের শেষাংশ। উঠে এল ঢাকনি।
নাক কুঁচকে গেল রানার। ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে ভয়ানক, বিশ্রী দুর্গন্ধ।
উঁহহু, ওসাইরিস ব্যাটা পচা গরুর কাবাব খেয়েই মরেছে! নালিশের সুরে বলল বেলা।
ভাল করেই সিল করা ছিল, জানাল লাবনী, হাজার হাজার বছরেও নষ্ট হয়নি কিছুই।
পেলাইট তাক করে জারের ভেতরে দেখল ডক্টর ব্রনসন। চকচক করছে কিছু। তিনটে বোতল নিয়ে বারকয়েক ঝাঁকি দিয়ে সব ঢালল অপেক্ষাকৃত বড় আরেক বোতলে। এবার এক পিপেট দিয়ে নিল জারের কালচে পিচ্ছিল কী যেন। স্যাম্পল। ভরল টেস্ট টিউবে। এবার বড় বোতলের তরল ঢেলে দিল ওটার ভেতর।
টিউবের মুখ আটকে কাদির ওসাইরিসকে বলল ডক্টর, কয়েক মিনিট লাগবে। স্পোর থাকলে এই টেস্টে তা ধরা পড়বে।
তা হলে সময় নষ্ট করার দরকার নেই, এক গার্ডকে ইশারা করল কাদির ওসাইরিস। খোলো সারকোফাগাস।
আল্লার দোহাই লাগে! কাতর সুরে বলল লাবনী, আপনারা কী করতে চাইছেন? অটোপসি করবেন মামির?।
বুড়োভাম ওসাইরিসের কথা বাদ দিয়ে আমাদের কী হবে, সেটা ভাবুন, করুণ সুরে বলল বেলা। এরা মেরে ফেলবে!
অ্যাই, মেয়ে, একদম চুপ! ধমক দিল নাদির।
ক্যানোপিক জারের মতই পুরু রজন ও বিটুমেন দিয়ে। আটকে রাখা হয়েছে কফিনের ঢাকনি। কাদির ওসাইরিসের এক লোকের হাতে ছোট এক বৃত্তাকার করাত। সাবধানে ওটা দিয়ে সিল কাটতে লাগল সে। শাবল ব্যবহার করে কফিনের ঢাকনি খুলতে চাইছে আরেকজন।
কাজটা শেষ করতে কয়েক মিনিট লাগবে বুঝে নির্দেশ দিল কাদির ওসাইরিস, আগের দুজনের পাশে গেল আরও দুজন। কফিনের দুদিকে জ্যাক লাগাল তারা। ঢাকনি ও কফিনের মাঝের ফাঁকে ভরে দেয়া হলো ক্রোম-স্টিলের শাবল।
তাদের একজন বলল, আমরা রেডি, স্যর।
সন্তুষ্ট চোখে লাবনী ও রানাকে দেখল কাদির ওসাইরিস। মাথা দোলাল। এবার খোলো।
চারজন মিলে কাজ করছে। কয়েক সেকেণ্ড পর কড়-কড় আওয়াজ তুলল ধাতব শাবল। কটাস আওয়াজে খুলে গেল। সিল। একটা শাবল পিছলে যেতেই ঠুং করে আওয়াজ হলো। ট্যাপ পড়ে গেছে কফিনের ঢাকনির ওপর।
ক্ষতির পরিমাণ বুঝে প্রায় কেঁদে ফেলল লাবনী।
তাড়াতাড়ি! অধৈর্য হয়ে ধমক দিল নাদির মাকালানি।
দৈহিক জোর খাটাল লোকলো। তুলছে রুপার ভারী ঢাকনি। সারকোফাগাস থেকে এল কর্কশ আওয়াজ। খটাং শব্দে সরে গেল ঢাকনি। কফিনের ভেতরে দেখা গেল মামি।
কোনও মূর্তি নয়, সত্যিকারের ওসাইরিস। বা তার অবশিষ্ট। মামি করা দেহ। রঙচটা ব্যাণ্ডেজে মোড়া। হাতদুটো বুকের ওপর। মুখে মৃত্যুমুখোশ। ঢাকনির ওপরের ছবির মতই সোনা-রুপার তৈরি। তুতেনখামেন বা অন্য ফেরাউনদের রাজকীয় মুখোশের তুলনায় অনেক সাধারণ। হেডড্রেস নেই। ফুটিয়ে তোলা হয়েছে রাজার মৃত্যুকালীন মুখ। প্রায় তরুণ মনে হলো ওসাইরিসকে দেখে।
সবার চোখ রাজার মুখের ওপর। সাবধানে সরে যেতে লাগল রানা। কিন্তু থমকে গেল নাদির মাকালানির ধমক খেয়ে। রানার মাথার দিকে অস্ত্র তাক করেছে সে।
