০৬.

বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে গেছে রানা, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লামিয়ার দিকে।

বিস্মিত হওয়াটাই স্বাভাবিক, বুলল লামিয়া। কারণ ব্যাপারটা যখন টের পাই, আমি নিজেও থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম।

নিজেকে সামলে নিল রানা। কে কবে শুনেছে বাঁচিয়ে তোলা যায় মরা মানুষকে?

যাদেরকে লাশ বলে মনে করছ, তারা কেউই এখনও মরেনি। আমরা তাই মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছি কেন তারা মড়ার মতো হয়ে আছে তা জানতে এবং ওই অবস্থা থেকে তাদেরকে বের করে আনতে।

ওদের কয়েকজনকে চেক করেছি আমি নিজে। কেউই দম নিচ্ছে না। পাস পরীক্ষা করলে ওদের হার্টবিট পাওয়া যায় না।

তারপরও ওরা দম নিচ্ছে, ওদের হৃৎপিণ্ড রক্ত পাম্পও করছে, তবে লম্বা বিরতিতে। গড়ে প্রতি দুই মিনিট পর পর একবার শ্বাস নিচ্ছে। আর হার্টবিট নেমে এসেছে সিঙ্গেল ডিজিটে। ভেন্ট্রিকুলার কন্ট্রাকশন এত দুর্বল যে, তা ধরা সম্ভব না সাধারণ কোনও মনিটরের পক্ষে।

মানে এক ধরনের কোমায় চলে গেছে ওরা?

আমরা তা-ই ধরে নিয়েছি। কিন্তু ও-রকম কোনও কোমা কখনও দেখিনি, শুনিওনি। সাধারণ কোমায় ব্রেইনের একটা অংশ কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। তখন কাজ চালিয়ে যায় ওটার সবচেয়ে গভীর আর আদিম কোনও অংশ। কিন্তু লিনোসার মানুষগুলোর ব্রেইন বলতে গেলে সম্পূর্ণ অচল হয়ে গেছে। অথচ আমরা কোনও ওষুধ বা উদ্দীপনা প্রয়োগ করলে তাতে সাড়া দিচ্ছে।

মানে?

ওদের মস্তিষ্কের কোনও ক্ষতি হয়নি, অথচ ওরা জেগে উঠতে পারছে না।

কিছু বলল না রানা। ডাক্তারি জটিলতায় তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে ওর।

একটা উদাহরণ দিই, বলে চলল লামিয়া। মনে করো ওরা সবাই একেকটা কম্পিউটার। কেউ একজন স্ট্যাণ্ডবাই বা স্লীপ মোডে দিয়ে রেখেছে ওদেরকে। অন্য কেউ এসে দেখছে, ওরা নষ্ট হয়ে যায়নি, অর্থাৎ মারা যায়নি। কিন্তু ভালো কম্পিউটার, আই মীন জীবিত মানুষের যেসব বৈশিষ্ট্য দেখা যায় তার প্রায় কোনওটাই নেই ওদের মধ্যে। এখন পাওয়ার সুইচ যতই চাপাচাপি করি, কম্পিউটার আর চালু করা যাচ্ছে না।

অক্সিজেন-বঞ্চিত থাকতে থাকতে এতক্ষণে ব্রেইন ড্যামেজ হয়ে যাওয়ার কথা লোকগুলোর।

আমার মনে হয় যেহেতু ওদের শরীরের তাপমাত্রা কমে গেছে, কোষগুলো স্বাভাবিক কার্যক্রম প্রায় থামিয়ে দিয়েছে, সেহেতু স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে অনেক কম অক্সিজেন লাগছে। অর্থাৎ অনিয়মিত শ্বাসগ্রহণ এবং দুর্বল কার্ডিওভাস্কুলার অ্যাক্টিভিটির পরও বেঁচে আছে ওরা। নষ্ট হয়নি কারও মস্তিষ্ক। তবে ইলেকট্রিক শক অথবা অ্যাড্রেনালিন ইনজেকশনের মাধ্যমে সারিয়ে তোলা যাচ্ছে না কাউকেই।

কালো কুয়াশা কী ধরনের বিষ?

এখনও জানি না।

কালো কুয়াশাতেই তো ছিল ওই বিষ, নাকি?

অনিশ্চিত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল লামিয়া। নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কুয়াশা বা ধোঁয়াশা যা-ই বলো, ওটার স্যাম্পল জোগাড় করা হয়েছে, পরীক্ষা করা হয়েছে। পোড়া পেট্রোলিয়ামের ধোয়া বাদে পাওয়া গেছে সীসা ও অ্যাযবেস্টসের সামান্য উপস্থিতি-কোমও জাহাজে আগুন লাগলে সাধারণত যা পাওয়া যায়।

কিন্তু এটা নিশ্চয়ই স্বীকার করবে, এম.ভি, টায়ানায় আগুন লাগা, অন্যভাবে বললে লিনোসায় কালো কুয়াশার বিস্তার ঘটা এবং দ্বীপের এতগুলো মানুষের কোমায় চলে যাওয়া কাকতালীয় ঘটনা না?

প্রমাণ কী? চোখ জ্বালাপোড়া করা, হাঁপানি রোগীর মতো শব্দ করে দম নেয়া, শ্বাসকষ্ট হওয়া-কোনও নমুনাই তো নেই লিনোসার কোমা রোগীদের মধ্যে? কাজেই কী করে স্বীকার করি প্রভাব বিস্তার করেছে লিনোসায়?

ডেস্কে দুই কনুই ঠেকিয়ে সামনে ঝুঁকল রানা। তোমার রোগীদের কোমার জন্য যদি দায়ী না হয়, তা হলে দায়ী কী?

যে-জিনিসকে তুমি বলছ, আমাদের ধারণা ওটা কোনও জাতের নার্ভ টক্সিন-টায়ানায় ঘটা বিস্ফোরণের কারণে ছড়িয়েছে। কেউ হয়তো ইচ্ছা করেই ঘটিয়েছে। বিস্ফোরণটা। আবার ওটা দুর্ঘটনাও হতে পারে। লিনোসার মাটি, বাতাস কিংবা যারা বিষের-শিকার-হয়েছে তাদের রক্ত পরীক্ষা করে জানা গেছে, ওই বিষ বায়োলজিকাল এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নিজেকে গায়েব করে ফেলতে সক্ষম।

বিস্ফোরণটা ইচ্ছাকৃত? লিনোসার সঙ্গে শত্রুতা ছিল কার?

জানি না, রানা। যাতে জানতে পারি সেজন্য খতিয়ে দেখা হচ্ছে, কেন ঘটল বিস্ফোরণটা।

চেয়ারে হেলান দিল রানা, এদিকওদিক তাকাচ্ছে। লামিয়ার পেছনে দুটো হোয়াইটবোর্ডে কিছু ডাক্তারি কথাবার্তা লেখা আছে। ওগুলোর উপর নজর বুলিয়ে ওর মনে হলো, লিনোসার রোগীদেরকে এখন পর্যন্ত কী কী ওষুধ দেয়া হয়েছে তা লিখে রাখা হয়েছে। আরেকদিকের দেয়ালে ঝোলানো আছে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের একটা ম্যাপ। ওটার জায়গায় জায়গায় পিন গাঁথা। একটা পিন লিবিয়ার উপর। আরেকটা ছেঁদা করেছে উত্তর সুদানকে। আরও কয়েকটা বারোটা বাজিয়েছে মধ্যপ্রাচ্য এবং পূর্ব ইউরোপের।

লামিয়া, রেডিও মেসেজে বলছিলে, আক্রান্ত হয়েছ তোমরা। আক্রান্ত শব্দটা ব্যবহার করলে কেন? ইঙ্গিতে ম্যাপটা দেখাল রানা। ও-রকম ঘটনা কি আগেও কোথাও ঘটেছে?

তুমি অনেককিছুই খেয়াল করো। …হ্যাঁ, ঘটেছে। লিনোসায় যারা আক্রান্ত হয়েছে বিষক্রিয়ায়, মাস ছয়েক আগে ওদের মতো অবস্থায় পাওয়া গেছে লিবিয়ার একদল প্রগতিবাদীকে। কেউ জানে না ঠিক কী হয়েছিল লোকগুলোর। অসুস্থ হয়ে পড়ার আটদিনের মাথায় মারা যায় ওরা সবাই। লিবিয়ার সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্ক আছে ইটালির, তাই ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে রাজি হয় আমাদের সরকার। একটু থেমে দম নিল লামিয়া। কাজ শুরু করার কিছুদিনের মধ্যে জানতে পারি, লিবিয়ার কয়েকটা হাসপাতালে একই ঘটনা ঘটেছে। তারপর…ম্যাপে যেসব জায়গায় পিন গাঁথা আছে সেগুলোর সবখানে…বুঝতেই পারছ।

চুপ করে আছে রানা, ভাবছে। বোঝার চেষ্টা করছে, কোথাও কোনও ক্লু আছে কি না।

আজব এক সামঞ্জস্য পাওয়া গেছে প্রতিটা ঘটনায়, বলছে লামিয়া। হয় প্রগতিবাদী, মানে যারা বিপ্লবের মাধ্যমে দেশ বা সমাজের সংস্কার ঘটানোর পরিকল্পনা করেছিল, নয়তো বড় মাপের কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বার বার শিকার হয়েছে ওই অসুস্থতার। ওদের বেশিরভাগই মারা গেছে, কেউ কোমায় আছে এখনও।

তোমাদের তদন্তের কী অবস্থা?

উল্লেখযোগ্য কোনও অগ্রগতি নেই। একটা টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে, ভাসমান ল্যাবরেটরি হিসেবে ব্যবহার করছি এই জাহাজ। এখনও জানার চেষ্টা করছি, আজব এই অসুস্থতার ব্যাখ্যা কী।

এখানে তোমার ভূমিকা কী?

আমি একজন ডাক্তার, নিউরোবায়োলজিতে বিশেষজ্ঞ। ইটালি সরকারের হয়ে কাজ করছি।

লিনোসা উপকূলে টায়ানায় বিস্ফোরণ ঘটল, ওই সময়ে দ্বীপটাতে ছিলে তুমি-ঘটনাটা কি কাকতালীয়?

মুচকি হাসল লামিয়া। দেখা যাচ্ছে, শেষপর্যন্ত সব কথাই বলতে হবে তোমাকে। …রহস্যময় অসুস্থতার সঙ্গে যোগসূত্র আছে, এ-রকম সন্দেহভাজন এক ডাক্তারকে খুঁজে পেয়েছিলাম লিনোসায়। দ্বীপের হাসপাতালে কাজ করত লোকটা।

কে সে? আমাদের উপর হামলা চালিয়েছিল যে-লোক?

না। তোমাদেরকে খুন করতে চেয়েছিল যে, তাকে আমরা চিনি না। ওর জামাকাপড় খুঁজে কোনও আইডি কার্ড পাওয়া যায়নি। ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে সেটা যে যাচাই করব, তারও উপায় ছিল না-কালো কুয়াশার কারণে আঙুলের টিস্যু ক্ষয়ে গিয়েছিল ওই লোকের। তখন দ্বীপে যারা ছিল, তাদের সবার সঙ্গে মেলানো হয়েছে লোকটার শারীরিক বর্ণনা; কোনও মিল পাওয়া যায়নি।

তারমানে সে একজন অভিবাসী? রাজনৈতিক আশ্রয়ের খোঁজে গিয়েছিল লিনোসায়?

যারাই অভিবাসনের উদ্দেশ্যে আসে ইটালিতে, চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয় তাদের সবার ডিটেইলস। ওই লোকের সঙ্গে কোনও ম্যাচ পাওয়া যায় কি না, জানার জন্য বেশকিছু রেকর্ড চেক করেছি আমরা। কিন্তু কিছুই পাইনি।

তোমাদের সেই সন্দেহভাজনটি কে?

ওর নাম ডারহাম। লিনোসার হাসপাতালে পার্টটাইম ডাক্তারি করত। ওর অতীত ভালো না…মানে অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল বেশ কয়েকবার। খবর পেয়েছিলাম, কোনওকিছুর চালান বুঝে নেয়ার জন্য অপেক্ষা করছে সে লিনোসায়। আজ আসার কথা ছিল চালানটার। কিন্তু ওটা কোত্থেকে আসছে, কে ডেলিভারি দেবে, অথবা ওটা আসলে কীসের চালান-জানতাম না কিছুই।

ডারহামকে সন্দেহ করলে কী করে?

ইঙ্গিতে ম্যাপটা দেখাল লামিয়া। আজব কোমার খবর পাওয়া গেছে, এ-রকম অন্তত চার জায়গায় ওর উপস্থিতির ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছি আমরা। ঘটনাটা একবার বা দুবার ঘটলে কাকতালীয় বলতে পারতাম, কিন্তু চারবার? মাথা নাড়ল।

তারমানে আমাকে আর আমার বন্ধুকে খুন করতে চাইছিল যে-লোক, সে-ই ডারহামের এজেন্ট। আর চালানটা ছিল নার্ভ টক্সিনের। কিন্তু টায়ানায় বিস্ফোরণ ঘটায় নষ্ট হয়ে গেছে ওদের পরিকল্পনা।

আমারও তা-ই মনে হয়।

 ডারহামের কী হয়েছে?

 খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

মানে?

আমাদের টিম কড়া নজরে রেখেছিল লোকটাকে। কিন্তু নার্ভ টক্সিনে আক্রান্ত হয়েছে ওরাও, ডারহাম সেই সুযোগে সম্ভবত পালিয়েছে।

তারমানে কালো কুয়াশার বিষক্রিয়া থেকে বাঁচতে পেরেছে শুধু দুজন? ডারহাম আর সেই খুনে এজেন্ট?

