১৬.
চুপ! একেবারে চুপ! কড়া গলায় আদেশ দিলো পট্টিওয়ালা। নড়লেই মরবে।
কিছু করার সাহস হবে না আপনার, মরিয়া হয়ে বললো কিশোর। ভালো চাইলে ছেড়ে দিন। আশপাশে আমাদের লোক আছে।
হেসে উঠলো পট্টি। ধাপ্পা দিতে চাইছো? ভালো। তা এসো না, বসে দুটো কথা বলি।
কিছু বলবে না, কিশোর! চেঁচিয়ে বললো মুসা।
দ্বিতীয়জন কথা বলে উঠলো। পরিচিত কণ্ঠ। অসুবিধে নেই। বলতে পারো। মিস্টার হারলিং একজন ডিটেকটিভ। চমকে দিয়ে একটু মজা করলেন তোমাদের সঙ্গে।
রবিন! দুই বন্ধুকে অবাক করে দিয়ে হাসিমুখে আলোর সামনে এসে দাঁড়ালো। বই পড়ার পরে কিভাবে সাহায্যের জন্যে ছুটেছে, জানালো সে। শেষে বললো, গাড়িটা চলে যেতেই ছুটলাম আবার। গিয়ে পড়লাম মিস্টার হারলিঙের হাতে।
ড্যাম হারলিং নাম জানালেন ডিটেকটিভ। একটা বীমা কোম্পানির হয়ে কাজ করছি। রবিন বললো তোমাদের কথা। সোজা চলে এলাম এখানে। সাহায্য আনার জন্যে র্যাঞ্চে গিয়ে আর সময় নষ্ট করতে চাইলাম না।
মিস্টার হারলিংও ভেবেছেন, তোমরা বিপদে পড়বে, রবিন বললো।
হ্যাঁ। যাদের পিছু নিয়েছে, ওরা ডেঞ্জারাস লোক।
তাহলে আপনি মিস্টার হারলিং, গোয়েন্দা, অবশেষে মুখ খুললো কিশোর। সংক্ষেপে জানালো গুহায় কি কি দেখেছে, কিছু কিছু কথা বাদ দিয়ে।
মাথা ঝাঁকালেন হারলিং। বললাম না, আমাদের দেখে ফেলেছে। দেখুক। বেশি দূর যেতে পারবে না। আর ওই ব্যাগের মধ্যে হীরাই রেখেছে, যেগুলোর পেছনে লেগেছি আমি।
কিসের হীরা?? মুসা জিজ্ঞেস করলো।
ওগুলো খুঁজে বের করতেই এসেছি আমি, বুঝিয়ে বললেন হারলিং। ধুরন্ধর। এক রত্নচোরের পেছনে লেগেছি আমি। অনেকগুলো হীরা চুরি করেছে সে। ওর আসল নাম কেউ জানে না, বাড়ি কোথায়, তা-ও না। ছদ্মনাম স্যাড সাইপ্রেস। সারা ইউরোপের সব দেশের পুলিশ ওকে খুঁজছে। ওর পিছু নিয়ে এক হপ্তা আগে এসে পৌঁছেছি সানতা কারলায়। ওখানেই শুনলাম মোনিং ভ্যালির কথা। চট করে। মনে হলো, লুকিয়ে থাকার জন্যে এতো ভালো জায়গা আর হয় না। সাইপ্রেস হয়তো এখানেই লুকিয়েছে। দেখতে চলে এলাম।
ওর পিছু নিয়ে এসেছেন মানে? ওকে আসতে দেখেছেন?
দেখবো কি? ওর আসল চেহারা দেখতে কেমন তাই তো জানি না। পাঁচ বছর আগে ইউরোপ থেকে পালিয়েছে, পুলিশের তাড়া খেয়ে। ওখানকার পুলিশের ধারণা, আমেরিকায় চলে এসেছে সাইপ্রেস। নতুন কোনো ছদ্মবেশ নিয়েছে। ছদ্মবেশ ধরতে আর অভিনয় করায় ওস্তাদ সে। সেজন্যেই তাকে ধরা মুশকিল। বোঝাই যায় না কিছু।
নিচের ঠোঁটে বার দুই চিমটি কাটলো কিশোর। নিশ্চয় আপনার কোম্পানির বীমা করা কিছু হীরা চুরি করে পালিয়েছে?
হা। বছরখানেক আগে। ইউরোপ থেকে পালিয়ে আসার পর অনেক দিন চুপ করে ছিলো, তারপর ওই প্রথম চুরিটা করলো। চার বছর ওর খোঁজ না পেয়ে পুলিশ ভেবেছিলো চুরি করা ছেড়ে দিয়েছে সাইপ্রেস, কিংবা মারা গেছে। কিন্তু হীরা চুরির আলামত দেখেই ইন্টারপোল বলে দিলো, ওটা সাইপ্রেসের কাজ। ওরা শিওর, ও ছাড়া আর কেউ নয়।
দা মোডাস অপার্যানডি, মানে, অপারেশনের পদ্ধতি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাপার, একমত হলো কিশোর। ওর বলার ধরন রহস্যময় মনে হলো মুসার কাছে। বড় বড় অপরাধীদের নিজস্ব কিছু পদ্ধতি আছে, আর সে-কারণেই ধরা পড়ে। পদ্ধতি কিছুতেই বদলাতে পারে না ওরা। বেশি অভিজ্ঞ যারা, তারা খুব সামান্য নড়চড় করতে পারে। পুরোটা পারে না।
ঠিকই বলেছো, বললেন হারলিং। চার বছর চুপ করে ছিলো। কারণ নতুন দেশে নতুন বেশে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছিলো। তারপর সুযোগ বুঝে করে বসলো হাত সাফাই।
নতুন কি ছদ্মবেশ নিয়েছে, আন্দাজ করতে পেরেছেন? জিজ্ঞেস করলো রবিন। র্যাঞ্চের কেউ নয় তো?
