এইমাত্র পনেরো মিনিটের পরিশ্রমসাধ্য যোগব্যায়াম শেষ করল মাসুদ রানা  শবাসন দিয়ে ইতি টানল ও। না, না, এতে মনের ওপর চাপ পড়ে না ওর। কারণ শবটাকে সব সময়ই সে অন্য কেউ বলে ধরে নেয়। এরপর একটু স্বভাববিরুদ্ধ কাজ করল রানা। মেডিটেশনের ভঙ্গিতে কাটাল আরও পনেরোটা মিনিট। প্রথম, পদ্মাসনে। তারপর গোমুখাসনে।

ওর বৃদ্ধ গুরুর, যার কাছ থেকে এগুলো শিখেছে রানা, দুটো পরামর্শ মনে মনে ক্ষমা চেয়ে অমান্য করে সে। চোখ বন্ধ করে না রানা। এবং খোলা রাখে। কান। এ দুটো বৈচিত্র্য সত্ত্বেও আবিষ্কার করেছে রানা, যথেষ্ট কাজে দেয় ওর যোগব্যায়াম। মেডিটেশনে বসলে সম্ভাবনা থাকে অনেক গভীর লেভেলে চলে যাওয়ার, সঙ্গে সম্ভাবনা বেড়ে যায় অপমৃত্যুরও। কে কখন অজান্তে পিঠে ছুরি মারে, মাথা ফুটো করে দেয় গুলি করে, কিংবা গলায় দড়ির ফাস পরায় কেউ বলতে পারে? ব্যারোনেসের সঙ্গে ভিলা রিকোতে আসার পর থেকেই কেমন জানি একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি হচ্ছে রানার। কেন জানে না ও। চালকের আসনেই তো এ মুহূর্তে বসে আছে সে। মৃত জাপানীর চাবির ভাগটা ওর কাছে, তারমানে হাত-পা বাঁধা অবস্থা রুডলফ ব্রিগলের। রানার সঙ্গে কন্ট্যাক্ট করতেই হবে তার। এবং তখনই মওকা পাবে ও প্রতিশোধ নেয়ার।

ও আর ব্যারোনেস-মানে জুলি-কয়েক ঘণ্টা হলো এসে উঠেছে ভিলা রিকোয়, এবং এখন অবধি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে, নিরাপদ মনে হচ্ছে রানার জায়গাটাকে। ভবিষ্যতের কথা জানে না ও।

 সুইস উপকূলের দুশো গজ ভেতরে, পর্বতসঙ্কুল ছোট্ট এক দ্বীপে ভিলাটার অবস্থান। ফোনের ব্যবস্থা নেই। তীরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্যে, ডকে নোঙর করা, ছোট্ট একটা বৈঠা চালিত হালকা নৌকা রয়েছে। লঞ্চটা ওদেরকে যেখানে নামিয়ে দিয়ে গেছে সেখানে। বৈঠাগুলো রয়েছে নৌকায়, কিন্তু শিকল ও তালা মেরে আটকে রাখা হয়েছে একটা পাইলের সঙ্গে। রানা লক্ষ করেছে ব্যাপারটা। শুধু এটাই নয়, লক্ষ করেছে আরও অনেক কিছুই; খাড়া, ঘোরানো কাঠের সিঁড়ি ভেঙে পাহাড়ের মুখ বরাবর ভিলায় উঠে আসার সময়।

তোমার বান্ধবী খুব প্রাইভেসি মানে দেখছি, মন্তব্য করেছে রানা।

 জেনেভা থেকে এখানে আসার পথে বান্ধবীর ব্যাপারে মুখ খুলতে অনাগ্রহী মনে হয়েছে ব্যারোনেসকে। তবুও রানা জেনে নিয়েছে যতটা পারে। ওর বান্ধবী কন্টেসা ডি কারেন্থ একজন সম্মানিতা বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা, এককালের বিখ্যাত কনসার্ট পিয়ানিস্ট। কঠিন বাতে আক্রান্ত কন্টেসা এখন প্যারিসে একাকী জীবন যাপন করছেন। কদাচ ভিলা রিকোয় আসেন। অবশ্য সারা বছরই ভোলা রাখেন এটা, কাজের লোকজনও পোষেন, এবং ব্যারোনেসের। জন্যে ভিলায় অবারিত দ্বার। জুলি বলেছে রানাকে, ভিলা রিকো ওর কাছে দ্বিতীয় ঠাই। প্রথমটা অবশ্যই বন। তবে প্রায়ই নাকি ও আসে এখানে। নিজস্ব ব্যবহার্য অনেক জিনিসপত্রও রাখে কাপড়চোপড়, বইপত্র ইত্যাদি।

এটুকু বলে কৌশলে প্রসঙ্গান্তরে চলে গেছে ব্যারোনেস।

দেহের একটি পেশিও না নাড়িয়ে এক পলকে ঘড়িটা দেখে নিল রানা। আর তিন মিনিট বাকি। তারপর ব্যালকনি জানালার পাশে রাখা দামী টেলিভিশনটা খুলবে ও, জেনেভার কোন খবর-টবর যদি পাওয়া যায়। দুএকটা। তথ্যসূত্র পেয়ে যেতে পারে হোটেল হিলসন ও নাকাতা সম্পর্কে।

আড়ষ্ট ভঙ্গিটা ছেড়ে মুচকি হাসল রানা। রুডলফ ব্রিগলও হয়তো ঠিক একই কাজ করবে।

দরজা ভেজানোর খুট শব্দটা এক মিনিট আগেই পেয়েছে রানা। কোন মহিলার উপস্থিতি সম্পর্কে অবগত হয়েছে, তবে মুখ খোলেনি। নাকে এসেছে ওর উগ্র সেন্টের গন্ধ। কি ব্যাপার, মেরী? কি চাই?

ভিলার কর্মচারীদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ওর আসার পর। কর্মচারী বলতে দুজন, মেইড মেরী পেটি ও বিশালদেহী এক লোক, ওমর আব্রাহাম-ব্যারোনেসের কাছ থেকে জেনেছে লোকটা সব কাজের কাজী।

ব্যারোনেস পাঠালেন, বলল মেরী। ডিনারের আগে তার সাথে সাঁতার কাটবেন কিনা জানার জন্যে।

 খুশি মনে, বলল রানা। কিন্তু কোথায়? লেকের পানি খুব ঠাণ্ডা থাকে না বছরের এসময়টায়?

কনজারভেটরী আছে, মঁসিয়ে। গরম পানির পুল। ব্যারোনেস এখন ওখানে আছেন। আপনি চাইলে আমি পথ দেখিয়ে দেব। ওর গোলগাল, নিষ্পাপ মুখটায় সাহায্য করার ব্যাকুলতা।

দরকার নেই। ব্যারোনেসকে বলে দাও দশ মিনিটের মধ্যে আসছি আমি।

মেরী বেরিয়ে গেলে দরজা লাগিয়ে দিল রানা। এক কোণে দাঁড় করিয়ে রাখা লম্বা শেভাল গ্লাসটায় নিজের প্রতিবিম্ব লক্ষ করল ও। বোঝা যায়, একসময় কোন মহিলার রূম ছিল এটা। এবার বেরিয়ে গিয়ে ঘোট স্লীপিং পোর্চটায় প্রবেশ করল। এই সুইটের বেডরূম হিসেবে ব্যবহৃত হয় এটা।

 বিছানায় খোলা পড়ে রয়েছে রানার বেটপ সুটকেসটা। ভেতরটা তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগল ও। ছোট্ট একটা সমস্যা ওর সামনে। সত্যি বলতে কি, একাধিক ছোটখাট সমস্যা। এক নম্বর, পোশাক। পরিষ্কার কাপড়চোপড় প্রায় নেইই বলতে গেলে। একটা স্পোর্টস শার্ট, গোটা দুই স্ন্যাক, একটা জ্যাকেট, মোজা আর জুতো। আপাতত এই সম্বল, তবে চলে যাবে। পরে, পরে বলে আদৌ থাকে যদি কিছু জেনেভায় রানা এজেন্সির ওই ডিপোটায় ঢুকে নিজেকে সাজিয়ে নেবে রানা।

এই মুহূর্তে মূল সমস্যা ওই চাবির টুকরোটা। পরনের বক্সার ট্রাঙ্কের ইলাস্টিক ওয়েস্ট ব্যান্ড থেকে ওটা বের করে নিয়ে পরখ করে দেখল রানা। সযত্নে লুকিয়ে রাখতে হবে এটাকে।  

কিন্তু রাখবেটা কোথায়? ওর সুইমিং ট্রাঙ্কে তো পকেট নেই। আশরাফ চৌধুরী এতকিছু পারে আর সামান্য একটা পকেট বানিয়ে দিতে পারে না? শেম, শেম!

