০৪.
পোর্টম্যান স্কয়ার। লন্ডন।
চার্চিল হোটেলের কার পার্কে এসে দাঁড়াল মাসুদ রানার নীল সিয়েরা। ড্রাইভিং সীট থেকে নামল ও, পরনে ডার্ক গ্রে স্যুট, সাদা শার্ট, লাল টাই। পায়ে বিশ্বের সবচেয়ে দামী জুতো সীব্যাপোস। আয়নার মত ঝকঝক করছে। চামড়া।
এঞ্জিন চালু, দরজা খোলা রেখেই প্রকাণ্ড প্রবেশপথের দিকে এগোল ও, এক পোটার বিনা বাক্য ব্যয়ে লটের দিকে চালিয়ে নিয়ে গেল গাড়িটা। পাঁচ মিনিট পর ষোলোতলার নির্দিষ্ট স্যুইটের দরজায় নক করল রানা। ডেস্ক থেকে ওর আসার খবর জানানো ছিল, কাজেই মুহূর্তে খুলে গেল চকচকে পালিশ করা কাঠের দরজা।
ভেতরে কমপ্লিট স্যুট পরা এক সুদর্শন যুবক দাঁড়িয়ে। ওকে নড় করল সে। প্লীজ, ভেতরে আসুন।
পা বাড়াল ও। যেমন বিশাল স্যুইট, তেমনি তার লাউঞ্জ। চোখ ধাঁধানো বিলাসের ছড়াছড়ি চারদিকে। ভেতরে তিন-চারজনকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসা দেখা গেল। সবাই উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক মানুষটি এগিয়ে এলেন দ্রুত পায়ে। আহ, সাবাহ আল খাইর, মিস্টার রানা?
সাবাহ ইন নর, মিস্টার আবদুল্লাহ, তার বাড়ানো হাত ঝাঁকিয়ে দিল ও।
আহলান ওয়া সাহলান। কাইফ হালাক?
ভাল আছি। ধন্যবাদ।
আসুন। আর সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে, তাদের দিকে এগোল দুজনে। সবাই রানাকে দেখছে গভীর আশা নিয়ে। তিনজন।
ইয়াসির আরাফাতের আল ফাতাহর উঁচু পদের কর্মকর্তা এরা। প্রথমজন, হানান আবদুল্লাহ, প্রধান সামরিক উপদেষ্টা। একজন তার সহকারী। অন্যদের একজন সংগঠনের ওমান, অন্যজন আমিরাত প্রতিনিধি। প্রথম যুবক আবদুল্লাহর একান্ত সচিব। আবদুল্লাহর সাথে রানার পরিচয় অনেকদিনের।
অন্যদের সাথে পরিচয় পর্ব সারা হতে বসল সবাই। সচিব কফি সার্ভ করল। আবদুল্লাহ প্রসঙ্গ তুললেন দুই চুমুক দিয়ে। আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে, মিস্টার রানা। এত টাকার জিনিস, সব পানিতে গেল।
হতাশ হবেন না,বলল ও। পুরোটা আগে শুনি। কাল লন্ডন এসে আমি নিজেও কিছু খোঁজ-খবর নিয়েছি। যা জেনেছি তাতে ভেতরের সব খবর বোঝা সম্ভব ছিল না। আপনি আমাকে একদম প্রথম থেকে খুলে বলুন দয়া করে। খুক করে কাশল ও। তার আগে আরেকটা কথা। এখানে যা খুঁজে দেখতে বলেছিলাম, দেখেছেন?
শিওর, দ্রুত মাথা ঝাঁকালেন আবদুল্লাহ। দুবার। শেষবার চেক করেছি মাত্র এক ঘণ্টা আগে। আমরা সবাই মিলে। নেই লিসনিং ডিভাইস। নিচের লাউঞ্জেও লোক আছে আমাদের। সন্দেহজনক কাউকে দেখলেই জানাবে।
বেশ, এবার বলুন প্রথম থেকে।
ঝুঁকে বসলেন ভদ্রলোক দুই হাঁটুতে কনুইয়ের ভর রেখে। আমরা যা করতে চেয়েছি, তার জন্যে সবচেয়ে আগে প্রয়োজন অস্ত্রের। কিছু নিজেদের, কিছু বন্ধু আরব দেশের দেয়া সাহায্যের টাকায় তাই ওগুলো কেনার সিদ্ধান্ত নিই আমরা। যোদ্ধা তৈরির ট্রেনিং চলছে, অস্ত্র এলেই… সে যাক। এ ব্যাপারে ভুলেও কখনও ইংল্যান্ড বা আমেরিকার কাছে যাই না আমরা, এবারও যাইনি।
অনেক ভেবেচিন্তে ফ্রান্সের সাথে যোগাযোগ করলাম। অস্ত্র বিক্রির মাঠে লীডার হওয়ার জন্যে ইউরোপে একমাত্র ওরাই ক্রেতার পরিচয় নিয়ে মাথা কম ঘামায়। খোঁচাখুচি কম করে। তারপরও সরাসরি যাইনি আমরা, মিশর আমাদের হয়ে ওদের সাথে যোগাযোগ করে। আপনি বোধহয় জানেন কায়রো আমাদের প্রচুর টাকা সাহায্য করেছে অস্ত্র কিনতে?
ওপর-নিচে মাথা দোলাল রানা। শুনেছি।
ইউ নো, আমাদের অঞ্চলে ইসরাইল বর্তমানে এমন এক বিষফোঁড়া হয়ে উঠেছে যে ওটাকে কেটে বাদ না দিলে আর চলছে না। কিছু আরব দেশ এতদিন ব্যাপারটাকে বিশেষ গুরুত্ব না দিলেও এখন দিচ্ছে। প্রায় সবাই আজ একমত এ ব্যাপারে। তাই ওরা সাহায্য করছে আমাদের। কারণ ইসরাইলকে উচিত শিক্ষা দেয়ার এ এক পরম সুযোগ। আমরা স্বাধীনতা ঘোষণা করলে ওরা। নিশ্চই চুপ করে বসে থাকবে না, আক্রমণ করবে। এই ছুতোয় জর্ডান, সিরিয়া, ইজিপ্ট একসাথে ইসরাইলকে আক্রমণ করবে, আরব ঐক্যের ডাক দেবে। আমরা আশা করছি এক এক করে অন্যরাও যোগ দেবে সে যুদ্ধে।
থেমে সচিবকে আরেক রাউন্ড কফির নির্দেশ দিলেন উপদেষ্টা। হেলান দিয়ে বসলেন। কিছু সময় চোখ কুঁচকে ভাবলেন কি যেন। যাকগে সেসব। যা বলছিলাম। ফ্রান্স রাজি হলো, কিন্তু মিশরকে সরাসরি এ ব্যাপারে জড়াতে নিষেধ করল তার ইউরোপীয় মিত্ররা নাখোশ হতে পারে ভেবে। তৃতীয় কোন পক্ষের মাধ্যমে এগোতে পরামর্শ দিল। আমাদের সাথে যোগাযোগ করে তাই। করল ওরা। আম্মান ভিত্তিক বেশ নামকরা এক কোম্পানির মাধ্যমে এগোল। স্পাইডেক্স ইন্টারন্যাশনাল ওটার নাম।
দ্বিতীয় কাপে চুমুক দিল রানা। তারপর?
ওটার চেয়ারম্যান জর্ডানী, কিন্তু ভাইস চেয়ারম্যান ব্রিটিশ।
ব্রিটিশ? নড়ে বসল রানা। বিস্মিত হয়েছে।
হ্যাঁ। তবে আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি ওই কোম্পানি আফ্রিকা, সাউথ ঈস্ট এশিয়া এবং মিডল ঈস্টের অনেক দেশে অতীতে অস্ত্র সরবরাহ করেছে। তৃতীয় পক্ষ হিসেবে। বর্তমানেও করছে। সন্দেহ করার মত কোন রেকর্ড নেই স্পাইডেক্সের।
আচ্ছা! নাম কি ভাইস চেয়ারম্যানের?
জর্জ কাপলওয়েট। চেয়ারম্যান আবদুল্লা হারিয়া।
মাথা ঝাঁকাল ও। চিনতেন এদের?
আগে চিনতাম না। তবে কায়রোর কাছে কোম্পানির নাম জানতে পেরে হারিয়াকে খুঁজে বের করে তার ওপর নজর রাখার ব্যবস্থা করি আমরা। আম্মানে তার বাড়ি-অফিস, সবখানে লিসনিং ডিভাইস পেতে কড়া ওয়াচে রাখি। কিছুদিন। এক সময় শিওর হলাম জেনুইন ব্যবসায়ী ওরা, ফাঁক-ফোকর নেই। ভেতরে।
অন্যজন, জর্জ কাপলওয়েট? তারওপর…
না। তাকে এখনও চিনি না আমরা।
সিগারেট ধরাতে গিয়েছিল ও, লাইটার ধরা হাত শূন্যে থেমে গেল। চোখ। তুলে আবদুল্লাহকে দেখল। চাউনিতে প্রশ্ন।
ব্যাপার হলো ফ্রান্সের সাথে স্পাইডেক্সের বেচাকেনার আলোচনা শুরু হওয়ার আগে থেকেই সে আফ্রিকায়। বড় এক অস্ত্র বিক্রির কাজ বাগাতে গিয়েছিল। তার জন্যে আমাদের কাজ ঠেকে থাকেনি, চেয়ারম্যানই যথেষ্ট, তাই খুব একটা গুরুত্ব দিইনি আমরা ব্যাপারটাকে। তাছাড়া আগেই বলেছি। অন্যান্য রিজিয়নের মত মিডল ঈস্টের কয়েকটা, দেশকে; বিশেষ করে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় ইরান-ইরাক, দুপক্ষের কাছেই অস্ত্র বিক্রি করেছে ওরা। তাই লোকটার অনুপস্থিতি নিয়ে মাথা ঘামানো হয়নি।
ওপর-নিচে মাথা দোলাল রানা। অন্যমনস্ক।
তারপর, ফ্রান্স স্পাইডেক্সকে জানাল, মাল সরাসরি ওদের দেশ থেকে না। নিয়ে অন্য কোন দেশ থেকে নিতে। আই ওয়াশ দেয়ার জন্যে আর কি! ঠিক হলো, ব্রাজিল দক্ষিণ আমেরিকার বড় অস্ত্র রফতানীকারক দেশ, ওখানেই ট্রান্সশিপমেন্টের ব্যবস্থা করা হবে। আমাদের প্ল্যান জানতে পেরে ঢাকা প্রস্তাব। দিল মাল বহনে তারা আমাদের বিনে ভাড়ায় জাহাজ দিয়ে সাহায্য করবে সাও পাওলো থেকে। খুব খুশি হলাম আমরা।
আপনাদের শিপ, বাংলার গৌরব তখন মাল খালাস করে ওখানেই ছিল। ভয়েজ নিরাপদ করার জন্যে কিছু কিছু কাজ করানো হলো ওটার ॥ প্রায় দুমাস। লেগেছে তাতে। ফ্রান্সের তুলো থেকে আমাদের মাল অন্য এক জাহাজে সাও পাওলো গেল, ওখান থেকে বাংলার গৌরব…
সে সব জানা আছে আমার, রানা বাধা দিল। মাল যাতে নির্বিঘ্নে জায়গামত পৌঁছতে পারে সে জন্যে ওটাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল সোজা পথে এসে ঘুরে আসতে। অনেক পথ।
হ্যাঁ। আমাদের জানিয়েছে ঢাকা। আপনাদের সরকারের দূরদৃষ্টি দেখে খুশি হয়েছিলাম আমরা। কিন্তু… থেমে গেলেন উপদেষ্টা। ঠাণ্ডা কফিতে চুমুক দিলেন।
জাহাজ উধাও হওয়ার জায়গাটা পিন পয়েন্ট করা গেছে? প্রশ্ন করল রানা। ঝুঁকে অ্যাশট্রেতে ছাই ঝাড়ল।
হ্যাঁ, মোটামুটি, তার সহকারী, ইবনে আব্বাস বলল। মাঝবয়সী সে, ও মোটাসোটা। পাশে বসা ওমান প্রতিনিধিকে দেখিয়ে বলল, গালফ অভ ওমানের মোহনার কোথাও থেকে উধাও হয়েছে ওটা।
স্পাইডেক্সের চেয়ারম্যানের সাথে এ নিয়ে কথা হয়েছে আপনাদের?
মুহূর্তের জন্যে ইতস্তত ভাব ফুটল আবদুল্লার চেহারায়। সে নেই।
চোখ কুঁচকে উঠল রানার। নেই মানে?
মারা গেছে। জাহাজ উধাও হয়ে যাওয়ার চারদিন পর হংকঙে এক লিফট দুর্ঘটনায় মারা গেছে হারিয়া। ও দেশেও ব্যবসা আছে তার, প্রায়ই আসা যাওয়া করত।
অনেকক্ষণ চুপ করে ভাবল ও। কোম্পানির ভাইস চেয়ারম্যান?
তার কোন খোঁজ নেই। এখনও ফেরেনি আফ্রিকা থেকে।
কোথাকার রেসিডেন্ট সে? তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন করল রানা।
উপদেষ্টা কপাল চুলকালেন। সুইটজারল্যান্ড, লন্ডন, রোম, নিউ ইয়র্ক, সবখানেই বাড়ি আছে তার শুনেছি। তবে ঠিকানা জানি না। আর এক জায়গায় বেশিদিন থাকেও না।
ফ্যামিলি?
নেই। হারিয়া বলেছে। ব্যাচেলর।
অর্থাৎ লোকটাকে ট্রেস করার কোন উপায় নেই! মনে মনে বিরক্ত হয়ে উঠল মাসুদ রানা। এমনকি তাকে চেনেন না পর্যন্ত আপনারা!
ওর চোখের দিকে তাকিয়ে পকেট থেকে সুন্দর একটা ভিজিটিং কার্ড বের করলেন ভদ্রলোক। এগিয়ে দিলেন। এটা হারিয়ার দেয়া, কাপলওয়েটের এখানকার সলিসিটরের ঠিকানা। এখানে প্রয়োজনে তার কন্ট্যাক্ট অ্যাড্রেস পাওয়া যাবে বলেছিল সে। কিন্তু…
পাননি, বাধা দিয়ে বলল ও। এই তো?
হতাশ চেহারায় মাথা দোলালেন তিনি। হ্যাঁ। প্রথমে তো এদের কী। হোল্ডার অ্যাগনস্ট আমাকে দেখা দিতেই রাজি ছিল না। দুদিন ঘুরে অল্প সময়ের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেলাম। সে বলল, এ নামে কোন ক্লায়েন্ট তাদের নেই। চাপাচাপি করায় ওরা ওদের মক্কেলদের নামের লিস্ট দেখিয়েছে আমাকে, তাতে ছিল না এই নাম।
কার্ডের নাম-ঠিকানা পড়ল রানাঃ মেন্ডলেসহ্যাম, হল অ্যান্ড অ্যাগনস্ট, গ্রী, গ্রগমর্টন স্ট্রীট, লন্ডন।
আপনি শিওর এটা হারিয়ার দেয়া?
শিওর! তার এবং ফরাসীদের মধ্যে অস্ত্র কেনা নিয়ে যত বৈঠক হয়েছে, ছদ্ম পরিচয়ে তার প্রত্যেকটায় আমিও ছিলাম ঈজিপশিয়ানদের সাথে। এটা হারিয়া আমাকে নিজহাতে দিয়েছে।
তাহলে?
শ্রাগ করলেন তিনি ঠোঁট উল্টে। আল্লা মালুম, কিছুই মাথায় আসছে না। আমার।
আবার কার্ডটা দেখল ও বহু সময় ধরে। এর অর্থ কি, হারিয়া ব্লাফ দিয়েছে, না মেন্ডলেসহেম দিচ্ছে?