হতে পারে। আমি জানলাম কিভাবে জানো? দুটো হীরা বিক্রি করেছে সে। প্রথমটা করেছে নেভাডার রিলোতে, আর দ্বিতীয়টা এখানে।
নেভাডা!
আপনার গাড়িতে তো নেভাডার প্লেট লাগানো। আমাদেরকে ধাক্কা দিয়ে পাহাড়ের ওপর থেকে ফেলে দিতে চেয়েছিলেন, বললো মুসা।
না, আমি না। নেভাডার প্লেট লাগানো অন্য কেউ হবে। সানতা কারলা থেকে মোনিং ভ্যালিতে যাচ্ছিলাম, দেখি পথের ওপর সাইকেল পড়ে রয়েছে। সন্দেহ হলো। তাই নেমে এসে দেখছিলাম। তারপর দেখলাম, আরও লোকজন আসছে। ভাবলাম, ওরা তোমাদের তুলে নিতে পারবে। আমার পরিচয় তখন তোমাদের কাছে ফাঁস করতে চাইনি। তুলে আনলেই তো জিজ্ঞেস করতে, আমি কে? অনেক কষ্টে সাইপ্রেসের চিহ্ন খুঁজে পেয়েছি, সামান্য কারণে সেটা ভণ্ডুল করতে চাইনি। বুঝতেই পারছো, সাইপ্রেসের মতো একজন চালাক লোক নিশ্চয় টের পেয়ে গেছে তার পেছনে চর লেগেছে। হয়তো নেভাডাতে আমাকে দেখেও ফেলেছে সে। তাই আমিও ছদ্মবেশ নিলাম। চোখের ওপর কালো পট্টি লাগালাম, গালে কাটা দাগ বানালাম। তারপর এসেছি সানতা কারলায়। এতো কিছু করেও তাকে ধোকা দিতে পেরেছি কিনা কে জানে? বুঝে গিয়ে মনে মনে হয়তো হাসছে। সাইপ্রেস।
এ-জন্যেই লুকোচুরি খেলছেন? মানে, এরকম একটা…?
হ্যাঁ, রবিন কি বলতে চাইছে বুঝতে পারলেন হারলিং। সাইপ্রেসের নজর এড়িয়ে থাকতে চাইছি।
ওদের কথায় তেমন মন নেই, অন্ধকার গুহার দিকে তাকিয়ে নিচের ঠোঁটে চিমটি কেটে চলেছে গোয়েন্দাপ্রধান। হঠাৎ ঝিক করে উঠলো তার চোখের তারা, কেউ দেখতে পেলো না। ফিরলো। হীরাগুলো স্পেশাল কিছু, তাই না, মিস্টার হারলিং?
অবাক হলেন হারলিং। কি বোঝাতে চাইছে ছেলেটা? বললেন, আঁ! হ্যাঁ। কোনো জুয়েলারি কোম্পানি কিংবা দোকান থেকে চুরি হয়নি। হয়েছে স্যান ফ্রান্সিসকোর একটা মিউজিয়ম থেকে। আর ওগুলো…
রাফ ডায়মণ্ডস! বাক্যটা শেষ করে দিলো কিশোর।আকাটা হীরা। খনি। থেকে যে অবস্থায় তোলা হয়েছিলো সেভাবেই রেখে দিয়েছিলো। ঠিক? আর ওগুলো ছিলো ইণ্ডাস্ট্রিয়াল ডায়মণ্ড।
তুমি জানলে কিভাবে? সবগুলোই রাফ, তবে সব ইণ্ডাস্ট্রিয়াল নয়। মিউজিয়মে ডায়মণ্ড শো চলছিলো। দুনিয়ার অনেক দেশ থেকে হীরা. এনে রাখা হয়েছিলো মানুষকে দেখানোর জন্যে। কেন জানি না, বোধহয় রাফ ডায়মণ্ড বলেই, আর দেখতে সাধারণ পাথরের মতো বলেই বোধহয় বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি কর্তৃপক্ষ। সাইপ্রেসের চুরি করতে কোনো অসুবিধেই হয়নি, কারণ, পাহারা তেমন। কড়াকড়ি ছিলো না। কিন্তু তুমি এতো কথা জানলে কি করে?
ওরকম একটা পাথর এখানকার গুহায় পেয়েছি আমি। বাকিগুলো খুঁজে বের করছে মারটিন আর বেইরি। সব বোধহয় পায়নি এখনও। ওদের ব্যাগ থেকেই হয়তো কোনোভাবে শ্যাফটের মুখে পড়ে গিয়েছিলো পাথরটা। ..
তাহলে সত্যি সত্যি গুহায় আছে পাথরগুলো!
আনমনে মাথা দোলালো কিশোর। আমার বিশ্বাস, চুরি করার পরই এনে এখানে পাথরগুলো লুকিয়েছে আপনার সাইপ্রেস। অপেক্ষা করেছে পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হওয়ার জন্যে। তার প্ল্যানমতোই হতো সব, মাঝখান থেকে মারটিন আর বেইরি বাগড়া না দিলে। বহু বছর ধরে এখানে সোনা আর হীরা খুঁজছে ওরা, সাইপ্রেসের পাথরগুলো পেয়ে ভেবেছে বুঝি খনিই পাওয়া গেছে।
কিন্তু এই এলাকায় কোনো হীরার খনি নেই!