মাথা ঝাঁকাল লামিয়া।

সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় কালো কুয়াশার অ্যান্টিডোট ব্যবহার করছিল ওরা, যা পক্ষাঘাতের প্রভাব ঠেকিয়ে দিয়েছে ওদের শরীরে। কোমায় যায়নি কেউই।

কিন্তু ডারহামের অফিস, বাসা বা গাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও ও-রকম কোনও অ্যান্টিডোট পাওয়া যায়নি। খুনে এজেন্টের রক্তও পরীক্ষা করা হয়েছে। কোনও অ্যান্টিডোটের উপস্থিতি ধরা পড়েনি।

আশ্চর্য লাগছে আমার কাছে।

আমার লাগছে না। একটু আগেও বলেছি, কয়েক ঘণ্টা সক্রিয় থাকার পর গায়েব হয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আছে ওই নার্ভ টক্সিনের। একই কথা প্রযোজ্য হতে পারে ওটার অ্যান্টিডোটের ক্ষেত্রেও।

ডারহামকে খুঁজে বের করতে পারলে অনেককিছু জানা যেত। লোকন পালিয়ে কোথায় গেছে?

কিছু বলার আগে রানার চোখে চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল লামিয়া। কেন জানতে চাইছ?

কৌতূহল।

ডারহামকে খুঁজে বের করার কথা ভাবছ?

আমি ওকে খুঁজে বের করার কে? একজন সাধারণ ডুবুরির পক্ষে…।

কেন শুধু শুধু নিজের পরিচয় গোপন করার চেষ্টা করছ? আমি ইতোমধ্যে কথা বলেছি অ্যাডমিরাল হ্যাঁমিল্টনের সঙ্গে। নুমার সঙ্গে তোমার সম্পর্কের ব্যাপারে খোলামেলা মন্তব্য করেছেন তিনি।

রানা কিছু বলল না।

অ্যাডমিরাল বলেছেন, তোমার কাছে সাহায্য চাওয়া যেতে পারে। আরেকটা কথা। কয়েকজন বাংলাদেশীর একটা টিম কাজ করছিল লিনোসায়। ওদের একজনকে যেই খোঁচাতে উদ্যত হলো আমাদের এক ডাক্তার, মারমুখী হয়ে, গেলে তুমি। তারমানে তুমিও কি বাংলাদেশী? ওই টিমের সঙ্গে সম্পর্ক আছে তোমার?

ধরে নাও তা-ই।

রহস্যময় হাসি হাসল লামিয়া। তোমার সঙ্গে তোমার বন্ধু সোহেলকেও জুটিয়ে নিতে বলেছেন অ্যাডমিরাল। বলেছেন, তিনি নাকি তোমাদের বাংলাদেশী বসকে ম্যানেজ করে নেবেন।

ম্যানেজ না করলেও, মনে মনে বলল রানা, আরেকটা অ্যাসাইনমেন্ট যে চাপতে যাচ্ছে আমার আর সোহেলের ঘাড়ে, তাতে সন্দেহ নেই। বুড়ো খোকা যখন জানতে পারবে বিসিআই-এর পাঁচ এজেন্ট কোমায় চলে গেছে, তখন…। তারমানে তুমি অফিশিয়ালি সাহায্য চাইছ আমাদের কাছে? বলল ও।

হ্যাঁ। যে বা যারা নার্ভ টক্সিনের জন্য দায়ী, তোমাদের দুজনকে সঙ্গে নিয়ে ওদেরকে খুঁজে বের করতে চাই, ওদের এই ভয়ঙ্কর খেলা থামাতে চাই।

কিন্তু আমাদেরকে সঙ্গে নিতে চাও কেন?

কারণ আমি বুঝতে পেরেছি, তোমরা দুজন একদল ডাক্তার কিংবা পুলিশের চেয়ে বেশি কিছু। ভেবে দেখো, যদি সফল হই আমরা, যদি ওই অ্যান্টিড়োট উদ্ধার করতে পারি, কোমায় থাকা এতগুলো লোককে বাঁচাতে পারব।

কোত্থেকে শুরু করতে চাও?

মাল্টা। সেখানে গত তিন মাসে তিনবার গেছে ডারহাম। একটা ড্রয়ার খুলল লামিয়া, একটা ফাইল ফোল্ডার বের করে ডেস্কের উপর রাখল। ওটার ভিতর থেকে বের করল একগাদা সার্ভেইলেন্স ফটো, দিল রানাকে। এই লোকের সঙ্গে গত তিন মাসে তিনবার দেখা করেছে ডারহাম। লোকটার সঙ্গে সপ্তাহ দুয়েক আগে তর্কাতর্কিও করতে দেখা গেছে ওকে।

হাতে নিয়ে ছবিগুলো দেখছে রানা।

অচেনা লোকটার চেহারা ভার্সিটির প্রফেসরদের মতো। দুই কনুইয়ে তালিওয়ালা টুইডের জ্যাকেট বোধহয় পছন্দ ওর, কারণ বেশিরভাগ ছবিতে তা-ই পরে থাকতে দেখা যাচ্ছে ওকে। একটা ছবিতে দেখা গেল আউটডোর ক্যাফেতে বসে আছে, সঙ্গে আরও তিনজন লোক। কথা বলছে। দেখলে মনে হয়, ওকে ঘিরে ধরেছে লোকগুলো।

ঝুঁকে এসে ফটোর একজনের উপর একটা আঙুল রাখল লামিয়া। এর নাম ডারহাম। বাকি দুজনের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারিনি আমরা এখনও। ধরে নেয়া যায় ওরা ডারহামের সহচর।

প্রফেসরদের মতো দেখতে লোকটা কে? জিজ্ঞেস করল রানা।

মাল্টা ন্যাশনাল মিউযিয়ামের কিউরেটর।

জাদুঘরের কিউরেটররা সাধারণত সন্ত্রাসীদের সঙ্গে হাত মেলায় না, নার্ভ টক্সিন বা বায়োলজিকাল ওয়েপন চালান করে না। এই লোকের সঙ্গে ডারহামের যোগাযোগের ব্যাপারে তোমরা নিশ্চিত?

আমরা আসলে কোনও ব্যাপারেই শতভাগ নিশ্চিত না। তবে অনুমান করছি কিউরেটরের সঙ্গে নিয়মিত দেখা করত ডারহাম।

কেন?

আগামী তরশু একটা পার্টির পর নিলাম হওয়ার কথা ওই জাদুঘরে। ওদের কাছ থেকে প্রাচীন কিছু আর্টিফ্যাক্ট কিনতে চাইছিল ডারহাম।

অসুবিধা কী? সন্ত্রাসীদের কি শখ থাকতে পারে না?

পারে। কিন্তু প্রাচীন আর্টিফ্যাক্ট সংগ্রহ করা ডারহামের শখ না। ওকে জিজ্ঞেস করেছি কয়েকবার, একবারও স্বীকার করেনি কোনও শখ আছে ওর। অন্তত ওই কিউরেটরের সঙ্গে মোলাকাত হওয়ার আগপর্যন্ত ছিল না।

কিন্তু ডারহাম নিশ্চয়ই এত বোকা না যে, লিনোসা থেকে পালিয়ে সোজা হাজির হবে মাল্টায়?

কিউরেটরের সঙ্গে যেদিন সাক্ষাৎ হয় ডারহামের, তার পরদিনই ওখানকার একটা ব্যাঙ্কে নিজের নামে অ্যাকাউন্ট খোলে সে। ইন্টারপোল নিশ্চিত করেছে, ওই অ্যাকাউন্টে এখন পর্যন্ত দুলক্ষ ইউরো জমা হয়েছে। এবং সেটা কখন ঘটেছে, জানো? লিনোসার ঘটনাটার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে।

তারমানে, ভাবছে রানা, ডারহাম শুধু বেঁচেই নেই, লিনোসা ছেড়ে নিরাপদে পালিয়েছে ও। এবং তার আগে মোটা অঙ্কের টাকা ট্রান্সফার করেছে মাল্টায়। কাজেই, অন্তত একবারের জন্য হলেও মাল্টায় যাবে লোকটা, দেখা করবে কিউরেটরের সঙ্গে।

তুমি আর সোহেল সাহায্য করবে আমাকে, রানা? লামিয়ার প্রশ্নে চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল রানার।

হ্যাঁ, করব।

তা হলে মাল্টায় যাও, অপেক্ষা কোরো আমার জন্য। কোমা রোগীদেরকে কোনও একটা হাসপাতালে ভর্তি করিয়েই ওখানে চলে যাব আমি। একটা অনুরোধ-আমি না পৌঁছানো পর্যন্ত কোনও অ্যাকশনে যেয়ো না।

চেষ্টা করব, উঠে দাঁড়াল রানা, এগিয়ে যাচ্ছে দরজার দিকে।

.

০৭.

 সারওয়ার বিন জামাল সিনেমার নায়ক নয়, কিন্তু চেষ্টা করলে হতে পারত।

দীর্ঘদেহী, শরীরের কোথাও এক ছটাক বাড়তি মেদ নেই। সুদর্শন চেহারাটা রোদেপোড়া, কালো চুলেও বাদামি আভা আছে। চৌকোনা চোয়াল নিঃশব্দে বলে দিচ্ছে, অঢেল আত্মবিশ্বাস আছে ওর নিজের উপর। এই মুহূর্তে ওর পরনে সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মতো ইউনিফর্ম। ওর সঙ্গে যারা আছে তারাও একই রকম উর্দি পরে আছে, কিন্তু সারওয়ারের সাজসজ্জা দেখলে মনে হয় সে প্রেসিডেন্ট, বাকিরা আমজনতা। মিশরের মরুভূমিতে, গিজার পিরামিডগুলো থেকে মাইল সাতেক পশ্চিমে, নিজের হাইড্রো ইলেকট্রিক প্লান্টে আছে সে কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহচরসহ।

কয়েক বছর আগেও মিশরের সিক্রেট পুলিশবাহিনীতে ছিল সারওয়ার। তখন হোসনি মুবারাকের শাসনকাল শেষ হয়ে এসেছে। সারওয়ার তখন সিক্রেট পুলিশের সেকেণ্ড-ইন কমাণ্ড হিসেবে মুবারাকের শত্রুদের খুঁজে বের করে গুম করছে, চেষ্টা করছে আরব বসন্তের মিশরীয় সংস্করণের টুটি চেপে ধরার, যাতে দেশটার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট উল্টে না যায়। সারা দেশে সে-সময় সাংঘাতিক গণ্ডগোল।

ডামাডোল যখন আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে আসছে, সবাই যখন একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ব্যাপারে কমবেশি নিশ্চিত হয়ে গেছে, তখন সারওয়ার ভাবল, কেন অযথা আরেকজনের গদি বাঁচানোর বৃথা চেষ্টা চালিয়ে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনছে সে? তার চেয়ে নিজের ভবিষ্যতের জন্য কিছু করাই কি ভালো না?

সিক্রেট পুলিশে চাকরির অভিজ্ঞতার পাশাপাশি আছে তার বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শিতা। বাছাই-করা লোকদের নিয়ে আমেনথেস, মানে, প্রাচীন মিশরের মৃত্যুদেবতা ওসিরিসের আরেক নামে একটা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করল সারওয়ার। যে ব্যবসা চালিয়ে যেতে অন্যরা দশবার ভাববে, পেশিশক্তিকে পুঁজি করে বুক ফুলিয়ে নেমে পড়ল সেটাতে। পয়সাওয়ালা হতে বেশি সময় লাগল না ওর।

জন্মের পর থেকে এতদিন অপরাধের সঙ্গে বড় রকমের সম্পৃক্ততা ছিল না আমেনথেসের। কিন্তু গত সাত-আট মাসে অন্য চিন্তা খেলা করেছে সারওয়ারের মাথায়। কোটিপতি তো অনেক আছে দুনিয়ায়, কিন্তু রাজাদের রাজা আছে কজন? শুধু পয়সাই না, প্রচণ্ড ক্ষমতা চায় সারওয়ার; এমনকিছু হতে চায় যাতে মিশরের মানুষ হোসনি মুবারাককে ভুলে গিয়ে মনে রাখে ওর নাম। এবং ওর হিসেবে গরমিল না হলে আর কিছুদিনের মধ্যে শুধু মিশর না, উত্তর আফ্রিকার বেশিরভাগ অঞ্চল শাসন করবে আমেনথেস।

চার-পাঁচ টুকরো বরফ একটা গ্লাসে নিয়ে তাতে দুপেগ জিন ঢেলে সোফায় বসে আছে সে-ঘোট ঘোট চুমুকে মদ খেতে পছন্দ করে। ওর কাছে গিয়ে দাঁড়াল ওর সবচেয়ে কাছের লোক হুসাইন আখতার। বলল, খারাপ খবর আছে।

অলস ভঙ্গিতে আখতারের দিকে তাকাল সারওয়ার, কিছু বলল না।

খালফানি মারা গেছে।

জিনের গ্লাসে চুমুক দিতে গিয়ে থমকে গেল সারওয়ার, তাকিয়ে আছে আখতারের দিকে।

শেষপর্যন্ত ডারহামের সঙ্গে দেখা করতে পারেনি সে। মারা পড়েছে নুমার দুজন সদস্যের হাতে।

নুমা নামটা সারওয়ারের পরিচিত। সংগঠনটার কাজকর্ম সম্পর্কে অবগত।

খালফানি মারা যাওয়ায় আমাদের কোনও সমস্যা হবে না তো? কাজের কথায় চলে গেল আখতার।

সে কী বলতে চায়, বুঝে নিল সারওয়ার। ওই জাহাজ বা চালান বা খালফানিকে যদি তন্নতন্ন করেও খোঁজে কেউ, আমাদের কোনও সম্পৃক্ততা পাবে না।

ডারহামের কী হবে? ওর হাতে কালো কুয়াশার চালান তুলে দেয়ার কথা ছিল খালফানির, যাতে ওটা ব্যবহার করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সরকারকে চাপে রাখতে পারে সে।

ডারহাম পালিয়ে মাল্টায় গেছে। নিলামে ওঠার আগেই আর্টিফ্যাক্টগুলো কিনে নেবে সে। না পারলে চুরি করার চেষ্টা করবে। আগামী দুদিনের মধ্যে আমার কাছে রিপোর্ট করার কথা ওর।

এখন একমাত্র ডারহামই পারে আমাদেরকে ফাঁসিয়ে দিতে। ওকে যত জলদি সম্ভব শেষ করে দেয়া উচিত আমাদের।

তা-ই করব, তবে আগে আর্টিফ্যাক্টগুলো হাতিয়ে নিক। আমি চাই, ওগুলো অন্য কারও হাতে পড়ার আগে আমার হাতে আসুক।

এত কষ্ট করার কি দরকার আছে? আমরা নিজেরাই কিন্তু নিশ্চিত কী আছে আর্টিফ্যাক্টগুলোর ভিতরে।

বিরক্ত হলো সারওয়ার।

তোমার একের পর এক প্রশ্ন শুনে মনে হচ্ছে, আমি আসামি হিসেবে দাঁড়িয়ে আছি কাঠগড়ায়, আর তুমি বাদীপক্ষের উকিল। …ইউরোপের বড় বড় রাজনৈতিক নেতাকে কোমায় পাঠিয়ে দিতে চাই আমি। ফলে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই মহাদেশটার বড় একটা অংশের ওপর আমার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হবে। কেউ যদি আর্টিফ্যাক্টগুলোর মধ্যে কালো কুয়াশার অ্যান্টিডোটের ফর্মুলা পেয়ে যায়, তা হলে বানচাল হয়ে যাবে আমাদের সমস্ত পরিকল্পনা।

আখতার ভয় পায় সারওয়ারকে, দুপা পিছিয়ে গেল তাই। কিন্তু… বলবে কি বলবে না ভাবতে ভাবতে শেষপর্যন্ত বলে ফেলল, ওই ফর্মুলা যে আর্টিফ্যাক্টগুলোর মধ্যেই পাওয়া যেতে পারে, জানলে কী করে?