বিপদ ঘটলে বাংলার গৌরবের ডিসট্রেস বীকন সিগন্যাল দেয়ার কথা ছিল। দিয়েও ছিল, কিন্তু খুব অল্প সময়ের জন্যে। কয়েক সেকেন্ড মাত্র, তারপর থেমে গেছে। বিপদ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে আমাদের ওখানকার প্রতিনিধি জাহাজ খোঁজার ব্যাপারে ব্যবস্থা করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু ওমান অ্যান্টি টেররিস্ট সংস্থার চীফ মেজর হ্যারি রোমান বাধা দিয়েছে। কাজ করতে দেয়নি।
বিস্মিত হলো রানা। নামটা যথেষ্ট পরিচিত। মেজর রোমান আজও মাসকাটে?
নীরবে মাথা দোলালেন আবদুল্লাহ।
কেন? ওমান প্রতিনিধির দিকে তাকাল ও। বাধা দিল কেন সে?
হাত চিৎ করে অসহায় ভঙ্গি করল লোকটা। দিল। তার দেশের সীমার মধ্যে কোনরকম অশুভ তৎপরতা চালাতে দিতে রাজি নয় সে।
আচ্ছা! সে তাহলে জানে এখবর?
মনে হয়। কিছু বলেনি অবশ্য।
তাকে আপনি চেনেন মনে হচ্ছে? আবদুল্লাহ বললেন।
আনমনে মাথা ঝাঁকাল ও। হাড়ে হাড়ে। অতীত স্মৃতি ভিড় জমাতে শুরু করেছিল, জোর করে তাড়িয়ে দিয়ে সিগারেট ধরাল। লোকটা তাহলে ওমানী অ্যান্টি টেররিস্ট এজেন্সির চীফ?
হ্যাঁ। ব্যাপার কি, মিস্টার রানা?
না কিছু না।
আরও এক ঘণ্টা পর হোটেল ছাড়ল ও। চেহারা চিন্তিত। কপালে মৃদু কুঞ্চন। ওকে দেখে রিসেপশন ডেস্কের ওপাশে বসা দুই ক্লার্কের একজন সহজ ভঙ্গিতে ঘুরে দাঁড়াল। পিছনের ক্যাশিয়ার লেখা দরজা দিয়ে ঢুকে ফোনে দ্রুত কথা বলতে শুরু করল কারও সাথে।
.
জেরুজালেম। প্রধানমন্ত্রীর অফিস।
এই লোক, মাসুদ রানা তাহলে এখন লন্ডনে? হাতের তালুতে থুতনি। রেখে ঝুঁকে বসল বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
জ্বি, মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার, বলল মোসাদ প্রধান। ফিলিস্তিনীদের সাথে মীটিং করছে। ওদের আলোচনা রেকর্ড করতে চেয়েছিলাম আমি, লোকও লাগিয়েছিলাম হোটেলরূমে ডিভাইস প্ল্যান্ট করতে। কিন্তু সুযোগ বের করা গেল না।
হুম! তাহলে, এখন কি করবেন ভাবছেন?।
নজর রাখা ছাড়া তেমন কিছু এ মুহূর্তে করার নেই স্যার, চিন্তিত গলায় বলল বেন মেইর। তবে..মাসুদ রানার রেপুটেশনকে রীতিমত ভয় করি আমি। মনে মনে শ্রদ্ধাও করি। ভয় হচ্ছে শেষ পর্যন্ত ওলটপালট না হয়ে যায়। সব।
যাহাল চীফ এলিয়াহুদ চশমার ওপর দিয়ে চোখ কুঁচকে তাকাল তার দিকে। তেমন কিছুই হবে না, মিস্টার মেইর, চি-চি করে বলল। শিওর। থাকুন।তার আর যাই থাকুক, আমাদের ইয়োন্নিকে ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার মত ক্ষমতা বা যোগ্যতা, কোনটাই নেই। কাজেই রিল্যাক্স।
মুশকিল হচ্ছে মানুষটা ঘাস খায় না, বিড়বিড় করে বলল মেইর। কপালের ভাঁজ আরও গম্ভীর হলো। ওর তৎপরতা ভাল ঠেকছে না আমার।
.
বিকেল চারটে।
মেন্ডলেসহ্যাম, হল অ্যান্ড অ্যাগনস্টের অফিস বিল্ডিঙের সামনে দাঁড়িয়ে। ঠিকানা মিলিয়ে নিল ব্রিটিশ টেলিকমের কভারল পরা এক লাইনম্যান। লালচে কোকড়া চুল। নাকের পাশে বড়, লালচে এক আঁচিল।
বিল্ডিংটা ভিক্টোরিয়ান, ক্লান্ত চেহারা। টাইলের মেঝে, প্যানেলিং করা দেয়াল। দুটোরই জরুরী ভিত্তিতে ভানিশ কোটিং প্রয়োজন। পুরো নিচতলা নিয়ে সলিসিটরের অফিস। দরজা খুলে রিসেপশন এরিয়ায় ঢুকল লোকটা। কড়া মেক-আপ করা মাঝবয়সী রিসেপশনিস্ট ঘুরে তাকাল। গম্ভীর। ইয়েস?
লোকটা হাসল। টেলিকম, মিস্। তোমাদের ফল্ট চেক করতে এসেছি। আইডি কার্ড দেখাল সে নিজের।
কিসের ফল্ট? আমি তো কোন অভিযোগ করিনি।
না, তুমি নও। তোমাদের এক মক্কেল করেছে চেলসি এলাকা থেকে। অনেক চেষ্টা করেও নাকি লাইন পাচ্ছে না এখানকার।
কই, আমাকে কিছু বলেনি তো কেউ!
মারফতী হাসি দিল সে। কি করে বলবে, লাভ, যদি লাইনই না পেল? প্রয়োজনে আমার বসকে ফোন করতে পারো তুমি।
শ্রাগ করল মহিলা। তার কোন দরকার দেখি না।
তবু, করোই না, কার্ডটা এগিয়ে দিল সামনে। এই যে নাম্বার। শিওর। হয়ে নেয়া ভাল।
ও কে! ইচ্ছের বিরুদ্ধে রিসিভার তুলে নিল রিসেপশনিস্ট, নাম্বার দেখে পাঞ্চ করল। মনে মনে হাসল লাইনম্যান। বেশ কিছুক্ষণ পর ফোন রেখে বিরক্ত চোখে তাকাল মহিলা। তোমাদের ডিপার্টমেন্ট ভীষণ ইনএফিশিয়েন্ট। একটা কানেকশন দিতে এত সময় লাগে অপারেটরদের, এরমধ্যে বোধহয় চাঁদ থেকেও ঘুরে আসা যায় এক চক্কর।
কি হলো? লাইন পাওনি?
পেয়েছি! চেহারা বিকৃত হয়ে উঠল রিসেপশনিস্টের। ঠিকই আছে, যাও, তুমি তোমার কাজ শুরু করো। একটা ছোট আয়না বের করে চেহারা দেখতে লেগে পড়ল সে।
লাইনম্যানও শুরু করে দিল নিজের কাজ। মহিলার সামনের রিসেপশন সুইচবোর্ড পরীক্ষার ছলে রূমের অ্যালার্ম সিস্টেম দেখে নিল ভাল করে। ওটা ইনফ্রারেড ডিভাইস। এ ধরনের পুরানো, বড় ভবনের নিরাপত্তার কাজে বেশ কার্যকর জিনিস। খরচও কম। ডেস্কের ওপরে, দেয়ালে সেট করা আছে ওটার সেনসর আই। দেহের উত্তাপ পেলেই টকটকে লাল ব্লিঙ্ক দিতে শুরু করে জিনিসটা। এখন অবশ্য ঘুমিয়ে।
ডেস্কের পিছনের দরজা খুলে ভেতরের করিডরে চলে এল সে। রিসেপশনিস্ট তখনও আয়নায় মগ্ন। করিডরটা বেশ লম্বা, দুদিকে প্লাইউডের পার্টিশন করা ছোট ছোট অনেকগুলো অফিস। শেষ মাথায় কোম্পানির তিন পার্টনারের বড় তিন শানদার অফিস।
কিন্তু লাইনম্যান যা খুঁজছে, তা দেখা গেল না কোথাও।
এক এক করে প্রত্যেকটা রূমে ঢু মারল সে, সবার বিরক্তি উৎপাদন করে সবগুলো টেলিফোন সেট খুলল, জোড়া লাগাল। কাজের ফাঁকে দেখে নিল রামগুলোর ইনফ্রারেড সেনসরের পজিশন। সাড়ে পাঁচটায় ছুটি হলো। মেয়ে সেক্রেটারিরা দলে দলে বেরিয়ে এল অফিস ছেড়ে, সবার হাতে একগাদা করে ফাইল। রীতিমত হাট বসে গেল করিডরে। হাসি-ঠাট্টা, এটা-ওটা আলাপ করছে। বাড়ি ফেরার জন্যে ব্যস্ত সবাই। ওদের সাথে সামনের দিকে চলে এল লাইনম্যান।
যাওয়ার আগে গোপনীয় সমস্ত ফাইলের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত মেয়েরা। তখনই ব্যাপারটা চোখে পড়ল লাইনম্যানের। আগে দেখেনি; রিসেপশন ডেস্কের সাথেই ছোট একটা দরজা, প্যানেলিঙের খাজে এমনভাবে সেট করা আছে, যে জানে না, তার বোঝার উপায় নেই। ওটা দিয়ে ভেতরে ঢুকছে ওরা।
মেয়েদের ভিড়ে মিশে ব্যস্তবাগীশ লাইনম্যানও ঢুকে পড়ল। তার আগে আড়চোখে এক নজর দেখে নিয়েছে রিসেপশনিস্টকে। এদিকে খেয়ালই নেই, নিজের গোছগাছে ব্যস্ত। দরজাটা দিয়ে ঢুকেই কয়েক ধাপ সিঁড়ি, তারপর খানিকটা স্পেসের ওপাশে বড় এক রূম। স্যাঁতসেতে। খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে অসংখ্য ফাঁইলিং ব্ল্যাক দেখা যাচ্ছে। দরজা পুরু লোহার-ওটা স্ট্রংরূম।
ভেতরে ঢুকল না লাইনম্যান। সিঁড়িরূমের দেয়ালে টেলিফোন লাইন খোঁজার ভান করল কিছু সময়। চোখ স্ট্রংরূমে। মেয়েরা যে যার ফাইল নির্দিষ্ট র্যাকে রেখে বেরিয়ে আসছে। শেষ মেয়েটি বেরিয়ে এসে ভারী দরজা বন্ধ করে দিল। আর কিছু দেখার নেই তার, ঘুরে মেয়েটির আগে আগে উঠে এল সিঁড়ি বেয়ে।
তুমি এখনও কি করছ? তাকে দেখে বিস্মিত হলো রিসেপশনিস্ট। নিচে গিয়েছিলে কেন?
ওদিকে লাইন আছে কি না দেখতে, লাভ, হাসল সে দাঁত বের করে। লাস্ট মিনিট চেকিং। চলি, কাজ শেষ। আশা করি লাইন পেতে আর অসুবিধে। হবে না তোমার মক্কেলদের।
.
রানা এজেন্সি। সন্ধে গড়িয়ে গেছে।
নিজের অফিসরূমে মুখোমুখি বসে আছে রানা ও আল-ফাতাহর সামরিক উপদেষ্টা, হানান আবদুল্লাহ। তার পাশে একটু আগে হল অ্যান্ড অ্যাগনষ্ট থেকে ঘুরে আসা লাইনম্যান, তৌফিক আহমেদ। রানা এজেন্সির লন্ডন ফিল্ড অফিসার। লালচে কোঁকড়া চুলের উইগ খুলে টেবিলে রাখা, আসল চুল তার কুচকুচে কালো। নাকের পাশের আচিল গায়েব।
তার ব্রিটিশ টেলিকমের আইডি কার্ড এক্কেবারে ভুয়া-মেড ইন রানা এজেন্সি। এ ধরনের জরুরী কাজের জন্যে কেনা বাচ্চাদের খেলনা প্রিন্টিং মেশিনে ছাপা। ওটায় যে ফোন নম্বর লেখা, তাও এখানকার। লাইনম্যানের বসের অপারেটরের দায়িত্ব পালন করেছে এজেন্সির স্থানীয় চীফের পি.এস। ব্যস্ততা বোঝানোর জন্যে ইচ্ছে করে অ্যাগনস্টের রিসেপশনিস্টের সময় নষ্ট করেছে সে খানিকটা। বস ছিল স্বয়ং মাসুদ রানা।
র্যাকে কোন নেম স্টিকার দেখোনি তুমি? প্রশ্ন করল ও।
জ্বি-না, বলল তৌফিক। খুব সম্ভব রেফারেন্স নাম্বার অনুযায়ী ফাইল মেইনটেন করে ওরা।
তাহলে, কি কি হলে চড়াও হতে পারি আমরা? রানার কথা শুনে মনে মনে হাসলেন হানান আবদুল্লাহ। ওর কাজের পদ্ধতি বেশ প্রভাব ফেলেছে তার ওপর। এক সেট হ্যান্ড হেল্ড পিআরও ত্রিশ রেডিও স্ক্যানার হচ্ছে এক নম্বর, কেমন?
