জাদুর পুতুল

অলস ভঙ্গিতে আন্ডারগ্রাউন্ড আটলান্টায় ঘুরে বেড়াচ্ছে তিন গোয়েন্দা। বেড়াতে এসেছে রাশেদ পাশার সঙ্গে। তিনি এসেছেন জরুরী কাজে।

রাস্তার মাটির নিচে কিছু দোকানপাট আর ডিপার্টমেন্টাল স্টোর নিয়ে গড়ে উঠেছে জায়গাটা।

একটা দোকান থেকে লেটেস্ট হিট অ্যালবাম কিনেছে রবিন। কিশোরের হাতে বুকস্টোর থেকে কেনা একটা ব্যাগ। মুসা কিছুই কেনেনি। ইয়া বড় এক কোণ আইসক্রীম খাচ্ছে।

বাপরে, চারটে বাজে, ঘড়ির দিকে তাকাল কিলোর। চলো, হোটেলে চলে যাই। গোসল করা দরকার। চাচার সাথে সাড়ে ছটায় ডিনার। মনে আছে?

মাথা ঝাঁকাল মুসা আর রবিন দুজনেই। মনে আছে।

অদ্ভুত দোকানটা মুসার চোখে পড়ল প্রথমে। দোকানের সামনে বড় একটা জানালা। কালো রং করা। এক কোনায় প্রমাণ সাইজের একটা নরকঙ্কাল ঝুলছে। ডিসপ্লেতে ঝাড়ফুক, ভূত-প্রেত, জাদু-মন্ত্র ইত্যাদির ওপরে নানা বই সাজানো।

অ্যাই, কিশোর, আঙুল তুলে দেখাল মুসা, দেখো দেখো, সাইনবোর্ডটা: এখানে হাত দেখা হয়। চলো না, আমাদের ভাগ্যে কি আছে জেনে আসি।

মুচকি হাসল কিশোর। আবারও ভাগ্য গণনা! গত বারের কথা ভুলে গেছ? জ্যোতিষী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, আমাদের মাথায় শিং গজাবে। তিনজনেরই।

সম্ভাবনা এখনও ফুরিয়ে যায়নি, হাসল রবিন। এবার হয়তো বলবে লেজ গজাবে।

স্টোরের ভেতরে ঢুকল ওরা। ডাইনীর গুহার আদলে সাজানো হয়েছে ঘরটা। মৃদু আলো ধীরে ধীরে রঙ বদলাচ্ছে, আশপাশের সব কিছু ভূতুড়ে লাগছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে রোমাঞ্চকর মিউজিক। ঘরের দেয়ালে অদ্ভুত সব জিনিস সাজানো। কতগুলো বার দেখা গেল। সেগুলোতে নানা ধরনের লেবেল সটানোপ্রেমের আরক, ঘৃণার আরক, কর্মজীবনে উন্নতির আরক, ইত্যাদি। বড় বড় ভোলা পাত্র আছে কতগুলো। অদ্ভুত সব জিনিসে ভরা। লেখা দেখে বোঝা যায় ওগুলোতে আছে কুকুরের চুল, গোসাপের চোখ, ময়ূরের যকৃৎ, সাপের খোলস এবং ম্যানড্রেক গাছের শিকড়।

শুকনো মাথাগুলো দেখো, একটা কাঁচের বাক্সে আঙুল দিয়ে দেখাল মুসা। ভয়ঙ্কর লাগছে না?

সাবধান না হলে আমাদের দশাও ওগুলোর মতই হতে পারে, ঠাট্টা করল কিশোর।

মুসা বলল, জায়গাটা জানি কেমন লাগছে আমার। ঠিক বোঝাতে পারব না

হুঁ, তা ঠিক, মাথা দোলাল রবিন। এই ভূতুড়ে আবহর মধ্যে গা ছমছম করছে ওরও; ভয়ের কিছু নেই, এখানকার সব কিছুই সাজানো, নিজেকে মনে করিয়ে দিল ও।

মনে হচ্ছে যেন অ্যাজটেকের মন্দির। বলি দেয়ার ঘর, মন্তব্য করল কিশোর। এদিক ওদিক তাকাল। কিন্তু কেউ নেই নাকি এখানে?

যেন তার কথার জবাবেই খসখসে একটা কণ্ঠ ভেসে এল ঘরের দূর প্রান্ত থেকে। কি চাই?

পাক খেয়ে ঘুরে গেল ওরা। দেখল ছায়ার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে এক মহিলা। পরনে গোড়ালি ঢাকা কালো আলখেল্লা, লম্বা কালো চুল ঢেকে রেখেছে মুখের একটা পাশ। মহিলার কালো চোখের তির্যক দৃষ্টি, সবুজ আইশ্যাডো আর ঠোঁটের লাল টকটকে লিপস্টিকে তাকে ভ্যাম্পায়ারের মত লাগছে।

হাত দেখাতে চাই, ভয়ে ভয়ে বলল মুসা। কত লাগবে?

 দশ ডলার, জবাব দিল মহিলা।

আমার কাছে চার ডলার আছে, বলল মুসা। চলবে এতে?

 ইঙ্গিতে কিশোর আর রবিনকে দেখিয়ে মহিলা বলল, তোমার বন্ধুদের কাছ থেকে নিতে পারো না?

তিনজনে মিলিয়ে তিরিশ তো? মাথা নাড়ল কিশোর। আমাদের কাছেও অত টাকা নেই। চলো, মুসা, আজ আর হাত দেখানো হলো না।

হাত তুলল মহিলা। তাড়াতাড়ি বলল, দাঁড়াও দাঁড়াও। তোমাদেরকে আমার ভাল লেগেছে। যা আছে, তাতেই দেখে দেব। কে আগে দেখাবে রু কুঁচকে কিশোরের দিকে তাকাল মহিলা। তুমি?

মাথা কাত করল কিশোর। আমার আপত্তি নেই।

 এসো আমার সঙ্গে।

দরজার পর্দা সরিয়ে ওদেরকে নিয়ে পেছনের ঘরে ঢুকল মহিলা।

খাইছে! চমকে গেল মুসা।

এ ঘরটা আগেরটার চেয়েও ভূতুড়ে। পুরো ঘর কালো মখমলে মোড়া। একটা বেগুনি রঙের বাতি জ্বলছে। সেই আলোতে সবার দাঁত আর চোখের মণিও বেগুনি দেখাল। ভয়ঙ্কর লাগল তাতে। হঠাৎ করেই মনে হতে লাগল তিন গোয়েন্দার, এখান থেকে আর বেরোতে পারবে না কোনদিন। সময় থাকতে পালাবে কিনা চিন্তা করতে লাগল মুসা। কিন্তু মহিলা ততক্ষণে নিচু একটা টেবিলে বসে পড়েছে। কিশোরকে ইশারা করল তার পাশে বসতে। টেবিলটা কালো মখমলে মোড়া। ওপরে একটা কাঁচের বড় বল।

কিশোরের হাতের তালু মেলে ধরল মহিলা। চেয়ে রইল অনেকক্ষণ। টেবিলের সামনে দুটো কুশনে বসেছে রবিন আর মুসা। গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখছে মহিলার কাজকর্ম।

তোমার বয়স আঠারো, কিশোরের হাত দেখে অবশেষে বলতে শুরু করল মহিলা। তুমি সাগরের ধারের কোনও শহরে, বড় একটা বাড়িতে বাস করো। সাংঘাতিক বুদ্ধিমান তুমি, ছাত্র হিসেবে ভাল, ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র আর কম্পিউটারে আগ্রহ। আরও একটা কাজে তুমি খুব দক্ষ, কারও ওপর নজর…অর্থাৎ সতর্ক দৃষ্টি রাখা…।

এক টুকরো কাগজ আর পেন্সিল নিল সে। তোমার জন্ম তারিখ কবে বলো।

বলল কিশোর। মহিলা তারিখটা লিখে কাগজের ওপর কতগুলো লাইন টানল। লাইনগুলো কাটাকুটি করে তারপর আঁকল একটা বৃত্ত।

ক্রিস্টাল বলের দিকে তাকাও! হঠাৎ বলে উঠল সে।

তাকাল কিশোর। তবে ভেতরে ভেতরে সতর্ক। জানে ক্রিস্টাল বল দিয়ে জ্যোতিষীরা সম্মোহন করে ফেলে।

কিন্তু মহিলা সম্মোহন করল না কিশোরকে। সে-ও চেয়ে রইল ক্রিস্টাল বলের দিকে। ঝাড়া এক মিনিট ওদিকে তাকিয়ে থাকার পরে উত্তেজিত হয়ে উঠল সে।

তুমি গোয়েন্দা! রেগে গেছে মহিলা। তোমরা এখানে কেন এসেছ? আমার লাইসেন্স আছে। আমি অন্যায় কিছু করছি না। পুলিস আমার কিছু করতে পারবে না।

আমি পুলিসের লোক নই, ম্যাম, তাকে আশ্বস্ত করল কিশোর। আমরা আসলে শখের গোয়েন্দা। আপনার কাছে এসেছি শুধুই হাত দেখাতে। অন্য কোন মতলব নেই আমাদের।

অ! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মহিলা। তাহলে আর কোন সমস্যা নেই। আমার কাছে অনেক প্রাইভেট ডিটেকটিভ আসে। আমি তাদের নানা সাহায্য করি। দরকার হলে তোমরাও আমাকে ভাড়া করতে পারো। তোমাদের রহস্য উঘাটনে অনেক সাহায্য করতে পারব।

মনে হচ্ছে আপনার সেই ক্ষমতা আছে, সন্দিহান সুরে বলল কিশোর। আপনি আমাকে আগে কখনও দেখেননি। অথচ আমার সম্পর্কে সব বলে দিলেন।

আসলে পত্রিকায় আমাদের ছবি দেখেছে, রবিন বলল। পত্রিকায় আমাদের কেসের কথা তো মাঝে মাঝেই ছাপা হচ্ছে।

কড়া চোখে রবিনের দিকে তাকাল মহিলা। চেঁচিয়ে উঠল, তোমাদের নামও কোনদিন শুনিনি আমি। যা বলেছি, আমার জাদুর ক্ষমতার জোরেই বলেছি। আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না, না? ঠিক আছে। হাত দেখা শেষ করি আগে। তারপর ঠিকই বিশ্বাস করবে।

আবার ক্রিস্টাল বলের দিকে তাকাল মহিলা। আমি মোটর সাইকেল দেখতে পাচ্ছি। দুটো মোটর সাইকেল। তোমাদের মধ্যে একজনকে পেছনে বসিয়ে আনা হয়েছে। আবার উত্তেজিত শোনাল তার কণ্ঠ। গোয়েন্দাগিরি তোমরা আগেও বহুবার করেছ। তবে এবার তোমাদের সামনে বিপদ দেখতে পাচ্ছি আমি। ভয়ানক বিপদ!

অ্যাক্সিডেন্ট? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

 না। নতুন কোন কেসে জড়িয়ে পড়বে তোমরা। দেখতে পাচ্ছি-দেখতে পাচ্ছি এক চোখো একটা লোককে। নীল চোখ। সাদা গাড়িতে চড়ে সে। খুবই বিপজ্জনক লোক। তার ধারে কাছেও যেয়ো না। লোকটার কাছ থেকে সব সময় দূরে থাকবে।

মহিলার কণ্ঠ ভীষণ জোরাল হয়ে উঠল, চেহারা দেখে মনে হলো সমাধিস্থ হয়ে পড়েছে সে। চোখ বোজা। যেন জানে না, কাথায় আছে।

সিলভার স্টার থেকে সাবধান! ফিসফিস করল সে। ওখানে যেয়ো না।

সিলভার স্টার কি? প্রশ্ন করল রবিন।

জবাব দিল না মহিলা। খামচে ধরল কিশোরের হাত। ব্যথা পেল কিশোর।

এক চোখো লোকটার কাছ থেকে সাবধান! ভারী নিঃশ্বাস পড়ছে মহিলার। সিলভার স্টার থেকে সাবধান! আমি…আমি সোনা দেখতে পাচ্ছি। অনেক সোনা। কিন্তু ওই সোনা অশুভ। ধরতে যেয়ো না। ধরলে…ধরলে মৃত্যু হবে! ওই সোনাকে ঘিরে আছে মৃত্যু আর…।

হঠাৎ চোখ খুলল মহিলা। বিস্ফারিত চাউনি। কিশোরের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চেঁচিয়ে উঠল, সিম্বু! সিম্বু আছে ওখানে! ওর কাছে যেয়ো না! তারপরই চোখ উল্টে দিয়ে, অজ্ঞান হয়ে কালো মখমলে ঢাকা মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল সে।

সর্বনাশ! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। মুসা, রবিন-দেখো তো এখানে পানি টানির ব্যবস্থা আছে কিনা। পানি নিয়ে এসো।

 জ্যোতিষীর জ্ঞান ফেরাতে চেষ্টা করতে লাগল কিশোর। সিঙ্ক থেকে তোয়ালে ভিজিয়ে নিয়ে এল রবিন। ভেজা তোয়ালে দিয়ে তার মুখ মুছে দিতে লাগল কিশোর।

প্রথমে ভেবেছিলাম ভঙ্গি ধরেছে, কিশোর বলল। এখন তো দেখি সত্যি সত্যি বেহুশ।

কিন্তু মহিলা কি যেন বলছিল? রবিনের কণ্ঠে উদ্বেগ।

হুঁশ ফিরলে জিজ্ঞেস করব, বলল কিশোর।

কিছুক্ষণ পরে চোখ মেলে তাকাল মহিলা।

আপনি ঠিক আছেন তো? উকণ্ঠিত গলায় জানতে চাইল কিশোর।

ধীরে ধীরে মাথা দোলাল জ্যোতিষী। ভীষণ শক্তিশালী কম্পন অনুভব করছি আমি!… যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আটলান্টা ছেড়ে চলে যাও তোমরা। তোমাদের অনুরোধ করছি আমি।

সিম্বুটা কে? কিশোরের প্রশ্ন।

কে, জানতে চাও? আস্তে উঠে দাঁড়াল মহিলা। এসো আমার সঙ্গে।

তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে বাইরের ঘরে চলে এল সে।

শেলফ থেকে কিশোরকে একটা বই বের করে দিল মহিলা। এটা পড়ো। সিম্বু কি জানতে পারবে। না, দাম দিতে হবে না। বইটা তোমাদের এমনিই দিলাম। এখন যাও। আর কোনদিন এদিকে এসো না। আমি দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি, তোমাদের ভাগ্য খারাপ!

জবাবে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিশোর, মহিলার চেহারা দেখে চুপ হয়ে গেল। ভয় ফুটে আছে মহিলার মুখে। তাতে কোন ভণিতা নেই।

চলো, দুই সহকারীকে নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল কিশোর। দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। হাত নেড়ে মহিলাকে বলল, গুড-বাই। অ্যান্ড থ্যাংক

উফ, বাঁচলাম! অদ্ভুত দোকানটা থেকে বেরিয়ে এসে যেন হাঁপ ছাড়ল মুসা। অভিজ্ঞতা একটা হলো বটে!