নেই। কিন্তু ওদের দুজনকে বোঝায় কে? তাদের বিশ্বাস, আছে। পাথরগুলো পেয়ে সেই বিশ্বাস আরও জোরালো হলো।
তা ঠিক। কিন্তু একই জায়গায় পাথর জড়ো হয়ে পড়ে থাকতে দেখে ওদের সন্দেহ হয়নি? খনিতে ওভাবে পাথর থাকে না।
পেলে, হতো। তবে মনে হয় না এক জায়গায় পেয়েছে। ভালো করেই জানেন, স্যান অ্যানড্রিয়াস ফল্টের ওপর রয়েছে এই জায়গা। ফলে ওপরের মাটি খালি সরে যায়, আর ভূমিকম্প হয়,। গত কয়েক বছরে বড় ভূমিকম্প অবশ্য হয়নি। এখানে, তবে ছোট ছোট প্রায়ই হয়। গুহার ভেতরে ঢুকলেই তার প্রমাণ মেলে। যেখানে সেখানে পাথরের ধস।
তাতে কি? জানতে চাইলো মুসা।
তাতে? আমার মনে হয়, মাসখানেক আগে ছোট একটা ভূমিকম্প পাথরগুলোর অবস্থান নড়িয়ে দিয়েছিলো। ঝাঁকুনিতে ছড়িয়ে গিয়েছিলো। ফলে এক জায়গায় পায়নি মারটিন। ভেবেছে, খনিই আবিষ্কার করে বসেছে।
খাইছে! ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি ছড়ায়, তা কি সম্ভব?
সম্ভব, জবাব দিলেন হারলিং। হয় এরকম। আলগা মাটি সরে সরে যায় তো। আমি আরেকটা কথা ভাবছি এখন। হয়তো সাইপ্রেসকে খামোকা দোষ। দিচ্ছি। পাথরগুলো হয়তো ও চুরি করেনি, করেছে মারটিন আর বেইরি। এখানে এনে লুকিয়েছিলো, এখন তুলে নিচ্ছে।
কিন্তু, মিস্টার হারলিং, রবিন ধরলো কথাটা। ওরা দুজনে এখানে অনেক বছর ধরে আছে। সবাই চেনে। পাঁচ বছর নয়, আরও অনেক আগে এসেছে ওরা।
হাসলেন হারলিং। আগেই বলেছি, সব রকম ছদ্মবেশ ধরায় ওস্তাদ সাইপ্রেস। হতে পারে, ওদেরই একজন সে। দুই বুড়োর কোনো একজনকে সরিয়ে দিয়ে। নিজে সেই ছদ্মবেশ ধরে এখানে আরামসে লুকিয়ে রয়েছে পাঁচ বছর ধরে।
হ্যাঁ, এটা হতে পারে!
বোঝার উপায় এখন একটাই। গুহায় ঢুকে খুঁজে বের করতে হবে ওদেরকে। এক কাজ করো। একজন, র্যাঞ্চে চলে যাও। শেরিফকে গিয়ে নিয়ে এসো। ইতিমধ্যে আমরা গুহায় ঢুকে মারটিন আর বেইরিকে আটকানোর চেষ্টা করি।
মুসা, তুমি যাও, কিশোর বললো।
ক্ষুব্ধ হলো মুসা। এতো কষ্ট করলাম। এখন নাটকের শেষ দৃশ্যে এসে আমাকে তাড়াতে চাইছো?
-তুমিই যাও, মুসা, হারলিং বললেন। রবিনের পা ভালো না। তাড়াতাড়ি করতে পারবে না। আর কিশোরকে আমার দরকার। টীম ওয়ার্ক করছো তোমরা। যে যেটা ভালো পারবে সেটাই তো করা উচিত।
আর প্রতিবাদ করলো না মুসা। তবে খুশিও হতে পারলো না। নীরবে সরে গেল সেখান থেকে।
.
মারটিন যে গুহাটা খুঁড়ছিলো, ওটার শ্যাফটের মুখের কাছে এসে দাঁড়ালো রবিন, কিশোর আর হারলিং। পাথরটা সরিয়ে ভেতরে আগে ঢুকলেন ডিটেকটিভ।
ছোট গুহাটা শূন্য। ওপাশের দেয়ালে দেখা গেল সুড়ঙ্গমুখ, বোঝা গেল, ওটা দিয়েই পালিয়েছে মারটিন আর বেইরি। মানুষের তৈরি আরেকটা মাইন শ্যাফট, ঢালু হয়ে উঠে গেছে ওপর দিকে। পিস্তল বের করে নিয়ে আগে আগে চললেন হারলিং। পেছনে চক দিয়ে দেয়ালের গায়ে আশ্চর্যবোধক চিহ্ন আঁকতে আঁকতে চললো কিশোর।
মনে হচ্ছে উত্তরের শৈলশিরার দিকে চলেছি আমরা, রবিন বললো। বইয়ে লেখা আছে, ওদিকেই ছাউনি বানিয়ে থাকে মারটিন আর বেইরি।
হবে হয়তো, বললো কিশোর। ছাউনির মেঝে থেকেই হয়তো কোনো সুড়ঙ্গ খুঁড়ে নিয়েছে, কিংবা খোঁড়া ছিলো, সেটা দিয়েই ঢোকে খনিতে। ফলে তাদেরকে ঢুকতে-বেরোতে দেখে না কেউ।
থেমে গেলেন হারলিং। সামনে পথ বন্ধ। পাথরের স্তূপের গোড়ায় অসংখ্য পায়ের ছাপ। নিচু হয়ে বড় একটা পাথর ছুঁয়ে দেখলেন তিনি। জোরে ঠেলা দিতেই নড়ে উঠলো পাথরটা। সরাতেই বেরিয়ে পড়লো ফোকর। আর দুটো পাথর। সরাতে ঢোকার জায়গা হয়ে গেল।
হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে গেলেন ডিটেকটিভ। তাঁর পা দুটো অদৃশ্য হয়ে গেলে বসে পড়ে ওপাশে উঁকি দিলো দুই গোয়েন্দা। ওরাও ঢুকে পড়লো ভেতরে। বেরিয়ে এলো বাইরে। খোলা আকাশের নিচে। চারপাশে ঘন ঝোপঝাড়, গাছপালা। রবিনের অনুমান ঠিকই। ডেভিল মাউনটেইনের উত্তরের শৈলশিরাই এটা।
ঝোপের ভেতরে এই ছোট্ট মুখ কারো নজরে পড়বে না, হারলিং বললেন। এসো, যাই। আমার পেছনে থাকবে তোমরা।
এক পাশে সাগর, আরেক পাশে উপত্যকা। মাঝখানে এই শৈলশিরা। ওটার ওপর দিয়ে সাবধানে এগোলো তিনজনে। খানিক পরেই ছোট একটা কুঁড়ে চোখে পড়লো, আলো আসছে ভেতর থেকে। পা টিপে টিপে জানালার কাছে এসে উঁকি দিলেন ডিটেকটিভ। রবিন আর কিশোরও মাথা তুললো।
পুরনো একটা টেবিলের দুপাশে বসে রয়েছে মারটিন আর বেইরি। টেবিলের ওপর পাথরের ছোট একটা স্তূপ।
.