সমস্যাটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনার ফাঁকে সুটকেস থেকে বিশ্বস্ত তিন সঙ্গীকে বের করে পরীক্ষা করে দেখল রানা। ফার্স্ট ক্লাস অবস্থায় আছে সব কটা। একটা বিজ্ঞাপন দিলে কেমন হয়? টিপটপ অবস্থায় একটি লুগার অটোমেটিক, একটি স্টিলেটো ও একটি গ্যাস বম বিক্রয় হইবে!

 লুগারটা রেখে যেতে হবে। টেরি-ক্লথ রোবে জায়গা করে নেবে গ্যাস বম। কিন্তু স্টিলেটো? তালুর ওপর রাখল ওটাকে রানা। ট্রাঙ্কের ইলাস্টিকে সেঁধিয়ে দিল এবার। ব্যারোনেস হয়তো অবাক হতে পারে। হোকগে। কিন্তু রানা নিরস্ত্র অবস্থায় কখনও কারও হাতে ধরা পড়তে চায় না।

ফ্রেঞ্চ কী-টা সুটকেসে রাখতেই মনস্থ করল রানা। বার্গলার প্রাফ সুটকেসটার গোপন কোন কুঠুরিতে নিরাপদেই থাকবে ওটা। সাঁতার কাটতে গেলে চোখে চোখে থাকবে জুলি; মানুষ বলতে তো আর কেবল ওই মেরী পেটি ও হোদল কুতকুত ওমর। নাহ, ওদের সাধ্য হবে না বিশেষভাবে তৈরি রানার অসাধারণ সুটকেসটাকে বাগে আনা।

সুইট ত্যাগ করে দরজা লক করার সময় ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা টের পেল। রানা। হালকাভাবে শুরু হলেও এখন ভাবাচ্ছে ওকে মিশন লেপার্ড। চাবির অনাকাঙিক্ষত টুকরোটা কয়েক ডিগ্রি চড়িয়ে দিয়েছে ওর টেনশন।

 সাদা ও গোলাপী স্টাকৌ ব্যবহার করা হয়েছে ভিলা রিকোয়। এর ফলে প্রাসাদোপম বিশাল বাড়িটা পেয়েছে ভিন্নতর মাত্রা। লাল টালির ছাদ ও নিখুঁত রুট আয়রন ব্যালকনিগুলো আশ্চর্য এক সৌন্দর্য দান করেছে ভিলাটাকে। প্রাচীন কোন রোমান প্রিন্সের বাসস্থান হিসেবেই যেন বেশি মানানসই এটা। বাড়িটাকে খাড়া পার্শ্বদেশসমৃদ্ধ, খুদে দ্বীপটার মাথার মুকুট বললেও অত্যুক্তি হবে না। গাছ-পালা, ঝোপ-ঝাড় ঘন হয়ে জন্মেছে দ্বীপটিতে। অসংখ্য মোচাকৃতি গাছ গাছালি জড়াজড়ি করে রয়েছে লার্চ, বার্চ আর ওকের জটলার সঙ্গে। এবাড়িতে আসার পথে লক্ষ করেছিল রানা, অনেকগুলো পথ এদিক ওদিক চলে গেছে এখান থেকে, বাহ্যত দ্বীপের প্রতিটি কোণে, সাইকেলের শোকের মতন।

 প্রশস্ত সিঁড়িটায় লোহার ব্যানিস্টার, ওটা, বেয়ে নেমে আসতে গিয়ে রানার মনে হলো একটু ঘুরেফিরে দেখা উচিত দ্বীপটার চারধার। কাজটা সকালের দিকে সারবে ঠিক করল।

 ব্যারোনেসের সঙ্গে ভিলায় ঢোকার সময় কনজারভেটরী, কিংবা গ্রীনহাউজটা লক্ষ করেছিল রানা। সেদিকেই এগোচ্ছে এখন পথ করে নিয়ে। খিড়কি দরজা দিয়ে মেইন হাউজ ত্যাগ করেছে ও। দুপাশে ইউ গাছের সারি নিয়ে বিছিয়ে পড়ে থাকা, চওড়া মেটে রাস্তাটা ধরে রানা হটছে। পথটা আঁকাবাঁকা। রানা যেই শেষ বাকটা ঘুরেছে অমনি দেখা পেল সব কাজের কাজী হোঁতকা ওমরের। আস্ত একটা ফুটবল লোকটা, জায়গামতন নাক-মুখ-চোখ পেয়ে গেছে কেবল।

চর্বির ডিপো ওমর আব্রাহাম, প্রথম দর্শনে ধারণা করেছে রানা, সিরীয় কিংবা তুকী হবে। সুইস পর্বতারোহীর বেশভূষায় বিদঘুটে দেখাচ্ছে। লোকটাকে। অতিকষ্টে হাসি চাপল রানা।

পাথরের বেঞ্চিতে বসে সিগারেট ফুকছিল ওমর, রানামোড় ঘুরতে ওকে দেখতে পেয়ে সটান উঠে দাঁড়াল লোকটা। প্রায় চারশো পাউন্ড ওজন নিয়ে তার ওরকম ক্ষিপ্র রিফ্লেক্স রীতিমত তাজ্জব করে দিল রানাকে। অন্তরে গেঁথে নিল রানা দৃশ্যটা। যতটা ভেবেছিল, ততটা অচল মাল নয় তারমানে।

গুড ইভনিং, স্যার, বলল ওমর। ফাইন ডে, স্যার।অতিভক্তি আবিষ্কার করল রানা লোকটার কণ্ঠস্বরে। চড়া, তীক্ষ্ণ, মধুমাখা স্বরটা কানে লাগল ওর।

গুড আফটারনুন, ভদ্রতা রক্ষা করল রানা। হ্যাট হাতে দাঁড়িয়ে ওমর, স্পষ্টতই নার্ভাস। কাচুমাচু ভঙ্গিতে চেয়ে রয়েছে রানার দিকে। লোকটার মাথা সম্পূর্ণ বেল, চর্বি ভরা কোটর থেকে উঁকি দিয়ে রয়েছে একজোড়া কুতকুতে চোখ। বেচারী মেরী পেটি! আহা রে, এই কিম্ভুত জীবটার সঙ্গে একাকী দ্বীপবাস করতে হচ্ছে তাকে!