জানি বললে ভুল হবে। অনুমান করেছি। আসলে আমি চাই না আর্টিফ্যাক্টগুলো অন্য কারও হাতে পড়ক।

ডারহাম কি ওগুলো হাতিয়ে নিতে পারবে? সে তো তেমন কৌশলী না।

ওকে ব্যাকআপ দেয়ার জন্য আমাদের লোক পাঠাও। ওদেরকে বলবে, আমাদের উদ্দেশ্য পূরণ হওয়ামাত্র অথবা ডারহাম যদি বোঝায় পরিণত হয়, তা হলে যেন সঙ্গে সঙ্গে শেষ করে দেয়া হয় ওকে।

অবশ্যই। কোন কোন এজেন্টকে পাঠাব তা নিজে বাছাই করব আমি। …তোমার সঙ্গে কথা বলতে আমেনথেসের কয়েকজন স্টকহোল্ডার আর বোর্ডমেম্বার এসেছেন।

আমেনথেস একটা প্রাইভেট মিলিটারি ফোর্স, সারওয়ার সেটার প্রেসিডেন্ট এবং সিইও, তারপরও একচ্ছত্র অধিপতি নয়। জবাবদিহিতা পছন্দ না হওয়ার পরও স্টকহোল্ডার আর বোর্ডমেম্বারদের মুখোমুখি হতে হয় ওকে। কারণ কোটি কোটি টাকা নিয়ে এবং অভাবনীয় ক্ষমতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ওই লোকগুলোকে দলে ভিড়িয়েছে সে।

হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্রান্টের আশপাশে বেশকিছু পাম্পিং স্টেশন বানিয়েছে সারওয়ার; খররোদে ঝিকমিক করছে সেগুলোর বড় বড় পাইপ। অন্য ব্লক স্ট্রাকচারগুলো কালো রঙের। পুরো স্টেশন সিস্টেম ঘেরাও করে ফেলা হয়েছে কাঁটাস্তারের বেড়া দিয়ে, একদিকের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে দুজন গার্ড। সারওয়ারকে এগিয়ে যেতে দেখে দরজা খুলে ধরে রাখল

ওরা। সে ভিতরে ঢোকার পর লাগিয়ে দিল ওটা।

হাঁটতে হাঁটতে স্টেশন সিস্টেমের পেছনদিকে চলে এল সারওয়ার। এখানে একটা মাইনিং এলিভেটল্লকে আড়াল করেছে আরেকটা দরজা। একসঙ্গে অনেক লোক অথবা ভারী যন্ত্রপাতি বহন করতে পারে এলিভেটরটা। দরজা খুলে ওটাতে উঠল সারওয়ার, নিচে নামার বাটনে চাপ দিল।

নামল চার শ ফুট নিচে। এলিভেটরের দরজা খুলে পা রাখল গুহার মতো দেখতে ভূগর্ভস্থ কম্পাউণ্ডে। জমিনের কোনায় কোনায় আর দেয়ালের বিভিন্ন জায়গায় জ্বলছে বেশ কয়েকটা লাইট, আলোকিত হয়ে আছে প্রশস্ত প্রবেশপথ। দৈর্ঘ্যে দুশ গজের মতো এই গুহার কিছুটা অংশ প্রাকৃতিক, বাকিটা বানিয়েছে সারওয়ারের মাইনিং টিম আর ইঞ্জিনিয়াররা। গুহার বেশিরভাগ জায়গা জুড়ে আছে একতলা বাড়ির সমান আকারের অনেকগুলো বিশাল পাম্প। সাপের মতো এঁকেবেঁকে বিভিন্ন দিকে বিস্তৃত হয়েছে বড় বড় পাইপ। গুহার একটা নির্দিষ্ট জায়গায় একত্রিত হয়েছে সবগুলো পাইপ, তারপর মাটির ভিতরে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

কন্ট্রোল সেন্টারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সারওয়ার। এখানে বড় বড় স্ক্রিনে প্রদর্শিত হচ্ছে মিশর আর উত্তর আফ্রিকার মানচিত্র। ওগুলোর উপর দিয়ে আঁকাবাঁকা রেখার মতো বিস্তৃত হয়েছে অনেকগুলো লাইন, বারোটা বাজিয়েছে সব মানচিত্রের। প্রতিটা লাইনের পাশে দেখা যাচ্ছে কতগুলো সংখ্যা-কখনও বাড়ছে, কখনও কমছে। প্রেশার, ভলিউম, ফ্লো চার্ট ইত্যাদি নির্দেশ করছে সংখ্যাগুলো।

সব ঠিক আছে দেখে আত্মতৃপ্তিতে ভরে গেল সারওয়ারের মন। একটা মোড় ঘুরে এখন এগিয়ে যাচ্ছে চটকদার কনফারেন্স রুমের দিকে। কাঁচদরজা ভেদ করে দেখতে পাচ্ছে, ঘরের মাঝখানে একটা বড় মেহগনি টেবিল ঘিরে বসে আছে কয়েকজন দশাসই লোক এবং সারওয়ারের গুটিকয়েক সহচর। দেয়ালে ঝোলানো স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে আমেনথেসের লোগো।

ঘরে ঢুকে টেবিলটার একমাথায় নিজের চেয়ারে বসল সারওয়ার। স্টকহোল্ডার আর বোর্ডমেম্বারদের দেখছে। পাঁচজন মিশরীয়, তিনজন লিবিয়ান, দুজন আলজেরিয়ান এবং সুদান ও তিউনিসিয়া থেকে এসেছে একজন করে। আরও একবার আত্মতৃপ্তি ভর করল সারওয়ারের মনে।

শূন্য থেকে শুরু করেছিল সে, এখন একটা ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেশনে পরিণত হয়েছে আমেনথেস, অথচ সময় লেগেছে মাত্র কয়েক বছর। সাফল্যের ফর্মুলা বেশি কিছু নাঃ কঠোর পরিশ্রম, নৃশংস ধূর্ততা, যথোপযুক্ত জায়গায় যোগাযোগ এবং কাড়ি কাড়ি টাকা। সারওয়ার আর ওর সিক্রেট পুলিশের একান্ত সহচররা জোগান দিয়েছে প্রথম তিনটার, টেবিল ঘিরে বসে থাকা দশাসইরা অন্যটার জোগানদার।

আরব বসন্ত গদি উল্টে দিয়েছে নামীদামি নেতাদের, অথচ ওটার প্রভাবেই আজ এই কনফারেন্স রুমে একত্রিত হয়েছে সারওয়ার ও তার পার্টনাররা। সবার উদ্দেশ্য এক: যার যার অঞ্চলের ক্ষমতা দখল।

আসতে নিশ্চয়ই অসুবিধা হয়নি আপনাদের? আতিথেয়তা না করলেই নয়, তাই কথাটা বলল সারওয়ার।

খেজুরে আলাপ করতে আসিনি আমরা, বলল সাদা চুলের এক মিশরীয়, পরনে পাশ্চাত্য ধাঁচের স্যুট, বা কব্জিতে ঝকঝক করছে দামি হাতঘড়ি। লোকটার প্রতিটা পয়সা দুর্নীতিরমিশরীয় বিমানবাহিনীতে সাম্প্রতিক সময়ে যতগুলো অর্থ-কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে, তার সবগুলোর সঙ্গে জড়িত। আমরা জানতে চাই, অপারেশন কখন শুরু হবে? উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি আমরা সবাই।

একজন সহচরের দিকে তাকাল সারওয়ার। পাম্পিং স্টেশনগুলো রেডি?

জবাবে মাথা ঝাঁকাল লোকটা। ওর সামনে, টেবিলের উপর রাখা ল্যাপটপের কী-বোর্ডে আঙুল চালাল। ডিসপ্লে স্ক্রিনগুলোতে দেখা গেল আফ্রিকার ম্যাপ। সেখানে কোথায় কোথায় নিজেদের জাল বিছিয়েছে আমেনথেস তার কম্পিউটার অ্যানিমেটেড ডিজাইন।

আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, একটা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল সারওয়ার, আমাদের নেটওয়ার্ক কমপ্লিট।

টের পেয়েছে কেউ? জানতে চাইল লিবিয়ার এক প্রাক্তন জেনারেল।

না, বলল সারওয়ার। তেল উত্তোলনের পাইপ বসানোর বাহানায় কাজ চালিয়েছি আমরা। কাউকে সন্দিহান হতে না দিয়ে আমাদের পাইপগুলো নিয়ে গেছি সাব-সাহারা অ্যাকুইফারের প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ সেকশনের কাছে। মিশর থেকে শুরু করে আলজেরিয়া পর্যন্ত প্রায় সব ঝরনা আর মরূদ্যানের পানির উৎস ওই অ্যাকুইফারগুলো।

অগভীর অ্যাকুইফারগুলোর কী হবে? জিজ্ঞেস করল জনৈক লিবিয়ান।

যেসব অ্যাকুইফারের কথা বললাম, সেগুলো অগভীর অ্যাকুইফারগুলোরও পানির উৎস। সাব-সাহারা থেকে পানি সরিয়ে নিলে, অগভীরগুলোও আপনিই শুকিয়ে যাবে, আস্তে আস্তে।

আস্তে আস্তে কেন? তিউনিসিয়ানের কণ্ঠে আপত্তি, এত ধৈর্য ধরতে পারব না!

একটুখানি হাসল সারওয়ার। কিন্তু ধৈর্য ধরতে হবে। কারণ আমার কাছে আলাদিনের চেরাগ নেই যে, রাতারাতি পানিশূন্য করে দেব অগভীর অ্যাকুইফারগুলো। …তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া আর লিবিয়া যখন দেখবে ওদের পানির সরবরাহ আশি থেকে নব্বই শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে, আমাদের করুণার উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় থাকবে না। তখন একদিক দিয়ে আপনাদেরকে ক্ষমতায় বসাবে ওরা, আরেকদিক দিয়ে পানি পাবে। …আমরা যদি একসঙ্গে কাজ করি, তা হলে উত্তর আফ্রিকার নিয়ন্ত্রণ নিতে বেশি সময় লাগবে না।

আলজেরিয়া থেকে আসা লোকটা নাক সিটকাল। প্রতিদিন বিলিয়ন বিলিয়ন গ্যালন পানি বের করে মরুভূমিতে ফেলে দেবেন আপনি, অথচ কেউ কিছু টের পাবে না–এটা সম্ভব? প্রমাণ…।

কোনও প্রমাণ থাকবে না। স্ক্রিনের দিকে ইঙ্গিত করল সারওয়ার, পানি মরুভূমিতে ফেলা হবে না। বরং ওই যে পাইপলাইনগুলো দেখতে পাচ্ছেন, ওগুলো দিয়ে একটা হাইড্রো-ইলেকট্রিক চ্যানেলের মাধ্যমে সব গিয়ে পড়বে নীল নদে। তারপর সেখান থেকে চলে যাবে সাগরে। কেউ কিছু সন্দেহ করতে পারবে না।

মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে ক্ষমতালোভীরা, সন্তোষ দেখা যাচ্ছে ওদের দৃষ্টিতে।

যার যার দেশের গদিতে গিয়ে বসব আমরা, মুখ খুলল লিবিয়ান লোকটা, অথচ ইউরোপিয়ান বা আমেরিকানরা কিছুই বলবে না?

হা হা করে হেসে উঠল সারওয়ার, কেন তা সে-ই ভালো জানে। যে বা যারা কিছু বলবে, তাদেরকে শীতন্দ্রিায় শুইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করে রেখেছি।

মুখ চাওয়াচাওয়ি করল বোর্ডমেম্বাররা।

ঘটনা ঘটতে শুরু করবে কখন? জিজ্ঞেস করল একজন স্টকহোল্ডার।

অতি শীঘ্রিই। সবই ঘটবে আপনাদের চোখের সামনে।

.

০৮.

হ্যাটটার আকৃতি সমব্রেরোর মতো, তারপরও আসিফ রেজার মনে হচ্ছে, রোদে চেহারা পুড়ে গেছে ওর। দরদর করে ঘামছে সে। কপাল ভালো আর বেশিক্ষণ সহ্য করতে হবে না সূর্যের অত্যাচার, কারণ তিউনিসিয়ার পশ্চিমাকাশে একটু একটু করে ঢলে পড়ছে ওটা।

ন্যাড়া আর পাথরে-ভরা একটা পাহাড়ি ঢাল বেয়ে উঠছে সে কয়েকজন হাইকারসহ। এগিয়ে আছে ওর স্ত্রী তানিয়া। এমনভাবে ঢাল বাইছে মেয়েটা, যেন কোনও কষ্টই হচ্ছে না ওর। ওর পরনে রানারস আউটফিট, মাথায় বাদামি রঙের বল ক্যাপ। পনিটেইল, বানিয়ে বেঁধেছে কালো চুলগুলো। উপরে ওঠার ছন্দের সঙ্গে মিল থেকে এদিকওদিক দুলছে। টেইলটা।

আসিফ বেশ লম্বা, বিন্তু ওর শরীর মোটেও অ্যাথলেটদের মতো না। হাঁপিয়ে গেছে সে। গলা চড়িয়ে বলল, একটু বিরতি নিলে হয় না?