১৭.
পিস্তল হাতে ভেতরে ঢুকে পড়লেন হারলিং। খবরদার, নড়বে না কেউ!
প্রায় অর্ধেক উঠে পড়েছিলো বেইরি, ধীরে ধীরে বসে পড়লো আবার চেয়ারে। জ্বলন্ত চোখে তাকালো হারলিঙের দিকে।
ছেলেদের দিকে চেয়ে মারটিন বললো, কার্ল, তোমাকে আগেই বলেছিলাম, বিচ্ছগুলোর ব্যাপারে সাবধান হওয়া দরকার, শোনোনি…
ভুলই করেছি, বিড়বিড় করলো বেইরি।
কি চাই? ডিটেকটিভের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলো মারটিন। পাথরগুলো? এগুলো আমাদের। খনিটা আমরা আবিষ্কার করেছি…।
কে করতে বলেছে তোমাদের? অন্যের জায়গায় রাতে চুরি করে যে মাটি খোড়ো, সেটাই তো একটা অন্যায়। তার ওপর পাথর রাখতে চাইছে। কতোখানি। বেআইনী কাজ করেছো, বুঝতে পারছো সেটা?
না, বুঝি না, গোয়ারের মতো বললো মারটিন। বুঝি না, বোঝার চেষ্টাও করি না। বিশ বছর ধরে ওই পাহাড়ের তলায় খুঁড়েছি আমরা, মাথার ঘাম পায়ে। ফেলেছি, তার কোনো দাম নেই?
থাকতো, যদি সত্যি সত্যি খনি পেতেন আপনারা, রবিন বললো। আর খনি। থেকে পাথর তুলে আনতেন। তাহলে মিস্টার হারভে নিশ্চয় একটা ভাগ দিতেন আপনাদেরকে।
খনি পাইনি তো কি পেয়েছি? পাথরগুলো এলো কোত্থেকে তাহলে?
খনি যে নয়, খুব ভালো করেই জানেন আপনারা, মিস্টার মারটিন, এই প্রথম কথা বললো কিশোর। এতোক্ষণ ঘরের জিনিসপত্র দেখেছে। একটা ছোট রেডিও, বুককেসে কয়েকটা বই, এক কোণে কয়েকটা পুরনো খবরের কাগজ।. একটা কাগজ এখন তার হাতে।
ঝট করে কিশোরের দিকে ফিরলো চারজোড়া চোখ।
কি বলছো তুমি, কিশোর? প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো রবিন। কি করে বুঝলে?
ওখানে গোটা চারেক বই আছে, বুককেসটা দেখিয়ে বললো কিশোর। নতুন কেনা হয়েছে, হীরার খনির ওপর লেখা। আর এই পত্রিকাটায়, হাতের কাগজটা নাড়লো, স্যান ফ্রানসিসকো মিউজিয়মে হীরা ডাকাতির কথা লেখা আছে। এক বছরের পুরনো এটা। খবরটায় দাগ দিয়ে রেখেছে পেন্সিল দিয়ে।
মারটিন আর বেইরির দিকে চেয়ে ভুরু নাচালেন হারলিং। কী, কিছু বলবে?
কি আর বলবো? দীর্ঘশ্বাস ফেললো মারটিন। ঠিকই বলেছে ছেলেটা। জানি, ওটা হীরার খনি নয়। এ-অঞ্চলে কোথাও নেই ওরকম খনি।
দুটো পাথর পেয়েছিলাম, বেইরি জানালো। ভাবলাম বুঝি খনিই পেয়েছি। হীরার খনি সম্পর্কে ভালোমতো জানার জন্যে বইগুলো কিনে এনেছে ডিন। বই। পড়ে বুঝলাম, পাথরগুলো আফ্রিকান। তখন লাইব্রেরিতে গিয়ে খুঁজে বের করলাম পত্রিকাটা; কোথায় কবে ডাকাতি হয়েছে জানলাম। বুঝে ফেললাম, ডাকাতি করে এনে পাথরগুলো এখানে রেখে যাওয়া হয়েছে।
বেইরি থামতেই মারটিন বললো, যেহেতু চুরির মাল, ভাবলাম, পেয়েছি যখন আমরাই রেখে দেবো। চোরটা বাদে আর কেউ জানছে না এ-খবর। দুটো পাওয়ার। পর আরও খুঁড়তে লাগলাম। তারপর আর কি? দেখতেই পাচ্ছো এখানে..।
তবে খুঁড়তে গিয়ে একটা গণ্ডগোল হয়ে গেল, মারটিনের কথার খেই ধরলো। বেইরি। একটা বন্ধ সুড়ঙ্গ খুলে দিলাম, আবার গোঙাতে শুরু করলো গুহাটা। ভেবেছিলাম, ভালোই হলো, ভয়ে কাছে আসবে না কেউ। নিরাপদে কাজ করতে পারবো। কিন্তু মিস্টার হারভে আর শেরিফ দেখতে এলেন। তদন্ত শুরু করলেন। বাধ্য হয়ে ঘন্টার ব্যবস্থা করলাম। ডিন যখন খুঁড়তো, পাহাড়ের চূড়ায় বসে আমি চোখ রাখতাম। কাউকে আসতে দেখলেই ঘন্টা বাজিয়ে সতর্ক করে দিতাম ডিনকে।
হাসলো মারটিন। ভালোই চলছিলো। এই ছেলেগুলোকেও ভয় দেখিয়ে একবার তাড়িয়েছি। কিন্তু আজ যে কিভাবে ঢুকে পড়লো…এই, কিভাবে ঢুকলে? কার্ল দেখলো না কেন?