সহসা উপলব্ধি করল রানা, খুব কাছ থেকে গভীরভাবে লক্ষ করছে ওকে ওমর। রানাকে সরাসরি চাইতে দেখে চোখ নামিয়ে নিল। খুব কৌতূহলী লোক মনে হচ্ছে, ভাবল ও হবে না-ই বা কেন? এই নির্জন দ্বীপে মানুষ জনের পা তো পড়েই না একরকম। অবশ্য ব্যারোনেসের কথা সত্যি হয়ে থাকে যদি। মনে মনে হাসল রানা, এখনও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না ও জুলি গ্রাফকে।

ব্যারোনেস গ্রীনহাউজে আছে?

ও, হ্যাঁ। আছেন, স্যার। অপেক্ষা করছেন আপনার জন্যে, স্যার। চর্বি বাধা না দিলে হয়তো কুনিশ করত ওমর। হাস্যকর সবুজ হ্যাটটা গ্লাসহাউজের উদ্দেশে ঝটকা মেরে ইঙ্গিত করল। উঁচু তারে চড়ে বসল এবার ওর কণ্ঠস্বর। অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন, স্যার।

ওর দিকে চেয়ে মুচকি হাসল রানা। লোকটাকে একেবারেই পছন্দ হয়নি। ওর। কিন্তু ভাবে ভঙ্গিতে যাতে সেটা প্রকাশ পেয়ে না যায়, সতর্ক রইল।

কনজারভেটরীর উদ্দেশে পা বাড়াতে ওর ষষ্ঠেন্দ্রিয় জানান দিল ওমর লক্ষ করছে ওকে। মরুকগে, মনে মনে বলল রানা।

লম্বা একটা কাঁচের দরজা ঠেলে প্রবেশ করল রানা কুয়াশাচ্ছন্ন জঙ্গলময় এক পরিবেশে। হালকা রোবটা গায়ে ওর, পকেটে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকা ছুরিটা হঠাৎ করেই ভারী ঠেকল ওর কাছে। ওটা বের করে নিয়ে গুটিয়ে রেখে দিল আস্তিনের ভাজে। মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়িয়ে চারদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল। ও। কন্টেসা ডি কারেষুর, ভাবল ও, রুচি আছে বলতে হবে। সঙ্গে অবশ্যই আছে পকেটের জোর।

রানা যেখানে পা রেখেছে সে জায়গাটাকে অরণ্য কিংবা রেইন ফরেস্ট হিসেবে কেউ ভুল করলে তাকে দোষ দেয়া যাবে না। চারপাশে সর্বত্র তৃণ সবুজ গাছ-পালা। সবুজের যে ধরনের শেড চাই সবই আছে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় উজ্জ্বল পুষ্প-পল্লব জায়গাটাকে দান করেছে বিশেষ বৈচিত্র্য। বাদুড়ের সমান একেকটা প্রজাপতি, রঙবেরঙের মোম তুল্য ডানা ঝাপ্টে ভেসে বেড়াচ্ছে, ওড়াওড়ি করছে। রঙিন পাখিরা চকচকে তীরের মতন শো-শো উড়াল দিচ্ছে। গাছ থেকে গাছে, ঝোপে-ঝাড়ে।

চিতাবাঘটাকে গাছের মোটা ডাল থেকে নিষ্ঠুর, বুনো দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে দেখে আতকে উঠল রানা। প্রবৃত্তির বশে হাত চলে গেল। ওর স্টিলেটোর ওপর। কিন্তু হেসে উঠল পরক্ষণে। চিতাবাঘটা স্টাফ করা! কিন্তু একেবারে জলজ্যান্ত যেন। বুক এখনও ধড়াস ধড়াস করছে রানার।

দরজা থেকে জঙ্গলে ঢুকেছে বেশ কতগুলো পথ। রানা এক পলকের জন্যে দ্বিধা করতে কানে এল একাধিক মানুষের কণ্ঠস্বর। একটা কণ্ঠস্বর। আরেকটা রেডিও। মৃদু হাসি ফুটল ওর ঠোঁটে। ব্যারোনেস নিশ্চয়ই খবর। শুনছে। মেরী তখন এসে না পড়লে ও-ও শুনত। রাস্তা ধরে এগোল রানা, ঘোষকের ধাতব খ্যানখ্যানে কণ্ঠস্বর অনুসরণ করছে।

ছোট্ট একটুখানি ফাঁকা জায়গায় এনে পৌঁছে দিল পথটা রানাকে। ক্যামোফ্লেজটা এতই বাস্তব, এমনই শিল্পসম্মতভাবে তৈরি, যে জঙ্গলে অবস্থান করছে আবারও এমনি অনুভূতি হলো রানার।

সুইমিং পুলে দাপাদাপি করছে ব্যারোনেস জুলি গ্রাফ। সোনালী বিকিনি। পরনে ওর। রানা পুলের কিনারায় এসে দাঁড়াতে ওকে লক্ষ্য করে সাঁতরে কাছিয়ে এল যুবতী। মুখের চেহারায় আবছা অভিমানের ছায়া।

কোথায় ছিলে এতক্ষণ, রানা? জবাব চাইল। মেরীকে সেই কখন। পাঠিয়েছি!

কখন মানে পনেরো মিনিট আগে। যাকগে-খুব সুন্দর দেখাচ্ছে কিন্তু তোমাকে, বলল রানা।

সত্যি বলছ? হাসিতে উদ্ভাসিত ব্যারোনেসের মুখ।

পুলের কিনারায় অনেকগুলো পুরু রাবার ম্যাট লক্ষ করল রানা। তার একটায় বসে বকবক করে চলেছে মাঝারি সাইজের এক ট্রানজিস্টর। আরেকটার ওপর দেখা গেল লাঞ্চ হ্যাঁম্পার ও একটা সিলভার আইস। বাকেট-একটা বোতল ঠাণ্ডা হচ্ছে ওটার ভেতর। জুলির সাদা রোবটা দখল করেছে অপর একটা রাবার ম্যাট।

পুলের প্রান্ত আঁকড়ে ধরে রয়েছে এমুহর্তে ব্যারোনেস। ভেজা চুলে আঙুল চালিয়ে সিথি করছে। মুগ্ধ সপ্রশংস দৃষ্টিতে ওকে লক্ষ করছে রানা। সত্যি সত্যিই জলপরী মনে হচ্ছে ব্যারোনেসকে। কিন্তু মুগ্ধতা নয়, জয়ী হলো রানার। পেশাদারী মনোভাব।

জিনিসটা খুলে রেখেছ মনে হচ্ছে, বলল ও।

ঝট করে ওর চোখের দিকে সরাসরি চাইল জুলি। সবুজাভ আলোয় ল্যাভেন্ডার-গ্রে রঙ ধারণ করল মেয়েটির চোখ, সঙ্গে ঝিলিক দিল সোনালী ফুলিঙ্গ। কপালে দুমুহর্ত স্থির হয়ে রইল ওর হাতটা, ভেজা চুল সরাচ্ছিল।

কোন জিনিসটা, রানা?

লকেট।

আধো হাসিটা ধরা ছিল এতক্ষণ ঠোঁটে, মুছে গেল এবার। মুখ ফিরিয়ে নিল ও। আমার-আমার মনে ছিল না তুমি আমাকে সার্চ করেছ। লকেটটার। কথা তো জেনেছই তুমি-ছবিটাও নিশ্চয়ই দেখেছ। কিন্তু ওসব কথা কি এখন না বললেই নয়?