প্রায় পৌঁছে গেছি, গলা চড়িয়ে বলল তানিয়াও, আরেকটু এগোলেই হাজির হব পৃথিবীর নতুনতম লেকের কাছে। ওখানে গিয়ে একবারে বিশ্রাম নিয়ো।

ছুটি কাটাতে তিউনিসিয়ার গাফসা শহরে এসেছিল আসিফ-তানিয়া। রোমান শাসনামলে শহরটা একটা মরূদ্যান ছিল। এখানে-সেখানে ছিল বিভিন্ন ঝরনা আর জলাশয়, একটার সঙ্গে আরেকটা কোনও-না-কোনওভাবে যুক্ত। কিন্তু এখন যে-লেক দেখতে যাচ্ছে ওরা, তা যেন হুট করেই জন্মেছে কয়েক মাস আগে। এবং ব্যাপারটা কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে আসিফ-তানিয়াসহ কয়েকজন হাইকারের মনে।

 বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আসিফ পেশায় একজন জিয়োলজিস্ট। আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস-এ বড় হয়েছে, বিখ্যাত উডস হোল ওশানোগ্রাফিক ইন্সটিটিউশন-এর আশপাশে ঘুরঘুর করে কাটিয়েছে কৈশোর। পরে পিএইচডি করেছে মেরিন জিয়োলজিতে। কাজেই নতুন জন্মানো ওই লেক কৌতূহলের জন্ম দিতেই পারে ওর মনে। কিন্তু হোটেল থেকে ভাঙাচোরা রাস্তায় একঘণ্টার জিপজার্নি শেষে খররোদে পুড়ে পাহাড়ি পথ বেয়ে উঠতে গিয়ে খবর হয়ে গেছে ওর।

প্রায় পৌঁছে গেছি আমরা, আবারও আসিফকে আশ্বস্ত করল তানিয়া।

একটু থামল আসিফ, আশ্চর্য হয়ে দেখছে ওর স্ত্রীকে। ক্লান্তি বলে কিছু নেই মেয়েটার? ও ডক্টরেট মেরিন বায়োলজিতে। নিজের বিষয়ে সহজেই ক্লান্ত হয় সে, অথচ খুব আগ্রহ বোধ করে নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জে।

নুমা-য় কাজ করছে স্বামী-স্ত্রী দুজনই।

গাইডের আগেই পাহাড়ি ঢলের মাথায় হাজির হলো তানিয়া, বাকিদের জন্য অপেক্ষা করছে আর এদিকওদিক তাকাচ্ছে। এক হাত তুলে আড়াল করেছে মুখ, বিস্ময় গোপন করার চেষ্টা করছে সম্ভবত। কয়েক মুহূর্ত পর ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াল গাইডও, সন্তুষ্টির বদলে দ্বিধা ফুটে উঠল লোকটার চেহারায়। কী করবে বুঝতে না পেরে হ্যাট সরিয়ে মাথা চুলকাচ্ছে।

হাঁপাতে হাঁপাতে ঢালের মাথায় যাওয়ার পর আসিফ বুঝতে পারল ঘটনা কী।

কয়েকটা পাহাড় বেষ্টিত হয়ে যেখানে থাকার কথা ছিল টলটলে পানির গভীর লেকটা, সেখানে এখন শুধু আছে বড়জোর দশফুট পরিধির সামান্য পানি, উপরে সাদা ফেনা ভাসছে। লেকের যে-জায়গায় সবচেয়ে উঁচু ছিল পানির স্তর, বৃত্তাকার একটা ধূসর দাগ তৈরি হয়ে আছে সেখানে-বাথটাবে সাবানের ফেনা যে-রকম দাগ বানায় অনেকটা সে-রকম।

এতক্ষণে অন্য হাইকাররাও হাজির হয়েছে ঢালের মাথায়, আসিফ-তানিয়ার মতো বাক্যহারা হয়ে গেছে ওরাও। শুধু লেক দেখার উদ্দেশ্যেই এত কষ্ট করে এখানে এসেছে ওরা। হোটেলে থাকতে লেকের ফটোগ্রাফ দেখে মুগ্ধ হয়েছে; ডেবেছে দেখার মতো অন্তত কিছু একটা পাওয়া গেছে গাফসায়। কল্পনাও করেনি, লেকের বদলে দেখতে হবে লেকের লাশ।

গাইড লোকটা পয়সার বিনিময়ে এ-রকম জায়গায় নিয়ে আসে টুরিস্টদের; এখনও হতভম্ব দেখাচ্ছে ওকে। বলল, বুঝলাম না। এত গভীর একটা লেক এমন শুকিয়ে গেল কী করে? দুদিন আগেও দেখে গেলাম…

বাষ্পীভবন, স্কটল্যাণ্ড থেকে আসা এক টুরিস্ট বলল। কী গরম পড়েছে, দেখছ না?

ঢালু হয়ে নেমে-যাওয়া লেকের জমিনে থকথক করছে কাদা, সেদিকে তাকিয়ে আছে আসিফ। ক্লান্তি ভুলে গেছে। বুঝতে পারছে, চোখের সামনে যা দেখছে তা একটা রহস্য।

পাহাড়ি অঞ্চলে হুট করে একটা লেকের জন্ম নেয়াটা অস্বাভাবিক নয়-জমিনের নিচে সঞ্চিত পানি জমিনের কোনও রন্ধ্রপথে বেরিয়ে জলাশয় তৈরি করতে পারে। কিন্তু ও-রকম কোনও জলাশয়ের রাতারাতি গায়েব হয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক। কারণ বড় রকমের ভূমিকম্প না ঘটলে, মাটির নিচে সঞ্চিত পানির স্তর সরে অন্য কোথাও চলে যায় না।

লেকটার আয়তন সম্পর্কে ধারণা নেয়ার জন্য ওটার সার্ফেস এরিয়া আর গভীরতা খালিচোখে অনুমান করার চেষ্টা করল আসিফ। তারপর বলল, লেকে যে-পরিমাণ পানি ছিল তা দুমাসেও বাষ্পীভূত হতে পারবে না, দুদিন তো পরের কথা।

তা হলে এত পানি গেল কোথায়? জিজ্ঞেস করল এক মহিলা।

এখন খরার মৌসুম চলছে তিউনিসিয়ায়, বলল বাষ্পীভবনের থিয়োরি-দেয়া লোকটা, কেউ হয়তো এখান থেকে সব পানি নিয়ে গেছে।

কিন্তু এক হাজার ট্যাঙ্কার ট্রাক পুরো ভর্তি করেও যদি পানি নেয়া হয় এই লেক থেকে, আসিফের কণ্ঠে প্রতিবাদ, তা হলেও এখন তলানিতে যে-পরিমাণ পানি আছে তারচেয়ে অনেক বেশি থাকার কথা। এদিকওদিক তাকাচ্ছে, জমিনের কোথাও কোনও ফাটল আছে কি না খুঁজছে যেখান দিয়ে লেক থেকে পানি বেরিয়ে যেতে পারে।

কিন্তু ও-রকম কিছু নজরে পড়ল না ওর।

পথ দেখিয়ে এখানে আনার জন্য যত টাকা নিয়েছ, গাইডকে শাসাচ্ছে এক মহিলা, হোটেলে গিয়ে সব ফেরত দেবে। মামদোবাজি অন্য কারও সঙ্গে কোরো, বুঝলে? তেজ দেখিয়ে নামতে শুরু করল ঢাল বেয়ে।

লেকের বদলে কাদায়-ভরা একটা বিশাল গর্ত দেখতে রাজি না কেউই, তাই বাকিরাও অনুসরণ করল, ওই মহিলাকে।

হুড়োহুড়ি করে মহিলার পাশে গিয়ে হাজির হয়েছে গাইড, হাত নেড়ে বোঝানোর চেষ্টা করছে ধোঁকা দেয়নি সে, বলছে আসলেই কত সুন্দর একটা লেক ছিল এই জায়গায়।

যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে আসিফ আর তানিয়া, ওদের দৃষ্টি নিবদ্ধ লেকের তলদেশের দিকে। স্থানীয় কিছু ছোকরা জড়ো হয়েছে সেখানে, কাদামাটির উপর দিয়ে হেঁটে হাজির হয়েছে পানির কাছে, সঙ্গে করে আনা পাত্র প্রার চেষ্টা করছে কাদাপানি দিয়ে। খরার মৌসুমে গৃহস্থালি কাজে ওই পানিই ভরসা।

এখানে কোথাও কোনও ঝরনা নেই, বিড়বিড় করল আসিফ। লেক থেকে পানি বের হওয়ার কোনও পথও নেই।

ওর দিকে তাকাল তানিয়া। তুমি বলতে চাইছ, জমিনের পানি জমিনে গিয়ে ঢুকেছে?

কিছু না বলে মাথা ঝাঁকাল আসিফ।

সঙ্গে করে আনা ক্যামেরা দিয়ে লেকের কয়েকটা ছবি তুলে নিল তানিয়া।

এতক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে ওদেরকে দেখছিলেন মাঝবয়সী বেঁটে এক লোক, এখন এগিয়ে আসছেন ওদের দিকে। লোকটার মাথায় ঢলঢল করছে একটা ক্যানভাসের হ্যাট, ওটা ছাড়িয়ে কিছু কাঁচাপাকা লম্বা চুল নেমে এসেছে রোদেপোড়া কপালের উপর। সঙ্গে-থাকা ব্যাকপ্যাক, ওয়াকিং স্টিক আর বিনকিউলার নিঃশব্দে বলে দেয়, ওই লোকও একজন হাইকার।

হ্যালো, কাছে এসে বললেন তিনি, একটুখানি উঁচু করলেন হ্যাটটা। কিছু মনে করবেন না-লেকটা কীভাবে গায়েব হয়েছে তা নিয়ে কথা বলছিলেন আপনারা, আপনাদের আলোচনা শুনেছি। আপনাদের মতো আরও টুরিস্ট লেকটা দেখতে আজ সারাদিন এসেছে এখানে, তারপর হতাশ হয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে চলে গেছে। আপনাদের দুজনকেই দেখলাম লেকটা কেন উধাও হলো তা নিয়ে কথা বলছেন। …আপনারা কি জিয়োলজিস্ট?

আমার ব্যাকগ্রাউণ্ড জিয়োজি, হ্যাণ্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে নিজের পরিচয় দিল আসিফ। তারপর ইঙ্গিতে তানিয়াকে দেখিয়ে বলল, আমার স্ত্রী…তানিয়া।

অপরিচিত লোকটার উদ্দেশে মাথা ঝাঁকাল তানিয়া। আমার নাম খালিদ সাইফুল্লাহ। আপনাদের মতো আমিও বোঝার চেষ্টা করছিলাম, লেকের পানি কেন এবং কীভাবে গায়েব হলো।

আপনি কি অমেচার কোনও…

না, মাথা নাড়লেন খালিদ। আমি লিবিয়া সরকারের ওয়াটার রিকভারি ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টর।

লিবিয়া! আশ্চর্য হয়েছে তানিয়া। কিন্তু এটা তো তিউনিসিয়া!

চাকরির খাতিরে আসতে হয়েছে আমাকে এখানে। এই লেকের মতো আরও জলাশয় শুকিয়ে যাচ্ছে লিবিয়া তিউনিসিয়ার মতো কিছু দেশে।

সমস্যাটা কী?

বুঝতে পারছি না, আবারও মাথা নাড়লেন খালিদ। আমার দেশে পানির সরবরাহ অনেক কমে গেছে গত কয়েক মাসে। ঝরনা থেকে পানি এসে জমত যেসব লেকে, সেগুলো শুকিয়ে গেছে। ঝরনাগুলোও মৃতপ্রায়। মরূদ্যানগুলো আর সবুজ নেই, শুকিয়ে বাদামি হয়ে গেছে। পানির অভাবে মানুষ যাতে না মরে সেজন্য জমিনের অনেক গভীর থেকে পানি ভোলা হচ্ছিল, কিন্তু ইদানীং বেশকিছু পাম্পিংস্টেশন থেকে খবর আসছে, আর পারছে না ওরা–মাটির নিচে পানির প্রবাহ বলতে গেলে নেই।

মুখ চাওয়াচাওয়ি করল আসিফ-তানিয়া।

আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম এটা বোধহয় শুধু লিবিয়ারই সমস্যা। কিন্তু পরে শুনলাম, প্রতিবেশী কয়েকটা দেশেও প্রায় একইরকম সমস্যা দেখা দিয়েছে। আর এই লেকটা উধাও হয়ে গেছে শুনে নিজেই দেখতে এলাম। আমার মনে হয় আণ্ডারগ্রাউণ্ড ওয়াটার টেবিলে বড় রকমের পরিবর্তন ঘটেছে।

সেটা কীভাবে সম্ভব?

জানি না। কেউই মনে হয় জানে না। তবে জানার চেষ্টা করছি। আপনারা সাহায্য করবেন আমাকে?

আবারও মুখ চাওয়াচাওয়ি করল আসিফ আর তানিয়া, চোখে চোখে কথা হয়ে গেল দুজনের মধ্যে।

করব, বলল আসিফ। আপনার সঙ্গে গাড়ি আছে? তা হলে আমাদের গাইডকে ছেড়ে দেব।

একটা ল্যাণ্ডরোভার আছে আমার সঙ্গে।

.

মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) রাহাত খানের সঙ্গে কথা হয়েছে সোহেলের। যেমনটা ভেবেছিল রানা, তা-ই ঘটেছে। নতুন একটা অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয়েছে ওদের দুজনকে।

জানতে হবে কী, কোত্থেকে এল। ওটা যদি আসলেই কোনও নার্ভ টক্সিন বা বায়োলজিকাল ওয়েপ হয়ে থাকে, তা হলে এখন কাদের দখলে আছে। জানতে হবে ওই লোকগুলোর উদ্দেশ্য কী। এবং সম্ভব হলে খুঁজে বের করতে হবে কালো কুয়াশার অ্যান্টিডোট, কোমা থেকে ফেরাতে হবে বিসিআই-এর পাঁচ এজেন্টকে, সেইসঙ্গে অন্যদেরও।

মাল্টার ভ্যালেটা বন্দরে নামল রানা-সোহেল।

এখনও প্রাচীনত্বের ছোঁয়া রয়ে গেছে ভ্যালেটার প্রকৃতি ও মানবনির্মিত অনেককিছুতে। বন্দর থেকে সোজা শহরের দিকে তাকালে দৃষ্টির অনেকখানি দখল করে নেয় বিশাল একটা গির্জা। ওটার আশপাশে পুরনো কিছু দালান এবং আরও কয়েকটা ছোট গির্জা আছে। প্রাচীন নগর-রক্ষাব্যবস্থার নিদর্শন হিসেবে বন্দরে আজও রয়ে গেছে গানারি প্লাসহ পাথুরে দেয়ালের গ্যারিসন। সরু সাগর-প্রণালীর দিকে মুখ করে আছে কামানগুলো।

জাহাজঘাটে উঠে পড়ল রানা আর সোহেল, সেখান থেকে নামল রাস্তায়। মধ্যমগতিতে হাঁটছে। জাদুঘরের কিউরেটরের সঙ্গে দেখা করার কথা আছে ওদের।

কী মনে হয় তোর? হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল সোহেল। আমাদের সঙ্গে আসলেই দেখা করবে কিউরেটর?

মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল রানা। সন্ধ্যা ঘনাচ্ছে। ফিফটি-ফিফটি।

হাত তুলে একটা ট্যাক্সিক্যাব থামাল সোহেল, ড্রাইভারকে ঠিকানা জানিয়ে উঠে পড়ল। ঘোরপ্যাঁচ রাস্তা দিয়ে দক্ষহাতে গাড়ি চালিয়ে, জ্যাম এড়িয়ে ওদেরকে জাদুঘরের সামনে নামিয়ে দিল লোকটা।

জাদুঘরের সদর-দরজায় গিয়ে দাঁড়াল রানা-সোহেল। সিকিউরিটি গার্ড দাঁড়িয়ে আছে একজন।

কেন এসেছে ওরা, তা জানাল রানা লোকটাকে। ওদেরকে অপেক্ষা করতে বলে ইন্টারকম টেলিফোনে যোগাযোগ করল গার্ড। দুই কনুইয়ে তালিওয়ালা টুইডের জ্যাকেট পরিহিত একটা লোককে সদর-দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই।

এগিয়ে গিয়ে লোকটার সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করল রানা। ডক্টর হেল্ডন?

জর্জ, কোন্ নামে ডাকা হলে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে তা জানিয়ে দিল হেল্ডন, রানার সঙ্গে হাত মেলানো শেষ করে সোহেলের সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করছে।

আসতে একটু দেরি হয়ে গেছে আমাদের, বলল রানা।

একটুখানি হাসি দেখা গেল হেল্ডনের চেহারায়। ব্যাপার না। ভিতরে চলুন।

জাদুঘরের ভিতরে ঢুকল ওরা তিনজন। দরজা লাগিয়ে দিল হেন্ডন, তবে তার আগে গার্ডের উদ্দেশে মাথা ঝাঁকাল–কারণটা ঠিক বোঝা গেল না। হলের দিকে পা বাড়ানোর আগে খড়খড়ি ফাঁক করে কী যেন দেখল বাইরে।

ফোয়ে পার হয়ে মেইন হলে ঢুকল হেন্ডন, ওর পিছনে আছে রান। আর সোহেল। কয়েকদিনের মধ্যেই নিলাম অনুষ্ঠিত হবে, হলের এদিকে-সেদিকে তাকালে বোঝা যায়। জোর প্রস্তুতি চলছে সেটার।

রানা আর সোহেলকে নিজের অফিসে নিয়ে গেল হেল্ডন। রুমটা জাদুঘরের তৃতীয়তলায়, এককোণে।

আর্টিফ্যাক্ট, ম্যাগাজিন আর অন্যান্য কাগজপত্র গাদাগাদি, করে রাখা আছে ঘরের ভিতরে। কোটা দরকারি আর কোন্‌টা অদরকারি বোঝা মুশকিল। সবকিছু এত ঠাসাঠাসি হয়ে গেছে যে, এককোনার একমাত্র জানালাটাও চোখে পড়ে না ঠিকমতো। ময়লা হয়ে গেছে জানালার কাঁচ।

হেল্ডন গিয়ে বসল নিজের চেয়ারে, রানা আর সোহেল বসল ওর মুখোমুখি। উজ্জ্বল ফ্লাডলাইট জ্বলে উঠল বাইরে, আলোর শক্তিশালী রেখাকে ঠেকাতে পারল না কাঁচ, আলোকিত হয়ে উঠল জানালার উল্টোদিকের দেয়াল। নির্মাণকাজের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে–একসঙ্গে শব্দ করছে জ্যাকহ্যামার আর ক্রেন।

কোথাও ভাঙচুর চলছে বুঝি? চারদিকে তাকাল সোহেল।

বাইরের চত্বরের দিকে ইঙ্গিত করল হেল্ডন। নতুন করে বানানো হচ্ছে ওটা। রাত নামলে কাজ শুরু করে শ্রমিকরা যাতে ট্যুরিস্টদের কোনও অসুবিধা না হয়। …ফোনে বলেছেন নুমার হয়ে কাজ করেন আপনারা, আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। কীভাবে সাহায্য করতে পারি?

প্রি-অকশন রিসেপশনের ব্যাপারে জানতে চাইছিলাম, বলল রানা।

অনেকদিন পর বড় পরিসরে নিলামের আয়োজন করতে যাচ্ছি আমরা। আজ থেকে দুদিন পর একটা পার্টি আছে রাতের বেলায়।

আমরা দাওয়াত পেতে পারি? নিলামে উপস্থিত থাকতে চায় সোহেল।

কিছু মনে করবেন না, অতিথিদের সবাই একটা ক্লোড় গ্রুপের সদস্য। সেটার বাইরের কাউকে…আসলে…মনে হয় বুঝতে পারছেন কী বলতে চাইছি।

পার্টিতে কী হবে?

আমোদফুর্তি। তবে আমাদের উদ্দেশ্য থাকবে তার ফাঁকে ফাঁকে, নিলামের জিনিসগুলোর ব্যাপারে অতিথিদের জ্ঞান দেয়া। এবং তাদের পারস্পরিক পরিচিতিটা যাতে বাড়ে সে চেষ্টা করা।

তাতে লাভ?

ধূর্ত হাসি দেখা গেল হেন্ডনের চেহারায়। আমরা আসলে অতিথিদের দম্ভ বাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করি। তার ফলে মালের দাম অনেক বেশি পাই। কয়েক শ অথবা কয়েক হাজার বছরে যা দেখেনি লোকে, তা নিজের বাড়িতে নিয়ে সাজানোর জন্য রীতিমতো কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে যায়। কিন্তু কেউ বলতে পারবে না অন্যায় করছি আমরা। জাদুঘরের লাভের জন্য করা হয় ওসব। নিলামের আগে অন্য কোথাও দাওয়াত করে খাওয়ানো হয় অতিথিদের। সেই পয়সা কৌশলে উসুল করে নিই তাদের পকেট থেকেই।

এবার কী কী জিনিস নিলাম করবেন আপনারা?

বলা যাবে না–জাদুঘর কর্তৃপক্ষের নিয়ম। কিছু মনে করবেন না।

নিয়ম? বুঝলাম না।

চিকন ঘাম দেখা দিয়েছে হেল্ডনের চেহারায়। দেখুন, ঐতিহাসিক জিনিস নিয়ে দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে মারামারি-কাড়াকাড়ি লেগে ছিল, আছে এবং থাকবে। আমাদের কারবারই হলো ওসব জিনিস নিয়ে। তাই নিলামের আগে কী বেচতে যাচ্ছি তা ঢাকঢোল পিটিয়ে জানানো হয় না। যা বেচাবিক্রি হবে, নিজেদের মধ্যে হবে।

তারমানে মামলা-মোকদ্দমার আশঙ্কা করছেন আপনারা?

হ্যাঁ।

হেন্ডনের দিকে তাকিয়ে আছে রানা। কেন যেন মনে হচ্ছে ওর, সত্যি কথা বলছে না লোকটা। মনে হচ্ছে, কিছু একটা গোপন করছে। খোলস ছেড়ে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল

হেল্ডনের কয়েকটা ফটোগ্রাফ দিয়েছে ওকে লামিয়া, ওগুলো বের করে রাখল লোকটার সামনে।

কী দেখছি আমি এসব? জিজ্ঞেস করল হেল্ডন, ভাজা মাছ উল্টে খেতে না-জানার ভাব চেহারায়।

আপনারই ছবি। অথচ আপনিই জানতে চাইছেন কী দেখছেন। ছবির টুইডের জ্যাকেটের সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে। আপনার গায়ে এখন যেটা আছে সেটা।

তো?

 একটা ফটোগ্রাফ আলাদা করল রানা, আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল হেল্ডন বাদে ছবির বাকিদেরকে। এদেরকে চেনেন?

ইশারায় ডারহামকে দেখাল হেল্ডন। শখের ট্রেজার হান্টার আর অ্যান্টিক কালেক্টর-নিজের পরিচয় দেয়ার সময় আমাকে তা-ই বলেছে সে। তবে আসলে নাকি ডাক্তার। বাকিরা ওর কলিগ। কিন্তু…আমাকে কেন প্রশ্ন করা হচ্ছে এসব ছবির ব্যাপারে?

কারণ লোকটা শুধু ডাক্তারই না, একজন সন্দেহভাজন টেরোরিস্টও। লিনোসায় গতকাল যে-ঘটনা ঘটেছে, তার পেছনে ওই লোকের হাত থাকতে পারে ভেবে খোঁজা হচ্ছে। ওকে। ছবির বাকিরা ওর চ্যালা হতে পারে।

সাদা হয়ে গেল হেল্ডনের চেহারা। টিভি চ্যানেলগুলোর বদৌলতে ইতিমধ্যে জানা হয়ে গেছে লিনোসার ঘটনাটা। টায়ানার বিস্ফোরণকে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে।

বলল, টেরোরিজম নিয়ে কিছু শুনিনি আমি। ভেবেছিলাম, লিনোসার ঘটনাটা একটা রাসায়নিক দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছু না।

কিন্তু আসল ঘটনা তা না, বলল সোহেল।

ঢোক গিলল হেল্ডন, খাকারি দিয়ে পরিষ্কার করল গলা। আমি…আসলে বুঝতে পারছি না আপনারা আমাকে দিয়ে কী বলাতে চাইছেন। আমি ওই লোকের নামটা পর্যন্ত মনে করতে পারছি না।

ডারহাম, বলে দিল রানা।

 কিছু বলল না হেল্ডন, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল জানালার দিকে।

যারা এই ছবি তুলেছে তারা নিশ্চিত করে বলেছে, বলছে রানা, কমপক্ষে তিনবার বৈঠক করেছেন আপনি ডারহামের সঙ্গে। এতবার কথা বলার পরও ওর নাম ভুলে গেছেন? আপনার সঙ্গে এতবার কথা বলল কেন ডারহাম?

দীর্ঘশ্বাস ফেলল হেল্ডন, এদিকওদিক তাকাচ্ছে-যেন সাহায্যের আশায় খুঁজছে কাউকে অথবা কোনওকিছু। হঠাৎ করেই বলল, পার্টিতে আমন্ত্রণ চাইছিল। আমি বলে দিয়েছি সম্ভব না।

কেন?

কারণটা আগেও বলেছি।

চেয়ারে হেলান দিল রানা। দুই লক্ষ ইউরোর বিনিময়েও?