মাথা দোলাল তৌফিক। জ্বি, মাসুদ ভাই।
ও জিনিস কেন? ফস্ করে বলে বসলেন উপদেষ্টা। আর কোন্ ওস্তাদী রানা দেখাতে যাচ্ছে, না জানা পর্যন্ত শান্তি হচ্ছে না।
পুলিস ট্রান্সমিশন শোনার জন্যে, বলল ও। লন্ডন সিটি পুলিস হেডকোয়ার্টার্স মেসেজ ট্রান্সমিট করে ৪৫১.৭৭৫ ইউএইচএফ-এ, তথ্যটা ওর জানা আছে। মোবাইল প্যাট্রল আর পুলিস সার্জেন্ট বীটের সময় ১৫৪.০১০ থেকে ১৫৬.৭৭৫ মেগাহার্সের মধ্যে রিসিভ করে যে-কোন সঙ্কেত। ও দিকে খেয়াল রাখতে হবে ওকে। নইলে সমস্যা হয়ে যাবে।
তবে সলিসিটরের অফিস অন্য অনেক বেসরকারী অফিসের মত নন প্রায়োরিটি সম্পত্তি। অ্যাগনস্টের ইনফ্রারেডের সঙ্কেত পেলেও সাড়া দিতে সময় নেবে পুলিস।
আর কি? মাথা আঁকাল ও। একটা কবুতর বা মুরগি। নাহ, কবুতরই। ভাল। মুরগি আওয়াজ করে বেশি। এবার, তৌফিকের দিকে তাকাল। ওদের অফিসের ডিটেইলড় ফ্লোর প্ল্যান এঁকে ফেলো তুমি। কোন রূমে কোথায়। সেনসর, দেখাও।
ব্যস্ত হয়ে পড়ল তৌফিক।
রাত সাড়ে এগারোটা। নির্দিষ্ট বিল্ডিঙের উল্টোদিকের এক কার পার্কে এসে থামল রানার সিয়েরা। ও আর তৌফিক নামল ভেতর থেকে। তৌফিকের হাতের ছোট থলেতে একটা কবুতর। নড়ছে। গাড়ি লক করল। রানা, তারপর দুজনে মিলে রাস্তা পার হয়ে ভিক্টোরিয়ান বিল্ডিংটার সামনে পৌঁছল। বুক পকেটে রাখা স্ক্যানার অন করল রানা, থেকে থেকে ক্যানকেনে গলা শোনা যাচ্ছে ওটায়। হেড কোয়ার্টার্সের সাথে কথা বলছে পুলিসের মোবাইল প্যাট্রল ইউনিটগুলো।
সলিসিটরের এবং তার পাশের বিল্ডিঙের মধ্যে, সরু একটা গলি, ওটা ধরে পিছনদিকে চলে এল ওরা। শেষ মাথায় কোমর সমান উঁচু রেলিং দিয়ে গলিটা ঘেরা, ওপাশে ডেড বেসমেন্ট এরিয়া। রেলিং টপকে ভেতরে চলে এল। হল অ্যান্ড অ্যাগনস্টের গ্রাউন্ড ফ্লোরের এক জানালার সামনে থামল। একটা ডাস্টবিন টেনে নিয়ে এসে ওটার ওপর উঠল তৌফিক, পকেট থেকে সরু ব্লেডের চওড়া প্যালেট কিচেন নাইফ বের করে জানালার স্যাশ লক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রানার নজর রাস্তায়, কান রেডিওতে।
দুমিনিট পর রিসেপশনিস্টের অফিসে পৌঁছল ওরা। বডি হীট টের পেতেই সেনসরের লাল LED লাইট পিট পিট করতে শুরু করল। সঙ্কেতটা টেলিফোন লাইন হয়ে প্রথমে পৌঁছবে এদের সিকিউরিটি ফার্মে, ওখান থেকে পুলিস স্টেশনে, জানা আছে রানার।
লাইটটার উদ্দেশে চোখ টিপল তৌফিক। পরে দেখা হবে। এখন তাড়া আছে, ভায়া।
ব্যস্ত পায়ে বেজমেন্টে নেমে গেল সিড়ে ভেঙে। ফ্লোর প্ল্যান দেখে রানা। চলল সিনিয়র সেক্রেটারির অফিসের দিকে। খুব দ্রুত একটা জানালা সনাক্ত করল. তৌফিক, ওটার ওপাশেই রয়েছে বাইরের রেলিং ঘেরা গলি। উল্টোদিকে; স্ট্রংরুমের দরজার ওপরের সেনসর ততক্ষণে পিট-পিট শুরু করে। দিয়েছে। একটা বাতিল চেয়ার নিয়ে ওটার সামনে দাঁড়াল সে, ঝটপট সেনসর আইর পাস্টিক কভার খুলে তার ভেতরে খানিকটা পার্সেল টেপ লাগিয়ে জায়গামত বসিয়ে দিল কভার। পিটপিটানি বন্ধ হয়ে গেল সেনসরের, কানা হয়ে গেছে। এখন দশজন রূমে এসে দাঁড়ালেও সাড়া দেবে না ওটা। সন্তুষ্ট হয়ে ঘুরে দাঁড়াল তৌফিক চেয়ার জায়গায় রেখে।
ওদিকে রান রেডিও স্ক্যানার অন রেখে সিনিয়র সেক্রেটারির ডেস্ক ঘটছে ব্যস্ত হয়ে, তবে খুব সতর্কতার সাথে। কিছু ধরার আগে দেখে নিচ্ছে সেটা কোথায়, কিভাবে রাখা আছে। প্রায় দশ মিনিট লাগল জিনিসটা পেতে। একটা এস রেফারেন্স ইনডেক্স বুক। জর্জ কাপলওয়েটের ফাইল নম্বর লেখা আছে এতে। এক পলক দেখেই মুখস্থ করে নিল রানা।
কাজ সেরে এসে একই ডেস্কের অন্য সমস্ত ড্রয়ার হাতড়াতে লাগল তৌফিক। ডানদিকের মাঝের ড্রয়ারে পাওয়া গেল FILES লেখা বড় এক চাবি। ঐংরূমের চাবি। নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে বলে রোজ চাবি টানাটানির ঝামেলা পোহাতে চায় না এরা।
মনে মনে হাসল রানা। দারুণ সিকিউরিটি সিস্টেম।
ঠিক সেই মুহূর্তে চাঁচামেচি শুরু করে দিল স্ক্যানার। পুলিস স্টেশন থেকে একটা সেন্ট্রাল স্টেশন অ্যালার্ম বাজছে বলে জানানো হচ্ছে মোবাইল ইউনিটকে, ব্যাপার চেক করার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। ওটা একটা অফিস-মেন্ডলেসহ্যাম, হল অ্যান্ড অ্যাগন।
মাসুদ ভাই, কেটে পড়ি চলুন।
হ্যাঁ, চলো। চাবিটা পকেটে ভরে রাখল ও।
স্যাশ উইন্ডো দিয়ে বেরিয়ে এল দুজনে। পাল্লা টেনে নামিয়ে দিল তৌফিক, তবে পুরোটা নয়। ছয় ইঞ্চি ফাঁক রেখে। ফাঁক দিয়ে ভেতরে। পাঠিয়ে দিল হতভম্ব পাখিটাকে। পুলিস স্কোয়াড কার পৌঁছল ইনফ্রারেড সেনসরের সিগন্যাল শুরু হওয়ার ষোলো মিনিট পর। ওরা তার ঢের আগেই পৌঁছে গেছে গাড়িতে। বসে আছে।
দীর্ঘ নীরবতার পর পুলিস কোম্পানির কী-হোল্ডারকে ফোন করল। এল সে। অফিসারদের সাথে ঘুরে দেখল অফিস। ওদিকে গাড়িতে বসে স্ক্যানারে ওরা একটা মোটা গলার রিপোর্ট শুনতে পেল পরিষ্কার, স্টেশনে রিপোর্ট করছে। ফলস্ অ্যালার্ম, সার্জ। নিচতলার জানালা খোলা পেয়ে ঘুমকাতুরে এক কবুতর ঢুকে পড়েছে ভেতরে, আর কিছু নয়। ওটার বডি হীটে মাথা খারাপ হয়ে গেছে সেনসরের। ভাল কথা, সার্জ, তোমার গিন্নি পিজিয়ন পাইর ভাল কোন রেসিপি জানে নাকি
পুলিস চলে যাওয়ার আধঘণ্টা পর আবার এল রানা ও তৌফিক। পিছনের রেলিঙের সাথে দড়ি বেঁধে ঝুলে নেমে গেল সরু বেজমেন্ট এরিয়ায়, আই লেভেলের নিচে। এখানে সুবিধেজনক যে জানালা দেখে রেখে গিয়েছিল তৌফিক, ওটা দিয়ে ঢুকে স্ট্রংরূমের দরজা খুলল। অন্ধ সেনসর টের পেল না কিছু।
রূমটা মাঝারি। ওয়াল-টু-ওয়াল র্যাকে থরে থরে সাজানো আছে শত শত ফাইল। কোড নাম্বার জানা না থাকলে ওর ভেতর থেকে বিশেষ একটা ফাইল বের করা অসম্ভব কাজ। রানার জানা আছে, কাজেই কয়েক সেকেন্ডের বেশি লাগল না।
সঙ্গে আনা মিনক্স মাইক্রো ডকুমেন্ট ক্যামেরা দিয়ে নির্দিষ্ট ফাইলের প্রতিটা পাতার দুটো করে ছবি তুলে নিল ও।
পরদিনই অজ্ঞাতকারণে জর্জ কাপলওয়েটের ফাইল ক্লোজ করে দিল হল অ্যান্ড অ্যাগনস্ট, নষ্ট করে ফেলা হলো কাগুঁজে ডকুমেন্টস। থাকল কেবল ওসবের মাইক্রোফিল্ম করা রেফারেন্স। ইনডেক্সের ক্রস রেফারেন্স থাকল আগের মতই, ওটা নষ্ট করার নিয়ম নেই।
খবরটা মাসুদ রানার জানা হলো না।
.
০৫.
জেরিকো। পশ্চিম তীর।
পিছনে হালকা পায়ের শব্দে পর্দার ফাঁক থেকে চোখ সরিয়ে ঘুরে তাকাল মাসুদ রানা। কফি নিয়ে এসেছে গৃহকত্রী। অল্পবয়সী এক স্কুল শিক্ষিকা। নীল নয়না। নাম তানজিন। কাপ টেবিলে রেখে সোজা হয়ে মৃদু হাসল। ও আসছে।
মাথা ঝাঁকাল রানা, ইঙ্গিতে জানালা দিয়ে বাইরের রাস্তা বোঝাতে চাইল। অনেক সৈন্য মনে হচ্ছে!
গম্ভীর হলো শিক্ষিকা। ওর পাশ ঘেঁষে গিয়ে পর্দা সামান্য সরিয়ে উঁকি দিল। একটুপর মাথা দোলাল। অস্বাভাবিক কিছু নয়। ওরা সব সময় দল বেঁধে। ঘোরে!
কাপ তুলে নিয়ে দাঁড়িয়েই চুমুক দিল রানা। এক চোখ বাইরে। রাস্তায়। গিজ গিজ করছে মানুষ। বাজার বসেছে সদর রাস্তায়। ওর মধ্যে ছোটাছুটি করে খেলছে আরব শিশুরা। কারবাইন কাঁধে টহল দিচ্ছে ইসরাইলী সৈন্য। কঠোর, নির্বিকার চেহারা। সবকিছুর ওপর কড়া নজর।
জেরিকো শহরটা বেশি বড় নয়। বাড়িঘর সব প্রাচীন। শহরের পুব প্রান্ত, এটা, আদি শহর। ঘিঞ্জি। পরে যেটুকু বেড়েছে শহর, পশ্চিমদিকে বেড়েছে। তাও সেরকম নয়। বাড়িঘরের তুলনায় মানুষ বেশি মনে হয়। এর অবশ্য কারণও আছে। ৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে আমেরিকার মধ্যস্থতায় আরাফাত বেগিনের শান্তি চুক্তির কয়েক মাস পর জর্ডান নদীর পশ্চিম তীর ও গাঁজা উপত্যকার যে অংশটুকু ইসরাইল ফিলিস্তিন স্বায়ত্বশাসনে ছেড়ে দিয়েছে, জেরিকো তার রাজধানী। লেবানন, সিরিয়া, জর্ডানসহ অন্যসব জায়গায় যত অভিবাসী ফিলিস্তিনী আছে, প্রায়ই কিছু কিছু করে ফিরে আসছে। জেরিকোতে আসছে তাদের বেশিরভাগ।
স্বায়ত্বশাসন দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু পাহারাদারি ছাড়েনি ইসরাইলী সৈন্য। প্রতিমুহূর্ত আরবদের পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়ায়। সামান্য এদিক-ওদিক দেখলেই শহর ঘিরে ফেলে, বন্ধ করে দেয় রাস্তাঘাট। জেরুজালেমের খুব কাছে বলে বিশেষ করে জেরিকোর ওপর কড়া নজর ইসরাইলীদের। পথে পথে অসংখ্য রোড ব্লক। বেশ ঝক্কি পোহাতে হয়েছে রানাকে ভেতরে পৌঁছতে।
ও ব্রিটিশ ইহুদী জেনেও তেমন প্রভাবিত হয়নি ব্যাটারা। লন্ডন, গ্লাসগো, বার্মিংহাম আর কিয়েভের ইহুদী কমিউনিটির চ্যারিটি ফান্ড যে রানার কাছ থেকে। নিয়মিত মোটা টাকার চাদা পেয়ে থাকে, তার দুচারটা রিসিপ্টও বিশেষ কাজে। আসেনি। দফায় দফায় ওদের অজস্র প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে জান পেরেশান হয়ে গেছে।
তবু রক্ষা যে শেষ পর্যন্ত সোজা রাস্তায় ঢোকা গেছে। রানা ব্রিটিশ এক স্যানিটারি ওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার, এ অঞ্চলে বাজারের খোঁজে এসেছে বলে ছেড়ে দিয়েছে শেষ পর্যন্ত।
কাপ রেখে তানজিনকে ধন্যবাদ জানাল ও। সোফায় বসে সিগারেট ধরাল। শিক্ষিকা বেরিয়ে যেতে নজর বোলাল ঘরের চারদিকে।
বাড়িটা বেশ পুরানো। চারতলা। দোতলায় থাকে এদের পরিবার। তানজিনের স্বামী ওমর গোপন আল-ফাতাহর সংগঠক। ইসরাইলীদের তৎপরতার জন্যে খুব সতর্কতার সাথে কাজ করতে হয় এদের। শুধু খুব বললে ভুল হবে, অসম্ভব সতর্কতার সাথে। সামান্য এদিক-ওদিক হয়ে গেলেই সর্বনাশ। অবশ্য ওমরের আরেক পরিচয় আছে, এখানকার মোটামুটি বড় স্যানিটারি ওয়্যার ব্যবসায়ী সে। কাজেই তার সাথে ওর দেখা করতে আসায়। সন্দেহজনক কিছু নেই। কেবল ওমরের সাথেই নয়, রানা এসেছে বহুদিনের ঘনিষ্ঠ আরও এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে।
অপেক্ষা করতে করতে অস্থির ও, দুপুর গড়িয়ে যেতে শুরু করেছে, তখনই এল সে। দরজায় দাঁড়িয়ে কয়েক মুহূর্ত হাঁ করে দেখল ওকে। তারপর ছুটে এসে আলিঙ্গন করতে গিয়ে কোলেই তুলে ফেলল। স্যার! বস! সত্যি তুমি এসেছ? এতবছর পর মনে পড়ল আমাদের?
কাঁধ ধরে তাকে খানিকটা পিছনে সরিয়ে দেখল রানা। মুখে মিটিমিটি হাসি। কেমন আছ, আতাসী?
ভাল, বস। তুমি কেমন আছ?
দেখতেই পাচ্ছ। বোসো। মার্সিয়ার খবর কি?
খুব ভাল, বস্। খুব ভাল। আমার পাঁচ নম্বর ছেলের মা হতে যাচ্ছে ও। ওর জন্যে দোয়া কোরো।
চোখ কপালে উঠল রানার। সে কি! এবার দয়া করে রেহাই দাও বেচারীকে, আর কত?
কি যে বলো না, বস, এত তাড়াতাড়ি? আমার পুরো এক ব্যাটেলিয়ন চাই, আমি হব ওদের ব্যাটালিয়ন কমান্ডার। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইসরাইলীদের সাথে লড়ব, প্রয়োজনে মরব, তবে না জন্ম সার্থক হবে।
হাসল ও। আগের মতই আছ তুমি, বেদুইন।
হ্যাঁ, বস! এখনও সেই দুই আছি। কদিনে সখা হয় জানি না।
অনেক পুরানো রসিকতা। হাসল দুজনে। রানা সিগারেট ধরাল আতাসীকে একটা দিয়ে। তানজিন কফি নিয়ে এল। ও বেরিয়ে যেতে মুখ খুলল রানা। তুমি এখানে কতদিন থেকে আছ, লেফটেন্যান্ট?
অনেকদিন থেকে, বস। গেরিলা প্রশিক্ষণ দিচ্ছি এদের।
ওপর-নিচে মাথা দোলাল ও। তোমাকে আমার দরকার।
বলে ফেলো, বস্। বান্দা হাজির তোমার জন্যে।
আমার জন্যে নয়, কঠোর হয়ে উঠল রানার চেহারা। ফিলিস্তিনের জন্যে।
কফিতে চুমুক দিল বেদুইন। যে জন্যেই হোক, বস, তুমি আমার খোঁজে এসেছ, আমার তাই যথেষ্ট। এবং আমাকে তুমি আজও মনে রেখেছ বলে কৃতজ্ঞ আমি। বলল এবার, কাজটা কি?
.
আধঘণ্টা পর। পায়চারি করে বেড়াচ্ছে আতাসী, চিন্তায় চোখমুখ কুঁচকে আছে। আমি তো এখানেই আছি, বস্। কই, এতবড় খবর, কিছুই তো জানি না। কেউ বলেনি।
ফিলিস্তিন হাই কমান্ড ইচ্ছে করেই চেপে গেছে, আতাসী। জানাজানি হলে যোদ্ধারা হতোদ্যম হয়ে পড়তে পারে, মন ভেঙে যেতে পারে ওদের, তাই চেপে যাওয়া হয়েছে, রানা বলল।
তাই হবে। দাঁড়িয়ে পড়ল বেদুইন। তুমি তাহলে এখন…
ওকে থামিয়ে দিল রানা। হ্যাঁ। তুমিও যাবে আমার সাথে।
দাঁত বেরিয়ে পড়ল তার। ঝুঁকে কুর্নিশ করল। যথা আজ্ঞা, মহামান্য সম্রাট। পরক্ষণে চেহারা করুণ হয়ে উঠল। কিন্তু, বস, আমি যে সাঁতার জানি না! সাগর তো অনেক পরের কথা, পানির নাম শুনলেই কলজে শুকিয়ে আসে।
বুড়ো হতে চললে অথচ সাঁতার শেখোনি এখনও, এ কেমন কথা? কড়া গলায় বলল ও। পরক্ষণে স্বর নামাল। ঘাবড়িয়ো না। সে জন্যে সমস্যা হবে না।
বাঁচালে!