সরি, বলল রানা। এবং মন থেকেই।

হাসি ফিরল যুবতীর মুখে। সাঁতার কাটবে এসো।

ইতস্তত করছে রানা। চারপাশের ছদ্ম-জঙ্গলে তীক্ষ্ণ, সতর্ক দৃষ্টি ঘুরে এল ওর। রঙিন পাখিগুলো কিচিরমিচির করছে, উড়ছে এদিক সেদিক। একঘেয়ে সুরে বেজে চলেছে রেডিওটা, এই ফরাসিতে এই আবার জার্মানে। রোবট। গুটিয়ে শক্ত একটা বান্ডিল করে পুলের কিনারায় রেখে দিল রানা। আপাতত বহাল তবিয়তেই থাকবে সাপের মতন বিষধর স্টিলেটোটা। ঝুঁকে পড়ে আঙুল ছোঁয়াল ও শীতল, ধাতব অস্ত্রটার গায়ে।

চারপাশে আরেকবার সাবধানী নজর বুলিয়ে নিল রানা। ওর ইন্দ্রিয় বলছে, ভয় নেই। আপাতত নিরাপদ ও।

নিশ্চিত হয়ে তারপর ঝাঁপ দিল রানা।

.

০৬.

 হোটেল হিলসনের ঘটনায় পুলিস বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়েছে ফরাসিতে ঘোষণা করছে এখন স্থানীয় রেডিওর লোকটা।

তড়াক করে সিধে হয়ে বসল মাসুদ রানা। ব্যারোনেস ক্লান্ত দেহে শুয়ে আছে ওপাশে।

কি হলো, রানা? প্রশ্ন করল যুবতী।

চুপ!

বলে চলেছে ঘোষক পুলিস অনুরোধ জানাচ্ছে জুরিখের অধিবাসী কেনেট ডাহলিন যেন দয়া করে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পুলিসের ধারণা, কেনেট ডাহলিন, যিনি গভীর রাতে জনৈক ভদ্রমহিলাকে সঙ্গে নিয়ে হোটেল হিলসনে উঠেছিলেন, অদ্ভুত এই ঘটনার ওপর আলোকপাত করতে পারবেন…

ব্যারোনেসের দিকে চেয়ে মুচকি হাসল রানা। কেনেট ডাহলিনের ঠেকা পড়েছে তো–কিন্তু নাকাতার লাশটার কথা কিছু বলল না কেন? হয়তো বলেছে, মিস করেছি আমি…

একটা হাত তুলল জুলি। শশ-কি যেন বলছে।

বিজ্ঞাপন গেছে একটা, এবার ঘোষক আরম্ভ করল আবার। হোটেলের দারোয়ান, ইম্যানুয়েল থুরামের মতে, মুখোশধারীরা কোন কিছুর সন্ধানে এসেছিল। কেনেট ডাহলিনের ব্যবহৃত রূম তারা লণ্ডভণ্ড করে দেয় এবং পেছনের উঠানে ব্যাপক অনুসন্ধান চালায়। মঁসিয়ে থুরাম জানিয়েছেন, মুখোশধারীরা তাকে পিস্তলের মুখে আটকে রাখলেও কোন ক্ষতি করেনি। আগন্তুকরা বিদায় হলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিসে খবর দেয়া হয়। পুলিস ইতোমধ্যে একবার তল্লাশী চালিয়ে এসেছে হোটেলটিতে। এর ফলে আরও কিছু বিস্ময়কর বিষয় আবিষ্কৃত হয়েছে। শ্রোতাদের আমরা কেসটির অগ্রগতি সম্পর্কে অবগত রাখব। এখন আমরা ফিরে যাচ্ছি মূল-

নব ঘুরিয়ে দিল রানা। ভ্রূ কুঁচকে উঠেছে ওর। অস্বস্তিকর এক অনুভূতি পেটের মধ্যে। নাকাতার কি হলো? ওর মৃতদেহের কোন উল্লেখ নেই, ব্যাপারটা কি?

তিনটে বিকল্প চিন্তা খেলে গেল ওর মাথায়। নাকাতার মৃতদেহ পুলিস। পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু অজ্ঞাত কারণে চেপে গেছে। নাকাতার লাশ সরিয়ে নিয়ে গেছে ওর সাঙ্গপাঙ্গরা। কিংবা নাকাতা মারা পড়েনি আদৌ!

ভুল একটা করেছে রানা এখন বুঝতে পারছে। উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়াই খাড়া। করেছে মনগড়া কল্পনা। কিন্তু তবুও খুঁতখুঁতানিটা যাচ্ছে না-নাকাতার মত একটা পলকা লোক অণ্ডকোষে অমন এক বেয়াড়া লাথি হজম করল, উপরন্ত উড়ে গিয়ে পড়ল কংক্রিটের উঠানে, তারপরও বাঁচে কিভাবে? বাঁচার সম্ভাবনা লাখে এক। নাকাতা কি তবে সেই অতি সৌভাগ্যবান ব্যক্তিটি? এ যে লটারিতে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা পাওয়ার মত ব্যাপার!

রানার মাথায় কি চিন্তা-ভাবনা চলছে জানার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে জুলি। আবার কাজের কথা ভাবছ বুঝি? এই স্বর্গে এসেও কাজের চিন্তা! ওহ, মাঝে মাঝে ঘেন্না ধরে যায় দুনিয়ার ওপর। সে যে কী ঘেন্না তুমি কল্পনাও করতে পারো না।

সবুজাভ আলোয় ওকে লক্ষ করল রানা। গ্লাস হাউজের বাইরে দিনটা মরে আসতে ক্রমে জোরাল হচ্ছে আলো। পাখিরাও কেমন ঝিম মেরে যাচ্ছে। জানি, বেবি। কিন্তু দুনিয়াকে দুষে কি হবে বলো? একসময় তো কল্পনার স্বর্গরাজ্য ছেড়ে বাস্তবে ফিরতে হয় মানুষকে-জীবনের মুখোমুখি হতে হয়। কিংবা মৃত্যুর।

কেন?

সধৈর্য হাসল রানা। হাত বুলিয়ে দিল জুলির পিঠে। আপাতত কল্পনাবিলাস ছাড়ো। আমার বসের সোজা কথা, আগে কাজ পরে আর সব।

বস্! কাল সকালে যেভাবে হোক কন্ট্যাক্ট করতে হবে তাকে। রানা এজেন্সির ওই ডিপোটায় গিয়ে আবার ফিরে আসতে সমস্যা হতে পারে। খানিকটা, কিন্তু উপায় বের করে নিতেই হবে রানাকে।

তুমি এখন বিসিআইয়ের হয়ে কাজ করছ, বলল ব্যারোনেসকে। কাজেই ওসব স্বর্গমর্তের চিন্তা ছাড়ো।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে রানাকে ভেংচি কাটল জুলি। আমি বোধহয় তোমার প্রেমে পড়ে যাচ্ছি রানা, বলে পরক্ষণে জ কুঁচকাল। না, কারও প্রেমে পড়ি না আমি। কাউকে কখনও সত্যিকারের ভালবাসতে পারিনি।

বাবাকেও না?

শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে যেন ব্যারোনেসের, আড়ষ্ট দেখাচ্ছে গোটা দেহ। চোখের পাতা কেঁপে উঠে বন্ধ হয়ে গেল। আবছা, শীতল সুরে প্রশ্ন। করল ও, একথা বললে কেন, রানা?

কেন বলেছে রানা নিজেও জানে না। মনে হলো একটা ঢিল ছুঁড়ে দেখি, দেখেছে। কিন্তু এর ফলে ব্যারোনেসের প্রতিক্রিয়া স্পষ্টতই প্রকাশ পেয়ে গেছে।

এক মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিল জুলি। কিছু মনে কোরো না রানা। হঠাৎ বাবার কথা বলায় একটু ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম।

আমারই বরং দুঃখ প্রকাশ করা উচিত, বলল রানা। বাদ দাও, আমরা বরং কাজের কথায় আসি, কেমন?