জানালো কিশোর।
শুনে মুখ কালো করে ফেললো বেইরি। কিন্তু মারটিন হাসলো। চালাক ছেলে!
গম্ভীর হয়ে হারলিং বললেন, এতে হাসির কিছু নেই। চোরাই মাল চুরি করাও সমান অপরাধ।
চুরি করেছি কে বললো? খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেছি।
অ্যাক্সিডেন্টগুলো করালেন কেন? গরম হয়ে বললো রবিন। পাথর ফেলে আমাদেরকেও তো মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন।
দেখো, প্রায় সবগুলোই অ্যাক্সিডেন্ট ছিলো ওগুলো, ইচ্ছে করে ঘটানো হয়নি, বললো বেইরি। ওরকম পাথর ধসে পড়ে এখানে যখন-তখন। তাছাড়া গোঙানি শুনে নার্ভাস হয়ে যায় লোকে, অসাবধান হয়ে নিজেরাই দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বসে। তবে, তোমাদের ওপর যেটা পড়তে যাচ্ছিলো, সেটা আমার দোষ। পাথরটা আলগা হয়ে ছিলো। তোমাদের ওপর চোখ রাখতে রাখতে এগোচ্ছিলাম। হোঁচট খেয়ে পড়লাম ওটার ওপর। ঠেলা লেগে গড়িয়ে পড়লো পাথরটা। বিশ্বাস করো, ইচ্ছে করে ফেলিনি।
কঠিন হলো হারলিঙের চোখ। গাধার মতো কাজ করেছে তোমরা! বলে, পাথরগুলো নিয়ে আবার চামড়ার ব্যাগে ভরতে শুরু করলেন। চেয়ে রয়েছে দুই বুড়ো। চোখের সামনে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এতোগুলো দামী পাথর, কিন্তু কিছুই বললো না। হারলিং বলছেন, আসল চোরটাকে ধরতে যেতে হবে এখন..
মিস্টার হারলিং, বাধা দিয়ে বললো কিশোর, চোরটার কথা ভেবেছি আমি.. সে জানে, মিস্টার মারটিন আর বেইরি খুঁড়ে বের করছে পাথরগুলো। ওগুলো নেয়ার জন্যে ফিরে আসবে…
পেছন থেকে কথা বলে উঠলো একটা চাপা, ভোতা কণ্ঠ, ঠিকই বলেছো তুমি। আমি এসেছি।
চমকে ফিরে তাকালো সবাই। দোড়গোড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে নকল ফিগারো। মুখে মুখোশ। হাতে পুরনো আমলের পিস্তল।
নড়ো না কেউ, ঘরের সবাইকে সাবধান করলেন হারলিং। সাইপ্রেস ভয়ানক পাজী লোক। টেবিলে রাখা তাঁর পিস্তলটার দিকে আড়চোখে তাকালেন।
পিস্তল নাচালো নকল, ফিগাররা। না না, হারলিং, বোকামি করো না। পিস্তলের আশা ছাড়ো। যাও, দেয়ালের কাছে গিয়ে দাঁড়াও সবাই।
আদেশ পালিত হলো।
এই যে, তুমি, রবিনকে বললো নকল ফিগারো। ঘরের কোণে দড়ি আছে, দেখোএনে হারলিংকে বাঁধো শক্ত করে। জলদি!
রবিনকে দ্বিধা করতে দেখে হারলিং বললেন, যা বলছে করো।
দড়ি এনে হারলিঙের হাত-পা বাঁধলো রবিন। তাকে সরে যাওয়ার ইশারা করে নিজে এসে বাঁধন পরীক্ষা করে দেখলো সাইপ্রেস। সন্তুষ্ট হয়ে পিছিয়ে গেল দুই পা।
এখন দুজনে মিলে দুই বুড়োকে বাঁধো।
মারটিন আর বেইরিকে বাঁধলো দুই গোয়েন্দা। তারপর সাইপ্রেসের আদেশে কিশোরকে বাঁধলো রবিন। রবিনকে বাঁধলো, সাইপ্রেস নিজে। বাঁধা শেষ করে গিয়ে পাথরগুলো তুলে ব্যাগে ভরলো। খসখসে কণ্ঠে বললো, তোমাদের সবাইকে ধন্যবাদ। পাথরগুলো রেডি করে রেখেছো আমার জন্যে। ভূমিকম্পে ছড়িয়ে গিয়েছিলো। খুঁড়ে বের করা অনেক কষ্ট। কড়া নজর রেখেছিলাম অবশ্যই। এতো কষ্ট করে চুরি করে এনে হারাতে চায় কেউ? খিকখিক করে হাসলো চোরটা। তবে তোমরা তিন বিচ্ছু বড় জ্বালান জ্বালিয়েছে। স্কুবা ইকুইপমেন্টগুলো আনতে দেখেই বুঝেছি, কি করতে যাচ্ছে। তার ওপর পিছে লেগে ছিলো হারলিং। ভয়ই। পেয়ে গিয়েছিলাম। পাথরগুলো না হারাই! চলি। গুড বাই। বেরিয়ে গেল সে।
গুঙিয়ে উঠলো কিশোর। আমি একটা গাধা! আমাদেরকে ধরে যখন সুড়ঙ্গে আটকালো, তখনই বোঝা উচিত ছিলো আমার, খুঁড়ে পাথর বের করার ব্যাপারটা সে জানে। আমাদের যেখান থেকে ধরে এনেছে, স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিলো খোঁড়ার শব্দ। হুঁশিয়ার হওয়া উচিত ছিলো আমার। কেন ভাবলাম না, ব্যাটা আমাদের ওপর চোখ রেখেছে?
দুঃখ করো না, সান্ত্বনা দিলেন হারলিং। চমৎকার ভাবে এই রহস্যের সমাধান করেছে। গাধা তো আসলে আমি। কেন বুঝলাম না, মারটিন আর বেইরিকে ব্যবহার করছে সাইপ্রেস?