রবিন বলল, তুমিই তো ঢুকতে চাইলে।

চিন্তিত ভঙ্গিতে ঠোঁট কামড়াল কিশোর। কি যেন রয়েছে ওই মহিলা আর তার দোকানের মধ্যে। আরেকটু হলেই বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম তার কথা।

ভুরু কুঁচকাল মুসা। অবাক। তারমানে করোনি?

*

হোটেলে ফিরে কিশোর গেল বাথরূমে। মুসা বিছানায় চিৎ। আর রবিন শুয়ে শুয়ে মহিলার দেয়া বইটা পড়তে শুরু করল।

বইটা ভুডু চর্চার ওপরে লেখা।

ভুডু-তত্তের জন্ম আফ্রিকায় হলেও হাইতি দীপে এই রহস্যময় ধর্মীয় বিশাস নিয়ে চর্চা হয় বেশি। জাদুমন্ত্র, ঝাড়-ফুক, নরবলি এ সবের সাহায্যে কিভাবে বিন্নি অনুষ্ঠান করা হয় তার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে বইটাতে।

গোসল সেরে বেরিয়ে এল কিশোর।

রবিন বলল, জাদু করে তোমাদের যে কারও হাত এখন ভেঙে দিতে পারি আনি। এ জন্যে শুধু একটা পুতুল দরকার হবে আমার। পুতুলের হাতে সুচ ঢুকিয়ে দিলে মনে হবে তোমাদের হাতেও সুচ ঢুকে গেছে। বাবারে-মারে বলে চেঁচানো শুরু করবে।

লাফ দিয়ে উঠে বসল মুসা। না না, প্লীজ, এখন ওকাজটিও কোরো না ভাই! পাশা আঙ্কেলের সঙ্গে ডিনারের দাওয়াতটা আগে সেরে নিই। হাতে ব্যথা থাকলে খাওয়াটা আর জমবে না।

হেসে ফেলল কিশোর আর রবিন।

তবে, এ বিদ্যেটাতে যদি বিশ্বাস না থাকে তোর, বলল রবিন, তাহলে আর কোন ভয় নেই। তোমার ক্ষতি হবে না।

অ! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। তাহলে এটা কি আর এমন ক্ষমতা হলো। পচা জাদু।

সিম্বু কি জিনিস জানতে পেরেছ? আলমারি থেকে পরিষ্কার একটা শার্ট বের করল কিশোর।

ছোট, মোটাসোটা একটা পুতুলের নাম সিম্বু, রবিন বল। ভয়ঙ্কর চোখ জোড়া কোটর ঠেলে বেরিয়ে আছে বাইরে। এই যে, ছবিও আছে।

তার কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল কিশোর। সিম্বু দুহাত শূন্যে তুলে রেখেছে। প্রতিটি হতে দশটা করে আঙুল। পা জোড়া ফাঁক করা। পায়ে দশটা করে মোট বিশটা আঙুল। কোমরে চওড়া বেল্ট।

বাপরে, চেহারা বটে। মন্তব্য করল কিশোর। তা এই সিম্বুটা আসলে কে?

দুর্লভ একটা চরিত্র, ব্যাখ্যা করল রবিন। সিম্বু তার মনিবের ধনসম্পদ পাহারা দেয়। এ ধরনের পুতুল এখন পাওয়া যায় না বললেই চলে। সগ্রাহকদের কাছে খুবই মূল্যবান বস্তু। ইদানীং সিম্বুর আদলে বেশ কিছু মূর্তি তৈরি করা হয়েছে। তবে কোনটাই আসল সিম্বুর ধারে কাছে যেতে পারেনি। বইটা কিশোরকে দিল ও। নাও, তুমি পড়তে থাকো। আমি এই ফাঁকে গোসলটা সেরে আসি।

কিশোর বসল বই নিয়ে। মুসাকে পড়ে শোনাল, সিম্বুর কাজ হলো সব সময় তার প্রভুর পাশে থাকা, তাকে শয়তানের হাত থেকে রক্ষা করা। কেউ সিম্বুর ক্ষতি কিংবা সে যাকে পাহারা দেয় তার ক্ষতির চেষ্টা করলে, মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ছাড়ে।

একবার হাইতিতে দুটো সিম্বু পুতুল পাওয়া গিয়েছিল। মিউজিয়ামে বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল ওগুলো। তার পর থেকেই ঘটতে শুরু করল অঘটন। যারা ওগুলোকে খুঁজে পেয়েছিল, রহস্যময় ভাবে ভয়ঙ্কর মৃত্যু ঘটল তাদের। তাতেও অঘটন বন্ধ হলো না। মিউজিয়ামের পানির পাইপ বিস্ফোরিত হতে লাগল, হাতের ভারী আস্তর খসে পড়ে কাঁচের বাক্স চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে শেষে যেখান থেকে পুতুল দুটো আনা হয়েছিল, ফিরিয়ে দিয়ে এল মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ। অবশেষে বন্ধ হলো দুর্ঘটনা।

খানিক পরে মুসা আর রবিনকে নিয়ে হোটেলের লবিতে চলে এল কিশোর। রাশেদ পাশা ওখানেই আছেন। কিশোরের হাতে একটা ব্রীফকেস। ওতে তার কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রয়েছে।

তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে এলেন রাশেদ পাশা। রাস্তায় নেমে হাত তুলে ট্যাক্সি ডাকলেন।

সিলভার স্টারে যাব, জানালেন তিনি ড্রাইভারকে।

কি! চমকে উঠল কিশোর। কোথায় যাচ্ছি?

এই তো কাছের একটা রেস্টুরেন্টে, বললেন রাশেদ পাশা। তোদের পছন্দ হবে। সিলভার স্টারের সী-ফুডও চমৎকার।

তিন গোয়েন্দা আর কিছু না বলে চুপচাপ উঠে বসল ট্যাক্সিতে। রেস্টুরেন্টে ঢুকে কোণের দিকে একটা টেবিল দখল করল। বিকেলের ঘটনাটা চাচাকে জানাল কিশোর।

সাদা গাড়িতে চড়ে নীল চোখো লোক? আনমনা ভঙ্গিতে বললেন রাশেদ পাশা। এক চোখো। মনে হয় বুঝতে পারছি মহিলা কার কথা বলেছে।

কার কথা? অবাক হলো কিশোর।

লোকটার নাম পিয়েরে দুপা, বললেন রাশেদ পাশা। নষ্ট একটা চোখ ঢেকে রাখে সাদা কাপড়ের টুকরো দিয়ে। সাদা মার্সিডিজ চালায়। ঠাণ্ডা মাথার ভয়ঙ্কর এক খুনী।

খাইছে! বলে উঠল মুসা।

যখন পেশাদার গোয়েন্দা ছিলাম, দুপার সাথে বেশ কয়েকবার টক্কর লেগেছে আমার, রাশেদ পাশা বললেন। কিন্তু লোকটা বাইন মাছের মত পিচ্ছিল। ওকে ধরার জন্যে জাল গুটিয়ে এনেছি যতবার, ততবারই ও জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছে। ওর বিরুদ্ধে ডাকাতির বহু অভিযোগ এনেছি, লাভ হয়নি। সব সময় ফস্কে গেছে। মহা ধুরন্ধর এক লোক। তার কাজে যে-ই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, পথের কাঁটা দূর করতে দ্বিধা করেনি কখনোই।

ওর বিশেষত্ব কি? জানতে চাইল কিশোর।

অ্যান্টিক চোর, জবাব দিলেন রাশেদ পাশা। বিবেক বর্জিত কিছু সগ্রাহকের কাছে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে, চড়া দামে। ধরা পড়ে যাবার ভয়ে অবশ্য ওসব সংগ্রাহক তাদের সংগ্রহের প্রদর্শনী করার সাহস পায় না কখনোই। কি এক সাংঘাতিক নেশায় যেন তবু কেনে ওরা।

মহিলা জ্যোতিষী সিম্বুর কথা বলেছিল, বলল কিশোর। আর সিম্বু হলো দামী অ্যান্টিক। সব খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে।

মাথা ঝাঁকালেন রাশেদ পাশা। তার কপালে ভাঁজ পড়ল। কিন্তু দুপা কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ। সিম্বুর অভিশাপ থেকে একশো হাত দূরে থাকার কথা তার। অবশ্য প্রচণ্ড লোভ তাকে কোন পর্যন্ত নিয়ে যাবে সেটা অনুমান করা কঠিন।

আঙ্কেল, জ্যোতিষী মহিলা যে সব ভবিষ্যদ্বাণী করল, সেগুলো কি বিশ্বাস হয় আপনার? জিজ্ঞেস করল মুসা।

শ্রাগ করলেন রাশেদ পাশা। কে জানে! হয়তো কিছু ঘটার আভাস পেয়েছে মহিলা। বাস্তব প্রমাণ। অভিশাপ, ভবিষ্যদ্বাণী-এ সব জিনিসে বিশ্বাস নেই আমার। তবে জগতে অব্যাখ্যাত বহু জিনিসই ঘটে। সব কিছুই হেসে উড়িয়ে দেবার উপায় নেই।

সিলভার স্টারে আসার পর থেকেই মনটা খচখচ করছে আমার, দীর্ঘশ্বাস ফেলল রবিন।

আমার ধারণা, কিশোর বলল, দুপা যতই কুসংস্কারাচ্ছন্ন হোক না কেন, সিম্বুকে পাবার লোভ ছাড়তে পারবে না কিছুতেই।

 কিশোরের কথা কানে গেল না রবিনের। সে কিশোরের কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে আছে, চোখ বড় বড় হয়ে উঠেছে বিস্ময়ে। রবিনের দৃষ্টি অনুসরণ করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল কিশোর। হাঁ হয়ে গেল মুখ।

 ওই তো সেই লোক? ফিসফিস করল সে। নীল চোখো লোকটা!

রাশেদ পাশাকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে হলো না। দুপা নিজেই এগিয়ে এল তাদের টেবিলের দিকে। মশিয়ে পাশা, আপনাকে আবার দেখে খুব খুশি হলাম, তার গলার স্বর তেলতেলে, বিরস।

কিন্তু তোমাকে দেখে আমি খুশি হতে পারিনি, দুপা, বললেন রাশেদ পাশা। কি চাও?

আপনারা আসার আগে এই টেবিলে এক বন্ধুকে নিয়ে বসেছিলাম আমি। সে একটা খাম নাকি ফেলে রেখে গেছে এখানে। খামটা কি আপনাদের চোখে পড়েছে?

না, পড়েনি, জবাব দিলেন রাশেদ পাশা।

কিছু মনে না করলে একটু উঠে দাঁড়াবেন দয়া করে? বলল লোকটা।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে দাঁড়ালেন মিস্টার পাশা। দেখাদেখি তিন গোয়েন্দাও।

দুপা টেবিলের নিচে, চেয়ারের নিচে, গদির তলায় তন্নতন্ন করে খুঁজল। পেল না কিছুই। তার চেহারা কঠিন। বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত, মশিয়ে পাশা। তবে খামটা আপনাদের চোখে পড়ে গেলে, দয়া করে আমাকে পৌঁছে দিলে কৃতজ্ঞ থাকব। আমি জানি আপনার মত গণ্যমান্য ব্যক্তির ওপর ভরসা রাখা চলে, কি বলেন?

রাশেদ পাশা কটমট করে তাকালেন ট্রুপার দিকে। খামটা আমরা পাইনি।

তীক্ষ হয়ে উঠল দুপার কণ্ঠ। আমি চাই না পুলিস ডেকে আপনার এবং আপনার ছেলেদের সার্চ করাই। চেয়ারের ওপর রাখা কিশোরের ব্রীফকেসের দিকে ইঙ্গিত করল সে। ওটাতে নেই তো?

রাশেদ পাশা বসে পড়েছিলেন, লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ন্যাপকিনটা টেবিলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, আমি জানি না তোমার খামে কি আছে। তবে মনে হচ্ছে ওটা পড়তে পারলে খুশিই হবে পুলিস। যাও, ডেকে নিয়ে এসো পুলিসকে। আমরা অপেক্ষা করছি।

ঘেৎ-ঘোৎ করে উঠল দুপা, বিড়বিড় করে কি যেন বলল। বোধহয় গোয়েন্দাদের মজা দেখাবে বা এ রকম কিছু। তারপর জুতোর গোড়ালিতে ভর করে চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল। চলে গেল যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে।

এতে কি প্রমাণ হলো? রবিনের প্রশ্ন।

জ্যোতিষীর কাছে গেলে জবাব মিলতে পারে, ঠাট্টা করল কিশোর।

ব্যাপারটা অদ্ভুত, চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন রাশেদ পাশা। আমার ধারণা দুপা বা সিম্বুকে নিয়ে আরও ঘটনা ঘটবে।

সিম্বু সম্পর্কে আর কি জানো, চাচা? কিশোর জিজ্ঞেস করল।

আটলান্টা রাজ্যের অনেকেই জানে সিম্বুর কথা। গৃহযুদ্ধের আগে এই পুতুলটাকে নিয়ে একটা গুজব চালু হয়েছিল, রাশেদ পাশা বললেন। ধনী এক বুড়ো বাস করত এখনকার রূট থ্রী-এইটি রোডের ধারে, বিশাল এক বাড়িতে। আপনার বলে কেউ ছিল না বুড়োর। কালো চামড়ার এক চাকরকে নিয়ে থাকত বিশাল বাড়িতে। চাকরটাকে পছন্দ করত বুড়ো। চাকরটারও ছিল বুড়োর জন্যে জান-প্রাণ। ভুডু ম্যাজিকে বিশ্বাস করত চাকরটা। তার মালিককেও সে ভুডু চর্চায় উৎসাহিত করে তোলে। যা হোক, গৃহযুদ্ধ শুরু হলে ইউনিয়ন আর্মি হামলা চালায় দক্ষিণ এবং পুবে। বুড়ো তার ধন-সম্পদের কি দশা হবে তা ভেবে খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়।

খুবই স্বাভাবিক, মুচকি হাসল কিশোর।

সোনার টাকা, মোহর-যা কিছু ছিল তার, সব গলিয়ে সোনার বার বানিয়ে মাটিতে পুঁতে রাখে বুড়ো। সে-সব পাহারা দেয়ার জন্যে ওগুলোর সঙ্গে রেখে দেয় একটা সিম্বু পুতুল। পুতুলটা বানিয়ে দিয়েছিল তার কালো-চাকর। ইউনিয়ন আর্মিকে ঠেকাতে পাথরের দেয়ালও তুলেছিল বুড়ো। কিন্তু ঠেকাতে পারেনি। সৈন্যরা বাড়িতে ঢুকে খুন করে বুড়ো আর তার চাকরকে। তবে যদ্দুর জানি, সোনা-দানার সন্ধান আজতক কেউ পায়নি।

দারুণ গল্প! রবিন বলল। সেই গুপ্তধনের খোঁজ করেনি কেউ?