ওকে। ঢিল পড়ল ব্যারোনেসের শরীরে। মাথার নিচে দুহাত জুড়ে শুয়ে রইল চোখ বুজে।

আমি প্রশ্ন করব তুমি জবাব দেবে, ঠিক আছে?উত্তরের তোয়াক্কা না করে বলে চলল রানা, প্রথমে এই জায়গাটা সম্পর্কে জানতে চাই আমি। এবং তোমার বান্ধবী কন্টেসা ডি কারেম্বু সম্পর্কে। এটা সেফ হাউজ, মেনে নিচ্ছি আমি। কিন্তু আঁধারে থেকে কাজ করতে ভাল লাগে না আমার।

সময় হয়েছে, তন্দ্রাচ্ছন্ন কণ্ঠে আওড়াল জুলি। অনেক কথা খুলে। বলার

মনোযোগী হলো রানা।

কাজের লোক দুটোকে দিয়েই শুরু করি। মেরী নতুন এসেছে। এবারই প্রথম দেখলাম ওকে। কন্টেসার পুরানো মেইড ডেবি তার সাথে প্যারিসে থাকে। কিছু দিন আগে পাওয়া কন্টেসার শেষ চিঠিটায় জানতে পারি, মেরীকে কাজে নেয়া হয়েছে।

আর ওমর? দ্য ফ্যাট ম্যান? অদ্ভুত লোকটা, এখানে ঠিক যেন মানায় না।

অদ্ভুতই বটে। বেশিরভাগ মানুষের কাছে। তবে বহু পুরানো লোক। দেখে বোঝা যায় না, বয়স আসলে অনেক। এখানে-এখানে প্রথমবার যখন আসি তখনও দেখেছি।

ব্যারোনেসের কণ্ঠের দ্বিধাটুকু কানে লাগল রানার। কন্টেসা আর ওমর সম্পর্কে কিছু গোপন করে যাচ্ছ মনে হয়? বলল, তির্যক ভঙ্গিতে।

 দীর্ঘ নীরবতার পর জবাবটা এল। সব কথা তোমার শুনতেই হবে, রানা? এর সাথে আমাদের, রুডলফ ব্রিগল কিংবা ওদের কারও কোন সম্পর্ক নেই। বিশ্বাস করো।

সেটা আমি দেখব। তুমি বলো। রানার কণ্ঠে কাঠিন্য।

ব্যারোনেস দীর্ঘ একটা শ্বাস মোচন করল। বেশ। আমি-আমি ষোলো বছর বয়সে পরিচিত হই কন্টেসার সাথে। আমাকে ভাল লাগে তার, এবং তার অস্বাভাবিকতার সাথে একবার মানিয়ে নেয়ার পর আমারও ভাল লাগতে থাকে তাকে। আমার প্রতি আশ্চর্য মমতা ছিল তার। এবং সেটার দরকারও ছিল। আমার তখন। জীবনে ভালবাসা-মমতা কতটুকুই বা জুটেছে।

তার অস্বাভাবিকতা বলতে?

আবারও দীর্ঘ নীরবতা। সে পুরুষমানুষদের পছন্দ করে না, একেবারে। সহ্যই করতে পারে না। মেয়েদের ভালবাসে।

লেসবিয়ান?

হ্যাঁ। আঁধারে নড়ে উঠল ব্যারোনেস। দপ করে জ্বলে উঠল লাইটার। সিগারেট ধরাতে গিয়ে ক্ষণিকের জাফরানী আলোয় স্থিরদৃষ্টিতে রানাকে নিরীখ করে নিল ব্যারোনেস জুলি। এই ভিলায় কিছুদিন ছিলাম আমি। তারপর চলে যাই। ওসব আমার ভাল লাগত না। সত্যি বলছি, রানা।

তোমার নিজেকে জাস্টিফাই করার দরকার নেই, বলল রানা। তোমার। সেক্স-লাইফ নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই আমার। আমি শুধু অ্যাঙ্গেলগুলো দেখতে চাইছি।

কোন অ্যাঙ্গেল-ট্যাঙ্গেল নেই, রানা, তেতো সুরে বলল জুলি। সুসম্পর্ক বজায় রেখে বিচ্ছিন্ন হই আমি আর কন্টেসা। তার সত্যতা তো নিজের চোখেই দেখলে। যখন খুশি আসতে পারি, থাকতে পারি যতদিন ইচ্ছে। আজ সকালে সবার আগে তাই এ জায়গাটার কথাই মনে পড়ল। তা নাহলে এতক্ষণে হয় ব্রিগল, নয়তো পুলিসের হাতে ধরা পড়ে যেতাম।

বেশ, বলল রানা। তোমার গল্পটা মেনে নিলাম। কিন্তু ওই ওমর লোকটা কেমন যেন আজব ধরনের।

ব্যারোনেসকে ব্যঙ্গের হাসি হাসতে শুনে একটু থতমত খেয়ে গেল রানা। ওমর সম্পর্কে অমন প্রতিক্রিয়া আগেও অনেকের হয়েছে। তোমার খটকাটা মিটিয়ে দিচ্ছি-ও আসলে এক হতভাগ্য লোক। বেচারা খোজা।

ও, এইজন্যেই! এবার ব্যাখ্যা পাওয়া গেল তীক্ষ্ণ, মেয়েলি কণ্ঠস্বরের আর নতজানু আচরণের। সেই সঙ্গে খোলসা হলো কন্টেসার চরিত্রও। কন্টেসা পুরুষ মানুষ সহ্য করতে পারে না, কিন্তু ওমর তো সেই অর্থে পুরুষমানুষ নয়। কাজেই এতবছর ধরে ওকে মেনে নিতে অসুবিধে হয়নি মহিলার।

আবার কন্টেসার কথায় আসি- সিগারেট ধরাল রানা। আচ্ছা, এমন কোনও সম্ভাবনা কি আছে-ক্ষীণতম সম্ভাবনা–যে সে রুডলফ ব্রিগলের সঙ্গে জড়িত? কিংবা নাকাতার সাথে? ব্রিগল এ জায়গাটা সম্বন্ধে জানে এর সম্ভাবনা কতটুকু?

গলার ভেতর হাসল ব্যারোনেস। জিরো–অন্তত প্রথমটার কথা বলা যায়, একেবারেই অসম্ভব। কন্টেসার কোনদিনই রাজনীতি বা ভায়োলেন্সের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না-আর রুডলফ ব্রিগলের মত একটা লোকের মুখে সে থুথুও ফেলবে না। দুনিয়া থেকে আলাদা থাকতে চেয়েছে কন্টেসা সারাজীবন, রানা। জীবনটা সে কাটিয়ে দিয়েছে সঙ্গীতকে আঁকড়ে ধরে। অসাধারণ পিয়ানিস্ট ছিল। এখন বাতের ব্যথায় কাবু, আঙুল চলে না। প্যারিসে অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিচ্ছে। বয়স তাও প্রায় সত্তরের কাছাকাছি তো হবেই। আমার আমার সঙ্গে যখন পরিচয় হয় তখন প্রায় ষাট।

কিন্তু রুডলফ ব্রিগল যদি জায়গাটা স্পট করে থাকে? বলল রানা। ওর তো বড়সড় শক্তিশালী অর্গানাইজেশন। বিকেলে হোটেল হিলসনে যারা হাঙ্গামা। করেছে তারা ব্রিগলের লোক, কোন সন্দেহ নেই। নাকাতার এধরনের সংগঠন থাকবে না–অন্তত জেনেভায় নয়। ওরা ব্রিগলের লোক এবং খুঁজতে এসেছিল নাকাতার বাধানো দাঁত।