হু, দীর্ঘশ্বাস ফেললো রবিন। কিশোরের অনুমানই ঠিক। চোরটা সত্যি। ফিরে এলো।
কিশোর সন্তুষ্ট হতে পারছে না। ভিলেনের চেহারাই যদি দেখা না গেল, রহস্যের এমন কিনারা করে লাভটা কি? পালিয়ে গেল। দেখতে কেমন। কোনোদিনই হয়তো জানবো না। মিস্টার হারলিংকেও আবার নতুন করে মরা। মাছের মতো হাঁ হয়ে গেল হঠাৎ তার মুখ।
কিশোর? ডাকলো রবিন।
কিশোর, হারলিং জিজ্ঞেস করলেন। কি হয়েছে?
চোখ মিটমিট করলো কিশোর। বহুদুর থেকে ফিরে এলো যেন। বাঁধন খুলতে হবে! ছাড়া পেতে হবে আমাদের! চেঁচিয়ে বললো সে। জলদি! নইলে ব্যাটাকে ধরতে পারবো না!
বিষণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন হারলিং। বৃথা চেষ্টা, কিশোর। লাভ হবে না। ও এতোক্ষণে অনেক দূরে চলে গেছে।
মনে হয় না…
বাইরে ঘোড়ার খুরের শব্দ হলো। খানিক পরেই ঝটকা দিয়ে খুলে গেল। দরজা। বিশালদেহী একজন লোক ঘরে ঢুকলেন, দুই গোয়েন্দা আগে দেখেনি। তাঁকে। ভুরু কুঁচকে তাকালেন পাঁচ বন্দির দিকে। কি ব্যাপার? গমগম করে। উঠলো ভারি কণ্ঠস্বর।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো দুই গোয়েন্দা। দুটো পরিচিত চেহারা চোখে পড়লো। তাদের। মুসা, আর মিসেস হারভে।
.
১৮.
বিশালদেহী মানুষটা সানতা কারলা কাউন্টির শেরিফ। মারাত্মক ঝুঁকি নিয়েছে বলে তিন গোয়েন্দার ওপর রেগে গেলেন। এমন একটা ভয়ানক চোরের পেছনে লাগতে কে বলেছে তোমাদেরকে।
ওই গুহায় আটকে যদি মেরে ফেলতো! বললেন মিসেস হারভে। ভাগ্যিস, দেয়ালে চিহ্নগুলো দেখতে পেয়েছিলো মুসা। নইলে তো জানাই যেতো না তোমাদেরকে কোথায় বেঁধে রেখেছে।
চুপ করে রইলো রবিন।
সরি, স্যার, শেরিফের দিকে চেয়ে বললো কিশোর। আগে আপনাকে জানানোর সুযোগই পাইনি। তাছাড়া মিস্টার হারলিঙের দেখা পেয়ে গেলাম। তিনি অভিজ্ঞ গোয়েন্দা। এলাম সঙ্গে সঙ্গে। চোরটা যে ওভাবে আমাদেরকে চমকে দেবে, ভাবতেই পারিনি।
তা ঠিকই বলেছে ওশেরিফ, হারলিং বললেন। গুহায় যে ডেঞ্জারাস এক ক্রিমিন্যালও ঢুকতো, জানতো না, ওরা। ওরা ঢুকেছিলো নিছক কৌতূহলের বশে, কিসে গোঙায় জানার জন্যে। সেকথা মিস্টার হারভেও জানেন।
যুতসই কোনো জবাব খুঁজে না পেয়ে আরও রেগে গেলেন শেরিফ। হারলিঙের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধু ঘোঁৎঘোৎ করলেন।
আপনি যা-ই বলুন, শেরিফ, আবার বললেন হারলিং। কাজ দেখিয়েছে বটে ছেলেগুলো। বড়রা যা পারেনি, ওরকম একটা রহস্যের সমাধান করে দিয়েছে।
হাসলেন মিসেস হারভে। বড় হলে অনেক বড় গোয়েন্দা হবে ওরা।
তা হবে, এই প্রথম শেরিফের মুখে হাসি ফুটলো। আমরা যা পারিনি…কিন্তু চোরটা যে পালালো! তাকে ধরি কিভাবে?
আমার মনে হয় না পালিয়েছে, বোমা ফাটালো যেন কিশোর। একসঙ্গে তার দিকে ঘুরে গেল সবগুলো চোখ। চেষ্টা করলে এখনও ধরা যায়।
যায়?
অন্য সবাই কোথায়, স্যার? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
অন্য সবাই? র্যাঞ্চের লোকদের কথা বলছো তো? তোমাদের খুঁজতে বেরিয়েছে, জবাব দিলেন শেরিফ। কয়েকজনকে নিয়ে হারভে গেছে সৈকতে। আরও কয়েকজনকে নিয়ে কোহেন আর প্রফেসর গেছেন ডেভিল মাউনটেইনের ওপাশে।
ওদের সঙ্গে কোথায় আপনার দেখা হবে?
কেন? র্যাঞ্চে।
জলদি চলুন তাহলে।
ভ্রূকুটি করলেন শেরিফ। যা বলার বলে ফেলো না এখানেই।
মাথা নাড়লো কিশোর। একদম সময় নেই, স্যার। বলতে অনেক সময় লাগবে।.জলদি চলুন, চোরটাকে ধরতে চাইলে।
ওর কথা শুনুন, শেরিফ, হারলিং বললেন। ওর ওপর ভক্তি এসে গেছে। আমার। সত্যি ধরে ফেলবে চোরটাকে। চলুন চলুন।
বেশ, দরজার দিকে এগোলেন শেরিফ।
শেরিফের দুজন ডেপুটি পাহারায় রয়েছে পাহাড়ের গোড়ায়। তাদের দুটো ঘোড়ায় উঠলো রবিন আর মুসা। আর শেরিফের সঙ্গে কিশোর। রুক্ষ তরাই অঞ্চল, এবড়োখেবড়ো। কঁকুনির চোটে ঘোড়ার পিঠে বসে থাকাই দায়।
র্যাঞ্চের কাছে চলে এলো ওরা। কাউকে চোখে পড়লো না।
এবার বলো, শেরিফ বললেন। কাকে ধরতে হবে?