করেছে নিশ্চয়। আমি জানি না, জবাব দিলেন রাশেদ পাশা। তবে কেউ ওগুলোর খোঁজ পেলে মূল্যবান সিম্বু পুতুলটাও পেয়ে যাবে।

তা পাবে, মুসা বলল। সেই সঙ্গে অভিশাপের শিকারও হওয়া লাগবে হয়তো।

নীরব হয়ে গেল চারজনেই। চুপচাপ খাওয়া শেষ করল।

তারপর এয়ারপোর্টে গেল তিন গোয়েন্দা, রাশেদ পাশাকে পৌঁছে দিতে। রাশেদ পাশা নিউ ইয়র্কে যাবেন বিশেষ কাজে।

যাবার পথে কেন যেন অস্বস্তি লাগতে লাগল কিশোরের। অদ্ভুত এক অনুভূতি। ট্যাক্সির রিয়ার ভিউ মিররে চোখ রেখে বলল, কেউ আমাদের পিছু নিয়েছে।

সামনের ট্রাফিক লাইটে দাঁড়াতেই চেনা গেল লোকটাকে। সাদা একটা মার্সিডিজ, কিশোরদের ট্যাক্সির প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়াল। এক চোখে সেই লোকটা।

হয়তো ভেবেছে তার খামটা মেরে দিয়েছি আমরা! নিচু স্বরে বলল রবিন।

মনে হয়, চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলালেন রাশেদ পাশা। আমাদেরকে খুন করার ইচ্ছে থাকলেও অবাক হব না। সাবধানে থাকতে হবে। বিশেষ করে তোমাদের।…আগামী কদিন কি প্ল্যান তোদের, কিশোর? কি করবি ভাবছিস?

কোস্টের দিকে যাব। সৈকতে ঘুরে বেড়াব। দেখি, আরও কি কি করা যায়।

যা-ই করিস, সাবধানে থাকিস। বলা যায় না…

আর কয়েক মিনিটের মধ্যে এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেল ওরা। পিয়েরে ট্রুপার টিকিটিও দেখা গেল না আর আশেপাশে। চাচাকে প্লেনে তুলে দিয়ে আবার ট্যাক্সি নিল কিশোর। হোটেলে ফিরে এল তিন গোয়েন্দা। রাস্তার ওপারে দুপার গাড়িটা দেখতে পেল কিশোর।

লোকটা আসলে চায় কি? মুসার প্রশ্ন।

লোকটা বোধহয় ধরেই নিয়েছে আমরা তার খাম চুরি করেছি। তাই পিছু ছাড়ছে না, কিশোর বলল। লোকটার ওপর আমাদেরও নজর রাখতে হবে।

ট্যাক্সি ভাড়া চুকিয়ে হোটেলে ঢুকল ওরা। রূমে এসে ব্রীফকেসটা বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলা কিশোর। ওটার দিকে তাকাতেই চোখ স্থির হয়ে গেল রবিনের।

কিশোর! ব্রীফকেসের নিচে কি যেন লেগে আছে। চিৎকার করে উঠল সে। কি এটা?

একটা খাম। আটকে আছে ব্রীফকেসের তলায়।

আরি! কিশোরও অবাক। এটা এল কোত্থেকে!

খামটা খুলে নিল সে। বুঝতে পেরেছি। ব্রীফকেসের গায়ে কোন ভাবে লেগে গিয়েছিল চিবানো চিউয়িং গাম। তাতে আটকে গেছিল খামটা। চেয়ারেই পড়ে ছিল ওটা, মিথ্যে বলেনি দুপা। বড়ই কাকতালীয় ঘটনা। এবং অদ্ভুত।

খোলো তো দেখি! তাড়া দিল মুসা। ভেতরে কি আছে দেখার জন্যে তর সইছে না আমার।

খাম খুলল কিশোর। ভেতরে জরাজীর্ণ, মলিন এক টুকরো কাগজ। তাতে অদ্ভুত কিছু কথা লেখা ছড়ার ঢঙে। কিশোর জোরে জোরে পড়ে শোনাল:

ভাবছ ওটা আছে হেথায়।
খুঁজলে পাবে নাকো সেথায়
পাহাড় বেয়ে ওঠা মাথায়
আবার নামে নিচে।
অনেক গভীর শিকড় যেথায়
পাহারা দেয় সিম্বু সেথায়
সোনা চুরির ফন্দি ছাড়ো
 মানে মন কেটে পড়ো
 নইলে আছে দুঃখ অনেক
বাঁচবে নাকো কেউ।

অবাক হয়ে গেল ওরা।

রাশেদ আঙ্কেল যে বুড়ো লোকটার গল্প বলেছে এটা নিশ্চয় তার কাজ। অবশেষে বলল রবিন। ওই লোক তার ক্রীতদাসের সাহায্যে সোনাদানা লুকিয়ে রেখেছিল। পাহারার ব্যবস্থা করেছিল সিম্বুকে দিয়ে।

জ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে ধাপে ধাপে মিলে যাচ্ছে, ফাঁকা শোনাল মুসার কণ্ঠ। আমরা লোভে পড়ে গুপ্তধনের সন্ধানে বেরোলেই অভিশাপ নেমে আসবে আমাদের ওপর।

দূর, তোমার অভিশাপ! কে বিশ্বাস করে? মুখ ঝামটা দিল রবিন।

যা-ই বলল, অদ্ভুত কিছু যে ঘটছে এখানে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কি বলল, কিশোর?

চিন্তিত ভঙ্গিতে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে কাটতে ফিরে তাকাল কিশোর, হুঁ।

আমাদের এখন কি করা উচিত তাহলে? রবিনের প্রশ্ন।

হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল কিশোর। ব্যাপারটার শেষ দেখে ছাড়ব। সোনা যদি পেয়েই যাই পুলিস বা কোন চ্যারিটির হাতে তুলে দেব।

জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল কিশোর। দুপা ওদের দিকে নজর রাখছে কিনা দেখার জন্যে পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল। বৃষ্টি শুরু হয়েছে, জানাল সে। আমাদের বন্ধুটি এখনও আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে-না না, চলে যাচ্ছে। ভেবেছে হয়তো ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে আমরা কোথাও বেরোব না।

আকাশ ফুটো করে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। গাছের শাখায় ঝোড়ো হাওয়ার মাতামাতি।

চলো, এই সুযোগে বেরিয়ে পড়ি, প্রস্তাব দিল মুসা। রেইনকোট আছে। কাজেই ভিজতে হবে না বৃষ্টিতে। আর ক্যাম্পিং-এর জন্যে গর্ত খোঁড়ার কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে এসেছিলাম। ওগুলোও নেব সাথে।

প্রস্তাবটা মন্দ না, নিমরাজি হলো কিশোর। ঠিক আছে, চলো। চুপচাপ হোটেলে বসে থাকতে ভাল্লাগবে না। দেখেই আসি সিম্বুকে পাওয়া যায় কিনা।

কয়েক মিনিট পরে হোটেলের পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল ওরা। এখানে ওদের বাইক রেখেছে। সাবধানে মোটর সাইকেল দুটো নিয়ে উঠে এল মেইন রোডে। তাকাল এদিক-ওদিক। নাহ্, সাদা মার্সিডিজের চিহ্নও নেই কোথাও। রাস্তা প্রায় জনমানবশূন্য। গন্তব্য বুড়োর বাড়ি।

ভাগ্য ভালই বলতে হবে। একটু পরেই থেমে গেল বৃষ্টি। মেঘ সরিয়ে দিয়ে হেসে উঠল ঝলমলে চাঁদ। নদীর ধারে চলে এসেছে ওরা। নদীর পাশের সরু রাস্তায় ঢুকে পড়ল। অনেকটা পথ যাবার পর চোখে পড়ল বুড়োর বাড়ি। রাস্তা মেরামতির কাজ চলছে। বড় বড় সব যন্ত্রপাতি। খানিক দূরে একটা পাথুরে দেয়াল। ঘিরে রেখেছে বুড়োর শতাব্দী প্রাচীন বাড়িটাকে। মোটর সাইকেল থামাল ওরা। হেঁটে ঢুকে পড়ল গেট দিয়ে। চাঁদটাকে আড়াল করে দিতে শুরু করেছে মেঘ। বাতাস উঠছে। একটু পরেই আবার নামল বৃষ্টি।

বাহু, দারুণ! বিরক্ত কণ্ঠে বলে উঠল মুসা। এই আসে এই যায়!

টর্চ জ্বেলে এগোচ্ছে ওরা। বড় বড় ওক গাছের ডালে ঝুলে থাকা এক ধরনের শ্যাওলার কারণে বিঘ্নিত হচ্ছে যাত্রা। টর্চের আলোতে খুব কম জায়গাই আলোকিত হচ্ছে।

কানের পাশে নিশাচর পাখি তীক্ষ্ণ গলায় ডেকে উঠে দারুণ চমকে দিল ওদেরকে। ডাকতে ডাকতে বৃষ্টির মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙ কোরাস ধরেছে ব্যাঙ। হাঁটু ডুবে যাওয়া গভীর জলায় নেমে পড়েছে কিশোর। পায়ের নিচে পিচ্ছিল কি একটা কিলবিল করে উঠল। আঁতকে উঠল ও। এক লাফে উঠে এল তীরে।

কি হলো? জানতে চাইল রবিন।

সাপ! বিড়বিড় করল কিশোর। গোখরো! আরেকটু হলেই গেছিলাম।

পুরানো বাড়িটার কাছাকাছি এসেছে ওরা, এমন সময় মড়মড় করে একটা ডাল ভেঙে গেল। মুসা দেল ডালটা সোজা রবিনের গায়ে পড়তে যাচ্ছে। সাবধান করে দেয়ার সময় নেই। প্রচণ্ড এক ধাক্কা মারল রবিনকে। ছিটকে পড়ে গেল রবিন। বিশাল মোটা ডালটা এক সেকেন্ডের জন্যে তার শিকার হারাল। ডালটার দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠল রবিন। আরেকটু হলে আমিও গেছিলাম, খসখসে গলায় বলল ও।

কিশোরের দিকে তাকাল মুসা। সিম্বু পুতুলের কারণে মিউজিয়ামে দুর্ঘটনাগুলোর কথা মনে পড়ে গেছে তার। ফিরে যাবে নাকি?

নাহ? ওই তো সামনেই বাড়িটা।

ওটাকে এখন আর বাড়ি বলা যায় না। দেয়ালগুলো শুধু খাড়া হয়ে আছে, ছাদ অদৃশ্য। এবড়োখেবড়ো মেঝে। আবর্জনা, ভাঙা কাঠ আর অন্যান্য পরিত্যক্ত জিনিসপত্রে বোঝাই মাটির নিচের ঘরটা।

ভাবছ ওটা আছে হোথায়, খুঁজলে পাবে নাকো সেথায়, পাহাড় বেয়ে ওঠো মাথায়, আবার নামো নিচে, বিড়বিড় করে ছড়াটা আওড়াল কিশোর। ছোটখাট একটা পাহাড়ের মত টিলার মাথায় চড়ে তরাইয়ের চারপাশে চোখ বোলাল। বেশির ভাগটাই সমতল।

নেমে কোন দিকে যেতে হবে? জানতে চাইল রবিন।

মনে হয় বাড়ির পেছন দিকে যেতে বলেছে। চলো, দেখে আসি।

দেখা গেল বাড়ির পেছন থেকে মাটি ঢালু হয়ে নেমে গেছে।

অনেক গভীর শিকড় যেথায়, পাহারা দেয় সিম্বু সেথায়, এবার আবৃত্তি করল রবিন। কিসের শিকড়? এদিকে কোনও বড় গাছটাছ তো চোখে পড়ছে না।

রূট সেলারের কথা বলেনি তো? বলে উঠল কিশোর। ঠিক! তা-ই বুঝিয়েছে। সেলার শব্দটা ইচ্ছে করে বাদ দিয়েছে। গুপ্তধন শিকারীকে ধোকা দেবার জন্যে। রূট মানে শিকড়। সেলার বাদ দেয়াতে শুধু গাছপালাই খুঁজে বেড়াবে যারা গুপ্তধন খুঁজতে আসবে। আমরাও সেই ধোকায় পড়ে গিয়েছিলাম।…আগেকার দিনে ঘর-বাড়িতে রূট সেলার থাকত বলে জানতাম। লোকে শাক-সজি রাখত রূট সেলারে। তখন তো আর ফ্রিজ আবিষ্কার হয়নি।

তা ঠিক, মাথা দোলাল রবিন। প্রশ্ন হলো, রূট সেলারটা কোথায়?

 চলো, ওই টিলায় উঠে লাফালাফি করি, বুদ্ধি দিল কিশোর। ফাপা হলে শব্দ শুনেই বোঝা যাবে।

কিন্তু টিলায় চড়ব কেন? মুসার প্রশ্ন।

পাহাড় বেয়ে ওঠো মাথায়, আবার নামে নিচে, বলে স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে ছড়াকার, জবাব দিল কিশোর। সেজন্যেই উঠব। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ওই টিলার নিচেই কোনখানে আছে গুপ্তধন।

পাহাড়ের গায়ে লাফালাফি করতে গিয়ে কাদা মেখে ভূত হয়ে গেল তিনজনেই।

ঘণ্টাখানেক এ ভাবেই চলল। হঠাৎ মুসা বলে উঠল, দাঁড়াও। দাঁড়াও। এখানে ফাপা একটা আওয়াজ শুনেছি। খুড়ে দেখা যাক।

পরের আধঘণ্টা নিবিষ্ট মনে মাটি খুঁড়ে চলল তিন গোয়েন্দা। পরিশ্রমের ফল মিলল অবশেষে। মাটি সরে বেরিয়ে এল কাঠ। আধ চা কাঠে শাবল দিয়ে বার কয়েক গুতো মারতেই ভেঙে গেল। টর্চের আলোতে একটা গর্ত দেখতে লে ওরা। বারো ফুট মত গম্ভীর হবে। খালি গর্ত।

গুঙিয়ে উঠল মুসা। খামোকাই এত খাটলাম!

এক মিনিট, বলল কিশোর। এখানেই কোথাও আছে। নইলে এত খাটতে যেত না বুড়ো। রূট সেলারের কাঠের মেঝের নিচেই রেখেছে সোনার বারগুলো।

সঙ্গে করে আনা টুল কিট থেকে রশি বের করল কিশোর। রশির এক মাথায় হক লাগিয়ে মাটিতে গাঁথল। রশি বেয়ে প্রায় বারো ফুট নিচে নেমে এল। মেঝেতে আবার ঠুকতে শুরু করল ফাপা আওয়াজ শোনার আশায়। এবার বেশিক্ষণ পরিশ্রম করতে হলো না। শুনতে পেল প্রত্যাশিত শব্দটা।

কুঠরির কাঠের তক্তা ভেঙে খুলে ফেলেছে ওরা, এ সময় রূট সেলারে ঢুকতে শুরু করল বৃষ্টির পানি। পরিস্থিতি আরও খারাপ করে দেয়ার জন্যেই যেন ওপরের একটা গর্তে জমা পানিও উপচে গিয়ে ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে শুরু করল সেলারে।

দেখতে দেখতে গোড়ালি ডুবে গেল ওদের। ক্রমেই বাড়ছে পানি।

এখানে থাকলে তো দেখছি ডুবে মরব, মুখ অন্ধকার হয়ে গেছে রবিনের। জ্যোতিষীর কথাই শেষ পর্যন্ত ফুলে যাবে মনে হচ্ছে!