শেষ বাক্যটা রানার অন্তরে একটা খচখচে কাঁটা গেঁথে দিল। ব্রিগলের লোকেদের নাকাতার নকল দাঁত খোঁজ করার অর্থ, নাকাতা নিজে ব্রিগলকে জানিয়েছে কোথায় সে তার চাবির টুকরোটা রাখত। কিন্তু এর কোন অর্থ। পাওয়া যাচ্ছে না। নাকাতা ব্রিগলকে বিশ্বাস করবে না, ব্রিগল যেমন করবে না। তাকে। ব্যাঙ্কে যাওয়ার আগেই চাবির খোঁজ দেবে নাকাতা বিশ্বাস হয় না। রানার। গেলেও অবশ্য পূর্ণ সতর্কতা অবলম্বন করেই যাবে জাপানী। না, কোথাও কোন একটা গড়বড় আছে; খাজে খাঁজে পুরোটা মেলানো যাচ্ছে না। যাকগে, আপাতত ভাবনাটা একপাশে সরিয়ে রাখল রানা।

রুডলফ ব্রিগল জানতে পারে দ্বীপটার কথা, অসম্ভব নয়, বলল জুলি। অবশ্য কিভাবে জানবে বুঝতে পারছি না আমি। তবে সবই সম্ভব। বিশেষ করে এই লাইনে।

মুচকি হাসি উপহার দিল ওকে রানা। আপাতত ভুলে যাও ওটা। ও যদি জানেও আমরা এখানে, তেমন কিছুই করতে পারবে না। ওর হাত-পা বাঁধা। এবং সেটা জানেও সে। ও দস্তুরমত চাইছে এমন একটা জিনিস আছে আমার কাছে। কাজেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করার আগে আমার কোন ক্ষতি সে করবে না। পরিস্থিতিটাকে নিয়ন্ত্রণ করবে সে। আমি মারা পড়ার আগেই যাতে হাতে পেয়ে যায় জিনিসটা।

রানাকে ছুঁয়ে দিতে হাত বাড়াল ব্যারোনেস। প্লীজ, রানা! অমন কথা বোলো না!

কনজারভেটরীর ভেতর-বাইরে এখন ঘনঘোর অন্ধকার। বাইরে শরতের চোরা শীতের পরশ থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু কনজারভেটরীর ভেতরে বিরাজ করছে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রাতের উষ্ণতা। ব্যারোনেসের শরীর থেকে ভেসে আসছে পারফিউমে মিষ্টি এক হালকা সুবাস।

তোমার সম্পর্কে তো এখন পর্যন্ত তেমন কিছুই জানি না। ব্রিগলের সম্পর্কে আমাকে জানানোর দায়িত্ব তোমার, বলল রানা। রুডলফ ব্রিগলের চেহারা প্লাস্টিক সার্জারি করার পর কেমন হয়েছে, সেটা একমাত্র তুমিই জানো, এটা কি করে হয়? সে যে প্লাস্টিক সার্জারি করিয়েছে, তা-ই বা জানো কিভাবে তুমি?

মনে হচ্ছে, বলল জুলি, প্রথম থেকে শুরু করা উচিত। ভয় নেই, সংক্ষেপেই সারব। বনে শিখেছি কিভাবে রিপোর্ট তৈরি করতে হয়-বাহুল্য বাদ দিয়ে। আমার জন্ম–

ভাড়ামো ছাড়ো! রানার কণ্ঠে চাবুক।

ভাড়ামো নয়, রানা। আর সব কিছুর সঙ্গে নিজের কথাও একটুখানি। জানাব তোমাকে। এতে করে আমাকে বুঝতে সহজ হবে তোমার। পছন্দ করি না, তবু কেন কাজ করলাম বনের হয়ে জানতে পারবে। সমস্তটা বুঝলে পরে। আমার প্রতি বিশ্বাসও খানিকটা বাড়তে পারে তোমার। এখন যেটার ছিটেফোঁটাও নেই।

কে বলল নেই, একটু রূঢ় কণ্ঠেই বলল রানা। যথেষ্টই আছে। হ্যাঁ, বলে যাও।

 পশ্চিম জার্মানীর এক অভিজাত পরিবারে জন্ম হয় আমার। বাবার নাম কার্ল হাইঞ্জ গ্রাফ। মা ছিল ইংরেজ-বাবা লন্ডনের পশ্চিম জার্মান দূতাবাসে কাজ করার সময় পরিচয় হয় তাদের…

রবাটা? নামটা ইংরেজ নয়?

হ্যাঁ। আমার নানীর নামও ছিল রবার্টা। আমরা কিন্তু প্রসঙ্গ থেকে সরে যাচ্ছি।

সরি। ঈষৎ লজ্জিত হলো রানা।

আমার বাবাকে হত্যা করে ওরালকেটে ছবিটা দেখেছ তুমি, আমাকে বাধ্য করা হয় বাবার হত্যাকাণ্ড সামনে থেকে দেখতে। রীতিমত ঘটা করে হত্যা করা হয় আমার বাবাকে। কি দোষ তার? সে নাজীদের একজন কঠোর সমালোচক ছিল।

তলপেট কেমন যেন গুলিয়ে উঠল রানার। নিও নাজীরা কি জিনিস ভালই জানা আছে আমার।

ওরা মানুষ না, রানা। আমার তখন বারো বছর বয়স। মা মারা গেছে, আমাকে নিয়ে গেল ওরা বাবার মৃত্যুর সাক্ষী হওয়ার জন্যে। শিক্ষা দিতে চাইল। আসলে-রাইখের শত্রুদের কি দশা হয় নিজের চোখে দেখে যাতে শিখি। তোমাকে নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না, কে এসেছিল আমাকে নিয়ে যেতে এবং কে পরে আবার ফিরিয়ে দিয়েছিল ফুফুর কাছে?

রুডলফ ব্রিগল?

হ্যাঁ, সে-ই। নিও নাজীদের নেতা উয়ে সিলারের খুব ঘনিষ্ঠ তখন সে। সারাজীবনেও ভুলতে পারব না গুলি করার পর বাবার সে কী অসহ্য কাতরানি, বেচারা ছটফট করছিল কাটা মুরগির মতন। আমি নিজের হাতে, রানা, যদি সম্ভব হয়, খুন করতে চাই পিশাচটাকে।

ব্যারোনেসের কথা ও গলার সুর শুনে হিমশীতল একটা স্রোত নেমে গেল রানার শিরদাঁড়া বেয়ে। মনে হলো, যুবতীটির অত সুন্দর কোমল ত্বক একটা স্তরমাত্র, তার নিচে রয়েছে ইস্পাত ও জমাট বরফ।

আমি কোন কথা দিতে পারছি না, জুলি, বলল রানা। পরিস্থিতি বলে দেবে কি হতে যাচ্ছে ভবিষ্যতে। আচ্ছা, তারপর?

পরেরটুকু ভাবতেও ঘেন্না লাগে আমার। আমি টীন এজে পৌঁছতে না পৌঁছতে মারা গেল ফুফু। বাবার এক বন্ধু একটা ইনস্টিটিউশনে ঢুকিয়ে দিতে চায় আমাকে, কিন্তু পালালাম আমি। জড়িয়ে পড়লাম অপরাধ জগতের সাথে-কী না করেছি। কালোবাজারী থেকে নিয়ে ক্যাবারে ড্যান্স পর্যন্ত সবই, অবৈধ জিনিসপত্র বেচেছি! এখানে এসে গলাটা ভেঙে গেল ওর। এমনকি নিজেকেও বাধ্য হয়েছি বিক্রি করতে। গড়িয়ে রানার বাহুর মধ্যে এসে ঢুকল জুলি। কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে রানা।

কমুহূর্ত পরেই নিজেকে সরিয়ে নিল জুলি। দুগাল থেকে মুছে নিল। অশ্রু। কঠোর সংগ্রাম করে ঠিকই বেঁচে থাকলাম আমি। কিন্তু ভুলতে পারলাম না রুডলফ ব্রিগলকে।

পারার কথাও নয়, সান্ত্বনার সুরে বলল রানা। কুকুরটা সম্পর্কে আমাকে একটু জানিয়ে রাখো। লোকটা তোমার বাবাকে খুন করেও পার পেয়ে গেল কিভাবে?