কাজ বাদ দিয়ে চেয়ে আছে ডক্টর ব্রনসন। ঠিকভাবে এঁটে গেছে কফিনে মামি। আধ ইঞ্চি জায়গাও বাড়তি নেই। কঠিন রুপার ভারী ঢাকনি খাপে খাপ বসবে কফিনের ওপর।
ওসাইরিসের দিকে চেয়ে ফিসফিস করল কাদির, ওসাইরিস! দেবতা-রাজা! চিরকালীন জীবনের মালিক…
সত্যিই ভাবছ চিরকাল বাঁচবে? জানতে চাইল রানা।
মাত্র একমাস আগেও ভাবতাম ওসাইরিস বলে কেউ নেই, বলল কাদির ওসাইরিস, এখন জানি, পুরাণের কথা মিথ্যা নয়।
মিথ্যার পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছ, বলল রানা। ভাল করেই জানো, শেষপর্যন্ত মরতে হয় সবাইকে। মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছ একদল মানুষকে।
কে বলেছে ওদেরকে ভুল ধারণা দিয়েছি? বলল কাদির ওসাইরিস। আমার কথা ঠিক, তা তো প্রমাণ করছে ওই মামি। অতীতে ছিল ওসাইরিস। আমাকে দিয়ে নিয়তি আবিষ্কার করিয়ে নিয়েছে তাকে। ওই আত্মা এখন আমার ভেতরে। আমিই দেবতা-রাজা ওসাইরিস। কে বলবে আমার মৃত্যু হবে? চতুর শেয়ালের মত বিশ্রী হাসল সে। আসল কথা কোটি কোটি মানুষ চাইবে বাঁচতে। সেজন্যে টাকাও দেবে। বেশিদিন নেই, দুনিয়ার সবচেয়ে বড়লোক হব।
রানা খেয়াল করল, কথাগুলো শুনে কঠোর হয়েছে নাদির মাকালানির চোখ।
কাদির ওসাইরিস আরও কিছু বলার আগেই মাইক্রোস্কোপ থেকে চোখ তুলল ডক্টর ব্রনসন। মিস্টার ওসাইরিস!
তার পাশে পৌঁছে গেল কাদির। টেস্টের রোল্ট কী?
মাইক্রোস্কোপ থেকে স্লাইড নিল ডক্টর ব্রনসন। কাঁপা গলায় বলল, টেস্টের রেয়াল্ট… পযিটিভ! ইস্টের স্ট্রেইনে স্পোর আছে!
হাসতে শুরু করেছে কাদির ওসাইরিস। কয়েক সেকেণ্ড পর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, হ্যাঁ! ঠিক! আমার কথা ভুল হয়নি! খুশিতে মুঠো পাকিয়ে ফেলল সে। ঠিক ধরেছিলাম! মিথ্যা নয় ওসাইরিসের পাউরুটির কাহিনী! এবার হয়ে উঠব মস্তবড় বড়লোক, নাদির! এতই বড়লোক, ভাবতেও পারবে না কেউ! ছোটভাইয়ের দুকাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে দিল সে। দুনিয়া এখন আমার হাতের মুঠোয়!
বিরক্ত চেহারায় বলল নাদির মাকালানি, শুধু টাকার বেশি আর কিছুই চাও না তুমি? …আর ক্ষমতা?
শুধু টাকা নয়, আসবে প্রচণ্ড ক্ষমতা, হাসল কাদির ওসাইরিস। মজা পেয়ে গলা নিচু করল, আরও কিছু আসবে! লাখ লাখ মেয়ে চাইবে আমার সঙ্গ!
সত্যিই তোমার জন্যে করুণা হচ্ছে, শীতল কণ্ঠে বলল নাদির মাকালানি। তোমার কারণে ডুবেছে আমাদের বংশের নাম। বহু দিন ধরেই দেবতাদের অপমান করছ। কিন্তু এবার আর সুযোগ রাখব না। সাবমেশিন গান তুলল বড়ভাইয়ের বুকের দিকে।
কী হচ্ছে বুঝতে পারেনি কাদির ওসাইরিস। নিজের চোখও বিশ্বাস করেনি। কয়েক সেকেণ্ড পর মগজ কাজ করল তার। বেসুরো কণ্ঠে জানতে চাইল, নাদির, কী ঠাট্টা শুরু করলে? ছোটভাইয়ের কঠোর চেহারা দেখছে। নাদির মাকালানির চোখে-মুখে রাগ ও ঘৃণা। পাগল হলে, নাদির? কী করছ?