সত্যি চলে যেতে চাইছ? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

দেখি আরেকটু, গুপ্তধন পাওয়ার আশা কিশোরের মতই ছাড়তে পারল না রবিনও।

দেয়ালের আরেকটা তক্তা খুলে আনল মুসা। পাহাড়ের গায়ে একটা সুড়ঙ্গ চোখে পড়ল। উচ্চতায় পাঁচ ফুটেরও কম। ওপরের দিকে উঠে গেছে সুড়ঙ্গটা। ফলে পানি ওটার নাগাল পাবে না।

বুড়ো এটা তৈরি করে রেখে গেছে, বলল কিশোর। জানত, বৃষ্টি হলে পানি ঢুকতে পারে। তাই এমন জায়গায় বানিয়েছে, যাতে পানি না জমে।

মাথা নিচু করে সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকে পড়ল ওরা। দশ ফুট যাবার পরে বাম দিকে মোড় নিল। ধীরে ধীরে এগোতে লাগল হামাগুড়ি দিয়ে।

কড়াৎ করে বাজ পড়ল। এবং ঠিক ওই মুহূর্তে অযাচিত ভাবে সিম্বুর মুখোমুখি হলো ওরা। একটা লোহার সিন্দুকের ওপর চুপ করে বসে রয়েছে ছোট্ট মূর্তিটা। হাঁ করে তাকিয়ে রইল তিনজনেই।

সিন্দুকে কি বারগুলো আছে?–সবার মনেই খেলে গেল একই প্রশ্ন।

 বাক্সটা খুলব? ফিসফিস করে যেন নিজেকেই প্রশ্ন করল কিশোর।

কি-কি-কিন্তু, সিম্বুর অভিশাপ… ভয়ে কথা শেষ করতে পারল না মুসা।

বাক্সটা খুললে যদি…! রবিনও ভয় পাচ্ছে।

সিম্বুর কদাকার ছোট্ট মুখটার দিকে তাকিয়ে ভয় লাগছে ওদের। ফিসফিস করে বলল কিশোর, সিম্বু, আমরা তোমার কোন ক্ষতি করতে আসিনি। তোমার সোনা চুরি করার ইচ্ছেও আমাদের নেই। আমরা শুধু দেখতে চাই বাক্সের ভেতরে সোনাগুলো আছে কিনা।

আস্তে করে মূর্তিটা এক পাশে সরিয়ে রাখল কিশোর। বাক্স খোলার চেষ্টা করল। খুব মজবুত তালা। ওদের কাছে এই তালা খোলার যন্ত্র নেই।

 এখন কি করা? সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে কিশোরের দিকে তাকাল রবিন। সিম্বুকে নিয়ে যেতে পারি আমরা…

কথা শেষ হলো না তার। বিকট শব্দে বাজ পড়ল আবার।

রূট সেলারে পানি জমছে জানা কথা, কিশোর বলল। বেশি দেরি করলে ভরে যাবে। বেরোনোর উপায় থাকবে না আমাদের। তারচেয়ে চলো এখন চলে যাই। কাল বৃষ্টির পানি নেমে গেলে আবার আসা যাবে। তালা খোলার যন্ত্র নিয়ে আসব কাল।

ঠিক বলেছ, সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল মুসা। স্বস্তি পেল সিম্বুর প্রহরায় রাখা সোনা দেখতে গিয়ে তাকে রাগিয়ে দিতে হলো না বলে।

প্যাসেজওয়ে ধরে পিছিয়ে এল ওরা। রূট সেলারে ঢুকল। পানিতে থই থই করছে সেলার।

গর্ত থেকে পানি রানোর ব্যবস্থা করতে না পারলে সকালের মধ্যে সেলার পুরো ডুবে যাবে, নিচের দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর।

শাবল দিয়ে খুঁচিয়ে সেলার থেকে পানি সরে যাওয়ার জন্যে একটা মুখ তৈরি করল ওরা। সেলারের ছাত যাতে ভেঙে ধসে পড়তে না পারে, সেজন্যে তক্তা দিয়ে আটকে রাখার ব্যবস্থা করল।

করলাম তো, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর, কিন্তু থাকবে কিনা জানি না। চলে, যাওয়া যাক।

দড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এল ওরা।

মোটর সাইকেলে চড়ে হোটেলে ফিরল ওরা। কারও নজরে পড়ল না। দুপার সাদা মার্সিডিজটাও দেখতে পেল না কোথাও।

ঘণ্টাখানেক পরে রকি বীচ থেকে অপ্রত্যাশিত একটা ফোন এল। কিশোরের চাচী মেরিচাচীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অ্যাক্সিডেন্ট করেছেন। অপারেশন লাগবে।

চাচাকে খবর পাঠাল কিশোর। তক্ষণি বাড়ি যেতে তৈরি হলো। আফসোস করে বলল, সিম্বুর সোনা দেখা আর হলো না আমাদের। যাকগে, কি আর করা! চাচী ভাল হয়ে গেলে আবার আসব। এখন আমি এয়ারপোর্টে ফোন করছি টিকেটের জন্যে।

পরদিন সকালের ফ্লাইটের টিকেট পেল ওরা। এয়ারপোর্টে আসার পথে লক্ষ করল পিছু পিছু সাদা মার্সিডিজটাও আসছে।

বাজি ধরে বলতে পারি, আমাদেরকে চলে যেতে দেখে খুবই অবাক হচ্ছে দুপা, রবিন বলল।

*

মাসখানেক পরে তিন গোয়েন্দার হেডকোয়ার্টারে বসে গল্প করছে কিশোর, মুসা রবিন ও ওদের বন্ধু বিড ওয়াকার।

সিম্বুর গল্প শুনে বিড জিজ্ঞেস করল, সোনার বারগুলো দেখতে গিয়েছিলে আর?

গিয়েছিলাম, জবাব দিল কিশোর। তবে যেতে দেরি করে ফেলেছিলাম।

মানে? ভুরু কোঁচকাল বিড। তুলে নিয়ে গেছে নাকি কেউ গুপ্তধনগুলো?

না, মাথা নাড়ল কিশোর। বুড়োর বাড়ির পাশে যে রাস্তাটা বানানো হচ্ছিল, দেখে এসেছিলাম, পরের বার গিয়ে দেখি সেটা তৈরি হয়ে গেছে। বুড়োর বাড়ি ভেঙে ফেলেছে। টিলা সমান করে বাড়ির ওপর দিয়ে চলে গেছে ছয় লেনের, কংক্রিটের ঝকঝকে রাস্তা।

তারমানে, হতাশ হলো বিড, বুড়োর গুপ্তধন চিরকালের জন্যে চাপা পড়ে গেল মাটির নিচে।

গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা দোলাল কিশোর। হ্যাঁ। সিম্বু আর মনিবের জিনিস বেশ ভালমতই পাহারা দিয়ে রেখেছে। মনে হয় কাউকে ছুঁতে দেয়নি। দুপাকেও না।

.

.

ভূতের জাহাজ

মোটর বোট নিয়ে সাগরে বেড়াতে বেরিয়েছে তিন গোয়েন্দা। সময় পেলেই এ রকম বেরোয়। তবে আজ সাগরের মতিগতি সুবিধের ঠেকছে না। মাথায় সাদা ফেনা নিয়ে ফুঁসে উঠছে ঢেউ। বোটের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে উঠছে পানি।

কপালে হাত রেখে ঢেউ দেখতে দেখতে কিশোর বলল, ঝড় আসবে মনে হচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তীরে ফিরে যাওয়া দরকার।

হাতের চেটো দিয়ে মুখ থেকে পানির ছিটা মুছল মুসা। হাল ধরে রেখে বলল, হ্যাঁ। সন্ধ্যাও হয়ে আসছে। তবে তীর থেকে বেশি দূরে নই আমরা। বাড়ি ফিরে যাই চলো। আমি ইঞ্জিনের স্পীড বাড়াচ্ছি।

রবিন কিছু বলল না। তাকিয়ে আছে ঢেউয়ের দিকে।

মোটর বোট নিয়ে বেড়াতে বেরোয় ওরা, ঝড়-টর দেখে না তা-ও না। তবে সে-সম্ভাবনা দেখলেই দ্রুত উপকূলে ফিরে আসে।

অ্যাকসিলারেটরে চাপ বাড়াল মুসা। গতি পেয়ে লাফ মেরে ছুটল মোটর বোট।

হঠাৎ খকখক করে কাশতে শুরু করল ইঞ্জিন। তারপর থেমে গেল। স্থির হয়ে পানিতে ভাসতে লাগল বোট।

ইঞ্জিন স্টার্ট দেয়ার চেষ্টা করল মুসা। কাজ হলো না।

নাহ্, হচ্ছে না, হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল মুসা। কোথাও কিছু গড়বড় হয়ে গেছে।

ইঞ্জিনের ঢাকনা খুলে দেখতে শুরু করল সে। কাজ শেষ করে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, কই, কোথাও তো কোন গলদ দেখতে পাচ্ছি না। ট্রান্সমিশন, তেল, গ্যাস-সবই ঠিক আছে।

ইঞ্জিন স্টার্ট নিচ্ছে না কেন? রবিনের প্রশ্ন।

সাহায্য দরকার আমাদের। সাঁতার কেটে তো আর তীরে পৌঁছুতে পারব না, কিশোর বলল।

শিপ-টু-শোর রেডিও ট্রান্সমিটারের সুইচ অন করল সে। কিছুই ঘটল না। কয়েকবার সুইচ অন-অফ করল। পরীক্ষা করে দেখলতার, ব্যাটারি।

রেডিওতেও কোন সমস্যা দেখতে পাচ্ছি না, বিড়বিড় করল কিশোর। কিন্তু এটাও অকেজো হয়ে পড়েছে! অদ্ভুত ব্যাপার তো! এ কেমন ঝামেলায় পড়লাম।

সাঁঝের আঁধার ঘনিয়ে আসছে। সেই সাথে বাড়ছে বাতাস। বেড়ে যাচ্ছে ঢেউয়ের তীব্রতাও। ঢেউয়ের আঘাতে অসহায়ের মত পানিতে দোল খাচ্ছে বোট। আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছে না। কালো মেঘ ঢেকে রেখেছে নক্ষত্রপুঞ্জ। ঠাণ্ডায় গায়ে কাটা দিতে লাগল ওদের। শীত করছে।

অবস্থা দেখে তো মনে হচ্ছে সারা রাত এখানেই কাটাতে হবে, অস্পষ্ট স্বরে বলল রবিন। ঢেউয়ের ধাক্কায় বোট উন্টে না গেলেই বাঁচি।

কেউ যে আমাদের এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে সে-চান্সও নেই, মুখ কালো হয়ে গেছে কিশোরের। এক হাত দূরের জিনিসও দেখা যায় না। জাহাজ-টাহাজ এলেও আমাদের দেখতে পাবে না।

হঠাৎ অন্ধকার কুঁড়ে কালো, প্রকাও কি একটা ওদের সামনে ছুটে আসতে লাগল। কর্কশ একটা কণ্ঠ ভেসে এল সাগর থেকে কে তোমরা?

জাহাজ! উল্লসিত হয়ে উঠল মুসা। আমাদেরকে দেখতে পেয়েছে। মুখের সামনে দুই হাত জড় করে এনে চিৎকার করে জবাব দিল, আমরা সাগরে আটকা পড়েছি। আমাদেরকে আপনাদের জাহাজে তুলে নেবেন?

দাঁড়াও। আসছি, জবাব এল।

কালো পাহাড়ের মত জিনিসটা এগিয়ে এল ওদের দিকে, থেমে পড়ল বোটের পাশে।

জাহাজটা বিশাল। বাতাসে দুলতে থাকা লণ্ঠনের আলোয় গলুই চোখে পড়ছে। তার নিচে সাদা অক্ষরে লেখা: অ্যাড্রিয়াটিক পাঞ্চ।

অদ্ভুত নাম! বিড়বিড় করল রবিন।

 বোট লক্ষ্য করে জাহাজ থেকে একটা.দড়ির মই ছুঁড়ে দেয়া হলো।

মইটা দুহাতে ধরে ফেলল কিশোর। দ্রুত উঠে এল ওপরে।

বোটের সাথে মই বেঁধে ফেলল মুসা। রবিনকে উঠে যাওয়ার সুযোগ দিল। তারপর নিজেও অনুসরণ করল তাকে।

লাফ মেরে জাহাজের রেলিং টপকাল তিনজনে। দাঁড়াল এসে প্রকাণ্ড ওক কাঠের ডেকে। পুরানো আমলের লণ্ঠনের মিটমিটে আলোয় দেখল এটা একটা পাল তোলা জাহাজ। বাতাসে পতপত করে উড়ছে পাল। মূল মাল খাড়া উঠে গেছে অন্ধকার আকাশে। একটা কাঠের সিঁড়ির মাথা গিয়ে ঠেকেছে হুইল হাউজে।

ডেকে বেশ কয়েকজন রুক্ষ চেহারার নাবিক। সবার পরনে পুরানো আমলের পোশাক। দাঁড়িয়ে আছে নিঃশব্দে। ভ্রু কুঁচকে দেখছে ওদেরকে। একজনের হাতে একটা হাপুন। অস্ত্রটা ভীতিকর ভঙ্গিতে দোলাল সে।

ট্রেনিং শিপ, নিচু গলায় দুই সহকারীকে বলল কিশোর। মনে হচ্ছে।

এমন ভূতুড়ে ট্রেনিং শিপ জীবনে দেখিনি আমি, ফিসফিস করল মুসা।

নোনা পড়া জ্যাকেট গায়ে এক লোক এগিয়ে এল ওদের সামনে। লোকটা লম্বা, মুখভর্তি কালো দাড়ি। তীক্ষ্ণ, কালো চোখ। কথা বলার সময় গলার স্বর শুনে গোয়েন্দারা বুঝল, খানিক আগে এই লোকই ওদের পরিচয় জানতে চেয়েছিল।

নাম কি তোমাদের? কর্কশ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল লোকটা।

 নিজেদের পরিচয় দিল কিশোর।

ঘোৎ-ঘোৎ করে উঠল লোকটা। তোমরা যে-ই হও তাতে আমার কিছু এসে যায় না।

সাহস করে জানতে চাইল রবিন, আপনি কে?

আমি এডওয়ার্ড নাইল। অ্যাড্রিয়াটিক পাঞ্চের ক্যাপ্টেন। তিমি শিকারী জাহাজ এটা। আমরা এসেছি নাটুকেট থেকে। ওখানেই ফিরে যাচ্ছি আবার। শক্ত সমর্থ কয়েকজন লোক দরকার আমাদের। তোমাদেরকে দিয়ে কাজ হবে মনে হচ্ছে। নানটুকেট না পৌঁছা পর্যন্ত তোমরা আমার ক্রু হিসেবে কাজ করবে।

অবাক হয়ে পরস্পরের দিকে তাকাল তিন গোয়েন্দা। এ লোক বলছে কি? উনবিংশ শতাব্দীর পরে আর কোন পাল তোলা তিমি শিকারীর জাহাজ তৈরি করা হয়নি। লোকটা ঠাট্টা করছে ভেবে কিশোর বলল, ক্যাপ্টেন নাইল, আপনার জাহাজে থাকতে আসিনি আমরা। আমাদের ইঞ্জিন খারাপ হয়ে গেছে। মেরামতের জন্যে লোক দরকার। দয়া করে যদি বোটটা সহ আমাদের তীরে পৌঁছে দেন, কৃতজ্ঞ থাকব।

ইঞ্জিন? ইঞ্জিন আবার কি জিনিস? খেঁকিয়ে উঠল নাইল।

লোকটা কি রসিকতা করছে নাকি! কিশোর বলল, জাহাজ চালাতে আপনার শক্তির দরকার হয় না?