আরও কয়েকজনকে চাই আমার, রানা সিগারেট ধরাল। তোমার নিজ হাতে ট্রেইনড়দের মধ্যে থেকে। কি ধরনের বুঝতেই পারছ।
বসে ওর প্যাকেট থেকে সিগারেট নিল লে. আতাসী। ধরাল। তাতে সমস্যা হবে না। কিন্তু তার আগে সুপিরিয়রদের অনুমতি…
কিচ্ছু দরকার নেই। ওসব ব্যবস্থা করেই তোমাকে খবর দিতে বলেছি ওমরকে। তোমার ডিটাচমেন্ট অর্ডার এতক্ষণে জায়গামত পৌঁছে গেছে।
ও, তাহলে তো আর কোন সমস্যাই রইল না। আমার ক্যাম্পে চলো তাহলে। দেখেশুনে যাকে উপযুক্ত মনে হবে…।
.
অস্থায়ী ব্যারাকের টানা বারান্দায় চেয়ারে বসে আছে সার্জেন্ট দারভিশ হামাম। কিংসের মত অভিব্যক্তিহীন চেহারা। ইয়া পেশীবহুল দুহাত বুকের ওপর ভাজ। করা। ডান কবজির ওপরদিকে টাট্ট করা আছে আল্লাহ এবং নিজের প্রতি সবসময় বিশ্বস্ত থেকো।
বাইরে প্রচণ্ড রোদ। বালি ফুটছে বোধহয়। লু হাওয়া বইছে। চোখমুখ পুড়ে যাওয়ার অবস্থা। জর্ডান নদী ও জারকা নদীর মাঝখানে ওদের এই ক্যাম্প, জর্ডানের ভেতর। বহু বছরের বৈরিতা ভুলে আম্মান ফিলিস্তিনীদের সাহায্যে হাত বাড়িয়েছে অবশেষে, ওদের ট্রেনিঙের জন্যে ছেড়ে দিয়েছে প্রায় পঁচিশ বর্গমাইলের মত এই মরু প্রান্তর।
ব্যারাকের পিছনের বিস্তীর্ণ ড্রিল গ্রাউন্ডে ট্রেনিং চলছে। তবে হামামকে ছুটি দেয়া হয়েছে আজ। খুব গুরুত্বপূর্ণ এক অতিথি আসছে এখানে; সেই জন্যে। ক্যাম্প কমান্ড্যান্ট লে. আতাসী তাকে নিয়ে পৌঁছবে যে কোন সময়। তার সাথে জামাল শামলুও ছুটি পেয়েছে আজ। যদিও আজ ওর এমনিতেই ছুটি। ওর ট্রেনিং কাল শেষ হয়ে গেছে। তবে ওপর থেকে যখন ওদের দুজনকে রেস্ট নিতে বলা হয়েছে, তখন নিশ্চই এরমধ্যে অন্য কিছু আছে বলে হামামের মনে হচ্ছে।
বেচারা শামলু, ভাবল সার্জেন্ট। চার বছর বয়স থেকে দুনিয়ায় একদম একা সে। কেউ নেই। কিছু নেই নিজের বলে। ফিলিস্তিন আচমকা যেদিন ইসরাইল হয়ে গেল, তাড়া খেয়ে জর্ডানে পালিয়ে গেল ওর মা-বাবা। তারাও তখন অল্পবয়সী। সুবিধে হলো না ওদেশে, ফিলিস্তিনী রিফিউজির সংখ্যা এত বেড়ে গেল যে উৎকট ঝামেলা ভেবে জর্ডান তাদের তাড়িয়ে দিল। বহু ফিলিস্তিনী মরল জর্ডানী সৈন্যের গুলিতে।
তারপর লেবানন। ওরাও কম অত্যাচার করেনি। ৭৩ সালে পিএলও গেরিলার ঘাটি সন্দেহে সাবরা ও শাতিলা রিফিউজি ক্যাম্পে বিমান হামলা চালাল লেবানীজ এয়ার ফোর্স। ধ্বংস করে দিল সব, শত শত নিরীহ ফিলিস্তিনী মরল। কয়েক বছর পর আবার সেই একই ট্রাজেডি। এবার ইসরাইলী সৈন্যরা হামলা চালাল ওই দুই ক্যাম্পে। একা হয়ে পথে নামল জামাল।
ঘোট্ট, অসহায় শিশু। খিদে পেলে, কাঁদতে বসে যায়, হাজারো ফিলিস্তিনীদের মধ্যে মা-বাবাকে খুঁজে বেড়ায় ওর দুচোখ। মরণ যে তাদের চিরতরে নিয়ে গেছে, বুঝতে চায় না। ছয় বছর পর্যন্ত প্রতিবেশীদের ফাঁই ফরমাশ খেটে কেটেছে, তারপর পথে নামতে হয়েছে পেটের দায়ে। বড় হয়ে গেছে, কাজেই ওকে খাওয়ানোর পিছনে বাড়তি খরচ বন্ধ করে দিল তারা। এক টুকরো রুটি বাড়তি খরচ করাও তাদের জন্যে বিলাসিতা ছিল। অপব্যয় ছিল।
বৈরুতের আইন আল-রামানেহ স্কয়ারের অজস্র হকারের সাথে ভিড়ে গেল শামলু বাধ্য হয়ে। চুইং গাম, কেক, সিগারেট বিক্রি করে দিন চলত। দুবার খেত দিনে-সকালে আর রাতে। দুপুরে খেতে গেলে পুঁজিতে হাত পড়বে, তাই স্কয়ারের দামী দামী রেস্তরাঁর কাঁচের জানালায় নাক ঠেকিয়ে পয়সাওয়ালাদের খাওয়া দেখত তখন, ওসবের স্বাদ আর গন্ধ কল্পনা করত, ওতেই ভরে যেত পেট। বর্ণমালার বই কিনে আরবী আর হিব্রু লিখতে-পড়তে শিখেছে নিজে নিজে, ডাস্টবিনে বিদেশীদের ফেলে দেয়া খবরের কাগজ পড়ে একটু একটু করে জেনেছে নিজেদের দুর্ভাগ্যের ইতিহাস।
ফিলিস্তিন স্বায়ত্বশাসন পাওয়ার পর রামাল্লা হয়ে জেরিকো আসে ও, নাম লেখায় আল-ফাতায়। ক্যাম্পে পাশাপাশি থাকে শামলু আর দারভিশ। আগে প্রায় রাতেই ওর কান্নায় বা গোঙানিতে ঘুম ভেঙে যেত তার। এখন অবশ্য পরিস্থিতি বদলেছে, ট্রেনিঙের সাথে পাল্লা দিয়ে কমে গেছে ওসব। অনেক দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছে যুবক। চাউনি এত শীতল-কঠোর হয়ে উঠেছে যে দেখলে একেক সময় তার মত পাথর হৃদয় মানুষের বুকও কেঁপে ওঠে।
হায়রে ফিলিস্তিন, ভাবল সে, আর কত রক্ত চাই তোমার ছেলেবেলায় বড়দের মুখে পূর্বপুরুষদের দুঃখ-কষ্টের ইতিহাস শুনেছে দারভিশ। বড় হয়ে ক্লাসে পড়েছে। দুর্বল বলে ফিলিস্তিনীদের সাথে যে প্রবঞ্চনা, যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে পৃথিবী, তার জানামতে এমন নজির দ্বিতীয়টা নেই ইতিহাসে।
ইহুদীদের নিজেদের কোন দেশ ছিল না, দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে, তাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই চিন্তা-ভাবনা চলছিল কোথাও ওদের খানিকটা জায়গা ছেড়ে দেয়ার। মোটামুটি ধারণা দেয়া হয়েছিল পুব আফ্রিকার আজকের স্বাধীন দেশ উগান্ডা হবে ওদের দেশ, ২০০০ সাল নাগাদ। স্বাধীনতা দেয়া হবে ইহুদীদের। কিন্তু নোংরা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর কী। আজব রাজনীতির খেলা, তাদের গোপন নির্দেশে ইহুদীরা পৃথিবীর সব জায়গা থেকে দলে দলে ফিলিস্তিনে এসে জড়ো হতে শুরু করল।
আগে থেকে সামান্য কিছু ছিল, দিনে দিনে দল ভারী হতে লাগল ওদের। ইংল্যান্ড এবার করল চরম বিশ্বাসঘাতকতা। ৪৮ সালে ফিলিস্তিনের মাঝ বরাবর রেখা টেনে দিয়ে ঘোষণা করল একদিকে হবে ফিলিস্তিন, অন্যদিকে ইসরায়েল। ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হলো মধ্যগ্রাচ্যে, কিন্তু শক্তির দম্ভে মত্ত উকট্রনটম্যান আমল দিল না।
ইসরায়েলকে স্বাধীনতা দিল ওরা, ফিলিস্তিনকে দিল না। প্রায় আধ শতাব্দী হয়ে এল, কোন সমাধান হলো না সমস্যার। ইসরাইলী সৈন্যের মার খেয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়ায় ফিলিস্তিনীরা। স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধ করে ওরা, অথচ পশ্চিমারা তাকে বলে সন্ত্রাসী তৎপরতা। ও আরব সন্ত্রাসী। কী অদ্ভুত বিচার। আজ তাদেরই আদিভূমিতে ইসরায়েল তাদের সীমিত স্বায়ত্বশাসন দেয়।
দারভিশ হামাম জানে, ভেতরে ভেতরে কিছু একটা চলছে। খুব সম্ভব স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল নিয়েই স্বাধীন ফিলিস্তিন গঠন করতে যাচ্ছেন ইয়াসির আরাফাত। স্বাধীনতা, শব্দটা শুনলেই কেমন যেন লেগে ওঠে গায়ের মধ্যে। অদ্ভুত শিহরণ জাগে, ঠিক যেন…
লঘু পায়ের শব্দ শুনে ঘুরে তাকাল হামাম। জামাল শামলুকে দেখল তার দিকে এগিয়ে আসছে। পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চি দীর্ঘ ছেলেটা। হালকা-পাতলা, সুঠামদেহী। গভীর কালো চোখ। চোখের পাপড়ি মেয়েদের মত দীর্ঘ, ঢেউ হয়ে ওপরদিকে বেঁকে আছে। ক্লীন শেভড় মসৃণ ত্বকের নিচে দাড়ি-গোঁফের। নীলচে রেখা ফুটে আছে। সব মিলিয়ে চমৎকার দেখতে।
বোসো, কাছের চেয়ারটা দেখাল ওকে সার্জেন্ট।
ধন্যবাদ। বসল যুবক। আড়চোখে হামামের টাট্ট করা লেখাটা দেখল। ওটা…কোত্থেকে করিয়েছেন, সার্জেন্ট, জানতে পারি?
বৈরুত থেকে। কেন, তুমি করাতে চাও?
খানিক ইতস্তত করল যুবক। অপরাধ নেবেন না, ওখানে যা লেখা, ত৷ আপনি মেনে চলেন?
আপনমনে মাথা দোলাল সার্জেন্ট। যদ্দূর সম্ভব মেনে চলার চেষ্টা করি, বয়। খুব চেষ্টা করি। কিন্তু মৃদু শ্রাগ করল। নিতান্তই সাধারণ এক মানুষ। আমি সবসময় তাই পেরে ওঠা সম্ভব হয় না। তবে চেষ্টার ত্রুটি করি না আমি। সাধারণ মানুষের এরচেয়ে বেশি কিছু করার ক্ষমতা নেই।
নিজের দুহাতের কর্কশ তালু পরীক্ষা করল জামাল। মুখ না তুলে অনেকটা মন্তব্যের সুরে বলল, কাল আপনি ইচ্ছে করে আমাকে জিতিয়ে দিয়েছেন।
কি করে বুঝলে? ঘুরে তাকাল সে।
আমার মনে হয়েছে। সত্যি না?
একটু ইতস্তত করল, লোকটা। হা তোমার মনের জোর বাড়াবার জন্যে কাজটা করতে হয়েছে আমাকে। তুমি অযোগ্য বা আর কিছু বলে নয়। তাছাড়া কাল তুমি এমনিতেও অনেক ভাল করেছ। আমি যদি জিততাম কাল, খুব বেশি হলে আধ ইঞ্চির ব্যবধানে জিততাম। ওই আধ ইঞ্চির চাইতে তোমার নিজের আকাশছোঁয়া আস্থা অর্জন করার প্রয়োজন বড় ছিল, জামাল।
চেহারা কালো হয়ে গেল তার। তাই বলে…
কাম অন, বয়! এতে মন খারাপ করার মত কিছু নেই। অনেক সময় বাবা ছেলের জ্ঞানের বহরের কাছে হেরে আনন্দ পায়। অনেক শিক্ষকও একই মজা পায় শিষ্যের বিদ্যার কাছে হার স্বীকার করে। আমিও তেমনি পেয়েছি তোমার ব্যগ্রতার কাছে হেরে।
শ্রাগ করল সার্জেন্ট। মিথ্যে নয়, জামাল। কাল সত্যি আমার জিভ বের করে ছেড়েছ তুমি। অনেক কষ্ট হয়েছে তোমার নাগাল পেতে। ৩
সত্যি? সন্তুষ্টির, গর্বের নিষ্পাপ হাসি ফুটল যুবকের মুখে।
সত্যি। কাল অতুলনীয় পারফর্মেন্স দেখিয়েছ তুমি। আমি রেগুলার, স্পেশাল ফোর্স, তোমার বয়সের চেয়েও বোধহয় বেশি অভিজ্ঞতা আমার এ লাইনে। আর তোমার মাত্র তিন মাসের, সময়ের তুলনায় এ অনেক-অনেক বেশি।
আমার তো আজ এমনিতেই ছুটি, একটু পর বলল জামাল। তারপরও কেন ছুটির কথা বলা হলো?
ঠিক বলতে পারছি না। কেউ একজন আজ ক্যাম্পে আসবেন শুনেছি। গুরুত্বপূর্ণ কেউ। মনে হয়…থেমে গেল সার্জেন্ট।
কি?
মনে হয় কোন বিশেষ কাজ পড়েছে কোথাও। কোন মিশন…,
মিশন? উত্তেজিত হয়ে উঠল জামাল শামলু। রক্তে বান ডাকল। আমাকে মিশনে যেতে হবে?