তোমার নোংরা খেলা শেষ, বড়ভাই, মেঝেতে থুতু ফেলল নাদির। অনেক মজা লুঠে নিয়েছ। কিছু না করেও বহু কিছু পেয়েছ। কিন্তু ওসব প্রাপ্য ছিল না তোমার বুকে ধাক্কা দিয়ে কাদিরকে কফিনের ওপর ফেলল নাদির।
ভীষণ ভয় পেয়েছে কাদির ওসাইরিস। বুঝতে পেরেছে, তার ভাই সিরিয়াস। সাহায্য পাওয়ার জন্যে দলের সশস্ত্র লোকগুলোর দিকে তাকাল। অ্যাই, তোমরা ওর হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নাও। তার দিকে কঠোর চেহারায় চেয়ে আছে লোকগুলো। আরেহ! আমাকে বাঁচাও!
ওরা তোমার অনুসারী নয়, সাপের মত হিসহিস করল নাদির। ঠোঁটে টিটকারির হাসি। ওরা আমার অনুসারী। এরপর থেকে তোমার অনুসারীরা পূজা করবে আমাকে। নইলে খুন হবে তারা।
পিছিয়ে গেছে নার্ভাস ম্যান মেটয। ইয়ে… এখানে… এসব কী হচ্ছে?
যা হচ্ছে, ডক্টর মেটয, সেটা সহজ ঘটনা, বলল নাদির। যা উচিত, তাই হচ্ছে। জন্মাধিকার অনুযায়ী ওসাইরিয়ান টেম্পলের প্রধানের দায়িত্ব বুঝে নিচ্ছি আমি! কাদিরের পেছনে কফিনের ভেতর পড়ে থাকা মামিটাকে কঠোর চোখে দেখল সে। ওসাইরিস! গুহ্! দুই ভাইয়ের ভেতর সবসময় বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী ছিল সেট। কিন্তু ওসাইরিসের চাপে মাথা নিচু করে চলতে হতো তাকে! কথার সঙ্গে থুতু ছিটকে পড়ছে মুখ থেকে। সে যুগ শেষ! এবার আমার পালা! কর্কশ স্বরে চিৎকার করল নাদির, আমিই সেট! নতুন করে জন্ম নিয়েছি এই পৃথিবীতে!
ভয় ও বিস্ময় নিয়ে নাদিরের দিকে চেয়ে আছে কাদির। কৃ-কী… বলছ এসব, নাদির? কী হয়েছে তোমার? ঢোক গিলল সে। তুমি সেট নও… আমিও তো ওসাইরিস নই! আমরা দুই ভাই এক পাউরুটিওয়ালার ছেলে, নাদির! কেউ কখনও আবারও জন্মায় না… সত্যি সত্যি এসব হয় না! সব বানিয়ে বলেছি! মিথ্যা কথা! তুমি তো জানো, কেন এত মিথ্যা বলেছি!
হঠাৎ খুব শীতল স্বরে বলল নাদির, রাগিয়ে দিয়ে সত্যি জাগিয়ে তুলেছ দেবতাদেরকে! এখন প্রতিশোধ নেবে তারা! তোমার অনুসারীরা মনে করে তুমি সত্যিই ওসাইরিস, তাই তুমি ওসাইরিস। আর আমি ওসাইরিসের ভাই, তাই আমি সেট। অন্ধকার, বিশৃঙ্খলা ও মৃত্যুদেবতা! এবার সময় হয়েছে। আমার রাজত্ব করার!
তুমি… পাগল হয়ে গেছ, নাদির, ভয়ে কাঁপছে কাদির। ডা… ডাক্তার… মানসিক রোগের ডাক্তার দেখাতে হবে তোমাকে!