কিছুটা যেন চমকে উঠল হেল্ডন, তবে সামলে নিল নিজেকে। এক মিলিয়নের বিনিময়েও না।

আমাদের কাছে খবর আছে আপনাকে ঘুষ দেয়ার জন্য টাকাটা নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে এনেছে ডারহাম, আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ল রানা। টাকাটা নিয়ে ডারহাম যা চাইছে তা ওর হাতে তুলে দেয়ামাত্র আপনার হাতে পরপারের টিকেট ধরিয়ে দেবে সে। অথবা ওর দলের অন্য কেউ। দুলক্ষ ইউরোর দুহাজারও খরচ করার সময় পাবেন না।

কিছু বলল না হেন্ডন। চুপ করে বসে আছে, দেখে মনে হচ্ছে রানার কথাগুলো ভাবিয়ে তুলেছে ওকে।

আমার মনে হয় ব্যাপারটা টের পেয়েছেন আপনি নিজেও, আবারও আন্দাজে ঢিল মারল রানা। তা না হলে তখন খড়খড়ি দিয়ে উঁকি দিতেন না। বার বার দরজার দিকে তাকাচ্ছেন–আসলে ঘাবড়ে আছেন।

 আমি ওদেরকে কিছু দিইনি, একটুখানি হলেও ভেঙে পড়েছে হেন্ডন, কিচ্ছু না। আমি ওদেরকে চলে যেতে বলেছি। কিন্তু ওরা…আপনারা বুঝতে পারছেন না… কথা শেষ করল না, একটা ড্রয়ার খুলে ভিতরে হাতড়াচ্ছে।

সাবধান! সতর্ক করল সোহেল।

পিস্তল-রিভলভার কিছু বের করছি না, হেন্ডনের কণ্ঠে তেজ। অ্যান্টাসিডের একটা প্রায়-খালি বোতল বের করল, হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওটার দিকে।

আপনাকে বাঁচাতে পারব আমরা, বলল রানা। আপনি চাইলে যথোপযুক্ত কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেব আপনাকে। ওরা আগলে রাখবে আপনাকে। তবে তার আগে আমাদেরকে সাহায্য করতে হবে।

বোতল থেকে দুটো অ্যান্টাসিড ট্যাবলেট বের করে মুখে দিল হেন্ডন। চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে বিচলিত হয়ে পড়েছে। একটা রাইটিংপ্যাড টেনে নিয়ে পাতা ছিঁড়ল, কলম দিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে কী যেন লিখছে। আসলে মিশর থেকে আনা…মামুলি আর কমদামি কয়েকটা আর্টিফ্যাক্ট…

কথা শেষ করতে পারল না সে। ভীষণ একটা যান্ত্রিক গর্জন শোনা গেল নিচের চত্বরে, দাঁড়িয়ে গেল রানার ঘাড়ের লোম। চট করে তাকাল জানালার দিকে। একটা ছায়া যেন ধেয়ে আসছে।

সাবধান! চিৎকার করে উঠল ও, চেয়ার থেকে ডাইভ দিয়ে মেঝেতে পড়েছে।

সঙ্গে সঙ্গে জানালা ভেঙে দুরমুশের মতো ভিতরে ঢুকে পড়ল একটা ক্রেনের হুক-ব্লকসহ জিবের খানিকটা।

টুকরো টুকরো কাঁচ ছিটকে পড়ল মেঝের এখানে সেখানে, ধুলোর একটা চাদর আস্তে আস্তে ঢেকে দিচ্ছে ঘরের ভিতরটা। আরও আগে বাড়ল হুক-ব্লক আর জিব, আরও ইট ভেঙে হেন্ডনের ডেস্কটাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে উল্টোদিকের দেয়ালের কাছে। ভারী হুকের ধাক্কায় ডেস্কের সঙ্গে আটকা পড়েছে হেল্ডন, চেয়ারসহ দেয়ালের দিকে এগিয়ে চলেছে সে।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল রানা। একছুটে এগিয়ে গেল হেন্ডনের দিকে, দুহাতে থাবা দিয়ে সরিয়ে আনল লোকটাকে। এমন সময় জিবটা গিয়ে আঘাত করল ঘরের ছাদে, ভেঙে পড়ল একদিকের ছাদ।

চট করে হেন্ডনের দিকে তাকাল রানা। চেহারা জায়গায় জায়গায় কেটে গেছে লোকটার। নাক ভেঙে গেছে, ঠোঁট থেঁতলে গেছে, ভেঙেছে কয়েকটা দাঁত। মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেছে, যেন বুঝেও বুঝতে পারছে না কী ঘটছে। বেঁচে আছে, কিন্তু নিশ্চল হয়ে গেছে পক্ষাঘাতগ্রস্তের মতো। ওকে মেঝের এককোনায় শুইয়ে দিল রানা। সরে আসতে যাবে, এমন সময় খেয়াল করল, এক হাত মুঠ করে ভিতরে রাইটিংপ্যাড-থেকে-ছেঁড়া কাগজটা ধরে আছে হেল্ডন। চট করে কাগজটা ছাড়িয়ে নিল রানা, ঢুকিয়ে রাখল পকেটে।

সরে যা! শোনা গেল সোহেলের চিৎকার।

সঙ্গে সঙ্গে একলাফে চার-পাঁচ হাত দূরে পড়ল রানা, যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল ও সেখান দিয়ে জোরে বেরিয়ে গেল ক্রেনের হুক-ব্লক। হেল্ডন যেখানে শুয়ে আছে সেখান থেকে কয়েক ফুট উপরের দেয়ালে আঘাত করল ওটা। খসে পড়ল একগাদা পলেস্তারা।

জানালাটা যেদিকের দেয়ালে ছিল সেখানে বেশ বড় একটা ফোকর দেখা যাচ্ছে। একছুটে ওটার আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল রানা, সাবধানে উঁকি দিল বাইরে। ক্রেনের ক্যাবের ভিতরে বসে আছে এক লোক, জিবটা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। ওর পাশে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে আরেকজন, হাতে সাবমেশিনগান।

রানাকে দেখে ফেলল সাবমেশিনগানওয়ালা। সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্র উঁচু করল সে, টান দিল ট্রিগারে। কী ঘটতে যাচ্ছে তা আগেই বুঝে নিয়েছে রানা, চট করে সরে গেল আড়ালে। একটানা ছুটে আসা বুলেটগুলো একাধিক গর্ত তৈরি করল দেয়ালে।

পকেট থেকে স্যাটেলাইট ফোন বের করেছে সোহেল, জরুরি গলায় কথা বলছে কারও সঙ্গে। হঠাৎ করেই কথা থামিয়ে নিরাপদ জায়গায় সরে যেতে বাধ্য হলো সে, কারণ ওই ফোকর দিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়েছে আরও বুলেট–সমানে গর্জন করছে সাবমেশিনগানটা।

আসলে কাকে লক্ষ্য করে গুলি করা হচ্ছে, বুঝে গেছে রানা। ঝুঁকি নিয়ে আরেকবার উঁকি দিল ও ফোকর দিয়ে। চত্বরের আশপাশে জড়ো হওয়ার চেষ্টা করছিল পথচারীরা, এখন ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে–ওদের উদ্দেশে দুঝাঁক ফাঁকা গুলি করেছে সাবমেশিনগানওয়ালা। ক্রেনের ক্যাব ছেড়ে নেমে পড়েছে দুই গুণ্ডা, দৌড়ে পালাচ্ছে এখন।

হেল্ডনের সঙ্গে থাক তুই, সোহেলকে বলল রানা, আমি আসছি। সোহেল কিছু বলার আগেই লাফ দিল ফোকর দিয়ে, দুহাতে আঁকড়ে ধরল ক্রেনের জিব।

ওটা বেয়ে যত জলদি সম্ভব নেমে যাচ্ছে।

.

০৯.

 দুজন না, গুণ্ডা আসলে তিনজন। তৃতীয়জনকে আগে খেয়াল করতে পারেনিনা। রাস্তার অন্যপারে এককোনায় পার্ক করে রাখা মাইক্রোভ্যানের দিকে দৌড়াচ্ছে ওরা।

জমিন থেকে সাত-আট ফুট উপরে থাকতে জিবের স্টিল বিম ছেড়ে দিল রানা। অনতিদূরে পড়ে আছে কয়েকজন বুলেটবিদ্ধ শ্ৰমিক-ক্রেনে ঢোকার জন্য ওঁদের উপর গুলি চালিয়েছে গুণ্ডারা। লোকগুলো বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে বোঝা যাচ্ছে না। ওদেরকে সাহায্য করবে কি না ভাবল রানা একটা মুহূর্ত, তারপর বাতিল করে দিল চিন্তাটা। ওরা মারা গিয়ে থাকলে কিছুই করার নেই ওর, আর যদি বেঁচে থাকে তা হলে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পথচারীরাই খবর দিতে পারবে পুলিশ বা অ্যাম্বুলেন্সকে।

আলো জ্বলে উঠল ভ্যানটার, গর্জে উঠে চালু হলো ইঞ্জিন।

ওটার পিছু ধাওয়া করার জন্য জুতসই কিছুর খোঁজে এদিকওদিক তাকাল রানা। সবচেয়ে কাছে দাঁড়িয়ে আছে একটা ডাম্প ট্রাক।

একছুটে ট্রাকের কাছে হাজির হলো রানা, দরজা খুলে উঠে বসল ড্রাইভিংসিটে। ইগনিশনে চাবি ঝুলছে, ওটা মোচড় দিয়ে গিয়ার বদল করল, চেষ্টা করছে যত দ্রুত সম্ভব গতি বাড়ানোর। মাইক্রোভ্যানটার পথ রোধ করতে চায়।

কিন্তু কী গাড়ি নিয়ে এলে মাল্টার রাস্তায় সুবিধা করা যাবে তা জানে গুণ্ডারা, তাই সে-ব্যবস্থা করেই এসেছে। রানার উদ্দেশ্য টের পেয়ে চট করে সাইডওয়াকে ভ্যান তুলে ফেলল ওটার ড্রাইভার, কয়েক মুহূর্ত পর তীক্ষ্ণ মোচড় কেটে নেমে এল রাস্তায়।

ব্রেকপ্যাডেলে জোরে চাপ দিল রানা, আরেকটু হলে ধাক্কা লাগিয়ে দিয়েছিল একটা ল্যাম্পপোস্টে। ব্যাকগিয়ারে দিয়ে বনবন করে ঘোরাচ্ছে স্টিয়ারিং, এমন সময় খেয়াল করল মিউযিয়ামের দরজা দিয়ে বেরিয়ে ট্রাকের দিকে ছুটে আসছে সোহেল। ট্রাক চালিয়ে সোহেলের কাছে গিয়ে থামল ও, খুলে দিল ড্রাইভিংসিটের পাশের দরজা।

 চট করে উঠে পড়ল সোহেল। ছোট কিছু পেলি না?

না। ট্রাকের গতি বাড়াচ্ছে রানা।

যাক, নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো,, বলল সোহেল, তবে ক্রাইম সিন থেকে তোর কানা মামাকে নিয়ে পালানোর কারণে পুলিশ যখন গ্রেপ্তার করবে তোকে, তখন

কী জবাব দিবি?

তিন গুণ্ডাকে পাকড়াও করতে পারলে আমাদের হয়ে জবাব ওরাই দেবে।

গোঁ গোঁ করছে ট্রাকের ইঞ্জিন, তবুও গতি বাড়াচ্ছে রানা। শেষপর্যন্ত সুবিধা করতে পারবে কি না বোঝা যাচ্ছে না। হর্সপাওয়ারের বিবেচনায় ভ্যানটা ট্রাকের তুলনায় কিছু না, তারপরও চটপটে বলা যায় ওটাকে। যানবাহনের মোটামুটি ভিড় আছে রাস্তায়, ওগুলোর চিপাচাপা দিয়ে পথ করে নিয়ে ছুটতে পারছে। ওদিকে রানাকে ব্রেক চাপতে হচ্ছে বার বার, এবং যতবার ব্রেক চাপছে ততবার ভ্যানের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে। ট্রাকের।

গাড়িঘোড়ার ভিড় একটু পাতলা হওয়ামাত্র এক্সিলারেটর চেপে ধরল রানা। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বরাবর হয়ে গেল প্লেয়িংফিল্ড। স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে ভ্যানের পশ্চাদ্দেশে তো দিতে যাবে রানা, এমন সময় কায়দা করে সরে গেল ওটার ড্রাইভার, ঢুকে পড়ল কয়েকটা গাড়ির মাঝখানে। বুঝে গেছে খোলা জায়গায় থাকলে কুলিয়ে উঠতে পারবে না ট্রাকের সঙ্গে।

কোনও কারণে গর্ত খোঁড়া হয়েছিল রাস্তার মাঝখানে-ওটাতে পড়ল ট্রাকের একটা চাকা, জোরে ঝাঁকুনি খেল ট্রাক। বডির একপাশে বাড়ি খেল রানার মাথা, একটা মুহূর্তের জন্য চোখে অন্ধকার দেখল ও। হাত থেকে ছুটে গেল স্টিয়ারিং। সামলে নিয়ে দেখল রং সাইডে চলে এসেছে ট্রাক, মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটতে যাচ্ছে উল্টোদিক থেকে আসা একটা গাড়ির সঙ্গে। বনবন করে স্টিয়ারিং ঘেরাল রানা, কিন্তু কাঁচ ভাঙার আওয়াজ পেয়ে বুঝল বারোটা বেজে গেছে মুখোমুখি গাড়ির সাইডলুকিং মিররের।

প্লেয়িংফিল্ড আবারও বরাবর হয়ে গেছে, আরও একবার ভ্যানটাকে নাগালের মধ্যে পেয়ে গেছে রানা। খেয়াল করল, বন্দর এলাকায় ঢুকে গেছে ওরা। দূরে সাগরের কালো পানির পটভূমিতে ঝলমল করছে অনেকগুলো ফিশিংবোট আর ইয়টের আলো। ওগুলোর উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে ভ্যানের পেছনদিকে গুতো মারল রানা।

সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল গুলির আওয়াজ। ভ্যানের ড্রাইভার বাদে অন্য দুজনের একজন গুলি করছে। জোরে ধাক্কা খেয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে লোকটাতো মারতে যদি আর একমুহূর্ত দেরি করত রানা তা হলে খারাপ কিছু হতে পারত।

ধাক্কার কারণে চিড় ধরেছে ভ্যানের পেছনের গ্লাসে, এদিকে বুলেটটা ট্রাকের উইণ্ডশিন্ডে বীভৎস ফুটো তৈরি করে চুরমার করে দিয়েছে রিয়ারভিউমিরর। আবারও গুলি করা হলো ভ্যান থেকে, কিন্তু ট্রাকের বডিতে লালচে কমলা স্ফুলিঙ্গ ওঠানো ছাড়া আর কিছু করতে পারল না বুলেট।

স্টিয়ারিং ডানে-বাঁয়ে ঘোরাচ্ছে রানা, পিস্তলওয়ালার সহজ নিশানায় পরিণত হতে চায় না। কাজটা করতে গিয়ে গতি একটু কমে গেছে ট্রাকের, কিন্তু রানা জানে সুযোগ পেলেই দূরত্ব কমিয়ে আনতে পারবে ভ্যানের সঙ্গে। আরেকবার গুলি করা হলো, রানা আর সোহেলের মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে গেল বুলেট। গুলি থেকে বাঁচতে নিজের সঙ্গের দরজা খুলে বাইরে ঝুলে পড়েছে সোহেল।

সাবধান! চিৎকার করে উঠল রানা, তীক্ষ্ণ মোচড় দিয়েছে স্টিয়ারিং-এ। এমনভাবে ঘুরিয়েছে ট্রাকের নাক, যেন সামনের পিস্তলবাজ মনে করে অ্যাক্সিডেন্ট করল ট্রাকটা। একধারের রেলিঙের বারোটা বাজিয়ে বাঁয়ের একটা সরু রাস্তায় ঢুকে পড়েছে ট্রাক, ছুটে চলেছে।

ট্রাক থেকে প্রায় পড়েই গিয়েছিল সোহেল, কোনওরকমে সামলে নিয়ে বলল, আরেকটু হলে খুনই করে ফেলেছিলি, দোস্ত! আগে থেকে সাবধান করবি না? ভ্যানটাকে আর দেখা যাচ্ছে না, সোজা হয়ে বসল সিটে, দরজা আটকাল।

করিনি?