ঠোঁট কামড়ালো কিশোর। আসবে, স্যার, শিওর আসবে। এলেই ধরতে হবে। আমাদেরকে খোঁজার ভান করে না পেয়ে ফিরে আসবে। ওত পেতে থাকবো আমরা। এলেই ধরবো।
ঘোড়া থেকে নামলেন শেরিফ। কিশোরকে নামতে সাহায্য করলেন। এবার খুলে বলো সব।
স্যার, কিশোর বললো। কেবিনে কিছু বেফাঁস কথা বলে ফেলেছে চোরটা…
র্যাঞ্চ হাউসের পাশ থেকে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বেরিয়ে এলেন প্রফেসর হারকসন। এই যে, শেরিফ, খুঁজে পেয়েছেন তাহলে। ভেরি গুড। তোমরা ছেলেরা খুব একচোট দেখিয়েছো। ভুগিয়ে ছেড়েছো। নার্ভাস ভঙ্গিতে হাসলেন তিনি। যা চোখ পাথর।দেখতে পাইনি, কি করে যেন লেগে, কেটে গেল। ফিরে এসে ব্যাণ্ডেজ না বেঁধে আর পারলাম না।
সময় মতোই এসেছেন, প্রফেসর, শেরিফ বললেন। কিশোর পাশা এখন একটা গল্প শোনাবে আমাদের।
শান্ত কণ্ঠে কিশোর বললো, গল্প শোনানোর আর দরকার নেই, স্যার। প্রফেসরের দেহ তল্লাশি করলেই হীরাগুলো পেয়ে যাবেন। আবার হাতছাড়া করেছে বলে মনে হয় না। ওকে যে সন্দেহ করেছি, কল্পনাও করেনি নিশ্চয়। তাই এক না, মিস্টার স্যাড সাইপ্রেস?
সাইপ্রেস! শেরিফ অবাক।
ছদ্মনাম। ওর ব্যাণ্ডেজ খুলে দেখুন, হীরাগুলো পেয়ে যাবেন।
ঘুরে দৌড় দিলো প্রফেসর হারকসন, ওরফে স্যাড সাইপ্রেস। কিন্তু পালাবে কোথায়? শেরিফ আর তার দুই সহকারীর কাছে পিস্তল রয়েছে। সহজেই ধরে ফেলা হলো চোরটাকে।
.
১৯.
ব্যাণ্ডেজের ভেতরই পাওয়া গেল তাহলে, বললেন বিখ্যাত চিত্রপরিচালক মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফার।
হ্যাঁ, স্যার, কিশোর বললো। দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে ওঠার চেষ্টা করেছিলো। সাইপ্রেস। নেভাডার লাইসেন্স প্লেট লাগানো ওটাতে। দুটো গাড়ি ছিলো তার। নেভাডার প্লেট লাগানোটা লুকিয়ে রাখতো মোনিং ভ্যালির একটা গিরিপথে, ওদিকে যেতে না কেউ। তাই কারও চোখে পড়েনি গাড়িটা। হেনরি ফিগারোর পোশাক আর মুখোশটা রাখতো গাড়ির মধ্যে।
হুঁ, বিশাল ডেস্কের ওপাশে বসে আস্তে মাথা দোলালেন পরিচালক। ভীষণ চালাক। …যা-ই হোক, দুই বোকা বুড়োর কি খবর? মারটিন আর বেইরি?
হাসলো রবিন। ওরা বার বার কসম খেয়ে বলেছে, হীরাগুলো ফিরিয়ে দিতো। ওদের কথা বিশ্বাস করেননি শেরিফ। র্যাঞ্চের লোকদের ভয় দেখিয়েছে। বলে নালিশ করতে পারতেন মিস্টার হারভে। করেননি। তিনি মাফ করে দিয়েছেন দুই বুড়োকে। ফলে শেরিফও ছেড়ে দিয়েছেন তাদেরকে।
কিশোর, জানতে চাইলেন পরিচালক। কি করে বুঝলে, হেনরি ফিগারো, প্রফেসর হারকসন আর স্যাড সাইপ্রেস একই লোক?
সামনে ঝুঁকলো কিশোর। শুরু থেকেই প্রফেসরের ভাবভঙ্গি ভালো লাগেনি। আমার, খটকা লেগেছে। কয়েকবার ভেবেওছি, ও-ই হয়তো নকল হেনরি ফিগারো।
কিন্তু শিওর হলে কি করে, ও-ই স্যাড সাইপ্রেস?
কেবিনে বন্দি করার পর একটা কথা বলেছিলো, তাতেই…
দ্রুত আরেকবার রবিনের লেখা ফাইলের পাতা ওল্টালেন পরিচালক। তারপর মুখ তুললেন। কই, বিশেষ কিছু তো বলেনি সে?
কম বলেছে। তবে যা বলেছে, ধরা পড়ার জন্যে যথেষ্ট। আমাদের স্কুবা, ইকুইপমেন্টগুলো আনতে নাকি দেখেছে। কে দেখে থাকতে পারে? এমন কেউ, যে র্যাঞ্চে থাকে। তারপর রয়েছে তার কণ্ঠস্বর। অভিনয় করে অন্যরকম করার। চেষ্টা করেছে বটে; কিন্তু গলার স্বর, কথা বলার ধরন বদলালেই বা কতোটা: বদলাতে পারে একজন মানুষ? দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে ফেলতে শুরু করলাম, থামলো কিশোর। গাল চুলকালো। সে আরও বললো, হারলিং পিছু লাগাতে ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলো। ওই কথা থেকে দুটো সূত্র পেলাম। এক, নকল ফিগারো জানে। হারলিং কে। দুই, হারলিং যে তার খুব কাছাকাছি এসে গেছে, সেটাও জানে।
নিশ্চয়ই! একমত হলেন পরিচালক। হারলিং তোমাদেরকে বলেছে, স্যাড সাইপ্রেস তাকে চেনে। অথচ হারলিংকে তোমরা ছাড়া র্যাঞ্চের আর কেউ দেখেনি। তোমরা র্যাঞ্চের লোকের কাছে তার চেহারার বর্ণনা দিয়েছে। শুনেই হুঁশিয়ার হয়ে গেছে সাইপ্রেস, তোমাদের কথা থেকেই বুঝে গেছে চোখে পট্টি লাগিয়ে হারলিংই ছদ্মবেশ নিয়েছে।
ঠিক তাই, স্যার।
কিন্তু, তোমাদের কথা তো র্যাঞ্চের আরও লোকে শুনেছে। তাদেরকে সন্দেহ। না করে শুধু প্রফেসরের ওপর নজর গেল কেন তোমার?