আরও খেপল নাদির মাকালানি। ভাবছ পাগল হয়ে গেছি, না? না, আমি পাগল নই! জন্ম থেকে সবই পেয়েছ তুমি! আমি পাইনি কিছুই! তুমি ছিলে বাবা-মায়ের আদরের সন্তান মহানায়ক! আর আমি? অযোগ্য সন্তান! তুমি যখন নায়ক হয়ে দুনিয়া জয় করছ, সেসময়ে আমাকে যেতে হয়েছে সেনাবাহিনীতে। টাকা আর মেয়েলোকের অভাব ছিল না তোমার। আর মরতে মরতে বেঁচেছি আমি! একটানে শার্ট ছিঁড়ে ফেলল সে। পুড়ে গিয়েছিল পুরো বুক। দগদগ করছে শুকিয়ে যাওয়া ক্ষত। আসির আগুন থেকে টেনে বের না করলে, পুড়ে ছাই হতাম। হাসপাতালে একবারের জন্যেও দেখতে আসোনি! …হ্যাঁ, তুমি আসোনি!
বড়ভাই আর ছোটভাইয়ের ঝগড়া, নিচু স্বরে রানাকে বলল লাবনী।
ফলাফল বোধহয় ভয়ঙ্কর, বলল রানা।
আমি… তখন… অন্য লোকেশনে ছিলাম, ভয় মেশানো স্বরে দুঃখপ্রকাশ করল কাদির। চাইলেও তোমাকে দেখতে যেতে পারতাম না।
পুরো দুমাসেও যেতে পারোনি, তাই না? ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর হাসল নাদির। হ্যাঁ! জানি কী করছিলে। ঘুরে বেড়াচ্ছিলে দুনিয়া জুড়ে, সঙ্গে আট-দশজন দামি বেশ্যা!
এখনও হাল ছেড়ে দেয়নি কাদির। মাথা নাড়ল সে। ও, এবার বুঝতে পেরেছি। আমার টাকা আর নাম হয়েছে, সেজন্যে হিংসেয় বুক পুড়ে গেছে তোমার। এত ছোট মন নিয়ে পুরুষমানুষ হবে কী করে?
কথাটা শুনে রাগে থরথর করে কেঁপে উঠল নাদির। মুখে কিছু না বলে সাবমেশিন গানের নল দিয়ে প্রচণ্ড এক বাড়ি দিল বড়ভাইয়ের মুখে। গাল ফেটে ছিটকে গিয়ে রক্ত পড়ল কফিনের ডালার ওপর। কাদিরের গালের গভীর ক্ষত দেখে হা হয়ে গেছে বেলা। ভুরু কুঁচকে গেছে রানারও।
দুহাতে মুখ ধরে মেঝেতে বসে পড়ল কাদির ওসাইরিস। গলা নিয়ন্ত্রণে এনে ভগলারকে বলল নাদির, ভেতরের ওটাকে বের করো। আঙুল তাক করে দেখিয়ে দিল কফিনের মামি।
কফিনের ওপর ঝুঁকে গেল ভগলার ও দলের আরেকজন। লাবনী আপত্তি তোলার আগেই মামি তুলে অনানুষ্ঠানিকভাবে ফেলে দেয়া হলো কফিনের পাশে। মামির মুখ থেকে পড়ে গেছে মুখোশ। শুকনো লাশের পাতাহীন চোখের গর্ত চেয়ে আছে ছাতের দিকে।
বড়ভাইয়ের দিকে অস্ত্র তাক করে ধমকের সুরে বলল নাদির। ঢুকে পড়ো সারকোফাগাসের ভেতর।
ভীষণ ব্যথায় প্রায় পাগল কাদির ওসাইরিস অবাক চোখে তাকাল ভাইয়ের দিকে। ক্ব-কেন?
ঢোকো কফিনের ভেতর! এক্ষুণি!
হায়, আল্লা! কী হচ্ছে বুঝে চমকে গেছে লাবনী। কাদির, সত্যিকারের ওসাইরিস আর সেটের কাহিনী নকল করছে নাদির! মনে নেই, একটা ঘরে ডেকে নিয়ে এক কফিনের ভেতরে ওসাইরিসকে আটকে দিয়েছিল সেট?
লাবনীর দিকে চেয়ে নিষ্ঠুর হাসল নাদির। খুশি হলাম যে সত্যিকারের কাহিনী অন্তত কেউ জানে!