গাধা নাকি! হয় না মানে? শক্তি ছাড়া জাহাজ চলে? সেজন্যেই তো বাতাস দরকার, আর বাতাসের শক্তিকে ব্যবহার করার জন্যে পাল! গমগমে গলায় বলল ক্যাপ্টেন। এ ছাড়া সাগরে জাহাজ চালাতে আর কোনও শক্তি জোগাড় করতে পারবে তুমি? আরেকটা কাজ অবশ্য করা যায়-সাগরে লগি ঠেলে জাহাজ চালাতে পারো।

ক্যাপ্টেনের কথা শুনে হো হো হাসিতে ফেটে পড়ল নাবিকরা। নাইলও হাসছে। যেন খুব মজার একটা রসিকতা করে ফেলেছে।

লোকগুলো ভারী অদ্ভুত! রাগ লাগল কিশোরের। চলো। এই পাগলদের সঙ্গে থাকার চেয়ে নিজেদের বোটে নেমে যাই। উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে ভেসে থাকব, সে-ও ভাল।

রেলিং-এর ধারে ছুটে এল ওরা। যেখান দিয়ে মই বেয়ে উঠেছে। উঁকি দিল।

সাথে সাথে জমে গেল যেন।

 বোটটা নেই!

ধরো ওদেরকে! নাইল হুকুম দিল তার দেরকে। ধরো! ধরো!

নাবিকরা ছুটে এসে ধরে ফেলল তিন গোয়েন্দাকে। জোর করে নিয়ে এল মাঝ ডেকে। ক্যাপ্টেন নাইল গনগনে মুখ নিয়ে দাঁড়াল ওদের সামনে।

তোমাদের মতলব ভালই বুঝতে পারছি আমি, কর্কশ কঠে বলল সে। তোমরা অন্য তিমি শিকারীদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে চাইছ। কিন্তু সে-সুযোগ আর পাবে না। পাঞ্চেই থাকতে হবে তোমাদেরকে আমরা কেপ হন হয় প্রশান্ত মহাসাগরে যাচ্ছি। তোমাদেরকে তিমি শিকারী বানিয়েই ছাড়ব। আমাদের কথা না কালে স্রেফ হাওরের মুখে ছুঁড়ে ফেলে দেব।

অবাক লাগছে কিশোরের। না বলে পারল না, প্রশান্ত মহাসাগরেই তো রয়েছি আমরা। আবার যাব কি ওখানে?

আমাকে জাহাজ চালানো শেখাবে, না? খেঁকিয়ে উঠল ক্যাপ্টেন। চল্লিশ বছর ধরে সাগরে সাগরে ঘুরছি, আমাকে সাগর চেনাবে। আর একটা কথা বলেই কি ভাল হবে না বলে দিলাম।

নাইলের হুমকি তিন গোয়েন্দার মেরুদণ্ডে ঠাণ্ডা শিহরণ জাগাল। কিশোরের মনে হলো একদল পাগলের কবলে পড়েছে। মুসা আর রবিনের মনে শচ্ছে জ্যান্ত দুঃস্বপ্ন দেখছে।

হুইল হাউজের দিকে ঘুরল নাইল। চেঁচিয়ে আদেশ দিল, ডেভিড পুকার। এখানে এসো।

বিশালদেহী, মোটাসোটা এক নাবিক হাজির হলো হুইল হাউজের সামনে। সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল ডেকে। নাইল তাকে হুকুম করল তিন গোয়েন্দাকে নিচে নিয়ে যেতে। ডিউটির জন্যে প্রস্তুত করতে হবে।

পুকার নিয়ে চলল ওদের। পেছন থেকে ভেসে এল ক্যাপ্টেন এবং তার আজব নাবিকদের ভৌতিক হাসি।

আমি ফাস্ট মেট, সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় নিজের পরিচয় দিল পুকার। ডিউটি যখন থাকবে না, তখন তোমরা কোথায় থাকবে দেখিয়ে দিচ্ছি।

এ সব কি ঘটছে কিছুই বুঝতে পারছি না, মুসা বলল।

কি ঘটছে ঠিকই জানো তোমরা, কড়া গলায় বলল ফাস্ট মেট।

না, জানি না! প্রতিবাদ করল কিশোর।

 সিঁড়ির শেষ মাথায় এসে ঘুরে দাঁড়াল পুকার। ধমকে উঠল, তাহলে আগে জেনে নাও কি কি করতে হবে তোমাদের। সব সময় নির্দেশ মেনে চলবে। নির্দেশ অমান্যকারী নাবিককে সাগরে, হাঙরের মুখে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়।

ক্যাপ্টেন নাইলের হুমকির কথা মনে পড়তে কেঁপে উঠল রবিন।

ওদের নিয়ে ক্রুদের লিভিং কোয়ার্টার্সে চলে এল পুকার। বেশ বড় ঘর। দেয়ালের সাথে লাগানো কতগুলো বাঙ্ক। প্রতিটি বাঙ্কের নিচে ঝুলছে একটা করে হারপূন। হারপূনের পাশে বর্ষাতি আর সাউথ ওয়েস্টার। ঝড় বাদলার দিনে চামড়ার জ্যাকেটের ওপর বর্ষাতি চাপাতে হয়। মাথা ঢাকতে হয় সাউথ ওয়েস্টার দিয়ে।

*

ওই খালি বাঙ্ক তিনটে তোমাদের, হাত তুলে দেখাল ফাস্ট মেট। ডেকে কাজ করার জন্যে রেডি হয়ে তাড়াতাড়ি চলে এসো।

হুকুম দিয়ে চলে গেল সে।

চলতে শুরু করেছে জাহাজ, টের পেল ওরা। কাঁচকোচ করছে কড়িকাঠ, দুলছে এদিক-ওদিক। মাথার ওপর একটা লণ্ঠন জ্বলছে মিটমিট করে। চর্বি আর তেলের গন্ধ আসছে ওটা থেকে।

তিমির তেল, মন্তব্য করল রবিন।

সায় দেয়ার ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল কিশোর। গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে সব ধরনের জ্বালানি ব্যবহার করার অভিজ্ঞতা হয়েছে ওদের। তাই গন্ধ পেয়েই বুঝতে পেরেছে লণ্ঠন জ্বলছে তিমির তেলে।

যদ্দুর জানি, বলল কিশোর, কেরোসিনের ব্যবহার শুরু হবার পর থেকে তিমির তেলের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তাহলে ওটা এল কোত্থেকে? আসলে ঘটছে কি এখানে?

কিছুই বুঝতে পারছি না, জবাব দিল মুসা। তবে মন বলছে সাবধানে থাকা  দরকার। ভূত-প্রেত…

আরে ধুত্তেরি তোমার ভূত-প্রেত! খেঁকিয়ে উঠে তাকে থামিয়ে দিল কিপোর। সারাক্ষণ খালি ভূতের ভয়…

 বাঙ্কে এসে শুয়ে পড়ছে নাবিকরা। তাদের দিকে হাসি মুখে তাকাল রবিন। কিন্তু ওর দিকে ভাবলেশহীন মুখে তাকিয়ে রইল তারা।

আমরা এখানে নতুন, ভাব জমানোর চেষ্টা করল জো। কিন্তু পাথর-মুখ করেই থাকল জাহাজীরা।

নাবিকরা শুনেছি হাসিখুশি থাকে, বিড়বিড় করল কিশোর। কিন্তু এরা তো কবরের লাশ একেকটা।

বললেই তো খেপো, গম্ভীর কঠে মুসা বলল। কিন্তু না বলেও পারছি না। লোকগুলোর মতই জাহাজটাকেও ভূতুড়ে মনে হচ্ছে আমার।

এ জাহাজে বেশিদিন থাকতে হলে আর ভূতের প্রয়োজন পড়বে না, বলার সময় গলার স্বর কেঁপে উঠল রবিনের। নিজেরাও ভূত হয়ে যাব।

সমর্থন পেয়ে খুশি হয়ে তুড়ি বাজাল মুসা, এতক্ষণ ধরে ঠিক এই কথাটাই বোঝাতে চাইছি আমি।

ওদের কাছে বসা যামার্কা চেহারার এক নাবিক তার হারপূনের ধারাল, লম্বা ফলায় তেল মাখছে। সেই সাথে পালিশ করছে কাঠের ডাটা। একটা উকো হাতে নিল সে। ঘষে ঘষে ডগাটা তীক্ষ্ণ ও ধারাল করে তুলল। উকোটা লম্বা, মাছ ধরার বঁড়শির মত বাকানো।

লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল কিশোর। উঁকো দেখতে দেখতে বলল, বিপদজনক অস্ত্র মনে হচ্ছে।

বিপজ্জনক তো বটেই। তবে তিমির জন্যে, ঘেৎ-ঘোৎ করে উঠল লোকটা। কিছু বোকা ছাগলের জন্যেও, বাজি ধরে বলতে পারি, নইলে নাম বদলে রাখব আমার।

কি নাম আপনার খাতির জমানো ভঙ্গিতে নিরীহ স্বরে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

হোগার্ট ল্যাম্বার্ট, খসখসে কণ্ঠে জবাব দিল লোকটা। কি, নাম শুনে কোন সুবিধে হলো, বোকা হাগল?

ল্যাম্বার্টের ভাবভলি মোটেও সুবিধের পাগল না কিশোরের কাছে। আর কিছু বলল না তাকে। ওদের চেয়ে দুএক বছরের বড় এক কিশোরের সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করল। একে ওর মত লাগছে না। তোমার নামটা কি, ভাই?

বাফার। আমি নিউ বেডফোর্ড থেকে এসেছি। আমার বাপ-দাদারা বহু কালের পুরানো তিমি শিকারী।

এক প্রশ্ন করে তিনটের জবাব পেয়ে গিয়ে উৎসাহ বেড়ে গেল কিশোরের। জিজ্ঞেস করল, আহা, এডওয়ার্ড পাঞ্চের ব্যাপারটা কি, বলো তো?

বিস্মিত দেখাল বাফারকে। কেন, এটা নানৗঁকেটের একটা তিমি শিকারী জাহাজ।

যাচ্ছে কোথায়?

কেপ হর্ন। কিন্তু আমাকে এ সব প্রশ্ন করছ কেন? জাহাজ কোথায় যাচ্ছে যদি না-ই জানো তাহলে উঠলে কেন?

কিশোর কিছু বলার আগেই রবিন বলে উঠল, আমি তো জানতাম, কেপ হর্নে তিমি শিকার করা হত উনবিংশ শতব্দীতে।

আরও অবাক হলো বাফার। তা তো বটেই। আর এটা তো উনবিংশ শতাব্দীই। ১৮৫০ সাল।

বাফারের কথা শুনে হাঁ হয়ে গেল তিন গোয়েন্দা। ওদের কথা শুনছিল ল্যাঘাট। মুখ বাকিয়ে বলল, কোন্ সাল তা-ও জানে না! এমন বোকা তো জীবনে দেখিনি।

বাফার ছাড়া বাকি সবাই তিন গোয়েন্দার বোকামিতে হেসে উঠল। খনখনে, ভৌতিক হাসি। গা শিরশির করে উঠল গোয়েন্দাদের।

কিন্তু রেগে গেল মুসা। নাবিকদের দিকে তাকিয়ে ফেটে পড়ল, আমরা জানি এটা কোন্ সাল! আর এখান থেকে যে এখুনি চলে যাওয়া উচিত তা-ও জানি। আপনারা থাকুন আপনাদের অ্যাড্রিয়াটিক পাঞ্চ আর তিমি নিয়ে। আমরা গেলাম…

কটমট করে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে আচমকা ঝটকা দিয়ে হারপূনটা তুলে নিল ল্যাম্বার্ট। ছুঁড়ে মারল ওকে লক্ষ্য করে।

সাঁৎ করে সরে গেল মুসা। অল্পের জন্যে মিস হলো ধারাল অস্ত্রটা। ঘ্যাঁচ করে বিধল গিয়ে জাহাজের গায়ে। তিরতির করে কাঁপতে থাকল ওটার দণ্ডটা।

বাপরে! আরেকটু হলেই তো গেছিলে! ঢোক গিলল রবিন।

 সাবধান! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। বিপদ এখনও কাটেনি।

দলবল নিয়ে ছুটে এল ল্যাম্বার্ট। আত্মরক্ষার জন্যে তৈরি হলো তিন গোয়েন্দা। হাত বাড়িয়ে দিল কারাতে মারের ভঙ্গিতে।

খেক খেক করে হেসে উঠল জাহাজীরা। ধরার জন্যে হাত বাড়াল।

ঠিক সেই মুহূর্তে ডেক থেকে ভেসে এল চিৎকার। তিমি! তিমি! ওই যে, বাঁ দিকে!

দোরগোড়ায় হাজির হলো পুকার। এই জলদি এসো তোমরা!…কিশোর, মুসা, রবিন-তোমরাও তোমাদের হারপূন নিয়ে ডেকে চলে এসো।

আপাতত ল্যাম্বার্টের দলের হাত থেকে বেঁচে গেল তিন গোয়েন্দা। অকারণে মারমুখী হয়ে ওঠা নাবিকরা ছেড়ে দিল ওদেরকে। কিশোর, মুসা ও রবিন যার যার বাকের মাঝখান দিয়ে হেঁটে দরজার দিকে এগোল। তরতর করে উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে।

এখনও চারদিকে অন্ধকার। তবে সাগর আগের চেয়ে শান্ত। মৃদু ঢেউয়ের ওপর দিয়ে ধীর গতিতে চলেছে জাহাজ।

ক্যাপ্টেন কুপারের আদেশে দশ-বারো জন নাবিক একটা তিমি শিকারের নৌকা পানিতে ভাসানোর তোড়জোড় করছে। কপিকলের সাহায্যে শিকলে বাঁধা নৌকা নামানো হলো জাহাজের এক পাশে। খানিক নেমে শূন্যে ঝুলে রইল নৌকাটা।

দেখতে দেখতে বলে উঠল কিশোর, এখানে তিমি এল কোত্থেকে?

কেপ হর্ন হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে এসে পড়েছি, কড়া গলায় বলল ক্যাপ্টেন। এখানেই তো তিমির আড্ডা।

অবাক হয়ে রবিন বলল, এক রাতের মধ্যে কেপ হর্ন পৌঁছা কি সম্ভব? অ্যাটমিক জেট প্লেনের পক্ষেও এত দ্রুত চলা সম্ভব না।

জেট প্লেন! জিনিসটা কি? ক্যাপ্টেনের কণ্ঠে সন্দেহের সুর। আর অ্যাটমিক কথাটারই বা মানে কি?