গভীর দৃষ্টিতে ওকে দেখল হামাম। মাথা ঝাঁকাল। হয়তো।
কে আসছেন? রীতিমত কাঁপুনি উঠে গেল তার বুকে।
জানি না। এলে বোঝা যাবে। গম্ভীর হয়ে গেল হামাম। তবে খেয়াল রেখো, এ নিয়ে কারও সামনে কিছু বলবে না। একটা শব্দও না।
আচ্ছা।
আসরের আযান শুনে উঠল ওরা। নামাজ পড়ে এসে আবার বসল। পথের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে ব্যথা হয়ে গেল চোখ। বিরক্ত হয়ে উঠল দারভিশ হামাম। বুঝল, যে-জন্যেই হোক আজ আর আসছে না ক্যাম্প কমান্ড্যান্ট বা তার গুরুত্বপূর্ণ অতিথি। উঠে পড়তে যাচ্ছিল, এই সময় দূরে বালির মেঘ দেখতে পেল।
ঝড়ের বেগে পাঁচ মিনিটের মাথায় ক্যাম্পের উঁচু তারকাটার ফেন্সের গেটে পৌঁছে দাঁড়াল একটা সুজুকি জীপ। ভলান্টিয়ার গার্ড গেট খুলে দিতে ব্যারাকের সামনে এসে থামল ওটা। তিনজন নামল ভেতর থেকে, লেফটেন্যান্ট আতাসী, ওমর এবং অন্য আরেকজন। দীর্ঘদেহী।
তার ঠাণ্ডা চাউনি দেখেই হামাম বুঝে ফেলল লোকটা ভয়ঙ্কর। যার দেখার চোখ আছে…কমান্ড্যান্টের ডাকে চিন্তার সুতো ছিঁড়ে গেল তার।
সার্জেন্ট, ইনি হচ্ছেন আমাদের সেই মেহমান। মেজর মাসুদ রানা।
মেজর শুনেই শিরদাঁড়া সোজা হয়ে গিয়েছিল হামামের, খটাশ করে কড়া স্যালুট ঝেড়ে দিল। দেখাদেখি জামালও তাই করল। প্রতিউত্তর করল রানা, হাত বাড়াল হ্যান্ডশেকের জন্যে। এইখানটায় সামান্য হোঁচট খেলো হামাম। মানুষটা এত সুন্দর করে হাসে কি করে? চেহারায় খুনীর ছাপ, অথচ হাসিতে শিশুর সরলতা, তা হয় কিভাবে?
ভেতরে বসল ওরা। বিশাল আড়াইশো কেভিএ জেনারেটর চালিত ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা সফট ড্রিঙ্ক বের করে পরিবেশন করল সার্জেন্ট।
.
জেরুজালেম।
প্রধানমন্ত্রীর অফিসে সেদিনের মত গুরুত্বপূর্ণ, রুদ্ধদ্বার সভা চলছে। অভিন্ন সভাসদ। তবে সে রাতের উদ্দীপনা নেই মনে হলো মানুষগুলোর মধ্যে।
এই লোকের অ্যাকটিভিটিজ আমার সুবিধের মনে হচ্ছে না, বলে উঠল মোসাদ প্রধান ইয়েহুদা বেন মেইর। তার ব্যাপারে যে সব তথ্য গত দুদিনে পেয়েছি আমি, তা এক কথায় ডিসটার্কিং। ভেরি ডিসটারিং। যেনেক শেষ পর্যন্ত সফল হবে কি না, আমার সন্দেহ হচ্ছে।
আরে না! দৃঢ়স্বরে তার সন্দেহ প্রত্যাখ্যান করল যাহাল চীফ, ইয়াদ এলিয়াহুদ। ওর কর্মকাণ্ড ডিসটার্কিং, স্বীকার করি, কিন্তু তাই বলে ওরকম আশঙ্কা ভুলেও মনে ঠাই দেবেন না, মিস্টার মেইর। ইয়েহোনাথান যে কী চীজ, সে আমি জানি। ওরকম দশটা মাসুদ রানাকে…।
কিন্তু লোকটার ব্যাপারে আমার ডিপার্টমেন্টে যে সমস্ত রেকর্ড আছে, তা সত্যি বিস্ময়কর।
বিরক্ত ভঙ্গিতে মাথা দোলাল মেজর জেনারেল। জানি। কিন্তু অতীতে ওর প্যাঁচে পড়ে যেসব ক্ষেত্রে আমাদের হার মানতে হয়েছে, এবারের সাথে সেসবের অনেক তফাত আছে। অতীতে প্রতিবার আমাদের পিছু লাগার মত কিছু না কিছু সূত্র ছিল ওর হাতে, এবার নেই তা। সুতো ছাড়া দৌড়ঝাঁপ করে। কী-ই বা এমন করতে পারবে মাসুদ রানা? হানানের সাথে মীটিঙই সার, আর এগোবার পথ নেই।
ঝামেলা হলে ইমার্জেন্সি বীকন সিগন্যাল দেয়ার ব্যবস্থা ছিল বাংলার গৌরবের। সে খবর অবশ্য জানা ছিল না আমাদের। সে না হয় না-ই থাকল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওটা ঠেকিয়ে তো দিয়েছি আমরা! জাহাজ কোথায় সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই ওদের। আরেক ভয় ছিল কাপলওয়েট। ও আমাদের হয়ে কাজ করছে, সে খবর রানা যদি পেয়েও থাকে, সে আসলে যে কে কোনদিনও জানতে পারবে না। জানার একটা উপায় ওদের ছিল, তার সলিসিটরের মাধ্যমে। কিন্তু সে পথও আগেই মেরে রেখেছে কাপলওয়েট। হানান ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকেও সলিসিটরের দেখা পায়নি প্রথমে.। পরে যা-ও বা পেয়েছে, মক্কেলদের ভুয়া এক তালিকা দেখিয়ে তাকে বোকা বানিয়েছে সে।
আর কি বাকি থাকে তাহলে? সশরীরে হাজির হয়ে জাহাজ খুঁজে বের করার চেষ্টায় লাগা। তা করতে মাসুদ রানাকে ওমান যেতে হবে। সে পথও বন্ধ। ওমানী অ্যান্টি টেররিস্ট সংস্থার চীফ মেজর রোমান, থেমে একটু হাসল লোকটা। ওকে দেখতে পারে না। তাকে জানানো আছে, ও গেলে এয়ারপোর্ট থেকেই ফিরিয়ে দেয়া হবে। তাছাড়া আল-ফাতাহ জাহাজ খোঁজার যে পদক্ষেপ নিয়েছিল, তাও বানচাল করে দিয়েছে সে। সোজা হাঁকিয়ে দিয়েছে ওদের। ১ নড়ে বসল প্রধানমন্ত্রী। জানি। কিন্তু মাসুদ রানাকে দেখতে পারে না কেন?
ওদের মধ্যে পুরানো শত্রুতা আছে, মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার, মোসাদ চীফ বলল এবার।
কি নিয়ে সেটা?
৭৬ সালে ওমানের পাহাড়ী দফার উপজাতির সাথে সুলতানের বাহিনীর মধ্যে বড় ধরনের এক গৃহযুদ্ধ বেধেছিল, নড়েচড়ে বসে শুরু করল মোসাদ প্রধান। এখন ওদের যে সংস্কৃতি মন্ত্রী, শেখ জাফর, সে ছিল দফার ট্রাইব চীফ। এখনও তাই আছে সে। ব্রিটেন সুলতানের পক্ষ নেয় সেই যুদ্ধে, আর বহুদিনের বন্ধু বলে রানা নেয় জাফরের পক্ষ। তার যোদ্ধাদের গেরিলা ট্রেনিং দিত রানা, বলা যায় ওর জন্যেই জিতে যায় সেবার দফার বাহিনী। তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া মেনে নিতে বাধ্য করে সুলতানকে। না মেনে উপায় ছিল না সুলতানের, নইলে হয়তো গদিই হারাতে হত।
এখন ওদেশের অ্যান্টি টেররিস্ট সংস্থার চীফ, এক্স মেজর হ্যারি রোমান, সে তখন ছিল ব্রিটিশ এসবিএসে। সুলতানের বাহিনীকে পরিচালনা করত। হেরে যাওয়ার সেই কষ্ট এখনও ভুলতে পারেনি রোমান।
আই সী!
এখনকার পরিস্থিতি একেবারেই আলাদা, এলিয়াহুদ বলে চলল। চাকরি ছেড়ে ওমানের নাগরিকত্ব নিয়েছে সে, প্রভাব খাটিয়ে ওরকম ক্ষমতাশালী এক সংস্থার মাথা বনে গেছে। ইচ্ছে করলে যে কাউকে এয়ারপোর্ট থেকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারে সে। সুলতানের কাছে রিপোর্ট করে লাভ হবে না, লোকটা হ্যারি রোমানের কথার বাইরে যাবে না। কাজেই… শ্ৰগ করে থেমে গেল সে।
মৃদু হাসি দেখা দিল বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মুখে। তাহলে তো ভালই হলো দেখছি। এত সাহায্য যখন পাচ্ছি, তখন আর চিন্তা কিসের? যাহাল প্রধানের দিকে তাকাল। আমাদের মাদার শিপ জায়গামত পৌঁছুচ্ছে কবে নাগাদ?
আর তিন-চারদিনের মধ্যে, মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার। শিপিং লেন থেকে বহু ঘুরে যেতে হচ্ছে বলে সময় একটু বেশি লাগছে। আমার ধারণা ও নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।
কিন্তু…
কি? দ্বিধাগ্রস্ত মোসাদ চীফকে দেখল প্রধানমন্ত্রী
আমি ভাবছি মাসুদ রানা এ মুহূর্তে কোথায়। হঠাৎ করে লন্ডন থেকে উধাও হয়ে গেল কেন?
দেখুন গিয়ে কোন ক্লু না পেয়ে ফিরে গেছে হয়তো দেশে, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ফুটল এলিয়াহুদের চর্বি বোঝাই চেহারায়। আর যাবে কোথায়?
তাহলে আল-ফাতাহর ওরা ওখানে কি করছে শুধু শুধু? অনেকটা যেন নিজেকেই প্রশ্ন করল বেন মেইর।
মাতম করছে হয়তো, প্রধানমন্ত্রীর এক পরামর্শদাতা বলে উঠল। অথবা নতুন করে কোত্থেকে অস্ত্র কেনা যায় ভাবছে। পয়সাওয়ালা, দুম্বাখোর আরব গৌরী সেন বন্ধুর তো অভাব নেই আরাফাতের।
ভালই তো, ওরা কষ্ট করে অস্ত্র জোগাড় করবে, আমরা তা দিয়ে। আমাদের গুদাম ভরতে থাকব, ক্ষতি কি? ফেঁসে যাওয়ার ভয়ে ওরাও কাউকে কিছু বলতে পারবে না। আর আমরাও… থেমে শ্রাগ করল নেতানিয়াহু।
প্রধানমন্ত্রীর রসিকতায় ভুঁড়ি দুলিয়ে হেসে উঠল এলিয়াহুদ। দেখাদেখি অন্যরাও, বেন মেইর বাদে। কেন যেন হাসি এল না তার। ভাবছে কিছু একটা। বৈঠকে আসার আগে ভেবেছিল বাংলার গৌরবকে আর কোথাও সরিয়ে নেয়ার প্রস্তাব তুলবে, কিন্তু এলিয়াহুদ প্রথমেই যেভাবে হেসে উড়িয়ে দিল তার আশঙ্কা, তাতে মুখ খুলতে ভরসা হচ্ছে না।
তাছাড়া মনে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীও তার পয়েন্ট গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেননি। করলে নিশ্চয়ই এক-আধটা প্রশ্ন করতেন, কেন তার আশঙ্কা, জানতে চাইতেন।.তা যখন করেননি, তখন কথা না বাড়ানোই ভাল। তাছাড়া জাহাজ সরাতে গেলে বিপদ ঘটে যেতে পারে। খোঁজ নিয়ে হয়তো দেখা গেল বাংলাদেশী স্পাইটা সত্যিই দেশে ফিরে গেছে, অথচ এদিকে তার কথামত অনর্থক জাহাজ টানাটানি করতে গিয়ে কারও চোখে পড়ে গেছে ওটা, সব দোষ তখন তার ঘাড়েই চাপবে। কি দরকার শুধু শুধু ঝামেলা টেনে আনার?
বৈঠক শেষ হতে অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি নিয়ে উঠল ইয়াহুদ বেন। মেইর। গাড়িতে বসে মনে হলো কোথাও যেন কি এক ষড়যন্ত্র চলছে। খুব গভীর কোন ষড়যন্ত্র। সেটা কি, যদি জানা যেত!
.
করাচি। হোটেল হিলটন।
নিজের স্যুইটের ড্রইংরুমে বসে আছে মাসুদ রানা। জরুরী কিছু কেনাকাটার কাজে গত রাতে এখানে পৌঁছেছে। যা যা চাই, এখানেই সবচেয়ে সহজলভ্য সেসব। কাজ শেষ। অল্প সময়ের মধ্যে রওনা হয়ে যাবে ওমানের পথে। এ মুহর্তে চিন্তিত। মেজর হ্যারি রোমানের কথা ভাবছে।
লোকটা ওকে দুচোখে দেখতে পারে না, রানা খুব ভাল করেই জানে। অথচ এক সময় ঘনিষ্ঠ না হলেও দুজনের মোটামুটি একটা সম্পর্ক ছিল। কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ মিশনে তাকে নিয়ে কাজও করেছে রানা। কিন্তু ওমানের গৃহযুদ্ধে যেই সুলতান হেরে গেল, ব্যাপারটাকে ব্যক্তিগত, হার হিসেবে নিল লোকটা, খেপে গেল ওর ওপর। সেই ঘটনার পর বহুদিন ওর পিছনে লেগে ছিল ব্যাটা, নানাভাবে হেনস্তা করতে চেয়েছে। ফ্যাসাদে ফেলে ফাসাবার চেষ্টা করেছে, তাতে যদিও লাভ হয়নি। কিন্তু তবু পিছু ছাড়েনি রোমান। ,
এইবার একটা চমৎকার সুযোগ পাবে সে ওকে এক হাত নেয়ার। ওকে মাসকাটে দেখলে ব্যাটা কিভাবে রিঅ্যাক্ট করবে? ভাবতে গিয়ে হাসি পেল রানার। নিশ্চয়ই রাগের চোটে…
জানালার পর্দা সরিয়ে আনমনে নিচের ব্যস্ততা দেখল ও কিছুক্ষণ। বেশ কিছুদিন পর আসা, তাই সব নতুন নতুন লাগছে। আগের থেকে আরও সুন্দর হয়েছে করাচি, মানুষও বেড়েছে প্রচুর। সবাই মহাব্যস্ত। কার, জীপ, বাস মিনিবাস, ট্যাক্সি-বেবিট্যাক্সি মোটর সাইকেলে গিজগিজ করছে চওড়া রাজপথ। শেষেরটার মধ্যে ভেসপা প্রচুর। আর আছে ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ায় টানা টাঙা। সংখ্যায় কম অবশ্য। রাজপথে টু-ঠুক খুরের আওয়াজ তুলে দুলকি চালে ছুটছে ঘোড়া। মুখ তুলে দূরে তাকাল রানা, ক্লিফটন বীচের ওপাশের। সাগরের দিকে। ধোঁয়া ধোয়া দৃশ্য, প্রকাণ্ড এক গ্লাস শীটের মত বিছিয়ে আছে আরব সাগর। নিস্তরঙ্গ, নিথর। দশটায় নিচের লবিতে নেমে এল ও, ফোন করতে হবে পুরানো এক বন্ধু, শেখ আজিজ বিন সাউদ বিন নাসির আল জাফরকে। ওমানের সংস্কৃতি মন্ত্রী ভদ্রলোক। হোটেল থেকেও করা যেত ফোন, কিন্তু কাউকে ওদের ফোনালাপ ট্যাপ করতে দিতে রাজি নয় রানা।
পিছনে ফেউ আছে বলে মনে হয় না। লাগতে যাতে না পারে, সে জন্যে লন্ডন ছাড়ার সময় হাজার গুণ সতর্ক ছিল ও। তবু, সাবধানের মার নেই। রিসেপশন ডেস্ক থেকে একগাদা ফোন কার্ড কিনে লবির শেষ মাথার এক বক্সে এসে ঢুকল রানা। লাইন পেতে কোন সমস্যা হলো না, হলো মন্ত্রীকে পেতে। একের পর এক ওমানী অফিসারের ডেস্কে ঘুরে বেড়াতে লাগল কানেকশন, সবাই জানতে চায় মন্ত্রীকে ওর কি দরকার। জবাবে সন্তুষ্ট হতে না পেরে কেউ বলল মন্ত্রী ব্যস্ত, এখন লাইন দেয়া সম্ভব নয়, কেউ বলল কনফারেন্সে আছেন, অথবা ছুটিতে। মহাবিরক্ত হয়ে উঠল রানা।
এমন সময় খুব সম্ভব দুর্ঘটনাবশতই স্বয়ং শেখ জাফর ফোন তুললেন হঠাৎ করে। অনেকদিন পর তার পরিচিত গলা শুনতে পেয়ে নীরবে হাসল ও।
ইওর এক্সেলেন্সি?