আপনি কাদিরের পেনিস চোদ্দ টুকরো করে মাছকে খাইয়ে দেবেন? বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইল বেলা।
এবার আর চোদ্দ টুকরো করতে হবে না। আইসিস নেই যে ওকে বাঁচিয়ে তুলবে। কাদিরের দিকে তাকাল নাদির। কফিনে নেমে পড়ো।
নিজেকে সামলে নিয়েছে কাদির। উঠে দাঁড়িয়ে কঠোর সুরে বলল, তোমার কথায় চলবে না ওসাইরিয়ান টেম্পলের সবাই। ওরা ওসাইরিসের ভক্ত। সেটের নয়।
ভুল জানো, বড়ভাই, বলল নাদির। গর্বের সঙ্গে দেখাল গার্ডদেরকে। জুয়া, মদ্যপান বা বেশ্যাদের নিয়ে যখন মৌজ করছ, সেসময়ে টেম্পলের সত্যিকারের ভক্তদেরকে খুঁজে বের করেছি আমি। টেরও পাওনি, সব ক্ষমতা চলে এসেছে আমার হাতে। সিনেমার নায়ক হতে হবে না আমাকে, মানসিক জোর ও ক্ষমতা দেখে দলে ভিড়বে সবাই। পূজা করবে আমাকে। নির্ধারিত মূল্য দেবে তারা। আর এরপরও কেউ আমাকে মানতে না চাইলে… মরতে হবে করুণভাবে।
কীসের মূল্য? জানতে চাইল কাদির ওসাইরিস।
ডক্টর কার্ল ব্রনসন এবং তার বিজ্ঞানীরা তোমার নয়, কাজ করছে আমার হয়ে। ওসাইরিসের পাউরুটির ওই ইস্ট শুধু যে আয়ু বাড়িয়ে দেবে, তা নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু করবে। আমি স্থির করব কে বাঁচবে, আর কার বাঁচতে হবে না। আমার বিরুদ্ধে মাথা তুললে বাঁচবে না কেউ!
চিন্তিত চোখে রানাকে দেখল লাবনী। সুইটয়ারল্যাণ্ডের ল্যাবে ইস্টের জেনেটিক্যালি মডিফিকেশনের কথা বলছিল এরা।
কথা ঠিক, লাবনী, শয়তানির হাসি হাসছে নাদির, আমার অনুসারীরা দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে দেবে বিশেষ স্পোর। মিশিয়ে দেয়া হবে ফসলে, পানিতে, এনিমেল ফিডে। যারা নিয়মিত খাবে না সেট-এর পাউরুটি, বা পূজা দেবে না সেট দেবতাকে নিজ দেহের কোষের বিষেই খুন হবে তারা।
বদ্ধউন্মাদ তুমি, উঠে দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে বলল কাদির। জানতে চাও, কেন বাবা আমাকে বেশি পছন্দ করতেন?
বাবার কথা শুনে আরও রেগে গেল নাদির মাকালানি। ঢোক ওই কফিনে, শুয়োরের বাচ্চা! এক্ষুণি! কাদিরের বুকে অস্ত্রের নলের জোর গুঁতো দিল সে। পরক্ষণে চেঁচাল, অ্যাই, তোমরা ওকে ভেতরে ভরো!
মার খাওয়া কাদিরকে ধরে ফেলল চারজন লোক, ভরতে চাইল কফিনের ভেতর। কিন্তু আসল ওসাইরিসের তুলনায় অন্তত ছয় ইঞ্চি বেশি দীর্ঘ কাদির। প্রাণপণে বেরিয়ে আসতে চাইল। কিন্তু তার বুকে প্রচণ্ড জোরে অস্ত্রের বাঁট নামাল নাদির। কফিনের ভেতর পড়ে ব্যথায় ছটফট করছে তার বড়ভাই। সুদর্শন চেহারা এখন ভয়ানক যন্ত্রণায় বিকৃত।
আমি সেট! চিৎকার করল নাদির, বুঝে নিচ্ছি নিজের রাজ্যের অধিকার!
হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেছে কাদির, ভীষণ আতঙ্ক ভরা চোখে দেখল, ওপর থেকে পড়ছে ভারী ধাতব ঢাকনি। ফাপা জোরালো ধুমপ আওয়াজে নামল ওটা। একইসময়ে কাদিরের বেরিয়ে থাকা হাতের কবজি ও পায়ের গোড়ালির হাড় ভাঙার মড়-মড়াৎ আওয়াজ হলো। ভয়ে চিৎকার করে উঠে অন্যদিকে তাকাল বেলা। রুপার কফিনের ডালার ফাঁক দিয়ে গলগল করে বেরোচ্ছে তাজা রক্ত।
অস্ত্রের বাঁট দিয়ে বারবার ঢাকনির ওপর আঘাত হানছে। নাদির। চেঁচিয়ে চলেছে, আমি সেট! সেট! সেট! মৃত্যুদেবতা সেট!