কাঁধ ঝাঁকাল রবিন। আরও একশো বছর পার না করে দিলে এ প্রশ্নের জবাব জানতে পারবেন না।

মানে! কি বলছ তুমি?

বলছি বিংশ শতাব্দীর কথা। জেট প্লেন জিনিসটা বিংশ শতাব্দীর আকাশ যান।

ছোঁড়াটার মাথাটাই গেছে, বিড়বিড় করল নাইল। ওর কথার মাথামুণ্ডু তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

কনুই দিয়ে রবিনকে গুঁতো লাগাল কিশোর। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, বেশি কথা বলে আর ঝামেলা বাড়িয়ে না তো।

তিমি শিকারের নৌকা পানিতে ভেসে পড়তে প্রস্তুত। নাবিকরা উঠে পড়ল নৌকায়। বৈঠা ধরে বসল। পুকার চলে এল নৌকার মাঝখানে।

কিশোর পাশা, হারপুন ছোঁড়ার দায়িত্ব তোমার। তুমি গলুইয়ে গিয়ে বসো, আদেশ দিল ফাস্ট মেট। মুসা আমান, তুমি ধরবে হাল। রবিন, তুমি পেছন দিকের একটা বৈঠার ধারে বসো।

নৌকায় চড়ে যে যার জায়গায় বসে পড়ার পর কপিকলের লোকজন চাকা ঘুরিয়ে নৌকাটা পানিতে নামিয়ে দিল। দাড়িরা বৈঠা বাইতে শুরু করল। ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে অ্যাড্রিয়াটিক পাঞ্চ থেকে। ডেভিড পুকারের নির্দেশমত হাতল ঘুরিয়ে কোর্স ঠিক রাখছে। উদ্যত হারপূন হাতে গলুইয়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর।

ওই যে তিমির ফোয়ারা! তিমির ফোয়ারা! তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল পুকার। মুসা, বাঁ দিকে ঘুরাও।

তাড়াতাড়ি বয়ে কাটল মুসা। কই, আমি তো কিছু দেখছি না।

কানা নাকি? বেঁকিয়ে উঠল পুকার, তোমার কিছু দেখার দরকার নেই। যা বলছি করো। নইলে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেব সাগরে।

অন্ধকার পানিতে বাঁ দিকে মোড় নিয়ে ছুটে চলল নৌকা। মাথার ওপরে কালো মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে একটা তারা। বৈঠা পানিতে পড়ছে আর উঠছে ছন্দময় গতিতে।

এই যে এসে পড়েছি, ঘোষণা করল পুকার। কিশোর পাশা, হারপূন ছোড়ো।

এদিক-ওদিক মাথা নাড়ল কিশোর। কই, তিমি কই? কিসের গায়ে ছুঁড়ব?

ওই যে তিমি। ছুঁড়লেই বুঝবে কিসের গায়ে পড়েছে, খেক খেক করে উঠল ফাস্ট মেট।

হারপূন ছুঁড়ল কিশোর। তারপর রশি ধরে টে। তুলল অস্ত্রটা। কোন কিছুর গায়ে হারপূন বেঁধেনি দেখে মন মনে খুশি হলো ও।

রাগে কাঁপতে লাগল পুকার। তিমিটাকে মিস করেছ তুমি! ইচ্ছে করে ওটাকে পালিয়ে যেতে দিয়েছ।

কিশোরের কথা সমর্থন করে রবিন বলল, আমারও কিন্তু কোন তিমি চোখে পড়েনি।

নিশ্চয় তারমানে ভুল দিকে নৌকা ঘুরিয়েছ! চিৎকার করে উঠল পুকার। দাঁড়াও, জাহাজে ফিরে নিই। তারপর বোঝাব মজা। ক্যাপ্টেনের কাছে নালিশ করে তিনজনের পিঠের চামড়া না ছাড়িয়েছি তো আর কি বলব-নাও, ঘোরো এখন। পুরো এক পাক ঘোয়রা। আবার দেখা যেতে পারে তিমিটাকে। এবার যদি মিস করো কিশোর পাশা, তাহলে… দাঁতে দাঁত চাপল ফার্স্ট মেট।

হাল ঘুরিয়ে আবার নৌকার মুখ ঘোরাল মুসা। ছপাৎ-ছপাৎ দাঁড় ফেলছে দাড়িরা। গলুইয়ে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সাগরে চোখ বোলাচ্ছে কিশোর। নৌকাটা চক্কর মেরে মেরে ঘুরতেই থাকল।

তিমির চিহ্নও দেখা গেল না আর। হাল ছেড়ে দিল পুকার। জাহাজে ফিরে যাওয়ার হুকুম দিল।

জাহাজের কাছে এসে গা ঘেঁষে দাঁড়াল নৌকা। ওপর থেকে দড়িতে বাধা হুক নামিয়ে দেয়া হলো। সেগুলোতে আটকে আবার জাহাজে তুলে নেয়া হলো নৌকা। আগের জায়গায় ঝুলিয়ে রাখা হলো।

তিমিটাকে মারতে পারিনি ক্যাপ্টেন, ক্ষোভের সঙ্গে রিপোর্ট করল পুকার। এ জন্যে ওই ছোকরা তিনটে দায়ী।

এ কথা শুনে রেগে আগুন হলো নাইল। হুকুম দিল, জেলে ভরে তালা দিয়ে রাখোগে!

তিন গোয়েন্দাকে ঠেলা-ধাক্কা মেরে নিচে নিয়ে আসা হলো। একটা শিক লাগানো ছোট ঘরে ঢোকানো হলো। এটাই জাহাজের জেলখানা। সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল দরজা। ওদেরকে একা রেখে চলে গেল জাহাজীরা। তিমির তেল ভরা একটা লণ্ঠন মিটমিট করে জ্বলছে গারদে। গোটা দুয়েক কাঠের বাঙ্ক আর মাঝখানে একটা ছোট টেবিল ছাড়া আর কোন আসবাব নেই ঘরটাতে। বাঙ্কে বসল। পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল।

ঘটনা দেখছি জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে, মন্তব্য করল মুসা। একটা ভূতুড়ে জাহাজের কতগুলো নাবিক-ভূতের হাতে আমরা এখন বন্দী।

আর এজন্যে দায়ী একটা ভূতুড়ে তিমি, খিটখিটে গলায় যোগ করল রবিন।

নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে কাটতে কিশোর বলল, অথচ পুকার বলছে সে তিমিটাকে দেখেছে।

আমাদেরকে ফাঁসানোর জন্যে বলেছে, এ তো সোজা কথা। আর নাইল যে ওর কথাই বিশ্বাস করবে সেটাও স্বাভাবিক। তবে আমার কি মনে হয় জানো-পুকার নিজেই একটা ভূত।

কিশোরের দিকে তাকাল মুসা। ওরা আমাদের নিয়ে কি করবে বলো তো?

জবাবে নিচের ঠোঁটে একটা টান দিয়ে ছেড়ে দিল কিশোর। বুঝতে পারছি না।

চুপ হয়ে গেল তিনজনেই। নাইলের হুমকির কথা ভাবছে ওরা।

নাইল আমাদেরকে হাঙর দিয়ে খাওয়াবে বলেছে, নীরবতা ভাঙল মুসা। হারে-ভূত বলে আবার কিছু নেই তো? আর ওগুলো নিশ্চয় মানুষখেকো নয়?

হাঙরের মানুষখেকো হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, বলল কিশোর। সেটা আসল হাঙরই হোক, কিংবা ভূতুড়ে…।

হঠাৎ সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা গেল। লাফিয়ে সিধে হয়ে বসল ওরা।

পায়ের আওয়াজ ক্রমে কাছিয়ে আসছে। একটু পরেই লোকটাকে দেখা গেল। ল্যাম্বার্ট। ডান হাতে একটা হারপূন। ঘরের মাঝখানে চলে এল তিন গোয়েন্দা। লোকটা কোন মতলবে এসেছে দেখতে চায়।

তোমাদের দোষেই আজ তিমিটাকে হারাতে হলো, নাক সিটকাল ল্যাম্বার্ট। কিভাবে নৌকা বাইতে হয়, কিভাবে হারপূন দিয়ে মাছ শিকার করতে হয়, কিছু জানো না তোমরা। আমি থাকলেই হয়েছিল আজ। তিমির বাপও আমার হাত থেকে বাঁচতে পারেনি কোনদিন।

মুচকি হাসল কিশোর। আপনার বদলে হারনার হিসেবে আমাকে পাঠানোটা আসলে সহ্য হচ্ছে না আপনার।

শুনে মুখ লাল হয়ে গেল ল্যাম্বার্টের। হারপূন ছুঁড়ে মারল দুই গরাদের ফাঁক দিয়ে।

ব্যাপারটা আগেই আঁচ করতে পেরেছিল মুসা। চট করে টেবিলটা দুহাতে তুলে ধরল, ঢালের মত করে। টেবিলে লাগল হারপূন। এত জোরে আঘাত হানল, কাঠ ফুটো করে ফেলল ধারাল ফলা। কয়েক ইঞ্চির জন্যে মুসার গায়ে বিধল না।

টেবিলটা নামিয়ে রাখল সে। হাতের চেটো দিয়ে মুখের ঘাম মুছল। একটানে টেবিল থেকে খুলে আনল হারপূন।

ল্যাম্বার্ট, এ নিয়ে দ্বিতীয়বার হলো। আর ছাড়ব না তোমাকে, বলেই হারপূন তুলল ল্যাম্বার্টকে সই করে।

 বেগতিক দেখল ল্যাম্বার্ট। ধীরে ধীরে পিছু হঠল সে। তারপর আচমকা ঘুরে দাঁড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে ছুটে পালাল।

গারদের এক কোনায় হারপূনটা ছুঁড়ে ফেলে দিল মুসা। হাসতে হাসতে বলল, সত্যি সত্যি মারতাম না। তয় দেখালাম শুধু। তবে জিনিসটা আর হাতে নিতে দিচ্ছি না ওকে। তিমি শিকারে যাবার সময় ফাস্ট মেটকে হারপূন হারানোর কি ব্যাখ্যা দেবে তাই ভাবছি।

এমন সময় আবার কার পায়ের শব্দ শোনা গেল সিঁড়িতে।

আবার বোধহয় এসেছে ল্যাম্বার্ট, নিচুস্বরে বলল রবিন। মারামারি করতে। কিংবা হারপূনটা ফেরত নিতে।

বেশ। এবার আমরাও প্রস্তুত, হারপূন তুলে নিল কিশোর। আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে বাগিয়ে ধরল অস্ত্রটা।

তবে আগন্তক ল্যাম্বার্ট নয়, বাফার।

ওকে দেখে হারপূন নামাল কিশোর।

জেলখানার দিকে আসার সময় বারবার পেছন ফিরে দেখছে বাফার। আমার এখানে আসা উচিত হয়নি, ফিসফিস করল বাফার। আমার ডিউটি এখন ওপরে। তোমাদের একটা জরুরী কথা জানাতে এসেছি?

কি? জানতে চাইল রবিন।

ক্যাপ্টেন তোমাদেরকে এখনই হাঙরের মুখে ফেলে দিত। জেলে পুরে রাখার কারণ তোমাদেরকে তার দরকার হতে পারে। তবে নানটুকেটে ফেরার আগে হাঙরের মুখে ফেলবেই, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

তারমানে তার আগেই আমাদেরকে এখান থেকে কেটে পড়তে হবে, কিশোর বলল। তুমি আমাদের সাহায্য করবে?

দরকার হলে লড়াই করব, বুকে চাপড় দিয়ে বলল মুসা। বিনা যুদ্ধে নাহি দেব…

এদিক-ওদিক মাথা নাড়ল বাফার। আমি সাধারণ একজন ডেকহ্যান্ড। তোমাদেরকে রা করার ক্ষমতা আমার নেই। আর মুক্তি পেলেও লাভ হবে না। কারণ এখন আমরা মাঝ সমুদ্রে। কি করবে তোমরা? হাজার মাইল পথ সাঁতার কেটে ডাঙায় উঠবে?

তিমি শিকারের নৌকা নিয়ে পালাতে পারি, উত্তেজিত গলায় বলল রবিন।

আবার মাথা নাড়ল বাফার। হুইল হাউজ আর ডেকে সব সময়ই কেউ না কেউ নজর রেখে চলেছে। ধরা পড়ে যাবে। তা ছাড়া নৌকা পানিতে নামানোও এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। শব্দ না করে পারবে না। যাকগে, তোমাদেরকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই

করো, কিশোর বলল। শত হলেও তুমি ঝুঁকি নিয়ে নিচে এসেছ। সাবধান করে দিয়েছ আমাদের।

তোমরা এমন অদ্ভুত ভাবে কথা বলছ কেন? জানতে চাইল বাফার। এটা ১৮৫০ সাল। অথচ তোমরা বিংশ শতাব্দীর কথা বলছ। পালের বদলে অন্য শক্তির কথা বলছ। ঘটনাটা কি?

দ্রুত দৃষ্টি বিনিময় করল দুই গোয়েন্দা। এ সব কি বলছে ছেলেটা?

ওকে যে আমরা ভূত ঠাউরে বসে আছি তা বলা যাবে না, ফিসফিস করে কিশোরের কানে কানে বলল মুসা।

মাথা আঁকাল কিশোর। সত্যি কথা বলব? বাফারকে বলল সে, এটা আসলে কোন সাল সেটাই শিওর হতে পারছি না আমরা।

দেয়ালে ঝোলানো একটা ক্যালেন্ডার দেখাল বাফার। বড় বড় অক্ষরে তাতে লেখা: ১৮৫০ সাল।

এর মানেটা দাঁড়াচ্ছে, বিড়বিড় করল মুসা, এই জাহাজটাতেই কেবল সময় বদলে গেছে। পিছিয়ে গেছে। এখানে থাকলে এই সালটাকেই মেনে নিতে হবে আমাদের।

ভুরু কুঁচকে গেল বাফারের। তোমরা পাগলা গারদ-টারদ থেকে পালিয়ে আসোনি তো? উদ্বিগ্ন শোনাল তার কণ্ঠ।

না, পাগলা গারদ থেকে পালাইনি, তাকে আশ্বস্ত করল কিশোর। তবে এই জাহাজ থেকে পালাতে চাই।

সায় দেয়ার ভঙ্গিতে মাথা দোলাল বাফার। পরে যদি সম্ভব হয় সাহায্য করব তোমাদের। এখন ডিউটিতে যেতে হবে, কথা শেষ করে সিঁড়ি বেয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল সে।

মাথার নিচে হাত রেখে বাঙ্কে শুয়ে পড়ল কিশোর। আরেকটা বাঙ্কে গিয়ে বসল রবিন। টেবিলের ওপর উঠে বসল মুসা। পা ঝোলাতে লাগল। ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আলোচনা করতে লাগল ওরা। বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করল।

সমস্যাটা হলো, মন্তব্য করল কিশোর, ভূত না আসল মানুষ সেটাই বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে একদল পাগলের সঙ্গে চলেছি আমরা। কিন্তু ওদের কাজ কর্ম দেখে তো পাগল বলেও মনে হচ্ছে না।

ভূত! ভূত! কোন সন্দেহই নেই আমার, মুসা বলল। তুমি তো আর বিশ্বাস করবে না।

নাকি কোনও ধরনের টাইম মেশিনের মধ্যে পড়ে গেলাম আমরা? রবিনের প্রশ্ন। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্যময় কোন কিছুতে? এক টানে সময়কে পার করে নিয়ে এসেছে ১৮৫০ সালে!