ওর পিস্তলটা, স্যার।
পিস্তল? বুঝতে পারছেন না পরিচালক। এমন কি বিশেষত্ব আছে ওটার…
ওটার কিছু নেই, স্যার, তাড়াতাড়ি বললো কিশোর। ওটাকে যেভাবে ধরা হয়েছে…মানে, আমি বলতে চাইছি, নকল ফিগারো বাঁ হাতে ধরেছিলো পিস্তলটা। হোলস্টার পরেছিলো বাঁ দিকে। অথচ কোনো বইতে উল্লেখ নেই যে আসল হেনরি ফিগারো বাইয়া ছিলো। তার ছবিতেও হোলস্টার ডান দিকে ঝোলানো দেখেছি। গুহায় তার কঙ্কাল পেয়েছি, তখনও ডান হাতে ধরা ছিলো পিস্তলটা…
এহহে! নিজের ওপরই বিরক্ত হলেন মিস্টার ক্রিস্টোফার। এই সহজ কথাটা একবারও ভাবলাম না! বইতে উল্লেখ নেই, ছবিতে রয়েছে হেনরি ফিগারোর ডান পাশে হোলস্টার। শুধু প্রফেসর হারকসনের বক্তব্য, ফিগারো ছিলো বাইয়া। নিজের ফঁদে নিজেই পড়েছে।
হ্যাঁ, হাসলো কিশোর। স্যাড সাইপ্রেস কিন্তু আসলেই ইতিহাসের প্রফেসর, স্যার। ইউরোপ থেকে পালিয়ে এসে ক্যালিফোর্নিয়ায় লুকিয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার। ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছে, তাই বিন্দুমাত্র সন্দেহ করতে পারেনি কেউ। হেনরি ফিগারোর ওপর একটা বইও লিখতে আরম্ভ করেছিলো, তাতে বলেছে, ফিগারো ছিলো বাঁইয়া। নিজেকে ফিগারো বলে চালিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা ছিলো আগে থেকেই, তাই বাঁইয়ার ব্যাপারটা প্রতিষ্ঠিত করে ফেলতে চেয়েছিলো।
চেয়ারে হেলান দিলেন পরিচালক। খুব জটিল একটা রহস্যের সমাধান করেছে এবার। অথচ সূত্র বলতে প্রায় কিছুই ছিলো না তোমাদের হাতে। শুধু বাইয়ার ব্যাপারটা দিয়েই…নাহ, ইউ আর অ্যা জিনিয়াস, ইয়াং ম্যান!
মিস্টার ক্রিস্টোফারের মতো মানুষের প্রশংসা পাওয়া যা-তা কথা নয়। গর্বে ফুলে উঠলো গোয়েন্দাদের বুক। মুসার দিকে চেয়ে ইশারা করলো কিশোর।
বাক্সটা এতোক্ষণ কোলের ওপর রেখে দিয়েছিলো মুসা। তুলে টেবিলের ওপর দিয়ে ঠেলে দিলো। নিন, স্যার। আপনাকে প্রেজেন্ট করলাম।
কী?
খুলেই দেখুন।
বাক্সটা খুলে ভেতরের জিনিসটা বের করলেন পরিচালক। দীর্ঘ এক মুহূর্ত স্থির তাকিয়ে রইলেন ওটার দিকে। আনমনে বিড়বিড় করলেন, হেনরি ফিগারোর পিস্তল!
হ্যাঁ, স্যার। মিস্টার হারভে আমাদেরকে উপহার দিয়েছেন, আমরা দিলাম আপনাকে, রবিন বললো। আপনার ব্যক্তিগত জাদুঘরে রেখে দেবেন। আর মোনিং ভ্যালির ওপরে ছবি করলে, তাতেও ব্যবহার করতে পারবেন।
থ্যাংক ইউ, মাই বয়েজ! থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ!
পিস্তলটা উল্টেপাল্টে দেখে টেবিলে রেখে দিলেন পরিচালক। সরাসরি তাকালেন কিশোরের চোখের দিকে। মিটিমিটি হাসছেন। আচ্ছা, ওই বুড়ো মানুষটার ব্যাপারে কি মনে হয় তোমার? ওটাই কি হেনরি ফিগারোকে মেরেছিলো?
পলকে বদলে গেল কিশোরের চেহারা। দৃষ্টি চলে গেল যেন বহুদূরে। আপনি তো জানেন, স্যার, কিংবদন্তী শুধু শুধু তৈরি হয় না। পেছনে কোনো না কোনো কারণ থাকেই। হয়তো ওরকম কোনো কিছু একটা ছিলো গুহার ভেতরের খাড়িতে। হয়তো লক নেস মনস্টারের মতো কোনো দানব। ভাবছি, সময় করতে পারলে গিয়ে আরেকবার ঢুকবো গুহাটায়। দানব-রহস্যের সমাধান করার চেষ্টা করবো।
খাইছে! তাড়াতাড়ি দুই হাত নাড়লো মুসা। গেলে তুমি যাও। আমি বাবা ওর মধ্যে নেই।
হেসে উঠলো সবাই।
<