ভাগ্যের জোরে। বদমাইশ নিজেরটা খুব ভালই বোঝে। আগে থেকেই সব সাজানো ছিল। খুনের দায়ে বিচার হয় ওর–কিন্তু সাজা হয়নি। বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। শুধু এটাই তো না, আরও অনেক অপকর্ম আছে ওর। এই কিছুদিন আগেই তো জার্মানীতে বসবাসরত বিদেশীদের পিছনে লেগেছিল। মারাও পড়েছে বেশ কিছু লোক।

 চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল রানার। রোজানার সরল মুখটা ভেসে উঠল। কল্পনায়।

 কিন্তু বারবার যেভাবে বেঁচে যাচ্ছে … বিশ্বাস হতে চায় না।

হ্যাঁ। বাবার ব্যাপারটা আমিও প্রথমটায় বিশ্বাস করতে পারিনি। কিন্তু এটাই সত্যি। প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন মিথ্যে সাক্ষী দেয়, এবং বেঁচে যায়। ব্রিগল। কিন্তু তারমানে এই নয় যে ওকে ভুলে যাওয়া হয়েছে। আমি তো ভুলিইনি, ভোলেনি ওয়েস্ট জার্মানি, মানে এখনকার জার্মান ইন্টেলিজেন্স পুলিসও। আর বিদেশীদের ওপর হাঙ্গামার পর সমস্ত সন্দেহ ওর ওপর গিয়ে পড়লেও প্রমাণের অভাবে কেউ কিছু করতে পারেনি।

 দীর্ঘশ্বাস মোচন করল ব্যারোনেস। ব্রিগল ছাড়া পেলে রাগে অন্ধ হয়ে। যাই আমি। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি বড় হয়ে এর উপযুক্ত প্রতিশোধ নেব। পরে সুযোগ পেয়ে জার্মান ইন্টেলিজেন্সে যোগ দিই। পার্ট-টাইম জব। কিন্তু ইন্টেলিজেন্সের সাথে যুক্ত থাকায় রুডলফ ব্রিগলের ওপর চোখ রাখা সহজ হয়ে যায় আমার জন্যে। যদিও সর্বক্ষণ চোখে চোখে রাখতে পারিনি। আর সেটা সম্ভবও ছিল না। নিশ্চিত শাস্তির হাত এড়াতে পেরে একদম সাধু বনে যায়। ব্রিগল, সন্ত্রাসবাদী রাজনীতি থেকে গুটিয়ে নেয় নিজেকে।

তারপর? সুতো ধরিয়ে দিল রানা।

হামবুর্গে সেটল করে। ছোট একটা চাকরি নেয়, বাড়ি কেনে শহরতলিতে। কয়েক বছর একদম ঘাপটি মেরে থাকে। মাঝেমাঝেই উধাও হয়ে যেত বাড়ি ছেড়ে। সম্ভবত আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেত স্বেচ্ছায়। প্রায়ই হামবুর্গে যেতাম আমি ওর হাল-চাল বোঝার জন্যে, তক্কে তক্কে থাকতাম। আশা ছিল একদিন না একদিন ঠিকই হাতেনাতে ধরে ফেলতে পারব ওকে; কোন না কোন অপকর্ম করার সময়। শাস্তি তো পাবেই, এমনকি মৃত্যুদণ্ডও হয়ে যেতে পারে। এখন হাসি পায় কি ছেলেমানুষ ছিলাম। একটা পাকা শয়তানকে ওভাবে কেউ কোনদিন ধরতে পারে?

 আসলে এক সময় না এক সময় নজর বন্দী জানোয়ার টের পেয়ে যায় তাকে নজরবন্দী রাখা হয়েছে, বলল রানা। বিশেষ করে, একই মানুষ একই জায়গার ওপর যদি চোখ রাখে তাহলে তো আরও সহজ।

কাঁচা বুদ্ধি আর কাকে বলে, তিক্ত হেসে বলল ব্যারোনেস। একা একা যতটুকু পেরেছি করেছি। আমার সহকর্মীরা অবশ্য ব্রিগলকে ভুলতে রাজি ছিল না, কিন্তু কি আর করবে তারা, অভিযোগ থাকতে হবে তো লোকটার বিরুদ্ধে। হাজার হলেও ওরা প্রফেশনাল। যুক্তি-তর্ক মেনে চলতে হয় তাদের। কিন্তু আমার তো আর তা না। আমার ব্যাপারটা ব্যক্তিগত-ঘৃণা করি আমি! অন্তর, থেকে ঘৃণা করি শয়তানটাকে।

খুবই স্বাভাবিক, বিড়বিড় করে বলল রানা। লকেটটা তো দেখেছি আমি।

হ্যাঁ, তুমি বুঝবে। যাকগে, শেষমেষ আমার স্পাইং কাজে লাগল। কিছুদিন আগে আমি তখন হামবুর্গে। যথারীতি নজর রাখছি রুডলফ ব্রিগলের। বাড়িতে। কিন্তু পাখি ভাগল। বাড়ি বেচে দিয়ে চলে গেছে কোন্ ফাঁকে। যেমন তাজ্জব হলাম তেমনি রাগ হলো। যতভাবে পারি খোঁজ নিলাম, কিন্তু কোন পাত্তা পেলাম না ওর। স্রেফ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে রুডলফ ব্রিগল। এবং এমন এক সময়ে যখন বিচারে ওকে রক্ষাকারী লোকটা, ক্যান্সারে আক্রান্ত, মৃত্যুর আগে দিয়ে সত্য কথা স্বীকার করে যাবে ঠিক করেছে। খুশিতে মাথা ঠিক ছিল না আমার। এইবার বাগে পেয়েছি বাছাধনকে!

ব্যারোনেসের কাহিনী খাপে খাপে বসিয়ে দিচ্ছে বেশ কিছু বিষয়। রুডলফ ব্রিগলের ওপর চাপ বেড়েই চলেছিল ক্রমাগত। নিঃসন্দেহে জানত লোকটা নজর রাখা হচ্ছে তার ওপর। কিন্তু হিদেতোশি নাকাতা কারামুক্ত না হওয়া। অবধি কিছুই করা সম্ভব ছিল না ওর পক্ষে। নাকাতার কাছে চাবির অর্ধেকটা ছিল যেহেতু। ধীর অথচ অপ্রতিরোধ্য গতিতে চাপ বৃদ্ধি পেতে থাকায় শেষ পর্যন্ত। ফট করে ভালভ গেছে খুলে। নিকষ অন্ধকারে নিষ্ঠুর এক টুকরো হাসি খেলে গেল রানার ঠোঁটে।

বস ওকে মিশন লেপার্ড সম্পর্কে সমস্তটা খোলসা করে বলেননি, ভাবল রানা। ও-ও বসের ওপর দিয়ে আগ বাড়িয়ে কিছু জানতে চায়নি। মিশন নয়, রুডলফ ব্রিগল জেনেভায় টেনে এনেছে ওকে। বস পাঠিয়েছেন ব্রিগলের পেছনে, ও এসেছে। কিন্তু অনেক কিছুই জানার বাকি ওর–আরও অনেক কিছু। অবশ্য বুড়োর জন্যে এটা নতুন কিছু নয়। যতটুকু দরকার তারচেয়ে বেশি কখনোই বলেন না তিনি। আর অত কথার দরকারই বা কি? রানা এসেছে। প্রতিশোধ নিতে, বাঘ-সিংহ পরের কথা।