হোয়াট, শুনতে পাচ্ছি না!
চেঁচাল ও। ইওর এক্সেলেন্সি! আমি মাসুদ রানা!
আজিজ জাফর হিয়ার। ডু স্পীক আপ!
মাসুদ রানা বলছি আমি।
হোয়া…কে! বৃদ্ধের ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া চেহারা, বিস্ময়, দিব্যচোখে দেখতে পেল ও। কি বললেন? মাসুদ রানা!
ইয়েস, ইওর এক্সেলেন্সি।
কী আশ্চর্য! গলা খাদে নেমে গেল মন্ত্রীর। কী আশ্চর্য! বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। কোত্থেকে, মাই বয়?
আগে কাজের কথা বলে নিই, ইওর এক্সেলেন্সি। তারপর…
হ্যাঁ হ্যাঁ, শিওর!
প্রায় দশ মিনিট ধরে একনাগাড়ে বলে গেল ও, শুনতে শুনতে অন্য প্রান্তে চোখ কপালে উঠল ট্রাইব চীফের। একটাই প্রশ্ন করলেন, এতসব কিসের জন্যে, রানা?
ওরা গিয়ে কিছু কিছু বলবে আপনাকে, ইওর এক্সেলেন্সি। বাকিটা আমি এসে বলব।
ওকে, রানা, একটু চিন্তা করে বললেন তিনি। এনওসি কোন সমস্যা হবে না। ওরা কোন ফ্লাইটে আসছে বলো, কাগজপত্রসহ আমার ড্রাইভার এয়ারপোর্টে থাকরে। তোমারগুলোও জায়গামত থাকবে। ইন্সপেক্টর কারেমির, কাছে। আমার ট্রাইবের মানুষ।
অনেক ধন্যবাদ, ইওর এক্সেলেন্সি।
মন্ত্রীর সাথে কথা সেরে আরও দুই পুরানো বন্ধুকে ফোন করল রানা। একটা ওদেশের রয়্যাল এয়ার ফোর্স ব্যারাকে, অন্যটা মাসকাটের সমুদ্র বন্দর। মিনা কাবুজে। আরও একটা ফোন করল রানা ঢাকায়।
.
দুপুরের একটু আগে বন্দরে এল ও। অঘাটে ছেড়ে যাওয়ার জন্যে তৈরি এক স্পীড বোটে উঠে পড়ল। তীর থেকে বিশমাইল দূরে অপেক্ষমাণ মোটামুটি বড় এক ট্রলারে ওকে পৌঁছে দিল সেটা। নাগমা ওটার নাম। লে, আতাসী হাত ধরে টেনে তুলল। সব ওকে, বস?
ওকে, বলল রানা। এদিকের?
হেসে বুড়ো আঙুল দেখাল বেদুইন! ওরা রওনা হয়ে গেছে?
এতক্ষণে অর্ধেক পথ পেরিয়েও গেছে, ঘড়ি দেখে বলল ও।
হুঙ্কার ছেড়ে স্টাট নিল ট্রলারের শক্তিধর টুইন ইয়ানমার মেরিন ডিজেল এঞ্জিন, বো উট করে তুমুল গতিতে আরও গভীরের দিকে চলল। জায়গামত পৌঁছে পুব-দক্ষিণ দিকে মুখ করে লম্বা দৌড় লাগাল নাগমা।
.
০৬.
সময় হয়েছে, ভাবছে ফার্স্ট অফিসার ফখরুল হাসান। আজই পালাতে হবে। তাকে যেভাবে তোক।
বাংলার গৌরবের অন্ধকার স্টোররুমে বসে আছে সে। ইমার্জেন্সি সার্চিং বীকন সিগন্যাল পাঠাবার ব্যর্থ চেষ্টার পর তাকে এখানে আটকে রেখেছে ইসরাইলী কমান্ডোরা। আর কোন ঝুঁকি নেয়ার ইচ্ছে নেই ওদের।
ভেতরে বাইরের আলো আসার একমাত্র পথ বাল্কহেড়ের গায়ের ছোট্ট, আড়াআড়ি এক স্কাটুল বা পোর্টহোল। বেশ ওপরে। ওটার দিকে তাকাল হাসান। মাথার ওপরের ডেক প্লেটে ভারী একজোড়া বুটের আওয়াজ উঠল। গার্ড। গত কদিনের রুটিন যদি না বদলে থাকে, তাহলে দুঘণ্টা পর আবার শোনা যাবে শব্দটা। এদিকটায় নজর বোলাতে আসবে ওদের কেউ একজন।
হাসানকে যে কুঠুরিতে বন্দী করে রাখা হয়েছে, সেটা আফটার সুপারস্ট্রাকচারের ভিতের কাছে। সিঁড়ির নিচে। ভেতরটা ফাঁকা, তাকে ঢোকানোর আগে সব বের করে ফেলা হয়েছে। বিশেষ করে তার পালানোর ব্যাপারে সাহায্যে লাগে, এমন ছোটখাট কিছুই নেই। কয়েক ভাজ করা পুরু ক্যানভাসের বিছানায় ঘুমায় হাসান। দুটো জং ধরা বড় পেইন্টের টিনের ওপর। একটা প্ল্যাঙ্ক বিছানো ডাইনিঙ টেবিলে খায়। দিনে দুবার খেতে দেয়া হয়। সকালে ও রাতে।
সকালে টোস্ট বা সিয়েরিয়েলের সাথে কফি, রাতে সাধারণ ডিশ। তাও বেশি নয়, বরং প্রয়োজনের তুলনায় অল্প। তাতে শাপে বর হয়েছে ফখরুল হাসানের। খুব দ্রুত ওজন হারিয়েছে সে, বেশ শুকিয়ে গেছে দেহ। চারদিন আগে ব্যাপারটা খেয়াল হতেই পালাবার উদগ্র ইচ্ছে পেয়ে বসেছে তাকে। অপর্যাপ্ত খাবার থেকেও বেশ কিছু করে বাঁচিয়েছে সে পরের কদিন, খায়নি। বিশেষ করে মাছ বা পোলট্রি খেয়েছে একেবারেই অল্প। যা একটু খেয়েছে ভেজিটেবল।
উচ্ছিষ্ট ফিরিয়ে দেয়নি সে গার্ড কিছু সন্দেহ করে বসতে পারে ভেবে। সাগরেও ফেলেনি, তাহলে ওসবের লোভে ইনলেটে মাছের আনাগোনা বাড়বে, তার পিছনে আসবে হাঙর। তাই বিছানার তুলায় গুঁজে রেখেছে হাসান। অসহ্য গরমে পচে গলে বিচ্ছিরি দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে ওসব, মাছির ভ্যানভ্যানানি অসহ্য হয়ে উঠেছে। একটা সেকেন্ড সুস্থির হয়ে বসে থাকার উপায় নেই।
চোখ নামিয়ে পাজর বের হওয়া হাডিউসার দেহের দিকে তাকাল সে। নেভিতে থাকার সময়কার অভ্যেস আজও আছে তার। নিয়মিত ব্যায়াম করে। সে জন্যেই ভুড়ি গজাবার সুযোগ পায়নি। ও জিনিস থাকলে মহাসমস্যা হয়ে যেত। অনেক শুকিয়েছে সে, ভাবল সন্তুষ্ট হয়ে। আশা করা যায় স্কাট বড় রকমের কোন সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে না।
উঠে পড়ল ফার্স্ট অফিসার। পরনে শুধু জাঙিয়া, আর সব মেঝেতে শুপ হয়ে পড়ে আছে। ওগুলোর প্রয়োজন নেই আপাতত, থাকুক পড়ে। রঙের টিন একটার ওপর আরেকটা রেখে দাঁড়াবার জায়গা করল সে পোর্টহোলের সরাসরি নিচে। ওর ওপর উঠলে জাহাজের খোল মজবুত রাখার আড়াআড়ি যে সব লোহার স্পার আছে, তার একটায় পা কোনমতে রেখে উঁচু হওয়া যায়, নাগলি পাওয়া যায় পোটহোলের। ওটার গ্লাস প্রোটেকশনের অবস্থা যাচ্ছেতাই। এত পুরু হয়ে ময়লা জমে আছে কাঁচে যে বাইরে কিছু দেখার উপায়ই নেই। অ্যালুমিনিয়াম রিম জং পড়ে বরবাদ। তৈরির পর ওটা কোনদিন খোলা হয়েছে বলে মনে হয় না।
এখনও হত না যদি কমান্ডোরা তাকে এখানে আটকে না রাখত। পুরো একটা দিন পরিশ্রম করতে হয়েছে ওটা খুলতে। ডাইনিং টেবিল হিসেবে। ব্যবহৃত তার প্রান্ত দিয়ে সাবধানে পিটিয়ে পিটিয়ে জং ধরা স্ক ভেঙে ফেলেছে হাসান। রিমটাও গেছে। তবে রক্ষা যে খসে পড়েনি সবসুদ্ধ, এখনও লটকে আছে কোনমতে!
স্পারে পায়ের আঙুলের ভর রেখে দাঁড়াল সে, আস্তে আস্তে টেনে খুলে ফেলল গ্লাস প্রোটেকশন, ঠেলে দেয়ালের সাথে ঠেকিয়ে পথ পরিষ্কার করল। সাবধানে ছোট্ট ফোকর দিয়ে মাথা গলিয়ে দিল। বাইরের আলো ফুরিয়ে গেছে, জেঁকে বসতে শুরু করেছে আঁধার। কাজেই ভয়ের কিছু নেই। বাঁয়ে তাকাল সে, স্টার্নের দিকে। তারপর ডানে, কার্গো ডেকের ওমাথার বো-র দিকে।
ওখানে কোথাও সেন্ট্রি পোস্ট আছে, জানে সে। কিন্তু অন্ধকারে দেখতে পেল না কোথায়। অ্যাকুয়ামেরিন রঙ ধরেছে সাঁঝের আকাশ, কিছু কিছু তারা উঠেছে, মিট মিট করছে। ভীষণরকম স্থির বাতাস, পরিবেশ নিস্তব্ধ। অনেক নিচ থেকে খোলের গায়ে পানির মৃদু চাপড়ের দূরাগত আওয়াজ কানে আসছে শুধু।
জাহাজটাকে সবার চোখের আড়াল করার জন্যে কমান্ডোরা যে সব পদক্ষেপ নিয়েছে, এ কদিন বাথরূমে আসা-যাওয়ার পথে তার সবই দেখেছে হাসান। চারদিকে বেশ কয়েকটা কর্ক বয়া ভাসিয়েছে ওরা, তার সাথে ঝুলিয়েছে প্রায় অদৃশ্য মনোফিলামেন্ট নেট। এত সূক্ষ্ম যে রাতে দেখাই যায় না। ওই দিয়ে জাহাজ ঘিরে রাখা হয়েছে যাতে কোন অবাঞ্ছিত ডুবুরী এলে আটকা পড়ে, কর্কের ফাস্নার মত দুলুনি দেখে টের পায় গার্ডরা। নিজেদের ফ্রগম্যান আছে, তেমন কিছু দেখলে সঙ্গে সঙ্গে পানিতে নেমে পড়বে তারা।
প্রায় পুরো জাহাজ ঢেকে ফেলা হয়েছে ক্যামোফ্লেজ ড্রেপ দিয়ে, তার আড়ালে সারফেস হামলাকারী ঠেকাতে বসানো হয়েছে কয়েকটা মেশিনগান পোস্ট। এছাড়াও দুটো ইনফ্লেটেবল তো রয়েইছে প্রয়োজনে শত্রুকে তাড়া করার জন্যে। অবশ্য পানির তলার শত্রু ঠেকাতে কোন বেগ পেতে হবে না। এদের। ব্যাপার টের পাওয়া গেলেই হলো, দুচারটে হ্যান্ড গ্রেনেড পানিতে ফাটিয়ে দিলেই কাজ শেষ। মরা মাছ খেতে মুহর্তে গণ্ডা গণ্ডা হাঙর হাজির হবে। ইনলেটে। ওরাই ব্যবস্থা করবে তাদের। এতসব বাধা ডিঙিয়ে পালানো কঠিন, সন্দেহ নেই। প্রায় অসম্ভব। তবু যে করেই হোক, অসম্ভবকে সম্ভব করতেই হবে আজ তাকে।
নেমে এল ফখরুল হাসান। শোর্টহোলটা বেশ ছোট, মাথা ঢোকানোর পর খুব সামান্য জায়গাই থাকে। ওখান দিয়ে বের হওয়া কঠিন হবে খুব। কাজেই অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। রূমের এক কোণে রাখা একটা জং ধরা অ্যাঙ্কর গ্রীজের টিন খুলল সে, সারা গায়ে ইচ্ছেমত মেখে নিল দুর্গন্ধযুক্ত, চটচটে জিনিসটা। নিজেকে এখন কেমন দেখাচ্ছে ভেবে হাসি পেল। এখন যদি মিমি ওকে দেখত, নিশ্চয়ই হেসে খুন হয়ে যেত।
না বোধহয়, পরমুহূর্তে গম্ভীর হয়ে ভাবল, হাসার প্রশ্নই আসত না ওর। বরং যে ভয়ঙ্কর কাণ্ড করতে যাচ্ছে হাসান, তার কথা ভেবে ভয়ে, আতঙ্কে…। ভাবনা থামিয়ে ঘুরে দাঁড়াল সে। মাথা গলিয়ে দিল ফাঁক দিয়ে। বাইরে গাঢ় অন্ধকার। কিছু দেখা যায় না। তাপমাত্রা কিছু কমেছে, তবে হাসান তা টের পাচ্ছে না গ্রীজের প্রলেপের জন্যে। বরং ঘামছে সে, ঘামের সাথে গলে গলে। পড়ছে জিনিসটা।
বাইরের খোলা বাতাসে কয়েকবার গভীর করে দম নিল হাসান, রিমের কঠিন চাপ অগ্রাহ্য করে অনেক কষ্টে, অনেক সংগ্রাম করে মাথার পাশ দিয়ে একটা হাত বের করে দিল। কিন্তু আর চুল পরিমাণও এগোচ্ছে না শরীর, রিমের ফাঁদে এমনভাবে ফেঁসে গেছে হাসান যে দম নিতেও কষ্ট হচ্ছে। আতঙ্কিত হয়ে পড়ল সে, চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল।
মরিয়া হয়ে মোড়ামুড়ি শুরু করল জালের ফাসে আটকে পড়া মাছের মত। কিন্তু কাজ হচ্ছে না, বরং আরও দৃঢ় হয়ে এটে বসছে রিম। দম নেয়ার জন্যে একটু থামল সে, তারপর আবার লেগে পড়ল মরণপণ সংগ্রামে। অসহ্য চাপে চোখে আঁধার দেখছে! যে অবস্থা, এখন আর পিছিয়ে যাওয়ারও উপায়। নেই। মহাআতঙ্কে প্রায় দিশেহারা হয়ে পড়ল সে। অন্য হাতটা এরই মধ্যে কখন, কি করে যে বের করল, নিজেও টের পেল না।
ঠিক তখনই লকারের বন্ধ দরজার ওপাশে ভারী একজোড়া বুটের শব্দ শুনে জমে পাথর হয়ে গেল সে। বুকের খাঁচায় পাগলা ঘোড়ার মত উনাত্ত লাফঝাঁপ শুরু করে দিল হৃৎপিণ্ড। মুখ-গলা শুকিয়ে খসখসে হয়ে উঠল। সর্বনাশ! হঠাৎ চক্করের সময় বদলাল কেন আজ হারামজাদা? এই অবস্থায় যদি দরজা খুলে উঁকি দেয় ভাবনাটা মাথায় আসতেই স্রেফ উন্মাদ হয়ে উঠল ফখরুল হাসান, অসুরের শক্তি ভর করল তার ওপর। জাহাজের খোলে দুহাতের চাপ দিয়ে মহা বিক্রমে নিজেকে ঠেলতে শুরু করল। প্রথম কয়েক মুহূর্ত কিছুই ঘটল না। থমকে থাকল যেন মহাকালের ঘড়ি। ইনলেট, জাহাজ, বুটের শব্দ, সব অর্থহীন মনে হলো। তারপর, আচমকা দুইঞ্চিমত এগোল দেহটা।