মাথা চুলকাল মুসা। তা তো বুঝলাম। কিন্তু আবার নিজেদের সময়ে ফিরে যাব কি করে?

চালাকি করতে হবে আরকি আমাদের, রবিন বলল। ক্যাপ্টেন নাইল আমাদেরকে এখান থেকে বের করলে এমন ভান করব যেন আমরা খুব ভাল নাবিক। জাহাজের নানা কাজে লাগছি দেখলে হয়তো তার মন বদলাতেও পারে। তখন নিশ্চয় আর আমাদের সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলার চিন্তা করবে না।

বুদ্ধিটা মন্দ না, হাতঘড়িতে নজর বোলাল কিশোর। আমরা জাহাজে উঠেছি মাত্র কয়েক ঘণ্টা। এর মধ্যে এত কিছু ঘটল কি করে?

জবাবে মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ গা-টা কেন যেন শিরশির করে উঠল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। নাবিকের পোশাক পরা এক লোককে ওদের জেলখানার দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে গেল। মুসার দৃষ্টি অনুসরণ করে একই দিকে তাকাল কিশোরও।

লোকটা নীরবে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। ভূতুড়ে একটা আকৃতি। মুখটা অস্বাভাবিক সাদা। সরু, সাদা সাদা লম্বা আঙুল দিয়ে চেপে ধরেছে জেলের গরাদ। চেহারায় কোন ভাবান্তর নেই। নীল চোখ জোড়া স্থির।

লোকটা এখানে এল কি করে? জড়ানো গলায় বলল মুসা। সিঁড়িতে ওর পায়ের শব্দ পাইনি।

উঠে বসল কিশোর। আমিও না।

রবিন বলল, লোকটাকে এ জাহাজের কেউ মনে হচ্ছে না।

তার পেছন পেছন যাওয়ার জন্যে হঠাৎ ইশারা করল ওদেরকে রহস্যময় আগন্তুক।

কে আপনি? প্রশ্ন করল কিশোর। আপনার সঙ্গে আমাদের যেতে বলছেন কেন?

বেরোতে যে বলছেন, বেরোব কি করে? ইঙ্গিতে বন্ধ দরজাটা দেখাল মুসা। ফাস্ট মেট দরজায় তালা মেরে রেখে গেছে। চাবি আছে নাকি আপনার কাছে?

ওদেরকে তাজ্জব করে দিয়ে তালায় হাত রাখল লোকটা। খুলে গেল তালা। টান দিয়ে দরজাটা খুলে ফেলল সে। কোঁচকানো চামড়াওয়ালা আঙুল দিয়ে আবার বেরোনোর ইশারা করল লোকটা।

খাইছে! চাবি ছাড়াই তালা খুলে ফেলল! মুখ হাঁ হয়ে গেছে মুসার।

দেখাই যাক না ওর সঙ্গে গিয়ে, কিশোর বলল। মুক্তির পথ দেখিয়েও দিতে পারে। কিংবা নতুন কোনও বিপদের পথ। অতএব সাবধান।

সায় দেয়ার ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল তার দুই সহকারী।

জেল থেকে বেরিয়ে এল তিনজনে।

নিঃশব্দে আবার দরজা লাগিয়ে দিল ওদের ভৌতিক পথ প্রদর্শক। তালাটা তুলে লাগিয়ে দিল জায়গামত। তারপর হেঁটে গেল সিঁড়ির ধারে। উঠতে শুরু করল। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় কোন শব্দ হলো না।

অস্বাভাবিক নীরবতায় গা ছমছম করতে লাগল তিন গোয়েন্দার। মুসার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। তলপেট শিরশির করছে রবিনের। কিশোরের শিরদাঁড়া বেয়ে যেন বরফের পানি নামছে।

সিঁড়ির শেষ ধাপ টপকে লোকটা উঠে গেল ডেকে। এগিয়ে গেল জাহাজের সামনের দিকে।

তিন গোয়েন্দাও উঠল। দাঁড়িয়ে পড়ল সিঁড়ির দোরগোড়ায়। উঁকি মেরে দেখল কাছে-পিঠে কেউ আছে কিনা। অন্ধকারে শুধু টিমটিম করে লণ্ঠন জ্বলছে। খালি ডেক।

নিঃশব্দে ঘুরে দাঁড়াল রহস্যময় আগন্তুক। আবার ইশারা করল তিন গোয়েন্দাকে। অনুগতের মত লোকটার পেছন পেছন ডেক ধরে এগোল ওরা। বড় বড় ঢেউ ধাক্কা মারছে জাহাজের গায়ে। জাহাজের কিনার ঢেউয়ের দোলায় উঠছে আর নামছে। নিচে তাকাল ওরা। ঢেউগুলো মাথায় সাদা ফেনা নিয়ে যেন টগবগ করে ফুটছে। দূরের তারাশূন্য অন্ধকার আকাশ থেকে ভেসে এল নাম না জানা নিশাচর পাখির তীক্ষ্ণ চিৎকার।

থেমে দাঁড়াল ভূতুড়ে লোকটা। স্থির দৃষ্টিতে তাকাল তিন গোয়েন্দার দিকে। পলকহীন চাহনি।

এরপর কি করবে নোকটা ভাবল কিশোর। ধাক্কা মেরে ফেলে দেবে না তে!

আঙুল তুলে জাহাজের পেছন দিকটা দেখাল আগন্তুক। ওদিকটা অন্ধকার। চোখ কুচকে ওদিকে তাকিয়ে রইল তিন গোয়েন্দা। অস্পষ্ট ভাবে আরেকটা জাহাজ দেখা গেল। ওদের জাহাজটার পেছন পেছন আসছে।

রহস্যময় আগন্তুক সাগরের দিকে ইশারা করল। তারপর জাহাজটা দেখাল।

লোকটা কি বলতে চাইছে বুঝে ফেলল মুসা। ও বলছে আমরা যেন সাঁতার কেটে ওই জাহাজে উঠে পড়ি। জাহাজটা কাছেই আছে। চলো, সাগরে নেমে পড়ি। রেলিং বেয়ে উঠে পড়ল সে, ডাইভ দেবে পানিতে।

ওর হাত ধরে ফেলল কিশোর। দাঁড়াও। দাঁড়াও। লোকটা সত্যি এটাই বোঝাতে চেয়েছে কিনা সে-ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নিই আগে।

লোকটার দিকে ঘুরল ওরা। কিন্তু অদৃশ্য হয়ে গেছে আগন্তক! বোকা বনে গেল ওরা। আবার ঘুরে তাকাল পেছন দিকে। অন্য জাহাজটাকেও দেখা যাচ্ছে না আর।

ভীষণ অবাক হয়ে গেল ওরা।

দেখার জন্যে রেলিঙে উঠেছিল মুসা, নেমে এল সেখান থেকে।

সত্যি কি এ সব আমাদের চোখের সামনে ঘটছে? জিজ্ঞেস করল সে। নাকি দৃষ্টি বিভ্রমের শিকার হচ্ছি?

জানি না, জবাব দিল কিশোর।

এমন সময় পেছন থেকে কে যেন কথা বলে উঠল, বড় বেশি ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছ তোমরা।

পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা।

বাফারকে দেখতে পেল! চেহারায় উদ্বেগ। আমি হুইল হাউজের ডিউটিতে ছিলাম, জানাল সে। তাই তোমাদের দেখে ফেলেছি। জেলখানা থেকে কিভাবে বেরিয়ে এলে বুঝতে পারছি না। ধরা পড়লে কপালে কিন্তু সত্যি খারাবি আছে তোমাদের।

বোকা বোকা গলায় জানতে চাইল মুসা, নাবিক লোকটা কোথায় গেল দেখেছ?

নাবিক? তোমাদের দুজনকে ছাড়া ডেকে তো আর কাউকে চোখে পড়েনি আমার।

আর যে জাহাজটা আমাদের পিছু নিয়ে আসছিল ওটা? প্রশ্ন করল কিশোর।

এমন ভাবে ওদের দিকে তাকাল বাফার, যেন ওরা পাগল হয়ে গেছে। এদিকে জাহাজ! তোমাদের উল্টোপাল্টা কথাবার্তা শুনে এখন আমারই পাগল হওয়ার জোগাড় হয়েছে।…•াও, নিচে গিয়ে বিশ্রাম নাও। যে কোন সময় ডিউটি দিতে চলে আসতে পারে পুকার। তার চোখে পড়ে গেলে ভীষণ বিপদ হবে।

চলে গেল বাফার।

জেলখানায় ফিরে এল আবার তিন গোয়েন্দা। দরজাটা লাগিয়ে দিল কিশোর। দরজা বন্ধ হতে তালাটাও আপনা-আপনি লেগে গেল।

দরজাটাও দেখছি ভূতুড়ে! বিড়বিড় করল কিশোর।

যে যার বাঙ্কে শুয়ে পড়ল ওরা। ভাবছে একের পর এক ঘটে যাওয়া অদ্ভুত ঘটনাগুলো নিয়ে। বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছে।

রবিন কথা বলল প্রথম। নাবিকটা প্রেতাত্মা জাতীয় কিছু হতে পারে।

শিউড়ে উঠল মুসা। ভূতুড়ে জাহাজে প্রেতাত্মা! ভয়ঙ্কর ব্যাপার।

বলা নেই কওয়া নেই, কড়াৎ করে বাজ পড়ল কোথাও। জাহাজটা দুলতে শুরু করল ভীষণ ভাবে। ডেক থেকে ভেসে এল চিৎকার-চেঁচামেচি।

পুকার নেমে এল নিচে। চেঁচিয়ে বলল, ঝড় শুরু হয়েছে। ডেকে চলে এসো সবাই। জেলখানার দরজা খুলে দিল সে। যাও, ডেকে যাও, জলদি। সবাইকেই দরকার।

দৌড়ে চলে গেল পুকার।

ঘুমানোর ঘরে ছুটে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। যার যার বাঙ্কের কাছে রাখা বর্ষাতি, মাথায় সাউথ ওয়েস্টার আর পায়ে রাবার বুট গলিয়ে উঠে এল ওপরে।

আলকাতরার মত কালো আকাশ। মুষলধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই সাথে চলছে গুড়ুম গুডুম বজ্রপাত। প্রবল বাতাসে বিশাল ঢেউ উঠছে সাগরে। ঢেউয়ের আঘাতে থরথর করে কাঁপছে জাহাজ। ঢেউ ভেঙে পড়ছে গলুইয়ের ওপর দিয়ে। ভাসিয়ে দিচ্ছে ডেক।

মুখের সামনে দুই হাত জড় করে ধরে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে ক্যাপ্টেন নাইল। হুকুমের পর হুকুম দিয়ে চলেছে নাবিকদের। ঝটপট পাল গুটিয়ে ফেলল কয়েকজন নাবিক। আর কয়েকজন নিচে নামার গর্তের মুখের ঢাকনা আটকে দিল পেরেক ঠকে, যাতে ভেতরে পানি ঢুকতে না পারে। অনেকেই বাতাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে রেলিং ধরে ধরে জাহাজের সামনের দিক থেকে পেছনে যাবার চেষ্টা করছে।

পুকার এসে জানাল, জাহাজের খোলে ফুটো হয়ে গেছে।

এই ছেলেগুলোকে নিয়ে যাও, তিন গোয়েন্দাকে দেখিয়ে বলল ক্যাপ্টেন। ফুটো মেরামত করুক।

 ফার্স্ট মেটের সঙ্গে দেখতে গেল ওরা। দেখল খোলের একটা তক্তা ভেঙে গেছে। পানি ঢুকছে হুড়মুড় করে। মেঝের কয়েক ইঞ্চি ইতিমধ্যেই ডুবে গেছে পানিতে।

কিশোর পাশা, লকার থেকে পাম্পটা নিয়ে এসো, হুকুম করল পুকার। কোনার ওই ব্যারেলে পাম্প করে পানি ফেলো তুমি আর রবিন। মুসা আমান, আমার সঙ্গে এসো। ফুটো মেরামত করতে হবে।

যন্ত্রপাতি রাখার একটা বাক্স নিয়ে এসে ফুটোর কাছে ফেলল পুকার। এক টুকরো তক্তা নিয়ে ফুটোর ওপর চেপে ধরল। বাক্স থেকে হাতুড়ি বের করে পেরেক ঠকে তক্তাটা আটকে দিতে শুরু করল মুসা; দু হাতে দ্রুত কাজ করছে সে। একেক বাড়িতে একেকটা করে পেরেক বসিয়ে দিচ্ছে তক্তায়।

দেখতে দেখতে ফুটোটা বন্ধ করে ফেলল দুজনে মিলে। খোলে পানি ঢোকা বন্ধ হলো।

গুড! মুসার প্রশংসা না করে পারল না পুকার।

ওদিকে খোলের লকার থেকে পাম্প নিয়ে এসেছে কিশোর। ছোট, হস্ত চালিত যন্ত্র। অনেক পুরানো মডেল। টিউবওয়েলের হাতলের মত হাতল। সেটাকে ওপরে-নিচে করে পাম্প করতে হয়। এ জিনিস এর আগেও দেখেছে সে, তবে রকি বীচ মিউজিয়ামে। পাম্পের সঙ্গে হোস পাইপ যুক্ত করে পানি সেচতে শুরু করল সে। সেচা পানি ফেলতে লাগল খালি ব্যারেলে।

অল্পক্ষণের মধ্যে ভরে গেল একটা ব্যারেল। দ্বিতীয় আরেকটা ব্যারেলে পাইপের মুখ ঢোকাল কিলোর। ওকে সাহায্য করছে রবিন। এই ব্যারেলটাও কানায় কানায় ভরে গেল। মেঝের পানিও শেষ।  

ভালই তো দেখালে, পুকার বলল। ঠিক আছে, যাও এবার। ওপরে যাও। ওখানে যারা আছে তাদের সঙ্গে হাত লাগাওগে।

ডেকে উঠে এল তিন গোয়ে দা। লক্ষ করল ঝড়ের বেগ কমে গেছে অনেক। থেমে গেছে বৃষ্টি, বাতাসের তীব্রতা কমছে। ঢেউয়ের মাতামাতিটাও আর আগের মত নেই।

বড় বাঁচা বেঁচে গেছি, নাবিকদের বলল ক্যাপ্টেন নাইল। তবে ক্ষতিটা কম করেনি। জাহাজের যে সব জায়গায় ক্ষতি হয়েছে, মেরামত করে ফেলে।

বৃষ্টি নেই। অকারণে ভারী বর্ষাতি আর গায়ে চাপিয়ে রাখার কোন মানে হয় না। খুলে রেখে এল তিন গোয়েন্দা। দেখল, ঝড়ে জাহাজের ক্ষতি হওয়া জায়গাগুলো মেরামত করে ফেলেছে নাবিকেরা। মূল মাস্তুলের পালের একটা দড়ি ছুটে গেছে। ওপরে উঠে সেটা লাগানোর চেষ্টা করছে একজন নাবিক।