তো ওকে আবার খুঁজে পেলে কিভাবে? জিজ্ঞেস করল রানা। ও চেহারা পাল্টানোর পর

ব্যারোনেস হাসল শীতল, নিষ্ঠুর হাসি। ও আসলে কোথাও যায়নি। বাড়ি টাড়িও বেচেনি। ওকে নজরবন্দী রাখায় সতর্ক হবার সুযোগ যেমন পেয়েছে, তেমনি ধরাও পড়েছে। ও করল কি, বাড়িটা বেচে দিয়ে চলে যাওয়ার ভান দেখাল। কিছুদিনের মধ্যে চেহারা বদলে নিল প্লাস্টিক সার্জারি করে। তারপর ফিরে এল বাড়িটার নতুন মালিক হিসেবে।

 বাহ, ভারি বুদ্ধিমান তো, স্বীকার করল রানা। তা ফিরে আসার পর কি নাম নিল খুনীটা?

লিটবারস্কি। পিয়েরে লিটবারস্কি। বেচারা হাই ব্লাড প্রেশারের রোগী। কারও সঙ্গে মেলামেশা করে না। বাসায় প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিসপত্র ডেলিভারি দেয়া হয়। কক্ষনো বাসা ছেড়ে কোথাও যায় না সে, শুধু মাঝেমধ্যে মন চাইলে রাতের বেলা একটু হাঁটাহাঁটি করে।

চেহারাটা সারানোর জন্যে।

হা। পরে বুঝতে পারি। কিন্তু কিভাবে ওকে স্পট করলাম শোনো। এক কারণে না, ওকে ধরা পড়তে হয় একাধিক কারণে। ছোট ছোট অনেকগুলো ব্যাপার। দীর্ঘদিন নজর রাখার ফলে ওর কতগুলো অভ্যেস মুখস্থ হয়ে যায়। আমার। ওর সামনে ঝোকা, কান ঘষা কিংবা চিবুক চুলকানো এসব ছোটখাট ভঙ্গি। ওর হাঁটা আর দাঁড়ানোর ভঙ্গিটাও চিনে ফেলি আমি। কথায় আছে না, কয়লার ময়লা না যায় ধুলে, স্বভাব না যায় মলে-তেমনি আরকি। মানুষ এত সহজে তার বহুদিনের অভ্যেস ত্যাগ করতে পারে না। আর এগুলোই ধরিয়ে। দেয় ব্রিগলকে। ছোট্ট একটা বাগান করেছিল ব্রিগল। কাছের ভাড়া করা রূমটা থেকে দূরবীন দিয়ে ওর কাণ্ড-কারখানা দেখতাম আমি। শেষ যেদিন হামবুর্গ গেলাম, এবং আবিষ্কার করলাম ব্রিগল নেই, তখনও হাল ছাড়িনি আমি। ওর বাড়ির ওপর কি ভেবে চোখ রাখতে গেলাম, আমার মন বলছিল ফিরে আসতে পারে সে।

ব্রিগল ফিরে আসেনি। সে আসলে কোথাও যায়ইনি। পিয়েরে লিটবারস্কি নামের লোকটাকে বাগানে কাজ করতে দেখি আমি। হঠাৎই বুঝতে পারি এই লোকই রুডলফ ব্রিগল। পরদিন ও শহরে গেলে ফলো করলাম। অনেক দিন বাদে সম্ভবত সেদিনই প্রথম বাড়ি থেকে বেরোয় সে। বাসে ওর উল্টোদিকে বসি আমি। ভাল করে লক্ষ করি মুখের চেহারা।

এবং সে-ও লক্ষ করে তোমাকে, জুগিয়ে দিল রানা।

ও আমার দিকে একবারও তাকায়নি। চমৎকার কাজ করেছে ডাক্তাররা ওর মুখের ওপর। মুখ দেখে ওর মায়েরও চেনার সাধ্য নেই।

শুধু তুমি চেনো ওকে। কিন্তু পুলিসকে বা ইন্টেলিজেন্সকে চিনিয়ে দাওনি কেন?

সুযোগ পেলে তো, বলল ব্যারোনেস। ও তো জেনেভা চলে এল।

ব্রিগল মনে হয় জানে, বলল রানা। যে আমরা তোমাকে কড়া পাহারায়। রাখব। অন্তত ও মারা না যাওয়া পর্যন্ত। মিশন লেপার্ড ঠিক সময়ে ব্রেক না করলে এতক্ষণে হয়তো পরপারে পাঠানো হত তোমাকে। তুমি খুব লাকি। নাকাতা টোকিওর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে জেনেভা পাড়ি দিয়েছে। সব ধরনের চাপ সইতে হচ্ছিল রুডলফ ব্রিগলকে। তোমাকে হত্যা করার মত সময় এখনও করে উঠতে পারেনি ও। সোনার চিতাবাঘটাকে হাতে পেতেই ব্যস্ত ¢ সে। দুপ্রাপ্য চিতাবাঘ আর নয়া চেহারা নিয়ে সম্ভবত দেশত্যাগ করবে ব্রিগল। নাকাতার সঙ্গে নাকি জাপানী কমিউনিস্টদের যোগাযোগ রয়েছে। তাকে কিভাবে, সামলাবে ব্রিগল সে-ই জানে। কারণ চিতাবাঘের একজন ভাগীদার তো সে ও। কিন্তু পালালেও পেছনে আলগা সুতো ফেলে রেখে যেতে রাজি নয় ব্রিগল। তুমি কিন্তু, জুলি, ওর জন্যে সত্যিই একটা হুমকি।

আমি জানি, রানা। বলল জুলি। সেজন্যেই বলছি কি, আমার খুদে বন্ধু দুটোকে ফেরত দাও। আমার নিরাপত্তার জন্যেই ওগুলো দরকার।

সকালে পাবে, কথা দিল রানা। আর তোমার নিরাপত্তার ভার, আমার ওপর ছেড়ে দাও। এসো, ঘরে যাবে। উঠে দাঁড়িয়েছিল রানা, এবার একটানে দাঁড় করিয়ে দিল ব্যারোনেসকে।

খাবে না! ওফ, খিদেয় মরে যাচ্ছি আমি। আর ওয়াইন-ওটা তো ছুঁয়েও দেখিনি আমরা। খুবই চমৎকার ওয়াইন-কন্টেসার দুর্দান্ত একটা সেলার আছে।

ফাইন। লাঞ্চ হ্যাঁম্পার আর কুলার থেকে ওয়াইনের বোতলটা তুলে নিল রানা। তুমি ড্রিঙ্ক কোরো। তবে ভাল মত ঘরের দরজা লক করে, তারপর। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পোড়ো। আমি একটু টহল মারব চারধারে।

ইতোমধ্যে রোবটা গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে ব্যারোনেস। ওকে ঘরের দরজায় পৌঁছে দিয়ে চলে যাওয়ার সময় বলল রানা, রুডলফ ব্রিগলকে দেখলে সত্যিই চিনতে পারবে তো? যদি দেখা পাই আরকি।

ওর লাশপচা মুখও চিনতে ভুল হবে না আমার, দৃঢ় কণ্ঠে উচ্চারণ করল জুলি।

আশা করা যাক, বলল রানা। কবরে ওকে দেখতে পাব আমরা, তোমাকে নয়।

<

Super User