না, তিক্ত স্বরে বলল রানা, কাদির ঠিকই বলেছে। তুমি বদ্ধউন্মাদ!
ঝট করে রানার দিকে ঘুরল নাদির। প্রচণ্ড রাগে থরথর করে কাঁপছে। ট্রিগারে চেপে বসল আঙুল। এবার গুলি করবে সে।
পেরিয়ে গেল পাঁচ সেকেণ্ড, কিন্তু গুলি করা হলো না।
রানা, ব্যস্ত কণ্ঠে বলল লাবনী, অস্ত্র হাতে কেউ নিজেকে দেবতা দাবি করলে… সবসময় মেনে নিতে হয়!
কাঁপা-কাঁপা দম নিল নাদির। পিছিয়ে গেল। না, শান্ত করতে চাইছে নিজেকে। না, আমার ভাই ঠিকই বলেছে। এই সমাধি অপবিত্র করা ঠিক নয়! ওসাইরিস ফিরে এসেছে নিজের কফিনে। কিন্তু তোমরা? রাগী চোখে রানা, লাবনী ও বেলাকে দেখল সে। তোমাদের অধিকার নেই দেবতার এই সমাধিতে মরবে। কফিন ঘুরে আরেকদিকে গেল নাদির। দলের লোকদের উদ্দেশে বলল, ওদেরকে ওপরে নিয়ে গুলি করো। নিজ হাতে নিয়েছে শেয়ালের মাথা খোদাই করা জার। এটা রাখার কেস কোথায়?
অস্ত্রের মুখে রানা, লাবনী ও বেলাকে কামরার দরজার কাছে নিয়ে গেল ভগলার ও তার লোক। তাদের একজন ঘুরে দেখাল, তার পিঠেই ঝুলছে ইমপ্যাক্ট রেস্ট্যিান্ট কমপোযিট কেস। বুকের হার্নেস ক্লিপ খুলে কেস হাতে নিল সে। মেলল ডালা। ভেতরে নরম মেমোরি ফোম।
প্রোটেকটিভ লেয়ারে জার শুইয়ে দিল নাদির। সাবধানে বন্ধ করল ডালা। ক্লিক আওয়াজে ক্যাচ আটকে যেতেই বলল, জীবন দিয়ে হলেও রক্ষা করবে, হাতেম। ..ব্রনসন, হাতেমের সঙ্গে থাকুন। চোখের আড়াল করবেন না জারের কেস। মাথা দোলাল বিজ্ঞানী। আবারও পিঠের হার্নেসে ব্যাকপ্যাকের মত করে কেস আটকে নিল হাতেম।
ঘুরে নাদির দেখল, এখনও রক্তাক্ত কফিনের দিকে চেয়ে আছে ডক্টর ম্যান মেটয ও লুকমান বাবাফেমি। নরম স্বরে বলল সে, আশা করি খারাপ কিছু হয়নি?
না-না, কী যে বলেন, কিছুই না, হড়বড় করে বলল বাবাফেমি, বরাবরের মতই আমার সম্পূর্ণ সমর্থন থাকবে আপনার প্রতি। এমন ব্যবস্থা করব, কখনও এই পিরামিডের কথা জানরে না এসসিএ। এই গোপন তথ্য আমাদের বুকেই লুকিয়ে থাকবে। পরক্ষণে ভয় পেয়ে শুধরে নিল, আপনার গোপন তথ্য, স্যর।
গুড। আর, ডক্টর মেটয?
আ… মি… ইয়ে… বিড়বিড় করল মেট্য, ঠিক আছে। আমি আপনার সঙ্গেই আছি।
শুনে সত্যিই খুশি হলাম, ম্যান মেটয-এর দিকে চেয়ে গলা শুকিয়ে দেয়া এক ভয়ানক হাসি দিল নাদির। তা হলে চলুন, ফেরা যাক হোভারক্রাফটে। এ জায়গা থাকুক মৃতদের জন্যে। দেরি না করে কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে গেল ম্যান মেটয ও লুকমান বাবাফেমি। সারকোকাগাসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে নাদির। ঘুরে রওনা হওয়ার আগে ফিসফিস করে বলল, গুড-বাই, বড়ভাই!
সবাই বেরিয়ে যাওয়ায় ওসাইরিসের সমাধিতে রইল শুধু নৈঃশব্দ্য।
<