কিশোরের দিকে তাকাল ক্যাপ্টেন নাইল। কিশোর পাশা, আড়কাঠের উল্টো দিকে উঠে যাও তো। ওকে সাহায্য করো।

মাস্তুলের সাথে লাগানো সরু সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল কিশোর। আড়কাঠে চড়ে বসল। লোকটাকে চিনতে পারল এতক্ষণে। ল্যাম্বার্ট।

ঠিকঠাক মত কাজ করবে বলে দিলাম, অবজ্ঞার ভঙ্গিতে কিশোরকে বলল ল্যাম্বার্ট। পালের দড়িটা ধরো। গিট দাও…ওই যে ওই জায়গাটায়।

জবাব দিল না কিশোর। ওর দিকের পালের প্রান্তটা পতপত করে উড়ছে বাতাসে। ওটাকে ধরতে হলে তাকে আড়কাঠের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে হাত লম্বা করে দিতে হবে। মাত্র কাপড়টা ধরেছে ও, এমন সময় পাল ধরে হ্যাঁচকা টান মারল ল্যাম্বার্ট।

ভারসাম্য হারাল কিশোর। আড়কাঠ থেকে পড়ে যাওয়ার জোগাড় হলো তার। আতঙ্কিত হয়ে পড়ল মুসা ও রবিন। ডেকের ওপর ছিটকে পড়তে যাচ্ছে কিশোর।

তবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ওরা, যখন দেখল শেষ মুহর্তে আড়কাঠটা ধরে ফেলেছে কিশোর। জাহাজের দুলুনির তালে তালে মালটাও দুলছে। কিশোরও ঝুলে থেকে দুলতে লাগল। তারপর শরীরের সমস্ত শক্তি জড় করে প্রাণপণ চেষ্টায় একটা পা রাখল আড়কাঠে। উঠে এল ওটার ওপর।

আপনি আমাকে ইচ্ছে করে ফেলে দিচ্ছিলেন। কঠোর কণ্ঠে বলে উঠল কিশোর।

খিকখিক করে হাসল ল্যাম্বার্ট। আমি ফেলব? আড়কাঠে বি ভাবে কাজ করতে হয় জানো না তুমি। তাই পড়ে গেছ।

জানি কি জানি না দেখাচ্ছি আপনাকে, ওকে চ্যালে করে বসল কিশোর। আপনার আগেই পাল খাটাব আমি।

কিছুদিন আগে কোস্ট গার্ড ট্রেনিং শিপে তার দুই সহকারী কাজ করে এসেছে কিশোর। জানে কি ভাবে পাল খাটাতে হয়। বাতাসে উড়তে থাকা পালের অংশটা থাবা দিয়ে ধরে ফেলল ও। ওটার ধাতব ফুটোয় চামড়ার ফালি ঢুকিয়ে দিল। ফালিটা গোল করে আড়কাঠের হুকের মধ্যে ঢোকাল। তারপর গিট দিয়ে দিল শক্ত করে, নাবিকরা যে ভাবে দেয়। ব্যস, হয়ে গেল পাল খাটানো।

কাজ শেষ করে মইয়ের কাছে চলে এল কিশোর। ল্যাম্বার্টের তখন শোচনীয় অবস্থা। কিশোর যখন মই বেয়ে ডেকে নেমে এসেছে, তখনও পাল নিয়ে যুদ্ধ করছে ল্যাম্বার্ট।

চমৎকার দেখিয়েছ, কিশোর পাশা, পুকার বলল। সে সবই দেখেছে। ল্যাম্বার্ট ভুল করেছে। ওর তুলনায় তুমি অনেক বেশি দক্ষ। এক নম্বরের তিমি শিকারী হতে পারবে তুমি।

মুচকি হাসল কিশোর। মুসা আর রবিনের কাছে সরে এসে ফিসফিস করে বলল, প্ল্যানটা কাজে লাগছে। অন্তত ফার্স্ট মেটের মন গলাতে পেরেছি। আশা করি আমাদের পক্ষ নিয়ে এখন ক্যাপ্টেনের কাছে কথা বলতে দ্বিধা করবে না। বলবে আমাদের সাগরে ছুঁড়ে ফেলা উচিত হবে না। কারণ আমরা কাজের লোক।

আমারও তাই ধারণা, নিচু গলায় বলল রবিন। তবে বিপদ নিশ্চয় কাটেনি এখনও আমাদের…

ক্যাপ্টেনের চিৎকারে থেমে গেল সে।

এই, এদিকে এসো, হাত নেড়ে ডাকল ক্যাপ্টেন।

 তাড়াহুড়া করে তার কাছে চলে এল রবিন।

যাও, ক্রোজ নেস্টে গিয়ে বসো, হুকুম দিল ক্যাপ্টেন। তাহিতির কাছাকাছি এসে পড়েছি মনে হচ্ছে। ডাঙা কত দূরে জানা দরকার। আন্দাজে চলতে গিয়ে পাহাড়ে ধাক্কা খেতে চাই না। তীক্ষ্ণ নজর রাখবে। প্রবাল প্রাচীরে ধাক্কা খেয়ে ডুবে মরতে চাই না।

নাবিকদের ভঙ্গিতে আই, আই, স্যার, বলে মূল মাস্তুলের দিকে ছুটল রবিন। মই বেয়ে উঠতে লাগল। আড়কাঠ আর মাস্তুলের সবচেয়ে ওপরের পাল পার হয়ে এল। মাস্তুলের মাথায় ঝোলানো একটা ঝুড়িতে উঠে বসল। এটাকেই বলে ক্রোজ নেস্ট। এখান থেকে সাগরের চতুর্দিকে নজর রাখা হয়। সাগরের অনেক দূর পর্যন্ত চোখে পড়ে।

তবে রাতের বেলা অন্ধকারে খুব বেশিদূর দৃষ্টি চলে না। ঝুড়িতে বসে চোখ টানটান করে রাখল সে। আবছা অন্ধকারে দেখার চেষ্টা করছে। জাহাজের দুলুনির, সঙ্গে সঙ্গে ঝুড়িটাও দুলছে। জাহাজ যখন কাত হচ্ছে, মাস্তুল কাত হচ্ছে, দুলতে দুলতে প্রায় পানির ওপর চলে আসছে তখন ঝুড়ি। জাহাজ সোজা হলেই আবার অনেক ওপরে উঠে যাচ্ছে। ভীষণ বেকায়দা এক অবস্থা। অনেক সময় কোনও নাবিককে শাস্তি দেবার জন্যেও অতিরিক্ত সময় এই ঝুড়িতে বসিয়ে রাখা হয়।

ঝুড়ির বেকায়দা আসন, সেই সঙ্গে নোনা পানি মেশানো ঝোড়ো বাতাসের প্রচণ্ড ঝাপটা। অস্থির লাগছে রবিনের। চোখ কড়কড় করছে।

আহোয়, নিচ থেকে ভেসে এল ক্যাপ্টেনের নাবিক-সুলভ হাঁক। কিছু দেখছ?

পানি ছাড়া আর কিছু তো দেখছি না, জবাব দিল রবিন। অন্ধকারে বেশি দূর নজরও যায় না।

 তাহিতির দেখা অবশ্যই মিলবে, চেঁচিয়ে বলল ক্যাপ্টেন। অন্ধকার হলেও। দেখার সঙ্গে সঙ্গে জানাবে আমাকে।

পাহারা দিতে লাগল রবিন। হঠাৎ রাতের আবছা পর্দা ভেদ করে কালো একটা কাঠামো ফুটে উঠতে শুরু করল। মনে হলো পানিতে ভেসে রয়েছে জিনিসটা।

নিশ্চয়ই ডাঙায় উত্তেজিত হয়ে উঠল রবিন। আহোয়। নিচে কেউ আছেন! ডেকের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল সে। ডাঙা দেখা যাচ্ছে। ডানে! ডানে!…জাহাজ ঘোরান!

ডেক থেকে ওর কথার প্রতিধ্বনি করল কিশোর, ডাঙা ডাঙা! জাহাজ ঘোরাতে বলছে।

সঙ্গে সঙ্গে আদেশ শোনা গেল ক্যাপ্টেনের। হুইল ধরেছে যে, তাকে বলছে জাহাজ ঘোরাতে।

ডানে ঘুরে গেল জাহাজ। ঢেউয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটতে লাগল।

 ঠিক সামনেই ডাঙা! চিৎকার করে জানাল রবিন। বায়ে ঘোরান এখন।

ওর কথারই পুনরাবৃত্তি করল ডেকে দাঁড়ানো কিশোর।

যে লোকটা হুইল ধরেছে, তাকে কি যেন বলতে শোনা গেল। ওপর থেকে রবিনের মনে হলো একা কুলাতে পারছি না এ রকম কিছু বলল লোকটা।

আদেশ দিল ক্যাপ্টেন, মুসা আমান, তুমি যাও, ওকে সাহায্য করোগে।

 আই আই, স্যার, বলে এক মুহূর্ত দেরি না করে দৌড় দিল মুসা।

ক্যাপ্টেন বলল, নাক বরাবর সোজা চলে। ডাঙার দিকে। পাল টানটান করো। গতি বাড়াও।

এ-কি পাগলামি! শুনে গা হিম হয়ে গেল কিশোরের। ক্যাপ্টেন কি আত্মহত্যা করতে চাইছে নাকি? জাহাজসুদ্ধ সবাইকে ডুবিয়ে মারতে চাইছে।

প্রচণ্ড বেগে ছুটতে শুরু করল জাহাজ। কালচে কাঠামোটা ভীতিকর গতিতে কাছে চলে আসছে। আরও কাছে যেতে বোঝা গেল, তাহিতির ভূখও নয় ওটা। সাগরের মাঝখানে প্রবালের দ্বীপ।

ভয়ানক গতিতে প্রবাল প্রাচীরে এসে ধাক্কা মারল জাহাজ। বিকট শব্দে ভেঙে পড়ল মূল মাল আছড়ে পড়ল দড়ি-দড়ার জঙ্গলের ওপর। ক্রোজ নেস্ট থেকে ছিটকে পড়ল রবিন। দড়ি আঁকড়ে ধরে পতন ঠেকাল কোনমতে। তবে পুরোপুরি বাঁচতে পারল না। দড়াম করে এসে পড়ল ডেকে, কিশোরের পাশে।

রবিন! রবিন! উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল কিশোর।

ভয় নেই, আমি ঠিকই আছি, জবাব এল রবিনের। ভয় পেয়েছিল হাড়গোড় একটাও আও থাকবে না। কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।

দৌড়ে এল মুসা। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, শয়তানিটা ইচ্ছে করে করেছে ক্যাপ্টেন। আমাদের ঝামেলায় ফেলার জন্যে। বাফার বলেছে আমাকে…

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই শোনা গেল ক্যাপ্টেনের গর্জন। গালি দিয়ে বলল, সর্বনাশ করেছিস তোরা! আমার জাহাজের বারোটা বাজিয়েছিস! তোদের আমি ছাড়ব না!

কিন্তু আমি তো ঠিক মতই জানিয়েছি, কোন দিকে যেতে হবে… প্রতিবাদ করতে গেল রবিন।

কিশোরও বোঝানোর চেষ্টা করল ক্যাপ্টেনকে।

কিন্তু কে শোনে কার কথা। গর্জন থামল না ক্যাপ্টেনের। একগুয়ে ভঙ্গিতে বলতে থাকল, তোরা আমার জাহাজ ধ্বংস করেছিস! তোরা বিদ্রোহী! তোদের আমি ছাড়ব না! নাবিকদের দিকে ফিরে আদেশ দিল, ওদের সাগরে ফেলে দাও। হাঙরে ছিঁড়ে খাক।

বিকৃত আনন্দে চিৎকার করতে করতে ছুটে এল কয়েকজন নাবিক। ল্যাম্বার্টের দলের লোক এরা। এদের মধ্যে ল্যাম্বার্টকেও দেখা গেল। সবাই মিলে জাপটে ধরল তিন গোয়েন্দাকে। ঠেলা-ধাক্কা মেরে নিয়ে চলল রেলিং-এর ধারে।

হঠাৎ একটা অদ্ভুত ছায়ামূর্তিকে দেখা গেল এ সময়। এসে দাঁড়াল ওদের পাশে। সেই লোকটা, যে ওদেরকে জেলখানা থেকে বের করে এনেছিল। তারপর রহস্যময় ভাবে উধাও হয়ে গিয়েছিল ডেক থেকে।

ভাবলেশহীন মুখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে লোকটা। অদ্ভুত একটা কাণ্ড করল। আঙুল তুলে নাবিকদের ইঙ্গিতে বোঝাতে লাগল কোন দিকে ফেলতে হবে বন্দিদের।

চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে তিন গোয়েন্দাকে পানিতে ছুঁড়ে ফেলল নাবিকেরা।

পানিতে পড়ার জন্যে তৈরি হয়েছিল গোয়েন্দা। কিন্তু পড়ল কাঠের মেঝেতে। হতবুদ্ধি হয়ে গেল তিনজনেই। উঠে বসল। তাকাতে লাগল চারপাশে।

যখন দেখল, নিজেদের মোটরবোটেই রয়েছে, বাকহারা হয়ে গেল একেবারে। ভূতুড়ে জাহাজ অ্যাড্রিয়াটিক পাঞ্চের চিহ্নও নেই কোথাও। দিগন্তে ভোরের আভাস। ভালমত খেয়াল করে দেখে বুঝল, রকি বীচের কাছাকাছিই রয়েছে ওরা।

বোকার মত পরস্পরের মুখের দিকে তাকাতে লাগল তিনজনে।

বোটের ইঞ্জিনের কাছেই বসে আছে মুসা। ইগনিশনে মোচড় দিল। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল মোটর। কিশোর দেখল, রেডিওটাও ঠিক মতই কাজ করছে।

অকেজো জিনিস হঠাৎ করেই ঠিক হয়ে গেল কি ভাবে? বিড়বিড় করল কিশোর।

অতি সহজ জবাব, বলে উঠল মুসা। কাল সন্ধ্যায় ভূতে নষ্ট করে দিয়েছিল এগুলো। সকাল বেলা ভূতের আসর কেটে যেতেই আবার ঠিক হয়ে গেছে সব।

সত্যিই কি পুরো একটা রাত একটা ভূতুড়ে জাহাজে কাটিয়ে এলাম? এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না রবিন।

এখনও কি সন্দেহ আছে তাতে? ভুরু নাচাল মুসা।

আসলে স্বপ্ন দেখেছি, ভূতের জাহাজ, এ কথাটা মানতে রাজি না কিশোর। ১৮৫০ সালের একটা তিমি শিকারী জাহাজের স্বপ্ন।

দুঃস্বপ্ন, শুধরে দিল রবিন।

তিনজনেই কি দুঃস্বপ্ন দেখলাম? মুসার প্রশ্ন। একই সময়ে? অবিকল এক স্বপ্ন?

তার এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না কিশোর কিংবা রবিন।

<

Super User