রিমের সাথে ঠিকমত সংযোগ ঘটেছে গ্রীজের। নতুন উদ্যমে নিজেকে ফের ঠেলে দিল সে, আরেকটু এগোল। তারপর আরেকটু।
ওপরে বুটের শব্দ সরে যাচ্ছে টের পেয়ে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল যেন। চোখ বুজে কয়েক মুহূর্ত স্থির থাকল হাসান, সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাল হাজারবার। কোমর বের করতে সামান্য কষ্ট হলো, তারপর, চোখের পলকে বেরিয়ে এল পুরো দেহ। রিম ধরে কিছুক্ষণ ঝুলে থাকল, নজর সরাসরি নিচের আউটার কম্প্যানিয়নওয়ের ওপর। কোন নড়াচড়া নেই ওখানে।
নিশ্চিত হয়ে ঝুপ করে লাফিয়ে পড়ল হাসান, পা খালি বলে কোন শব্দ হলো না। ঘাপটি মেরে বসে থাকল অন্ধকারে। চোখ কুঁচকে আঁধার ফুড়ে দেখার চেষ্টা করছে। ইনলেটের পানি কুচকুচে কালো, মাঝেমধ্যে এক আধটা বুদ্বুদ উঠছে। ছোট ছোট ঢেউ আছড়ে পড়ছে মনোফিলামেন্ট নেট ধরে থাকা। কর্ক বয়ার ওপর। তারার আলো সামান্য বেড়েছে এরমধ্যে, আকাশের পটভুতিতে চারদিকের ক্লিফের আকৃতি মোটামুটি দেখা যাচ্ছে। বেশ কদিন পর নগ্ন শরীরে খোলা বাতাসের ছোঁয়া পেয়ে মন খুশি হয়ে উঠল হাসানের। হোক না তপ্ত বাতাস।
ব্রিজের কাছ থেকে যথাসম্ভব সরে এসে বো-র দিকে এগোল সে পা টিপে। দেহের ওপরের অংশ ঝুঁকে আছে। অন্ধকারে তার ফরসা চামড়া কারও চোখে যাতে না পড়ে, সে ব্যাপারে পুরো সচেতন। ক্যামোফ্লেজ ড্রেপের মধ্যে দিয়ে চলা খুব কঠিন হলেও থামল না। বেড়ালের মত নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে চলল।
আরেকটু হলে সর্বনাশ ঘটেই যাচ্ছিল, একদম যমের মুখে গিয়ে পড়তে যাচ্ছিল হাসান। বেঁচে গেল স্রেফ ভাগ্যের জোরে। কার্গো ডেকের কোথাও থেকে কেউ কেশে উঠতে চট করে থেমে দাঁড়াল। চাপা কাশি। বড়জোর দশ হাত সামনে আছে মানুষটা। গার্ড! দেহের সমস্ত রক্ত কয়েক মুহূর্ত জমে থাকল। তার, কাশি না দিলে সোজা লোকটার ঘাড়ের ওপর গিয়েই পড়ত নিঃসন্দেহে।
কুকড়ে আরও ছোট হয়ে গেল সে, পিছিয়ে এল। বুকের ধড়ফড়ানি কমে। আসতে ফের এগোল। কার্গো হোল্ডের ওপর দিয়ে চলে যাওয়া স্টালের ক্যাটওয়াক ধরে সরে এল জাহাজের আরেক মাথায়। প্রচুর সময় নষ্ট হলো। তারপর আবার ইঞ্চি ইঞ্চি করে সামনে যাওয়া।
একবার পৌঁছতে পারলে হয় ওখানে। জায়গায় ধরে রাখার জন্যে বয়া যে দড়ি দিয়ে বাঁধা, ওটা ধরে ঝুলে সোজা মনোফিলামেন্ট নেটের ওপাশে গিয়ে। ইনলেটে নামবে, তারপর ডুব সাঁতার দিয়ে উল্টোদিকের তীরে উঠবে হাসান। অন্তত চার মাইল পথ, কম নয়। তবে সাতারে সে ভাল, অনেক পুরস্কার পেয়েছে সার্ভিসে, কাজেই ওটা তেমন সমস্যা হবে না।
ভোর হওয়ার আগেই ওপারে পৌঁছে যেতে পারবে সে, ভাল একটা জায়গা দেখে আত্মগোপন করবে। তারপর, কাল রাতে কাছের কোন জেলে পল্লীতে গিয়ে ওঠার চেষ্টা করবে সাঁতার কেটে। খাবার, পানি, পরিধেয়, জুতো, কিছুই নেই। ওসব ছাড়া পাথুরে জেবেলে একটা দিন কাটানো যে কতবড় অসম্ভব এক কাজ, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামাচ্ছে না হাসান। জানে, এতসব সমস্যা নিয়ে একসাথে ভাবতে বসলে সব এলোমেলো হয়ে যাবে। পিছিয়ে পড়বে সে। তারচেয়ে যখন যে সমস্যা আসবে, তখন তাই নিয়ে মাথা ঘামাবে।
আরেকটু গেলেই বো। অ্যাঙ্কর উইঞ্চ আর দড়িদড়ার স্তূপ টপকে এগোল সে। জায়গাটা খোলামেলা, তারওপর ব্রিজ থেকে দেখা যায়। কেউ যদি ওখানে থেকে থাকে, যদি একবার এদিকে তাকায়, ধরা পড়ে যাবে। তারার আলোয় পরিষ্কার দেখে ফেলবে খালি চোখেই। নাইট ভিউইং ডিভাইসের প্রয়োজন হবে না। তবে এ পরিস্থিতিতে দ্রুত নড়াচড়া করলে চোখে পড়ার চান্স যত বেশি, আস্তে করলে ততই কম। সেই ভরসায় বুক বেধে আছে হাসান।
পিঁপড়ের গতিতে অ্যাঙ্কর উইঞ্চ হাউজিঙের দিকে এগোল। সামান্য পথ, তাই অতিক্রম করতে ঝাড়া পাঁচটা মিনিট লাগল। স্টীল শেলে হেলান দিয়ে। বসে বুক ভরে বাতাস টানল সে, স্বস্তির ঝিরঝিরে ধারা বইছে দেহমনে। হয়ে গেছে, আর সামান্যই বাকি। তারপর…
জমে গেল সে খুব কাছেই কাপড়ের খসখস আওয়াজ উঠতে। উইঞ্চ হাউজিঙের ঠিক ওপাশে নড়ছে কেউ। মুহূর্তে ঘাম ছুটে গেল। নিশ্চই। বেখেয়ালে কোন শব্দ করে ফেলেছিল, অথবা জোরে নিঃশ্বাস ফেলেছিল, সেই শব্দে তন্দ্রা কেটে গেছে কাছের সেন্ট্রির। দ্রুত ভাবছে কি করবে, আবার নড়ে উঠল সেন্ট্রি। কাশল খুক করে, হাই তুলল।
একটা কাঠামো দেখল হাসান খুব কাছেই, উঠে দাঁড়াচ্ছে। একবার এদিকে তাকালেই শেষ। কিন্তু এ পর্যায়ে তা সে হতে দিতে পারে না। ব্যাটা যেই হোক, তাকে সতর্ক হওয়ার সময় দেয়া যাবে না। বিদ্যুৎগতিতে উঠে দাঁড়াল ফখরুল হাসান। চোখের কোণ দিয়ে ওকে দেখে সেন্ট্রিও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল, আঁতকে উঠল অস্ফুটে। ছয় হাত ব্যবধানে দাঁড়িয়ে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকল ওরা। গার্ডের এম-১৬ কাঁধে ঝুলছে। চোখের ঘুম ঘুম ভাব পুরো কাটেনি।
হাসান সজাগ, সতর্ক, প্রস্তুত। সেই রিঅ্যাক্ট করল আগে, জোর পাবে বলে হাউজিঙে এক পা বাধিয়ে ঝাঁপ দিল লোকটার বুক সই করে। কাঁধ দিয়ে রকেটের গতিতে পড়ল বুকের ওপর। ব্যস্ত হয়ে কারবাইন তুলতে যাচ্ছিল কমান্ডো, ঘ্যাক! করে উঠল, হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল হাত-পা ছড়িয়ে। হাসান পড়ল তার ওপর। ডেক প্লেটে জোর আওয়াজ হলো দুজনের আছড়ে পড়ায়, কারবাইন হাতছাড়া হয়ে গেল সেন্ট্রির। ওটাও কম শব্দ করল না।
কোনদিকে খেয়াল নেই ফার্স্ট অফিসারের, চিৎ হয়ে পড়া শত্রুর বুকে চেপে বসে দুহাতে সাড়াশির মত গলা চেপে ধরেছে তার। দুই বুড়ো আঙুল গেঁথে বসে যাচ্ছে লোকটার ভয়েস পাইপের ওপর। চাঁচাবার চেষ্টা করল। কমান্ডো, চাপা গোঙানি বের হলো কেবল। গলায় চাপ আরেকটু বাড়তে উন্মত্তের মত হাটু ছুড়ল সে হাসানের কুঁচকি সই করে। কাজ হলো, মুহূর্তের জন্যে একটু আলগা হলো সাড়াশি, এই সুযোগে দ্রুত নিজের আর শক্রর মাঝে দুই হাত ভরে দিল সে চট করে। গলা ছাড়াবার জন্যে মরিয়া লাফ ঝাঁপ শুরু করল। মেঝেতে বুট ঠুকছে। গলা ছেড়ে দিল হাসান বাধ্য হয়ে। শব্দ থামাতে হবে এখনই।
ধীরেসুস্থে হাতের কিনারা সই করল সে। ধাই করে সর্বশক্তিতে মারল। একই জায়গায়-গলায়। উইন্ডপাইপ চুরমার করে দিল আঘাতটা মুহূর্তে নিভে। গেল কমান্ডোর প্রাণপ্রদীপ। মাথা দড়াম করে বাড়ি খেলো ডেকে। দ্রুত তার বুক থেকে নেমে পড়ল হাসান, হাপাচ্ছে। কিন্তু বিশ্রামের সময় নেই, যে কোন সময় নতুন বিপদ এসে হাজির হবে। পানিতে কারবাইন কোন কাজে আসবে না বলে ওটার দিকে তাকাল না, বড় কমান্ডো ছুরিটা টান মেরে খুলে নিল লোকটার বেল্ট থেকে।
পিছনে কেউ কাউকে ডাকল চাপা গলায়। থেমে গেল হাসান, কমান্ডোর কালো পোশাক, বুট, খুলে নিয়ে যাবে ভেবেছিল, হলো না। দাঁতে ছুরি কামড়ে ধরে উবু হয়ে ছুটল রেলিঙের দিকে। আবার এল ডাক, কিছুটা উদ্বেগ প্রকাশ পেল তাতে। সে তখন পৌঁছে গেছে জায়গামত, বয়ার পাকানো রশি দুই হাতে আঁকড়ে ধরে ঝুলে পড়েছে, পুতুলের মত দোল খেতে খেতে ছুটে যাচ্ছে। হাতের চামড়া রেখে আসছে কর্কশ লাইনে, খেয়ালই নেই সেদিকে।
ওপর থেকে একটা বিস্ময় ধ্বনি ভেসে এল। পরক্ষণে একটা হক এবং ধুপ-ধাপ দৌডের শব্দ উঠল। লাশটা চোখে পড়েছে। আরও ঢিল দিল হাসান, নিচের কালিগোলা পানির ধেয়ে আসার গতি বেড়ে গেল। ওদিকে হাতের জ্বলুনি অসহ্য হয়ে উঠছে ক্রমেই। দেখতে দেখতে বয়ার ওপর পৌঁছে গেল। সে। জানে সারফেসের কয়েক ফুট নিচে আছে নেট, কাজেই নিশ্চিন্তে দড়ি ছেড়ে ভেসে পড়ল। নিজেকে ভাসিয়ে রেখে কয়েক ফুট এগোল, তারপর ডুব দিল। টের পেল, ওপরে কয়েকটা আলো জ্বলে উঠেছে।
বেশ কিছুটা দূরে সরে গেল হাসান, তারপর মাথা তুলল আস্তে করে। ঘুরে তাকাল। ডেকে অনেকগুলো ফ্ল্যাশ লাইটের লাফালাফি দেখা গেল, চিৎকার, অর্ডার আর কয়েক জোড়া পায়ের ছোটাছুটি আছে তার সাথে। পানিতে আলো ফেলে ব্যস্ত হয়ে ওকে খুজল কিছুক্ষণ কমান্ডোরা। তারপর হঠাৎ সব আলো নিভে গেল, নীরব হয়ে পড়ল বাংলার গৌরব।
এবার কি ঘটবে জানা আছে হাসানের, তাই সময় নষ্ট না করে যথাসম্ভব নিঃশব্দে সরে যেতে থাকল। যত দূরে সরে যাওয়া যায়, ততই ভাল। বিপদ দেখলে ডুব সাঁতার দিয়ে এগোবে। গত বছরও একনাগাড়ে তিন মিনিট পানির নিচে থাকতে পারত হাসান। অতটা হয়তো সম্ভব হবে না আজ, প্র্যাকটিস নেই, তবে দুমিনিট নিশ্চই পারবে। সে ক্ষেত্রে দুটো ইনফ্লেটেবলকে ফাঁকি দেয়া খুব একটা কঠিন কাজ হবে না,
জাহাজ থেকে বড়জোর একশো মিটার সরে গেছে সে, এমনসময় কানে এল দুটো আউটবোর্ড এঞ্জিনের গুঞ্জন। একটুপর আরও দুটো। ইয়া আল্লা! কতগুলো নিয়ে এসেছে ওরা? দুটো না ছিল?
চেঁচিয়ে কিছু অর্ডার করল কেউ, এবং একযোগে রাতকে দিন করে জ্বলে উঠল চারটে হেভি-ডিউটি নাইটসান সার্চলাইট। একটার আলো সরাসরি চোখে এসে পড়তে অন্ধ হয়ে গেল হাসান। আঁতকে উঠে ডুব দিল। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে এক সেকেন্ড, দেখে ফেলেছে কমান্ডোরা। নাইটসান যখন জ্বালানো হয়েছে, আর রেহাই নেই। বুঝে ফেলেছে হাসান। ওরা মরিয়া দূর থেকে কেউ আলো দেখে ফেলতে পারে জেনেও আমল দিচ্ছে না।
ব্যাপারটা ঘটল একটু পর। শক ওয়েভ এবং স্থানচ্যুত পানির ধাক্কায় চর্কির মত কয়েকটা পাক খেলো হাসান, প্রচণ্ড চাপে কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার। অবস্থা। ব্যথায় কাৎরে উঠল সে, একগাদা বুদ্বুদ বেরিয়ে গেল মুখ দিয়ে। গ্রেনেড় ফেলছে ওরা। পরক্ষণে আবার একই কাণ্ড, তারপর আবার। নাইটসান ফ্লাডলাইট তার মাথার ওপর ফসফরেসেন্ট সিলিং তৈরি করেছে, নিচে প্রচুর আলো। হাসানের চারদিকে অজস্র রঙচঙে মাছ-কোনটা মৃত, কোনটা মরতে যাচ্ছে।
ভেসে উঠতে বাধ্য হলো ফখরুল হাসান। দম নিয়ে আবার ডুব দিতে যাবে, এমন সময় পিছন থেকে প্রায় ঘাড়ের ওপর এসে পড়ল একটা বোট। চেঁচিয়ে উঠল কেউ, সঙ্গে সঙ্গে ডুব দিল সে। কিন্তু পালাবার কোন উপায় দেখল না। দিনের মত আলো হয়ে উঠেছে পানির তলায়, যত নিচেই নামুক, ওপর থেকে একদম স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে কমান্ডোরা।
পথ খুঁজছে হাসান মরিয়া হয়ে, এমন সময় চোখ পড়ল জিনিসটার ওপর। কলজে হিম হয়ে এল সঙ্গে সঙ্গে।
হাঙর!