কী? কী করিসনি?

 সাবধান করিনি, ব্যাটা বদমাইশ?

 করেছিলি তো। আমি বুঝিনি।

এবার মাথাটা একটু খাটিয়ে বল, সামনের রাস্তায় বেরিয়ে কী দেখব বলে আশা করছি?

হাতী। বলেই হাসল সোহেল। ভাবছিস, আপদ গেছে মনে করে সামনের ওই রাস্তা দিয়ে ফিরে আসবে ব্যাটারা?

ট্রাকের মেঝের সঙ্গে প্রায় চেপে ধরেছে রানা এক্সিলারেটর, ক্রুদ্ধ বুনো জন্তুর মতো গোঙাচ্ছে ইঞ্জিন।

সামনে বন্দর থেকে শহরে যাবার আর একটা রাস্তা দেখা যাচ্ছে। এটাও ওয়ান-ওয়ে।

ঝড়ের গতিতে ওখানে হাজির হলো রানা, ডানে তাকিয়ে দেখল, ফুলম্পিডে ছুটে আসছে ভ্যানটা। মেইন রোডে উঠে মুখোমুখি সংঘর্ষের মধ্যে না গিয়ে শহরের দিকেই চলতে শুরু করল। ভ্যানটা এখন ওদের পেছনে। রানার যুদ্ধংদেহী ভাবটা চলে গেছে দেখে অবাক হলেও কিছু মন্তব্য করল না সোহেল।

রিয়ারভিউ মিরর নেই, ট্রাকের সাইডলুকিং মিররের দিকে তাকিয়ে একটু একটু করে গতি কমাচ্ছে রানা। হঠাৎ বলল, ব্রেক চাপতে যাচ্ছি আমি। কথা শেষ করেই জোরে চাপ দিল ব্রেকপ্যাডেলে, একইসঙ্গে হ্যাঁচকা টান মারল ডাম্পবেডের হাইড্রলিক লিভারে।

ঝাঁকুনি খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে ট্রাক, আস্তে আস্তে উঁচু হয়ে যাচ্ছে ওটার ডাম্পবেড। কয়েক টন ভাঙা কংক্রিট, বাঁকাত্যাড়া ধাতব পদার্থ, আর নির্মাণকাজে ব্যবহৃত হয় এমন সব আজেবাজে জিনিস গড়িয়ে পড়ল রাস্তায়, ছড়িয়ে গিয়ে রোড-ব্লক তৈরি করল রাস্তা জুড়ে।

ট্রাকটাকে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে বনবন করে স্টিয়ারিং ঘোরাতে শুরু করেছিল ভ্যানের ড্রাইভার, ইচ্ছা ছিল পাশ কেটে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু কংক্রিটের ঢল স্তব্ধ করে দিল ওটার সামনের বাম চাকাকে, সঙ্গে সঙ্গে একদিকে কাত হয়ে গেল ভ্যানটা। গ্রিল ভেদ করে রেডিয়েটরে ঢুকে পড়ল আজেবাজে কিছু জিনিস, প্রচণ্ড গতিতে ছিটকে এসে উইণ্ডশিল্ডটাকে চুরমার করে দিল কিছু ধাতব পদার্থ। কয়েক শ কেজি কংক্রিটের ঠেলায় শেষপর্যন্ত একদিকে কাত হয়ে উল্টে গেল ভ্যানটা।

ট্রাকের দরজা খুলে লাফিয়ে রাস্তায় নামল রানা, ছুটে চলেছে ভ্যানের দিকে। ওর পাশে দৌড়াচ্ছে সোহেল, অস্ত্র হিসেবে একটা ক্রৌবার তুলে নিয়েছে হাতে।

ভ্যানের কাছে গিয়ে দেখল ওরা, সমানে বাষ্প বের হচ্ছে। ওটার রেডিয়েটর থেকে। বাতাসে গ্যাসোলিনের তীব্র গন্ধ।

প্যাসেঞ্জার সিটে বসা এক গুণ্ডা মারা গেছে। কংক্রিটের কোনও ব্লক ছিটকে গিয়ে ছেচে দিয়েছে লোকটার মাথা, কিছুটা মগজ বেরিয়ে এসেছে।

ভ্যানের ভিতরে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে সোহেল। বাকি দুজন কই?

দেখা গেল, দূরে ছুটে পালাচ্ছে দুটো ছায়ামূর্তি, ফোর্ট সেইন্ট মার্কাসের দিকে যাচ্ছে।

ওই যে! দৌড়াতে শুরু করল রানা।

.

দুর্গের উদ্দেশে দৌড়াচ্ছে ডারহাম, বড় রকমের মানসিক ধাক্কা খেয়েছে। অবস্থা খারাপ থেকে আরও খারাপ হচ্ছে।

গোপন ডিভাইস বসানো ছিল হেল্ডনের অফিসে, লোকটা আরেকটু হলে সব ফাঁস করে দিয়েছিল নুমার দুই এজেন্টের কাছে। আতঙ্কিত হয়ে পড়ে ডারহাম, হেল্ডনকে খুন করতে বলে সঙ্গে-থাকা আমেনথেসের লোকদেরকে। অফিসের যে দেয়ালের দিকে পিঠ দিয়ে বসত হেন্ডন, সেটাতে যেভাবে হামলা করা হয়েছে, তাতে এতক্ষণে বেঁচে থাকার কথা নয় লোকটার।

ওই পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। ডাম্প ট্রাকটা যত ঘাপলা লাগাল। কল্পনাও করেনি ডারহাম, ওভাবে ধাওয়া করা হবে ওদেরকে। ভাবেনি, হঠাৎ উল্টে যাবে ভ্যান, হাত থেকে উধাও হয়ে যাবে সঙ্গে-থাকা রিভলভার।

সাহায্য দরকার আমাদের, চেঁচিয়ে বলল সে ওর সঙ্গীকে। রেডিওতে যোগাযোগ করো।

 ডারহামের সঙ্গের লোকটার বেল্টে রেডিও ঝুলছে এখনও। দৌড়াতে দৌড়াতেই ওটা হাতে নিল সে। স্ল্যাগো, চার্লি বলছি। সাহায্য দরকার।

কী হয়েছে? রেডিওতে শোনা গেল স্ল্যাগোর উদ্বিগ্ন কণ্ঠ।

নুমার দুই লোকের সঙ্গে দেখা করেছে-হেল্ডন। আরেকটু হলে আমাদের সব কথা ফাঁস করে দিতে যাচ্ছিল সে। ওকে পরপারে পাঠানোর চেষ্টা করেছি আমরা এবং সম্ভবত সফল হয়েছি। কিন্তু এখন নুমার সেই দুই এজেন্ট পিছু ধাওয়া করছে আমাদের।

মেরে ফেলো ওদেরকেও।

সম্ভব না। আর্মস আছে ওদের সঙ্গে।

কথাটা মিথ্যা, কিন্তু তাতে কী? যাদের কাছে সাহায্যের আবেদন জানানো হচ্ছে, তারা তো জানছে না সেটা!

আমরা আহত, বলে চলল চার্লি। একজন মনে হয় মারা গেছে। কিছু একটা করো জলদি!

এখন কোথায় আছ তোমরা?

ফোর্ট সেইন্ট মার্কাসের দিকে যাচ্ছি।

যাও। ওখানে একটা খাল আছে, তোমাদের জন্য বোট রেডি রাখার ব্যবস্থা করছি। আগে জনমের শিক্ষা দেবে ওই এজেন্ট দুটোকে, তারপর বোটে উঠবে।

.

১০.

 দুই হামলাকারীর পিছু ধাওয়া করতে অসুবিধা হচ্ছে না রানা বা সোহেলের। কিন্তু শুরু থেকেই এগিয়ে ছিল, দুর্গের ভিতরে ঢুকে পড়ে গায়েব হয়ে গেল ওরা।

ক্ষিপ্র গতিতে ছুটছিল রানা, গতি কমাল। এখন জগিং করার ভঙ্গিতে দৌড়াচ্ছে। সোহেলকে পাশে নিয়ে দুর্গের পরিধিপ্রাচীরের ভিতরে ঢুকে পড়ল একসময়। এদিকওদিক তাকাচ্ছে।

দুর্গের ভিতরে জায়গায় জায়গায় জ্বলছে অত্যুজ্জ্বল কমলা আলোর একাধিক স্পটলাইট, চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। ছায়ায় ঢাকা-পড়া কোনওকিছু আসলে কী তা প্রথম দেখায় ঠিক বোঝা যায় না। কোনাকাঞ্চি বা সরু পথের কাছ থেকে সরে গেল রানা। ওখানে সহজেই ঘাপটি মেরে থাকতে পারে যে কেউ।

রানা যে-অ্যাঙ্গেল থেকে তাকাচ্ছে সেখান থেকে মনে হচ্ছে, দুর্গের মুখ বন্দরের দিকে ফিরিয়ে ওটা জোর করে জমিনের উপর বসিয়ে দিয়েছে কেউ। বিয়ে বা জন্মদিনের মাল্টিলেয়ার কেক যেমন হয়, দুৰ্গটা দেখতে সে-রকম।

দৌড়ানোর গতি আরও কমাল রানা। মূল দুর্গের দেয়াল এখন ওর ডানদিকে, আর বন্দরটা বাঁ দিকে। সামনে তালাবদ্ধ একটা দরজা দেখতে পেয়ে পথ বদল করল ও, বাঁক নিয়ে এগিয়ে চলেছে। অনতিদূরের একটা দেয়ালের গায়ে সরু গিরিখাতের মতো বানানো আছে কয়েক ধাপ সিঁড়ি, ওটার সামনে আরেকটা দরজা। ওটাতেও তালা ছিল, এখন ভাঙা।

ভিতরে ঢুকেছে ওরা, নিচু গলায় বলল সোহেল।

আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দরজার পাল্লায় ঠেলা দিল রানা, উপরের দিকে একবার তাকিয়ে উঠতে শুরু করল সিঁড়ি বেয়ে। দেয়ালের গা ঘেঁষে সাবধানে উঠছে। শেষ ধাপে পা রাখা মাত্র যেন অন্ধকার কুঁড়ে বের হলো একটা লোক, হাতের তলোয়ার দিয়ে কোপ মেরেছে রানার ঘাড় সই করে।

সাবধান ছিল বলে বেঁচে গেল রানা। একটু ঝুঁকে একদিকে কাত হয়ে গেল ও, এড়াতে পারল কোপটা। তলোয়ারটা দুহাতে ধরে আবারও কোপ মারতে যাচ্ছিল লোকটা, ভোতা কিন্তু ভারী একটা আওয়াজ শোনা গেল এমন সময়-হাতের ক্রৌবার সজোরে ছুঁড়ে মেরেছে সোহেল হামলাকারীর মাথায়।

ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল লোকটা, বেসামাল হয়ে গেছে। সুযোগ নিতে দেরি করল না রানা। একলাফে এগিয়ে গেল খানিকটা, বাঁ পায়ে ভর দিয়ে ডান পায়ে প্রচণ্ড লাথি হাকাল প্রতিপক্ষের সোলার প্লেক্সাসে। হুক শব্দ করে কুঁজো হয়ে গেল লোকটা, কয়েক পা পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। বেরিয়ে এসেছে ফুসফুসের সব বাতাস, আলগা হয়ে গেছে হাতেধরা তলোয়ার। উবু হয়ে ক্রৌবার তুলে নিল রানা।

স্পটলাইটের আলো উজ্জ্বল আভা তৈরি করেছে একদিকের দেয়ালে, সেটা যেন ঠিকরে আসছে এদিকে। কায়দা করে একটা আর্মারস্যুট দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে কাছেই, তলোয়ারটা ছিল ওটারই হাতে, আলগা করা হয়েছে ওটা।

কাজটা যে করেছে তাকে চিনতে পারল রানা। তুমিই ডারহাম, না?