কম করেও পঁচিশ ফুট লম্বা ওটা, আলোড়নের ফলে ভেসে ওঠা কাদা মাটির মেঘের ভেতর থেকে তেড়েফুড়ে বেরিয়ে আসছে টর্পেডোর মত। আলোয় বকিমক করছে ওটার গানমেটাল রঙের মসণ তুক। অন্য কোন গ্রহ থেকে আসা স্পেস ক্রুজারের মত লাগছে দেখতে। সাদা-কালো পাজামা স্ট্রাইপের ফুটখানেক লম্বা এক পাইলট মাছকে অনুসরণ করছে। দৈত্যাকার খুনীটাকে সোজা হাসানের দিকে টেনে নিয়ে আসছে আধমরা, বেহুশ মাছটা।
সম্মোহিত হয়ে পড়ল সে হাঙরের টকটকে লাল চোখ দুটো দেখে। উন্মাদের চাউনি ওখানে। আরেকটা গ্রেনেড় ফাটতে হাসানের সাথে এটাও পাক খেলো, ব্যথায় পুরো উন্মাদ হয়ে উঠল, হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগল কিসের ওপর। প্রতিশোধ নেয়া যায়। হোমিং সোনারের পালদোর মত ধক ধক করছে চোখ।
হঠাৎ হাসানের ওপর নজর পড়ল এটার, পানিতে লেজের বিদ্যুৎগতির এক শক্তিশালী বাড়ি মেরে ছুটে এল তীরের বেগে। একটু দেরিতে হলেও আতঙ্কে স্থবির মস্তিষ্ক সাড়া দিল তায়, কিন্তু কাজ হলো না। এসে পড়েছে দানবাকৃতি খুনী। বা কাঁধে ভয়ঙ্কর এক ধাক্কা অনুভব করল ফখরুল হাসান, নেমে যাচ্ছে নিচে।
শেষ মুহূর্তে প্রিয়তমা মিমির কথা মনে পড়ল, ছেলে সুহৃদের কথা মনে পড়ল। কিন্তু অনাগত মেয়ের নামটা যে কি রেখেছিল, কিছুতেই খেয়াল করতে পারল না।
দুমাসের নয়, চিরকালের ছুটি হয়েছে তার।
.
জেরুজালেম। প্রধানমন্ত্রীর অফিস। মোসাদ প্রধানের জরুরী অনুরোধে খুঃ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার জন্যে তড়িঘড়ি বৈঠকে বসেছে যেনেক প্ল্যানিং কমিটি। দুপুর গড়িয়ে গেছে তখন।
ফোল্ডার থেকে দুটো ছবি বের করল মোস চীফ, এগিয়ে দিল যাহাল চীফের দিকে। বয়স্ক লোকের ছবিটা দেখুন আগে। দারভিশ হামাম ওর নাম।
আধখানা চাঁদের ভেতর দিয়ে দেখল এলিয়াদুদ। চোখের কোণ কচকে আছে। কে লোকটা? বলল মিকি মাউসের গলায়।
আল ফাতাহর স্পেশাল ফোর্সের সদস্য, গম্ভীর গলায় বলল বেন যেইর। ওদের কমব্যাট সুইমার ইউনিটের কমান্ডার।
প্রধানমন্ত্রী ঝুঁকে বসল। ব্যাপার কি?
এই লোক, এবং তার সঙ্গী, দ্বিতীয় ছবিটা দেখাল সে। আজ সকালে মাসকাট গেছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আমার অনুমান ওখানে কিছু একটা ঘোট পাকিয়ে উঠছে। নইলে এরা ওখানে কেন যাবে হঠাৎ!
ওরা মাত্র দুজন, অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলে উঠল এলিয়াহুদ। মাত্র দুজন। কি এমন করতে পারবে ওরা?
মাথা দোলাল মোসাদ প্রধান। জানি না। তবে কিছু যে ঘটাবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। মাসুদ রানার লন্ডন থেকে উধাও হয়ে যাওয়াটা প্রথম থেকেই সুবিধের মনে হয়নি আমার, মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার। শে, যদি ফিরেই যাবে সে, গোপনে যাওয়ার কি দরকার ছিল? সোজা পথেই তো যেতে পারত। আমার সন্দেহ লোকটা আদৌ দেশে যায়নি, এদিকেই কোথাও আছে। কলকাঠি নাড়ছে আড়াল থেকে।
আমার তা মনে হয় না, মিস্টার মেইর, যাহাল চীফ বলল। নিশ্চয়ই…
বাধা দিল প্রধানমন্ত্রী। এরা গেল কি করে ওদেশে? ওদের এনওসি কে স্পন্সর করল।
জানতে পারিনি, মেইর মাথা দোলাল। ফোন করেছিলাম মেজর হ্যারি রোমানকে, শহরে নেই সে। মেসেজ দিয়ে রেখেছি, ফিরলেই পেয়ে যান।
এই ছবি কোত্থেকে পেয়েছেন?
আম্মান থেকে। এরা প্লেনে ওঠার সময় আমার লোক তুলেছে।
থুতনি ঘষতে লাগল প্রধানমন্ত্রী। চিন্তায় পড়ে গেছে। কে ওদের এনওসি দিয়েছে জেনে আমাকে জানান। মেজর রোমানকে ভালমত সতর্ক করে দিন ওদের ব্যাপারে।
নিশ্চয়ই!
আর আপনি, মিস্টার এলিয়াহুদ, যেনেক কমান্ডারকে সতর্ক করে দিন।
এরপরও আধঘণ্টা চলল কমিটির বৈঠক।
.
মাসকাট। ওমান।
সংস্কৃতি মন্ত্রী শেখ আজিজ বিন সাউদ বিন নাসির আল জাফরের অফিস শহরতলিতে। জায়গার নাম রুয়াই। আধুনিক পাশ্চাত্য ও ঐতিহ্যবাহী আরবী আর্কিটেকচারের চমৎকার এক নমুনা তার অফিস ভবন।
ঢুকতেই সুবিশাল লবি। রিসেপশন ডেস্ক নেই। এক ভারতীয় ক্লীনার মার্বেল পাথরের মেঝে পরিষ্কার করছে। চওড়া সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতেই। চমৎকার এক ফোয়ারা। ওটা ছাড়াতে তিনটে প্রশস্ত করিডর, একটা গেছে। সোজা, অন্য দুটো ডানে-বায়ে। প্রতিটার দুপাশে অনেকগুলো করে অফিস। আরবী অফিসাররা বসা ভেতরে, প্রত্যেকে কমবয়সী। বিশাল ডেস্ক সবার, কিন্তু টেলিফোন ছাড়া কিছু নেই ওপরে। ফাইলপত্র দূরে থাক, এক টুকরো কাগজও নেই।
মিনিস্ট্রির ড্রাইভার মাহমুদের পিছন পিছন চলেছে দারভিশ ও জামাল। অবাক চোখে বিলাসের ছড়াছড়ি দেখছে যুবক। সার্জেন্ট নির্বিকার। বেশ কিছু রূম পেরিয়ে একটায় ঢুকল ওরা। ভেতরে চমৎকার প্রেস করা সাদা শার্ট আর টাই পরা সুদর্শন এক পাকিস্তানী যুবক অভ্যর্থনা জানাল ওদের দুজনকে। বিদেশীরাই চাকা সচল রেখেছে এ দেশের। মন্ত্রী-সচিবরাই শুধু ওমানী, আর সব ব্রিটিশ, ভারতীয়, পাকিস্তানী।
পরিচয় পর্ব সেরে রূম সংলগ্ন বড় এক দরজা খুলে ঘোষণা করল যুবক, আপনার গেস্ট, ইওর এক্সেলেন্সি।
ব্যস্ত হয়ে আসন ছাড়লেন আজিজ জাফর। ষাটের মত বয়স, কিন্তু এখনও দারভিশ হামামের মতই শক্তপোক্ত দেখতে। হেঁটে নয়, অনেকটা যেন নাচের ভঙ্গিতে দরজার কাছে পৌঁছে গেলেন তিনি। দারভিশ মনে মনে অবাক হলো ভদ্রলোকের গতি দেখে। পরিচয় পর্ব শেষ হতে তাদের নিয়ে ডেস্কের দিকে চললেন।
এই বিল্ডিঙে একমাত্র আমার অফিসই এয়ার কন্ডিশন্ড নয়, সে জন্যে আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, সুবাস মাখা দাড়ি নেড়ে বললেন জাফর। ওই জিনিস সহ্য হয় না আমার। ইঙ্গিতে রূমের দুই কোণে চলন্ত দুই পেডেন্টাল ফ্যান দেখালেন। এতেই কাজ চলে আমার।
আমাদের কোন অসুবিধে হচ্ছে না, ইওর এক্সেলেন্সি, বলল দারভিশ। ফ্যানই যথেষ্ট।
ওদের বসতে বলে মন্ত্রী বসলেন। আমি বেদুইন। জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে পাহাড়ে-মরুভূমিতে। বর্তমানে সে দিন নেই। তাবুর জায়গা দখল করেছে বিল্ডিং, ট্রাক চাপা পড়ে গেছে টারমাকের নিচে, আর গাড়ির যন্ত্রণায় উট তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। জানেন, উট এখন কত সমস্যার কারণ আমাদের? বেকার থাকে, গবাদী পশুর খাবার খেয়ে ওদের খাদ্যের অভাব ঘটায়। অথচ ওরা যখন মরুভূমিতে চরে বেড়াত, এ সমস্যা হত না।
অদ্ভুত ব্যাপার! মন্তব্য করল সার্জেন্ট।
অদ্ভুত? বলুন দুঃখজনক। সহকর্মী মন্ত্রীদের অনেকবার এ ব্যাপারে ভেবে দেখতে অনুরোধ করেছি। কেউ কানে তোলে না। আরও আধুনিক হতে চায় সবাই। উপসাগরকে নিউ ইয়র্ক না বানানো পর্যন্ত যেন ওদের শান্তি নেই। হাসলেন জাফর। যে মানুষ তার আপন ঐতিহ্য ভুলে যায়, হাজারো বাধনে বাধা, পড়ে যায় সে। কি বলেন? যাক সে কথা, এতদূর থেকে এক বুড়োর অর্থহীন প্রলাপ শুনতে আসেননি নিশ্চই আপনারা!
বেয়ারার রেখে যাওয়া কফি ও এক প্লেট খেজুর দেখালেন। নিন, শুরু করে দিন। তারপর শুনব সব।
পাঁচ মিনিট পর জাফরই শুরু করলেন। তারপর? আমার ওল্ড ফ্রেন্ড মাসুদ রানা কেমন আছে?
ভাল আছেন, ইওর এক্সেলেন্সি, শ্রদ্ধার সাথে বলল সার্জেন্ট।
ও বলছিল কাজটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, আর… কি যেন… গোপনীয়। তাই না?
মাথা দোলাল সে।
কিন্তু এত রাখঢাক কেন, বেআইনী কিছু নয় তো?
আহত দৃষ্টিতে তাকাল দারভিশ। ইওর এক্সেলেন্সি, আমার বিশ্বাস আমার থেকে ভাল চেনেন আপনি তাকে।
ওহ, ইয়েস! অফকোর্স! সরি, প্রশ্নটা আসলে মুখ ফসকে বেরিয়ে। গেছে। লজ্জা পাওয়া হাসি ফুটল মন্ত্রীর মুখে। ঘটনাটা কি, বলুন তো!
মিস্টার রানার দেশী একটা জাহাজ মাল নিয়ে আকাবা যাওয়ার পথে ওমানী সাগর থেকে নিখোঁজ হয়ে গেছে।
চোখ বিস্ফারিত, সতর্ক হয়ে উঠল তার। কবে?
এক সপ্তা আগে, ইওর এক্সেলেন্সি।
নিখোঁজ মানে, ডুবে গেছে, না ডাকাতি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে?
ডুবে গেছে, এ কথা বিশ্বাস করেন না মিস্টার রানা। আমরা তাই এসেছি ওটাকে খুঁজে বের করতে।
কি যেন ভাবলেন মন্ত্রী। কিন্তু এ কাজে আপনারা কেন? বাংলাদেশ সরকার সরাসরি কেন যোগাযোগ করেনি আমাদের সাথে? ওটায় মাল কি ছিল বলুন তো, আমর্স?
ঠিক জানি না, ইওর এক্সেলেন্সি, বিব্রত চেহারা হলো সার্জেন্টের।
আমি বুঝেছি, টেবিলে হালকা চাপড় মারলেন আজিজ জাফর। কোথায়। যাচ্ছিল জাহাজ বললেন, আকাবা?
হ্যাঁ।
কাদের মাল হতে পারে? নিচু কণ্ঠে নিজেকে প্রশ্ন করলেন তিনি। মাসুদ রানা যদি আমার পরিচিত, ঘনিষ্ঠ বন্ধু না হত, তাহলে ধরে নিতাম কাজটা বেআইনী কিছু। কিন্তু… চোখ বুজলেন তিনি। আচ্ছা, ঠিক আছে। ও আমার কাছে কি ধরনের সাহায্য আশা করে তাই বলুন।
ইওর এক্সেলেন্সি, রয়্যাল নেভি, এয়ারফোর্সে আপনার ট্রাইবের অনেক অফিসার আছেন। আপনি তাঁদের চীফ। উনি চান আপনি তাদের বলেন, নিয়মিত টহলের সময় ওই জাহাজের কোন খোঁজ বের করা যায় কি না, সে ব্যাপারে তারা যেন একটু খেয়াল রাখে। এবং সে কথা যেন গোপন রাখে। এইটুকুই।
হুম! আর?
আর কিছু নয়।
আপনারা কি করবেন?
আমরাও একই কাজ করব নিজেদের মত করে।
আবার বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন মন্ত্রী। অবশেষে বললেন, মাসুদ রানা অতীতে আমার পুরো ট্রাইবের যে উপকার করেছে, তার বিনিময়ে এ কিছুই নয়। ঠিক আছে, আমি আজই কথাটা জানিয়ে দেব ওদের।
চেপে রাখা দম নিঃশব্দে ছাড়ল সার্জেন্ট। ধন্যবাদ, ইওর এক্সেলেন্সি। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
তবে একটা কথা, শাঁসানোর মত করে তর্জনী নাচালেন জাফর আজিজ। এ মিশনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মুখ একদম বন্ধ রাখবেন আপনারা। আমাদের স্পাই নেটওয়ার্ক যেমন বড়, তেমনি এফিশিয়েন্ট। এসবের গন্ধ ও যদি পায়। ওরা, ঘাড় ধরে দেশ থেকে বের করে দেবে আপনাদের। আমার তখন কিছুই করার উপায় থাকবে না, মনে রাখবেন। উল্টে আপনাদের এনওসি ইস্যু করার জন্যে বাজে পরিস্থিতিতে পড়ে যাব আমি।
অবশ্যই, ইওর এক্সেলেন্সি। ধন্যবাদ। আমরা আমাদের কাজ বুঝি।
গুড। মিনা কাকূজে কোন অসুবিধে দেখলে কাস্টমস সুপার কারেমির সঙ্গে দেখা করবেন। ওকে আপনাদের কথা বলে রাখব আমি।
<