মাথা নেড়ে নিজের পরিচয় অস্বীকার করল ডারহাম। কোঁকাচ্ছে–জায়গামতো লেগেছে রানার লাথি।

কোমায় চলে গেছে লিনোসার মানুষরা, বলে চলল রানা, ওই অসুখের অ্যান্টিডোট আছে তোমার কাছে। আমাদের হাতে তুলে দাও ওটা।

জবাবে তলোয়ারটা দুহাতে ধরে দুর্বল ভঙ্গিতে মাথার উপর তুলল ডারহাম। এক পা এগিয়ে এসে আবার কোপ মারল রানাকে।

ক্রৌবার দুহাতে ধরে লাঠিখেলার কায়দায় আঘাতটা ঠেকাল রানা, শোনা গেল ঠং শব্দ। একমুহূর্ত দেরি না করে সাইডকিক মারল ও ডারহামের কানে, বেসামাল করে দিল লোকটাকে। ব্যালেন্স ফিরে পেয়ে ক্রৌবার দিয়ে জোরে বাড়ি মারল লোকটার ডান হাতের কব্জিতে। ব্যথায় চিৎকার করে উঠল লোকটা, তলোয়ার ছেড়ে দিয়েছে হাত থেকে। এক লাথিতে ওটা সোহেলের দিকে পাঠিয়ে দিল রানা।

তলোয়ারটা বরং তুই নে, বলল সোহেল। খুঁজে বের কর এই ব্যাটার পার্টনারকে। ততক্ষণে আমি একটু খাতিরযত্ন করি ডাক্তার সাহেবের।

ক্রৌবার সোহেলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে তলোয়ারটা নিল রানা। ডাহামকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় জোরে একটা ঘুসি মারল লোকটার বাঁ কানে-যেখানে সাইডকিক মেরেছিল একটু আগে ঠিক সেইখানে। আরেকবার চিৎকার করে উঠল ডারহাম, হাঁটু গেড়ে বসে পড়তে বাধ্য হয়েছে।

কিন্তু যতটা না ব্যথা পেয়েছে তারচেয়ে বেশি ব্যথা পাওয়ার ভান করেছে ডারহাম; রানা চলে যাওয়ামাত্র উঠে দাঁড়িয়ে ছুট লাগাল সোহেলের উদ্দেশে–দুহাতে জাপ্টে ধরতে চায় ওকে। প্রস্তুত ছিল সোহেল, নাগালের মধ্যে পাওয়ামাত্র ক্রৌবারটা ব্যাট আর ডারহামের কপালটাকে বল ধরে নিয়ে ছক্কা হাঁকাল। থমকে গেল ডারহাম, চিৎকার ছাড়তে বাধ্য হলো প্রচণ্ড ব্যথায়।

পরেরবার মারব গর্দানে, হুমকি দিল সোহেল।

মাতালের মতো টলছে ডারহাম, দুর্বল কায়দায় একের পর এক ঘুসি মারছে বাতাসে। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে উপহাসের দৃষ্টিতে লোকটাকে দেখছে সোহেল। ডারহামকে নাগালে পাওয়ামাত্র পা চালাল, থেঁতলে দিল লোকটার ঠোঁট। তারপরও যখন লড়াইয়ের খায়েশ গেল না ডারহামের, ক্রৌবারটা দুহাতে ধরে সজোরে নামিয়ে আনল লোকটার ডান কাঁধের উপর। হাড় ভাঙার আওয়াজ পাওয়া গেল।

যে-হাড়টা ভেঙেছে সেটার নাম কী, ডাক্তার সাহেব?

কোন্ শক্তির কারণে কে জানে, এখনও দাঁড়িয়ে আছে ডারহাম, তবে একদিকে কাত হয়ে গেছে, ডান হাতটা ঝুলছে আংশিক-পক্ষাঘাতগ্রস্তের মতো।

এসো, এবার তোমার বাঁ হাতটাও অবশ বানিয়ে দিই, আগে বাড়ল সোহেল।

না, না, বাঁ হাত তুলে আর্জি জানাল ডারহাম, আর মেরো না, প্লিয। হার মানছি। বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সোহেলের দিকে, বোঝার চেষ্টা করছে ঠিক কতখানি প্রস্তুত অবস্থায় আছে সোহেল। ভালো হাতটা দিয়ে হঠাৎ থাবা চালাল প্যান্টের পকেটে, বের করে এনেছে হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ। নিডলক্যাপটা দাঁতে কামড়ে আলগা করেই ঝাঁপিয়ে পড়ল সোহেলের উপর।

ভুল করেছে ডারহাম। দেখে যা-ই মনে হোক, আসলে টান টান অবস্থায় ছিল সোহেল। ক্রোবার দিয়ে প্রচণ্ড বাড়ি মারল ডারহামের বাম কব্জিতে, গুঁড়ো করে দিল ওটা। সিরিঞ্জটা আলগা হয়ে গিয়েছিল লোকটার হাত থেকে, ওটা লুফে নিল। ক্রোবার ছেড়ে দিয়ে সুঁই গেঁথে দিল ডারহামের রানে, চাপ বসাল প্লাঞ্জরে।

সিরিঞ্জে কী ছিল তা ডারহামই ভালো জানে, কিন্তু যা ছিল তা কাজ করল তৎক্ষণাৎ। চোখ উল্টে গেল ডারহামের, ডানদিকে কাত হয়ে পড়ে গেল সে। আর নড়ছে না।

ডাক্তার সাহেব, বিড়বিড় করছে সোহেল, তোমাকে বইতে হলে মনে হয় অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে হবে। ঝুঁকে পড়ে পালস্ দেখল ডারহামের, লোকটা বেঁচে আছে বুঝে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সিরিঞ্জ বের করে নিল লোকটার রান থেকে, সুঁই ভেঙে ফেলে ঢোকাল নিজের পকেটে।

জানতে হবে কী ছিল এটাতে, বিড়বিড় করল আবারও।

.

ডানহাতে তলোয়ার নিয়ে এদিকওদিক তাকাতে তাকাতে এগিয়ে চলেছে রানা, খুঁজছে ডারহামের সঙ্গীকে।

লোকটার কাছে সম্ভবত কোনও ফায়ারআর্ম নেই। অথবা থাকলেও বুলেট শেষ। নইলে এতক্ষণে একটা-দুটো গুলি চালাতই। কিন্তু তার মানে এই নয়, রানার জন্যে কোথাও ওঁৎ পেতে নেই সে।

আরেকটু এগোতে অন্যদিকের সিঁড়ির কাছ থেকে আলগা কাকরে পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। দেয়ালের সঙ্গে গা মিশিয়ে ফেলল রানা, প্রস্তুত অবস্থায় রেখেছে তলোয়ারটা। দেয়ালের কোনার কাছে এসে সাবধানে উঁকি দিল। অনতিদূরে সর্পিলাকৃতি সিঁড়িটা উঠে গেছে দুর্গের উপরতলায়। সিঁড়ির প্রতিটা বাকের সঙ্গে যেন জড়াজড়ি করে আছে অন্ধকার, ঠিকমতো ঠাহর করা যায় না কিছু।

মূর্তির মতো স্থির হয়ে আছে রানা, কান খাড়া। কয়েক মুহূর্ত আর কোনও আওয়াজ নেই। খুব সম্ভব নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে প্রতিপক্ষও, বোঝার চেষ্টা করছে কেউ পিছু নিয়েছে কি না। হঠাৎ ধৈর্যচ্যুতি ঘটল লোকটার, সিঁড়ির আলগা কাঁকরে আবারও শোনা গেল ওর পদশব্দ। দ্রুত পার হওয়ার চেষ্টা করছে সিঁড়ির শেষ কয়েক ধাপ।

ওদিকে ছুটে গেল রানা, তলোয়ারটা বাগিয়ে ধরে উঠতে শুরু করেছে। উপরতলায় হাজির হওয়ামাত্র দেখল, সমতল গানারি ডেক ধরে ছুটে পালাচ্ছে একজন লোক। যেখানে যাচ্ছে সে, সমুদ্রের দিকে মুখ করে কয়েকটা কামান বসানো আছে সেখানে।

উসাইন বোল্টের গতি তুলে ছুট লাগাল রানা। লাফিয়ে পার হলো খাটো একটা দেয়াল, চত্বর ধরে আড়াআড়িভাবে এগোচ্ছে পলায়নরত লোকটার দিকে। ছুটন্ত অবস্থায় পিছন ফিরে রানাকে দেখতে গিয়ে ভুল করল লোকটা, হোঁচট খেল একটা র‍্যামপার্টের সঙ্গে, সঙ্গে সঙ্গে উল্টে গিয়ে আছড়ে পড়ল আট ফুট নিচের আরেকটা ডেকে। আর্তনাদ করে উঠল ব্যথায়।

র‍্যামপার্টের সারির কাছে পৌঁছে গেল রানা, ঝুঁকে তাকাল নিচের দিকে। কিনারার আরেকটু কাছে গিয়ে কুঁজো হলো খানিকটা, তারপর লাফিয়ে পড়ল নিচে। কিন্তু ততক্ষণে বাঁচার তাগিদে উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়ে ফুট চল্লিশেক দূরে চলে গেছে ওর টার্গেট, বেঁটে একটা দেয়ালের ওপর চড়ে বসে লাফিয়ে নামতে যাচ্ছে ওপারে।

ঘাড় ঘুরিয়ে আরেকবার রানাকে দেখল লোকটা, তারপরই লাফ দিল।

দেয়ালটার কাছে হাজির হওয়ামাত্র একটা ঝপাৎ আওয়াজ কানে এল রানার। উঁকি দিয়ে তাকাল নিচের দিকে।

ফুট ত্রিশেক নিচে খাড়া শেষ হয়েছে দুর্গের দেয়াল, তারপর থকথকে কাদামাটির খানিকটা বিস্তার। এরপরই শুরু হয়েছে সরু খাল। বড় বড় পাথরের ব্লক ফেলে সাগরের মুখ সঙ্কুচিত করে ফেলা হয়েছে খালের মোহনায়, লোকটা সাঁতার কেটে এগিয়ে চলেছে ওদিকে। ওর জন্য একটা ব্লকের আড়ালে অপেক্ষা করছে মোটরবোট।

আফসোস লাগছে রানার-প্রতিপক্ষ নিরস্ত্র হওয়ার পরও ধরতে পারল না। এখন ওর পক্ষে ত্রিশ ফুট নিচে লাফিয়ে পড়া সম্ভব না। যদি তা করেও, সাঁতার কেটে লোকটাকে ধরার আগেই মোটরবোটে উঠে পড়তে পারবে সে। তখন বোট থেকে হয় গুলি করা হবে রানাকে, নয়তো স্রেফ গায়েব হয়ে যাবে সেটা। কাজেই নির্বাক দর্শকের ভূমিকা পালন করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।

তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল, সাঁতার কেটে বোটের কাছে হাজির হলো লোকটা। ওকে তুলে নেয়া হলো সেটাতে। গর্জন করে উঠল শক্তিশালী ইঞ্জিন। কয়েক মুহূর্ত পরই কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল বোট রাতের অন্ধকারে।

সর্পিল সিঁড়িটা বেয়ে নিচে নেমে এল রানা, হাজির হলো সোহেলের কাছে।

খোলা একটা ল্যাণ্ডিং-এ দাঁড়িয়ে আছে সোহেল, ওটা মুখ করে আছে বন্দরের দিকে। অজ্ঞান ডারহামকে ইতোমধ্যে খাড়া করে ফেলেছে ও, লোকটার একটা হাত তুলে নিয়েছে নিজের ঘাড়ে। সোহেলকে সাহায্য করার জন্য পা বাড়াতে যাচ্ছিল রানা, গুলির শব্দটা শোনা গেল এমন সময়।

তিনটে ঘটনা ঘটল একইসঙ্গে।

একটা ঝাঁকুনি খেল ডারহামের শরীরটা।

লোকটাকে ছেড়ে দিয়ে ডাইভ দিল সোহেল, গড়িয়ে সরে যাচ্ছে সবচেয়ে কাছের আড়ালের উদ্দেশে।

হাত থেকে তলোয়ার ফেলে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে রানাও, আড়াল নেয়ার উদ্দেশ্যে গড়াতে শুরু করেছে।

কোন্ শালা গুলি করে, রে? বলল সোহেল।

তোর সব শালাকে চিনে রাখিনি আমি।

গুলির আওয়াজ ভয় পাইয়ে দিয়েছে কয়েকটা পাখিকে, তারস্বরে চেঁচাতে শুরু করেছে ওরা। কেউ কেউ ডাক ছাড়ছে আর প্রাণ নিয়ে পালাচ্ছে দু-চারটে কুকুর। এ ছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই।

সোহেল বলল, ডারহাম বোধহয় বেঁচে নেই, রে।

নিশ্চয়ই নবজীবন দান করার জন্যে গুলি করা হয়নি ওকে?

গুলি চালানো হয়েছে কোত্থেকে?

খুব সম্ভব ডক-এরিয়া, ঝুঁকি নিয়ে মাথা একটুখানি উঁচু করল রানা।

মোটরবোটটা চলে গেছে। ওটা যদি ফিরে আসত তা হলে ইঞ্জিনের আওয়াজ শোনা যেত। ডক-এরিয়ার যতটুকু দেখতে পাচ্ছে রানা, কোথাও এমন কোনও প্ল্যাটফর্ম নেই যেখানে পজিশন নিয়ে দূরপাল্লার রাইফেল দিয়ে গুলি করা যেতে পারে। ওই জায়গা ছাড়িয়ে দূরে দেখা যাচ্ছে আরেকটা দুর্গ, ওটার সমতল গানারি প্লযাটাও চোখে পড়ে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গোটাকয়েক দালানও দেখা যায়।

মাথা নামাল রানা। তোর শালার নিশানা দেখেছিস?

না দেখলে কোন্ শখে গড়াগড়ি খাচ্ছি মাটিতে?

আমাদের দুজনকে অনায়াসে শুইয়ে দিতে পারত সে। তা না করে শেষ করে দিল ডারহামকে।

প্রফেশনালরা যেমনটা করে।

প্যাঁ-পোঁ আওয়াজ শোনা গেল। বন্দর এলাকার দিকে ছুটে আসছে পুলিশের কয়েকটা গাড়ি। সম্ভবত খালের কাছে হাজির হয়েছে পুলিশের কোনও পাওয়ারবোট, প্যাঁ-পোঁ আওয়াজ করছে ওটাও।

রোগী মরিবার পর ডাক্তার আসিল, বলল সোহেল।

উপুড় হয়ে ছিল রানা, এবার চিৎ হলো। ডারহাম এত সহজ টার্গেটে পরিণত হলো কীভাবে, বুঝতে অসুবিধা হয় না। স্পটলাইটের আলো দেয়ালে ঠিকরে হলুদাভ উজ্জ্বল আভায় ভরিয়ে তুলেছে ল্যাণ্ডিং-এর এই জায়গা। টার্গেটকে আলাদা করে চিনতে অসুবিধা হয়নি স্নাইপার লোকটার।

পকেটে রাখা হেন্ডনের নোটটার কথা মনে পড়ে গেল রানার। একটু কসরত করে বের করল ওটা।

হেল্ডনেরই রক্তে ভিজে গেছে চিরকুটের একটা প্রান্ত। তবে যা লিখেছে লোকটা, তা পড়তে কোনও অসুবিধা হয় নাঃ

লুসি এল…

ভ্রূ কুঁচকে গেল রানার। এটা কার নাম? কার সঙ্গে দেখা করার কথা মুখে উচ্চারণ করতে পারেনি হেল্ডন, কিন্তু কাগজে লিখে দিয়ে গেছে?

মানুষটা…আসলে মেয়েমানুষটা…কে?

<

Super User